প্রথম পরিচ্ছেদ— অনিশ্চয়তা ক্ষেত্র
আচ্ছা, আপনি কি ঘুমিয়ে মজা পান? আমি পাই না। এক্কেবারে না। আমি চোখ খুলে থাকি। জেগে বসে থাকি আলোর উল্টোপিঠে। মাঝে মাঝে একনাগাড়ে বই পড়ি আর আপন মনে আবোল-তাবোল বকি। ফরসা রাতে বক্স-খাটটার ভিতরে রাখা হাড়গুলো থেকে খটমট শব্দ হয়। বেশ একটা সোনাটা ফর্ম জন্ম নেয়। ওটা খুব দরদ দিয়ে শোনার চেষ্টা করি আর ভাবি। ধর্ম, জিরাফ, রাজনীতি, গাছ, পেঙ্গুইন, পিঁপড়ে সবরকমই ভাবার চেষ্টা করি। যদিও এখন কদিন ওই ভয় নিয়ে একটু ভাবছি। মানে খুব উঁচুদরের কিছু নয়, সে এলেম আমার নেই। ওই প্রাথমিক ব্যাপারগুলো যেমন ভয় কি, মানুষ কেন ভয় পায় এইসব আর কি। তবে আমার কি মনে হয় জানেন, এই ভয় হল অনিশ্চয়তা ক্ষেত্রের একটা খেলা। যেখানেই নিশ্চয়তা নেই সেখানেই ভয়। আপনি হয়ত বলবেন, “এ আর নতুন কি?”। আমি বলছি না এটা নতুন কিছু। আপনি হামেশাই এর কাছাকাছি আসছেন, ভিড় বাসে গায়ে গা দিয়ে ঢুলছেন, ভিক্টোরিয়ায় গিয়ে আলুকাবলি খাচ্ছেন, আমি সেই অপদার্থ অনিশ্চয়তার কথা বলছি না। আমি বলছি এমন এক অনিশ্চয়তার কথা যেখানে অনিশ্চয়তাও অনিশ্চিত। একটা নামহীন, দেহহীন, সকালহীন ভ্যাবলাটে সত্ত্বা।
একটু সহজ করে বললে “সকাল” এর কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তির কাঠামো নিয়ে আপনার কাছে একটা ব্যাপকতর নিশ্চয়তা ক্ষেত্র তৈরি করছে। আমি, শুনছেন, দেখছেন, ভাবছেন, গাইছেন, “আমার মুক্তি আলোয়, আলোয়…” আর সেই আদিম অনিশ্চয় সত্ত্বাটা আপনার খাটের অন্ধকারতম কোণে নিজেকে কেন্নোর মত গুটিয়ে রেখে অপেক্ষা করছে, হ্যাঁ, ঠিক আমার মত। আপনার শরীরের প্রতিটি অন্ধকারতম শিরা-উপশিরা ওর নখদর্পণে। ওর মিথ্যুক জিভ, চেটেপুটে গিলছে আপনার “কান এঁটো করা, হাসি”র পিছনের লুকানো কান্নাগুলোকে, আপনি টেরও পাচ্ছেন না।
সূর্যের দেহ পুড়ে ছাই হলে, ও এগোবে সুড়সুড় করে। তবুও আপনাকে কাছে পাবার জো নেই ওর। আপনার কৃত্রিম আলোর স্পর্ধা আর দু-পয়সার আনন্দযাপন তখনো নিশ্চয়তাক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছে। তবে ওকেও আপনি নির্বোধ ভাববেন না। ও জাল বুনবে। টোপ ফেলবে। আপনার সাধের হরর জঁরও ততক্ষনে আপনার পিঠ রাঙানোর জন্য ছুরি শানাচ্ছে। তবে এ সবের তোয়াক্কা ও করে না। ও স্বকীয়। ও নোঙর ফেলে সাগরে। আপনার দাবিয়ে রাখা পাপ, ঘৃণা, ইচ্ছে, ভয় প্রত্যেকে চুপি চুপি এসে আপনার কানে কানে বলে যাবে আপনার নিশ্চয়তা ক্ষেত্র কত ঠুনকো, কতো মেকি আর তারপরই ও এসে আপনার চোখে আঙ্গুল দিয়ে আপনাকে আপনার একাকীত্ব, আপনার অনিশ্চয়তা চিনিয়ে খেলা শেষ করবে।
তবে না, এসব সস্তা সেমি-ফ্রয়েডিয়ান তত্ত্ব হাতড়িয়েও আর কোনো লাভ হচ্ছে না। আমি ভয় পাচ্ছি, ভীষণ ভয় পাচ্ছি। চোখ দুটো ভারী হয়ে আসছে। দু-চোখের পাতা এক করলেই অশ্বত্থামার অভিশাপের মতন নেমে আসছে সে। একটা নামহীন, দেহহীন, সকালহীন, ভ্যাবলাটে সত্ত্বা। আমি কিন্তু তাকে মোটেও অপছন্দ করি না। এই যে সে আসে, আমায় জাগিয়ে রাখে, আমার অফিসহীন, কেচ্ছাহীন নিঃসঙ্গ ক্লান্তিকর মুহূর্তগুলোয় উত্তেজনার মলম লাগায়, তাতে আমার বেশ ভালো লাগে। মাথার পিছনে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করি। একটা ভোঁতা আনন্দ হয়। তবে বাড়াবাড়ি রকম মাখামাখি দেখলেই ভয় করে। গাঢ় শ্রেণীহীন ভয়।
ওটা কি মড়ার গাড়ির শব্দ? কটা বাজল কে জানে? হাতঘড়িটাও খুঁজে পাচ্ছি না। চাঁদটাও যেন একটু ঘোলাটে হয়ে আসছে। মনে হয় ওর আসার সময় হয়ে গেছে। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। সবুজ সুরে গান গাইছে কে ও? ওই তো, লাল নিশান দেখতে পাচ্ছি। আমার নিশ্চয়তা ক্ষেত্র ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আর মাত্র কয়েকটা পা, তারপরেই ঝাঁপ দেব অসীম অনিশ্চয়তা ক্ষেত্রে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ—পিঁপড়ে
আচ্ছা, আপনি কি দেশলাই এর আগুনে কখনো পিঁপড়ে পুড়িয়েছেন? আমি পুড়িয়েছি, ঘরের অন্ধকারতম কোণের আলোর টিপ পরা গর্তগুলোয় থাকা সারি সারি পিঁপড়ে। লাল, কালো সব পুড়ে ছাই। তবে ছোটো লাল পিঁপড়ে বা নিরীহ কালো ডেঁয়েপিঁপড়ে পুড়িয়ে ততটা মজা পাই নি, যতটা পেয়েছি কাঠপিঁপড়ে পুড়িয়ে। লাল নৃশংস কাঠপিঁপড়ে। একটু লক্ষ করে শুনবেন বেশ একটা ‘পটপট’ শব্দ হয় ওরা পুড়লে। আমার তো এখনো শিহরন জাগে। ওদের পোড়া গন্ধের আবেশে আমি আর মানুষ থাকি না।
তবে এসব অবশ্য একদিনে হয় নি। ঝুরি ঝুরি মুহূর্ত কাটিয়েছি ওদের অপেক্ষায়। শরীরের প্রতিটি সজীব ধারণাকে জাগিয়ে রেখেছি ক্লান্ত দুপুরগুলোয়। সেইরকমই এক দুপুরে প্রথম দেখেছিলাম ওকে। একটা লম্বা চওড়া লাল কাঠপিঁপড়ে। মায়ের থ্যাঁতলানো দেহটার পাশে হাঁটু ভাঁজ করে বসে ছিল। ঘরটা থই থই করছিল পিঁপড়েতে। কিছু পিঁপড়েকে তো আমি ডিসকভারি চ্যানেলেও দেখিনি তার আগে কোনো দিন।
মা বেঁচে থাকার মতো আরো অনেক বিষয়ই পছন্দ করত বেঁচে থাকার কালে, তবে পিঁপড়েরা সে তালিকায় কোনোকালেই ছিল না। চিলেকোঠার ঘরের জানালার গা বেয়ে আমার গায়ে পিঁপড়ে উঠলে, ঘেন্নার ফোয়ারা ছুটত মায়ের শরীরে। আমাকেও তড়িঘড়ি ছুটতে হত, চান করতে। সেদিনও ছুটেছিলাম রোদ-হাওয়া-জলে মিশে যেতে। তবে তা ভয়ে। জলের তোড়ে ভেসে যাওয়া লাল সৈনিকদের প্রেতমায়ের মায়ের প্রতিটা ঘেন্নার স্তম্ভে কামান দাগায় বুঝতে পারছিলাম সে আসছে।
তবে এসব অনেক আগের কথা। আজ সে সব ভয়ে ধুলো জমে গেছে। মাঝের অনেকটা সময় আর চিলেকোঠার ঘরে যাওয়া হয় নি। ব্যাপারটা কাল হঠাৎ খেয়াল হতেই আজ ভাঙ্গা দুপুরে ওঘরে সেঁধিয়ে যাবার তোড়জোড় শুরু করেছিলাম। দরজাটা সহজে খোলা গেলেও একটা ভ্যাপসা পচা গন্ধ অনেক্ষন বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। জানলাটা খুলতে একটু বেশিই মেহনত করতে হল। দিনের আলো তখনো সবটা শুকিয়ে যায় নি। সেই নুয়ে পড়া আলোয় জানলার এককোণে একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম, মানুষের মত কি যেন একটা পাক খেয়ে পড়ে আছে।
ছোটবেলায় রুনুর জামাকাপড়গুলোও ওমনি করে পাক খেয়ে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম ছোটকার ঘরে। ছোটকা অফিস চলে গেলে রুনু চিলেকোঠার এই ঘরটায় এসে বসে থাকত। মাঝে মাঝে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদত। মা রুনুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিত। আমিও দিতাম। রুনু আমার মাথায় বিলি কেটে দিত। ঘুমে জড়িয়ে আসত দুচোখ। মনে হত বাইরের যা কিছু লজ্জা্র, ভয়ের, নৃশংসতার সব মিথ্যা, সব সাজানো। তবে সেসবই অবশ্য রুনুর সুইসাইড করার আগের কথা।
রুনুটা ছিল একটা চিরকেলে হাঁদা। আমার ছোটোমাসি যখন নিজের মা হবার খবর শুনল, ছোটোমেসো আমাদের বাড়ি এসে নেচে-কুঁদে ফুর্তি করে গেল, কিন্তু রুনু যখন নিজের মা হবার খবর পেল, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল। মনে হয় রুনু-মেসো বলে কোনো ফুর্তি করার লোক ছিল না বলে। আরে, রুনুর তো বিয়েই হয় নি। বোবা মেয়েকে আবার বিয়ে কে করে?
রুনু যে গ্রাম থেকে আমাদের বাড়িতে কাজ করতে এসেছিল, সেখানকার জনাকয়েক মোড়ল গোছের লোক সেদিন আমাদের বাড়ি এসেছিল পুলিশ নিয়ে। ছোটকা তখন মেজোপিসির বাড়িতে ধেড়ে ইঁদুরের মত লুকিয়ে বসে আছে। কিছুদিন পর ছোটকা ফিরে এলে বাবা ছোটকার বাড়িতে থাকা নিয়ে আপত্তি করে। কলেজে পড়া খুকিদি কি জানি কেন ছোটকার জন্য কেঁদে সারা হচ্ছিল, তাই বড়জ্যাঠুও প্রথমে ছোটকাকে বাড়িতে রাখতে রাজি হয় নি কিন্তু পরে ঠাম্মার মুখের দিকে চেয়ে একটু নরম হয়। মেজোজ্যাঠিই প্রথম দেখে সেদিন ছোটকাকে, রক্তে ভেসে যেতে। আবার পুলিশ আসে। তবে এবার ছোটকার ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহটা মর্গে চালান করতে। অসম্ভব ঠেকলেও, প্রাথমিক তদন্তে মনে করা হয় রুনুরই কাছের কোনো লোক কুপিয়ে খুন করেছে ছোটকাকে, কিন্তু… না, সেসব কিন্তুর আর খোঁজ পাওয়া যায় নি তবে থানার বড়বাবুর সাথে বড় পিসেমশায়ের ভাব থাকাটা নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার, তাই না?
আমি যদিও জানি খুনটা কে করেছে। বাবাকে আমার মাঝে মাঝে ভীষণ ভয় করে। খুন হওয়ার পর থেকেই বাবার আচরণ কেমন যেন বদলে যায়। বিশেষ করে আমায় দেখলেই কেমন যেন একটা করত। আসলে বাবা বোধহয় জানত, যেদিন ছোটকা মারা যায়, সেদিন দুপুরে আমি চিলেকোঠার ঘরে, গায়ে লাল লাল ছোপ নিয়ে আকুলিবিকুলি করে কাঁদতে দেখেছিলাম ছোটকাকে। শেষবারের মতো।
একটুও ভুল দেখছি না আমি। সাপের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে যে কৃশকায় কঙ্কালটা আমার সামনে পড়ে আছে এখন, সেটা ছোটকা। হাতে একটা আধপোড়া বিড়িও জ্বলছে। ঝিমোচ্ছে না ঘুমাচ্ছে বুঝতে পারছি না। চোখদুটো ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। বোধহয় বন্ধ করে রেখেছে। খুলবেই বা কি করে? চক্ষু লজ্জা কি আর অত সহজে যায়!
এখন সন্ধে হয়ে গেছে। আমায় ফিরতে হবে। বিড়ির আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওরা আসছে। ওনেক আজেবাজে পিঁপড়ে আর একাটা লাল নৃশংস কাঠপিঁপড়ে। রান্নাঘরে দেশলাই আছে। আজ খাণ্ডবদাহন হবে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – রিয়্যালিটি
আচ্ছা, আপনিও কি রিয়্যালিটির গুলপট্টিতে বিশ্বাস করেন? না মশায়, আমার সে সব বদখেয়াল নেই। আমার ইনটুইশান বলে রিয়্যালিটি হল একটা প্রথম শ্রেণীর ভাঁওতাবাজি। আপনার মনের কারসাজি। একটু ভিতরকার খবর নিলেই বুঝতে পারবেন সবটাই আসলে ফাঁকা। একটা ন্যাকা ন্যাকা গণ মেকিপনা। এটা অনেকটা শহুরে বাড়ি সাজাবার মত ব্যাপার। আপনি সকাল-বিকেল হাফ-হাবলার মত চারদিক থেকে নানান জিনিস এনে দিব্যি এখানে ওখানে জাপানি জুজুৎসুর সাথে চাইনিস চিন্তামনি মিশিয়ে দিচ্ছেন, তারপর এক ময়লা জমা শ্যাওলা রাতে ঝরঝরে ঝাড়বাতির আলোয় বাড়ির দরজা খুলে বোমকে যাচ্ছেন। আপনার অবচেতন মনটিও একই কাজ করছে। আপনার ঝেঁপে নেওয়া নাটুকে তথ্যগুলোকে নিয়ে সে জম্পেশ করে খিচুড়ি রেঁধে আপনাকে খাওয়াচ্ছে। আর আপনি এই খিচুড়ির নাম দিচ্ছেন রিয়্যালিটি।
এ যেন পাগলের অভিনয় করতে করতে ভুলে যাওয়া যে আপনি আদৌ পাগল নন। কিন্তু এতদিন পর আপনি যে পাগল নন, আপনার প্রতিটা নির্লোভ কদর্য কাজ যে সূক্ষ্ম চিন্তার কারসাজি সেটা প্রমাণ করবেন কীভাবে?
সে যেভাবেই করুন না কেন তাতে আমার বেশি সুবিধে হবার নয়। তা, একবারেই যে নয় তাও নয়। আমি আসলে এসব প্যারা-পক্ক দেঁতো আঁতলামি গায়ে মেখে আরেকটু অপেক্ষা করতে চাইছি। ভয়টা যদিও একটু কমই লাগছে আজকাল। সেদিন সেই ঘুমিয়ে পড়ার পরপরই ভয়টা কমতে শুরু করেছে। সেদিন ছেঁদো সেই ঘুমের প্রথমটায় মনে হয়েছিল আমি যেন তলিয়ে যাচ্ছি বৃত্তিহীন অন্ধকারের অতলে। গন্ধহীন, স্বাদহীন একটা ধুলোটে সত্ত্বার আড়ালে কেবল কিছু স্পর্শ অনুভব করতে পারছিলাম। আর কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ, যেন কেউ মুখে রুমাল গুঁজে চিৎকার করছে তারস্বরে। সে শব্দে আমার নাড়িভুঁড়ি পাক দিয়ে উঠছিল। কারা যেন সবুজ সবুজ হাত পা নিয়ে আমাকে বেঁধে ফেলার তোড়জোড় করছিল। একটা লাল টকটকে চিতা জ্বলছিল মাঝখানে। সেই আগুনের চারপাশে আরো কারা সব দুহাত ওপরে তুলে গোল হয়ে বসেছিল, আর কিসব বিড়বিড় করছিল। তাদের মধ্যে একজন, প্রায় বিধ্বস্ত একটা সত্ত্বা গাঁতিয়ে-গুঁতিয়ে এগিয়ে আসছিল আমার দিকে। প্রথম বার, একটা গন্ধ টের পেলাম, ভারী পোড়া একটা গন্ধ। আর একটা অলস নোনতা স্বাদ। আমার যেন দম আটকে আসছিল। বুকটা আঁকুপাঁকু করছিল খুব নরম কিছু একটা জড়িয়ে ধরার জন্য।
হঠাৎ একটা গভীর আলিঙ্গনের হ্যাঁচকা টান অনুভব করলাম। জান্তব কিছু একটার পিছুটান। জেগে উঠতেই দেখলাম, আমার বক্স খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। খাটের ভিতর থেকে হাড়ের একটা মৃদু খটমট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। উঠে বসতে বুঝলাম মাথাটা বেশ ভারী হয়ে গেছে। একটা ঘোরলাগা ভাব নিয়ে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারটা চালিয়ে দিলাম হাল্কা করে। সাবানের ফেনায় চোখ ঢাকা থাকায় আগে দেখিনি কিন্তু বাল্বের লাল আলো সব ধুয়ে দিতে দেখলাম, শাওয়ারের ঠিক পিছন দিকের কান ঘষা ফটোফ্রেমে সে ধরা দিয়েছে। আমার ভয়। অবয়বহীন বাস্তব। কিন্তু আমি জানতাম, ও নিজের আকার খুঁজবে, আমাকে নিংড়ে নিয়ে। ও ভাবছে, এভাবেই সব চলবে তারপর একদিন আমারই কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে আমাকেই ফেলে দেবে খাট থেকে। কিন্তু ও ভুল করবে। আমি জানি ও করবে, ওকে করতেই হবে। আমি অপেক্ষা করব। নিজেকে আবোল-তাবোল বুদ্ধিমত্তার চাদরে মুড়ে, বসে থাকব চুপটি করে। ওর জন্যে। ওর ভুলের জন্যে। আর একবার পা ফসকালেই, ধেড়ে টিকটিকি যেমন আরশোলা গেলে, তেমনি গপাৎ করে গিলে নিয়ে ফেলে দেব অ্যাবসোলুট রিয়্যালিটিতে। একেবারে ফক্কায়।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – গাছ
আচ্ছা, আপনি কি মানুষই হতে চেয়েছিলেন? আমি চেয়েছিলাম। গভীর ভাবে চেয়েছিলাম একটা মানুষ হতে। কিন্তু, আমার মা তা চাননি। উনি চেয়েছিলেন ওনার একটি গাছ হোক। সবুজ নরম একটি গাছ। দুর্ভাগ্যবশত আমি মানুষ হয়ে জন্মাই। অগত্যা, গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করার মত মানুষ বেঁধে গাছ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বৃষ্টি পড়লেই মা আমায় নিয়ে যেত চিলেকোঠার ঘরে। তারপর সমস্ত জামাকাপড় খুলিয়ে বড় জানলার রেলিঙের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখত। হাত টানটান করে ছড়িয়ে রাখতে হত জানলার বাইরে, জিভ বার করতে হত “অ্যা” “অ্যা” করে। এরকম থাকতে হত যতক্ষন না বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা আমার শরীরে মিশে আমাকে একটা পুরুষ্ট গাছে পরিণত করে। গ্রীষ্মকালের দুপুরে অবশ্য মেঝেতে তিন ঘন্টা চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলেই হত। এক বালতি জলও থাকত পাশে। বইতে পড়েননি, “ঠিকমত জল, আলো, হাওায়া পেলে একটি গাছ তরতর করে বেড়ে ওঠে”। কিন্তু, কিছুতেই কিছু হয় নি। এত জল, আলো, হাওয়া পেয়েও তখনও আমি গাছ হয়ে উঠতে পারিনি।
বাবা ব্যাপারটা নিয়ে রীতিমতো বিরক্ত ছিলেন। বাবা মাকে বোঝাবার চেষ্টা করত। এ নিয়ে ওদের মধ্যে ঝগড়াও হয়েছে বহুবার। শেষবার মা যখন বলল “তোমার মত ঘিনঘিনে কীটের সাথে থাকতে আমার ঘেন্না করে”, তারপর বাবা মায়ের সাথে কথা বলা একরকম বন্ধ করে দিল। সবকিছুই চলতে থাকল আগের মতন, চ্যাটচ্যাটে স্বাভাবিক ছন্দে। তবে ভিতর ভিতর সকলেরই গাঢ় ফোঁসফোঁসানি টের পাচ্ছিলাম। সেইরকমই এক ফ্যাঁসফ্যাঁসে দুপুরে ঘ্যাঁষঘ্যাঁষে আলোর বিনুনি পরা ষণ্ডামার্কা কারা যেন মাকে চিলেকোঠার ঘর থেকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। মাও ভোঁতা গোঙানির মত শব্দ করে হাত পা ছুড়ছিল। বাবা তখন অফিসে, ঠাকুমা বড় পিসির বাড়ি গেছে, জ্যাঠুরাও ওদের নতুন বাড়িতে থাকতে শুরু করেছে। একা আমি সেদিন বীরপুরুষের মতন ছুটে গেছিলাম মাকে বাঁচাতে। তখনো ওরা অন্ধ গলিটা পেরোয় নি। ওদেরই এক অপগণ্ড সঙ্গীর লিকলিকে লাল হাতে দৌড়ে গিয়ে মেরেছিলাম এক কামড়। কাজটা খুব একটা ভাল করিনি। আমার জিভটা জ্বলে যাচ্ছিল। পরে বুঝেছিলাম ওরা কেউই মানুষ ছিল না।
বেশ কয়েকদিন পর মা যখন ফিরে এল, আমি প্রথম দেখায় চিনতে পারিনি। মা অনেক রোগা হয়ে গেছিল। গাল ভেঙে গেছিল, চোখের তলায় কালি, আর শরীরে এক হালকা বাদামি আভা। এক ঝটকায় যেন অনেকটা বয়স বেড়ে গেছিল। মা কারুর সাথেই কোনোদিনই বিশেষ কথা বলত না, এর পর সেটা আরো কমে যায়। কিছুদিন আমাকেও আর গাছ হবার জন্য জোরাজুরি করেনি। কিন্তু, এটাও বেশিদিন স্থায়ী হোল না। ঘুম থেকে উঠে দেখতাম মায়ের সতেজ অংশ গুলো থেকে সবুজ রস গড়িয়ে পড়ছে। আমার জামা ভিজে যেত রসে। বাবা আড়াল থেকে কাঁদত।
মা মারা যাবার বেশ কিছুদিন আগেই ঠাকুমা মারা যায়। বাবা যে কখন বাড়ি ফিরত আর কখন বেরিয়ে যেত টেরই পেতাম না। মা চিলেকোঠার ঘরেই থাকতো বেশিরভাগ সময়। নিচে আসত খুব কম। মাঝে মাঝে রান্না করতেও নামত না। আমরা না খেয়ে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতাম বাইরের গাছগুলোর দিকে। একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করতাম। কি শান্ত অথচ দৃঢ় একটা সত্ত্বা। জানলার টবে রাখা জুঁইটাকে জুড়ে একটা মিষ্টি ভালোভাসার স্বপ্ন বুনতে শুরু করে ছিলাম। মায়ের তাতে মৃদু প্রশ্রয়ও ছিল। কিন্তু সব কিছুই ভেস্তে গেল। সেটাও একটা সকাল ছিল। অনেকদিনের চেনা, আলগা, মিষ্টি একটা সকাল। নরম আলো চোখের ওপর আলতো করে টোকা মারছিল। হয়ত আরেকটু ঘুমাতাম যদি না একটা ভেজা ভেজা অনুভূতি হুলহীন মৌমাছির মত বোঁ বোঁ করে কানের কাছে ঘুরত।
জেগে উঠতেই দেখলাম মায়ের থ্যাঁতলানো দেহটা পড়ে আছে জানলার সামনে। টবের জুঁইটা দুমড়ে মুচড়ে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পিঁপড়ের সামনে মাথা নত করে। আমার জামাকাপড় ভিজে গেছিল সবুজ রসে। যে সিড়িঙ্গে শুঁড়ওয়ালা পতঙ্গগুলো জানলার পিছনে জটলা পাকিয়েছিল, আমাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিল। আশাহতের ভঙ্গিতে একটা বটের ঝুরি আমায় পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিল। মায়ের মুখটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না কোথাও। সবুজ রস বিন্দু বিন্দু চাটছিল যে লাল কাঠপিঁপড়েটা, তার তখন আমাকে আর মনে নেই। সবুজ রস আমার গায়েও লেগেছিল। লেগেছিল আমার প্রতিটা জাগ্রত সত্ত্বাবিন্দুতে। চিনি, এদের সবাইকে আমি চিনি। ওই যে লাল নৃশংস কাঠপিঁপড়েটা, এখন আমার দিকে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে আছে আর আপন মনে বিড়বিড় করছে তাকেও চিনি। এখন যেমন এই চাপা অন্ধকারটা ভেংচি কাটছে আমার হাতের দেশলাইটাকে সেদিনও তেমনি আগন্তক কিছু আলোর ঢেউ, আমার এই বাইরের ভাঁড়ামোটাকে দুয়ো দিতে দিতে বলছিল, “তুমি একটি গাছ, সবুজ নরম একটি গাছ।”
আর কথা নয়। সে এগোচ্ছে শান্ত অথচ ধীর পায়ে। ভুঁইফোঁড় হাহাকারেরা উল্লাস করছে সময়ের বাজি ধরে। সময় ফুরিয়ে আসছে, এবার মুখোমুখি দাঁড়াবার পালা।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – কিমেরা
আচ্ছা, আপনি কি কখনো কারোর মুখ মেরে বিলা করে দিয়েছেন? আমি দিয়েছি, পুরো ছাতু করে দিয়েছি। তবে বেশ ঘাম ঝরাতে হয়েছিল, বিলা করতে নয়, ছাতু করতে। একটা শরীরের প্রত্যেকটা সবুজ আলোড়নকে থেঁতলে ছাতু করা তো আর ধাপার মাঠে ঢ্যাঁড়শ ফলানো নয়। ওতে পরিশ্রম লাগে। আর তার থেকেও বেশি পরিশ্রম লাগে নোনতা, আশঁটে, তেলতেল সবুজ রস পরিষ্কার করতে। বিশেষ করে সে যদি কাছের কেউ হয়। খুব কাছের কেউ। বাকিরা প্রায়শই এসব ক্ষেত্রে ভ্যাবলা মিত্তির হয়ে গিয়ে উলটোপালটা কাজ করে বসে। কেউ নদীর জলে বস্তা ভাসিয়ে কুমিরডাঙ্গা খেলে, তো কেউ হাড়কাটা গলিতে হাড়কেটে ফেলে রাখে মৃতজীবীদের সাথে কানামাছি ‘ভোঁ’,’ভোঁ’-এর অপেক্ষায়। তবে আমি এসব পাংশুটে ছ্যাবলামোর ধার ধারি না। আমি ভাবি। জিভের ডগায় নোনতা স্বাদ নিয়ে, আমার বক্স-খাটের উপর হাত-পা গুলো তুলে দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবি, এই ঠিক এখন যেমন ভাবছি।
না, কুকুর-টুকুর আমি মোটেও পছন্দ করি না। বাড়িতে আগে ছিল একটা, ঘিয়েভাজা যমদূত। সেদিন ওটার জন্যই আরেকটু হলে আমার সব পরিশ্রম মাটি হয়ে যেত। কিন্তু মাটি যে হয় নি তা তো বুঝতেই পারছেন। কুকুরের রক্ত গরম হয় বইয়ে পড়েছিলাম, কোনোদিন হাতেকলমে দেখা হয় নি অগত্যা সে সাধটাও সেদিন পূরণ করতে হল। তবে এতক্ষন যে চাপা জান্তব ঘরঘর শব্দটা শুনছিলেন সেটা সেই যুধিষ্ঠিরের ন্যাওটাটির নয়। সে মোটেও ফিরে আসেনি আমায় পুড়িয়ে মারবে বলে। এটা খোদ ইলিয়াডের গর্জন। A thing of immortal make, not human, lion-fronted and snake behind, a goat in the middle. আমার ব্রোঞ্জের কিমেরাটার ছায়াময় অনুলিখন। এই শব্দটা ওর সম্ভাষণ তাকে, যে আসছে আজ।
আজ বিকেলে আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বউটার কথা মনে পড়ে গেল। মোটামুটি বেশ খারাপই ছিল বলতে গেলে। কারুর সাথে মিশত না, কথা বলত না, খালি চিলেকোঠার ঘরে, দরজায় খিল এঁটে বসে থাকত আর সারাদিন গাছ গাছ করত। প্রথম প্রথম ভাবতাম শহুরে জঞ্জালে থাকতে থাকতে মাথায় বুঝি শক্তি চাটুজ্যের ভূত ভর করেছে, কিন্তু এখন বুঝি ওখানেই একটা বেখাপ্পা ভুল হয়ে গেছিল। আসলে বিয়ে করার সময় আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল। হামেশাই যার কাছাকাছি আসছি, ভিড় বাসে যার গায়ে গা দিয়ে ঢুলছি, যার সাথে ভিক্টোরিয়ায় গিয়ে আলুকাবলি খাচ্ছি তার যে এমন মাথার ব্যামো তা ফুকো ফুঁকেও ঠাওর করতে পারিনি। তবে এসব নেহাতই ঠুনকো কারণ। এর জন্য কাউকে থেঁতো করা একটা নারকীয় বর্বরতা। কিন্তু ছেলেটাকে আদর্শ গাছ হবার কোচিং দেওায়াটা বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছিল। উফফ! ছেলেটাও ছিল বটে একখান। ভাবতে পারেন একটা দশ-এগারো বছরের ছেলে নিজের ছোটকাকে খুন করছে। তাও আবার যেমন তেমন নয়, কুপিয়ে কুপিয়ে খুন। আমি সেদিন ছাদে সিগারেট খেতে গেছিলাম। জানালা দিয়ে দেখি লাল অ্যাক্রিলিক রঙের একটা ভাঙ্গাচোরা ডেভিড মাটিতে পড়ে আছে আর আমার ছেলে একটু একটু করে তার পাপধরা মার্বেল খুবলে নিচ্ছে। আমার কিন্তু খারাপ লাগেনি। একটুও না। আমার খালি ভয় করত। হাল্কা ম্যাড়ম্যাড়ে একটা ভয়। ওর চোখে চোখ রেখে তাকাতে একটু অস্বস্তি হত। কেমন বুনো মানুষ-মানুষ চোখ। সে সব বাদ দিলে, ছেলেটার মধ্যে কিন্তু এক আদর্শ ‘আমি’ হবার সমস্ত পোটেনশিয়াল ছিল। কিন্তু একটা মাথামোটা বাদামি শুকনো অস্তিত্বের জন্য সবকিছু ধেড়িয়ে যাচ্ছিল, অগত্যা। বিশ্বাস করুন আমার আর কিছুই করার ছিল না। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি, আদর করে বুঝিয়েছি, লোক লাগিয়ে ধরে নিয়ে গেছি, বাটালি-ছেনি দিয়ে দম্ভের প্রতিটা দাঁত ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে … কিন্তু … সত্যি! আমার আর কিচ্ছু করার ছিল না।
ছেলেটাকে তিলে তিলে একটা গাছ হতে দেখছিলাম। সবুজ, নরম একটা গাছ। আমার ভিতরকার ঘুমন্ত নৃশংসতাও একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল। যত্ন করে জমিয়ে রাখছিলাম চুঁইয়ে পড়া বিষ। বিষিয়ে যাওয়া হাড়গুলোও জমিয়ে রাখছিলাম বক্স-খাটটার ভিতরে। রাতে ঘুম না এলে বা ভয় করলে ওদের খটমট শব্দ শুনি আর ভাবি। ধর্ম, জিরাফ, রাজনীতি, গাছ, পেঙ্গুইন, পিঁপড়ে সবরকমই।
কিমেরাটা গর্জন থামিয়ে দিয়েছে। ওর আর কাউকে ডাকার দরকার নেই। ঘেন্না, পাপ, আঁতলামো, বেঁচে থাকা ছাইপাঁশ, সব শেষ। শেষ বারের মত রিভিশন দেবার সময়টুকুও শেষ। পরীক্ষার ঘন্টা বেজে গেছে। সে চলে এসেছে। আমার ভয়। ওর গা থেকে কেমন যেন একটা বোটকা-বোটকা গন্ধ আসছে। অনেকটা আদর্শ-মানুষের মতন। ওর হাতের দেশলাইটা জ্বলছে বিষাক্ত সূর্যের গম্ভীর আত্মপ্রত্যয়ে। ও পা টিপে টিপে এগোচ্ছে। ভেবেছে আমাকে পুড়িয়ে মারবে, মাতাল হয়ে যাবে পোড়া গন্ধে, কান পেতে শুনবে ‘পটপট’ পুড়ে যাবার শব্দ। কিন্তু আমি তা হতে দেব না। জ্বলুক। যতক্ষন ইচ্ছে জ্বলুক। তবে এ খেলা বেশিক্ষনের নয়। সব পুড়ে ছাই হবে, শেষ হবে। কিমেরাটা আমার পিছনে কোথাও একটা দাঁড়িয়ে আছে। ওর হিংস্র অন্ধকার ছায়াটা আজ আরো হিংস্র দেখাচ্ছে, যেন রেসের ময়দানে নেমেছে, নিভিয়ে ফেলার রেসে। আলোর বটুয়াটা এখন খাটের তলায় সেঁধিয়েছে। বিষ খুঁজছে ও। বিষ। ও জানে না আমিও খুঁজে পেয়েছি। অমৃত। বিষের আঁতুড় থেকে জন্মাবে সে। আমার ছেলে। তবে এবার আর গাছ হয়ে নয়, পিঁপড়ে হয়ে। আমার মত লাল টকটকে একটা কাঠপিঁপড়ে।
(পরবাস-৮১, ১২ জানুয়ারি, ২০২১)