Subscribe to Magazines






পরবাসে
দিলশাদ চৌধুরী

লেখা


ISSN 1563-8685




খোয়া পারিজাত

কটা পুরো রাত বারান্দায় একা বসে কাটিয়ে দিল হাবিব। অন্য কোন সময় হলে বেশ ভয়ই লাগত তার। এমনিতেও একটু ভয়কাতুরে সে, বাতাসে গাছের পাতা নড়লেও আলহামদুলিল্লাহ সূরা পড়ে চোদ্দবার। আগে যে বাসাটায় তারা থাকত সেটার পাশেই ছিল একটা বড় ডোবা পুকুর, গভীর রাতে পানিতে ঢিলের আওয়াজ হত। আব্বা বলতেন, "মাউছ্যা পেত্নি ঢিল দিতাছে, আয়াতুল কুরসি পড়।" নিজেও বিড়বিড় করে পড়তেন। মা চুপ করে থাকতেন। এক শুক্রবার আব্বা বাজারে গেলে মা তাকে রান্নাঘরে ডাকলেন। তারপর তরকারি কাটতে কাটতে আস্তে আস্তে যা বললেন তার সারমর্ম হলো, রাতে পানিতে মাছে ঘাই দেয়, তাই শব্দ হয়। সে যেন অযথা ভয় না পায়। হাবিবের অবশ্য আব্বার ব্যাখ্যাটাই বেশি মনঃপূত হয়েছিল, কিন্তু সেদিনের পর থেকে সে বুঝতে পারল যে তার মায়ের এক যুক্তিবাদী মন রয়েছে। আরও একবার সেই মনের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল, এই বাসায় ওঠার সময়। খোলামেলা সুন্দর টাইলস বসানো বাসা। দুটো বাথরুম, একটাতে আবার বাথটাবও আছে। খোলা দুটি বারান্দা, আলাদা স্টোররুম। কিন্তু এই বিল্ডিং নাকি কোন এক পুরনো কবরস্থান ভেঙে তার উপর করা। তাই আব্বা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না এই বাসায় উঠতে। মার আগ্রহেই শেষে রাজি হন।

আজ বারবার মায়ের কথাই মনে হচ্ছে তার। প্রায় পনেরো দিন হলো মা হাসপাতালে। ডাক্তারের মতে তার শরীরের ভেতরের কোন অর্গানই ঠিকমতো কাজ করছেনা। মায়ের রোগ আজকের নয়, বিভিন্ন ধরনের রোগ মায়ের শরীরে বহু আগে থেকেই দানা বাঁধছিল। কিন্ত মাকে কখনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি সেভাবে। মায়ের শরীরের যেকোন সমস্যার ডাক্তারি আব্বাই করতেন, মা কিছু বলতেন না। এখন নাকি সমস্যা বাড়তে বাড়তে বিপুলা হয়ে উঠেছে। আব্বা বেঁচে নেই, থাকলে তার চিকিৎসার কেরামতি দেখে কি বলতেন তাই ভাবে হাবিব।

গতকাল মাকে বেডে দেয়ার কথা ছিল। যদিও মায়ের জ্ঞান নেই,কাউকেই চিনতে পারেননা। শরীর নাড়াতেও পারেননা তেমন, স্থির হয়ে শুয়ে থাকা কেবল। তবুও, বেডে দিলে দুবেলা গিয়ে দেখে আসা যেত। সকালে সে আশা নিয়েই সে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। ডাক্তার তাকে জানাল, কয়েকবার জ্বর আসায় তার মায়ের করোনা টেস্ট করানো হয়েছিল এবং টেস্ট পজেটিভ এসেছে। বেডে দেয়া তো দুরস্ত, বরং এখন তাকে আইসোলেশনে রাখা হবে। হাবিব তার মায়ের কাছেই যেতে পারবেনা, নার্সরাই তার দেখাশোনা করবে।

হাবিব বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে দাঁড়ায়। মেয়ে তিনা আর স্ত্রী পিয়া ঘুমুচ্ছে। পিয়া আবারও সন্তানসম্ভবা, এই অবস্থায় কোন রিস্ক নেয়া যায়না। নইলে সে মাকে এখানে এনেই সেবা করত নিজের হাতে। মা চেয়েছিল, নিজে পছন্দ করে ঘরে বউ আনতে। পিয়াকে মা পছন্দ করে আনেননি, এনেছে হাবিব। পিয়ার আচার-আচরণ ভালো, রাঁধতে বাড়তেও জানে। কিন্তু মায়ের সাথে তার সম্পর্কটা তেমন গভীরে যায়নি। পিয়ার বাবা মা উচ্চশিক্ষিত, তাই মা নিজের অশিক্ষা নিয়ে একটু অস্বস্তিতেই ভুগতেন। হাবিব কখনো এই ব্যাপারগুলো নিয়ে চিন্তা করেনি। আজ একা বসে এই সমস্ত কথাগুলো যেন আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে সারাজীবন সব নিয়েও একা হয়ে থাকা মায়ের ছবি।

তার মনে পড়ে, চট্টগ্রামে পড়তে গিয়ে সে সবসময় আব্বার কাছেই চিঠি লিখত। টাকা চেয়ে, কুশল জানিয়ে এক পৃষ্ঠার চিঠি। কোন এক ছুটিতে বাড়ি আসার পর মা খেতে দিয়ে আস্তে আস্তে বলেছিলেন, "তুই তো তোর আব্বার কাছেই লিখস, আমারে তো চিঠি লিখসনা।" হাবিব হেসে বলেছিল, "লিখব নাহয় সামনেরবার।" কিন্ত আর সে লেখা হয়ে ওঠেনি, মাও আর কোনদিন অনুযোগ করেননি। হাবিবের আজ খুব অপরাধী লাগে নিজেকে। টাকার প্রয়োজন হলেই আব্বাকে সে চিঠি লিখত। মাকে চিঠি লেখার কথা কোনদিন মনে হয়নি তার। সে কি মায়ের টাকা নেই বলে? উপার্জন নেই বলে?

পরদিন হাবিবকে দেখা যায় আইসোলেশন ওয়ার্ডের সামনে। অনেকক্ষণ ইতিউতি করার পর এক নার্স তাকে দেখে এগিয়ে আসে।

- কাউকে খুঁজছেন? এখানে কিন্তু ঢোকা যাবেনা।

- হ্যাঁ... না মানে, আমার মা আইসোলেশনে।

- কত নাম্বার বেড?

- ১৬ নাম্বার।

হাতে থাকা ফাইলের কাগজগুলো উল্টে কি যেন দেখে নেয় নার্সটি। তারপর কিছু বলার আগেই হাবিব বলে,

- একটা কাজ করে দেবেন, আপা?

- কি কাজ, বলুন।

হাবিব পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে, সাথে মানিব্যাগ থেকে একশ টাকা।

- এই চিঠিটা, আমার মাকে একটু পড়ে শোনাবেন।

- কিন্ত যতদূর জানি, আপনার মায়ের তো জ্ঞান নেই। কাউকে চিনতে পারেননা, কথাও বলতে পারেননা।

- হ্যাঁ জানি। তবুও পড়ে শোনাবেন নাহয়, শুনতে তো পাবে। শুনতে পেলেই হবে। বলবেন বারবার করে, হাবু পাঠিয়েছে।

হাবিবের চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে যায়।



(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)