দামোদরের চর থেকে কলসি ভরে বালি তুলে আনে মণিমালা। মণিমালা বাসবের বউ। এরপর ওগুলো রোদে শুকিয়ে সরু চালনিতে চেলে কাঠকয়লা বেছে খোলায় দেয়। সবাই জানে মণিমালা যদি ভুনা না ভাজত বাসবের সংসারটা এদ্দিন কবে কোথায় ভেসে যেত! অথচ বাসব একদণ্ড ঘরে থাকে না। সে সারাক্ষণ তিন বাঁশের খুঁটির মাথায় মাচা বেঁধে বসে থাকে। পাড়ার লোক বলাবলি করে, “পাকা আনারসের মতো ঘরে অমন একখান বউ থাকতে কোন দুঃখে যে বাসব বালির ওপর পড়ে থাকে কে জানে!”
এসব নিয়ে মণিমালার আলাদা কোনও মাথাব্যথা নেই। সে চাষাঘর থেকে খুঁজে খুঁজে মিষ্টি সুগন্ধি ধান এনে খই ভাজে। আর ওগুলি নিয়ে সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলে বাইরে বার হয় বাসব। বাদবাকি দিনগুলো সেই নদীর ওপর বালির বিছানায় বুক জাবড় দিয়ে পড়ে থাকে সে।
কাঠ-পাতার আখা। উনোন নিভে গেলে বালি জুড়িয়ে যায়। তখন খই ভালো ফোটে না। একহাতে সবদিক সামলাতে হিমসিম খায় মণিমালা। মাঝে মাঝে উপুড় হয়ে ফুঁ দিতে হয়। মণিমালার শরীরটা মোটাসোটা, ওর পেটে চাপ পড়ে। বাসব বাঁশঝাড় থেকে ফাঁপা দেখে বাঁশের সরু আগা কেটে দিয়েছে। ওই চোঙাতে গাল ফুলিয়ে ফুঁ দিয়ে আখার আগুন জাগিয়ে রাখে মণিমালা। গরম বালিতে কাঁচাধান পড়লে ফটফট করে ফেটে উনোনের চারপাশ সাদা হয়ে আসে। আর ঠিক তখন একটা ভুরভুরে গন্ধ মণিমালার উঠোন পার হয়ে পাড়াময় ভেসে বেড়ায়। এসময় ওর সাথে গল্প করার জন্যে আসে রতন। গল্প ঠিক নয়, বলা চলে মণিমালার পেছনে লাগতে আসে রতন। মণিমালা একহাতে একটা খুরশি পিঁড়ি চেলে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলে, “বসো, কথা আছে। খোলাটা ভেজে নিই, বলছি।”
আজ নিজে থেকেই পিঁড়িটা টেনে নিয়ে বসেছে রতন। একগাদা পড়াশুনা করে বাড়িতে বেকার বসে আছে রতন। দেশের আর দশটা ছেলে যেমন বেকার বসে থাকে, সেও তেমনি বসে আছে। উচ্চশিক্ষিত ছেলে, অথচ গ্রামের কেউই ওকে দুচক্ষে দেখতে পারে না। কেননা ও নাকি কারণে অকারণে একে-তাকে উত্যক্ত করে বেড়ায়। একথা রতনও স্বীকার করেছে, মানুষকে অতিষ্ঠ করতে ওর নাকি ভীষণ ভালো লাগে! এটাও কি একপ্রকারের মানসিক রোগ? জানে না রতন। এখন ওর কেবলি যেন মরে যেতে ইচ্ছে হয়, পারে না। তখন পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় মণিমালার উঠোনে। গ্রাম সম্পর্কে মণিমালার ঠাকুরপো হয় রতন। অথচ মণিমালার কাছে এলে শোনে অন্য কথা, “জানো, কাল প্রায় মরেই যাচ্ছিলাম! এই দেখো গলায় এখনো দাগ!”
রতন মনেমনে অবিশ্বাস দেখিয়ে বলে,“ওফ্ শেট!”
অভিমানে লাল হয়ে ওঠে মণিমালা,“বিশ্বাস করলে না তো? সত্যি বলছি...!”
--“মরলে না কেন?”
মণিমালা অপলক চোখে চেয়ে থাকে রতনের দিকে। মুঠোর মধ্যে গরম খই গুঁড়ো করে রতন বলে,“বেকার, বুঝলে? কোনও লাভ নেই!”
--“কুচের হাঁড়ি কোলে নিয়ে বসে থাকলে কেউ কাজ দেবে না। তাছাড়া তুমি তো শুনি বৃন্দাবনদার চোখেও শত্তুর! কী দরকার ওদের মতো মানুষের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে? চাকরি বলো আর যাই বলো, ওদের হাতেই তো এখন সমস্ত ক্ষমতা। দেখো না একটা কলাগাছও শক্তপোক্ত প্যালা না পেলে ফল সমেত কেমন ধপাসকরে মাটিতে শুয়ে পড়ে!”
--“বলছ কী! ওই বৃন্দাবনের হাতেই আস্ত একটা নদী চুরি হয়ে যাচ্ছে, কিছু বলব না?”
--“যাক চুরি হয়ে! এতে মা জাহ্নবীর কিছুই যায় আসে না। কত লোকে কত কী উঠোচ্ছে! এই যেমন আমার খই ভাজতে বালি দরকার, আমি আমার মতো করে উঠিয়ে নিয়ে আসি। তোমার বাসবদার আঠার দরকার, সেও...।” বাকি কথাটুকু আর বলা হয় না, আটকে যায়। মণিমালা কথা ঘুরিয়ে বলে, “শুধু শিক্ষিত হয়ে লাভ নেই, বুঝলে?”
--“সত্যিকথা বলতে কী, পিসিটা মাথার ওপর ছিল বলে যাহোক এটুকু শিখতে পেরেছি। উনি যদি দেখে আমি একজন মাটিচোরের সাথে মেলামেশা করছি...!”
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। হঠাৎ বালিতে কাঠি দিতে দিতে মণিমালার মনে পড়ে যায় গণেশের কথা,“সত্যিই কাজ করতে চাও? আচ্ছা ওদের বলে দেখছি, কিছু তো একটা উপায় হবেই!”
রতন উৎসাহে আখার মধ্যে জ্বালানি উসকে দিয়ে বলে, “সত্যি বলো না কী উপায়?”
ঝপ করে উঠে পড়ে মণিমালা। ঘর থেকে এক প্যাকেট ব্লেড এনে রতনের হাতে দিয়ে বলল, “এই নাও। পারলে চরে যাও। ফল চিরতে পারো?”
--“কীসের ফল?” মণিমালা কথা বলে না। উপুড় হয়ে ফুঁ দেয়। এখন ঘনঘন বুকের ওপর থেকে কাপড়টা সরে যায় ওর। রতন ক্রমশ তেতে ওঠে। হঠাৎ খপকরে মণিমালার হাতখানা ধরে বলে, “কী গো, বললে না তো কীসের ফল?”
মণিমালা বুকের কাপড় টেনে নিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে। ওর হাসির সাথে পাল্লা দিয়ে খইগুলোও ফেটেচটে এদিক-ওদিক ছুটতে শুরু করে। হঠাৎ রতনের নজর পড়ল মণিমালার হাতের চোঙাটায়, “কী এটা?”
--“কেন মোটে চেনো না মনে হচ্ছে! ঢং...।”
-“কই দেখি...।”
উনোন থেকে আধপোড়া চোঙাটা টেনে তুলতেই মণিমালার হাত থেকে রতন ওটা কেড়ে নিল। এরপর ওর পোড়া অংশটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল, “বাঃ দারুণ জিনিস তো!”
--“দাও বলছি আমার আখা নিভে যাবে।” মণিমালা কেড়ে নিতে গেলে রতন আরও শক্ত করে ধরল। মণিমালা পলকা অভিমান দেখিয়ে বলে,“ছাড়ো, কেউ দেখে ফেলবে!” রতন ছাড়ল না। চোঙাটা দুজনের মুঠোর মধ্যে পড়ে সমানে মোচড় খেতে লাগল। এমন সময় বাসব চর থেকে ফিরে এল। মণিমালা তাড়াতাড়ি আখা নিভিয়ে উঠে গেল। বাঁশের চোঙাটায় ফুঁ দেবার অছিলা দেখিয়ে রতন আস্তে আস্তে সরে পড়ল।
এখন একদিন অন্তর অন্তর চরে পুলিশ আসে। রাতে গাড়িতে বালি লোড হয়। মাঝে মাঝেই সকাল হলে একটা দুটো মৃত্যুর খবর চাউর হয়। চরের হাওয়া দুদিন কিছুটা থমথমে থাকে, আবার যে কে সেই। ধু-ধু করা বালু। মরা নদী। মাঝখানে এক আঁজলা জল আয়নাধোয়া আঠার মতো ঝিরিঝিরি করে সারাক্ষণ বইতে থাকে। বিকাল হলে উঠতি বয়েসের ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে নদীর চরে আসে। কেউ সেলফি তোলে, কেউবা টিকটক ভিডিও বানায়। আবার কেউ কেউ উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায় চোরাবালির চরে। এরা অধিকাংশই স্কুলপড়ুয়া। কিন্তু এখন আর লেখাপড়ার সাথে বিশেষ কারও যোগ নেই বললেই চলে। কিছু একটা আসক্তির মধ্যে এরা যে আটকে পড়েছে, সেটা এদের হাবেভাবে খানিকটা হলেও বোঝা যায়। এদের মধ্যে রতনকেও বালির ওপরে বসে থাকতে দেখেছে বাসব।
এখন একদণ্ডও বাঁশের মাথা থেকে নামে না বাসব। প্রতিটি গাছের গিঁটে গিঁটে ফল ধরেছে। আর দিন পনেরো পরেই ব্লেড দিয়ে চিরে দিতে হবে। একফোঁটা আঠার এখন অনেক দাম। প্রায় আড়াই বিঘে জমিতে আফিম চাষ করেছে বাসব। গণেশের কাছে অনেক টাকা ঋণ ওর। সে-কারণে মাথায় এখন হরেক কিসিমের দুশ্চিন্তা ভর করে। থানা পুলিশ, রাতের বালি মাফিয়া, বিকালের বালি-শ্রমিক, জল তুলতে আসা মেয়ে বউ সবাইকে সমানে ওয়াচ করতে হয় বাসবের। কেননা চরের জমি, যে কেউ গায়ের জোর ফলাতে পারে। এর আগে পুলিশ এসে পর পর তিন বছর ট্রাকটর দিয়ে গাছ নষ্ট করে দিয়ে গেছে বাসবের। ফি বছর সেই একই হতাশা, ফুল ফুটতে না ফুটতেই পুলিশ আসে। ফলের মুখ কিছুতেই আর দেখা হয় না বাসবের। অনেকদিন থেকে এক্কেবারে ভিখিরি হয়ে আছে বাসব। কিন্তু আর না! এবার তাকে এই আঠার আলাদিন ঘরে তুলতেই হবে। মাছ ধরার ভান করে জলের ওপরে দিনরাত ঝোপ মেরে বসে থাকে বাসব। কেউ কেউ জল নিতে এসে ঘোলা দিয়ে বলে, “ঘরসংসার ভাসিয়ে দিয়ে দিব্যি জাল পেতে বসে আছে! রঙ্গ কত!” এসব কথায় কর্ণপাত করে না বাসব। ঘর সংসার কী দিতে পারে তাকে? মণিমালাই বা সামান্য দুমুঠো খই ভেজে কী এমন রাজ্য উদ্ধার করে দেবে তার! ওদের কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই বাসবের। বালির ওপরে বেড়ে ওঠা খেতখানা জুড়ে এখন আকাশকুসুম কল্পনার মধ্যে আছে বাসব। এখন প্রতিদিন স্বপ্ন দেখছে আঠা চালান যাচ্ছে বাংলাদেশ মায়ানমার হয়ে আরও অনেক দেশে। চোখ বন্ধ করলে এখন দিব্যি দেখতে পায় ফুলে ফুলে ভরে আছে ওর দখলী নদীর চর, ঘরবাড়ি, উঠোন পুকুরপাড় সব সব! গাছে ফুল আসার পর থেকে খই নিয়ে আর বাইরে বার হয়নি বাসব। এমনকী স্নান-খাওয়ার জন্যেও যে বাড়ি আসতে হয়, একথাও ভুলে গেছে বাসব। ইদানিং রাত হলে গামলায় ভাত বেঁধে বালির চরে দাঁড়িয়ে হাঁক দেয় মণিমালা। বাসব মাচার ওপর থেকে নেমে এসে ভাতের পাত্রটা নিয়ে সটান মাচায় গিয়ে ওঠে। দুয়েকটা দরকারি কথা ছাড়া অন্য কথা হয় না বললেই চলে।
--“আজ পুলিশ এল যে বড়!”
--“কনে?”
--“রতনের কামরায়।”
--“দেখ চাকরিটাকরি বাগাবে বোধহয়।”
মণিমালা চলে যাচ্ছিল। বাসব আবার ডাকল, “তুই ঠিক দেখেছিস তো?”
--“আমি ইয়ার্কি মারতে এইচি মনে হচ্চে?” মণিমালা যেতে যেতে হঠাৎ শুনতে পায়, বাসব হাঁকছে, “গণেশ, রাতের মধ্যে যতটা পারা যায় হাত চালিয়ে ভাই...!” মণিমালার বুকের ভেতটাতেও মোচড় দিয়ে উঠল। হঠাৎ আকাশে কালবৈশাখীর মেঘ ঘনিয়ে এলে খেতভরা পাকা ধান কোলে নিয়ে চাষিরা যেমন আতঙ্কে হাঁকডাক শুরু করে দেয়, ঠিক তেমনই ভয় আর উত্তেজনা মেশানো হাঁক শুনতে পায় মণিমালা!
রাতেই নদীর ওপর থেকে বাসব গ্রেপ্তার হল। আর ওর আফিমের খেতখানাও তছনছ করে দিয়ে গেল। কার হাত কে কীভাবে কলকাঠি করল, কেউ কিচ্ছুটি রা কাড়ল না। শুধুমাত্র গণেশের লোকেরা এসে রতনকে বাইরে বার করে একটা আমড়া গাছের সাথে বাঁধল। তারপর আছোলা বাখারি দিয়ে যে যা পারল বেধড়ক পেটাল! মণিমালা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখল, কিন্তু একটিবারের জন্যেও ওদের সামনে গেল না।
সন্ধ্যাবেলা সবে আখায় আগুন দিয়েছে, এমনসময় মণিমালা শুনতে পেল কে যেন বাঁশি বাজাচ্ছে। অদ্ভুত সেই সুর। পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে উঁকি মারল, কিন্তু না! নদী থেকে এমন স্বর ভেসে আসবার কোনও লক্ষণই দেখল না মণিমালা। থেমে থেমে বাজছে। মণিমালা মনে মনে ভাবে, “যেই বাজাক, বড় মোহিনী জানে সে!”
আজ খইও ভালো ফুটছেনা। বালিতে দিলেই ধোঁয়া হয়ে ছাই কয়লা হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই মন বসছে না মণিমালার। “পরেশকাকাদের কামরা থেকে আসছে না তো?” মণিমালা আন্দাজ করার চেষ্টা করে। উনোনের মুখে পাতা পুরে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল মণিমালা। দেখল, অন্ধকার বারান্দায় বসে একমনে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে রতন। গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মণিমালা। এমন সময় ওর চোখে পড়ল তখনো রতনের চোয়াল বেয়ে ঘন তাজা রক্ত টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে। এবার মণিমালা এগিয়ে এসে রতনের হাত থেকে বাঁশিটা কেড়ে নিয়ে জানতে চাইল, “আরে, আমার সেই আখা ফোঁকানো চোঙাটা না? তাই বলি জিনিসটা গেল কনে!” পরক্ষণেই কিছু একটা চিন্তা করে বাঁশিটা রেখে দিয়ে আঁচল দিয়ে রতনের কপাল থেকে রক্ত মুছতে গেলে রতন বাঘের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠল, “খবরদার! বেশি পীরিত দেখালে ভালো হবে না বলছি! যাও এখান থেকে!”
--“তাহলে যা আন্দাজ করেছিলাম তাই?”
--“হ্যাঁ হ্যাঁ তাই!”
অন্ধকারে খিলখিল করে হেসে উঠল মণিমালা, “বালিতে একমুঠো ধান ফেলে দিলেও তা থেকে সাতমুঠো খই পাওয়া যায়। কিন্তু তোমার ঘটে তাও নেই! এই বিদ্যে নিয়ে তুমি চাকরিবাকরি খুঁজে বেড়াও?”
মণিমালা কী বলতে চাইছে কিছুই বুঝতে পারল না রতন। এবার সে বাঁশিটা রতনের পাশে রেখে বলল, “পোড়া কাঠ দিয়ে দিব্যি কী দারুণ একখান বাঁশি বানালে। অথচ এইটুকু পারো না?” রতন দেখল বাসবের এরেস্ট হওয়ার ঘটনায় মণিমালা মোটেও বিচলিত নয়, বরং ওর চোখেমুখে কেমন যেন এক নিষিদ্ধ ফুলের আভা। যে আভা সদ্য ফোটা আফিম ফুলে থাকে, তেমই এক আলো ওকে মুহূর্তে মুহূর্তে উজ্জ্বল করে তুলছে! মণিমালা চলে যাচ্ছিল। অন্ধকারে ওর পায়ের কাছে ঠং করে কী যেন একটা এসে পড়ল। মণিমালা নিচু হয়ে দেখল সেই চোঙাটা, “কে ছুড়ে মারল? রতন...?” না। দেখল অন্ধকারে খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রতনের পিসি।
--“কী রে মণিমালা, কিছু বুঝলি?”
মণিমালা অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে উঠবার চেষ্টা করে, “সেই তো কথা! যা হবার এদ্দিন আমাদের ওপর দিয়েই তো হচ্ছিল, খামোখা কেন যে...!”
--“আমি ওকথা বলছিনে।”
--“তাহলে...?”
--“এই যে পোড়া কাঠ থেকে সুর বের করতে হলে সন্তানের বাবা-মা হিসেবে বুকের রক্ত কতটা জল করতে হয় জানিস?” মণিমালার গলা শুকিয়ে আসে। জবাব দেওয়া তো দূরের কথা এক্কেবারে নিঃশব্দে ওটাকে কুড়িয়ে নিয়ে ঘরে উঠল মণিমালা।
এখন তিনখুঁটির মাচার ওপরে সারাক্ষণ শুয়ে থাকে রতন। বাসবের জমি গণেশের দখলে। ওর হয়ে কাজ করে রতন। বৃন্দাবনের সাথেও রতনের দারুণ ভাব! দিনে আফিম চারা পরিচর্যা করে, আর রাত হলে বৃন্দাবনের হয়ে বালির গাড়ি গোনে। লোডিং বুঝে কিছু বকশিস পায়। সকাল হতে না হতেই এনামেলের কলসি কাঁখে জল নিতে আসে অপর্ণা, গণেশের জেঠতুতো বোন। অপর্ণা ঘাটে এলেই রতন জলে জাল চুবিয়ে চুপ করে চেয়ে থাকে। ইদানিং অপর্ণার কলসি মাঝে মাঝেই ওর হাত ফসকে ভেসে যায়। অপর্ণা বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কেননা অপর্ণাকে কে যেন বলেছে এই চরে ভয়ঙ্কর সব চোরাবালি। একবার পা পড়লেই...! কলসিটা ভাসতে ভাসতে সেই জালে গিয়ে আটকে যায়। রতন জাল উঁচু করে অপর্ণাকে কলসি ফেরত দেয়। চৈতি ঘূর্ণির মতো শুখা বালির চরে হা-হা করে কেঁদে বেড়ায় রতনের পিসি! দুঃখে হতাশায় কপাল চাপড়ে মণিমালাকে শাপ-শাপান্ত করে। মণিমালা এসব দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না। রতনের চোখে চোখ পড়লে, সেও আজকাল না দেখার ভান করে চলে যায়। যতক্ষণ অপর্ণা চরে থাকে মণিমালা ওদের চোখে চোখে রাখে। রতন বাসবের বাঁধা মাচায় বসে জাল বায়, মণিমালা কিচ্ছুটি বলে না। পাছে সে বৃন্দাবনের রোষে পড়ে, এই ভয়ে সব অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করে মণিমালা।
অপর্ণা চলে গেলে চাটনার ওপর শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল কত কী ভাবে রতন। তারপর একসময় চড়া রোদ্দুর বুকের ওপর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে সেও আজকাল কত রঙবেরঙের ফুল ফোটায়! সে যে শিক্ষিত বেকার, তার যে একটা চাকরির স্বপ্ন ছিল, মণিমালার সাথে দারুণ একটা সহজ সম্পর্ক ছিল, সবকিছু ভুলে যায় রতন! বিকাল হলে রতন লক্ষ করে অপর্ণার বয়সী আরও অনেকগুলো মেয়ে বালির চরে হাওয়া খেতে আসে। সকলের হাতেই কমবেশি সেলফোন। কেউ সেলফি তোলে, কেউবা জলে পা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। দূরে কঞ্চির বেড়া দিয়ে ঘেরা আফিমের গাছগুলো হাওয়ায় দোল খায়। সেদিকে কেউই যায় না। অনেক কষ্টে গাছগুলো আগলে রেখেছে রতন। দুয়েকটা গাছে ফুলও এসেছে। রতন ওইদিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। চোখ দুটো অসম্ভব ফোলাফোলা, কেমন যেন ঘুমঘুম ভাব। অপর্ণার ইশারায় রতন নেমে আসে। এরপর ওরা হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে যায়।
--“ওদের তুমি চেন?”
--“চিনব না মানে? আমার স্কুলের বান্ধবী তো! পড়াশুনা ছেড়েছুড়ে দিয়ে দিব্যি কেমন চরগিরি করে বেড়াচ্ছে!”
--“তুমি কীকরে বুঝলে?”
--“হাতের মোবাইলগুলো দেখেছ? অনেক দামী। কে দিয়েছে আমি কি কিছুই বুঝিনে? মরবে মরবে সব একটা একটা করে মরবে!”
--“ওদের সাথে মিশো না।”
এবার অপর্ণা রতনের কোলের মধ্যে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে বলে, “আগে বলো, মণিমালাকে কি এখনো ভালোবাসো?”
--“তোমার কী মনে হয়?”
--“যে কোনও একটাকে ছাড়তে হবে তোমায়!”
রতন অপর্ণার চুলে বিলি কাটতে কাটতে আহ্লাদে বলে উঠল, “চেষ্টা তো করি পারি কই!”
--“আমি ঘুরিয়ে কথা পছন্দ করিনে। সোজাসুজি বলো।”
--“যদি না ছাড়ি, তাহলে...?”
--“তাহলে আমিও ওদের সাথে কাজে নেমে পড়ব!”
--“কাজে নেমে পড়ব মানে?”
--“চোরাবালির মধ্যে ডুব দিয়ে টিকটক ভিডিও বানাব। সাধু সাধু ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াব। কোনও দিন বা গরু বাছুরের ঘাস কাটার অভিনয় করব। আর...!”
--“থামলে কেন, বলো?”
--“আফিমে কখন ফুল আসে আমিও জানি। ফলে আঠা ঝরতে শুরু করলে পুলিশে খবর দিয়ে মোটা অঙ্কের...!” রতন কথা বলা ভুলে অপর্ণার মুখের দিকে চুপ করে চেয়ে থাকে। সূর্যাস্তের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে ধু-ধু বালির চরে। সহসা সে আভা রতনের চোখেও ভেসে ওঠে।
সেদিন রাতে সবচে বেশি গাড়ি লোডিং ছিল। বখরা বুঝে নিয়ে একটু বিশ্রাম নেবে, এমনসময় নদীর ক্ষীণ কলতানের মতো একটা আর্তনাদ শুনতে পেল রতন। মাচা থেকে ঝপ করে নেমে সোজা চর ধরে দৌড়োতে শুরু করল। একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল রতন। দেখল একটি মেয়ে ডুবে যেতে যেতে হাত দুখানি অস্থির ভাবে ওপরের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে! রতন মেয়েটির চুলের মুঠি ধরে খানিকটা উঁচু করল। তারপর কিছু একটা ভেবে ছেড়ে দিল।
এখন শেষরাত। ঘাটে এসে শান্তভাবে হাত-পা ধুয়ে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল। মাচায় উঠতে যাবে, ঠিক এইসময় মাচার ওপর থেকে রাক্ষুসীর মতো কেউ একজন অট্টহাসি হেসে উঠল। রতন ভয় পেয়ে জলে ঝাঁপ দিল, “কে? কে তুমি?”
এবার টর্চ জ্বালল। আবার সেই হাসি।
রতন দেখল মাচার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে মণিমালা।
--“এ কী তুমি...?”
--“অপর্ণাকে পুঁতে দিয়ে এলে বুঝি? কিন্তু তোমার কাজ বড় কাঁচা! সকাল হতে না হতেই বেচারাকে শেয়াল শকুনে ছিঁড়ে খাবে। পুঁতলেই যখন আরেকটু ভালো করে চাপা দিতে হয় তো!”
--“কী যা তা বকছ! কে বলেছে ওটা অপর্ণা?”
--“আমি কী জানি! সকাল হোক। খেয়ে থুয়ে থাকে যদি মিলিয়ে নিও! যাইহোক এলেই যখন, এইবার একটা কাজ করো তো দেখি!”
--“কী?” পোড়া বাঁশিটি রতনের হাতে দিল মণিমালা।
রতন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, “এখানে কেন?”
--“শোনোনি বাসব আজ ছাড়া পেয়েছে! তাই ভাবলাম...!”
--“কোথায় সে?”
এবার মণিমালা চাটনার ওপরে আঁচল বিছিয়ে দিতে দিতে বলল, “তোমার সাথে দেখা হয়নি বুঝি? তুমি যেপথ দিয়ে এলে, ওই পথেই তো গেল। খেতে নাকি ব্যাপক ফুল ফুটেছে তাই...!”
রতন আর এক মুহূর্তের জন্যেও কালক্ষয় করল না, সড়াৎ করে নেমে গেল।
এখন সে দামোদরের অন্ধকার চর ধরে দৌড়োচ্ছে...
(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)