|| ১ ||
ছেলেটির দিকে খানিকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়েছিলেন ডক্টর বোস৷
একটা মারাত্মক ভয় ও সীমাহীন অবিশ্বাসের কাল্পনিক বেড়াজালে যেন বন্দী করে রেখেছে নিজেকে৷ ঘোলাটে দুচোখ দিয়ে মাঝে মাঝেই আড়চোখে একবার দেখে নিচ্ছে তাঁকে, কিন্তু চোখ পড়লেই শশব্যস্ত হয়ে মুখ লুকিয়ে নিচ্ছে৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে রিসার্চ করছিল ছেলেটি, সবকিছু ঠিকঠাক চললে এতদিনে তার ডক্টরেট ডিগ্রী পেয়ে যাওয়ারই কথা৷ কিন্তু বিধি বাম, হঠাৎ কি যে হল — ধীরে ধীরে যেন মানসিক সুস্থতা হারিয়ে ফেলতে থাকে সে৷ ও হ্যাঁ, ছেলেটির নামটাই বলা হয়নি — ঋজু মুখোপাধ্যায়৷ বাবা শান্তনু মুখোপাধ্যায় গণিতের অধ্যাপক, ডক্টর সায়ন্তন বসুর পূর্ব-পরিচিত৷ হতভাগ্য পিতার একান্ত অনুরোধ ফেলতে পারেননি ডক্টর বোস, তাই ঋজুর সঙ্গে দেখা করতে আসা৷ ভারতবর্ষের অন্যতম সফল সাইকিয়াট্রিস্ট হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে এ-ফিল্ডের সবাই একটু এড়িয়েই চলে — এই ভয়মিশ্রিত সমীহের কারণ হল, চিকিৎসাক্ষেত্রে কোনওদিন তিনি খুব একটা নৈতিকতার ধার ধারেননি, তাঁর কাছে রোগীর সুস্থতাই প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য৷
পাভলভ হাসপাতালের সুপারকে বলে একটি সম্পূর্ণ আলাদা ঘরে ঋজুর সঙ্গে কথাবার্তার ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন ডক্টর বোস৷ মিনিট পনের কেটে গেছে, একটি বাক্যও কেউ এখনো উচ্চারণ করেনি৷ তাঁর অভিজ্ঞতা বলছে, ঋজু এমন কিছু আয়ত্ত করেছে যা সে গোপন রাখতে চায়, অথচ এই গোপনীয়তা দিন দিন তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠছে৷ তার অবচেতন ও সচেতন মনের এই দ্বন্দ্ব থেকে সে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে — হয়তো একমাত্র মৃত্যু তাকে দিতে পারে সেই মুক্তি৷
‘কি খেতে খুব ইচ্ছে করে, ঋজু?’ দেওয়াল ঘড়ির একঘেয়ে বিরক্তিকর টিক-টিক আওয়াজ ছাপিয়ে প্রশ্নটা করলেন ডক্টর বোস৷
‘আইসক্রিম’— সংক্ষেপে এককথায় উত্তর দিল ঋজু৷ ডক্টর বোস একটা কুলফি আনিয়ে দিলেন৷ তার খাওয়ার মাঝেই হঠাৎ বলে ওঠেন —
‘তুমি কি সবসময় ঐ ঢাউস ব্যাগটা নিয়ে ঘোরো?’
আতঙ্কে প্রায় ছিটকে সরে বসে ঋজু, চোখের সতর্ক দৃষ্টি বুঝিয়ে দেয় যে এই ব্যাগই তার প্রাণ, কোনও মূল্যেই তা হাতছাড়া করতে রাজী নয় — এই নিয়ে আলোচনাতেও সে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে৷
যাক! একটা সূত্র অন্তত পাওয়া গেল, মনে মনে ভাবলেন ডক্টর বোস৷ তাঁর পেশেন্টকে আশ্বস্ত করে সেদিনের মত উঠে পড়লেন তিনি, তাড়াহুড়ো করলে হিতে-বিপরীত হতে পারে৷
কয়েকদিন এভাবেই কাটলো, রোজ মামুলি কিছু কথাবার্তার বেশী আর তেমন এগোলনা৷ শেষে একদিন সাহস করে বলেই ফেললেন —
‘ব্যাগটা যখন সাথেই আছে তখন তোমার এত ভয় কিসের, ঋজু! কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবেনা!’
চোখ দুটো ছোট হয়ে এলো ঋজুর, ‘কিন্তু যদি জোর করে কেড়ে নেয়?’
‘ধুর, কেড়ে নিয়ে করবেটা কি? কিছু বুঝতে পারলে তো!’ হাত তুলে আশ্বস্ত করেন ডক্টর বোস৷
‘হুঁ, তা ঠিক! বেশ জটিল, বোঝা শক্ত৷ কিন্তু আপনি?’ সন্দেহের চাউনি ঋজুর চোখে৷
‘আরে আমি ওসবের কিছুই বুঝিনা — আমি তোমার বাবার বন্ধু, জাস্ট তোমার সাথে গল্প করতে আসা৷’ — নিস্পৃহভাবে বললেন ডক্টর বোস৷
‘তাহলে কাকে বলা যায় বলুনতো?’ অসহায় প্রশ্ন ঋজুর৷
‘তুমি অতো ভেবোনা, একদিন সময় করে আমাকেই বলবে’খন৷ আমি আরেকদিন এসে শুনব, কেমন?’ ঋজুর মন নিয়ে এবার সত্যিই নাড়াচাড়া শুরু করে দিয়েছেন ডক্টর বোস৷
‘সেই ভাল, তবে আরেকদিন!’ উঠে পড়ল ঋজু, একবারও পিছনে না তাকিয়ে সটান বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে৷
ছেলেটা তাঁকে বোধহয় বিশ্বাস করেছে,তার হয়ত সত্যিই মনে হয়েছে যে কেউ জানতে পারলেও আসলে কিছুই করতে পারবেনা৷ অর্থাৎ আর দেরী করা ঠিক হবেনা, ওর মনের ভেতর থেকে গোপন কথা টেনে বার করতে হবে তাঁকে৷ কিন্তু ঋজু যে বলল, এ বড়ই জটিল! কি এমন জটিল জিনিস বয়ে বেড়াচ্ছে ঋজু? সে ঐ ব্যাগের ভার, না শুধুই তার মনের ভ্রম?
|| ২ ||
শেষমেশ যা আশংকা করেছিলেন মিহির, তাই সত্য হল৷ সারারাত্রি দুচোখের পাতা একত্র করতে পারেননি — মহাকালের কাছে অশ্রুসজল চোখে একটাই প্রার্থনা করেছেন, আজ বিফলে যাক তাঁর শিক্ষা, মিথ্যে হয়ে যাক তাঁর গণনা৷ কিন্তু হায়! তিনি কালের লিখন পড়তে পারেন মাত্র, তা বদলাবার ক্ষমতা যে তাঁর নেই! সম্রাট বিক্রমাদিত্যের একমাত্র পুত্রের মৃত্যু-কারণ ও সময় তিনি নির্ধারণ করেছিলেন শুধুমাত্র রাণী ধ্রুবদেবীর অনুরোধে৷ বারংবার গণনার পরও সময় সেই একই নির্ধারিত হয়েছিল — অষ্টাদশ বৎসর বয়সে, বালকের জন্মদিনেই সে মৃত্যুমুখে পতিত হবে, এক বরাহর আক্রমণেই হবে সে ভয়ঙ্কর মৃত্যু৷ দেবী রাণীর উন্মত্ত ক্রোধ, সম্রাটের বিষণ্ণতা ও বাকি ভারত-খ্যাত জ্যোতিষীদের বিদ্রূপ তাঁকে টলাতে পারেনি — শান্তভাবেই বলেছিলেন, সূর্য ও চন্দ্রের মতই সত্য তাঁর বিচার৷ জাতকের বুধের দশা আর বৃহস্পতির অন্তর্দশা হয়ত তাঁরা ধরতে পেরেছিলেন, কিন্তু বুধেরই প্রত্যন্তর্দশা তাঁদের নজর এড়িয়ে যায়৷ হায়, এই গ্রহ বুধই কুমারের অষ্টম বা মৃত্যুর ঘরে বসে তার অকালমৃত্যু নির্ধারণ করে গেছে!
খবরটা অবশ্য লোকমুখেই পেয়েছিলেন মিহির, শোনামাত্র আর দাঁড়াননি৷ আজ দ্বিপ্রহরে প্রাসাদের মধ্যেই এক বিশাল বরাহের প্রস্তর মূর্তি উচ্চ-স্তম্ভ থেকে ভূপতিত হয়, তার পাথরের শিং-দুটি বিদীর্ণ করে দেয় যুবরাজের বক্ষ৷ শেষ হয়ে যায় এক তরুণের যাবতীয় সম্ভাবনা, সমাপ্তি ঘটে এক যন্ত্রণাদায়ক লম্বা প্রতীক্ষার — আর অবশ্যই তিনি উত্তীর্ণ হন এ কঠিন পরীক্ষায়৷ দেবীর হাহাকারের মাঝে ভারত-সম্রাট তাঁর হাত দুটি ধরে আর্তনাদ করে ওঠেন — ‘আমি পরাজিত! আমার সুবিশাল প্রাসাদ ও সৈন্যবল দিয়েও নিজের আপন পুত্রকে রক্ষা করতে পারলুম না৷ আজ থেকে আপনার নাম হল বরাহ-মিহির — হে জ্যোতিষশ্রেষ্ঠ!’ প্রচণ্ড কষ্টে ও যন্ত্রণায় তিনিও কাতর হয়ে পড়েছিলেন, পরম বিষ্ণুভক্ত সম্রাটকে তাঁর মত এক সামান্য জ্যোতিষী কি বলেই বা আজ সান্ত্বনা দেবে! ম্লানমুখে চোখ নামিয়ে শুধু বলেছিলেন, ‘আমি ধন্য, কিন্তু আজ যে সত্যি বড় দুঃখের দিন — সম্রাট, এ বিধাতার লিখন, আমি তাঁর লেখা পড়ে আপনাকে জানিয়েছিলাম মাত্র৷ কিন্তু এই হৃদয়-বিদারক ঘটনায় আমি অত্যন্ত ব্যথিত, আজ থেকে আমার জ্যোতিষ বিদ্যা আর কোনওদিন কারও মৃত্যু-বিচার করবেনা৷’
নাহ, তখনই মনে মনে উজ্জয়িনী ছাড়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন বরাহ-মিহির৷ সে কত যুগ আগে তাঁর পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন সুদূর পূর্ব পারস্য থেকে৷ তাঁর অবশ্য জন্ম এদেশে, উজ্জয়িনীর কাছেই ছবির মত সুন্দর সে গ্রাম — কপিত্থ৷ এখনও চোখ বুজলেই স্পষ্ট দেখতে পান ছোট্ট দালানে বসে পিতার কাছে তাঁর প্রথম জ্যোতিষের পাঠ, পিতা আদিত্যদাস-ও বেশ নাম করেছিলেন এ বিদ্যায়৷ কিন্তু বরাহ-মিহির এখানেই থেমে থাকতে রাজী নন — গণিতের বিবিধ শাখার সীমাহীন রহস্য তাঁকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে৷ কুসুমপুর (পাটনা) যাওয়ার সিদ্ধান্ত একপ্রকার নিয়েই ফেলেছেন তিনি৷ মহান গণিতজ্ঞ আর্যভট্টের কাছে শিক্ষালাভের সুযোগ এসেছে, সে ডাক উপেক্ষা করতে রাজী নন বরাহ-মিহির৷
|| ৩ ||
স্নান শেষ করে আনমনে পায়চারি করছিলেন আচার্য আর্যভট্ট, কদিন ধরেইএক মানসিক অশান্তিতে ভুগছেন তিনি৷ বরাহ-মিহির-এর অসম্ভব জীবনীশক্তি ও মেধা অবাক করে তোলে আচার্যকে৷ পুত্রসম শিষ্য তাঁর, মাঝেমধ্যেই মতানৈক্য হয় — এবং তা অবশ্যই গাণিতিক বিষয় নিয়ে৷ তবে তিনি কখনই সংযম হারান না, কারণ গণিতের নানাবিধ জটিল তত্ত্ব আবিষ্কার ও তার সমাধানের এই নেশা যে তাঁর বড়ই প্রিয়৷ পুরাণ ও পৌরাণিক ব্যাখ্যা চোখবুজে বিশ্বাস করতে একেবারেই রাজী নয় তাঁর এই শিষ্যটি৷ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’-র পাণ্ডুলিপি লেখায় সবে হাত দিয়েছেন বরাহ-মিহির, কিন্তু পাশ্চাত্যের অর্থাৎ গ্রীক ও রোমানদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্রগুলি মোটেই অবজ্ঞা করতে রাজী নন — বরং সে চিন্তাধারা নিয়ে আলাদাভাবে লেখার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন৷ তাঁর সঙ্গে ইতিমধ্যেই নানাবিধ জটিল গণনা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে — বরাহ-মিহির-এর অকাট্য যুক্তি তাঁকে চমৎকৃত করেছে, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন তার চন্দ্রের দশা ও গ্রহণের ব্যাখ্যা, যেখানে রাহু ও কেতুর অস্তিত্বকে তিনি স্বীকারই করতে চাননি৷ কিন্তু মনে হয় শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানেই আর আবদ্ধ থাকতে চাননা তাঁর বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই শিষ্য৷ নতুন জ্যামিতিক উপপাদ্যগুলি নিয়ে বরাহ-মিহিরের সাথে বসার কথা চলছে অনেকদিন ধরেই — কিন্তু ছাত্রের মন যে মোটেও স্থির নেই, বড়ই চঞ্চল হয়ে উঠেছে ইদানীং৷ তাই আজ মধ্যাহ্নভোজনের সময় কথাটা পাড়লেন আচার্য আর্যভট্ট —
— বরাহ-মিহির, তোমার বুদ্ধি ও নিষ্ঠায় সত্যই আমি চমৎকৃত৷ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ লেখার কাজে কতদূর অগ্রসর হলে বৎস?
— আপনার আশীর্বাদে পাণ্ডুলিপির কাজ প্রায় সমাপ্ত, আচার্য!
— কিন্তু কেন জানিনা, ইদানীং বড়ই বিচলিত লাগে তোমায়, অনেক বৃহৎ কার্য যে অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য — ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে সে কার্যে সফল হবে কি প্রকারে?
— আমি ক্ষমাপ্রার্থী, আচার্য!
— বৎস, তুমি সংখ্যা হিসেবে শূন্যের বিশেষত্ব নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলে, ঋণাত্মক সংখ্যার গুরুত্ব সম্পর্কেও আমাদের কিছু আলোচনা করার ছিল — কিন্তু বর্তমানে তোমার এ বিষয়ে উৎসাহের কিঞ্চিৎ অভাব লক্ষ্য করছি আমি৷ আমরা কবে পুনরায় শুরু করতে পারি সে কাজ?
— আসলে সম্রাটের এক বিশেষ নির্দেশ পেয়ে আমি বর্তমানে ঈষৎ চিন্তিত...
— সম্রাট বিক্রমাদিত্য পত্র পাঠিয়েছেন, কই বলনিতো আমায়? কিন্তু হঠাৎ কি ব্যাপার?
— উদয়গিরিতে এক বিজয় স্তম্ভ স্থাপন করতে চান সম্রাট, এক সুবিশাল লৌহ স্তম্ভ, যা কালের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে যুগ যুগ ধরে প্রচার করবে তাঁর কীর্তি! সম্রাট আমার সাহায্যপ্রার্থী — কিন্তু আচার্য, এ ব্যাপারে কোনও জ্ঞানই যে আমার নেই! ধাতুবিদ্যা বিশারদ কে এমন আছেন যিনি শিষ্য হিসাবে আমায় গ্রহণ করতে সম্মত হবেন? শেখাবেন এই গূঢ় তত্ত্ব?
— হুম, সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় তোমার গঙ্গারিদয় যাওয়া উচিত, দেবী লীলাবতীর চেয়ে এ বিষয়ে উপযুক্ত কেউ আছেন বলে আমার জানা নেই৷
— গঙ্গারিদয়? গঙ্গার তীরে এ প্রাচীন জনপদের নাম শুনেছি বটে! কিন্তু দেবী লীলাবতী আমার পরিচিত নন, সেক্ষেত্রে আমায় শিক্ষা প্রদানে আদৌ সম্মত হবেন কি?
— তুমি যাত্রার বন্দোবস্ত করো বৎস, আমি একটি পত্র লিখে দিচ্ছি, তুমি এটি দেবীকে দেবে — বাকিটা তোমার জ্ঞান ও বুদ্ধির উপরই নির্ভর করছে৷ হে জ্যোতিষশ্রেষ্ঠ, বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার এক অতি উজ্জ্বল রত্ন তুমি, দেবীর তোমাকে শিক্ষাদানে অসম্মত হওয়ার আমি কোনও কারণ দেখিনা৷
— তবে তাই হোক, আমি কালই রওনা হতে চাই!
— অতি উত্তম৷ আশীর্বাদ করি, জ্ঞানলাভে সফলতা অর্জন করো বৎস! আমার শরীর আদৌ ভাল নেই, তবু আশা রাখি — আবার দেখা হবে!
— হে আচার্য, আপনি যখনই আদেশ করবেন আমি আপনার পদতলে উপস্থিত হব!
|| ৪ ||
আকাশের মুখ আজ বেজায় ভার, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে ডক্টর বোসের মুডও৷ তিনি ইতিমধ্যেই তিন তিনবার ঋজুর সঙ্গে কথা বলেছেন, নানা কৌশলে জানতে চেয়েছেন ওর ভয় বা আশঙ্কার মূল কারণ — কিন্তু সে এখনো মুখ খোলেনি৷ আজ চতুর্থ দিন, ভাবছিলেন ঠিক কিভাবে শুরু করা যায়, হঠাৎই এক অদ্ভুত প্রশ্ন করল ঋজু —
‘আপনি ম্যাজিক স্ক্যোয়ার-এর নাম শুনেছেন?’
কৌতূহলী মুখে ডক্টর বোসের দিকে চেয়েছিল ঋজু, এ কয়েকদিনে অনেকটা সহজ হয়ে এলেও সে অন্য কোনও বিষয় নিয়ে খুব একটা আলোচনা কোনওদিন করেনি — তাই হঠাৎ এ প্রশ্নে খানিকটা অবাকই হলেন ডাক্তারবাবু৷
‘ম্যাজিক স্ক্যোয়ার? না বাপু, কোনওদিন শুনেছি বলে ঠিক মনে পড়ছে না, তবে বুঝিয়ে দিলে ঠিক বুঝতে পারব!’ অপ্রস্তুত গলায় বলে ওঠেন ডক্টর বোস৷
‘কে এই জিনিসটির আবিষ্কার করেন তা নিশ্চিত করে না জানা গেলেও, চৈনিক তা-তাই-লি-চি আনুমানিক ৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম এর উল্লেখ করেন৷ সেটি ছিল সংখ্যা দিয়ে বানানো ৩*৩-এর এক স্ক্যোয়ার, অর্থাৎ ৩টি রো আর ৩টি কলাম, এবং আশ্চর্যজনকভাবে বর্গক্ষেত্রটির যেকোনও রো বা কলামের সংখ্যাগুলির যোগফল একই ছিল৷ বুঝতেই পারছেন, যত আকারে বড় হবে এই সংখ্যার চতুর্ভুজ ততই জটিল হয়ে দাঁড়াবে পুরো বিষয়টি৷’
‘আমার পিএইচডি গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল তথাকথিত কোল্ড-ফিউশন — অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় পদার্থের একেবারে মৌলিক গঠনের পরিবর্তন ঘটানো৷ বলে রাখা ভাল, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এই মতবাদ মোটেই স্বীকার করে না, অতি উচ্চশক্তির প্রয়োগ-বিনা পদার্থের পরমাণুর মৌলিক গঠন পরিবর্তন সম্ভব বলে সে আদৌ মানতে চায়না৷’ এটুকু বলে থামল ঋজু৷
‘হুম, কিন্তু এর সঙ্গে সেই ম্যাজিক স্ক্যোয়ারের কি সম্পর্ক ঠিক বোঝা গেল না তো!’ এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেলেন ডক্টর বোস৷
‘হ্যাঁ, সেই কথাতেই আসছি৷ দিল্লীর এক ছোট অখ্যাত লাইব্রেরীতে হঠাৎই আমার হাতে আসে এক অতি প্রাচীন রসায়নের বই, রসরত্নাকর — লেখক ছিলেন নাগার্জুন৷ বইটি সংস্কৃত ভাষায় লেখা, তবে আমি ছোটবেলায় সংস্কৃত পড়েছিলুম বলে আমার বুঝতে খুব একটা সমস্যা হয়নি৷ যাই হোক, এই নাগার্জুন প্রথম জীবনে ব্রাহ্মণ হলেও পরে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন — তাঁর সময়কাল নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে, মোটামুটি সপ্তম থেকে নবম শতকের কোনও এক সময় গুজরাটে তিনি তাঁর পরীক্ষাগারে বিভিন্ন রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান৷ এই রসরত্নাকর বইয়ে তিনি আচার্য বরাহ-মিহিরের বৃহৎসংহিতা বইটির উল্লেখ করেছেন, এবং সেখানেই রয়েছে এক রহস্যময় ম্যাজিক স্ক্যোয়ার৷ নাগার্জুন সেই সংখ্যার রহস্য ভেদ করার বহু চেষ্টা করেছেন, এবং সব শেষে সাফল্যের মুখ দেখেন এই বঙ্গদেশে এসে৷
‘আচার্য বরাহ-মিহির ছিলেন প্রাচীন ভারতের এক অতি উজ্জ্বল নক্ষত্র — সম্রাট বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার এক রত্ন৷ আর্যভট্টের এই মহান শিষ্য সম্পর্কে জানতে আজ আমরা খুব একটা আগ্রহী নই, প্রায় ভুলেই গেছি৷ তিনি শুধুই প্রখ্যাত জ্যোতিষী ছিলেন না — মহাকাশ গবেষক ছাড়াও ছিলেন একাধারে গণিতজ্ঞ, রসায়নবিদ, স্থাপত্যবিদ, আবহাওয়াবিদ, ভূতত্ত্ববিদ ইত্যাদি ইত্যাদি৷ বর্তমান দিল্লীতে যে মরিচা-রোধক লৌহস্তম্ভ দেখে আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই তা আসলে বরাহ-মিহিরই নির্মাণ করেছিলেন, সম্রাট বিক্রমাদিত্যের আদেশে তিনি এর স্থাপন করেছিলেন উদয়গিরিতে৷ তিনিই প্রথম পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের উল্লেখ করেন, চন্দ্র যে সূর্যের আলোয় আলোকিত তা তিনি সে যুগেই বলে গেছেন, এ-ধরিত্রী যে আসলে গোলাকার তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ ধর্ম তাঁরই আবিষ্কার — সর্বোপরি তিনি টেলিস্কোপ ছাড়াই সে যুগে মঙ্গল গ্রহের ব্যাসের দৈর্ঘ্য মাপতে সমর্থ হয়েছিলেন৷ তাঁর গণনা ছিল প্রায় নির্ভুল, ৩৭৭২ মাইল, যা প্রকৃত দৈর্ঘ্যের অর্থাৎ ৪২১৮ মাইলের খুবই কাছাকাছি ছিল৷ ভারি অবাক হচ্ছেন, না? আমিও যখন প্রথম শুনেছিলাম সত্যি বেশ অবাকই হয়েছিলাম!’
‘হ্যাঁ, অবাক হওয়ারই তো কথা — আমরা ভারতীয়রা সত্যিই এক আত্মবিস্মৃত জাতি৷’ শুনতে বেশ রোমাঞ্চ বোধ হচ্ছিল ডক্টর বোসের৷
‘একদমই তাই৷ যাকগে যা বলছিলাম, আচার্য বরাহ-মিহির অনেকগুলি বই রচনা করেছিলেন — এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বৃহৎসংহিতা৷ এটিকে এক প্রাচীন এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যেতে পারে, সর্বমোট ১০৬টি অধ্যায়, এবং সত্যি বলতে, কি নেই তাতে! তার ৭৬ নম্বর অধ্যায়ে উনি এক ম্যাজিক স্ক্যোয়ারের রচনা করেছেন — এবং আগেই বলেছি, এর উল্লেখ করেছিলেন রসায়নবিদ নাগার্জুন তাঁর রসরত্নাকর বইটিতে৷ চার ঘরের সেই সংখ্যার বর্গক্ষেত্রটি হল —
২, ৩, ৫, ৮এর প্রতিটি রো বা কলামের যোগফল ১৮, এবং দুটি কর্ণের বা ডায়গোনালের সমষ্টিও সেই ১৮৷ এছাড়াও,
৫, ৮, ২, ৩
৪, ১, ৭, ৬
৭, ৬, ৪, ১
বর্গক্ষেত্রের চারটি কৌণিক সংখ্যার (২,৭,১,৮) যোগফল ১৮
কেন্দ্রের ছোট বর্গক্ষেত্রটির (৮, ১, ৭, ২) যোগফল ১৮
প্রথম ও শেষের রো-এর মাঝের দুটি সংখ্যার (৩, ৫, ৬, ৪) যোগফল ১৮
প্রথম ও শেষের কলাম-এর মাঝের দুটি সংখ্যার (৫, ৪, ৩, ৬) যোগফল ১৮
বলা বাহুল্য, এটিই ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন ম্যাজিক স্ক্যোয়ার৷’
‘ভারী অদ্ভুত ব্যাপার তো! কিন্তু কেন এর রচনা করেছিলেন বরাহ-মিহির, এর পেছনে কোনও উদ্দেশ্য ছিল নিশ্চয়ই!’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন ডক্টর বোস৷
‘সেটাই তো রহস্য,’ একগ্লাস জল খেয়ে আবার বলতে শুরু করে ঋজু, ‘‘বৃহৎসংহিতা’র এই ৭৬তম অধ্যায়টির নাম গন্ধ্যোক্তি — নামটি দেখে প্রায় সবারই মনে হয়েছে যে এতে বোধহয় নানাবিধ সুগন্ধি তৈরির প্রণালী বর্ণনা করা আছে৷ আসলে প্রাচীন ভারতের রসায়ন চর্চার আরও একটি অন্য ধারা ছিল, তান্ত্রিক ধারা, যা ছিল মূলতঃ লোকচক্ষুর আড়ালে কিছু মুষ্টিমেয় তান্ত্রিক সাধুদের এক গোপন সাধনার অঙ্গ৷ এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অমরত্ব লাভ, বা সেই সাধুদের ভাষায়, দ্বিতীয় শিবের সৃষ্টি৷ এই তান্ত্রিক মত অনুযায়ী, মার্কারি বা পারদ আসলে দেবাদিদেব মহাদেবের শরীর নিঃসৃত রস — আর তাই পারদকে সেযুগে বলা হত রস৷ তাঁরা এও বিশ্বাস করতেন, গন্ধক বা সালফার এসেছে দেবী পার্বতী বা মহাশক্তির শরীর থেকে৷ এই দুটি পদার্থই ছিল সে যুগের রসায়ন চর্চার অন্যতম উপাদান, বা বলা ভাল, প্রাথমিক উপাদান৷ রসায়নবিদ নাগার্জুনের মতে, এই গন্ধ্যোক্তি নামটির উৎপত্তি আসলে গন্ধক শব্দটির থেকেই৷
‘সে যাই হোক, গন্ধ্যোক্তি অধ্যায়ের ২৩, ২৪, ২৫ ও ২৬ নম্বর শ্লোকে বর্ণিত আছে এক অদ্ভুত দ্রব্য প্রস্তুতির উপায় — যে দ্রব্যটিকে বরাহ-মিহির বলেছেন, সর্বতোভদ্রা৷ নাগার্জুনের মতে, এই সর্বতোভদ্রা আসলে জগতের সমস্ত মৌলিক ধাতুর আদি রূপ, বা মাতৃস্বরূপ, যা থেকে যেকোনও অন্য ধাতুর সৃষ্টি করা সম্ভব — এমনকি সোনাও৷ মোট আটটি উপাদানকে নানা প্রক্রিয়ায় মিশিয়ে, প্রকৃতির মূল উপাদান ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম-এর সাহায্যে এক কঠিন প্রণালীতে এই সর্বতোভদ্রা প্রস্তুত করা সম্ভব৷’ একটু থেমে ডক্টর বোসের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে ঋজু৷
‘এবার ব্যাপারটা গাঁজাখুরি গল্পের দিকে যাচ্ছে, নিঃসন্দেহে ইন্টারেস্টিং, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য নয়৷’ একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ে সায়ন্তন বসুর গলায়৷
‘হ্যাঁ ঠিক, অ্যালকেমিস্টদের এই অমরত্বের চেষ্টা এবং সোনার পেছনে দৌড়নো সুবিদিত ও বহুচর্চিত, আপনার অবিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে — আমিও ওখানেই থেমে গেলে হয়তো আজ এই অবস্থায় পড়তে হত না৷’ অদ্ভুত এক যন্ত্রণা মিশে ছিল ঋজুর গলায়৷ সে বলে চলে— ‘বরাহ-মিহির তাঁর ম্যাজিক স্ক্যোয়ারের একেবারে কেন্দ্রের ছোট বর্গক্ষেত্রটির (৮, ১, ৭, ২) ওপর অত্যধিক জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনও অজানা কারণবশতঃ সর্বতোভদ্রা তৈরির সম্পূর্ণ প্রণালীটি এড়িয়ে গেছেন৷ তবে তিনি রহস্য করে বলেছেন — ধাতুর এ লীলা শুধু জানে লীলাবতী৷ মানে কি, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর? বলা বাহুল্য, নাগার্জুন যখন রসায়ন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তখন বরাহ-মিহির যুগ অতিক্রান্ত — কিন্তু তবুও তিনি হাল ছাড়েননি৷ তাঁর মনে হয়েছিল, এই ১-৮ সংখ্যা এবং যোগফল ১৮ ধরে ম্যাজিক স্ক্যোয়ার রচনা — এ সবের কোনও উদ্দেশ্য আছে৷ তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল, আচার্য বরাহ-মিহির এক সুপ্রাচীন পর্যায় সারণী বা পিরিয়ডিক টেবিল-এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন — এবং তিনি দেবী লীলাবতীর থেকেই এবিষয়ে শিক্ষালাভ করেন৷ সে সময় দেবী লীলাবতী বা খনা বাস করতেন তখনকার বাংলার গঙ্গারিদয়-এ, নাগার্জুনও আর দেরী না করে গুজরাট থেকে পাড়ি দেন এই বাংলায়৷ যদিও বরাহ-মিহিরের মতই লীলাবতীর যুগও অতিক্রান্ত, কিন্তু নাগার্জুন বহু পরিশ্রম ও চেষ্টায় উদ্ধার করেন সেই গুপ্তবিদ্যা, এবং সফল হন সর্বতোভদ্রা প্রস্তুত করতে — আর হ্যাঁ, অবশ্যই তা থেকে স্বর্ণ-ধাতুর সৃষ্টি করতে!’
ডক্টর বোস অনেকক্ষণ থেকেই উসখুস করছিলেন, শেষে বলেই ফেললেন — ‘কিন্তু ঋজু, বরাহ-মিহির খামোখা এত রহস্য করলেন কেন? সরাসরি পুরো প্রক্রিয়াটিই তো লিখে যেতে পারতেন তাঁর বৃহৎসংহিতায়?’
‘হয়ত তিনি চাননি যে সবাই এ বিদ্যা সহজেই আয়ত্ত করুক, অথবা কারও নিষেধ থাকতে পারে — তবে মনে হয় তিনি এটাও চাননি যে এই প্রাচীন বিদ্যা হারিয়ে যাক একদিন এই দেশ থেকে৷ কেন হঠাৎ খুব ঘুম পাচ্ছে আমার...চোখ খুলে রা..খ..তে পা..র..ছি না..’ বলে প্রায় ঢলেই পড়ল ঋজু৷
লোক ডেকে আনলেন ডক্টর বোস, তারা ধরাধরি করে ঋজুকে নিয়ে গেল ঘরে৷ ভ্রু কোঁচকান ডাক্তারবাবু — ড্রাগের ডোজটা কি বেশী হয়ে যাচ্ছে! নিষিদ্ধ ড্রাগ দিতে শুরু করেছেন তিনি, এছাড়া ঋজুর পেট থেকে কথা বার করার আর কোনও উপায় ছিল না — তিনি ওসব তথাকথিত ডাক্তারি নীতিতে বিশ্বাস করেননা৷
|| ৫ ||
নাহ, আবার বরাহ-মিহিরকে ফিরে আসতেই হল গঙ্গারিদয় — তিনি নিশ্চিত, দেবী লীলাবতী তাঁকে ভূতত্ত্ব, আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও ধাতুবিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শী করে তুললেও এক বিশেষ বিদ্যা সন্তর্পণে গোপন করে গেছেন৷ সেবার এনগরে পদার্পণ করেই দেবীর কাছে আচার্য আর্যভট্টের চিঠিটি তুলে দিয়েছিলেন তিনি, করজোড়ে প্রার্থনা করেছিলেন বিদ্যাদানের৷ লীলাবতী তাঁর জ্যোতিষ, মহাকাশ গবেষণা ও গণিতের বিভিন্ন ধারায় কাজ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন — অবশ্য সম্রাট বিক্রমাদিত্যের ইচ্ছা তাঁদের সবার কাছে আদেশেরই নামান্তর৷ তাই দেবী আর দুবার ভাবেননি, দীর্ঘ তিন বছরে তাঁরা একে অপরের বিবিধ বিষয়ের গবেষণা থেকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছেন৷ লীলাবতীর মৌলিক ধাতু নিষ্কাশন ও তার পরবর্তী শোধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে গভীর জ্ঞান তাঁকে বিস্মিত করেছে৷ বরাহ-মিহির লোহার শুদ্ধিকরণ ও বিভিন্ন পদার্থের পারস্পরিক বিক্রিয়া বিষয়ে অধ্যয়ন করেছেন, বিশেষ করে মরিচা-রোধক লোহার খুঁটিনাটি জানা ছিল একান্তই প্রয়োজন৷ তিনি হাতে-কলমে শিখেছেন কিভাবে ধাতুর উপর এক নিষ্ক্রিয় পাতলা স্তরের সৃষ্টি করে তাকে জলবায়ুর আক্রমণ থেকে বাঁচানো যেতে পারে৷
বরাহ-মিহির ফিরে গেছিলেন উজ্জয়িনী, এবং ধাতুকারদের সঙ্গে মিলিয়ে বানিয়েছিলেন লোহার এক অভূতপূর্ব স্তম্ভ, মেরু স্তম্ভ — যা সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে উদয়গিরিতে৷ অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সম্রাট বিক্রমাদিত্যকে আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি — কালের ভ্রূকুটি অগ্রাহ্য করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে এই মেরু স্তম্ভ, গর্বের সাথে প্রচার করবে সম্রাটের গুণগান৷ তিনি দেবীর কথায় লোহার সাথে মিশিয়েছিলেন আভর্তকী-র ডাল, যা এই মেরু স্তম্ভকে মরিচার হাত থেকে রক্ষা করে প্রদান করবে অমরত্ব৷ কিন্তু লীলাবতী কি শুধু ধাতুকেই অমরত্ব প্রদান করতে পারেন? নাকি মনুষ্য জাতির ধীর গতিতে মৃত্যুর দিকে যাত্রাও তিনি রোধ করতে পারেন! অথবা কি সে এমন জিনিস, যা দেবী গোপন রাখতে বদ্ধপরিকর — যে জ্ঞানের অমোঘ আকর্ষণে তিনি আজ আবার এ শহরে!
বঙ্গদেশের এই বন্দর শহরকে বড় ভালবেসে ফেলেছেন বরাহ-মিহির — সৎ সহজ-সরল মানুষ, ধর্মপ্রাণ ও সংস্কৃতিবান৷ আগাগোড়া সুউচ্চ দেওয়াল দিয়ে ঘেরা এ শহর বড়ই সুরক্ষিত৷ এখানকার অনেকেই মৃৎশিল্পে বেশ নাম করেছেন, পোড়ামাটির কিছু অপরূপ সুন্দর কাজ দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছেন৷ শহরে পদার্পণ করে প্রথম রাতটি এক পান্থশালায় কাটিয়ে পরদিন সকালেই দেবী লীলাবতীর কাছে হাজির হলেন বরাহ-মিহির — মনে আশঙ্কা, যদি ক্ষুব্ধ হন দেবী তাহলে তাঁর আশা আর পূর্ণ হবে না এ জীবনে৷ লীলাবতী তখন ফিরছিলেন... সম্ভবতঃ বিষ্ণুমন্দির থেকে —
‘একি...বরাহ-মিহির....এ অসময়ে? হঠাৎ কি কারণে আগমন হে আচার্য?’ বিস্ময় ঝরে পড়ছিল দেবীর দুচোখে৷
‘আমি অত্যন্ত ক্ষমাপ্রার্থী দেবী, জানি এভাবে বিনা বার্তায় হঠাৎ আগমনে আপনি বিব্রত, আমায় মার্জনা করুন৷ আমি এসেছি আমার অসমাপ্ত শিক্ষা সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে, দয়া করে আমায় ফিরিয়ে দেবেন না৷’ অনুনয়ের সুরে বললেন বরাহ-মিহির৷
‘আপনার পুনরায় আগমনে আমি সত্যিই বিস্মিত — আপনার ধাতুবিদ্যা-লাভ সম্পূর্ণ আচার্য, আমার আর শেখানোর কিছু নেই৷ তাছাড়া শুনেছি আপনার সাহায্যে সম্রাট ইতিমধ্যেই মেরুস্তম্ভের নির্মাণ করেছেন — তা স্থাপনও করা হয়েছে উদয়গিরিতে৷ সম্রাট আর কি আশা করেন আমার কাছ থেকে?’ কিঞ্চিৎ যেন অসহিষ্ণু লাগে দেবীকে৷
‘মার্জনা করবেন দেবী, এবার প্রয়োজনটা সম্পূর্ণই আমার৷’ নীচের দিকে চেয়ে কুণ্ঠাভরে বললেন আচার্য — ‘গঙ্গারিদয়ে বিষ্ণুমন্দিরের দেওয়ালে লক্ষ্য করেছি এক বিচিত্র পর্যায়-সারণী এবং তাতে উল্লিখিত বিবিধ উপাদানের নাম৷ পোড়ামাটির কারুকার্যের মাঝে এক জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়া বর্ণিত আছে, যা আমার চোখ এড়ায়নি৷ ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠীতে বেশীরভাগ নির্দেশ লেখা হলেও, আমি নিশ্চিত সেটি ছিল আসলে ধাতুর মৌলিক গঠন পরিবর্তন প্রক্রিয়া৷ আমায় ভুল বুঝবেন না দেবী — এ এক অত্যন্ত কঠিন ও জটিল রসায়নবিদ্যা, যে বিদ্যালাভ থেকে আমায় বঞ্চিত করবেন না৷’ করজোড়ে দেবীকে অনুরোধ করলেন আচার্য বরাহ-মিহির৷
লীলাবতীর চোখে মুখে অনেকগুলি অভিব্যক্তি পরপর খেলে গেল, তিনি বেশ ক্ষুব্ধই হলেন৷ গ্রীষ্ম যেন দরজায় কড়া নাড়ছে, মধ্যাকাশে সূর্যদেবের প্রবল পরাক্রম সহজেই অনুভূত হয় —নীচে মর্ত্যে দেবী ও আচার্য এক কঠিন বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লেন৷ অবশেষে মন গলল লীলাবতীর, এ বিদ্যা প্রদানে তিনি সম্মত হলেন — কিন্তু বরাহ-মিহিরকেও করতে হল এক কঠিন প্রতিজ্ঞা৷ তিনি দেবীকে কথা দিলেন যে কোনওদিন কাউকে এ বিদ্যা শেখাবেন না, প্রয়োজনে একমাত্র চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাজেই ব্যবহার করতে পারবেন এই গুপ্তবিদ্যা৷
এরপর বিষ্ণুমন্দিরের গোপন কক্ষে শুরু হল তোড়জোড়, বহুকষ্টে সংগৃহীত হল সমস্ত উপাদান৷ বৈশাখী পূর্ণিমার দ্বিপ্রহরে যজ্ঞকুণ্ডে অগ্নিসংযোগ করলেন দেবী লীলাবতী৷ মন্দির গাত্রে বর্ণিত নির্দেশগুলি পালন করা হল অক্ষরে অক্ষরে, অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে৷ নয়-দিন ধরে চলল এই জটিল প্রক্রিয়া — রসদ সংগ্রহ করা হল ব্রহ্মাণ্ডের আদি উপাদান ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম থেকে৷ দেবীর আবহাওয়ার পূর্বাভাস নির্ভুল, দশম দিনে আকাশ কালো করে হল মেঘের সঞ্চার, সমাপ্ত হল পুরো প্রক্রিয়া৷ একাদশীর প্রভাতে অগ্নিকে প্রণাম করে নির্বাপিত হল যজ্ঞের আগুন — ছাই সরাতেই আচার্যের চোখ যেন ধাঁধিয়ে গেল৷ নতুন সূর্যের আলো দেখেছে সদ্য ভূমিষ্ঠ স্বর্ণখণ্ডটি, এক স্বর্গীয় নরম আলো তার সারা গায়ে৷ বাকরহিতশূন্য বরাহ-মিহির আনন্দে কেঁদে ফেললেন — এও কি সম্ভব! জয়ের অশ্রু যেন আজ দেবীর চোখেও৷
|| ৬ ||
সম্রাটের পত্রখানা হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে গেছিলেন দেবী লীলাবতী৷ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বিক্রমাদিত্য তাঁকে পত্রপাঠ উজ্জয়িনী আসার অনুরোধ করেছেন৷ কিন্তু সম্রাটের তাঁকে হঠাৎ কি প্রয়োজন? তিনি এই গঙ্গারিদয়-এ বসে বহু বিষয়ে চর্চা করেন, গুণী সমাজে তাঁর যথেষ্ট কদর৷ তবে রাজ অনুরাগের জন্য কোনওদিনই ব্যস্ত হননি, তিনি সেসবে একেবারেই নির্লিপ্ত৷ তাহলে সম্রাটের এহেন জরুরী তলব কেন? এর সাথে কি কোনওভাবে আচার্য বরাহ-মিহির জড়িত? তাই হবে হয়তো, নাহলে সম্রাটের নজরে তো পড়ার কথা নয়!
কিন্তু যেটা চিন্তার, সম্রাট সাথে লোক-লস্কর পাঠিয়ে দিয়েছেন — একটি সুসজ্জিত নৌকা অপেক্ষা করছে বন্দরে৷ অর্থাৎ তিনি যেন পালাতে না পারেন — এতো একপ্রকার তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া! তাহলে কি তাঁর স্বর্ণ-ধাতু উৎপাদন প্রক্রিয়া আজ আর গোপন নেই? সম্রাট কি তাঁর রাজকোষ ভরার পরিকল্পনা করেছেন? কিন্তু আচার্য যে এ বিদ্যা গোপন রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তিনি কি সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছেন? লীলাবতী তাঁকে শুধু সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি হাতে-কলমে করে দেখিয়েছেন, বিভিন্ন উপাদান ও তার আনুপাতিক পরিমাণ জানাননি৷ তবে কি রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে তিনি তা বলপূর্বক আদায় করতে চান? না! তিনি কোনওমতেই সাহায্য করবেন না — তাতে প্রাণ গেলে যাক৷ প্রকৃতি যা সম্পদ দিয়েছে তাতেই সবাইকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে — নচেৎ বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী৷ কিন্তু সম্রাট বিক্রমাদিত্যের আদেশ অমান্য করা অসম্ভব, যাত্রার জন্য তৈরি হয়ে নিলেন লীলাবতী৷ এক পুণ্যক্ষণে জন্ম হয়েছিল তাঁর, তাই পিতা তাঁর নাম রেখেছিলেন খনা৷ জানা নেই, এই মুহূর্তটি তাঁর জীবনে আর এক সন্ধিক্ষণ কিনা৷
বেশ কয়েকদিন কেটে গেল, উজ্জয়িনী নগরে যখন পা রাখলেন লীলাবতী তখন প্রায় সন্ধ্যা৷ তাঁর আদর যত্নের কোনও ত্রটি হয়নি — উজ্জয়িনী পৌঁছেও পেলেন উষ্ণ অভ্যর্থনা৷ সে রাত্রি বিশ্রাম নিলেন তিনি, ব্যবস্থা করা হয়েছিল রাজপ্রাসাদেই৷ দেবী এত বিশাল প্রাসাদ বাস্তবে কেন স্বপ্নেও দেখেননি৷ কিঞ্চিৎ কুণ্ঠাই বোধ করছিলেন লীলাবতী, হঠাৎ এক গলার আওয়াজ পেয়ে সচকিত হলেন৷ এ গলা তিনি বিলক্ষণ চেনেন! আচার্য বরাহ-মিহির!
‘দেবী, অসময়ে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত — এতটা পথ যাত্রা করে আপনি নিশ্চয়ই অত্যন্ত ক্লান্ত৷ তবুও আপনার সাথে দেখা করার একান্ত প্রয়োজন ছিল, কারণ পরে আর হয়ত সুযোগ পাবনা৷’ বলে এক মুহূর্ত থামলেন বরাহ-মিহির৷
‘আমি মর্মাহত আচার্য, আপনি প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করেছেন৷ আমি নিশ্চিত, আপনি সম্রাটকে আমাদের রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে অবহিত করেছেন, আপনি পথভ্রষ্ট হয়েছেন৷’ লীলাবতী তাঁর ক্ষোভ চাপার কোনও চেষ্টা করলেন না৷
‘এ জন্যই আমার আসা জরুরী ছিল দেবী, আপনার ধারণা ভুল৷ তবে এটা সর্বৈব সত্য, সম্রাট গঙ্গারিদয়-এর সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে অবগত আছেন৷ আমি নিশ্চিত, অন্য কোনও সূত্রে এ সংবাদ পৌঁছেছে তাঁর কানে৷ দেবী, আপনাকে উজ্জয়িনীতে ডেকে আনার পিছনে সম্রাটের কি উদ্দেশ্য আমি জানিনা — তবে আমার অনুরোধ, তাঁর কাছে এ ঘটনা গোপন করার কোনও চেষ্টা করবেন না৷’ সাবধানী গলায় বললেন আচার্য৷
‘আমি যা কঠোর পরিশ্রম করে আয়ত্ত করেছি তা একান্তই আমার, সে সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও শুধু আমার৷ আমি পথশ্রমে ক্লান্ত আচার্য, একটু বিশ্রাম নিতে চাই৷’ দেবীর ইঙ্গিত স্পষ্ট, তাই বরাহ-মিহির আর বিরক্ত করলেন না৷
পরদিন প্রভাতকে ঠিক সুপ্রভাত বলা যায় কিনা জানেন না লীলাবতী৷ সুউচ্চ রাজপ্রাসাদটি উজ্জয়িনী নগরের পশ্চিমে, সকালের সূর্যোদয় আলস্যভরে উপভোগ করলেন তিনি৷ দালানের পাখির দল যেন তাঁকে সাবধান করে দিতেই জড়ো হয়েছে, তাদের কল-কাকলিতে বিপদের পূর্বাভাস৷ হয়তো কেউ কেউ উড়ে এসেছে সেই সুদূর বঙ্গদেশ থেকে, গঙ্গারিদয়ের বিষ্ণুমন্দিরেই হয়তো তাদের দীর্ঘদিনের বাস৷ আর ভাবলেন না দেবী — স্নান সেরে পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিলেন৷ রাজবাড়ীর প্রাতঃরাশ তাঁর মুখে আর রুচল না৷ সম্রাট বিক্রমাদিত্য তলব করেছেন, সূর্যপ্রণাম সেরে ধীর পায়ে রওনা হলেন লীলাবতী৷
ভারত-শ্রেষ্ঠ পরাক্রমী সম্রাট বিক্রমাদিত্যকে এই প্রথম সামনা-সামনি দেখলেন লীলাবতী৷ আচার্য বরাহ-মিহিরও সেখানে উপস্থিত৷ সাধারণ সৌজন্য বিনিময়ের পর সম্রাট আসল কথায় এলেন — ‘দেবী লীলাবতী, আমার সাম্রাজ্যে কোথায় কি ঘটছে তা জানা আমার অত্যন্ত প্রয়োজন —এক শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধশালী ভারত গড়ে তোলাই আমার লক্ষ্য৷ ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদে চতুর্দিকে সুখ ও শান্তি বিরাজমান৷ অকৃপণ প্রকৃতি দুহাত ভরে বিলিয়েছে তার সম্পদ, এ দেশে ভগবানের কৃপায় অভাব তো কিছু নেই!’ এক মুহূর্ত থামলেন সম্রাট, যেন লীলাবতীর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছেন৷
‘আমি সম্পূর্ণ একমত, হে সম্রাট বিক্রমাদিত্য! আপনার ছত্রছায়ায় আমরা অত্যন্ত সুরক্ষিত —সুখ ও শান্তি সর্বত্র বিরাজমান!’ সম্রাটের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করলেন লীলাবতী৷
‘তাহলে দেবী, আপনি ভগবান বিষ্ণুর সৃষ্টি এই ধরিত্রীর নিয়ম ভাঙলেন কেন? আমি গুপ্তচর মারফত আপনার সাম্প্রতিক গবেষণা সম্পর্কে অবহিত হয়েছি৷ আপনি প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন, মৌলিক ধাতুর চরিত্র বদলে সচেষ্ট হয়েছেন — এমনকি কৃত্রিমভাবে স্বর্ণ-ধাতুর উৎপাদনেও প্রবৃত্ত হয়েছেন৷ দেবী লীলাবতী, আপনার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নিয়ে আমার কোনও সংশয় নেই, আপনি ভারতবর্ষের গর্ব৷ কিন্তু একাজ আপনাকে বন্ধ করতেই হবে৷ এভাবে কৃত্রিম স্বর্ণ-ধাতু দেশে সুলভ হয়ে পড়লে গোটা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে, অস্থিরতা দেখা দেবে৷ আপনি সৃষ্টির নিয়মগুলি লঙ্ঘন করতে পারেন না দেবী৷’ সম্রাটের কণ্ঠে আদেশের সুর৷
‘হে সর্বশক্তিমান সম্রাট, রসায়নের এ জ্ঞান বহু প্রাচীন৷ গঙ্গারিদয়ের বিষ্ণুমন্দিরে এ বিষয়ে প্রাচীন ভারতীয় ভাষায় সমস্ত বর্ণিত আছে৷ আমি তার মর্মোদ্ধার করি মাত্র, এবং সে বিদ্যা সফল ভাবে প্রয়োগ করি৷ রসায়নশাস্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে চিকিৎসাশাস্ত্রে — তা চর্চায় বাধা দেবেন না সম্রাট৷
‘তবে আমি একটি বিষয়ে সহমত পোষণ করি, কৃত্রিম উপায়ে স্বর্ণ-ধাতুর উৎপাদন বন্ধ হওয়া উচিত৷ ভারতবর্ষে এই বিদ্যা আর কারও জানা নেই, আচার্য বরাহ-মিহিরও পুরো প্রক্রিয়াটি জানেন না৷ আমি কথা দিচ্ছি, এর চর্চা আমি আর কোনওদিন করব না৷’ সম্রাটকে আশ্বস্ত করেন লীলাবতী৷
‘হে দেবী, আপনি যে এ বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছেন তা দুর্ভাগ্যবশতঃ আজ অনেকেই জানেন — এমনকি ভারতের বাইরেও৷ এই বিদ্যা আয়ত্তে আনার জন্য আপনার ওপর নিষ্ঠুরভাবে বলপ্রয়োগ হতে পারে, আপনার নিরাপত্তা নিয়ে আমি গভীর চিন্তিত৷ আপনিই বরং কোনও উপায় বলুন আমায় যাতে এ বিদ্যা আর কেউ কোনওদিন না জানতে পারে৷’ উদ্বিগ্ন দেখায় সম্রাটকে৷
কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন দেবী লীলাবতী — সময় বোধহয় থমকে গেছিল, চারিদিকে বিরাজ করছিল এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা৷ তাঁর মনের ভেতর যে তুমুল ঝড় উঠেছিল তা একসময় স্তিমিত হয়ে এল৷ ভরাট বিষণ্ণ গলায় বলে উঠলেন খনা — ‘আমি যদি বাকশক্তি হারাই, আমার যদি কণ্ঠরোধ হয়, একমাত্র তা হলেই এ বিদ্যা চিরতরে হারিয়ে যাবে — কালেরই নিয়মে’ বলেই চকিতে দেবী পাশের প্রহরীর কোমর থেকে ছিনিয়ে নিলেন ধারাল ছুরিখানা৷ হঠাৎ এক বিদ্যুতের ঝলক, মুহূর্তেই ভূপতিত হলো তাঁর কর্তিত জিহ্বা৷
ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে গেছিলেন সম্রাট, সম্বিৎ ফিরল আচার্যের ভয়ার্ত চীৎকারে৷ রক্তাক্ত দেবীর চিকিৎসায় ছুটে এলেন রাজ্যের শ্রেষ্ঠ কবিরাজ, কয়েকদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেবী ফিরে পেলেন জীবন — কিন্তু চিরকালের মত হারালেন তাঁর বাকশক্তি৷ প্রবল পরাক্রমী সম্রাটেরও যেন আজ চোখের কোণে জল — এছাড়া আর কোনও সমাধানের উপায় কি সত্যিই ছিল না?
এ ভয়াবহ ঘটনার পর কিছুদিন কেটে গেছে — বরাহ-মিহিরের বিবাহ প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন দেবী লীলাবতী, উজ্জয়িনী নগরেই বসবাস করতে লাগলেন তাঁরা দুজনে৷ ওদিকে সম্রাটের নির্দেশে গঙ্গারিদয়ের বিষ্ণু মন্দির পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হল, যা কালের নিয়মে এক নতুন নাম পেল — খনা-মিহিরের ঢিবি৷
|| ৭ ||
‘আপনি চন্দ্রকেতুগড়-এর নাম শুনেছেন? গিয়েছেন সেখানে কোনওদিন?’
কোনও ভূমিকা না করেই প্রশ্নটা ডক্টর বোসের দিকে একরকম ছুঁড়ে দিল ঋজু৷ আজ সায়ন্তনবাবু একটু তাড়াতাড়িই এসেছেন হাসপাতালে৷ তাঁর ধারণা, ঋজু সত্যিই প্রাচীন রসায়নবিদ নাগার্জুনের ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিল, এবং একাজে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছিল৷ কিন্তু তার মানসিক অসুস্থতার কি কারণ হতে পারে? সে কি সোনা তৈরিতে বিফল হয়েছিল, আর তাতেই একেবারে ভেঙে পড়েছিল? নাকি একেবারেই উল্টোটা ঘটেছিল! কিন্তু একাজে সফল হওয়ার ব্যাপারটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়৷ আজই হয়ত আসল ব্যাপারটা জানা যেতে পারে — আর তা আন্দাজ করেই তাঁর তাড়াতাড়ি চলে আসা৷ মনে হল ঋজুও যেন তাঁর জন্যই অপেক্ষা করেছিল, ঘরে ঢুকতেই বেমক্কা হঠাৎ প্রশ্নটা করে বসে৷ সে তাঁকে সত্যি বিশ্বাস করে, এবং যে ঘটনা কাউকেই বলতে পারেনি, অথচ না বললেও তার শান্তি নেই, তা তাঁকেই বলে মুক্ত হতে চায়৷
‘চন্দ্রকেতুগড়? নাম শুনে তো কোনও পৌরাণিক যুগের শহর মনে হচ্ছে ঋজু! কোথায় বলো তো?’ কৃত্রিম উৎসাহ দেখিয়ে বললেন ডক্টর বোস৷
‘হ্যাঁ, তা ঠিক — বাংলায় উত্তর চব্বিশ পরগণার এই বন্দর শহর আসলে বহু প্রাচীন, খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকেরও আগে, মানে সেই মৌর্য যুগের-ও আগে ছিল এর অস্তিত্ব৷ গ্রীক-রোমানরা প্রথম এ শহরের কথা জানতে পারে টলেমির লেখায়, তখন এর নাম ছিল গঙ্গারিদয়৷ বাণিজ্যের সূত্রে পৃথিবীর বহু উন্নত দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল এই চন্দ্রকেতুগড়ের৷ রোমান যুগের মুদ্রা, বিক্রমাদিত্যের নামাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা ও আরও অনেক বহুমূল্য পুরাতাত্ত্বিক জিনিসের খোঁজ মেলে এখানে৷ গুপ্তযুগে এই শহরেই বসে জ্যোতিষ, গণিতশাস্ত্র ও আরও নানা বিষয়ের ওপর চর্চা করতেন দেবী লীলাবতী বা খনা৷ শুনলে হয়ত অবাক হবেন, প্রখ্যাত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৯ সালে চন্দ্রকেতুগড় পরিদর্শনে আসেন, এবং এ বিষয়ে তাঁর একটি লেখাও বেরোয় মাসিক বসুমতী পত্রিকায়৷ তাঁর হাতে এমন কিছু প্রমাণ এসেছিল যে তিনি নিশ্চিতভাবে বলতে পেরেছিলেন — খনা-মিহিরের ঢিবি আসলে এক প্রাচীন বিষ্ণুমন্দির৷ নাগার্জুনের গঙ্গারিদয়ে বিষ্ণুমন্দিরের বর্ণনা; বরাহ-মিহিরের বৃহৎসংহিতায় দেবী লীলাবতীর উল্লেখ; চন্দ্রকেতুগড়ের খনা-মিহিরের ঢিবি; এবং রাখালদাসের বিষ্ণুমন্দিরের কথা — সব কেমন যেন মিলে যাচ্ছিল৷ বুঝলুম, একবার সেখানে যাওয়া একান্তই দরকার৷
‘২০১০ সালের জানুয়ারিতে আমি গিয়ে হাজির হই চন্দ্রকেতুগড়ে, এবং প্রথমেই যাই খনা-মিহিরের ঢিবি-তে৷ জায়গাটা এখন এক ধ্বংসস্তূপ — এখানে যে একদিন এক বিষ্ণুমন্দির ছিল, এবং সেখানে খনা ও বরাহ-মিহির একত্রে জটিল রসায়নশাস্ত্রের চর্চা করতেন, তা বোঝার কোনও উপায় নেই আজ৷ কিন্তু নাগার্জুন এখানেই খুঁজে পেয়েছিলেন এমন কিছু যা তাঁকে বরাহ-মিহিরের ম্যাজিক স্ক্যোয়ার রহস্য সমাধানে সাহায্য করেছিল, তিনি শেষপর্যন্ত গবেষণায় সফল হতে পেরেছিলেন৷ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম জোগাড় করে আমি একদিন কোমর বেঁধে খননকার্যে নেমে পড়লুম, কিন্তু কপাল খারাপ — সে অঞ্চলের মানুষজন আমায় বাধা দিলেন৷ ঘটনাচক্রে তখন আমার সাথে পরিচয় হয় জনৈক চঞ্চল দাশ মহাশয়ের, যিনি ঐ অঞ্চলের এক প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রাহক এবং নিজের একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় সমস্ত পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রীর রক্ষণাবেক্ষণ করেন৷ আমিও একদিন গেলুম তাঁর মিউজিয়ামে — কথায় কথায় হঠাৎই চঞ্চলবাবু কিছু রহস্যময় পোড়ামাটির টালি দেখান আমায়, তাতে দেখি প্রাচীন ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠীতে কিছু সাংকেতিক নির্দেশ দেওয়া আছে৷ ঠিক পড়তে না পারলেও ছবি দেখেই বুঝতে পারলুম, যা খুঁজছি তা পেয়ে গেছি৷ চঞ্চলবাবু জ্ঞানী লোক, এ ভাষার মানে বুঝিয়ে দিলেন আমায় — যদিও তাঁর বদ্ধধারণা, এগুলি কোনও দেবের আরাধনা বা যাগযজ্ঞের প্রক্রিয়া৷ আমিও তাঁকে আর কিছু ভেঙে বললুম না, বরং গোপনে পরীক্ষা চালাবার প্রস্তুতি নিলাম৷
‘আপনাকে আগেই বলেছিলাম, পারদ এবং গন্ধক হচ্ছে প্রাচীন রসায়নশাস্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাথমিক উপাদান — এদের বৈশিষ্ট্য যেন অনেকটা আগুন এবং জলের মত৷ সঠিক অনুপাতে মেশালে সে মিশ্রণ কৃত্রিম ভাবে সোনা বা যে কোনও ধাতু তৈরির মূল বীজ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে৷ এই দর্শনটা অনেকটা সেই দই তৈরির মত, একটু পুরনো দই দুধে মিশিয়েই যেমন তৈরি হয় নতুন দই, তেমনই অ্যালকেমিকাল সোনা যদি পারদের মধ্যে ইনজেক্ট করা হয় তবে সে মিশ্রণ আবার নতুন বিশুদ্ধ সোনার জন্ম দেয়৷ এই পারদকে সর্বপ্রথম ১৮টি উপায়ে বা খনার ভাষায় সংস্কার দ্বারা শুদ্ধ করতে হবে — স্বেদন, মর্দন, মূর্ছন, উত্থাপন, পাতন, রোধন, নিয়মন, দীপন, গ্রসমান, চারণ, গর্ভদ্রুতি, জারণ, বাহ্যদ্রুতি, রঞ্জন, সরণ, ক্রামন, বেধ ও ভক্ষণ৷ কৃত্রিম স্বর্ণ-ধাতু তৈরির পুরো প্রক্রিয়া বা রসার্ণভকল্প-টি মোট তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে — রসায়নোৎপত্তি, রসপ্রক্রিয়া ও কল্পপ্রভাগ৷ এবার বরাহ-মিহিরের ম্যাজিক স্ক্যোয়ারে আসা যাক — সেই টেরাকোটার কাজ করা টালিতে তাদের নাম পাওয়া গেল :
১—রস, ২—নাগ, ৩—নরসার, ৪—মাক্ষিক, ৫—কান্ত, ৬—হিঙ্গুল, ৭—অভ্র ও ৮—গন্ধক৷
রস মানে যে পারদ তা আগেই বলেছি, বাকিগুলো বিভিন্ন পদার্থের প্রাচীন নাম, যেমন ধরুন নাগ হল সীসা বা লেড৷ এবার মনে করে দেখুন ম্যাজিক স্ক্যোয়ারের কেন্দ্রে কি কি সংখ্যা আছে — ৮-১-৭-২, অর্থাৎ ৮/১৮ভাগ গন্ধক, ১/১৮ভাগ পারদ, ৭/১৮ভাগ অভ্র ও ২/১৮ভাগ সীসা পরপর মিশিয়ে তৈরি করতে হবে মূল বীজটি৷ মিশ্রণটি তৈরির জন্য নানা যন্ত্রের উল্লেখ ছিল সে মন্দির গাত্রে — যেমন শিলা যন্ত্রম, বংশ যন্ত্রম, নালিকা যন্ত্রম, দোলা যন্ত্রম, নিয়ামক যন্ত্রম, গমন যন্ত্রম, পতন যন্ত্রম, তুলা যন্ত্রম, চাকি যন্ত্রম, বালুকা যন্ত্রম, অগ্নিসোম যন্ত্রম ইত্যাদি ইত্যাদি৷ প্রাকৃতিক এই যন্ত্রগুলি শুধু যে তার নির্দিষ্ট কাজটিই করত তা নয়, এগুলির থেকে অনেক উপাদান এসে মিশত মূল রাসায়নিক মিশ্রণটিতে, যেমন ধরুন বাঁশ৷ মূল বীজটি তৈরি হওয়ার পর তাতে বরাহ-মিহিরের সেই ম্যাজিক স্ক্যোয়ারের সংখ্যাগুলি অনুযায়ী বিভিন্ন উপাদান সঠিক অনুপাতে মেশাতে হবে, মনে রাখতে হবে সে সংখ্যাগুলির যোগফল যেন সর্বদা ১৮ হয়৷ মন্দিরের গায়ে ব্রাহ্মী সাংকেতিক লিপি পড়ে অবশেষে উদ্ধার করা গেলপবিত্র সর্বোতভদ্রাতৈরির মূল প্রক্রিয়াটি৷ আগেই বলেছি, এই সর্বোতভদ্রা থেকেই কৃত্রিম ভাবে যেকোনও ধাতুর সৃষ্টি সম্ভব, এবং ঠিক দই বানানোর মতই সেই ধাতুটিও এক উপাদান হিসেবে এ মিশ্রণে যোগ করতে হবে৷ এবার সোনা তৈরি করতে হলে সর্বোতভদ্রা’য় একে একে সঠিক অনুপাতে মেশাতে হবে — রসক, শিলা, শুল্ভ, তালক, টঙ্কন, তাপ্য়, তুত্থ ও অতি অবশ্যই আসল খাঁটি সোনা — যা প্রথমে এক বিশেষ উপায়ে শুদ্ধ করে নিতে হবে৷’ একটানা অনেকক্ষণ কথা বলায় হাঁপিয়ে উঠল ঋজু, বোধহয় দম নিতেই থামল সে৷
‘উপাদানগুলির প্রাচীন নাম তো বেশ খটমটে, ঋজু! এগুলো ঠিক কি পদার্থ বলো তো!’ অবশেষে যেন কথা বলার সুযোগ পেলেন ডক্টর বোস৷
‘হ্যাঁ, তা সত্যি, যেমন শুল্ভ হল তামা; টঙ্কন-এর ইংরেজি নাম বোরাক্স; তুত্থ আসলে হল কপার সালফেট; সমস্ত উপাদানগুলির প্রচলিত নাম ও রাসায়নিক নাম আমার খাতায় লেখা আছে, আপনি দেখতে পারেন৷’ বলে একটা খবরের কাগজের মলাট দেওয়া মোটা খাতা ডক্টর বোসের দিকে এগিয়ে দিল ঋজু৷ এই প্রথম খাতাটা হাতে পেলেন ডাক্তারবাবু, মানে ঋজুর সম্পূর্ণ আস্থা এতদিনে বোধহয় অর্জন করতে পারলেন তিনি৷ এক অদ্ভুত গন্ধ খাতাটিতে, নেশাগ্রস্তর মত পাতা ওলটাতে ওলটাতে আনমনা হয়ে পড়েছিলেন ডক্টর বোস, সম্বিৎ ফিরল ঋজুর কথায় —
‘বলেছিলুম না, বেশ জটিল — বুঝিয়ে না দিলে বোঝা সত্যি মুশকিল৷’ বাঁকা হাসি খেলে যায় ঋজুর মুখে, ‘যাই হোক, তারপর বলি৷ দেবী খনা ছিলেন অসম্ভব বুদ্ধিমতী ও পরিশ্রমী, সাংকেতিক ভাষায় কথা বলার এক বিশেষ ক্ষমতা ছিল তাঁর — আপনি নিশ্চই খনার বচনের সঙ্গে পরিচিত৷ সংকেত উদ্ধারেও কিন্তু তাঁর জুড়ি মেলা ভার, সেই প্রাচীন মন্দিরগাত্রে বর্ণিত পুরো প্রণালীর রহস্যভেদ তিনি করতে পেরেছিলেন৷ সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই খনা বৈশাখী পূর্ণিমার দিন থেকে শুরু করে টানা ৯ দিন এ পরীক্ষা চালান বিষ্ণুমন্দিরে৷ আমার অবশ্য সমস্ত জোগাড়যন্ত্র করতে করতেই প্রায় দুবছর কেটে গেল৷ তারপর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি-তে আমি প্রথম পরীক্ষাটি চালাই এই চন্দ্রকেতুগড়েই — এক বাড়ি ভাড়া নিয়ে৷ পরপর তিনবার ব্যর্থ হই — এবং স্বাভাবিক ভাবেই বেশ ভেঙে পড়ি৷ কারণ যে পদার্থটি তৈরি হয়েছিল তা সোনার কিছু ভৌতিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করলেও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলি অর্জন করতে পারেনি৷ আসলে প্রক্রিয়ার শেষ ধাপটি ঠিক আমার বোধগম্য হচ্ছিল না৷ মন্দিরের গায়ের সে টালির ছবিতে ছিল — কিছু তালগাছের সারির মাঝে এক যজ্ঞকুণ্ড, আর আকাশ থেকে যেন কিছু পড়ছে সে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মাঝে৷ সরু এবং কিঞ্চিৎ মোটা, দুধরনের রেখা নেমে এসেছে ওপর থেকে৷ মাথা কিছুতেই আর কাজ করছিল না, হঠাৎই এক ব্যাটারির দোকানে ডিস্টিলড ওয়াটারের বোতল দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল৷ বৃষ্টির জলে কোনও খনিজ পদার্থ দ্রবীভূত থাকে না — বর্তমানে অবশ্য দূষণের ফলে দ্রবীভূত গ্যাসীয় পদার্থ পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সেই ১৫০০ বছর আগে বৃষ্টির জল ছিল প্রায় খাঁটি ডিস্টিলড ওয়াটার৷ স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, একদম শেষধাপে এসে পরিমাণ মত ডিস্টিলড ওয়াটার মেশাতে হবে৷ নতুন উদ্যমে আবার পরীক্ষা চালালুম ২০১৪ সালে, মনে হল এবার সত্যিই বেশ কাছে এসে গেছি — কিন্তু সে যেন এক মায়া হয়েই রয়ে গেল, সোনা থাকল অধরাই৷ এই কয়েক বছরের সীমাহীন শারীরিক পরিশ্রমের ক্লান্তি আমায় ধীরে ধীরে গ্রাস করতে লাগল, তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল প্রবল মানসিক অশান্তি৷ এভাবে কেটে গেল আরও এক বছর৷ ২০১৫-র এপ্রিল মাস, সেদিন গরম পড়েছে বেশ — আকাশে উঁকিঝুঁকি মারছে কালবৈশাখীর মেঘ৷ হঠাৎই যেন প্রকৃতির প্রলয়-নাচন শুরু হয়ে গেল, প্রায় দৌড়ে দক্ষিণের জানলাটা বন্ধ করতে গিয়ে কানে তালা লেগে গেল আমার — এক প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল বাড়ির বাগানের তালগাছটিতে৷ অনেকক্ষণ ধরে কান ভোঁ ভোঁ করছিল, কথাও প্রায় বলতে পারছিলাম না — কিন্তু সাথে সাথে আরেক বিদ্যুৎ চমক হল আমার মস্তিষ্কে৷ জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল — খনা আসলে বৃষ্টির সাথে বজ্রপাতের কথাও বলেছিলেন৷’
‘তার মানে খনা কোল্ড ফিউশনের কথা ভাবেননি, সে প্রাচীন ছবি থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে একদম শেষ পর্যায়ে প্রচণ্ড তাপ ও বৈদ্যুতিক শক্তির প্রয়োগ করতে হবে৷ আর তাই হয়ত দিকে দিকে অ্যালকেমিস্ট-রা ব্যর্থ হলেও, তিনি হননি৷ কিন্তু খনার আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছিল অব্যর্থ, আমার তো সে ক্ষমতা নেই৷ সরকারী আবহাওয়ার পূর্বাভাস বেশীরভাগই মিলত না৷ অবশেষে...’ বলে চুপ করে চোখ বুজল ঋজু৷ ডক্টর বোস শান্তভাবে অপেক্ষা করতে লাগলেন৷
‘অবশেষে...২০১৬-র মে মাসের সে দিনটির কথা কোনওদিন ভুলতে পারব না৷ আমি নতুন উদ্যমে আবার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, এবং এবার তালগাছের ব্যাপারটা বিশেষভাবে মাথায় রেখেছিলাম৷ তালগাছের উচ্চতা ও তার শরীরে জলের পরিমাণ আকাশ থেকে যেন বজ্রকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে, তাই দেখা যায় বেশীরভাগ বজ্রপাত এই তালগাছেই হয়৷ ইন্দ্রদেব-এর বোধহয় আমার অবস্থা দেখে করুণাই হয়েছিল৷ আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে পূর্ণ সম্মান জানিয়ে ঠিক দশম দিনে সে এলো, চোখ ধাঁধিয়ে, চতুর্দিক কাঁপিয়ে এক বিকট আওয়াজ করে৷ একে ভাগ্য ছাড়া আর কিইবা বলবেন বলুন? পরদিন সকালে গিয়ে দেখি সেখানে চিকচিক করছে গুঁড়ো সোনা৷ সে তখন একেবারে পাগলের মত অবস্থা আমার — নিজে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে তারপর গুঁড়োগুলো কাগজে মুড়ে নিয়ে গেলাম কাছেরই এক সোনার দোকানে৷ এত খাঁটি সোনা দেখে সেও অবাক, সন্দেহের বশে তখুনি পুলিশকে খবর দিল তারা — আগে থেকে বুঝতে পেরে কোনও মতে পালিয়ে বাঁচি সেখান থেকে৷ দাঁড়ান, একবার দেখাই আপনাকে সে অপরূপ পবিত্র ধাতু, যা সত্যিই যেন দেবলোকের সম্পদ — সম্পূর্ণ ১০০ শতাংশ খাঁটি...’ বলে ব্যাগটা হাতড়ায় ঋজু, বার করে আনে কাগজের সেই মোড়ক৷
‘আরে অনেকক্ষণ হয়ে গেল, আজ তো তোমার কুলফি খাওয়াই হল না — দাঁড়াও আনাই একটা৷’ হঠাৎই বাধা দিয়ে বললেন ডক্টর বোস৷ আড়চোখে একবার ঋজুর কুলফি খাওয়া দেখে নিয়ে কাগজের মোড়কটা সাবধানে খুললেন তিনি, চিকচিকে সোনালী গুঁড়োগুলো যেন এক অশুভ ঈশারা করতে লাগল তাঁকে৷
|| ৮ ||
গাড়ি চালাতে চালাতে চোখ দুটো প্রায় বুজে এলো ডক্টর বোসের৷ সোনালী গুঁড়োগুলো নিয়ে গেছিলেন এক পরিচিত জুয়েলারের কাছে, এতো খাঁটি সোনা উনি নাকি জীবনে দেখেননি৷ প্রায় ১০০গ্রাম ছিল, ভালই দাম দিতে চেয়েছিলেন — কিন্তু তিনি বেচতে রাজী হননি৷ পথে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির আসতেই ভক্তিভরে প্রণাম সেরে নিলেন একবার — ঐ পাপস্খালনের চেষ্টা আর কি!
ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে ওঠে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঋজু শেষ — ড্রাগের ডোজ-টা এবার বেশ বেশীই দিয়েছিলেন তিনি৷ ঋজু আগে একসময় অবসাদে পড়ে ড্রাগের নেশা ধরেছিল, ওর বাবার কাছ থেকেই জেনেছিলেন ডক্টর বোস৷ সবাই বুঝবে সে আবার নেশা ধরেছিল, আর ঐ নেশাই চিরকালের মত কেড়ে নিলো তাকে৷ শুধু হাসপাতালে কে সাপ্লাই দিত সে ড্রাগ তা আর কোনওদিন জানা যাবেনা — জানা যাবেনা, কিভাবে কুলফির সাথে সে বিষ মিশে যেত ঋজুর শরীরে৷
ঋজুর খাতাটা বার করে আর একবার শুঁকলেন তিনি৷ কি আছে এতে কে জানে, মনে হয় যেন এক স্বর্গীয় সুখ — আমেজে চোখ বুজে আসে৷ কাল একবার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ডক্টর পোদ্দারের সঙ্গে দেখা করতে হবে, রসায়ন বিভাগের প্রধান সমর পোদ্দার তাঁর ছোটবেলার বন্ধু৷ পুরো ব্যাপারটা নিয়ে একবার আলোচনা করা দরকার৷
পুরোনো খাতাখানা জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পড়লেন ডক্টর সায়ন্তন বোস, ক্রমশঃ ঘাড় এলিয়ে পড়ে সীটের ওপর — কালো রাতের বুক চিরে তাঁর গাড়িটা তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে, যেন বড্ড তাড়া তার.... পৌঁছবার.... নরকের দ্বারে৷
(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)