Subscribe to Magazines



পরবাসে দেবাশিস গোস্বামীর
লেখা



ISSN 1563-8685




গুচ্ছ কবিতা

বৃষ্টি

বৃষ্টিরা সব জানে। কেমন করে ঝড়ের রাতে
প্রথম দুয়ার খুলেছিলো,    বাদল দিনের
অযাচিত প্রথম কদম হস্টেলের ছাদে
তোমার গলায় "কোথায় যে উধাও হলো"

তারপর, গনগনে কঠোর রোদের বেলা
স্মৃতিকণা বাষ্প হয়ে মিশে ছিল মেঘে
ঝরেছিল অন্য তীরে, হয়তো বা ছিল জেগে
স্বপ্নের শিয়র ঘিরে, সুপ্তির গভীরে

....    ....    ....

আর এক বাদল রাতে, প্রবাসী আকাশে
শ্রাবণের ধারাপাত যেখানে অচেনা
এসেছিলো মেঘে মেঘে সঘন গহন
বৃষ্টির মতো তোর গলা দূরভাষে

বেজেছিল, "এখানেও নেমেছে বরষা"
সাগর পেরিয়ে আসা সেই ঝড়জল
জেনেছিলো আমাদের মনের অতল
সেঁচা, তখনো আফোটা-কুঁড়ি ভালোবাসা।

....    ....    ....

বহুদিন পার হয়ে, জানালায় আবার
ঝড় দেখা সদ্য-কিশোরী চোখ আত্মজার
ঈষৎ পাল্লা খোলে, অমনি বৃষ্টিরা
চোখে চুলে মাখামাখি, মেঘের ইশারা

জাগায় বিদ্যুৎ, "বাবা, আমি বুঝে গেছি
ঝড়কে করবো মিতা এ গানের মানে!"
বাইরে দামাল হাওয়া, আমাকেও গানে
পায়, "চিত্ত আমার হারালো", মনে আছে?

তোমাকে প্রথম শোনা আমার এ গানে?
বৃষ্টিরা মৃদু হাসে। ওরা সব জানে।


সেতু

এমন হয়েছে এই মোবাইল ডেটা, এই আছে এই নেই
কথা বলা মানে যেন সুতোর সেতু পারাপার

     শব্দ খসে পড়ে, টুপ টাপ
উদ্বায়ী শিশিরের মতো

কথা না এলেও মেঘ আসে
     দম-চাপা অন্ধকার
তারাময়ী অপার রাত্রির নয়,
দৃষ্টিহীন কোটরের অনঙ্গ শূন্যতা
     হাঁ করে গিলতে আসে

কথা না গেলেও, মেঘ যায়
আকুল আঙুলের ছোঁয়া
     মৃদু ঢেউ তোলে দেশকাল স্তরে
চেনা কম্পাঙ্কে দোলে মেঘের অখণ্ড সেতু


কুড়ি বছরের পর

তারপর ....

দুপুরের আকাশ জুড়ে নেমে এলো রূপকথা
আশ্চর্য ইন্দ্রজালে থামলো ঘড়ির কাঁটা
ইঁট কাঠ ইস্পাতে মোড়া বিমানবন্দর
অলৌকিক কুয়াশায় ঝাপসা হতে হতে
মুছে গেলো আর অপূর্ব আলো ফুটে
উঠলো স্মৃতির গহন থেকে

এক জাদুবাস্তব তলে আমরা মুখোমুখি
মনে হলো কেউ কোথাও যায় নি চলে
কোনো দিন, দেশকালের গোপন খাঁজে
স্থির হয়ে জেগে ছিল
নিশ্চিত অপেক্ষার এই মুহূর্ত
জলজ শৈবালে ঘেরা প্রবালের নীড়ে
ইন্দ্রিয়ের অগম পাতাল-ফল্গুর তীরে

সময়ের মুঠি থেকে অনন্ত মসলিনের
মতো পরতে পরতে খুলে যায় স্তর
গাঢ় থেকে উজ্জল বেগুনি কমলা হলুদ সাদা
পেখম মেলে ধরে আমাদের ঘিরে
ঘটমান অস্তিত্বের কল্লোল মুছে গিয়ে
শুধু থাকে মুখোমুখি দাঁড়াবার
চোখে চোখে তাকাবার
স্তব্ধবাক অসীম অবকাশ
আমার আঙ্গুল থেকে তোমার আঙুলে
তোমার আঙ্গুল থেকে আমার আঙুলে
হয়ে ওঠা এবং না হওয়া মুহূর্তরা
বয়ে চলে অবিরল


দুই জীবন

এক টুকরো অতীত এসে
জুড়ে বসেছে ঘটমান বর্তমানে
কি আশ্চর্য, মিলেও গেছে খাপে খাপে
এভাবেই তবে থেমে ছিল জীবন, এখানে?
সমান্তর ভুবনে, অন্য কোনো দেশ কালে
পাশাপাশি হেঁটেছি আমরা সবাই
এই হাসি গান, চানঘরে জলের আওয়াজ
খাবার টেবিলে অনাবিল অকুন্ঠ
সময়, চায়ের ধোঁয়ায় মাখামাখি সকাল

যেন এক স্ফটিক অবয়বে
পরস্পরের অস্তিত্বের ভেতর দিয়ে
যাতায়াত করেছি অনন্তকাল
জিলা কফিতে আলী আকবর যেমন
হঠাৎ মিশিয়ে দিতেন এক পশলা কান্না
মনে হতো, না হওয়া জীবনেরা যেন
দাঁড়িয়েছে আকাশের প্রান্তে এসে
প্রাত্যহিক যাপনের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে
আরেক জীবন তার অদৃশ্য শরীর
বুনে দিচ্ছিলো, স্মৃতি বলে যাকে
ভ্রম হতো, আসলে সচল বাস্তবের
স্থান-কাল-বেড়া ডিঙোনো
মৃদু পায়ের দাগ
সময় সৈকতে অদৃশ্য প্রতীক্ষার মতো
জল থেমে ছিল, মালকোষ-পূর্ণিমায়
নিমেষে ভরে উঠেছে দিগন্ত ছাপিয়ে
যেন চিরদিন জেগে ছিল, বহেছিল
অবিরল আনন্দধারায়


কোয়ারেন্টাইন

স্পর্শের সীমার বাইরে এলে এসব জানা হয়।
     এমনি সময়ে
অঙ্গে অঙ্গে ছুঁলেই বিদ্যুৎ
চেনা স্নায়ুপথে নিমেষে মিশে যায়
এত দ্রুত বোঝা যায় না
     আকুল তীব্রতা,
এখন স্বেচ্ছাবৃত পর্দার আড়ালে
ধ্বনি আর দৃশ্যের আভাস
দরজা পেরিয়ে একফালি জ্যোৎস্নার মতো
     বিছানার ঠিক আগে থমকে দাঁড়ায়
ছুঁলেই মিলিয়ে যাবে

আকাশ আর জলের বিভাজিকায়
দুই উজ্জ্বল সুরের ফাঁকে মগ্ন বিরতি

হাত বাড়িয়েও যেটুকু শূন্যতা
     অধরা, সেখানে
স্থির তড়িতের মতো
         প্রেম জেগে থাকে।


অতিমারীর দিনলিপি

কবে সুড়ঙ্গে নেমেছিলাম মনে নেই। অন্ধকার ক্রমে গাঢ় থেকে গাঢ়তর। অনেকে বলেছিলো চোখ বুজে
থাকা যাক। পেছনের লোকের ঠেলায় পেরিয়ে যাবো ঠিক। চোখ খুলেই দেখবো পরিচিত আলোর জগৎ।
কিন্তু কোথাও কোনো আলোর ইশারা ছিল না। পথ এঁকেবেঁকে, শিরা উপশিরার মতো বিভক্ত হতে হতে
ছড়িয়ে পড়ছিলো। কোনো কোনো বাঁকে কানাগলি। পাথুরে দেয়ালে মাথা-কোটা আর্তনাদ। অন্যান্য পথ
পরস্পর থেকে দূরে সরে যেতে যেতে কখনো এক মানুষের গলে যাওয়ার মতো সংকীর্ণ। কোথাও বা প্রশস্ত।
কিন্তু কোথাও কোনো আলো ছিল না। কেউ কেউ চোখ খোলার ভরসা না পেয়ে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে গিয়ে হুমড়ি
খেয়ে পড়েছিল। আর ওঠে নি। তাদের ভারী শ্বাসের প্রাচীর ঠেলে অন্যদের এগুতে হচ্ছিলো।

শেষে আমরা সবাই একে একে চোখ খুললাম। আলোর কোনো ইঙ্গিত ছিল না। আমরা যে কজন কাছাকাছি ছিলাম হাতে হাতে
জড়িয়ে নিলাম। আগে পিছে হাতের সেতু। হাতড়ে হাতড়ে দেয়ালের খাঁজ আর বাঁক বুঝতে হচ্ছিলো। হাত আর পায়ের ত্বক
ব্যাঙের মতো খসখসে। স্নায়ু গোড়ায় অবশ হয়ে এলেও এখন তীক্ষ্ণ অচেনা বেদনা। ক্রমে চোখ সয়ে এলে বোঝা যায়, অন্ধকারের
নিজস্ব দীপ্তিময় ভাষা। আলোর থেকে তার ভিন্ন ব্যাকরণ। বস্তু যে আলোটুকু ফিরিয়ে দেয় শুধু তাই চোখে আসে। যে আলো তার
গভীরে সে তো অরূপ অন্ধকার। চোখ তাকে ছুঁতে পারে না। সর্বাঙ্গীণ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। হৃদয় আর মস্তিষ্ক দিয়ে।

মাথার ভেতর একটা একটা করে দরজা খুলে যায় এসময়। সমস্ত শরীর দিয়ে অন্ধকারকে স্পর্শ করতে পারি। চিনতে পারি কোন
আঙুলে আপনজনের নিবিড় টান আর কোথায় অবিশ্বাস বা বিদ্বেষ। আলোর বিভ্রম নেই বলে এ সবই স্বতঃসিদ্ধের মতো স্পষ্ট আর
নিখাদ। সম্পর্কের শরীর ছোঁয়া যায় এখন। বেআব্রু, নিঃসংকোচ, ঋজু অথচ সহজ। যা থাকার নয় খসে পড়ছে শিথিল পোশাক বা
ঝরা পাতার মতো। ভালোবাসা ছাড়া অবশিষ্ট নেই কোনো বন্ধন। নেই আর কোনো হিসেবে, বিবেচনা কিংবা সাংসারিক ট্রাপিজের
খেলা। শুধু ভালোবাসার আদিম টান অন্ধকারের বুক থেকে সঞ্চিত শক্তি শুষে নেয় আর তৈরি করে ভরসা আর বিশ্বাসের বলয়।
পুকুরের জলে প্রথম বৃষ্টির মতো ছোট ছোট বৃত্ত।

কেউ জানে না আদৌ কেউ কিছু শুনেছিলো কিনা। শ্বাসের শব্দ ছাড়া অন্য কোনো আওয়াজ সম্ভবত ছিল না।
তবু কিভাবে যেন সবাই জেনে যায়, পথের শেষ বলে কিছু নেই। অন্ধকারের গর্ভেই যাবতীয় আলোর দিশা।
যে যার বলয়ের নিবিড় আর্তি দিয়ে খুঁজে নেবে নিজের মতো করে। তৈরি করে নেবে নিজস্ব আলোর বাস্তব।

এখন থেকে পথগুলো আলাদা হয়ে যাবে। মাঝের দেয়ালে আর পরস্পর ছোঁয়া বা শোনার স্বচ্ছতা নেই।
কোনো কোনো পথ অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। কেউ কেউ ক্রমাগত ব্যর্থ চেষ্টা করে যাবে সুড়ঙ্গের দেয়াল
ভাঙার। তবে কেউ কেউ নিশ্চয় খুঁজে পাবে চকমকি পাথর। নতুন, অকৃত্রিম আগুন। অন্ধকারের
গভীর স্তর খুঁড়ে বিশুদ্ধ স্নিদ্ধতার ধারা। সুড়ঙ্গের ছাদ ব্যাপ্ত হয়ে স্বপ্রভ আকাশ হবে।

আসলে সুড়ঙ্গের শেষ নেই, শুরুও ছিল না কখনো। ভালোবাসার উজ্জ্বল দীপ্তি দিয়ে এখানেই বপন
করা যায় আদিগন্ত জীবন। অন্ধকার তার ধাত্রী। অপেক্ষা করে থাকে যুগান্ত ধরে। যারা তাকে চিনতে পারে
তারা আলো হয়ে নক্ষত্র হয়ে নদী হয়ে ছড়িয়ে যাবে সাত সুরের তরঙ্গে ....



(পরবাস-৮১, ১২ জানুয়ারি, ২০২১)