পথটা এখানে দু’ ভাগ হয়ে দু’ দিকে চলে গেছে।
পটল-দা গতকাল রাতে আমাকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়েছে কিভাবে যেতে হবে, কিন্তু এই রাস্তা দু-ভাগ হবার ব্যাপারটা বলে নি। দু’ ঘন্টা হয়ে গেলো হাঁটছি তো হাঁটছিই, হাঁটছি তো হাঁটছিই, শেষে যে এইভাবে ফেঁসে যাবো কে জানতো।
অন্ধকার শীতের রাত। আশেপাশে কোনো গ্রাম নেই। দুপাশে হালকা জঙ্গল। এখন কে আমাকে বলবে কোন রাস্তাটা আমার নেওয়া উচিত?
দেখে মনে হচ্ছে দুটো রাস্তাই জঙ্গলের আরও গভীরে গিয়ে মিশেছে। তাই একবার ভুল রাস্তায় পা রাখলে জঙ্গল না ছাড়ালে মনে হয় না আর কেউ আমাকে পথের দিশা দেখাতে পারবে।
এতক্ষণ হেঁটে পা ব্যথা হয়ে গেছে। কিন্তু উপায় নেই। পটল-দা পইপই করে বলে দিয়েছে, “দ্যাখ্ ঘেঁটু, বিদ্যার্থী হিসেবে যাচ্ছিস। বিনয়ের সাথে যাবি। হেঁটে যাবি, খালি পায়ে যাবি। হরু তান্ত্রিক নিজে যেখানেই যায়, হেঁটে যায় আর খালি পায়ে যায়। আর হ্যাঁ, মনে রাখিস, কোনোরকম অহংকার বা অসভ্যতা কিন্তু হরু-তান্ত্রিক সহ্য করে না।”
ভরসা এই যে গন্তব্যস্থল আর খুব দূরে হবার কথা নয়। এই জঙ্গলেটা প্রায় তিন মাইল জায়গা জুড়ে। জঙ্গলের অন্যপ্রান্তে শূলীপুকুর। আট-গাঁয়ের রাজারা আগে সেখানে অবাধ্য প্রজাদের শূলে চড়াতেন। হরু তান্ত্রিকের বাসা নাকি এই শূলীপুকুরের গায়ে।
বাঁ-দিকের রাস্তাটা-ই নেবো ঠিক করলাম। এগোতে যাবো, এমন সময় পিছনে শুকনো পাতায় খড়মড় করে একটা আওয়াজ হলো। ফিরে তাকালাম। অন্ধকারে খুব ভালো বোঝা যায় না, তবে মনে হলো কেউ একটা আসছে।
একটা লোক। হনহন করে হেঁটে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। এতক্ষণ নিশ্চয় আমার অনেক পিছনে ছিলো, তাই টের পাই নি।
লম্বা সিড়িঙ্গে চেহারা লোকটার। হাঁটুর উপর থেকে আগাগোড়া চাদরে মোড়া শরীরটা। হাতদুখানাও চাদরের ভিতরে গুটিয়ে রাখা। এই শীতে হাত গুটিয়ে রাখাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু হাত গুটিয়ে রাখতে গেলে যেরকম বড় চাদরের দরকার হয়, তেমন বড় চাদর আজকাল শহরের দোকানগুলোতে ক্রমশ বিরল হয়ে আসছে। চাদরের রংটাও আবার কালো। অবশ্য এই অন্ধকারে হালকা বাদামি রংকেও কালো ছাড়া অন্য কিছু মনে হবে না।
আমার কাছে এসেও ভাবের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না লোকটার| আমার দিকে একবার তাকিয়ে দিব্যি আমাকে ছাড়িয়ে ডানদিকের রাস্তাটা ধরলো, যেন এই শীতের রাতে একটা লোকের জঙ্গলের মুখের এই দুই রাস্তার মোড়ে থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা একটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ঘটনা!
চেঁচিয়ে ডাকলাম লোকটাকে।
—- দাদা, শূলীপুকুরের পথ এ-দুটোর মধ্যে কোনটা বলবেন একটু?
— আসুন।
সেই ডানদিকের পথ-ই ধরলো লোকটা। বোঝা উচিত ছিলো ডানদিকের রাস্তাটাই আসল রাস্তা, কারণ বাঁ দিকের থেকে এদিকের রাস্তাটা আরো সরু, পটল-দা যেমন বলেছিলো। একদম পায়ে চলা সরু পথ। পাশাপাশি দুজনের বেশি যাবার উপায় নেই। দুপাশে নালিঘাস আর ঝোপ। শীতকাল বলে অবশ্য ধরে নেওয়া যায় সাপেরা যে যার গর্তে গভীর ঘুমে।
জঙ্গল এদিকে বেশ গভীর। পথের দুপাশে বিশাল বড় বড় সব গাছ। এগাছের ডালের সাথে ও গাছের ডাল জড়িয়ে যায় এত ঘন। অনেক ডাল আবার পায়ে চলা পথটার এপাশ থেকে ওপাশে চলে গিয়েছে। এদের মধ্যে কিছু ডাল বেশ নিচুতে। তাই চলার সময় দেখে না এগোলে গাছের ডালে মাথা ঠুকে যাবার সম্ভাবনা প্রবল।
একশ দেড়শ বছর আগে এই জঙ্গল বাঘ-ভালুকে গিজগিজ করতো। তবে এখন অবশ্য তারা আর নেই। আটগাঁয়ের রাজারা শিকার করে করে বহুদিন আগেই সব নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
এতক্ষণ ধরে একা পথ হেঁটেছি। কথা বলতে না পেরে পেট ফুলেছে। যেতে যেতে তাই প্রশ্ন করলাম লোকটাকে, "আপনার বাড়ি কি এই দিকেই?"
ক্যাঁক-ক্যাঁক করে একটা বিকট আওয়াজ হলো। একটা নিশাচর পাখি উড়ে গেলো আমাদের মাথার উপর দিয়ে। ফলে লোকটা বিড়বিড় করে কি যে জবাব দিলো কিছু শুনতে পেলাম না।
— শূলীপুকুর কতদূর এখান থেকে?
কোনো উত্তর দিলো না লোকটা।
— মাঝরাতের আগে পৌঁছবো তো ওখানে?
আবার একটা চাপা কান্নার আওয়াজ। শকুনের বাচ্চার ডাক নাকি একদম মানুষের বাচ্চার কান্নার আওয়াজের মতন।
নিঃশব্দে ঘাড় নাড়লো লোকটা।
বাঁচালো। মাঝরাতের আগেই ধরতে হবে হরু তান্ত্রিককে। তন্ত্রের গূঢ়বিদ্যা শুরুর সঠিক লগ্ন নাকি একদম মাঝরাতে।
আবার হাঁটা শুরু। এই জঙ্গলটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আমার। কিন্তু যেই আবার মুখ খুলতে যাচ্ছি, লোকটা মুখে আঙ্গুল রেখে হিস্ করে আওয়াজ করলো একটা।
দুটো কালো বনবিড়াল আমাদের ঠিক সামনে লাফিয়ে রাস্তা পার হয়ে আবার গাছের আড়ালে মিশে গেলো।
জঙ্গলের এই জায়গাটা একটু ফাঁকা। অমাবস্যা, তাই চাঁদ নেই আকাশে, শুধু কয়েকটা তারার হালকা মিটিমিটি আলো। আবছা আলোতে খুব কাছের জিনিসও ভালো বোঝা যায় না, তবু আমার কেমন যেন মনে হলো লোকটা এর মধ্যে আর একটু লম্বা হয়ে গেছে। হাঁটা শুরু করার সময় ওর মুখ আর আমার মুখ প্রায় সমান উচ্চতায় ছিলো। অথচ এখন দেখে মনে হচ্ছে ও আমার চেয়ে আরও অন্তত দু-তিন ইঞ্চি বেশি লম্বা।
— আপনি শূলীপুকুরে আমায় ছেড়ে দিলেই হবে!
— শূলীপুকুরে ছেড়ে দেবো? মানে জলের উপরে?
ও বাবা! এ যে বেজায় রসিক দেখছি।
— হা! হা! না, না, জলে আবার কেন? ওই পুকুরের পশ্চিমে নাকি এককালে ঘাট ছিল একটা। সেই ঘাটে পৌঁছোতে পারলেই আমার চলবে।
— শূলীপুকুরের ওই ঘাট থেকে একসময় কত মৃতদেহ চ্যাংদোলা করে জলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে তা জানেন?
— না, তবে শুনেছি নাকি প্রচুর।
— যাঁরা জলের তলায় রয়ে গেছেন তাঁরা ডাকলে কি করবেন শুনি?
— কি আবার করবো! আড্ডা দিয়ে আসবো একটু। চা-টা খাওয়াবে নিশ্চয়?
— তেনাদের ভয় করেন না তাহলে। শহুরে লোক, ন্যাকাপড়া করেছেন, তাই না?
— আরে আরে রেগে যাচ্ছেন কেন?
— শূলীপুকুরে কার কাছে যাবেন আপনি?
লোকটার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। না ভুল নয়, লোকটার চোখদুটো এখন আমার চোখের থেকে অন্ততঃ ছয় ইঞ্চি উপরে।
— যার কাছেই যাই, আপনার কি মশাই?
— শূলীপুকুরের পশ্চিম ঘাটের পাশের ডাকাতে-কালির মন্দিরে একটা হাঁড়িকাঠ রয়েছে। আট-গাঁয়ের রাজারা সেখানে নরবলি দিতো, আপনি জানেন?
— জানবো না কেন? সব জেনেশুনেই তো আসছি!
“নরবলি কিন্তু এখনো হয়!”, আমার ঘাড়ের কাছে নিচু হয়ে ফিসফিস করে লোকটা বললো, “এক ব্যাটা তান্ত্রিক আছে সেখানে। হরু তান্ত্রিক ..”
— আরে আপনি চেনেন নাকি হরু তান্ত্রিককে। ওর সাথেই তো আমার দরকার ..
“হরু তান্ত্রিকের সাথে দরকার?”, চোখ দুটো আবার জ্বলজ্বল করছে লোকটার, “কেন?”
— বাঃ, হাঁড়িকাঠে বেঁধে আমার মাথাটাকে ধড় থেকে আলাদা করে দেবে, রক্ত বেরোবে গলগল করে, সেই মজাটা লুটতে হবে না?
“তবে রে হতচ্ছাড়া! হরু তান্ত্রিকের সাথে ইয়ার্কি?”
এক ঝটকায় মাথাটাকে দেহ থেকে খুলে আমার দিকে তেড়ে এলো হরু তান্ত্রিক। শূন্যে ঝুলছে মাথাটা। দু’চোখে আগুন ঝরছে। চাদর জড়ানো ধড়ের থেকে বেরিয়ে এসেছে হাত-দুটো। দুটো হাতেই আবার কোত্থেকে দুটো রক্তমাখা খাঁড়া এসে জুটেছে।
— “বল, কোন খাঁড়ায় কাটবো তোর মাথাটা?”
আনন্দে হেসে উঠলাম আমি। সাষ্টাঙ্গে হরু তান্ত্রিকের ধড়কে প্রণাম করে শূন্যে ঝোলা মাথাটার দিকে তাকিয়ে বললাম, “মহারাজ, গত দু বছর ধরে চেষ্টা চালাচ্ছি আপনার মতন মাথাটাকে দেহ থেকে আলাদা করার। আপনি জ্ঞানী ভূত। দয়া করে আমার মতন এক অধম ভূতকে যদি এই বিদ্যেটা শেখান!”
(পরবাস-৭৭, ১০ জানুয়ারি ২০২০)