Subscribe to Magazines






পরবাসে
রবিন পালের

আরো লেখা

বই



ISSN 1563-8685




নবনীতা: এক মহীয়সী শিখা

‘তুমি একটি জ্বলন্ত শিখা। তুমি নিশ্চিত জয়লাভ করবে’ — আস্তুরিয়াস

নাম রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ — নবনীতা। তাঁর কথা মনে এলেই সেই রবীন্দ্র গীতিটি মনে পড়ে — ‘নব আনন্দে জাগো আজি নবরবিকিরণে / শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে।।’ গত ষাট সত্তর বছর ‘ভালো-বাসা’ বাড়ির পাশ দিয়ে গেছি, ‘ভালো-বাসার বারান্দা’ পড়ছি দশ-বারো বছর। ভালোবাসার মূর্ত প্রতিমা চলে গেলেন, এবার বুঝি ভালো-বাসা হয়ে পড়ল সংখ্যালঘু, ম্রিয়মান।

পঞ্চাশের দশকে স্কুল জীবন শেষ করে এলেন যাদবপুরে, তুলনামূলক সাহিত্যে, বাবার উৎসাহে, বুদ্ধদেব বসুর স্নেহে। ১৯৫৮তে এম.এ. পরীক্ষায় শুধু তুলনামূলক সাহিত্যে নয়, মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থানাধিকারীর স্বর্ণপদক। ষাটের দশকে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ফেলো, দেশে ফিরে অধ্যাপনা আর সাহিত্য পড়া পড়ানো রচনা। তাঁর অধ্যয়ন ও বক্তৃতার খ্যাতি ভুবনবিদিত। এই দিকটি বাদ দিলে গবেষণা, তার খবর আমরা রাখি না। তিনি জগৎজোড়া মহাকাব্যিক কবিতার ভাষা গঠন ও বিষয় ভিত্তি নিয়ে কাজ করেছেন। মিলম্যান পেরি ও এ. বি. লর্ড এর মৌখিক মহাকাব্যগত ভাষার শৈলী বিশ্লেষণ অতিক্রম করে গেছেন নব দিগন্তে। হার্ভার্ডে গবেষণাকালীনই (ব্যেলির তত্ত্বাবধানে) তিনি সংস্কৃতে রচিত কাব্যের শৈলী নিয়ে মৌলিক ভাবনা সন্ধান করেছেন। কেম্ব্রিজ থেকেই তাঁর সীমা অতিক্রমী কাজ (বাল্মীকি রামায়ণ নিয়ে) পূর্বসূরী পাণ্ডিত্যকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ধ্রুপদী কাব্যের বিষয়-সাদৃশ্য নিয়ে প্যারী ও লর্ড এর পরবর্তী কাজ নবনীতার কাজ দ্বারা প্রভাবিত — বলেন অমর্ত্য সেন। রামায়ণের পাঠগত বিশ্লেষণ, interpolation ও redaction — কাজটা ছিল অসামান্য। রামায়ণ যে মোটেই monolithic text নয়, যাতে নানা সংস্কৃতি, উপসংস্কৃতি মিশেছে একথা নবনীতা দেখান, এ. কে. রামানুজন-এর ‘তিনশত রামায়ণ’ যখন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচী থেকে বাতিল করা হল তখন নবনীতার কাজ হয়ে উঠল আরও প্রাসঙ্গিক। বিবাহবিচ্ছেদ হল, এ গবেষণার index card সংগ্রহ গেল হারিয়ে। এ ধারার কাজ, হারালো ধারা। আমাদের কারো কারো নিশ্চয়ই মনে পড়বে তিনটি বইয়ের কথা — ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৭৭), বীরশৈব সন্তকবি ও বীরশৈব সাধনা (১৯৮৭), চন্দ্রমল্লিকা এবং প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ (২০১৫)। প্রথম বইটিতে কাম্যুর ডাঃ রিয়্যু (প্লেগ) ও শশীর (পুতুল নাচের ইতিকথা) তুলনা, এবং কমলকুমারের কথাসাহিত্য শৈলী বিষয়ক ভাবনার কথা আমাদের যৌবনকালের উজ্জ্বল স্মরণিকা। দেশ বিদেশে ওঁর উচ্চারিত বক্তৃতাগুলি এবং কিছু কিছু সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকা ডিভোর্স পরবর্তী অধ্যায়ের উজ্জ্বল স্মারক — এ বুঝি অত্যুক্তি নয়।

মৌলবাদের হুঙ্কারের বিরোধিতা, গৌরী লঙ্কেশ, কালুবর্দ্দী প্রভৃতিকে হত্যার প্রতিবাদ, নারীত্বের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য অসংখ্য প্রয়াস, ‘সই’ প্রতিষ্ঠা ও রচনাসংগ্রহ ও সর্বভারতীয় সম্মেলন নবনীতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল নারীমর্যাদা রচনার অন্যতম করণিক রূপে।


কবিতা লিখছিলেন ছোটবেলা থেকেই। তারপর পাণ্ডিত্যের, অধ্যাপনার, ঘরকন্নার চাপে কবিতা কমে যায়। শুনছি কবিতার সংকলন মোটে তিনটি, তবে তাঁর কবিতার খ্যাতি ভুবনজোড়া। বহু ভ্রমণ কাহিনীর উৎস কবিতা পাঠ, স্বভাষায় বা অন্য ভাষায়। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি অনুবাদক নবনীতার কথা আমরা মনে রাখি না। স্মরণ করি তার দুটি নাটক — মেদেয়া এবং তিনটি একাঙ্কিকা (১৯৯৪), অভিজ্ঞান্‌ দুষ্মন্তম (২০০৯)। পুরোদস্তুর অনুবাদ চারটে — শতেক বচন (কন্নড় বীরশৈব কবিতা) (১৯৮৭), অষ্টমী (আট এশীয় নারীর কবিতা) (২০০৬) উপমহাদেশের গল্প (২০১৩), হলদে ওয়ালপেপার এবং অন্যান্য (শার্লট পারকিনস গিলম্যানের গল্প (২০১৫), হাইকু ৭৯ (২০১৭)। চলে যাওয়ার আগেই ঘোষণা করেছিলেন — পাঁচটা কবিতার বই (নিজের লেখা, ইংরেজি অনুবাদে) বেরুচ্ছে — তিনটে বিদেশে, দুটো স্বদেশে, মেয়েদের উদ্যোগে।

বহু আলোচিত না হলেও তিনি একজন ঔপন্যাসিক, যার ২৩টি উদাহরণ জ্বল জ্বল করছে। ছোটগল্পের সংকলন দশটি। কিশোর সাহিত্যের সংকলন ১৪টি। আত্মজনকথা ১টি, রম্যরচনা ৪টি। এমনকী বাংলা বিদ্যালয় — পাঠ্যবই একটা সম্পাদনাও করেছেন ২০০৭-এ। তিনি ছোটদের না কি বড়োদের, ছাত্রদের না কি গবেষকদের, নারীবাদীদের নাকি মজারুদের — নবনীতাকে নিয়ে আমাদের সমস্যা অনেক। আপাতত তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি সক্কলের। তাঁর খোলামেলা স্বভাব আর বিপুল লিখন প্রবাহ — এর তুলনা আজকে আর কারো কথা মনে পড়ছে না।

প্রতিবাদের নানান ধরন আছে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে তাঁর প্রতিবাদের ঐতিহ্যটা একেবারেই আলাদা। বিধবা রাধারাণী ও কবি অনুবাদক বুদ্ধিজীবী ভ্রমণউৎসুক নরেন্দ্র দেবের বিবাহ ছিল প্রতিবাদী, নবনীতার সে যুগে প্রেসিডেন্সী ছেড়ে তুলনামূলক ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে পড়তে যাওয়া প্রতিবাদী, আর তাঁর এপিক অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা--সেও যথেষ্ট প্রতিবাদী। ভালো-বাসার বারান্দার খণ্ডগুলির পাতা ওল্টালে যেমন মানবিক নবনীতাকে, তেমনি প্রতিবাদী বিষয় নির্বাচনে, বিষয় উপস্থাপনে পাওয়া যায়। দাভোলকর, পানসারে, কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশের কথাও উঠে আসে কোনো কোনো উচ্চারণে। অন্যদিকে তাঁর ভাবনাবলয়ে এসে যায় রামায়ণের ভিন্ন ব্যাখ্যান। বাংলা, মৈথিল, তেলেগু, মরাঠি, রচনায় মেয়েদের ভাষ্যে রাম পাপিষ্ঠ, সীতার শোকালাপে তারা জানান নিজেদের দুঃখতাপের কথা। চন্দ্রাবতীর রামায়ন তো গোপভরমের কুমোর কন্যা মোল্লার রামায়ণ আলোচকদের অনেকের কাছে অবজ্ঞাত, অশ্রদ্ধেয়। কিন্তু নবনীতা দেখান সীতাকে দুখিনী করায় দায়ী রাম, অযোধ্যা ধ্বংসেও দায় তাঁর, কাহিনি তার গুরুত্বের বয়ান নিয়ে চলে সীতার দৃষ্টিকোণে। শূদ্র কবির তেলুগু রামায়ণ অশ্রদ্ধেয়, নারী রচিত রামায়ণের যে নাতি-উজ্জ্বল ঘরানাটাই অশ্রদ্ধেয়, যেখানে রাম পাপিষ্ঠ, সীতা দুঃখতাপিত। নবনীতা তাঁর রচনায় সেইসব রচনার প্রতিষ্ঠা দেয়। তাঁর বামাবোধিনী উপন্যাসও এই দৃষ্টিকোণে। নারীবাদী নবনীতার এই প্রতিবাদী ব্যাখ্যান মহলটি অবশ্য তেমন আলোকিত হয়নি। কন্নড় বীরশৈব কবিতার অনুবাদ ‘শতেক বচন’ আশা করা যায় এবার দু’চারজন পড়বেন। মহিলা গল্পকারদের যে সংকলন তিনি করেছেন সেটার পাতাও এবার ওল্টানো হবে নিশ্চয়ই। এন.বি.টি.-র উদ্যোগে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতার একটি সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন নবনীতা। তাঁর ভূমিকায় অনেক প্রয়োজনীয় কথার সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন ক) মাতৃভাষার কুশল কামনায় ঢাকা ও কাছাড়ে প্রাণ দেওয়া মানুষের কথা, খ) নতুন করে নারীবাদী কবিতা রচনার কথা, তার প্রাবল্য কথা, গ) দলিত মানুষের ব্যথিত ভাবনার কথা। তাঁর উপলব্ধিতে — ‘কবিতার শিকড় নেমে যায় জীবনের মাটির গভীরে, ইতিহাস, আর্থসামাজিক অবস্থানের’ অন্তরালে — এই মানবসংবেদী উচ্চারণ মনে পড়ে, বারংবার মনে পড়ে। ‘যে কোনো মানবিক প্রশ্নে নিজের কন্ঠস্বর প্রক্ষেপ করত নবনীতা’ (পবিত্র সরকার); ‘মনে আছে ভ্যলতেয়র-এর ক্লাস — একের পর এক ঝলমলে উজ্জ্বল ছবি, হাল্কা কিন্তু তীক্ষ্ণ বাক্যের সমাবেশ আর তার মধ্যে তৎকালীন সমাজের অবিচার, কুসংস্কারের প্রতি তীব্র ব্যঙ্গ। ক্লাসের মধ্যেই সমাজ, সংস্কার, হাস্যকৌতুকের আঙ্গিক নিয়ে অনেক কথাবার্ত্তা হত।’ (শুভা চক্রবর্তী দাশগুপ্ত)। ‘অনেকগুলো নবনীতাদি যেন আমার চোখের সামনে আছে। ...স্নেহে, মানবিকতায় বৈদগ্ধ্যে, অনুভবে আর উচ্ছ্বাসে তাঁর জুড়ি হয় না’। (অভীক মজুমদার) ‘তুখোড় ব্যঙ্গ, শাণিত ক্রোধ, চতুষ্পার্শ্ব সম্পর্কে সতত সচেতনতা, নৈতিক দৃঢ়তা জাগরূক ছিল নবনীতার মধ্যে’, (চন্দ্রিল) অবশ্য আছেন ‘অনেক নবনীতা’।


রম্যরচনা, কিশোর সাহিত্য আর কবিতা — এ সবের জনপ্রিয়তা - নবনীতার এসব লেখার বহুচারী ছটা আস্বাদনের পাঠক অজস্র। কিন্তু তাঁর ভ্রমণ কথা — তা বোধকরি আকর্ষণে সবার ওপরে। এ কালের ভ্রমণ সাহিত্যে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যদি আলোচনায় নামি তাহলে অনেকগুলো কারণ বার করা যাবে। কে যেন বলেছেন যে বাঙালির মধ্যে পর্যটনে প্রথমেই আছেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিতীয়ে অমিয় চক্রবর্তী আর তৃতীয়ে নবনীতা। আমার মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ পিপাসা যথেষ্ট কিন্তু সে ভ্রমণ একান্তভাবে শিষ্ট আবহে, মার্জিত শিক্ষিত পরিবেশে, পদে পদে তার নিরাপত্তা ও সে কারণে নানা আয়োজন। অমিয় চক্রবর্তীর ভ্রমণ ব্যাপ্ত, যদিও সে ভ্রমণের অনেক কথা লোকমুখে শোনা এবং সেটাও ওই শিষ্ট মার্জিত আবহে আর তার অধিকাংশই লেখা হয়নি। আমরা শুনেছি তাঁর মুখে, তাঁকে যাঁরা জানতেন তাঁদের মুখে। নবনীতার সঙ্গে পূর্বোক্ত দুজনের প্রথমত দুটি ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। নবনীতা তাঁর বিশ্ব পর্যটনের রিহার্সাল নিয়েছিলেন বাবা ও মা নরেন্দ্রদেব ও রাধারাণীর সঙ্গে। ছোটবেলায় শুকতারা, শিশুসাথী বা ওই জাতীয় পত্রিকায়। (আমিও কিছু পড়েছি) সঙ্গে থাকত ছবি। পরে স্বামী অমর্ত্যর সঙ্গে এবং তৃতীয় পর্যায়ে প্রধানত একা, বিশ্ব পর্যটন তৈরি করা বন্ধুত্বে, নির্মীয়মান পরিজনসহ। দ্বিতীয়ত: তিনি নারী। রবীন্দ্রনাথ বা অমিয় চক্রবর্তী অপেক্ষা নারী নবনীতার বিচরণ তুলনারহিত। ভ্রমণ সমগ্র ১-এর ভূমিকায় নবনীতা বলেন — ‘ভ্রমণের নেশা এক তীব্র নেশা, প্রায় কৃষ্ণপ্রেমের মতো, সে মাদকের সুখ যে একবার আস্বাদন করেছে, সে বারবার সেই স্বাদ ফিরে পেতে চায়।’ ঠিক এই কথা বলেছিলেন বিভূতিভূষণ আরণ্যক উপন্যাসের এক জায়গায় — ‘একবার যদি ভ্রমণের নেশা পেয়ে বসে অসম্ভব ঘরকন্না করা। নবনীতা বলেন — ‘কোনো দেশে গিয়ে আমার নিজেকে বাইরের লোক বলে মনে হয় না, মনে হয় না এখানে আমি একা, নিঃসঙ্গ।’ এবং ‘নতুন দেশে, নতুন পরিস্থিতিতে, অচেনা মানুষদের মাঝখানে, অনভ্যস্ত আবহাওয়ায় চলে যেতে একটুও ভয় করে না।’ এই কথা যে স্রেফ কথার কথা নয় যাঁরা ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে’ বা ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ পড়েছেন তারা ভালোভাবেই জানেন। রবীন্দ্রনাথ বা অমিয় চক্রবর্তী এটা পারতেন না, সে মানসিকতা তাঁদের ছিল না। বরং রামনাথ বিশ্বাস বা বিমল দে বা প্রবোধ সান্যালের কথাই মনে পড়ে যায়। নবনীতার কাছে দেশ ও বিদেশ কাছে ও দূরে পরিচিত আর অপরিচিত ছিল সমান। সর্বভূতে সমদৃষ্টি। কিছু কিছু দৃষ্টান্ত অবশ্যই দেব।

‘হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে’ হল সুপ্রসিদ্ধ চারিধাম গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদার ও বদ্রী ভ্রমণ কথা। এ বইয়ের গোড়াতেই তিনি বলে নেন — ‘আমার জীবনটাই যে স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন সাজিয়ে গড়া।’ সর্বোপরি মেয়েমানুষ। ১৯৮৫-এ একথা অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছিন্ন জীবনের ইঙ্গিত। একই সঙ্গে ক্রিটিক নবনীতা বলে নেন, তাঁর মধ্যে ভক্তি নেই (প্রবোধ সান্যালের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ মনে পড়ে, কেদার মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে এমন ভাবনা ব্যক্ত করেছিলেন।) আর নবনীতা মজা করে বলেন ঈশ্বরের সব স্পয়েল্ট চাইল্‌ড চাদ্দিকে খেলা করে বেড়াচ্ছে, ভগবানের খাচ্ছে আবার তার দাড়ি ওপড়াচ্ছে। রাজনীতির গুরু প্রভাবিত ভ্রমণ কথাও আসছে। অন্যদিকে তাঁর মধ্যে — ‘দর্পিত নাস্তিক্যের আত্মাহীন আত্মবিশ্বাস।’ এবং তাঁর ভ্রমণ নব্বই ভাগই অ্যাক্সিডেন্টাল। এ ব্যাপারেও তিনি তুলনারহিত। আশির দশকের গোড়ায় এসেছিলেন হৃষিকেশে বৌদি ও তার কন্যার সঙ্গে। সূর্য ওঠা দেখার জন্য রোজ সূর্যের আগে উঠে পড়তেন। কেদার-বদ্রী যাবার সুতীব্র বাসনা জেগে উঠল মনে। মান্ধাতার আমলের গাইডবই হাতে নিয়ে মজা করেছেন। পরের বছরই মেয়ে ও পাতানো ভাইকে নিয়ে চলে এলেন দিল্লী। নবনীতার ভাগ্য ভালো এক বিশিষ্ট জনের সাহায্যে (যিনি নবনীতার প্রয়াগভ্রমণের ভয়ঙ্কর বৃত্তান্ত পড়ে মুগ্ধ) পেয়ে গেলেন বিনিপয়সায় সুশোভিত গাড়ি, থাকার হরেক চিঠি। পাঠকের মনে পড়বে উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অপূর্ব সব ভ্রমণ কথা, যেখানে থাকার ও যাত্রার নানা ব্যবস্থা (অবশ্য ঐশ্বর্য নয়) তবে উমাপ্রসাদে যা নেই তা হল পদে পদে রঙ্গ। কৃচ্ছ্রসাধনে তীর্থ ভ্রমণ বললেও নবনীতার এ যাত্রায় কৃচ্ছ্র ছিল না। এ পথের কৃচ্ছ্র যে কি মারাত্মক তা কয়েকবার কেদার বদ্রী গঙ্গোত্রী যাতায়াতে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। ‘চাঁদটা ভাঙাচোরা, মলিন এবং বেশ দীন দুঃখী’ নবনীতার বর্ণনকুশলতা এবং হিন্দি ফিল্মের গান মিলে তৈরি হয়ে যায় বিরল আবহ। রঙ্গ ছড়িয়ে আছে আদ্যন্ত — জীবনানন্দীয় পঙ্‌ক্তি দিয়ে হেডিং (হয়তো ভোরের কাক হয়ে)। এটা ঠিকই ‘হিলস্টেশনে যাওয়া মানে হিমালয় যাত্রা নয়।’ প্রথমটা গার্হস্থ্য, হিসেবী ভ্রমণ, দ্বিতীয়টিতে আছে নানা আশ্চর্য ও নানা অসুবিধে। সহস্রধারা, মুসৌরী ইত্যাদি দেখেছেন ইতিপূর্বে। মানুষ ও উদ্ভিদ আবিষ্কার, কেম্পটি ফল্‌স — আগ্রহচক্ষু সবদিকেই। হনুমান চটিতে পৌঁছানোর কথা বলেছেন, পড়তে পড়তে মনে পড়ল ওই একই সময়ে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে, অন্ধকার ও কাদার মধ্যে আশ্রয় পেতে ব্যর্থ হয়ে, দেহাতি এক চিলতে ঘরে মেঝেতে প্ল্যাস্টিক বিছিয়ে শরীর রেখেছিলাম, অতি সতর্কতায় — ইঁদুরের আনাগোনায় ঘুম হয়নি। কাকভোরে উন্মুক্ত পার্বত্য ঢালে প্রাতঃকৃত্য সেরে রওনা হয়েছিলুম বাক্স রেখে। দোকানি বলেছিল — চিন্তা করবেন না, কেউ হাত দেবে না। বাজারে আমিষের লুকোচুরি আশির দশকেই শুরু হয়ে গেছে। বরকোট, নওগাঁও, সায়নচট্টি আমিও পার হয়েছি। দুজনেরই চোখে পড়েছিল — জায়গাটা ভীষণ নোংরা, অযত্নলালিত। যাত্রীদের ২/৪ কথার বর্ণনা উপভোগ্য। খচ্চর ও মানুষের ধাক্কাধাক্কি পরিস্থিতি নৈপুণ্য। চমৎকার গদিওয়ালা ঘর পেলেও কালো কুচকুচে মাকড়সা আতঙ্ক এনে দিয়েছিল। মধ্যরাতে বারান্দাভর্তি মানুষ, দেহাতি মানুষ, হতদরিদ্র মানুষ, আশ্রয়দান, লেখিকার দরদের পরিচয় বহন করে। যমুনা মাঈ-এর ঘোষণা করে যাত্রা, খচ্চরের পিঠে বিপন্ন অবস্থা আর প্রচুর জাঠ আর রাজস্থানীযাত্রা, মেয়েদের নানা ধাতুর নানা বস্তুর চুড়ি, পোশাক, ভোটকম্বল। পথটা সত্যিই অসহ্য সুন্দর। পথে নানা উপদেশ — দরকারি তো বটেই আর চটঘেরা শৌচালয়। জানকী চট্টি তুলনায় সুন্দর লেগেছিল, কিন্তু সামান্য খাবার খেয়েই আমরা হাঁটা লাগিয়েছিলাম। বৈচিত্র্য (রচনা) আনার জন্য থুরথুরে পাঞ্জাবী মহিলা যাত্রীর কথা, নিজের কন্যা ও পাতানো ভাইয়ের চলা। পথ ভয়াবহ সুন্দর — ‘ঘোড়া গেলে মানুষ যেতে পারে না।’ ‘সবচেয়ে কঠোর সবচেয়ে কঠিন’ চড়াই পার হবার কথা আমারও মনে পড়ে এতদিন পরে। দক্ষিণেশ্বরের এক যুবকদল, বন্ধুরা ফেলে পালিয়েছে আতঙ্কিত যুবাকে, প্রবোধ দিয়ে এগিয়ে নিয়েছিলাম সে যাত্রায়, মনে পড়ে। বৃষ্টিপিছল পথ, বড়ো বড়ো সাজানো পথ, সরু পথ পিছল আর কাদাময়, নোংরা। সত্যিই আমারও মনে হয়েছিল — যমুনোত্রী এমন কুশ্রী, অপবিত্র, নোংরা, কেন আসা? যমুনোত্রী আমাকেও ‘হতাশ’ করেছিল। আজও কি তাই? কে জানে।

লেখিকা তাঁর অভিজ্ঞতার সাহায্যে জানান পাশ্চাত্যে পার্বত্য স্থান যথাসাধ্য সুন্দর, সুবিধাযুক্ত, উপভোগ্য করে তোলে। আমরা পার্বত্যকে তীর্থ করে তুলি, পাশ্চাত্যে মানুষ পার্বত্যকে করে তোলে আকর্ষণীয়। সাধুজীরা প্রধানত ‘পা-গাড়ি’ নির্ভর, নবনীতাদের তার উপায় নেই। প্রসাদ পুনরায় দোকানে ফিরে বিক্রয়যোগ্য হয়ে উঠবে — অপ্রিয় সত্যটি জানিয়ে দেন। কুন্দন, সুরথ, রবীন্দ্র চরিত্রগুলি নিপুণভাবে অঙ্কিত। আর মেয়ে পিকোর মেজাজ গাড়ি চললেই ‘পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করে।’ কারণ--বমির উদ্রেক। আটপৌরে খাওয়া দাওয়ার রেট দুটো বড়ো ভ্রমণ বৃত্তান্তেই নবনীতা দিয়েছেন। তিনি মোটেই দামী খাওয়ায় আগ্রহী নন। ফেরার পথে উত্তরকাশী — সৈন্যশিবির অসহ্য সৌন্দর্য নষ্ট করতে পারেনি। উখীমঠের ঊষা অনিরুদ্ধ কথা দু’কথায় সেরে দিয়ে তিনি চলে যান পথযাত্রী কথায়। আর জানিয়ে দেন — ‘মস্তিষ্ক কিছু ভাববার আগেই আমার জিব কাজ করে।’ আত্মসমালোচনায় তিনি আদৌ অকৃপণ নন। খেতে গিয়ে দুই বিদেশী রমণীর মধ্যে একজন জানিয়েছিল - আদর্শ স্বামী হবে একনিষ্ঠ। তাঁর আত্মবেদনার ঝলক আমরা অনুভব করি। তখনও ভৈরব ঘাঁটি ও লঙ্কার সেতুবন্ধন হয়নি। এ পথ কষ্ট করে হেঁটে যাবার সৌভাগ্য আমারও হয়েছে। আর ভাটওয়াড়ী, গাঙ্গনানী, দুধ সমুদ্রের মতো কল্লোলিত ভেড়াবাহিনী প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর পরে এখনও স্বপ্নাচ্ছন্ন করে তোলে আমাকে। তবে স্কটল্যান্ডের সবুজ পাহাড়ে চরে বেড়ানো ভেড়াদের স্বাস্থ্য আমার অভিজ্ঞতায় নেই। লক্ষ্য করেছেন লেখিকা — ‘পাহাড়ীরা নিজেদের জাত নিয়ে খুবই গর্বিত।’ গাঙ্গনানীর পথ সত্যিই খুব অদ্ভুত, পথের সৌন্দর্য ‘প্রাণ জুড়ানো’। পথে হঠাৎই জমে যাওয়া বরফ, ভারত তিব্বত বর্ডার, বাসস্ট্যান্ডে সংসার, উপর বা নীচের মানুষ আমরাও দেখেছি আর পেয়েছিলাম - ধুপ গাছের কাণ্ডচেরা চা দোকানের খুঁটি, ভুরভুর করে ধূপের গন্ধ। প্রকট মৃত্যু হামেশাই হয়, বর্ডার সৈন্যদের কথা। ভৈরব মন্দির, শতধারায় বাস থেকে মানুষ ঝরে পড়া। লেখিকা জানিয়ে দেন প্লেনে যেতে খারাপ লাগে, কারণ কিছুই দেখা যায় না। তার চেয়ে ট্রেন ভালো। এ কথা যথার্থ রসিক ভ্রামণিকের কথা। গঙ্গোত্রীতে দেখা কবিতা সিংহ, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত প্রভৃতির সঙ্গে। মহাদেবের জটা দেখা হল, শুতে গিয়ে ঘুম আসে না। গঙ্গা দেবীর নৈবেদ্যটি লাগে সুন্দর। পুজো দেবার পর ডালি ভাসানো গঙ্গায়। গঙ্গাতীরে যাগযজ্ঞ, তর্পণ ইত্যাদি। মনে পড়ে প্রথমবার গঙ্গোত্রী মন্দিরের ঠিক পাশেই পাহাড়ের উঁচুতে দরজাবিহীন ঘরে জায়গা পেয়েছিলুম। প্রবল ঠান্ডায় ঘুমোতে না পারলেও দিনে পুরোহিতের দুই নাতির সঙ্গে হইচই করেছি, দুপুরে ভুর্জপত্রে মন্দিরের অপূর্ব ভোগ খেয়েছি, আর সারা দিন তুষার ভরা পর্বতশৃঙ্গ দেখেছি। মৌনীবাবার আশ্রমে নবনীতা-কন্যা পিকোর মতো আমিও গিয়েছিলাম। আরও কয়েকটি কুঠিয়া। গঙ্গাঘাটে বিরাট পর্বতখণ্ডের পাশে নিহত প্রণব সন্ন্যাসীর কুঠিয়া দেখেছি। এখানে নবনীতা চরিত্রসমূহের চাঞ্চল্য। জনৈক শিবখৃষ্টস্বামীর কথা এনেছেন। বাঙালী পথিকদের স্বার্থদৃষ্টির কথা বলেছেন। তারপর ভাগ্যবতীর বদ্রীর পথে যাত্রা। আমরা গরীব যাত্রী ভোররাত্রে উঠে শীতল বাসে ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পাড়ি দিই, আশা রাখি কোনো এক সময়ে পৌঁছে যাব। ধৈর্য রাখা চাই।

এ ভ্রমণ কথার ২য় পর্বে শুরু হয় হিমালয়ের সঙ্গে ভারতবাসীর নাড়ীর বন্ধনের কথা। বদ্রীনারায়ণ, তাঁর মতে — ‘স্বামীর কাছে আটপৌরে রূপসী গৃহিণীর মতো।’ বালানন্দ স্বামীর ওখানে নবনীতারা জায়গা পেয়েছিলেন, আমিও ওখানে একবার থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। সত্যিই অপূর্ব, সামনে তাকালেই বিরাজমান নীলকন্ঠ। মনে হয় ছুটে গেলেই পৌঁছে যাব। হায় মরীচিকা। ধরাসুর কাছে নেকড়ে বাঘের মতো কুকুর দর্শন, রুদ্রপ্রয়াগের চটি, শ্রীনগর, রুদ্রপ্রয়াগের জিম করবেটকে স্মরণ। নবনীতার সৎ উপলব্ধি — ‘একা না হলে হিমালয়ের দিকে আসা উচিত নয়।’ এবং তীর্থে আসা উচিত সমমানসিকতা সম্পন্নদের সঙ্গে। দ্বিতীয় কথাটি ভীষণ সত্য, নানা বিপত্তির অভিজ্ঞতা আছে। তবে সাধারণ যাত্রীর পক্ষে অন্তত স্বজন না থাকলে বাসে জায়গা রাখা, বাসের ছাদে মাল তোলা, একটা সময় ভেতরে বসার জায়গা রাখা, দীর্ঘ পথে হাসিঠাট্টা বিনিময় — দরকার বলেই মনে হয়।

‘হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে’ — নামটা ভালো লাগল না। নামের মধ্যে ভক্তিভাব আছে, যা নবনীতার নেই। তা ছাড়া কি পূর্ণ তা অনুধাবনে হিমালয়ে যাওয়া দরকার বারংবার। বোধহয়, সেটা সম্ভব হয়নি।

‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ — সত্যই রোমাঞ্চকর ভ্রমণ কাহিনী, যা প্রায় থ্রিলার পর্যায়ে উন্নীত, লেখনীগুণে। শুরুতেই আছে বয়স্কদের বিস্ময়, মায়ের সন্ত্রস্ত সাবধানবাণী। হায়দ্রাবাদে কনফারেন্স — মাথায় ঘুরছে কুম্ভ। তিনি অবশ্য এই অনুষ্ঠানকে অবহেলা করেননি। স্বয়ং রঙ্গনাথানন্দ তাঁর পেপার শুনে মুগ্ধ। তাঁর অতিসাধারণ আচরণ আর রঙ্গপ্রিয় দৃষ্টি গোড়া থেকে শেষপর্যন্ত। ব্যক্তি বর্ণনায় সেফিস্টোফিলিস বা ম্যাজিক ল্যাম্প কুম্ভ যাত্রার অসম্ভাব্যতায়, অবিশ্বাস্যতায় খাপ খেয়ে যায়। সেমিনার নিয়ে অতি সামান্য কথা। বরং রাজা রাও-এর ভাষণ Only the word exists মোটেই মালার্মেকে স্মরণ করায় না। বরং বার্থ — যিনি বলেছিলেন — লেখাই সব, লেখক তখন মৃত। নিজের বক্তৃতা জমে যায় ‘কপালগুণে’ এ বিনয়, জানি আমরা, এই পৃথিবীতে তিনি অসামান্য আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণে পারঙ্গম। তিরুপতি মন্দির দেখার বাধ্যতায় তাঁর চোখে পড়ল কিভাবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা গোনা চলছে, কীভাবে কাটা চুলের বিজনেস। দৈবী মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে অরণ্যদেব, লিবারেটেড দেবী — এ সব কথনে আছে রঙ্গপ্রিয়তা। প্রয়াগ প্রস্তুতিতে একাধিক ভি.আই.পি. ও প্রভাবশালীর সাহায্য ব্যতিরেকে প্লেনে কাশী, সেখান থেকে এলাহাবাদ যাওয়া সম্ভব হত না। তবে ‘জীবনে নিজের স্বামী সন্তানের জন্যেও কখনো কোথাও পুজো দিইনি আমি।’ অন্যের হয়ে পুজো দিয়েছেন, মন্দিরে গেছেন, ভক্তদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। নবনীতা একা একা চলেছেন প্রয়াগের ভিড় সমুদ্রে — এতে নানাস্তরের লোক অবাক, কিন্তু তাঁর চলা ঠেকায় কে? স্বীকার করেন — ‘আমি অতি গেছো মেয়ে। আর আমাকে দেখাশুনোর কাজটা ঈশ্বরই করেন।’ এ কথায় সত্য আছে, মজাও আছে। ট্যাক্সির সূত্রে জনৈক বৃদ্ধের সঙ্গে পিতা কন্যা, ড্রাইভারের সঙ্গে ভাই সম্পর্ক গড়ে ওঠে, ধাবাতে বসে তড়কা রুটি খাওয়া হয়। তিনি অবশ্য বলেছেন — মিরাক্ল-এ বিশ্বাস করি না, কিন্তু পাঠক পড়তে পড়তে বুঝে যান নিরাপদে স্বাস্থ্যহানি না ঘটিয়ে প্রত্যাবর্তনে মিরাক্ল অবশ্যই আছে। অলৌকিকতার এক গল্প ফাঁদেন পিতৃবিপন্নতা নিয়ে। (পৃ.৪৪) তাঁর জরিভরা পোশাক, চোখে চশমা, পাতানো ভাইয়ের সূত্রেই লালা ও গোঙা দুই মালবাহক জোগাড় হয়। হাতি, উট আর পদচারী — কৌতূহলী নবনীতা — মালপত্র ‘যেন পাপের বোঝা’, বইপত্র মানে ‘সরস্বতীর প্রসাদ’ — পাশে ধুলোয় ঝুপড়ি, বিছানা, রান্না, খাওয়া, কম্বলমুড়ি ঘুম — হাত পেতে চিনির বাতাসা নেওয়া। এ যেন ঈশ্বরের দান, বাচ্চারা চলে পথ দেখিয়ে। একদিকে হাঁপানির উপদ্রব অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান ভিড়। মস্ত ইঁদারা, বিশ্রামরত যাত্রী, জল তুলছে যাত্রীরা, সেতুর ওপর অসংখ্য মানুষ — নিরবচ্ছিন্ন মানুষের দেওয়াল। ধর্মের বক্স অফিস নিয়ে প্রতিযোগিতা চোখে পড়ে, সব কিছুতেই ভেজাল, সাবুতেও। আর গাড়িতে — ‘কচিমুখ, পচামুখ, পাকামুখ, ডাঁসামুখ — নানা আকারের ভি.আই.পি.। আনন্দময়ীর আশ্রম বা গভর্নর হাউস চিনতে বিভ্রাট। কিন্তু চায়ের দোকান দেখে চমৎকৃত নবনীতাকে আমরা যেন প্রত্যক্ষ করতে পারি বর্ণনাগুণে। পায়ে ডবল মোজা, চটিজুতো, আর হরবখত ঘোষণা হারিয়ে যাওয়া মানুষ ও তার চেনা দলের উদ্দেশে। ভিখিরি। শুধু হাঁটা, থামা, প্রশ্ন, বিফলতা। ভিড়ের চাপ, নাগা সাধুদের শোভাযাত্রা, তারই ফাঁকে গায়ে হাত — উড়ে আসা আরশুলার মতো। লেখিকার ইংরেজিতে গর্জন। এই বহুমাত্রিক চলিষ্ণু বর্ণনার নিপুণতা ভাষায় তারিফ করা কষ্টকর। এক বহিনজীর কৃপায় আনন্দময়ীর আশ্রম পাওয়া গেল, মনের মধ্যে বাজনা বেজে উঠল যেন!

ভারত সেবাশ্রম, পাশেই আনন্দময়ীর আশ্রম। নবনীতা যখন চকোলেট ভেঙে বাচ্চাদুটোকে দিল তখনই সে পূর্ণকুম্ভের স্বাদ পেয়ে গেছে। চেনা ভি.আই.পি. দেখা। কিন্তু চতুর্দিকে কতো সাধুসন্ত পুণ্যার্থীর পদরজ:কণা। একটা ছাউনি, তাতেই আশ্রয়। তিনজনের হাতে হাতে উঠে গেল সুটকেস, ব্রিফকেস, লোটাকম্বল, ফুটুনি-ঝোলা। এক দাদু আশ্রয় দিলেন। তারপর অনেক হেঁটে চৌমাথা। চা এর জন্য ভিড়, আলাপ এক দাদা ও বৌদির সঙ্গে, তাঁরা অবলা নবনীতাকে আশ্রয় দেন। ক্লান্ত শরীরে ওই ছাউনির নীচেই কম্বল আশ্রয়ী। বিচালী বিছানো তাঁবু, কিন্তু হাঁফানির কষ্ট। কথা ও প্রশ্ন আর বিস্ময় ঝরে ঝরে পড়ে। শেষপর্যন্ত প্রশ্ন স্বামীকে সঙ্গে আনলে না কেন? ক্ষুধার্ত মানুষটিকে চিঁড়ে গুড় কলা। চিৎকৃত বাচ্চা, সান্ত্বনার বৃথা চেষ্টা, শাপ শাপমুক্তি। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, কফি দিয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টা। আগ্রহী নবনীতাকে সপাট জবাব — হ্যাঁ কফি আছে, তবে আপনাদের জন্য নয়। অপূর্ব পরিস্থিতি নির্মাণ, অতুলনীয় ভাষাবৈচিত্র্য। দিব্যি একপাশে উবু হয়ে বসা। অদূরে গাঁজার ছিলিম। পাঞ্জাবী সাধু পেতলের ডেকচিতে দুধ গরমে চাপায়। মনে পড়ল ছাত্রাবাসে গাঁজার আসর, এড়িয়ে যাবার চেষ্টা। সুস্বাদু সুরভিত গরম দুধ এনে দিল সাধু স্বয়ং। ওদিকে ভারত সেবাশ্রম ছাউনির নীচে তার মালপত্র দেখছে দাদু। সেখানে গিয়ে জানা গেল স্নানে বেরিয়েছে সবাই। অনুভব করেন — ‘এই ধুলোয় বসতে পাওয়াটুকুই আমার তীর্থবাস।’ (পৃ. ৭৫) দলের মেম্বার হওয়ায় নবনীতার হাতেও এসে গেল শালপাতার বাটিতে পুরি, একহাতা তরকারি, অমৃতি, জিলিপি। চাইতে একটা পানও পাওয়া গেল। মনে পড়ল জর্দা খেয়ে টলোমলো পা, সঙ্গে প্রাণবিন্দু, অমিয়, সুবীর। এরপর তাঁবু পাওয়া। অন্যের হাতে হাতে মালপত্র চলে যায়। কীর্তন, আনন্দময়ীকে প্রণাম, মাইকে স্নানের ডাক। ঠিক দুটোয় বেরুনো। স্নানপর্বের বিবরণ রীতিমত রোমাঞ্চকর। দুই পা জুতোসুদ্ধ, কাদায় প্রোথিত, বগলে পুঁটলি। ধমক খেয়ে ভিজে মোজা, জুতো নিংড়ে নেওয়া, তারপর; ‘জয় কুম্ভ’ বলে এক ডুব। কী ঠান্ডা। আবার ধমক জুতো হাতে উদকাঞ্জলির জন্য। পাণ্ডা ও পুরুত সহযোগে এগোনোর চেষ্টা। আলাপ এদের সঙ্গে। ‘এই আমাদের দেশ। এ কেবল ভারতবর্ষেই সম্ভব। যাকে জানিনে চিনিনে তারই জন্যে বুকটা ফাটিয়ে ফেলি। যেমন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে অন্যকে উত্যক্ত করতে আমাদের জুড়ি নেই। তেমনি অন্তর থেকে মধু ঢেলে অন্যের ঊষর জমিতে আবাদ করাও আমাদের চরিত্রে স্বাভাবিক।' (পৃ. ৮৮)।

ইতিমধ্যে উত্তুরে বাতাস, বর্ধমান বৃষ্টি, ফ্ল্যাগ হাতে স্বামীজীর সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া। কোনোরকমে চোখ-কান বুজিয়ে শাড়ী বদলানো। ভিজে কাপড়ের পুঁটলি। কার যেন সোনার মাকড়ি হারাল। মেয়েদের কলকলানি। দিলীপ বৃদ্ধ মেসোকে স্নান করিয়ে আনে। এই ‘অনৈসর্গিক কুম্ভস্নানের ক্লোজআপ ছবি’ (পৃ. ৯০) এককথায় অতুলনীয়। ফেরার পথে সন্তর্পণে হাঁটা, পবিত্রতা রক্ষা বেশ কঠিন। পায়ে শুকনো মোজা পরতে পেরে প্রাণ আসে। বেরুবার আগে সেবাশ্রমের দান বক্সে গুরদীপের দেওয়া পাঁচটা টাকা রেখে এলেন। শুনে নিলেন দাদুর মুখে সন্ন্যাসীদের স্নানযাত্রার বর্ণনা। দীর্ঘ সর্পিল মিছিল, মন বলে উঠল — ‘শোনো তোমাদের সকলের সঙ্গেই আজ থেকে আমিও রইলুম, আমিও আছি।’ এ যেন স্বপ্নের কুম্ভস্নান। কুম্ভ স্নানের কাহিনী আমরা অনেক শুনেছি। সমরশ বসু থেকে আরও অনেকের। কিন্তু নবনীতার এ কাহিনী সত্যই অতুলনীয়। মায়ের কাছে কলকাতায় ফিরে বকুনি। ‘মা চলো না আমরা কাশীতে যাই। গঙ্গার ধারে থাকব।’ মা হাসেন। মধুরেণ সমাপয়েৎ। বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যে এ রচনা — প্রকল্প রচনার অবিশ্বাস্যে, বিপজ্জনকতার একাধিক সীমান্ত অতিক্রম, নানা মানুষের বিচিত্রতায়, দুর্জয় ইচ্ছা পূর্তিতে, বর্ণনার অভাবিত নৈপুণ্যে মুহূর্তে পাঠকের হৃদয় হরণ করে সন্দেহ নেই।

প্রথম খণ্ডে (ভ্রমণ সমগ্র) এই দুটো বড়ো সাইজের রোমাঞ্চময়ী ভ্রমণ কথার পাশে আছে ছোট ছোট ১৪টি ভ্রমণ কথা। তার ২/১টি স্বদেশীয়, বাদবাকি বিদেশীয়। সবচেয়ে বড়ো কথা তাতে এমন সব ভ্রমণ আছে যা আমরা অনেকেই শুনিনি। ‘জলের ধারে ঘর’ রচনায় বিদেশে স্বদেশে ঘর বাঁধার কথা বলেছেন। এই সব জল পার্শ্ববর্তী বিচরণে অবস্থানে তাঁর শারীরিক ও মানসিক অতিবাহন। স্বপ্নের শহর সান জিমিনিয়ানোতে তন্বীপথ, ক্যাথিড্রাল পার হতে হতে নিশাচরত্ব, স্মৃতিবিধুরতা। সঙ্গী ভালেরি একটা মূল্যবান কথা বলেছিল — ‘বিনা ইতিহাসে একটা জায়গার আত্মার খবর তুমি পাবে কেমন করে?' (পৃ. ২২৯) এখানেই এসেছিলেন দান্তে, বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সম্বর্ধিত হয়েছিলেন, সেই দান্তে সভাঘর, মৃৎপাত্রাদি দেখতে দেখতে স্মৃতি মিশে গেল বাস্তবে। ইজরায়েল-এর বোকের তোভ, পূরিম উৎসব, হিব্রুভাষা ও সংস্কৃতিতে তালিম নেওয়া, স্বপ্নসন্ধান, ছোট্ট শহরে থাকা, তাদের প্রাতরাশের টেবিলে সব্জি ও ফলের প্রাচুর্য মনোহরণ করে লেখকের, পাঠকেরও। এর পাশে গাদিয়াড়া যাবার ডাক নিষ্প্রভ মনে হলে কিছু করার নেই। কিন্তু ‘ভাইকিংদের দেশে’ ফিরিয়ে আনে অজানিতের বিস্ময়। মনে পড়ে সুইডেনে আসা অজস্রবার, বাবা, মা, স্বামীর সঙ্গে। ব্যাঙ্কোয়েট ব্যবস্থার বর্ণনা আকর্ষণীয়, তবে কিঞ্চিৎ দুঃসাহসী ভোজ্য। বক্তৃতা এখানেও রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা, তসলিমা নাসরিনের কথাও ওঠে। রাজপ্রাসাদ, পুরোনো ও নতুন স্টকহোম, মধ্যযুগীয় গামলাস্টান, সুইডেন বললে যা অনিবার্যত মনে পড়ে। গনডোলেন, মহার্ঘ হোটেল, কিন্তু দিনে সস্তা, এ সম্পর্কে মজা করে বলেন — এ হোটেল — ‘নিশীথে বাঘিনী, দুপুরে গৃহিণী’ (পৃ. ২৫৩) ‘আরও অনেক অনেক কিছু দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সময়ে কুলোল কই?’ বস্টনে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন সেমিনারে অংশগ্রহণের পর দৌড় আটলান্টায়। ছাত্রীজীবনের অসামান্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ মনে পড়ে। ‘ষাটের দশকের মার্কিন মুলুকের রাজনীতির অন্ধিসন্ধি জানি’ আর ছাত্র জীবনের আদর্শ মার্টিন লুথার কিং। কিছু কথা কিংকে নিয়ে। প্রতিবাদ প্রকাশের একটা পথ গান — জানা হয়। তাঁর মানসিকতা জানা হয়ে যায়।

মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিন ইউরোপে গিয়েছিলেন ১৯৬৬তে, রামমোহনের-ও আগে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দায়িত্বশীল কর্মচারী। তাঁর ছিল বিশ্লেষণী চোখ, উদার মনোভঙ্গি, কুসংস্কারবিরোধী মন। ভ্রমণ পথের নানা রহস্য তাঁকে টানত। যেমন — কম্পাস, সামুদ্রিক জলজন্তু, মাছ, মেয়েদের নাচগান হুল্লোড়, তিমি শিকার ইত্যাদি। এই লেখার সঙ্গে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতাকেও মিশিয়ে দিয়েছেন। সাইরেনের গল্প, রাজা প্রীতি — আরও কতো কি আছে এ বইতে। নরওয়ে দেখেছিলেন বাবা-মায়ের সঙ্গে, ছোট্টবেলায়। নতুন করে আগ্রহ জাগল মেরু অঞ্চল দেখার। (২০০৩) বক্তৃতার আমন্ত্রণ সূত্রে আলাস্কায় যাত্রা, বক্তৃতা হল স্লাইড সহযোগে — রবীন্দ্র চিত্রকলায় নারী। তারপর আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, কিন্তু মন ছটফট করছে আর্কটিক সার্কেলে যাবার। ঘটনাচক্রে Arco চেয়ারম্যান বক্তৃতা শুনতে এসেছিলেন, তারই কৃপায় শ্রমিকদের জন্য নির্দ্দিষ্ট প্লেনে যাত্রা। জো তাঁর দেখাশোনার দায়িত্বে। Arco কোম্পানীর বিবরণাদি, অয়েল রিগ, তুন্দ্রা গ্রাস দেখা, কিন্তু ওরা এ ঘাস সামান্য হলেও নিয়ে যেতে দেবে না। ফ্রোজেন জাহাজ শুনে দেখার দুরন্ত আগ্রহ, পেট্রোলের গ্যাসের আগুন, বড়ো বড়ো ঈগল, এ গল্প অদ্বিতীয়। তবে এমন ভ্রমণ ভাগ্যবানেই পায়, চাই ‘মোহরের থলি।’ কামার্গ-এ গিয়ে বুনো ঘোড়ার দেশ দেখা — এও বোধহয় ‘ঈশ্বরের করুণা।’ মনে পড়ল আশির দশকে স্বামীসহ বরেণ্যদের সঙ্গে পেপার পড়া। পরিচিত সুনীল সৈকত, সেজান স্মৃতি, পোপের সাড়ম্বর রাজকীয় প্রাসাদ, কবরস্থানের ‘অতিলৌকিক আবহ।’ খামার বাড়ির আতিথেয়তা ভোলা যায় না। তাকালে চোখে পড়ে জংলী বাইসনের দল, গোলাপী সারস, বুলফাইটের আয়োজন, মন চলে যায় যীশু মৃত্যুর ৪০ বছর পরে নৌকা এসে কুলে ভেরা — এও বোধকরি ‘সান্তা সারা’র কৃপায়। লৌকিক ও অতিলৌকিকের সমন্বয় এ রচনায়।

বোর্নিওর জঙ্গলের গল্পও কম বিস্ময়ের নয়। সেখানে আছে জঙ্গলে লং হাউস, একটা বেড়ালের স্মৃতিস্তম্ভ। নবনীতা এ লেখায় বলেন — ‘আমি গ্রুপ ভ্রমণে বিশ্বাসী নই’ কারণ যূথতা নানা বিড়ম্বনা এনে ইচ্ছার স্বাতন্ত্র্যকে হত্যা করে। ট্রাভেল এজেন্সির মহিলা স্বাগত জানিয়ে বলেন — ‘আমাদের প্রথম ভারতীয় যাত্রী আপনি।’ গোলমরিচ ও লবঙ্গ গাছের; রবার চাষ, খেতখামার পার হয়ে নৌকায় অরণ্য অতিক্রম করা। এর পর লং হাউসের বিরল বর্ণনা, কোথাও আছে দেওয়ালে মানুষের মুণ্ডু, মানুষগুলোর শরীরে অজস্র উল্কি, তাতে ভ্রমণকথা, একটা ঘরে মাইকেল জ্যাকসনের বিশাল পোস্টার। কারুকার্য সমন্বিত দীপদান। জীবনই এখানে মৃত্যুকে হার মানায়, মানব সভ্যতার প্রাথমিক যৌথ অস্তিত্বের কাহিনী এখানে। এমন অনুত্তেজিত, বিরল পরিক্রমা, নারী চোখে আর পড়িনি। একটা লেখায় নানা একথা সেকথার ফাঁকে তিনি মিশর ভ্রমণের কথা বলে নেন। সেই খামেনের স্বর্ণভার, সুন্দরী নেফ্রোতিতির রত্নভাণ্ডার, রাজা রামেসিসের মন্দির, ক্লিওপেট্রার রহস্যময় লিপিস্তম্ভ, পিরামিডের গায়ের সরু সিঁড়ি, অন্ধকার গর্ভগৃহ, উটে চড়ে আগুন সাহারা পার হয়ে শীতল মরুদ্যানে পৌঁছানো। হাটবাজার নয়, নীল নদের জলে শরীর ভাসানো, নীল সবুজ স্বচ্ছতা, নৌকার হাতির দাঁতের কাজকরা সরু গলুই — বিস্ময়ের খনি যেন। ‘গোপন পিরামিডের শীতল অন্ধকার আমাকে হাতছানি দিচ্ছে’ — এই দুরন্ত, অনির্বাণ ভ্রমণ আকাঙ্ক্ষা নবনীতাকে করে তোলে মহনীয়।

লিখেছেন নবনীতা — ‘আমি তো একটুতেই নেচে ফেলি, এটা আবাল্য আমার বদস্বভাব।’ (পৃ. ৩১৭) এই নাচা, অমিত প্রাণশক্তিতে কোনো কাজে অংশ নেওয়া। জোন বায়েজ স্বয়ং গান গাইতে এসেছেন, তাঁর গানে নেচে ওঠা, জেমস বল্ডউইনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, নাদিনে গর্দিমারের বাড়ি গিয়ে সাক্ষাৎ — প্রতিষ্ঠান বিরোধী ছাত্রযুব আন্দোলনে সামিল হওয়া — নবনীতার স্কলারশিপ জীবনের বৈপরীত্যে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা প্রথানুযায়ী ছন্দায়িত বক্তব্য পেশ, প্রশ্নোত্তর, আর অন্যটি নেচে দুলে, শরীরের পরোয়া না করে, নারীত্বকে তুচ্ছ করে দিগবিদিগ শূন্য হয়ে ছুটে যাওয়া — এই দুয়ের সম্মেলন ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। বান্ধবী একটা দ্বীপ কিনেছিল — সেই দ্বীপভবনে সস্তার উড়োজাহাজে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে যাওয়া, সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন —

‘জগৎ দেখিতে হইব বাহির / আজিকে করেছি মনে
দেখিব না তার নিজেরি স্বপন / বসিয়া গুহার কোণে।’
নবনীতার কাজকারবার দেখলে মনে হত — ‘ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ/ রুধিয়া রাখিতে নারি।’

তাঁর ভ্রমণ কাহিনীর অজস্র উৎসার। তার সামান্যমাত্র উপহার দিলাম। আমার মনে হয়েছে — প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেনের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ-এর পর নবনীতার যেন জন্মান্তর ঘটে গিয়েছিল।

অপমানিত হবার দুঃখকে তিনি পাশ কাটিয়ে দৃষ্টি দিয়েছিলেন বিশ্বভুবনে। ভুবন তো বিচিত্র, তার প্রসারণের শেষ নেই, আপদ বিপদ তুচ্ছ করে এক যুবতী বেরিয়ে পড়েছে পথে বিপথে। আছে নাকি এমন দৃষ্টান্ত আমাদের এখানে? আর নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন নিরন্তর নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায়, নারী সংহতিতে, দৃপ্ত প্রতিবাদে, সতত নীতি ও প্রীতি রক্ষায়। অথচ তাতে, এইসব উচ্চারণে ছিল না কোনো রাজনীতির আবিলতা, তথাকথিত চাতুর্যবৃত্তির পাপস্পর্শ। মজা হল বিচরণ বা মৈত্রী সবের মধ্যে যেমন ফুটে ওঠে তাঁর ক্রমান্বয় জেগে ওঠা ব্যক্তিত্ব, তেমনি সেই ব্যক্তিত্ব বিচ্ছুরণে ফুটে ওঠে প্রতিবাদ। নইলে কি লিখতে পারতেন — ‘আমাকে রাঙাবে চোখ এত শক্তি রাখে না সময়।’ পুরুষতন্ত্রের, প্রভুত্ব স্ফুলিঙ্গের, অসুস্থতার আক্রমণকে একেবারে তুড়ি মেরে উঠে পড়লেন চিতায় — আমরা নতমস্তক হলাম, কেউ ক্ষণকালের জন্য, কেউ বা চিরকালের জন্য। বিরলতমার জন্য রইল আমাদেরও একগুচ্ছ পুষ্পাঞ্জলি।




(পরবাস-৭৭, ১০ জানুয়ারি ২০২০)


ছবিঃ দে'জ পাবলিশিং-এর সৌজন্যে প্রাপ্ত