অবিনাশবাবু ভিজিটিং কার্ডটা মন দিয়ে দেখছিলেন। নাম: বিরাজ বসু। অবিনাশ পাত্র, রায়মঙ্গল বিদ্যাবীথির হেডমাস্টার।
আগন্তুক প্রাক্তন ছাত্রটিকে আরেকবার দেখলেন। ভদ্রলোক এতক্ষণ অনেক কথা বললেন। সবটুকু মন দিয়ে শুনেছেন। সব শুনে অবিনাশবাবু নিশ্চিত। প্রাক্তন ছাত্রটি মিথ্যে বলছেন না। স্কুল সম্পর্কে এত তথ্য!বিশেষ পরিচয় না থাকলে জানা যায় না।
ইতস্তত করছেন। তবুও না বলে পারলেন না।
'বিরাজবাবু,আপনার কথায় আমি আশ্চর্য না হয়ে পারছি না। যা শোনালেন এসব সত্যি!'
'মিথ্যে বলে কি লাভ স্যার?'
'আসলে ঘটনাটায় আমি স্তম্ভিত। তাই জিজ্ঞেস না করে পারলাম না। কিছু মনে করবেন না।'
'না না স্যার। মনে করার কিছুই নেই। মনে তো সেদিন হয়েছিল। আজ এসব দিকে মন দেবার এক মুহূর্তও সময় নেই। আমি তো কিছু চাই না। শুধু ঐ অনুরোধটুকু…'
কথাটা খাঁটি। ছাত্রটি কিছুই চায়নি। কিছু চাইবারও নেই। ভিজিটিং কার্ডই তার প্রমাণ।
'শুধু আজ যদি উপস্থিত পারমিশন দেন।'
'এছাড়া আমার আজ চাইবার কিছু নেই স্যার। শুধু আর্জিটা যদি মঞ্জুর করেন...আমাকে একটু সুযোগ করে দেন…'
'আজ?'
'হ্যাঁ স্যার। আজ। ওনার চাকরি-জীবন শেষ হবার আগেই। এই পরিবেশে তো আর ওনাকে পাব না স্যার। তাই আজ।'
অবিনাশ পাত্র সব শুনেছেন। তবুও কোন উত্তর খুঁজে পেলেন না। বড় টেবিলের ওদিকে ছাত্রটিকে দেখছেন।
কলার দেওয়া পাঞ্জাবি। ঘন নীল। সাদা পাজামা। কাঁধে ঝোলা। হাফ রিম চশমা। মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। পোশাকআশাক ওনার কথা মত আজও ফিটফাট। তবে দৃষ্টি অন্যমনস্ক।
অবিনাশবাবু বিচলিত। প্রাক্তন ছাত্রের কাজটা কঠিন। বিশেষত আজ। ভাবছেন,এত সফল... এত প্রতিষ্ঠিত… মানুষটার ভিত্তিস্তম্ভের নিচে এত বেদনা!... লুকিয়ে আছে?
আজ মনীশবাবুর রিটায়ারমেন্ট। মনীশ বর্ধন, বায়োলজির টিচার। শিক্ষকতা করলেন একত্রিশ বছর। হল ঘরে ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান। গোজগাছ চলছে।
অবিনাশবাবু বললেন,'একটা সত্যি কথা বলি আপনাকে। একটু ভয়ই লাগছে।'
'হ্যাঁ স্যার। আপনার জায়গায় আমি থাকলে হয়ত এই কথাই বলতাম। তবে কি জানেন। জোর করার কোন অধিকার নেই। আপনি পারমিশন দিলে একটা সুযোগ পাব। এমন অসংখ্য ঘটনা। কত মানুষের স্মৃতিতে লুকিয়ে থাকে। কষ্টটা বুকে টনটন করে। শেষে ব্যথাটাই হারিয়ে যায়। হয়ত কখনও হঠাৎ হঠাৎ হাজির হয়। আচমকা। তার না আছে কোন উদ্দেশ্য না প্রতিকার। শুধু পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হওয়া। অবিরত রক্ত ক্ষরণ। আজও তেমনই। আপনি অনুমতি না দিলে কষ্ট পাব। আবার আপনা থেকেই ঠিক হয়ে যাবে।'
অবিনাশবাবুর মনে দোটানা। শেষে বলেই ফেললেন,'ঠিক আছে। যা হবার হবে। আপনার ঘটনাটা শুধু চমকপ্রদ নয়। অত্যন্ত ইন্সপায়ারিং। সবার জানা উচিত।'
'থ্যাঙ্ক উ স্যার। আপনার সম্মান রাখব। আর একটা কথা। ওনার কি মানপত্র রেডি?'
'তেমনই তো অ্যারেঞ্জমেন্ট শুনলাম।'
'লেখা হয়ে গেছে কি?'
'ঠিক জানা নেই। এক মিনিট। জেনে বলছি।'
হেডমাস্টার বেল বাজালেন। পিওন জিতু ঘরে এল। 'ডাকছেন স্যার?'
'ননীবাবুকে একবার ডাক তো—'
অবিনাশবাবু বিরাজকে বললেন,'ফেয়ারওয়েলের বিষয়টা উনি দেখছেন। আমি একেবারেই নতুন। এসেছি তিন বছর।'
একটু পরে ননীবাবু এলেন। হেডমাস্টারমশাই আলাপ করিয়ে দিলেন, 'ইনি হলেন আমাদের ফিজিক্সের মাস্টারমশাই। আর ইনি, বিরাজ কুমার।’ আর বেশি ভাঙলেন না।
প্রাথমিক আলাপ শেষ হলে বললেন, 'মনীশবাবুর মানপত্র লেখা কমপ্লিট?'
'না স্যার, চলছে। শেষমুহূর্তের কাজ।'
'আচ্ছা। এটাই জানার ছিল। অনুষ্ঠানের আর কত বাকি?'
'এই তো। আর কিছুক্ষণ।’
'বেশ। আমি এনার কাজটা সেরে নিই।'
'আচ্ছা।' ননীবাবু ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
অবিনাশবাবু বললেন, 'বিরাজবাবু, মানপত্রটা কি আপনার বিশেষ দরকার?'
'না স্যার। তেমন কিছু নয়। একবার দেখতাম আর কি।'
'ও।'
বেল বাজিয়ে জিতুকে ডাকলেন।
'ননীবাবুকে বলতে ভুলে গেছি। উপরে গিয়ে বল। স্যারেরা আজ মনীশবাবুর জন্য যেটা লিখছেন,শেষ হলে একবার যেন দেখিয়ে যান।'
'আচ্ছা।'
‘বিরাজবাবু, একটু চা.. কফি চলবে?'
ইতস্তত করে বিরাজ উত্তর দিল, 'কফি। অল্প।'
‘জিতু---দু কাপ কফি।'
টুকটাক কথাবার্তা চলছিল।
'আপনি কোন সালের মাধ্যমিক?’
'১৯৮৭।'
'ওরে বাবা। আপনি তো ঢের সিনিয়র। আমি ২০০০। আপনাকে দেখে আন্দাজই হয়নি। মনীশবাবুকে কতদিন পেয়েছেন?’
'ছ'বছর। ফাইভ টু টেন।'
'এ স্কুলে এগারো-বারো পড়েননি?'
'না স্যার। আমার ইস্কুল ভালো লাগত না।'
'আপনাদের সময়ের কোন স্যার আন্টিই নেই, সবাই রিটায়ারড। এই মনীশবাবুই শেষ। আমরা সব নতুন।'
'হ্যাঁ জানি। ওনারাই বলেছেন। আজ মনীশ স্যারের রিটায়ারমেন্ট।'
‘স্কুল ছাড়ার পর আর আসেন নি?'
'নাহ।'
'এখন তো অনেক কিছুই চেঞ্জ হয়ে গেছে।'
'হুম। সেই তো দেখছি। আমাদের সময়ে স্কুলের ঐ পাশের এক্সটেশনটা হয়নি। ওটা মাঠ ছিল। আমরা খেলতাম। মাঠে অনেক গাছ ছিল। প্রচুর পাখি আসত….’ বিরাজের স্বর স্তিমিত। যেন হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
একটু পরে ননীবাবু মানপত্রটা রেখে গেলেন। জিতু কফি দিয়ে যায়।
বিরাজ মানপত্রটা হাতে নিয়ে এক ঝলক কি যেন দেখল। আবার টেবিলে রাখে।
বলল, 'মনীশ স্যারের হাতে এটা দেবার পর... কোনভাবে একবার কি আমার হাতে একটু দেওয়া যাবে?'
হেডমাস্টারকে চিন্তিত দেখায়। কাজটা কি ঠিক হবে? হয়তো মনের কথাটা আন্দাজ করেই বিরাজ বলল,
'ভয় নেই স্যার। আপনার সম্মানহানি হয় এমন কিছুই করব না।'
'চেষ্টা করব।'
জিতু বলল, 'স্যার আপনাকে উপরে ছাত্ররা ডাকছে।'
'আপনি একটু বসুন বিরাজবাবু। আমি হলঘর থেকে আসছি।'
'হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক আছে।'
বিরাজ একা বসে থাকে। ভালই হল। এটা চাইছিল মনেমনে। এই স্কুলের সঙ্গে একা একটু কথা বলতে। ইস্কুল কি আর কথা বলতে চাইলেই রাজি থাকে? তারও কি কম অভিমান জমা হয়ে আছে বুকে?
চেয়ার ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। এইখানে প্রেয়ার হত। দশটা পঞ্চাশ। ঐ বাঁদিকের সামনের সারিতে বিরাজ। দু'হাত বুকের কাছে। ভাঁজ করা। চোখ বোজা। ঠিক এর উপরেই ছিল ক্লাস ফাইভ... ঐ যে!... বাইরে কান ধরে বিরাজ দাঁড়িয়ে…টানা দুই পিরিয়েড। চোখ লাল... পাশ দিয়ে পুলোমা যাচ্ছেন... যেতে গিয়েও ফিরে এলেন আন্টি...
'এই তোর চোখ লাল কেন রে?'
'কিছু না আন্টি।'
'কি হল বল?'
বিরাজের চোখ বেয়ে কেবল জলই পড়ছে। কথা বলছে না। বিরাজ চুপ। সৌগত ছুটে আসছে ক্লাস থেকে ...
...পুলোমা আন্টি সৌগতকে জিজ্ঞেস করছেন,
...'এই ও কান ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেন রে?'
...'ওকে স্যার শাস্তি দিয়েছে।'
..'কোন স্যার?'
..'বিজ্ঞান স্যার।'
..'নাম জানিস না?'
..'না আন্টি। ঐ যে লম্বা মতো। ধুতি পরেন …’
আন্টির মুখ গম্ভীর। বিরাজকে বলছেন,
'তুই ক্লাসে যা..'
...বিরাজ তবুও দাঁড়িয়ে আছে..
'কি রে যা—'
'না আন্টি। আজ আমার সারাদিন শাস্তি।'
'দূর পাগল। ক্লাসে যা। আমি স্যারকে বলে দেব।'
সৌরভকে জিজ্ঞেস করছেন,'এই ও কি করেছে রে?'
'তেমন কোন কিছু নয় আন্টি। বোর্ড মুছেছে।'
'মানে?'
...ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যায় আন্টির মুখ। সৌগতও হারিয়ে যাচ্ছে কোথায়…!
বিরাজ একটু এগিয়ে এল। প্রেয়ারের উঠোনটার মাঝখানে। এখান থেকেই ফাইভের ঘরটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ফ্রেমে রঙ একই আছে। ফ্রেমের মাথায় লেখা। ফাইভ। কক্ষ:২
আজ বোধহয় স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। এত ফাঁকা। এদিকটায় কেউই নেই। হেডস্যার বললেন হলঘরের কথা। সেটা কোনদিকে? নতুন বিল্ডিং?
বিরাজ এলোমেলো হ়াঁটতে হাঁটতে চেনা সিঁড়িতে পা রাখে...সিঁড়ির ধাপ... দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে আসে ...পায়ের পাতায়...এক..দুই..তিন.. চার..সিঁড়ির ধাপে ধাপে পা ..দিতেই ..দমকা বাতাস .. পাক খেয়ে ছুটে আসছে ...লক্ষ লক্ষ নিঃশব্দ ঢেউ। কথা। জড়িয়ে ধরা হাত। রঙিন বেলোয়ারি ধুলোর ঠুংঠাং। হাসি। গানের সুর।
এই সিঁড়ির মোট বাইশটা ধাপ। এগারো। আবার থামো। আবার ডানদিকে ঘুরে এগারো। বিরাজ লোভ সামলাতে পারে না। একবার উপরে উঠবে কি?
….সৌগত ..প্রদীপ.. অমর ..ধাক্কাধাক্কি করে উপরে উঠে যাচ্ছে। কোমরের কাছে গুঁজে রাখা আকাশি নীল জামা... কখন বোতাম ছিঁড়ে...বেরিয়ে পড়েছে! ...অমরের হাত থেকে অ্যালুমিনিয়াম টিফিন বাক্স ছিটকে পড়ল। ঝনঝন … যাহ…
'তোর টিফিন ..!’
'দূর টিফিন।'
ততক্ষণে পাঁউরুটির টুকরো ফুটবল। উঠে গেছে আকাশে...ছিন্নভিন্ন ...পাউরুটির ফাঁক দিয়ে আলো আর সবুজ বাতাস। নেমে আসছে। ..উপরে লম্বা টানা করিডোর। এক কোনায় কাগজের পাকানো বলে ওদের এখন নজর ..হইহই… ছুট লাগালো..
...হ্যালো মাইক টেস্টিং ...হ্যালো মাইক টেস্টিং.. পবন পরীক্ষার খাতায় পাকানো মাইক ..নিজেই নিজের নম্বর বলছে...এবারের ফার্স্ট টার্মিনাল পরীক্ষায় পবন মান্না ...ইংরেজিতে আবার ফেল...মোট নম্বর পেয়েছে সাত….
টেস্টিং টেস্টিং শুনে সৌগত,পলাশ,অমিয় ছুটে আসে। এখন পাকানো খাতার মাইক হাতে হাতে... নম্বর ঘোষণা হচ্ছে। ...এই তুই থাম ...আমি একটু বলি ..হ্যালো টেস্টিং ..আমি অমিয় কুন্ডু। ...আমি পেয়েছি… আরো কম...হি হি... ইংরেজিতে দুই...ভূগোলে এক...সৌগত পাকানো খাতার ফাঁক দিয়ে উপুড় করে দিয়েছে ভর্তি ঝালমুড়ির ঠোঙা …
পলাশ চট করে হাত পাতে। .. এএএএ.. আমি ঝালমুড়ি পেয়েছি...আমাকেও একটু দে মাইরি…!
বিরাজ ফাইভের সামনে এসে দাঁড়ায়। ফ্রেমের গায়ে কম্পাস দিয়ে খুঁটে খুঁটে নাম লিখেছে...হ.রি.শং.ক.র
খাঁজে খাঁজে রঙ। তবু স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। হাত বুলিয়ে দিতেই জলতরঙ্গ ভেঙ্গে যাচ্ছে। টুংটাং। শব্দের ঝালর ...
ঐ তো ফার্স্ট বেঞ্চ। জানলার ধারে ফড়ফড় করে উড়ছে অসীমের নতুন খাতার পেছনের পাতা...
ওর হুঁশ নেই.. সহদেব সোয়েটারের পিঠের দিকে চক দিয়ে লিখেছে ...গাধা...গায়ের নীল সোয়েটার... থেকে উড়ে যাচ্ছে রোঁয়া..চকের গুঁড়ো…
বিরাজ বারান্দার দরজার বাঁদিকে দাঁড়িয়ে আছে,..এখনও দাঁড়িয়ে আছে বিরাজ! ..এতদিন পরেও! ওকে পুলোমা আন্টি যে বারবার করে বলল। ক্লাসে যাবার কথা ..কান লাল..একি কবে থেকে এভাবেই দাঁড়িয়ে বিরাজ...কতদিন হল…?
দেখতে পায় মনীন্দ্র কাকু আসছে। সেই একই রকম। চটি ঘসে হাঁটছে।
বিরাজ বলল, 'আপনি মনীন্দ্র কাকু না?'
বুড়ো লোকটা হাঁটতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
'আপনারে তো চিনলাম না?'
'আমি এই ইস্কুলে পড়তাম।'
'কত সালে পাইশ করছো?'
'১৯৮৭।'
'কও কি! হেইডা তো অনেক দিন হইল।'
'হুঁ হলই তো।'
'নামডা কি?'
'বিরাজ।'
''ও ও আইচ্ছা আইচ্ছা। বয়স হইয়া গেছে গিয়া-- অহন মুখ ভুইল্যা যাই..কেমন আছ?'
'ভালো।’
‘তুমি?'
'অহন যাইবার লগে পাও বাড়াইয়া আছি। আইজ তো মনীশ স্যারের রিটায়ারমেন্ট।'
'হুঁ।'
'আমরা চইল্যা গ্যালে আমাগো যুগ শ্যাষ হইয়া যাইব।'
মনীন্দ্র কাকুর কথাটা পাক খেয়ে ওঠে নির্জন বারান্দায়। থামগুলোর গায়ে গায়ে জড়িয়ে ওঠে। বোগেনভিলিয়া ঝাড়। বাতাসে দুলতে থাকে। কাগজি ফুল। আড়ালে কাঁটা। শুঁয়োপোকায় ভরা। পাতলা রুগ্ন ডাল। দুলছে।
বিরাজ বুঝতে পারে। এক্ষুনি কাকু ওকে আহ্লাদে ধরে নিয়ে যাবে স্টাফরুমে। সেটা হতে দেওয়া যাবে না। চট করে বলে,
'কাকু তুমি নিচে যাচ্ছ?'
'হ।'
'চলো। আমিও যাব। হেডস্যারের কাছে।'
বিরাজ নিচে আসে ভাগ্গিস। ওকে দেখেই অবিনাশ পাত্র বললেন, 'আপনাকে খুঁজতেই লোক পাঠাচ্ছিলাম। দেখলাম ব্যাগ রেখে গেছেন। ভাবলাম পুরোনো স্কুল। ঘুরে দেখছেন।'
'চলুন, চলুন। শুরু হয়ে গেছে।'
বিরাজ বলল, 'স্যার আপনি আগে আগে যান। আমি পেছনে থাকব। পরে ঢুকব।'
হলঘরে ঢোকার তিনটে দরজা। বিরাজ একদম পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকে। শেষ সারিতে বসল।
টানা বড় হলঘর। মঞ্চে মনীশ স্যার। দেখেই চিনল বিরাজ। তবে সে লম্বা চওড়া অবয়ব আর নেই। কোলকুঁজো। মাথা জোড়া টাক। চামড়া কুঁচকে গেছে। চোখে ঘুম ঘুম ভাব। গাল ভাঙা। আগের হুঙ্কারটা ছেড়ে পালিয়েছে।
অনেকে অনেক কথা বলছেন। এদের একজনকেও চেনে না। ফুল-মালা, উপহার। ডাঁই হচ্ছে সামনের টেবিল। মানপত্র পাঠ হল।
অবিনাশবাবু বিরাজকে দেখিয়ে জিতুকে বলে রেখেছিলেন সব। জিতু সেই মত জিনিসপত্র প্যাকিংয়ের জন্য মঞ্চের একদম শেষে ফাঁকা জায়গায় যাবে। বিরাজ ওখানেই থাকবে।
একদম শেষে অবিনাশ পাত্র মঞ্চে উঠলেন। মাইকে বলা শুরু করলেন। অনেক অনেক কথা বললেন।
'আজ আমি আপনাদের একটা গল্প শোনাব। ছোট্ট। প্রথমেই এজন্য মাফ চাইছি। অনেক ভেবেও বুঝিনি। এমন দিনে এ গল্পটা সমীচীন কি না। তবে বলতেই হবে। যেহেতু গল্পটা ব্যতিক্রমী। এবং বেদনার। তবে নিঃসন্দেহে ইন্সপায়ারিং।'
‘এই ইস্কুলেরই ঘটনা। সে এক ফাইভের ছাত্র। পোশাকআশাকে ফিটফাট। তেমনই ফিটফাট ওর মনিটরিং। ক্লাস কন্ট্রোল। আমাদের শিক্ষার্থী উৎসব শুরু হবে। সিলেকশন হচ্ছে। ক্লাসে ক্লাসে চলছে বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র নির্বাচন।
ফাইভে চলছিল অঙ্কন প্রতিযোগিতার বাছাই। কে আঁকবে ঠিক হচ্ছে। বোর্ডে সবার আঁকা দেখছেন শিক্ষক মহাশয়। একজন চমৎকার ছবি আঁকলো। সবার খুব পছন্দ। ঠিক হল সে আঁকবে। ক্লাসের ছোট্ট মনিটর ফিটফাট। আঁকার বিন্দুবিসর্গ বোঝে না। আঁকতেও জানে না। ক্লাস শেষ। টিফিন ব্রেক।
মনিটর বোর্ড পরিষ্কার করে দিল। পরের ক্লাস। আবার ঐ স্যারই এলেন।
ক্লাসে ঢুকেই ক্ষিপ্ত। বোর্ড মুছে পরিষ্কার করা। ভয়ংকর চটে গেলেন। বললেন,
“কে বোর্ড মুছেছে?”
‘সম্মিলিত আঙ্গুল ওঠে অপরাধীর দিকে। স্যারের মাথা তখন আগুন। রাগ প্রকাশিত হল শাস্তিতে। সঙ্গে গালমন্দ,
“মাথা মোটা!আঁকার কিছু বুঝিস?”
‘ক্লাস শেষ হলে বোর্ড মুছতে হয়। মনিটর এটাই জানে। সেদিনের শাস্তিটা হয়ত খানিকটা অন্যায়ই হয়েছিল। কারণ কেউ তো শেখায়নি। ক্লাস ওভার হলে বোর্ড মোছা যাবে না। তবে ঐ শাস্তিটিতে বাচ্চাটির লাভই হল।
‘অপমানিত শিশুটি সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকল। সমস্ত অভিমান তখন গুঁড়ো গুঁড়ো সিমেন্ট। জমা হল মনে। চোখের জলে ভিজে সে গুঁড়ো সিমেন্ট প্রতিজ্ঞায় শক্ত পাথর হল। আঁকা তাকে শিখতেই হবে। আঁকার 'আঁ'ও না জানা বাচ্চাটির কঠিন শপথ। আঁকা শুধু শিখলই না। ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠল শিল্পী। বিখ্যাত শিল্পী। এই দেশের অন্যতম শিল্পী।
এই স্কুলের অখ্যাত ছাত্র। এখন স্বনামধন্য। বললে আপনারা অনেকেই চিনবেন: বিরাজ কুমার।’
হলঘরে শোরগোল উঠল। বিরাজ বসু কুমার! ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রেটি ...বিরাজ.. আমাদের স্কুলের ছাত্র!
'কই কোথায় স্যার ?…'
'উনি একদম পেছনের সারিতে। বসে আছেন।’
সবাই হুড়োহুড়ি করে উঠে পেছনে দেখে। মনীন্দ্র আর জিতু আসছে। মনীন্দ্রের হাত ভর্তি উপহার। প্যাক করা।
আর জিতুর হাতে শুধুমাত্র মানপত্র।
'কই?..উনি কই?'
জিতু আর মনীন্দ্র এসে জিনিসগুলো টেবিলের উপর রাখে।
হেডস্যার হাতে তুলে নেন মানপত্রটি। চারপাশ হাতে আঁকা চমৎকার বর্ডার। আর ঐ অল্প ফাঁকে মনীশবাবুর দুটি অনবদ্য ছবি। দুই বয়েসের। পাশে সাল। লেখা,
স্যারকে যেমন দেখেছি: ১৯৮৭; আর যেমন দেখলাম: ২০০৭। ছবিতে মনীশ বর্ধন হাসছেন। সে হাসি ক্রমশ উচ্ছল থেকে মলিন।
২৫
মনীশ বর্ধন বিচলিত। বিরাজকে খুঁজলেন। বিরাজ অপেক্ষা করেনি। দেখা না দিয়েই চলে গেছে।
(পরবাস-৮২, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)