Subscribe to Magazines




পরবাসে দেবাশিস দাসের
আরো লেখা




ISSN 1563-8685




প্যান্টিক

সেদিন অফিসফেরতা শিয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠেই টের পেলাম ভুল করে বনগাঁ লোকালে উঠেছি। প্রচণ্ড ভিড়। ট্রেনের ভিড়টাই ঠেলতে ঠেলতে আমাকে কামরার মাঝখানে নিয়ে এল। আর নড়াচড়ার উপায় রইল না। পাঁজরের নিচে দুটো কনুইয়ের গুঁতো আর চোখের নিচে কারো আঙ্গুলের খোঁচা খেয়ে ট্রেনের ছাদের দিকে তাকিয়ে থিতু হলাম। আমি দুটো স্টেশন যাব, এই ট্রেনে না উঠলেও চলতো। কিন্তু ভুল শোধরাবার আর উপায় নেই। ইতিমধ্যে শুনতে পেলাম পাশেই কোথাও বেশ ঝগড়া লেগেছে।

‘দাদা নিজের পায়ে দাঁড়ান।’

‘আরে অসুবিধা হোলে ট্যাক্সি করে যান।’

‘জুতো দিয়ে মাড়িয়ে পায়ের তো রক্ত বার করে দিলেন আবার একেবারে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করছেন, পা-টা নামান আগে, কি ভাবে দাঁড়াতে হয় শিখিয়ে দিতে হবে নাকি? চেহারাটা তো হাতীর মতো বানিয়েছেন।’

‘আপনার বাবার পয়সায় চেহারা বানাই নি।’

‘কি, বাপ তুললেন?’

এরকমই চলছিল। ভীড় আর ঝগড়ায় প্রাণ অতিষ্ঠ। এমন সময় আর একটা গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।

‘ভিড়ের মধ্যে আপনারা ঝগড়া করছেন কেন? একে তো দাঁড়ানো যাচ্ছে না ঠিকমত।’

‘কেন আপনার কি অসুবিধে হচ্ছে?’ যুযুধান দুজনেই খাপ্পা একেবারে।

‘এভাবে ঝগড়া করছেন, দুজনেরই তো ভদ্রবেশ দেখছি।’

‘কি বললেন?’ --দুজনেই যেন কিছুর খোঁচা খেয়েছে।

‘দোষ তো দুজনেরই। চেপে যান না।’

কেন আপনি কে মশাই। অন্যদের কথার মাঝে এসে পড়লেন। ছোটলোক তো আপনিই।’

'দাদারা, বেশী কথা বলতে হোলে নেমে গিয়ে বলুন। এখানে যাত্রীদের অসুবিধা হচ্ছে দেখছেন না?’

দুজনেই খড়গহস্ত। ‘নেমে যাবো। ট্রেন কি আপনার সম্পত্তি? বেশী দাদাগিরি, না? কি পেয়েছেন কি? দেখাচ্ছি আপনাকে।’

এরমধ্যে একজন ওনার কলার ধরল আর একজন মাথায় চাঁটি মারল। ভিড়ের সুযোগে আরও কয়েকটা চপেটাঘাত পড়ল পিঠে মাথায়। ভিড়ের মধ্যে মুখ দেখা না গেলেও, কিছু কিছু নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছিলাম আর বাকিটা আন্দাজ করছিলাম। ঝগড়া থামাতে এসে তৃতীয় জনের অবস্থা বেশ কাহিল মনে হোল। স্টেশন এসে যাওয়াতে ভিড়টা নড়াচড়া করাতে এক ঝলক দেখতে পেলাম তৃতীয় লোকটিকে। ফরসাপানা, মাথায় অবিন্যস্ত কোঁকড়া চুল। তৎক্ষণাৎ আবার উঠতি যাত্রীর ভিড়ে হারিয়ে গেল মুখটা। তখনই মাথার অনেক ভেতর থেকে ভেসে উঠল একটা শব্দ ‘প্যান্টিক।’

***************

এই স্কুলে আজ আমার প্রথম দিন। ক্লাসে বেশ গণ্ডগোল হচ্ছে। নাইন-এ তে বসে আছি। শুনলাম ‘সজনে-ডাঁটা’ আজ স্কুলে আসেন নি। তাই ক্লাস ফাঁকা যাচ্ছে। জানলাম ‘সজনে-ডাঁটা’ হলেন রোগা চেহারার ভূগোল স্যার। এমন সময় একটি ছেলে ক্লাসে ঢুকেই বলল, সবাই চুপ কর, হেডু আসছে। মুহূর্তে ক্লাস ঠান্ডা। যে যার নিজের জায়গায়। একটা সূঁচ পড়লেও আওয়াজ হবে এমনই নিস্তব্ধ। চামড়ার জুতোর মস্ মস্ আওয়াজ তুলে ক্লাসে ঢুকলেন ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত দশাসই চেহারার হেডু বা হেড-স্যার। এসেই বাজখাঁই গলায় জিজ্ঞেস করলেন ‘কে কে গণ্ডগোল করছিল বল।’ প্রশ্নটা ক্লাস মনিটরের উদ্দেশ্যে। কেউ কথা বলছে না দেখে আবার প্রশ্ন করলেন, ‘বল কে কে গণ্ডগোল করছিল?’ আবার নিস্তব্ধতা। একটু একটু করে মুহূর্ত কাটছে। এরই মধ্যে উঠে দাঁড়াল একজন, ‘স্যার সবাই ভূগোল পড়ছিল। আজ স্যর-এর ভূগোলের ক্লাস-টেস্ট নেবার কথা ছিল, তাই।’

‘ভূগোল পরীক্ষা? কই কোথায় ভূগোল বই? কারো তো বই বা খাতা খোলা নেই? গণ্ডগোল করছিস আবার মিথ্যে কথা? স্ট্যান্ড আপ অন দা বেঞ্চ। একটু পরেই দেববাবু তোদের ক্লাসে আসবেন। ততক্ষণ তুই দাঁড়িয়ে থাক। আর বাকিরা ভূগোল পড়তে থাক। একটুও যদি আওয়াজ হয় পুরো ক্লাসকে মাঠে দাঁড় করিয়ে বেত মারব। এই ধৃতি, তুই লিখে রাখবি যারা গণ্ডগোল করবে তাদের নাম। দেব-বাবু আসলে ওনাকে দিবি।’

ক্লাস মনিটর ধৃতিকান্ত উঠে দাঁড়িয়ে খাতা বের করতে করতেই হেড-স্যার বেরিয়ে গেলেন।

লম্বা, রোগা, মাথায় ঝাঁকড়া-চুলওয়ালা ছেলেটা বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে রইল দেবস্যার ক্লাসে এসে ওকে বসতে না বলা পর্যন্ত। মাঝে সবাই বলছিল, ‘তোর এত পাকামো করে কথা বলার কি দরকার ছিল কিশোর? তাও আবার ভূগোল নিয়ে?’ ও বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়েই বলেছিল, ‘আমি তো ঠিকই বলেছি। আমি নিজেই তো ভূগোল পড়ছিলাম, স্যার শুধু শুধু রেগে গেলেন।’ তখনই জানলাম ছেলেটির নাম কিশোর।

ধৃতিকান্ত ক্লাসের মনিটর, আমার পাশে বসতে বসতে বলল ‘কিশোরটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়েও একই কথা বলছে। আরে, রাগের সময় কথা বলার দরকার কি? ঠিক আছে তবে থাক দাঁড়িয়ে।’

কাল যখন এই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম অফিসঘরে হেডস্যার এই ধৃতিকেই ডাকিয়ে বলেছিলেন আমাকে নাইন-এ সেকশনে নিয়ে গিয়ে সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিতে। সেই থেকে ধৃতির সাথে আমার ভালই জমে গেছে। আজ থেকে ধৃতির পাশেই বসছি আমি।

ধৃতি বলল ‘কিশোরটা ওরকমই। দরকার না থাকলেও যেচে নাক গলিয়ে মার খাবে। এটাই ওর স্বভাব।’ দেব স্যার এসে যাওয়াতে সেদিন আর কথাবার্তা এগোল না। কিশোর ছেলেটা নাকি দরকার না থাকলেও গণ্ডগোল দেখলেই নাক গলায় আর গালাগালি খায় বা মার খায়। পরে জেনেছিলাম, ছেলেটি বেশ সরল। লেখাপড়া বা খেলাধুলো কোনটাতেই তেমন আহামরি কিছু নয়। নীচু ক্লাসে একবার নাকি রসাল ফলের উদাহরণ জিজ্ঞেস করাতে ও ‘রসগোল্লা’ দিয়ে শুরু করেছিল। আর একবার নাকি ক্ষেপে উঠেছিল ৪০০মি দৌড়ে প্রাইজ নেবে বলে। সেইমতো প্রচুর প্রাকটিস করেও ফাইনালে দৌড়ে লাষ্ট হয়েছিল। কি হল জানতে চাওয়াতে বলেছিল, শুরুটা ও দারুন করেছিল কিন্তু মাঝামাঝি গিয়ে হাঁচি পেয়ে গিয়েছিল। সেটা সামলাতে গিয়েই লাষ্ট হয়ে গেল। লাক খারাপ। দৌড় প্রতিযোগীদের কারো কোনদিন দৌড়োবার সময় হাঁচি পেয়েছে বলে শুনিনি। কি জানি, হয়তো ওর কপালটাই খারাপ। দৌড়ের ভূত ঘাড় থেকে নেমে গিয়েছিল, কিন্তু ওর এই যেচে গণ্ডগোলে পড়ার স্বভাবটা নাকি প্রথম থেকেই ছিল এবং আর যায় নি।

কদিন পরেই আর একটা ঘটনা ঘটল। সেদিন স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেলার সময় দুজন উঁচু ক্লাসের ছেলের মধ্যে ‘এল বি ডবলু’ আউট নিয়ে ঝামেলা হতে হতে প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেল। আর কিশোর সেই সময় কোথা থেকে এসে আলটপকা মন্তব্য করল ‘তোমরা কেউই “এল বি ডবলু” আউট-এর ব্যাপারটা ভাল করে জানো না।’ যেই না বলা, ব্যাস, উত্তেজিত দুজনেই কিশোরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে এমন রামগাঁট্টা মারল যে ওর মাথায় সাথে সাথেই কয়েকটা প্রমাণ সাইজের আলু গজিয়ে গেল। আমরা কোনরকমে ওকে ছাড়িয়ে আমাদের ক্লাসে নিয়ে এসে জল টল দেওয়াতে রক্ষে হোল। এর পরে সেদিন ও কিছুটা থম মেরে বসে ছিল। আমরা ভাবলাম বোধ হয় কিছুটা শুধরবে। কিন্তু আবার যে কে সেই। এবারে আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার।

সেদিন বোধহয় ক্লাসে পরীক্ষার খাতা দেখান আর নম্বর বলা চলছিল। টিফিন টাইমে আমরা ক্লাসের বাইরের লম্বা করিডোরে দাঁড়িয়ে সেই সব নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমাদের পাশেই উঁচু ক্লাসের দাদাদের আলোচনা উত্তপ্ত হয়ে উঠল। এদের একজন বোধ হয় ক্লাসের টপার, কোন সাবজেক্টে বেশ কম নম্বর পাওয়াতে সে কোন টপ পজিশন পায় নি। এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। ওর ধারণা হয়েছিল যেহেতু ও স্যারের কাছে প্রাইভেটে পড়ে না সেইজন্য স্যার ওকে কম নাম্বার দিয়ে যে ওনার কাছে কোচিনে পড়ে তাকে বেশী নম্বর দিয়ে দিয়েছেন। দু চারজন ওকে সাপোর্টও করছিল। ছেলেটিকে মনে হচ্ছিল বেশ ক্রুদ্ধ আর হতাশ। এর মধ্যে হঠাৎ কিশোর আমাদের জটলা থেকে ওদের জটলায় গিয়ে বেশ উপদেশ দেবার মত করে মন্তব্য করল। ‘আমি শুনেছি তোমাদের আলোচনা। স্যারের দোষ না দেখে, যে যা পেয়েছে তাতেই তার সন্তুষ্ট থাকা উচিত।’ আর যায় কোথা, ছেলেটা বেশ চিৎকার করেই বলল ‘কেন তুই কি আমার দাদু নাকি যে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস?’ পাশের ছেলেটা আরও রেগে ওর কলার ধরে বলল ‘তোকে আমাদের কথা শুনতে কে বলেছে?’

এতেও না থেমে, কিশোর ওই ছেলেটার দিকে ঘুরে বলল ‘আমি সব মানছি, কিন্তু তোমার উচিত পরের বার পরীক্ষায় আরও ভাল করা। স্যার তোমাকে ঠিক নম্বরই দিয়েছেন আর অন্যরা নিশ্চয়ই তোমার থেকে ভাল করেছে।’ ছেলেটি এর পর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সপাটে একটা চড় কষাল কিশোরকে। ওর ফুলো ফর্সা গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ ফুটে উঠল। ছেলেটি বলল ‘তুই কি আমাদের খাতা দেখেছিস নাকি? কে কত নম্বর পেয়েছে জানিস? ফের যদি কোনদিন এরকম জ্যাঠামো করিস তবে কিন্তু শুধু চড়ে ব্যাপারটা থেমে যাবে না জামা-প্যান্ট খুলে মাঠে ঘোরাব এই বলে রাখলাম।’ অনেক কষ্টে সেদিন কিশোরকে ছাড়িয়ে এনেছিলাম। কেন যে ও অন্যের ব্যাপারে মাথা গলায় কে জানে। ওর কিন্তু একটাই কথা ‘আমি তো ওদের সঠিক কথাই বলছিলাম, ওরা বুঝতে পারল না।’ ও নিজেই বুঝতে চাইত না। আমরা আর বলতাম না, ভাবতাম ওর এটাই স্বভাব। এটা কিছুতেই যাবে না। কাজেই মাঝে মাঝেই এরকম হতে থাকল। তবে এর পরেই ঘটল সেই মোক্ষম ঘটনা।

সেবারে স্কুলের ফুটবল টুর্নামেন্টে আমরা খেলতে গেছি মধ্যমগ্রামে। আমাদের ক্লাসের দুজন স্কুল টীমে ছিল। সেই কারণে আমরা ক্লাসের কয়েকজন স্কুল বাসে চড়ে টীমকে সাপোর্ট করতে খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের সাথে কিশোরও ছিল। স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় মধ্যমগ্রামের স্কুলগুলোর স্থান একদম ওপরের দিকে। এখান থেকেই একটা স্কুল বার কয়েক চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। যাদের সাথে খেলা তাদেরও বেশ নামডাক ফুটবলে। এই বছর বাঘা বাঘা দুটো টীমকে এরা হারিয়েছে লীগ পর্যায়ে। এই ম্যাচটা কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার রাস্তা। কাজেই বেশ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।

মধ্যমগ্রামে এসে একটা ইঁটভাটার সামনে বাসটা দাঁড়িয়ে গেল। ড্রাইভার বলল এর পরে রাস্তা খুব সরু তাই বাকি রাস্তা হেঁটেই যেতে হবে। এখানকার দু একজন কর্মকর্তা গোছের লোক আমাদের নামিয়ে নিল। আমরা আমাদের গেমস টিচার সুভাষ স্যারের পেছন পেছন হাঁটতে থাকলাম। বর্ষাকাল, সকালে বৃষ্টি হয়েছে বেশ। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে আরও ঢালবে। জল কাদামাখা কাঁচা মাটির রাস্তা দিয়ে আমরা হাঁটছি মাঠের উদ্দেশ্যে। খেলার শেষে আবার বড় রাস্তায় এসে বাস ধরতে হবে। আমাদের টীম যদিও বেশ শক্তিশালী তবু সবাই টীমকে চীয়ার আপ করতে করতে চললাম। দুপাশে বেশীর ভাগই টালির বা টিনের ঘর আর মাঝে মাঝে দু-একটা পাকা বাড়ি। বাড়িগুলোতে সামনে সুন্দর বাগান করা আর সামনের দিকে রয়েছে বাঁশের বেড়া। বেশ লাগছিল। বাড়িগুলোর জানলা দিয়ে মানুষজন আমাদের দেখছে। আর আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে। ‘এরা কলকাতার স্কুলের টীম আজ কমকরে পাঁচ গোল খাবে।’ শুনে একটু দমে গেলেও ওদের কথায় কান না দেবার চেষ্টা করছিলাম।

হঠাৎ কিশোর আর থাকতে না পেরে বলে উঠল, ‘পাঁচ গোল কারা খাবে দেখা যাবে।’ শুনে ওরাও সবাই বলতে লাগল, ‘মাঠে গোলের মালা পরাব রে।’ বুঝলাম এরা খুব চার্জড হয়ে আছে খেলাটা নিয়ে। আমরা আর বিশেষ কিছু না বলে আরও মিনিট খানেক হেঁটে একটা বিশাল মাঠে পৌঁছলাম। একেবারে ঘন সবুজ মাঠ। বৃষ্টির জলে ভিজে একেবারে সজল। মাঠের ওপাশ দিয়ে রেল লাইন চলে গেছে আর এপাশে ঘরবাড়ি। এটা আমাদের স্কুলের মাঠের চেয়ে অনেক বড়। ছেলেরা কি দম পাবে এখানে? কে জানে?

ওরা চা মিষ্টি দিয়েছিল। কিন্তু পূর্বনির্দেশ অনুযায়ী আমাদের প্লেয়াররা শুধু সঙ্গে আনা শুকনো কিছু হাল্কা খাবার মুখে দিল।

একজন কর্মকর্তা বলে গেলেন যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খেলা শুরু করতে হবে যাতে বৃষ্টি আসার আগেই শেষ করা যায়। আমদের টীম ওয়ার্ম আপ করে মাঠে নেমে গেল। খেলা শুরু হোল। অবাক হলাম ওদের প্লেয়ারদের দেখে। দুজন ফরওয়ার্ড আর দুজন ডিফেন্ডারকে বয়সে অনেকটা বড় মনে হোল। এরা কি স্কুলে পড়ে আদৌ? কিশোর উত্তেজিত হয়ে স্যারকে বলল, ‘স্যার ওরা দুনম্বরী প্লেয়ার নামিয়েছে, এটা কিছুতেই মানা যায় না।’ স্যার কর্মকর্তাদের সে-কথা বলাতে ওরা বলল, ‘সব অফিসিয়ালি চেক করা হয়েছে। কোন গণ্ডগোল নেই।’ কারা যে কি চেক করেছে বোঝা গেল না।

খেলা শুরু হতেই বুঝলাম ওদের ফরওয়ার্ড দুজন দুর্দান্ত। কি স্পীড, কি স্কিল, যখন তখন আমাদের ডিফেন্সকে চিরে ফেলছে। প্রথম কুড়ি মিনিটেই আমাদের গোলকিপার দুটো শিওর গোল বাঁচাল। আমরা তো আক্রমণে যেতেই পারছি না। বুঝলাম এভাবে বেশিক্ষণ টেকা যাবে না। আক্রমণে যেতেই হবে। এদিকে ওদের দর্শকরা আমাদেরকে যা তা টিটকিরি দিচ্ছে। কটা গোল খাব সেটাই চিন্তা করছি।

এরই মধ্যে ওদের একজন ফরওয়ার্ড কর্নার শটে মাথা ছুঁইয়ে প্রথম গোলটা করে ফেলল। গোলটাকে অসাধারণ বললে কম বলা হয়। কোথা থেকে বাজপাখির মত উড়ে এসে হেড করল বোঝাই গেল না। এর পর থেকেই আমাদের প্লেয়ার আর সাপোর্টারদের উদ্দেশ্যে টিটকিরির বহর বেড়ে গেল। ভাষা বেশ নিম্নস্তরের। হঠাৎই ওদের গোল করা ফরওয়ার্ড বল পায়ে আমাদের গোল লাইন-এর কাছে আসতেই কিশোর চিৎকার করে উঠল, ‘দাদু, আবার গোল করবে নাকি?’ এটা প্লেয়ারটার বয়স নিয়ে ডিরেক্ট কটাক্ষ। ও একবার কিশোরের দিকে রক্তচক্ষু মেলে দেখল তারপর আবার খেলায় মন দিল। আমরা কোনরকমে কিশোরকে ঠেকাবার চেষ্টা করলাম। বললাম ‘এটা ওদের এলাকা, চুপচাপ থাক, না হোলে মেরে পাট করে দেবে।’ ওদের আক্রমণ মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছে আমাদের পেনাল্টি বক্সে। এরই মধ্যে স্রোতের উল্টোদিকে আমদের ফরওয়ার্ড যতীন কি করে একটা বল পেয়ে গেল ফাঁকায়। বল পেয়েই ও ওর সেরা দৌড়টা শুরু করল। পেনাল্টি বক্সে ওদের গোলকিপারকে কাটিয়ে জালে জড়িয়ে দিল বলটা। গোল। সারা মাঠ নিস্তব্ধ। ওরা যে গোল খেয়েছে সেটা বিশ্বাসই করতে পারছে না। আমরা তখনই বুঝলাম যে খেলাতে আমরা জিততেও পারি। এর পরের খেলাটা মাঝ মাঠেই আটকে রইল। কিশোর মাঝে মাঝেই ‘দাদু’ ‘দাদু’ বলে ওদের ফরওয়ার্ডদের চটাতে লাগল আমাদের বারণ সত্ত্বেও। এভাবেই হাফটাইম হোল। কিশোরকে আমরা বললাম। ‘আর চেঁচালে বাসে রেখে আসব। না হোলে বিরাট গণ্ডগোল হবে। এখান থেকে বাড়ি ফেরা মুস্কিল হবে।’ কিশোর তাও বলল, ‘ওরা বয়েস ভাঁড়িয়ে বড় প্লেয়ারদের খেলাচ্ছে আর আমি কিছু বলতে পারব না?’ আমরা ওকে বললাম, ‘তোর কি রে? তুই চুপ কর। স্যার তো দেখছেনই ব্যাপারটা।’

এর মধ্যে ওদের দিক থেকে দুজন হোমরা-চোমরা লোক এসে স্যারকে বলে গেল, ‘আপনাদের ছেলেটিকে থামান, নাহলে আমরাও গণ্ডগোল আটকাতে পারব না। লোকজন ভীষণ তেতে উঠছে। ওকে কিন্তু এখানেই রেখে যেতে হবে।’

হাফটাইমের পর খেলা শুরু হতেই ওদের উইং দিয়ে আক্রমণ ধেয়ে এল। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেনাল্টি বক্সের এক কোন থেকে জোরাল শটে গোল করলো ওদের নতুন নামা বদলি রাইট হাফ-এর প্লেয়ারটি। গোল অনবদ্য কিন্তু বয়সে এত বড় প্লেয়ারকে স্কুল ফুটবলে কখনো দেখা গেছে কিনা জানিনা। কে একজন বলল, ইনি নাকি কলকাতা ফুটবল লিগে খেলেন কোন ফার্স্ট ডিভিশন টীমে। সত্যি কিনা কে জানে? এরপর আমাদের একটা গোল রেফারি নাকচ করে দিল অফসাইডের দোহাই দিয়ে। বুঝতে পারলাম এখান থেকে জিতে ফেরা সম্ভব না। ওরা যেন তেন প্রকারেণ জিতবে বলে পণ করেছে।

কিন্তু প্রায় শেষের দিকে কি করে যেন একটা ফ্রী কিক পেয়ে গেলাম ওদের পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকে। রবি একটা দুর্দান্ত শটে বলটা ওদের জালে জড়িয়ে দিল। খেলা ২-২। সারা মাঠ আবার নিস্তব্ধ। এরপর যেটা হোল সেটাকে খেলা বলা যায় না। ওরা বল ছেড়ে আমাদের প্লেয়ারদের পায়ে মারতে লাগল। গৌর তো চোট পেয়ে বসেই গেল। সদা নামল ওর জায়গায়। সদার নাকি পায়ের গাঁট পাথরের মত শক্ত। তবে অনেক মারলেও গোল আর ওরা করতে পারল না। সদার সাথে চার্জ করে ওদের একজন ডিফেন্ডার পা ধরে বসে পরল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঠের বাইরে। এ তো হতেই পারে, কিন্তু ওদের সাপোর্টাররা মাঠে নেমে হাঙ্গামা করতে লাগল। খেলা বন্ধ। আমদের দু একজন প্লেয়ারকে ওরা চড় থাপ্পড়ও মারল। স্যার আর রিস্ক না নিয়ে প্লেয়ারদের মাঠের বাইরে ডেকে নিলেন। ইতিমধ্যে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। খেলা আর শুরু হতে পারল না। পয়েন্ট ভাগাভাগি হয়ে গেল। কথা বলতে বলতেই একজন খেয়াল করল, কিশোরকে দেখা যাচ্ছে না। আমরা চিন্তিত হয়ে খুঁজতে লাগলাম। দেখলাম এই বৃষ্টির মধ্যেই ওদের সাইডে গোলপোস্টের কাছে একটা জটলা হচ্ছে। ওখানে যেতেই দেখলাম, ওদের সেই বিরাট চেহারার ফরওয়ার্ড, যাকে দাদু বলা হচ্ছিল, সে কিশোরকে মাটিতে ফেলে বুকের ওপর বসে বেদম চড় ঘুসি মারছে। কিশোর নীচ থেকে ‘আমাকে ছেড়ে দাও, আমি কিছু বলিনি’ বলে চেঁচাচ্ছে। আর ওই ফরওয়ার্ড বলে যাচ্ছে ‘আর দাদু বলবি? আবার বেল্ট খুলে মারতে আসবি?’ আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম সত্যই কিশোরের হাতে বেল্ট। যদিও মার খেয়ে ওর অবস্থা খুবই খারাপ। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে। কেউ একজন স্যারকে ডেকে আনাতে, উনি গিয়ে ওদের থামালেন। কেন মারছে ওকে প্রশ্ন করাতে ওরা বলল, কিশোর নাকি ওদের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে বলছিল, ‘অসদুপায়ে দাদুদের খেলিয়েও জিততে পারলেনা, এরকম করার দরকার কি?’ আর ওই ছেলেটিকে কাছে গিয়ে ‘দাদু’, ‘দাদু এভাবে আর খেলো না। এতে নাম খারাপ হয়।’ বলে উপদেশ দিচ্ছিল। ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করাতে ও নাকি নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলে ওই বিশাল ছেলেটাকে মারতে গিয়েছিল। এর পর আর ছেলেটা থাকতে পারে নি। কিশোরকে সে মাটিতে ফেলে দিয়েছে শুধুই নাকি নিজেকে বাঁচাবার জন্য।

বিশ্বাসই করতে পারলাম না যে ওই রোগাপটকা কিশোর বিরাট চেহারার মানুষটিকে বেল্ট দিয়ে পেটাতে যাচ্ছিল।

কিশোরকে জিজ্ঞেস করাতে ও কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ‘আমি কোথায় ওকে মারতে গেলাম?’

ভিড়ের মধ্য থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘তবে বেল্ট খুলেছিলি কেন?’

কিশোর বলল ‘প্যান্টটা আর বেল্টটা দুটোই নতুন, কোমরে আলগা হয়েছে, তাই বেল্টটা খুলে প্যান্ট ঠিক করছিলাম। না হোলে খুলে পড়ে যেত।’ এই বলে আবার বেল্টটা প্যান্টে লাগিয়ে নিল সে।

উত্তেজনার মধ্যে সবাই হেসে উঠল। কিভাবে মার খেতে খেতেও কিশোর প্যান্ট ঠিক করছিল, তাই মনে মনে কল্পনা করছিলাম।

কোনরকমে সেদিন কিশোরকে ‘মার খেয়ে আহত’ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।

ফেরার পথে বাসে অবশ্য দারুন মজা হয়েছিল। একদল কোরাসে প্রশ্ন করছিল ‘বেল্ট খুলে কি করছিলি?’ আর একদল কোরাসেই জবাব দিচ্ছিল ‘প্যান্ট ঠিক করছিলাম।’

‘কি করছিলি?’

‘প্যান্ট ঠিক।’

‘কি বললি?’

‘প্যান্ট ঠিক।’

‘প্যান্টিক?’

‘হ্যাঁ প্যান্টিক।’

**************


সেই থেকে কিশোরের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘প্যান্টিক।’ স্কুলে সবাই ওকে প্যান্টিক বলেই ডাকত। বাবার বদলির জন্য বছর দুই পরে সেই স্কুল ছেড়ে অন্য স্কুলে চলে গিয়েছিলাম। ওর সঙ্গে আর দেখা হয় নি কোনদিন। একটা কথা আমার আজও মনে হয়, অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করলেও বিবাদের মধ্যে সঠিক কথা বলার সাহস কিন্তু একমাত্র প্যান্টিকেরই ছিল। কিছু মানুষ আছেন যারা নিজের কথা চিন্তা না করে, ঝগড়া বিবাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন, সঠিক কথা বলে মধ্যস্থতা করার, বিবাদ মেটাবার চেষ্টা করেন। তাদের দেখলেই এখনো আমার মনে উদয় হয় একটি ফুলপ্যান্ট ও বেল্ট পরা ছেলে, যার জামা ছিঁড়ে গেছে মারের চোটে, চড় ঘুসি খেয়ে ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে।


(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)