না আর ধৈর্য রাখতে পারল না গোবর্ধন! কাঁচা খেজুরের ছড় ভেঙে ওর বকনাটার পিঠের ওপর ছপাছপ ঘা কতক বাড়ি কষিয়ে দিল। ল্যাম্পের আলোটা উসকিয়ে সুমিত্রা খিলখিল করে হেসে উঠল, “ওই নাদন যদি উঠতি না পারে ওর কী দোষ?”
অস্থির গোবর্ধন আরও দুখান বাড়ি দিয়ে বলে উঠল, “তেঁও গুটি একঠেঁই দাঁড়াবে ভেবেছ!”
সুমিত্রা ওর পৌরুষে খোঁচা দেয়, “উঁহু নিজে কতো পার! বললাম আমার কুমড়োর খেতখানা একটু ঠিক করে দাও!.... সেবেলায় বাহানা কত!”
পরপর তিন বছর কুমড়ো চাষে ব্যাপক মার খাচ্ছে সুমিত্রা। গোবর্ধন টোটকা জানে। নিশিঘোরে খেতে গিয়ে কী যেন একটা ঠেকিয়ে দেয়, আর তাতে নাকি ফলন হয় মারাত্মক! সবাই বলে, “গোবর্ধনের টোটকার এমন গুণ, ফসল তুলে ক্ষেত ফাঁকা করতে হলে দশ কাঠায় দশখানা গোরুর গাড়ি নামাতে হয়। সুমিত্রার স্বামী বিপুল। সে ঘরে থাকে না। গত দুবছর ধরে সে বাইরের রাজ্যে থাকে। বিপুল রঙের মিস্ত্রী। সুমিত্রা একাই ক্ষেতখামার সামলাচ্ছে। এবারও কুমড়ো লাগিয়েছে সুমিত্রা। লতায় ফুল আসবার পর থেকেই সে যেন আঠার মতো লেগে আছে গোবর্ধনের পেছনে। কিন্তু গোবর্ধন আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে। সুমিত্রার কথায় সে মোটেও সময় দিতে রাজি নয়। ওর আদরের পালিত বকনাটা আজ দুদিন হল ডেকেছে। সাধন কালার বাড়ি থেকে এই এট্টু বেলায় ওকে কোলে করে এনেছিল। এখন এই এত্তো বড়টা হয়েছে। কিন্তু ওর শিং ওঠেনি। গোপা আদর করে ওকে ডাকে বুচি। বুচিকে খুব ভালোবাসে গোপা। গোপা গোবর্ধনের বৌ। গোপাই গরু পোষানীর হিসেবটা শিখিয়েছিল গোবর্ধনকে। আঙুলের কর গুনে ওরা মোটামুটি একটা হিসেব কষে নিয়েছিল। হিসেবটা এইরকম.... “প্রথম বাছুর হলে দুধ বাছুরের ভাগ দিতে হবে না। দ্বিতীয়বারের হিসাব আধাআধি।”
কিন্তু ষাঁড় বেটা সেই যে দেগ্গাছ হয়ে দাঁড়াল তো দাঁড়াল। যেই একটু কাছে যাচ্ছে, অমনি ওর বুচি সার্কাসের ঘোড়ার মতো পেছনের দুপা ছুড়ে তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে! গোবর্ধন নিজের মনেই বকনাটাকে বহুবার বোঝাতে চেষ্টা করেছে, “কী রে বাপু! অমন অস্থির হলে হয় নাকি! এট্টু থির হয়ে দাঁড়া। না হলে ছেনো দড়া এনে এমন বাঁধা বাঁধব বুঝবি তখন গুঁতো!
কিন্তু না! গোটা একটা রাত কেটে গেল। নির্ঘুম চোখের পাতা কচলে ঘনঘন দেখতে লাগল রসুইপুরের মিঞারা ষাঁড়টাকে খেদিয়ে নিয়ে চলে গেল কিনা! না যায়নি। সকাল তেতে দুপুর হল। কিন্তু না দ্বিতীয় দিনেও একটি বারের জন্যেও বিশালাকার ষাঁড়টা ওর পিঠে উঠতে পারল না। চেষ্টা যে করেনি তা নয়। যতবার সে তার ভালোবাসা আরোপ করতে গেছে, ততবারই বুচি মাটিতে শুয়ে পড়েছে। সারারাতের মধ্যে একটিবারের জন্যেও শিং দিয়ে ঠেলে বুচিকে তুলতে পারেনি বেচারা! গোবর্ধন একদৌড়ে মদন মুন্সীর বাঁশ ঝাড় থেকে খটাখট দুখানা বাঁশ কেটে এনে একটা খাঁচা বানিয়ে ফেলল। যাকে বলে খাটরা। আদাড়ে গোরু বাছুরকে বশে রাখতে কিম্বা গুঁতোনে গাভীর টনটনে পালানের বাট চেঁছে দুধটুকু নিংড়ে নেবার জন্যেই সচারাচার এমন খাটরা বানিয়ে থাকে গোয়ালারা। খাঁচাটা এমনভাবে বানাল, বকনাটার পেটের তলায় দুখান বাঁশ আর পিঠের ওপর চাপান দুখান বাঁশ। না পারবে শুতে না পারবে বসতে। এবার ওর ঘাড়ের ওপর গোটা একখানা পাহাড় হুড়মুড়িয়ে পড়লেও সে আর কোনওমতে শুয়ে পড়তে পারবে না।
সুমিত্রা বুকের কাপড় সরিয়ে ভাঁজ করে পায়ে বাড়ি দিতে দিতে আক্ষেপ করে বলল, “মুশার ঘায় প্রাণীডা মোটে তিষ্ঠোতে পারছে না! সন্ধ্যে হয়েচে এই কখন! এট্টু সাঁজাল দিতিও তো পার না কি? দাঁড়াতেই যদি না পারে, পাল নেবে কী করে?... সেটা তো ভাবনা!”
-“পাতান্যাতা কুড়িয়ে রেখেছি, এখন জ্বালব না। গুটি আগুন দেখলি পালাবে!”
সুমিত্রা খিলখিল করে হেসে উঠল, “বৌ কনে গেল? নাকি অন্য কোনও....?”
-“আছে। কদিন ধরে কাশছে খুব! আমি বলি, চুপচাপ মুখে ন্যাকড়া পুরে দিয়ে পড়ে থাকো। জানাজানি হলি পরে সব্বোনাশের শেষ থাকবে না!”
সুমিত্রা নাকে কাপড় চেপে ভাঙা দর্মার বেড়ায় একবার কান পাতার ভান করল। এরপর চিমটি কেটে বলতে শুরু করল, “পেটের বায় চাপলে কী হয় বোঝ তো? কোনদিক দিয়ে বেরোয়? তোমার হয়েছে তাই বুঝলে!” গোবর্ধন সুমিত্রার কথায় গুরুত্ব দিতে চায়না। সে একটা লম্বা লগি নিয়ে বিরাটাকায় ষাঁড়টার নাভির নিচে সুড়সুড়ি দিয়ে ওর পৌরুষকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা চালাতে লাগল। সুমিত্রা অস্থির হয়ে উঠল, “এসব না করে, চাকলার ফজলু ডাক্তারকে ডেকে এনে একটা ইনজেকশান দিয়ে নিলেই তো মিটে যেত!”
গোবর্ধন আঁতকে উঠল, “মাথা খারাপ!”
-“কেন, এতে আবার মাথা খারাপের কী হল?”
-“শুনিসনি, মিম্বার এসে ওদের বাড়ি থেকে বেরুতে মানা করে গেছে। ওর ছোটভাই হাবলু ছিল দুবাইতে। দুদিন হল বাড়ি ফিরেছে। করুনা না কী ছাইপাশ পেটে করে এনেছে। বাড়িসুদ্ধ লোকের কাশি দেখে মানুষের সন্দ হল। এখন নুকোতে বালিশ চাপলে হবে!”
-“তাতে আর গরু বাছুরের কী দোষ? হাতে কভার পরেই তো দেখি পেটের মধ্যে পুরে দেয়। তারপর দুবার চোনালেই সব সাফসুতরো ব্যাস!”
-“চোনালেই যদি সব ধুয়ে যেত রে, তাহলে তো আর দেশে এই যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হত না!”
-“বল কী! একফোঁটা চোনার কী দাম জান? দেশের সব তাবড় তাবড় লোক খেয়ে তুড়ে দেচ্ছে! আর ওই তুমার ষাঁড়ও কমে যায় না! দিনেরাতে কতজনের পেছন শুঁকে বেড়াচ্ছে খোঁজ রাখ? কাল দেখলাম ছাপিয়াদের আধবুড়ি গাইটার পেছন চেটে চকা করে দেচ্চে!”
-“সত্যিকথা বলতে কী জানিস, আমি চাইছি বুচির প্রথম একটা বকনা বাছুর হোক। ফজলুর ওষুধে শুনেছি সব এঁড়ে বেরোয়!”
-“ভগমান তোমাকেও তো অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। কি দেয়নি? ঝেদি তেমন হত গোপাকে কোনটা দিতে পেত্থম?” সুমিত্রার স্বরে সবসময় যেন পরাগ মাখানো থাকে! গোবর্ধনের কানের লতি গরম হয়ে ওঠে। দুই উরুর লোমকূপ বেয়ে কী যেন এক অনুভূতি বিছার মতো ব্রহ্মতালুর দিকে ঠেলে ওঠে ওর। অন্ধকারে সুমিত্রা গোবর্ধনের হাত ধরে বলল, “কী গো ঠাকুরপো, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো? চলো খানিক গা ঢাকা দিই, নিশ্চই ঝাঁপবে!”
গোবর্ধনের গা শিরশির করে উঠল, “হাত ছাড়। কেউ দেখে ফেললে....!”
-“বাইরে তোমার জন্যে কে দাঁড়িয়ে আছে শুনি? জীবনের ভয় সবার আছে বুঝলে?”
সুমিত্রা আরও জোর খাটাল। হাতের ঝটকা খেয়ে টিনের টেমিটা মাটিতে উলটে পড়ল। ওটা আর উঠোতে অবসর দিল না। তার আগেই সুমিত্রা মরিয়া হয়ে পীড়াপীড়ি করতে লাগল,“আমার খেতখানা উজাড় হয়ে গেল! টোটকা তোমায় দিতেই হবে। দোহাই তোমার, আজ আর না করো না।”
ভোর। আঁচলভরে পুরুষফুল ভেঙে গোবর্ধনের কোলের কাছে এসে বসেছে সুমিত্রা। ওর মুখেও যেন আজ তৃপ্তির আভা। গোবর্ধন চোখের ক্লান্তি মুছে ফুলগুলো থেকে হলুদ পাপড়ি গুলো খসিয়ে পুরুষ লিঙ্গের পরাগ ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষা দিচ্ছিল। এমনসময় ওদের নজরে এল, গোবর্ধনের গোয়ালঘর সহ বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলছে! গোবর্ধন চঞ্চল হয়ে উঠল। সুমিত্রা ওকে টেনে ধলল, “দাঁড়াও, একসাথে না। আমি আগে যাই। এট্টু পরে এসো। সাঁজালের ওপর কেরোসিনের ছিটে লেগেছে নিশ্চই!”
-“কেরোসিন এল কোত্থেকে?”
-“কেন, ন্যাম্পোটা চেলে ফেললে যে!”
-“আমি চেলে ফেললাম?”
-“তা নয় তো কী! আমি তখনও তো দেখলাম, ওর খোলের আগুন আর ধুঁয়া গুবগুব করে খাবি খাচ্চে! বাস্ট হয়েচে বোধয়!”
গোবর্ধন যতক্ষণে এল ততক্ষণে সব শেষ! গোয়ালে রাখা খড়ের আঁটি, বুচির জন্যে তৈরি খাটরা সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
গোবর্ধন একা একাই উঠোনে প্রলাপ বকে চলেছে, “কোথায় গেলে গোপা? বুচি,...সে কোথায়? বুচি নাহয় দড়ি এড়া পেয়ে পালিয়েছে। ষাঁড়টাও বোধয় ওর সাথে সাথে....! কিন্তু তুমি কোথায়? কামরা অব্দি আগুন যাবে না তো! তাহলে....?”
সকালবেলা পাড়ার লোকের কাপড় জড়ানো চোখেমুখে স্বস্তির হাসি, “যাক, সুমিত্রার মুখে শুনছিলাম বৌটা কদিন ধরে কাশছিল খুব!....নিজেও বেঁচেছে আমরাও চিন্তা মুক্ত হলাম!”
অনেকে আবার আরেক ধাপ এগিয়ে এসে বলল, “গোপার গতিক দেখে যা অনুমান করছিলাম, আটক তো একদিন না একদিন করতই তাইনা? সেই যাতনার চেয়ে এটা ঢের সম্মানের!”
-“কী সব্বোনেশে কথা! এতো নিষ্ঠুর হও কী করে? শরীর থাকলে জ্বরজারি কতকিছুই হয়। তাইবলে ছুতোই নাতায় মানুষকে এভাবে দাগিয়ে দেওয়া ঠিক না!”
-“দেখ ঝেয়ে অন্য কোনও অশৈলে ছিল কিনা?” প্রতিবেশীদের আঁচলচাপা ঠোঁটের ফাঁস গলে এসব কথা অর্ধেক বাইরে প্রকট হয়, অর্ধেক মোড়া থাকে অজানা রহস্যেই।
গোপা নিঃসন্তান। পাঁচবছরের বিবাহিত জীবনে একটিও সন্তান দিতে পারেনি গোবর্ধনকে। অনেক দুঃখ ওর তলপেট বেয়ে মোচড় মেরে উঠতে চাইছিল। কিন্তু বুচিকে খুঁজতে গিয়ে কাঁদবারও অবসর মেলেনি গোবর্ধনের! তাছাড়া এই মড়ক পোড়ানো প্রলাপ শুনবেই বা কে! কেউই আর উঠোনে দাঁড়াতে আসে না।
পড়ন্ত বিকেল। পুড়ে যাওয়া ভিটের ওপর বসে ধারালো দা দিয়ে বাঁশের বাখারি বানাচ্ছিল গোবর্ধন। ঝলসানো সজনের ডালে বসে একটা পাখি তার চেরা গলায় পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা বলে ডেকে ডেকে কানমাথা অস্থির করে তুলতে লাগল। এখন আগুনমাস। ঘরে বাইরে তীব্র দাবদাহ! ভেতরটা হুহু করে উঠল গোবর্ধনের। গোপা নেই ভাবতেই মনের ভেতর থেকে যেন ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো কষ্টমাখা শ্বাস বেরিয়ে এল। হঠাৎ দেখতে পেল আধপোড়া কাঠকয়লার স্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে বুচি, ... ওর বকনাটা। পেছনে সেই অলস ষাঁড়টা! একটা কটু খিস্তি ককিয়ে উঠল ওর কন্ঠনালী বেয়ে, “রস এখনো মাঠে হয়নি! গুটি পারবে না কিছু!.... তেঁও ওর পেছন পেছন ঘুরে মরছে!” কিন্তু গোবর্ধনের সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। দেখল, বকনাটা ঘাসপাতা খেয়ে এক্কেবারে গণ্ডারের মতো চেহারা হয়েছে। আর সে খুটি গেঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে আর ষাঁড়টা ঘনঘন ওর পিঠে উঠছে! গোবর্ধনের বুকের ভেতরটা মলকানো মাচার মতো মচমচ করে উঠল। খাটরা ছাড়া, খাঁচা ছাড়া,... কেবলমাত্র খালি পায়ে সুবোধ বধূর মতো কী সুন্দর পাল নিচ্ছে তার বকনাটা।
এবছর সুমিত্রার ক্ষেতে ব্যাপক কুমড়োর ফলেছে। একটা বোঁটাও বাদ যায়নি। কিন্তু সুমিত্রার দেখা নেই। ‘ঘর থেকে বেরোয় না কেন ও?’ গোবর্ধন ভাবে। যে সোমবার গোবর্ধনের বুচির একটি এঁড়ে বাছুর হল, ঠিক তার পরের সোমবার সুমিত্রার কোল আলো করে একটি পুত্রসন্তান এল। বুচির বাটে দুধ নামবে খুব। পালানের ভার দেখে তাই তো মনেহয়। পালান যেন মাটিতে ন্যাতড় খায়! শুতে গেলে উলটে পড়ার উপক্রম হয় বুচির! গোবর্ধন আগে থেকেই বাসনওয়ালার কাছে বড় বালতির বরাত দিয়ে রেখেছে। কোনওপ্রকার শালদুধটুকু শেষ হলেই বুচির বাট চেপে বালতি বালতি দুধ নামাবে গোবর্ধন।
ঘোষ আসেনা। দুধের চাহিদা একদমই নেই। মানুষ এখন ইঁদারায় দুধ ঢেলে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এসব কথা ভাবে আর মাথাটা এলোমেলো হয়ে যায় গোবর্ধনের। অন্যদিকে সকাল হতে না হতেই এঁড়েটা একছুট্টে বেরিয়ে গিয়ে এর ওর উঠোন চেটে তিড়িং বিড়িং করে লাফায়। একে এঁড়ে, তার ওপর এতো অশৈলে সহ্য করতে পারে না গোবর্ধন। ইচ্ছে করে দা দিয়ে গাই বাছুরকে দুভাগ করে দিতে।
এখন সকাল হতে না হতে সাধন কালা আসে। বুচির বাটে দুধ নামার কথা ওর কানে কারা যেন ভাইরাসের মতো ঠেসে দিয়েছে! সাধন কালা কানা বকের মতো টোয়াতে টোয়াতে গোবর্ধনের উঠোনে এসে বসে। গোবর্ধন ভেতরে ভেতরে পুড়তে থাকে, “নর্দমায় ঢেলে দেব তেঁও স্বীকার ...একছটাক তো দেবই না। তাছাড়া বকনা না হওয়া পর্যন্ত বুচিকে ফেরত চাইলেও দিচ্ছিনে!”
সাধন কালা নিজ থেকেই কথা পেড়ে সময় অতিবাহিত করে, “দুয়েকদিনের মধ্যেই বিপুলের বদমায়েশ বৌটা মরবে!”
গোবর্ধন চমকে উঠল, “কে সুমিত্রা?”
-“তা নয় তো কে! কার সাথে লটরপর করে মরেছে কে জানে! সবাই ঝ্যাকন ঘর বন্দী, আর উনি....!” কথাটা আর বলতে পারল না সাধন।
গোবর্ধন লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞাসা করল,“বাচ্চাটা?”
-“দেখ না উঠোনে চিৎ করে ফেলে রেখেছে! ছুঁতেও মানা! সুমিত্রা একাই সারা গ্রাম ছড়িয়েছে। সুস্থ হলেও মানুষ ওকে ছেড়ে দেবে ভেবেছ?”
বিপুলের কথা আর জিজ্ঞেস করতে সাহস হলনা ওর। কেবলমাত্র পায়ের পাতা উঁচু করে সুমিত্রাদের উঠোনে একটুখানি উঁকি মারল। মাত্র দুটো বাড়ির পরেই সুমিত্রাদের উঠোন। অথচ কালচক্রে আজ ব্যাবধান অনেক। গোবর্ধনের দুঃখ হল খুব,“হা ভগবান! ছেলেটা কী কুক্ষণেই না জন্মেছে!” ওকে দেখার জন্যে গোবর্ধনের চোখদুটো চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু কী একটা ভেবে সে চেষ্টায় ক্ষান্ত দিল। অস্ফুটে বলে উঠল উঠল,“কী সব্বোনাশ! এখন উপায়?”
-“সব্বোনাশের আর দেখেছ কী! এই কাজটা যে করেছে তার ছাড়া নেই। সন্ধান চলছে তলে তলে। ধরা একদিন পড়তেই হবে। তখন বুঝবে বাচাধন!”
-“মানে?”
সাধন শুষ্ক বুকের হাপর ঠেলে অর্ধেক হেঁচে অর্ধেক কেশে ধমক দিয়ে উঠল,“মদ্দা মানুষ হয়ে মানে মানে কর কোন দুঃখে শুনি? ক্ষেতের কুমড়ো তুলে, তুমার নামে সিন্নিও তো দিয়েছে শুনেছি!”
এই অস্বস্তি গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে গোবর্ধন একপ্রকার মরিয়া হয়ে উঠল,“দেখ আমাকে ওই হিসেব দেখাতি এস না! দুদিন ওর ভুঁইতে গেছি সত্যি।...কিন্তু সে কবেকার কথা? তাছাড়া সবই তো এখন হুজুগে চলছে। ওর যে ওটাই হয়েছে,... তার কী ঠিকঠিকানা আছে! দেখলে না গোপার ব্যাপারটাও কেমন হড়েগড়ে মিশিয়ে দেওয়া হল!” বহুদিন পর বৌএর কথা মুখে নিতেই সহসা চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে গোবর্ধনের।
-“আমিও তো তাই বলি! ওই সব্বোনেশে মাছিটা কোনদিক দিয়ে যে কার হুল ফোটাচ্ছে,...হিসেব মেলান যাচ্ছে না!”
আজ আর সাধন দুধের হিসাব চাইল না। বুচিকে ফিরিয়ে নেবে,... সে কথাও বলল না। পরিবর্তে বিষাক্ত একটা পেরেক গোবর্ধনের বুকের মাঝখানটায় যেন ঠুকে দিয়ে গেল!
সাধন চলে গেলে গোবর্ধন নিজের মনেই চিন্তা করতে থাকল,“গোপার অভিশাপ নয় তো? সেটাও বা কীভাবে সম্ভব? এই যে শুনি একটানা পনেরো দিনের বেশি এসব বালাই বাঁচে না! তাহলে...?” অপরাধ বাহক অস্থির তালুদুটো গোবর্ধন তার বুকের ওপর রেখে ঘষতে থাকে....ঘষতেই থাকে!
(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)