স্বীকারোক্তি
সে বলল ‘কথা বলো, মুখ বুজে থাকা তো যাবে না—
‘মনে পড়ে, কী কী কথা ভেসে গেছে উজিয়ে সময়?
‘রুগ্নবীজ পাখির ছানার মতো নষ্টনীড় থেকে
‘ডানাভাঙা প্রতিশ্রুতি পড়ে গেছে প্রদোষ আঁধারে।
‘এখন নেশার ঝোঁকে বারোটায় মুহূর্ত দাঁড়িয়ে
‘স্থির। স্বীকারোক্তির বিশ্বস্ত সময় হল এই।’
‘স্বীকারোক্তি বলো যদি,’ আমি বলি, ‘সে কখনো এই
‘নিঃস্ব অবলম্বহীন তেপান্তরে শোনানো যাবে না।
‘এখানে পায়ের নীচে স্পর্শ নেই। কোথায় দাঁড়িয়ে
‘উচ্চারণ করি? বর্ণ, গন্ধ নেই, সিরক্কো সময়
‘বুকের অন্দর থেকে বাষ্প শোষে তৃষার্ত আঁধারে
‘নষ্টনীড়ে শকুনের ছানাগুলো ডাকে থেকে থেকে।’
‘দেখা কি শোনার বাইরে গিয়ে বসি চলো তার থেকে
‘মনে মনে।’ সে বলল: ‘ভুলে যাও। আমিও তো এই
‘ছায়াতে থাকি না; দেখি— মৃত আলো, বিলুপ্ত আঁধারে
‘কী পড়ে রয়েছে। তবে, সে-সমস্ত ফেরানো যাবে না
‘জানো তো নিশ্চয়।’ ‘আমি জানি, কিন্তু নিভন্ত সময়
‘প্রায় ভস্ম হয়; আর কাজ নেই এখানে দাঁড়িয়ে।’
সে বলল: ‘না, তোমায় বলতে হবে এখানে দাঁড়িয়ে,
‘ছায়াময় মগ্নতায়। আলোছায়া পরিচয় থেকে
‘সরলেও তোমার তো এই স্থাণু অন্ধ অসময়
‘সঙ্গ ছাড়বে না। আর তাই যদি হয়, তবে এই
‘স্মরণের পর্দা ঠেলে অন্য পারে যাওয়াও যাবে না।
‘স্বীকারোক্তি করো এই হন্যমান সুতীক্ষ্ণ আঁধারে।’
আমি বলি অস্ফুট মর্মরে সেই মির্মির আঁধারে:
‘স্বীকারোক্তি করি আমি অস্তিত্বের প্রত্যন্তে দাঁড়িয়ে:
‘অভিযোক্তা জানা নেই, অপরাধ বোঝানো যাবে না—
‘দোষী আমি জন্মসূত্রে। শাস্তি বহে কারাগার থেকে
‘মুক্তি পেলে লুপ্ত হবো। যাবজ্জীবন আমি এই
‘কৃপাণের প্রত্যাশায় আছি— এই এলো সে-সময়?’
সে বলল: ‘এখনও হয়নি শুরু সেই সুসময়,
‘কৃপাণপ্রত্যাশী, আগে জীর্ণ হও দুর্বহ আঁধারে,
‘তার পরে দেহগন্ধস্পর্শহীন অর্থহীন এই
‘অনুভূতিবিহীন কালেতে এসে বিবিক্ত দাঁড়িয়ে
‘প্রশ্ন কোরো কেন শাস্তি, আসে কোথা থেকে—
‘জানো তো, উত্তর তার জীবিতকে জানানো যাবে না।’
শূন্যতানিবাসী সেও হন্যমান কালের আঁধারে;
কেন সে এখানে তাও কথা বলে জানানো যাবে না
জন্মসূত্রে অর্থহীন এ-সময় জীর্ণ বিষময়।
(পরবাস-৮১, ১২ জানুয়ারি, ২০২১)