চারদিকে পুজো-পুজো গন্ধ। মহালয়ার ঠিক পরদিন আমি তখন গুটি গুটি পায়ে পুজো মণ্ডপের দিকে এগোচ্ছি। দেখি নিমাইদা খুব মন দিয়ে ছবি আঁকছে পুজো মণ্ডপের ঠিক পাশের দেয়ালটাতে। নিমাইদা মানে নিমাই পালিত, মানে যাঁর অবয়ব ভাবতে গেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পরনে সামান্য অপরিষ্কার পায়জামা-পাঞ্জাবি, গালে না-কামানো কয়েক দিনের দাড়ি এবং ঠোঁটে বেশির ভাগ সময়েই একটা জ্বলন্ত বিড়ি। শেষ বছর তিনেক ধরে দেখেছি মহালয়ার ঠিক পরেই নিমাইদার ডাক পড়ে এই ছবি আঁকার জন্য আর নিমাইদাও মহানন্দে তার “কাজে” লেগে যায়। নিমাইদাকে দেখলাম — এবারও — একমনে ছবি এঁকে চলেছে।
তো ঠোঁটে বিড়ি, হাতে তুলি সেই নিমাইদা সেদিন একটা কার্টুন চরিত্র আঁকতে আঁকতেই আড় চোখে আমাকে সামান্য মেপে নিয়ে — কী জানি কেন বলল, কী রে ঋতুপর্ণা, তোর চোখ-মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে তোরও একটু তুলি চালাতে ইচ্ছে করছে। হবে নাকি দুই-এক টান। লক্ষ্য করলাম নিমাইদার ঠোঁটে একটা দুষ্টু হাসি ঘোরাফেরা করছে। খেয়াল করে দেখেছি, নিমাইদাই আমাকে পুরো নাম ধরে ডাকে। বাকি পরিচিত লোকজন আমার নামটাকে ছোট করে নিয়ে “ঋতু” ডাকতেই পছন্দ করে। এ ব্যাপারে নিমাইদাকে প্রশ্ন করলে উত্তর পেয়েছি, ঋতু ডাকব কেন? এত সুন্দর নামটা তোর, তাকে ভাঙতে যাব কেন? নিমাইদার অমন যুক্তি শুনে আমিও “নাম ভাঙানোর” ব্যাপারে আর উৎসাহ দেখাইনি।
তুলি চালানোর ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থেই একদম আনাড়ি আমার সেদিন সম্ভবত “পুজো-পুজো” গন্ধে প্ররোচিত হয়ে সত্যিই একটু তুলি চালাতে ইচ্ছে করছিল। তবে নিমাইদা যে আমার মনের ইচ্ছেটা এভাবে ধরে ফেলবে এটা কিন্তু আমার ভাবনাতে একদমই আসেনি। তাই হঠাৎ প্রশ্নের মুখে পড়ে কিছুটা থতমত খেয়ে বলেই ফেললাম, ইয়ে, হ্যাঁ, ধুর কী যে বলো তুমি নিমাইদা...আমি আঁকার কী বুঝি...
নিমাইদা আমার উত্তর শুনে কী বুঝল কে জানে! আমার দিকে না তাকিয়েই দাঁতে একটা জ্বলন্ত বিড়ি চেপে ধরে বলল, ঋতুপর্ণা, শুনেছি, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ছাত্রদের হাতে খবরের কাগজ আর কাঁচি ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, যেমন খুশি কাটো। পরে ওই কাটা টুকরোগুলো থেকেই শুনেছি তিনি এক-একটা দারুণ ছবির জন্ম দিতেন। তুই এক কাজ কর — বড় ঝাঁকড়া তুলিটা নিয়ে তোর যে রংটা পছন্দ তাতে ডুবিয়ে কিছুটা রং দেয়ালে বিলিয়ে দে। দেখি তোর আনাড়ি চলন থেকে আমি কোনও ছবি বের করে আনতে পারি কি না।
নিমাইদার মুখে “বিলিয়ে দে” শোনার পর আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে আমি মহা উৎসাহে নিমাইদা বর্ণিত “বড় ঝাঁকড়া তুলিটা” বেশ করে হলুদ রঙে চুবিয়ে দেয়ালে রং “বিলিয়ে” দিলাম। হলুদ রং কেন বেছেছিলাম সেটা আমি নিজেও জানি না। হতে পারে রংটা উজ্জ্বল বলে চোখে পড়েছিল, হতে পারে অনেকটা হলুদ রং গোলা নাগালেই ছিল বলে আমি হলুদাসক্ত হয়েছিলাম।
বিলিয়ে তো দিলাম — কিন্তু আমার সেই “বিলিয়ে” দেওয়া দেখে তো নিমাইদার চক্ষু চড়কগাছ। দ্রুত বিড়িতে শেষ সুখ টান দিয়ে আমার “হলুদ ডোরা”র কাছে দ্রুত পৌঁছে নিমাইদা আমার চোখে চোখ রাখল। আমি চুপ। নিমাইদাও চুপ। কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভঙ্গ করে নিমাইদা বলল, ঋতুপর্ণা, তুই কিন্তু বেশ কঠিন একটা অঙ্কের মধ্যে আমাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিস। দেখি, কী করা যায়।
পরের মিনিট খানেকের মধ্যেই নিমাইদা — মুখে সদ্য ধরানো বিড়ি — ফের এক মগ্ন শিল্পী। বলতে গেলাম, “নিমাইদা, এত বিড়ি খেও না।” মনে হল আমার কথাগুলো নিমাইদার কানেই যায়নি। সে তখন একমনে আমার আনাড়ি হাতের “যামিনী টান”কে বুঝে নেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এভাবে মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। আমার তখন উৎকন্ঠায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। এরপর হঠাৎ করেই নিমাইদা তার নীরবতা ভগ্ন করে আমার দিকে ফিরে আলতো হাসল। ওই হাসি দেখে আমি কিছুটা সাহস পেয়েই বললাম, নিমাইদা, একদম কেলো করে দিয়েছি — নাগো?
আমার কথা শুনে নিমাইদা ফের হাসল। বলল, ঋতুপর্ণা, নো চিন্তা — আমি সামলে নেব তোর এই হলুদ বাহিনীর আক্রমণ। তুই এক কাজ কর, আমাকে একটু রং গোলায় সাহায্য কর।
পরের কয়েক মিনিট ছিল আমার স্তম্ভিত হবার পালা। আমি দেখলাম নিমাইদার তুলি আমার “হলুদ বাহিনী”র উপর সুকৌশলে লাল রং টেনে সেটাকে আগুনের রূপ দিল, তারপর সেই আগুনের নিচে তুলির নিপুণ টানে ফুটে উঠল বেশ কয়েকটা কুঁড়ে ঘর।
“কাজ” শেষ করে নিমাইদা হাসিমুখে আমার দিকে ফিরে বলল, কেমন দিলাম ঋতুপর্ণা? উত্তেজিত আমি উত্তর দিলাম, ফাটাফাটি, জাস্ট ফাটাফাটি। তুসি গ্রেট হো নিমাইদা। অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে পাঞ্জাবি বুলি বেরিয়ে এল।
— তুই এখনই এত উত্তেজিত হোস না ঋতুপর্ণা — কাজ এখনও বাকি আছে। নিমাইদা ফের হাতে তুলি তুলে নিতে নিতে বলে।
— বাকি আছে? কেন, এটাই তো বেশ সুন্দর ছবি হয়েছে।
— আরে বোকা, পুজো মণ্ডপের পাশে কুঁড়ে ঘরে আগুন লেগেছে এমন ছবি রাখা যায় নাকি?
— তবে কী হবে? আমি চিন্তিত গলায় বলি।
— সমস্যা নেই। তুই শুধু দেখে যা আমি কী করি। নিমাইদা নিরুত্তাপ।
পরের পনের মিনিট নিমাইদার সেই “আমি কী করি” একটু একটু করে ফুটে উঠল। দেখলাম সেই জ্বলন্ত কুঁড়ে ঘরের গায়ে-গায়েই নিমাইদার আশ্চর্য তুলি জন্ম দিয়েছে একটা অল্প বয়েসী মেয়ের, যে সব ছেড়ে ওই জ্বলন্ত কুঁড়ে ঘর থেকে কিছু পড়ার বই দু’হাতে আগলে ধরে বেরিয়ে আসছে।
এবারে কিন্তু ছবিটা আমার খারাপ লাগতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল “পাবলিক”কে খাওয়ানোর জন্যেই ছবিটাতে প্রায় জোর করেই মেয়েটাকে আনা হয়েছে। আমার সেই খারাপ লাগার কথা নিমাইদাকে বলার আগেই আমার পিছন থেকে কেউ একজন বলল, “কী নিমাই, ছবি আঁকা কেমন চলছে?” পিছন ফিরে দেখি, পুজোকমিটির সম্পাদক রঞ্জনদা হাজির। এই রঞ্জনদাকে আমি আবার বেজায় অপছন্দ করি। গত কয়েক বছর ধরে “নির্মাণ শিল্প”র সঙ্গে যুক্ত থেকে রঞ্জনদা এখন “বড়লোক” এবং পাড়ার সব অনুষ্ঠানের ঘোষিত এবং অঘোষিত মাতব্বরও বটে।
যেমনটা ভেবেছিলাম — নিমাইদার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে “মাতব্বর” “কার্টুন” পেরিয়ে সটান হাজির হল নিমাইদার সদ্য আঁকা ছবিটার সামনে। কিছুক্ষণ বিজ্ঞের মতো সে ছবিতে চোখ বুলিয়ে রঞ্জনদা বলল, আহা, কী ছবি এঁকেছ নিমাই। আহা, এখনই এই ছবির একটা নাম দেওয়া দরকার হে নিমাই।
নিমাইদা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই রঞ্জনদা এবার আমাকে বলল, ঋতু, যা তো একটু অতনুদাকে ডেকে আন তো, অতনুদাই পারবে এ ছবির নামকরণ করতে।
আমি ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। রঞ্জনদাকে দেখেছি পয়সা হবার পর থেকে খালি একে-ওকে নির্দেশ দেয় — এটা কর, ওটা কর। আমার তো মনে হয় রঞ্জনদাকে যদি বলা হয় যে, দাদা, আপনার একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি লাগবে — রঞ্জনদা তখনও হয়ত আমাদের মতো কাউকে ডেকে বলবে, যা তো বাবা ষ্টুডিওতে গিয়ে আমার হয়ে ছবিটা তুলে আন তো!
তবে রঞ্জনদা যাঁকে ডেকে আনতে বললেন সেই অতনু ব্যানার্জী সত্যিই যোগ্য লোক। অতনুদা কলকাতার নামি কলেজে বাংলা পড়ান। ওনার প্রচুর প্রবন্ধ নামি-দামি সংবাদপত্রগুলোতে মুখ দেখায় আর অতনুদার বাড়িটাও পুজো মণ্ডপের খুব কাছে। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই অতনুদাকে হাজির করানো গেল। এবং হাজির হয়েই অতনুদা হাসিমুখে বেশ হালকা চালে রঞ্জনদাকে বলল, কী হে রঞ্জন, দেবীপক্ষের গোড়াতেই এত ডাকাডাকি কেন?
আমি জানি, রঞ্জনদার ডাকে সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের এই দৌড়ে আসার পিছনে আসলে একটা ভয় কাজ করে — এ ক্ষেত্রে দেবীপক্ষের গোড়ায় — হতে পারে অতনুদার মাথায় হালকা করে “বলিদান” শব্দটাও কাজ করছিল। তাই এত দ্রুত পৌছে যাওয়া মণ্ডপ চত্বরে।
অতনুদা হাজির হবার পর দেখলাম আমি তো বটেই — এমনকি নিমাইদাও প্রায় ব্রাত্য হয়ে গেছে। রঞ্জনদা “খুব দায়িত্ব” নিয়ে অতনুদাকে নিমাইদার সদ্য আঁকা ছবিটার সামনে নিয়ে গিয়ে বলল, অতনুদা, এই ছবিটা দেখুন। আহা, কী ছবি! এই ছবিটার একটা নামকরণের জন্যেই আপনাকে ডাকা।
অতনুদা কিন্তু নিমাইদার উপস্থিতিটা মনে রেখেই বললেন, সত্যি নিমাই, কী ছবি এঁকেছ! এ ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তা অতনুদা বলেই সম্ভবত এবার নিমাইদা কথা বলার সুযোগ পেল এবং বলে দিল, অতনুদা, ছবিটা আসলে আমি আর ঋতুপর্ণা দু’জনে মিলে এঁকেছি।
নিমাইদার কথা শুনে কানটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। লোকটা বলে কী! গোদা-গোদা কয়েকটা হলুদ দাগ টেনেছি দেয়ালে — তার জন্য একেবারে গৌরবে বহুবচন — “যৌথ খামার”। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আরে না, না, আমি নিমাইদাকে একটু...
এবারে রঞ্জনদা আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল, ঋতু, এবার তোর ফার্ষ্ট ইয়ার না?
বোঝো! রঞ্জনদা নিমেষেই কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে এল। ভিতরের বিরক্তি চেপেই উত্তর দিলাম, না, সেকেন্ড ইয়ার। আমার উত্তর শুনে রঞ্জনদা বলল, ও হ্যাঁ, তাই তো। ফার্ষ্ট ইয়ার তো গত বছর ছিল।
রঞ্জনদার কথা শুনে যখন হাসব না কাঁদব ভাবছি — শুনলাম অতনুদা বলছেন, হ্যাঁ, নাম পেয়ে গেছি ছবিটার।
— পেয়ে গেছেন? জানতাম আপনিই পারবেন। তা, কী নাম দিলেন দাদা? রঞ্জনদা বাঁ হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে সামনের একটা দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে জিজ্ঞেস করল।
— একটা কাগজ দাও লিখে দিচ্ছি।
এবার রঞ্জনদাকে, “এই ঋতু যা তো কাগজ আর পেন নিয়ে আয়” বলার সুযোগ না দিয়ে আমিই বললাম অতনুদা, আপনি বানানটা বলতে থাকুন — নিমাইদা তুলি দিয়ে সেটা ছবির নিচে সরাসরি লিখে দিক।
“সেই ভালো, সেই ভালো” — এবারও রঞ্জনদাই লীডার।
অতনুদার বলা বানান অনুযায়ী নিমাইদা লিখল, “বই-তরণী”। রঞ্জনদা যথারীতি বুঝে বা না বুঝে বেজায় উচ্ছ্বসিত — বলে ফেলল, আহা, যেমন ছবি, তেমনই তার নামকরণ। আহা, আহা...
আমি হেসে অতনুদাকে বললাম, নামকরণে বেশ একটা “শিব্রাম” স্টাইল পেলাম। আমার কথা শুনে অতনুদাও হাসলেন। বললেন, একদম ঠিক বলেছ ঋতু।
অতনুদার কথা শেষ হওয়া মাত্র রঞ্জনদাও হেসে বলল, হ্যাঁ, ঋতু একদম ঠিক বলেছে। আসলে কী জানেন তো অতনুদা, আজ সকাল থেকেই আমার “সিক্স” ইন্দ্রিয় বলছিল যে, আজ দারুণ কিছু একটা ঘটবে। রঞ্জনদার কথা শুনে অতনুদা আড় চোখে আমাকে একবার দেখে নিয়ে ফের হাসলেন। কী আশ্চর্য, রঞ্জনদাও দেখলাম হাসছে।
রঞ্জনদা আর অতনুদা চলে যাবার পর আমি নিমাইদাকে বললাম, যাই বল নিমাইদা আমার কিন্তু ছবিটা আগেই বেশি ভালো লাগছিল। তুমি শুধু শুধু নিরীহ আবেগে সুড়সুড়ি দেবার জন্য ছবিতে ওই অল্প বয়েসী মেয়েটা আর বইগুলোকে না আনলেই পারতে।
এতক্ষণ রঞ্জনদা আর অতনুদার আড়ালে থাকা নিমাইদা আমার কথা শুনে একটু ক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঋতুপর্ণা, আমি বড় সাধারণ জন। তবু বলি ওই মেয়েটা আসলে আমার কল্পনা ফুঁড়ে উঠে এসেছে। একজন শিল্পী যা দেখেন, সেটা যতটা আঁকেন — তার থেকে অনেক বেশি আঁকেন তাঁর কল্পনার উপর ভর করে।
— কেন?
— কারণ একমাত্র কল্পনার উপরেই একজন শিল্পীর একচেটিয়া অধিকার আছে। তবে হ্যাঁ, সেই কল্পনার দৃষ্টিটাও কিন্তু শিল্পী-সুলভ হতে হবে। সেখানে মোটা দাগের ভাবনা-চিন্তার কোনও জায়গা নেই। সে যাক, অনেক বকে ফেললাম। আজ চলি রে।
নিমাইদা আর একটাও কথা না বলে তাঁর “জিনিসপত্র” গুছিয়ে হাঁটা দিল।
নবমীর দিন তখন পুজো মণ্ডপের পাশে আলাদা পান্ডেল করে পাড়ার কচি-কাঁচাদের নিয়ে বিচিত্রানুষ্ঠান বেশ জমে উঠেছে। হঠাৎ দেখি মাঝের সামান্য বিরতির সময়ে রঞ্জনদা হাজির অনুষ্ঠান মঞ্চে। এরপর তাঁর ঘোষণা, আমরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে, পুজো কমিটি ঠিক করেছে নিমাই পালিতকে তাঁর অসাধারণ ছবি বই-তরণীর জন্য একটা “মোমেন্টো” দেবে।
রঞ্জনদার ঘোষণা শুনে আমার ঠিক পাশে দাঁড়ানো অতনুদা দেখলাম বিড়বিড় করছে, ওরে, ওটা “মেমেন্টো”, মোমেন্টো নয়। যার জন্য ওই কথাগুলো বলা, সে দেখা গেল তখন হাঁক পাড়ছে, কই নিমাই কোথায় গেলে গো...।
নিমাইদাকে পাওয়া গেল এবং সে মঞ্চে উঠে মেমেন্টো নেবার আগে বলে বসল, আমি এই ছবিটা একা আঁকিনি, এ ছবি আঁকায় আমাকে সঙ্গ দিয়েছে ঋতুপর্ণা। আমার অনুরোধ, ঋতুপর্ণাকেও মঞ্চে ডেকে নেওয়া হোক।
নিমাইদা এমন একটা কাণ্ড ঘটাতে পারে এটা আমি ভাবতেই পারিনি। সামান্য ধাতস্থ হয়েই আমি তখন সবে এক পা-দু পা করে অদৃশ্য হবার চেষ্টা করছি — অতনুদা আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে বললেন, এই মেয়ে, পালালে হবে? যাও সোজা স্টেজে উঠে যাও।
স্টেজে উঠলাম। লজ্জায় বেগুনি হয়ে যাবার ইমোটিকনের কথা ভাবতে ভাবতে নিমাইদার সঙ্গে ছবি তোলার পোজ দিলাম। এবং মনে মনে “হে অনুষ্ঠান মঞ্চ দ্বিধা হও” বলতে বলতে একটু পরেই ফের এসে দাঁড়ালাম অতনুদার পাশে।
মিনিট দুয়েক পরে ওদিকে কচি-কাঁচারা তখন গাইছে, “আমরা শুনেছি ওই/ ‘মা ভৈঃ মা ভৈঃ মা ভৈ”। অতনুদা আবেগে গাঢ় হতে হতে বললেন, আহা, তাসের দেশ, আহা, রবীন্দ্রনাথ!
খেয়াল করিনি রঞ্জনদা কখন এসে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। অতনুদার কথা শেষ হওয়া মাত্র এবার রঞ্জনদা, হ্যাঁ, “তাসের দোষ”! আমিও শুনেছি আগে। বড্ড ভালো।
রঞ্জনদার কথা শুনে আমি তখন মনে মনে গাইছি, “বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও...”। অতনুদাও নিশ্চয়ই...!
দুর্গাপুজো গেল, কালীপুজো এল। কালীপুজোর দিন দুয়েক পর পাড়ার গলিতে আমি ফের নিমাইদার মুখোমুখি। নিমাইদা মাথা নিচু করে কিছু একটা চিন্তা করতে করতে আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার মুখে আমি বললাম, কী ব্যাপার নিমাইদা, এত হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছ?
আমার কথা শুনে থমকে দাঁড়াল। তারপর একগাল হেসে বলল, ঋতুপর্ণা, তোর কথাই ভাবছিলাম।
নিমাইদার মুখে ওই “তোর কথাই ভাবছিলাম” শুনে আমি একটু চাপ খেয়ে গেলাম। তবে চোখে-মুখে তার কোনও চিহ্ন না রেখেই নিমাইদাকে বললাম, বলো কী, আমার কথা ভাবছিলে! কেন?
— ঋতুপর্ণা, আমি ভাবছি তোর একটা ছবি আঁকব। তেল রঙ। তোর একটা ছবি পাওয়া যাবে?
নিমাইদা আমার ছবি আঁকতে চায় শুনে ফের ঘেঁটে গেলাম। তবু ঠোঁটে একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললাম, আমার ছবি? সবাইকে ছেড়ে শেষে আমার ছবি কেন নিমাইদা?
— আসলে কী জানিস, সেদিন অমন আলটপকা হলুদ দাগ টানার পর তোর মুখের যা চেহারা হয়েছিল — আজকাল কিছু আঁকতে গেলেই সেই ভণিতাহীন, সরল মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সে জন্যেই ভাবছি তোর একটা ছবি আঁকব। আর আমি তেমন ভালো কোনও আঁকিয়েও নই যে তোকে দেখে-দেখেই ছবি এঁকে ফেলব — সে জন্যেই তোর একটা ছবি চাইছি। অবশ্য তোর আপত্তি থাকলে আলাদা কথা।
নিমাইদা একটানা বলে থামার পর আমি কেন জানি না একটা পোড়া গন্ধ টের পাওয়া শুরু করলাম। তবু নিছকই “ছবি” হওয়ার ইচ্ছেতেই কিনা জানি না — বলে ফেললাম, হ্যাঁ, দেব আমার ছবি। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
— কী, কী শর্ত বল। নিমাইদা দ্রুত বলে।
— ছবিতে শুধু আমার মুখটুকুই থাকবে, আর কিছু নয়। রাজী?
আমার কথা শুনে নিমাইদা একটু চুপ করে গেল। তারপর বলল, শুধু মুখ আঁকলে ছবিটা একটু অসম্পূর্ণ দেখাবে ঋতুপর্ণা। আমি ভাবছি ছবিটা তোর কাঁধ পর্যন্ত রাখব। ছবিতে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকবে তোর বিখ্যাত হাসি, গালে টোল — আর...
— আর? সন্দিগ্ধ আমি নিমাইদার কথা শেষ হবার আগেই জিজ্ঞেস করে ফেলি।
— আর ঠিক তোর বাঁ কাঁধ বরাবর এক জোড়া উজ্জ্বল তিল।
নিমাইদার কথা শেষ হওয়া মাত্র এবার আমি বেশ গলা তুলেই বলি, মানে? ওই তিল-জোড়া তুমি কোথায় পেলে?
— ওটা, ওটা আমার কল্পনা বলতে পারিস। শিল্পীর কল্পনা। শিল্পীর স্বাধীনতা। আর হ্যাঁ, ছবিটার ক্যাপশন হবে, “ঋতু পর না — আপন”।
নিমাইদার কথা শেষ হওয়া মাত্র আমার ভিতরে ভিতরে প্রবল অস্বস্তি শুরু হল। কারণ সত্যিই আমার বাঁ কাঁধে এক জোড়া তিল আছে, কিন্তু সে তিল জোড়া সহজে কারোর নজরে আসার কথা না। দৃশ্যত আমার পোশাকের আড়ালে থাকা এই জোড়া তিলের খবর নিমাইদা কী করে জানল সেটা ভেবেই আমি তখন দিশেহারা। একদিকে ওই ইঙ্গিতবাহী ক্যাপশন, অন্য দিকে “ব্রেকিং নিউজ”এর মতো এই “গোপন তিল সংবাদ” — জোড়া আবেগী আক্রমণে আমি তখন ভিতরে ভিতরে প্রায় বিধ্বস্ত।
বুঝতে পারছিলাম না নিমাইদার সামনে “তিল”এর কথাটা তুলব কী করে। বিষয়টা আক্ষরিক অর্থেই এত স্পর্শকাতর যে বেশ লজ্জা লাগছিল এবং বুঝতে পারছিলাম না প্রশ্নটা করা উচিত হবে কিনা। শেষ-মেষ মনের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে বলেই ফেললাম, নিমাইদা, ছবিটাতে তাহলে তুমি আমার বাঁ কাঁধে এক জোড়া তিল রাখতে চাইছ, তাই তো?
— হ্যাঁ, রাখতে চাইছি তো। তোর ভালো লেগেছে আইডিয়াটা?
নিমাইদার এই সটান, ভণিতাহীন উত্তর আমার সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। আমি বুঝতে পারছিলাম না — নিমাইদা আসলে অভিনয় করছে কিনা। তাই গলায় একটু ঝাঁঝ ঢেলেই প্রশ্ন করলাম, তুমি কি ওই তিলগুলো আঁকবে বলেই আমার ছবি আঁকতে চাইছ?
নিমাইদাকে দেখে মনে হল আমার শেষের কথাগুলো ওকে বেশ কিছুটা বিমর্ষ করে দিয়েছে। নিমাইদা মাথা নিচু করে বলল, আ-আ-মি ঠিক ওভাবে ভেবে দেখিনি ঋতুপর্ণা। ছবিটাকে আকর্ষণীয় করতে গিয়ে একটু কল্পনাবিলাসী হতে চেয়েছিলাম মাত্র। শিল্পীর সূক্ষ্ম কল্পনা বলতে পারিস।
— ছবিটা আর কোনওভাবে আকর্ষণীয় করার চিন্তা এল না তোমার মাথায়? যত আকর্ষণ খালি ওই কাঁধের তিলে? আমি ফের একটু জোরেই বললাম কথাগুলো।
— না রে ঋতুপর্ণা, ব্যাপারটা তা নয়। ছবি আঁকাটা আমার কাছে অনেকটা ধ্যান করার মতো। আমি সেদিন মনে মনে তোর ছবি আঁকার কথা ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে যেন দেখতে পেলাম তোর বাঁ-কাধে এক জোড়া তিল আছে। জাস্ট কল্পনা।
— চোখ বুজে দেখছ, নাকি খোলা চোখে উঁকি মেরে দেখেছ? তোমার লজ্জা করে না...।
রাগের চোটে আমি হয়ত আরও অনেক কিছু বলতাম, কিন্তু নিমাইদা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ঋতুপর্ণা, সত্যিই তোর বাঁ কাঁধে অমন এক জোড়া তিল আছে। ও-হো-হো-হো...। দ্যাখ, একেই বলে শিল্পীর কল্পনা। বিশ্বাস কর, এর মধ্যে কোনও নোংরামি নেই। প্লীজ, ঋতুপর্ণা, প্লীজ।
আমি ততক্ষণে “শিল্পীর কল্পনা” শুনে ভিতরে ভিতরে ঘামতে শুরু করেছি। বুঝতে পারছিলাম না, “শিল্পী” তার কল্পনার চোখে আর কী কী দেখতে পেয়েছে।
নিমাইদা দেখলাম তখনও শিশুর মতো একটানা বলে যাচ্ছে, ওহ্, ঋতুপর্ণা, আমি ভাবতেই পারছি না...এভাবে আমার কল্পনার সঙ্গে বাস্তব মিলে যাবে — আমি ভাবতেই পারিনি...
নিমাইদার ওই সারল্য ভরা উচ্ছ্বাস দেখে কেন জানি না বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল যে, সত্যিই ছবিটাতে ওই জোড়া তিলের আগমনের পিছনে শিল্পীর আবেগটাই আসল কারণ — এর পিছনে অন্য কোনও রহস্য বা নোংরামি নেই।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে নিমাইদা ফের বলল, এই যা, আমি তো শুধু আমার কথাই বলে যাচ্ছি। ঋতুপর্ণা, আমি জানি, তুই আমার উপর খুব রেগে গেছিস। ঠিক আছে, দরকার নেই ছবিটাকে কাঁধ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবার। তুই যেমনটা চেয়েছিস — ঠিক সেভাবেই আঁকব আমি। তবে হ্যাঁ, তোর হাসি আর গালে টোল নিয়ে কিন্তু তোর কোনও বারণ মানতে পারব না আমি।
শিশুর সারল্য ভরা, প্রায় ভণিতাহীন এমন একজন পুরুষের মুখোমুখি হয়ে কেন জানি না আমি ভিতরে ভিতরে এই প্রথম অন্য একটা “আমি”র অস্তিত্ব টের পাওয়া শুরু করলাম। মনে হল, আবেগের গভীরে লুকিয়ে থাকা একটা সম্পূর্ণ অনাবিষ্কৃত আগুন আমাকে ডাকছে, আমাকে ঘিরে নিতে চাইছে, আমাকে পোড়াতে চাইছে।
মনে পড়ল সুদীপের কথা। আমরা দুজনেই দুজনকে পাগলের মত ভালোবাসি। আমার কাঁধের তিলজোড়া সুদীপের খুব প্রিয়। আমার উস্কোখুস্কো চুল পেরিয়ে প্রায়ই ওখানে সুদীপের ঠোঁট পৌঁছে যায় আদরের তুলি নিয়ে। মনে হচ্ছিল সে তুলি কোথাও যেন হেরে যাচ্ছে এক শিল্পীর কল্পনার কাছে। মনে পড়ল সুদীপের সেই মোক্ষম “বাণী” — মনে রাখবি, তুই চুড়িদার ছেড়ে জিনস পরলেও আমার, অন্য কারও প্রেমে পড়লেও আমার।
তবু বুঝতে পারছিলাম হঠাৎ করে তৈরি হওয়া এক আগুনের কবলে পড়েছি আমি। এবং এ আগুন কেবল আমাকেই পোড়াতে চাইছে এবং উল্টোদিকে থাকা সারল্যে ভরা মানুষটা “সম্ভবত” নয় “নিশ্চিতভাবেই” এ সবের কিছু টের পায়নি।
তাই “সুদীপ” পেরিয়ে ক্রমশ তীব্র হতে থাকা সে আগুনে “সামাজিক” আমি পুড়ে ছাই হবার আগেই বেশ কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, নিমাইদা, আজ আমি আসি। এই ছবি আঁকা নিয়ে পরে একদিন কথা হবে।
— হ্যাঁ, আয়। পরে একদিন তোর ছবি নিয়ে গুছিয়ে আলোচনা হবে।
বললাম বটে, “আসি” — কিন্তু দেখলাম আমার পা সেভাবে নড়তে চাইছে না। ঠিক এই সময়েই কেন জানি না আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল পুজোমণ্ডপের পাশের দেয়ালে নিমাইদার আঁকা “বই-তরণী”র কথা। মনে পড়ল “এক সে মেয়ের” আগুন থেকে বেরিয়ে আসার কথা। সুদীপের সঙ্গে এতগুলো দিন কাটিয়েও যে আগুনের সাক্ষাৎ পাইনি আমি — তা কী করে এমন না জানিয়ে হাজির হল বুঝতে পারছিলাম না। আগুনেও অমন রোমাঞ্চ আছে এমনটা এই প্রথম টের পাওয়া আমার চোখ-মুখে নিশ্চয়ই কোনও পরিবর্তন এনেছিল। ফলে নিমাইদাও দেখলাম অবাক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে।
আমাকে এই আগুন পেরিয়ে বেরোতেই হবে ভেবে আর সময় নষ্ট না করে আমার সমস্ত শক্তি এক করে বাড়ির পথ ধরলাম। পিছনে পড়ে রইল নিমাইদা, পিছনে পড়ে রইল আগুনে পুড়তে চাওয়া কিছু আবেগ আর যন্ত্রণা।
বাড়ির খুব কাছে এসে আমি থমকে দাঁড়ালাম। কাছেই একটা ঘুঘু ডাকছে। একটা ঘুঘু পাখি ডেকে চলেছে একটানা, এই ঋতু, ওড়, ওড়, ওড়...
(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)