টুকটাক মালপত্র গোছাচ্ছিল গণা। আনাড়ি হকারের যেমনটা থাকে।
মাত্র ক'দিন হল এসেছে। এখনও সেটিং হয়নি। হকারি চলছে টেম্পুরারি। তাড়া না দেওয়া অবধি । এ লাইনে গণা একা নেই। আরও অনেকে জুটেছে। সবার অবস্থাই টালমাটাল। গণারা চারজন একসঙ্গে থাকে। খুপরি ঘরে গাদাগাদিতে রাত কাটায়। ঘুম কি আসে? মটকা মেরে থাকে গণা। অন্য তিনজন ইসমাইল, তরুণ আর চপল ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা।
চপল বসে মাস্ক, রুমাল, নিয়ে। ইসমাইলের অল্প সব্জি, ভ্যানে ঘোরে। তরুণ এখনও বাজার ধরতে পারেনি। লাইনবাজি চলছে ব্যাটারি-রিকশার সঙ্গে। একশো টাকা, বাতচিৎ**।
গণারা বাজারে ভাগ বসাচ্ছে। পুরোনো হকারেরা বেজায় খাপ্পা। নিত্য ঝামেলা। লেগেই আছে। এছাড়াও প্যাঁচপয়জার বিস্তর। ভুঁইফোড় লোকজনও কম নয় -- দালাল, ইউনিয়নের রঙবাজ, ফড়ে ধাপে ধাপে উঠেছে টপ লেভেল অবধি যেন ল্যাসোর গিঁট। একের ঘাড়ে পা দিয়ে উপরে অন্যজন। তার উপরে একজন। তার উপর। তার উপর। চুনোপুঁটি টু হাইফাই। আর হল্লা তো ধরেই নি। গণার বাপেরও অসাধ্যি উপরে ঠিক কতজন এ-আন্দাজ করে।
দু'একজন মুখচেনা হয়েছে। ওদের সঙ্গে গণাও ঘুরঘুর করে। এটা শোনা কথা যে একটা না একটা লাইন লেগেই যায়। তবে সে লাইন এখনও বোঝেনি।
এ ক'দিনে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝেছে। বড় মেলাটেলায় আগেই সব সেটিং হয়। পরে নো ঝামেলি। ছোটখাট মিটিংমিছিল জমায়েতের বিক্রিবাটা অল্প। আয়ের ভাগেও ছাড়।
স্পোর্টস, মাদারি, অনশন, ধরনা, এসব পাবলিক এখন খায় না। ভিড় থাকে ছাড়া ছাড়া। পথচলতি লোক কম, বিক্রিবাটা অল্প। এদিকে ওরা নিশ্চিন্ত।
গণা অফিসিয়ালি গগন ভট্টাচার্য। চাকরি ছিল মাহিন অটোমোবাইলে। সিকিউরিটি গার্ড, পোস্টিং শালবনি। মাইনে ন'হাজার। এপাশওপাশ কিছু ইনকাম হত। রামপুরহাটে বাড়ি, তিন মাস অন্তর যেত। মোটামুটি চলছিল। হঠাৎ করোনার থাবা। ধাঁ করে ব্যবসার গণেশ উল্টালো। প্রথমে সিক্সটি পারসেন্ট পে কাট। চলল মাস দুয়েক। এরপর ধুমধাড়াক্কা ছাঁটাই। এখন ঝাঁপই বন্ধ। গণাদের পথে বসিয়ে দিল মহামারী।
কয়েকমাস বসে বসে পিএফের টাকায় চলল। শেষে ধাক্কা সামলাতে লজ্জার মাথা খেয়ে এদিক-ওদিক লাইন দিল। সব জায়গাতেই লম্বা কিউ। কে কাকে দেখে, সবখানেই ভিড়। দেখতে দেখতে ন’মাস গড়িয়েছে। গণা বাড়ি যায়নি। এখন বাড়ি যাওয়াও বিলাসিতা। বাসভাড়া আকাশছোঁয়া, যাবার কথা ভাবলেই মনেহয়, আবার একগাদা ফালতু খরচ। মাত্র চারঘন্টার পথ রামপুরহাট। তাতেও খরচের হিসাবে মনটা খচখচ করে। ভাবছে পৌষমেলার চক্কর যাক। না হয় তারপর ঘুরে আসবে একবার।
এই আকালের বাজারে, বলতে নেই, গণার কপাল মন্দের ভাল। বউ লতিকা, আশাকর্মী। ঠিক চাকরি না। সরকারি গাজর ঝোলানো কেস। ভাগ্গিস ঐটুকু ছিল। তবে কাজটার গালভরা নাম। সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী । উজ্জ্বল বেগুনী শাড়ি, সাদা এপ্রন।
লতিকাকে চমৎকার লাগে।
লতিকার কাজটা স্বাস্থ্যসেবা। স্নেহমমতায় রুগি আগলানো। গোটা দেশে, জেলায় জেলায় ছড়িয়ে আছে আশাকর্মী। মা-শিশুর রোগ প্রতিরোধ। স্বাস্থ্যসেবামূলক আরও কত কী।
ইদানীং করোনায় এলোপাথাড়ি কাজ। দিনরাত ঘুরছে দরজায় দরজায়। সংক্রমণ প্রতিরোধে লতিকাদের অসম লড়াই--ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, প্রাণ হাতে নিধিরাম। লতিকারা মাইনে পায় না। ওরা ন্যাশনাল রুরাল হেল্থ মিশনের ভলান্টিয়ার। অনারারিয়াম আসে।
অসুস্থতাজনিত যে-কোন কাজের দায়িত্ব বর্তায়। রুগীর বিছানার পাশে হাজির থাকো, দিনের পর দিন ক্লান্তহীন সেবা করে যাও। এতে ছুটিছাটা আবার কি? ফুঃ!
এত চাপ, এত দায়িত্ব তবুও মিনিমাম মজুরিটুকু নেই। হু হু বাওবা, এ হচ্ছে ‘কেয়ার ইকোনমি’র মাজাকি। মিনিমাম ওয়েজ অ্যাক্ট আবার কী! বালাইষাট। লতিকাদের শ্রমদান মূল্যহীন, সেবাটা ফাউ।
সরকারের ভাবখানা এমন, স্বেচ্ছাশ্রমের আবার মূল্য! হুস। ওতো পড়ে পাওয়া আঠেরো আনা।
গণার মতো মোটামাথার লোকও বোঝে। নিজের দাড়ি সেলুনে কাটারও খরচ আছে। তবে লতিকাদের বেলায় গোঁজামিল কেন? আসলে সরকার জানে ওদের ঘরে নিত্য অভাব। বিরোধিতার মাজা ভেঙে রেখেছে। তাই এত নিশ্চিন্ত গোঁজামিলে চলছে 'কেয়ার ইকোনমি'!
আসলে এসব পলিটিক্সের সেয়ানা ছক। ভোটের আগে আগে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি। মেয়েরা হল মায়ের জাত… ইত্যাদি, প্রভৃতি সেন্টুর মোড়ক।
একটু-আধটু খাটুনি সংসারে সবারই থাকে। নিজের সংসারে মহিলারা তো হামেশাই করে থাকে, তেমনই একটু বাইরে হলে ক্ষতি কী? তাই বলে কি সব তাতে টাকা টাকা করতে হয়?
আদতে লতিকারা কার্যত বাধ্য। ওদের ইউনিয়ন নেই। এসব ঘটনা এখন গা সহা। মুখ খুললেই কোপ। যা পাচ্ছে, তাও যাবে। দরকার কি বাবা শুধু শুধু চটিয়ে?
গণা চোখের সামনে দেখছে লতিকাদের হাড়ভাঙা খাটুনি। তবুও সরকারের ফালতুমিতে এসব অদৃশ্যই রয়ে যায়। ওদের অধিকারের লড়াইটাও তাই অনুপস্থিত। আশাকর্মীদের 'কাজে বহালে'র শর্তগুলোও অদ্ভুত।
অবিবাহিত চলবে না! বিবাহিত, অথবা বিধবা। কিংবা বিবাহবিচ্ছিন্না। কাজের এমন বিচিত্র শর্ত কেন? কি জন্য ? পুরুষকর্মীর তো এমন শর্ত নেই।
মেয়ে মানেই সেকেন্ড ক্লাস ব্যাপারস্যাপার। তাই আলাদা। বিয়ে হলে তো শ্বশুরবাড়ি যাবে । বাসস্থান অনিশ্চিত। অতএব শুরুতেই বাতিল করো। আচ্ছা, বিধবা আশাকর্মী যদি বিয়ে করে? নিশ্চয়ই ফুটিয়ে দেবে। এদের তো বদলিরও অধিকার নেই । কেন?
প্রতি হাজার গ্রামবাসীতে একজন আশাকর্মী! মা-শিশুর স্বাস্থ্যের আপডেট। রেগুলার চেক-আপ। আয়রন, ক্যালসিয়াম বড়ি পৌঁছানো। ভ্যাকসিন দেওয়ানো। ডেলিভারির আগে, পরে দেখভাল। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে খবর দেওয়া। প্রসবকালীন শিশুমৃত্যুর মৃত্যুহার কমিয়ে আনা। সব হ্যাপা সামলাতে জেলায় জেলায় টিমটিম করছে ঐ একজন লতিকা!
একি সোজা কাজ। ওরা মানুষ, না আলাদীনের দৈত্য! আর বছরের শেষে ক্রেডিট জোটে মন্ত্রীদের। ঝলমলে আলোয় সাফল্যের খতিয়ান। আর লতিকারা হল পিলসুজ! অন্ধকারেই পড়ে থাকে।
আশাকর্মীদের কাজে বিস্তর ঝকমারি। ষোলোআনা আব্দার সামলাও। আর মাস গেলে? তিন-চার হাজার। কখনো কিছু বকশিস। তাও অনিশ্চিত।
বুঝিয়েসুঝিয়ে সরকারি হাসপাতালে প্রসব যদি হয়। এরপর আরও যদি আছে। ঠিকঠাক ভ্যাকসিনের কোটা কমপ্লিট হবে, তবেই ইন্সেনটিভ। নানান ফ্যাকড়া। এসব মিলিয়ে কোন মাসে হয়ত সাতহাজার। এ টাকায় সংসার চলে?
হারামি লকডাউন, গতকয়েক মাস ইন্সেনটিভও নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব হাতে গোনা। ডাক্তারবাবুরা কোভিড সামলাতেই জেরবার। হাসপাতালে সংক্রমণের ভয়।
টিকা দেওয়ার কাজ বন্ধ। ভ্যাক্সিন, ওষুধ অমিল। অঙ্গনওয়াড়িও খোলে কি খোলে না। মা, শিশুদের পুষ্টিকর খাবার জুটল কি না সে নিয়ে কারো খোঁজ নেই । টিকা তো কোন ছার।
লাভের মধ্যে লকডাউনে লতিকার ঝুঁকি বেড়েছে। ল্যাঠা সামলাও যেমন করে হোক।
সম্পূর্ণ অচেনা ঝক্কি। আনাড়ি লতিকা। নিজেই মাথামুণ্ডু বোঝেনি। তার আবার সচেতনতা বৃদ্ধি। কনট্যাক্ট ট্রেসিং, সুপার স্প্রেডার। আরও কত কী। হুহ! সব মাথার উপর দিয়ে। হুসস…
ভিনরাজ্য থেকে শ্রমিক আসছে কাতারে কাতারে। কে কোথায় যে লুকিয়েছে! কোয়ারেন্টাইনের নিয়মটিয়ম কে বুঝবে? দায় যেন গিয়ে ঠেকেছে সব আশাকর্মীদের। কালঘাম ছুটছে। চোদ্দোদিনের ফিটনেসের হিসেবের সার্টিফিকেট নেওয়া। সেফহোম-টু-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সাটল ককের মতো দৌড়ঝাঁপে নাজেহাল।
কিন্তু লতিকাদের সুরক্ষা? এসব বয়েই গেল। এনিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ওদের মাস্ক, স্যানিটাইজার, সাবান কিস্যু না। কাজ করে সম্পূর্ণ অসুরক্ষিতভাবে। পিপিই কিট বাতুলতা। ভাবখানা এমন, টেলএন্ডারে ব্যাটিং। বাঁচলে বাঁচো। কিন্তু ম্যাচ বাঁচাতে হবে। নইলে অনারারিয়াম নট।
এসব ভাবলেই গণার বুকের ভেতরে টের পায় হাতুড়ির এলোপাথাড়ি ঘা। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা বরফ। জমাটবাঁধা উদ্বেগ উঠে আসে গলার কাছে। শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তার করাতে ঘুম ফালা ফালা হয়ে যায়। আতঙ্কের বাঘনখ অন্ধকারে আঁচড়ায়। গলার কাছে যমদূত পা দিয়ে বসে শাসাচ্ছে । গণার শরীর ঘামে ভিজে ওঠে।
অথচ ইসমাইলকে বলে, 'ধুর। তোর গা তো হলুদ শালপাতার মতো শুকনো, খসখসে।'
তবুও স্বস্তি কই? ছড়িয়ে ছিটিয়ে উঠে আসে অস্থিরতা। মাথায় দিনরাত খোয়া ভাঙ্গার শব্দ—ঠক… ঠক… ঠকাস।
বুকের মধ্যে একটু একটু করে জমানো আশার তুবড়ি। ঝিকমিকিয়ে জ্বলার বদলে ক্রমাগত বিস্ফোরণ... অন্যমনস্ক হয়ে যায় গণা। লতিকার খবর নিতেও ভয় পায়। লতিকা ভালো আছে তো? আশাকর্মীদের সুরক্ষা আবার কি? বেঁচে থাকে, এই ঢের। ওদের জীবন সব হিসাবের বাইরে। কারোর কোথাও মাথাব্যথাও নেই। কে জানে, ও কেমন আছে?
বাস বন্ধ। ট্রেন বন্ধ। গণা আসার আগে বার বার সতর্ক করে।
'ঠিকমত না হয় নাই বা হল এ ক'দিন। তুমি অসুস্থ হলে? দেখতেও দেবে না। পায়ে দড়ি বেঁধে কি আঁকশির একটানে ভাগাড়ে! ...থাক না, একটু ঢিলে দিলে... কী এমন অশুদ্ধি হবে…?'
তা সত্ত্বেও লতিকা দূরে দূরে যায়, রিপোর্ট দেয়।
কোরিন্টিন সেন্টারের মানুষগুলোর মধ্যে হেঁটে বেড়ায়। মৃত্যুহীন। অবিচল। যেন শমনকে গিঁট বেঁধেছে আঁচলে। ওদের যাতায়াতের ব্যবস্থা নিয়েও কেউ ভাবেনি। অথচ হাজিরা মাস্ট।
গণা বলে বলে মাস্ক, স্যানিটাইজার কিনিয়েছে। ইউজ করছে তো ঠিকমত?
একা থাকলে আবোলতাবোল ভাবনার বেনোজল, গণাকে চুবিয়ে মারে। ভাবে কী দুঃসাধ্য লতিকার কাজ--গাড়ির আগে ঘোড়া জুতে দেওয়ার মতো।
মেয়েদের আবার কথা! গুরুত্ব দেয়ারই অভ্যেসই নেই তো শোনা। মেয়েরা নিয়ম বোঝাবে, নির্দেশ দেবে আর পুরুষেরা মন দিয়ে শুনবে, মানবে! হেঃ সব ভোঁ ভাঁ। সেটাই আরেকবার প্রমাণ হচ্ছে লকডাউনের গেরোয়।
আশাকর্মীরা মেয়ে। অভিবাসী শ্রমিকরা অধিকাংশই পুরুষ। ভরসা ঐ লতিকারাই। কালঘাম ছুটেছে বোঝাতে। মেয়েদের পরামর্শ মানে কে। শুনবেই বা কেন? হুশ। কোভিড সচেতনতার প্রচার ভোগে।
তবু এমনদিনও গেছে,লতিকা তিনদিন বাড়িই ফেরেনি। সেন্টারেই থেকেছে। ভাগ্গিস লতিকার বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। অবশ্য বিয়েই বা ক'দিন। ঊনিশের ডিসেম্বর। এর মধ্যেই সংসার, জীবন তছনছ। লতিকার এখন দিনরাতের তফাৎ নেই। অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে কাজ। একটা দুটো কমিউনিটি কিচেন আছে নাম কা ওয়াস্তে। খাবার জুটল কি জুটল না, ভগবান জানে।
গণা ছাঁটাই হলে লতিকাই কোনরকমে চালাচ্ছে। অনেক দেনা হয়েছে, যদিও গয়নাগাঁটি সামান্য যা ছিল, একে একে বিক্রি করেছে হাসিমুখে। নেহাত বাবার বাড়িটা ছিল। না হলে রাস্তায় দাঁড়াতে হত। এমন ঘটনা তো কলিগদের অনেকেরই ঘটল।
পাশের টেবিলের শুভময়ের সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল সেপ্টেম্বরে। ও তখন রাস্তায়। ফোন কেটে দিয়ে শুভই ভিডিও কল করল। শুভময় হাসছে--বাজ খাওয়া হাসি। স্থির, নিঃশব্দ হাসি, শুধু হাসির বিবর্ণ ছাই উড়ছে।
বলল, 'ফোন করে ভালই করলি। এখন বেরিয়েছি। ফোনটা বিক্রি করতে। যা পাই--'
ছ্যাঁত করে উঠেছিল বুকটা। তিরিশ হাজারে কেনা, এই জানুয়ারিতে। মাত্র ক'টা টাকায় ছেড়ে দেবে! বুকটা খাঁ খাঁ করে। শুভময় ফোন কেটে দিল। মনে হল ডুবন্ত মানুষটা সাধ মিটিয়ে ভেসে যাচ্ছে অথৈ জলে।
শুভময়ের ফ্ল্যাট ছিল ব্যাঙ্ক-লোনে, ইএমআই দিতে পারেনি। ভেবেছিল মোরাটোরিয়ামে সুবিধে হবে, উল্টে বাঁশ হল। মোরাটোরিয়াম উঠে গেল এদিকে আয়ের সুরাহা হল না। একধাক্কায় মোটা টাকা, ব্যাঙ্কের তাগাদা। উপায় ছিল না। ফ্ল্যাটটা গেল। সপরিবারে পথে বসল। কী ভাবে কাটছে ওদের?
সেসব কথা ভাবতেও পারে না। হার্টটা যেন ক্যাম্বিস বল! ধড়াস ধড়াস লাফায়। দিন নেই রাত নেই ড্রপ খাচ্ছে। এক-একসময় ভাবে, বলটা যদি মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় তো বাঁচে। ও বল ড্রপ খেয়ে যেখানে খুশি যাক।
একা একা বসে থাকলে চোখের সামনে কত কী যে দেখে। আজ দেখল অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে। ঠিক যাচ্ছে না । একটু থেমে থেমে এগোচ্ছে। এমনভাবে সাধারণত অ্যাম্বুলেন্স যায়না। ঐ গাড়িগুলো রেলাবাজ। উর্ধ্বশ্বাসে দেদার সিগন্যাল ভেঙ্গে ছোটে। কিন্তু আজ যেন যাওয়ারই ইচ্ছা নেই। একটু যাচ্ছে আবার থামছে। ঠিক যেন হাওড়ার ট্যাক্সি। ভাড়া নিয়ে যেমন নকশাবাজি করে। মিটার খারাপ… দু'শো... এক্সট্রা। একটা অ্যাম্বুলেন্স কি এসব পারে? ভেতরে তো পেশেন্ট আছে তবু রাস্তায় দরাদরি!
গাড়িটা বেশি দূরে নয়। একটা মেয়ে কথা বলছে। মনে হয় পেশেন্টের আত্মীয়। কেমন কাকুতি মিনতি করছে।
'চলুন না দাদা, একবার তো ঠিক হল ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতাল পাঁচ হাজার। আবার এখন বলছেন সাত। সত্যিই অত নেই--'
ড্রাইভার বাইরে এসেছে। গাড়ি সাইড করা। খ্যাচম্যাচ করছে, 'এইজন্যই এসব পেশেন্ট তুলি না। ডিস্ট্রিক্ট বলবে কোলকাতা। তখন কেস খেয়ে যাব। দেবেন তখন সত্তর হাজার? মালকড়ি আছে? দেখে তো লুন্ডাপার্টি লাগছে। করোনা পেশেন্ট আনেন কেন? কেউ ছুঁয়ে দেখবে? বেকার আমার তেলখর্চা! পেশেন্ট ফুটে গেলে কিন্তু রেসপন্সিবিলিটি নেই…'
গণা আশ্চর্য হয়ে যায়। বলে কী? কোলকাতায় গেলে সত্তর হাজার! খুব ভাল গাড়িতে আপডাউন করলেও... বড়জোর ...কুড়ি। সেখানে চাইছে সত্তর! লোকটা মানুষ? এতক্ষণ হুটারের শব্দটা বালি কাগজের মত ঘষে ঘষে ভয় উড়াচ্ছিল। এই মাত্র হুটার বন্ধ হল। দরদামের ঢেঁকি চলছে।
এসব কী হচ্ছে! একজন মুমূর্ষুকে নিয়ে যাবে! তার জন্য এত দরাদরি?
ওই তো গাড়ির গায়ে লেখা। মিউনিসিপ্যালিটির নাম। তার মানে এই মাগ্গিগন্ডার বাজারেও মাস গেলে ড্রাইভার মাইনে পায়। তাহলে? এত হৃদয়হীন হতে পারে কেউ! মৃত্যুশ্বাস কি মোহর, যে বেচাকেনা হবে?
ঝড় তো একদিন নিশ্চয়ই থেমে যাবে। কিন্তু এই পচা মানুষগুলো? ড্রাইভারের মুখটা ভালো করে দেখল। তোবড়ান গালটা শুকনো চ্যাঙারি যেন--ফুটো ফুটো, পোকায় কাটা শালপাতা।
রাণীগঞ্জের স্টেশনে এক ভিখিরি দেখেছিল গণা। উন্মাদ মহিলা, নিম্নাঙ্গে শতছিন্ন কাপড়। একটা পায়ে ঘা। বস্তা পেঁচানো কালচে। বুকের স্তন শুকিয়ে পেটের কাছে লেপ্টে আছে। সারা শরীরে কালচিটে। মাথার উকুন নেবে এসে ঘুরছে মুখে। চোখের পাতায় উইপোকা। ঘা থেকে পুঁজ গড়িয়ে পড়ছে পায়ের কাছের বাটিতে। সেটাও তোবড়ান। দেখলেই গা ঘিনঘিন করবে। অথচ মহিলার হুঁশ ছিলনা।
কিন্তু এই লোক? এতো পাগল নয়। দিব্যি সুস্থ সবল, হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। তবে মনটা ঐ ঘিনঘিনে ভিখিরি।
করোনা কি এত প্রচণ্ড? মানুষকেও পচিয়ে দিল! শিউরে ওঠে গণা। পচনটা আরও যে কত বিকৃত হবে! লোকটা যা টাকা চাইছে, ওর একবছরের কোম্পানির মাইনের কাছাকাছি। মাথা ঝিমঝিম করে। ফুসফুস পুড়ে যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাসে। ধোঁয়ার ছাইয়ে আচ্ছন্ন গণা।
বিক্রির ইচ্ছেটাই চলে গেল। লতিকাকে কি এসব বলাও যাবে? ও নরমসরম। এসব বললেই হল। গায়ের উপর উঠে মুখ চেপে ধরবে একেবারে, 'থাক থাক। ভয় করছে।'
গণা এসেছিল পৌষমেলার মাঠে। একপাশে রাজমিস্ত্রি, জোগাড়ে সিমেন্ট মাখছে। পাঁচিল উঠবে বলে লম্বা গর্ত খোঁড়া।
বাইরের লোকজন ঘুরছে, যদিও আসল মেলার এখনো দেরি আছে। তখন হয়ত এ জায়গাটা থাকবে না। চড়া দামে নিলাম হবে। গণার এখনও গুছিয়ে বসা হয়নি। ওর জিনিসপত্র তেমন আহামরি কিছু নয়। দুটো ঝুড়িতেই ধরেছে। একটায় মাটির পুতুল নানারকম -- বাউল একতারাওলা, কলের দৌড়, সাঁওতাল দম্পতি, রামকিঙ্করের হারভেস্টার, সুজাতা এমন সব। এসব অনেকগুলোই গণা কিনেছে। একলপ্তে একটু দাম কম হয়। আরেকটা ঝুড়িতে হাতের কাজ। শ্রীনিকেতনের একতারা, কুটুমকাটাম, ব্লকপ্রিন্টের লেদার পার্স, তালপাতার বাঁশি।
বাবা ঠাকুর গড়ত। ছোটবেলায় মূর্তি বানানো শিখেছিল শখে। এতবছর পর কাজে লাগল।
গণার বানানো মূর্তিও আছে ঝুড়িতে -- চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ। পৌষমেলায় রবীন্দ্রনাথের বিক্রি বেশি। তখন মাঠ ভরে উঠবে।
এবারেও কি এত লোক হবে? অবশ্য পুজোর ক'দিন মন্দ ভিড় হয়নি। গণার ভয়ও লাগে। এই এত কাছাকাছি গায়ে গায়ে মানুষ!
রোগটা যদি আরও ছড়ায়। আবার ভাবে, উপায় কি ? এতদিন তো ঘরবন্দিই ছিল। কেউ ফিরেও দেখেনি। কত আশ্বাসই তো শুনল, কত সাহায্যের নাম। সব ফাঁপা বুলি।
ভয় লাগলেও ক্ষিদে তো পায়। ক'দিন না খেয়ে কাটাবে? মরণ যে দুদিনেই কামড় বসিয়েছে। যাবে কোথায়? কে আছে বসিয়ে খাওয়াবে?
এত লোক সব বেপরোয়া। সবাই নতুন হকার। দেখলেই বোঝা যায়। পুরোনোদের দরাদরির কায়দা আলাদা। কাস্টমার ডাকার টেকনিক অন্য রকম।
প্যাকেটে ভাঙা মাটির পুতুল, মূর্তি বদল হয় নিমেষে। কাগজের মোড়ক সটান কাস্টমারের ব্যাগে। আজ রোদ তেমন চড়া হয়নি। পুরোনো হকারেরা প্লাস্টিক টাঙাতে দেয় না। ওতে নাকি কাস্টমার বেশি হয়।
আজ অবশ্য তেমন বাধা নেই। পুরোনোদের আসার সময় হয়নি। ওদের জায়গাগুলো ফাঁকা। গণার নির্দিষ্ট জায়গা নেই। আজ যেমন, বিশ্বভারতীর গেটের সামনে। অ্যাম্বুলেন্সের ঘটনাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। মাল গোছানোয় মন ছিলনা।
হঠাৎ দেখল পিলপিল করে লোক আসছে।! নিমেষেই ভিড় থিকথিক করছে। চারিদিক হইচই। চিৎকার । একটু একটু করে বাড়ছে। কিছুই বুঝতে পারেনা। দু'চারজন মুখচেনা হকার। মালপত্র গোটাচ্ছে। বলল, 'বাঁচতে চাস তো ভাগ।'
পুরোনো কাশির মতো ঘঙঘঙ শব্দ। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তিনটে পে-লোডারের দৈত্যচাকার খাঁজকাটা হাসি। এগিয়ে আসছে শকুনের তীক্ষ্ণ ঠোঁটের মত। ফালাফালা করে দিচ্ছে যা পাচ্ছে। সবকিছু গুঁড়িয়ে এগোচ্ছে । যেন যুদ্ধট্যাঙ্ক। চেনে বাঁধা সারি সারি চাকার গভীর কামড় পড়ছে লালমাটিতে। আঁকশি নেমে আসছে আকাশ থেকে। মুহূর্তে ছোবল। ঐ দাঁতের ফাঁকে আটকে উঠে যাচ্ছে গণার ঝুড়িভর্তি রবীন্দ্রনাথ। টংয়ের মাথায় ঝুলছে। আগের হাওলাতের টাকা এখনও শোধ হয়নি। কাতর চোখে ঝুড়িটাকে দেখল। গোলমাল হচ্ছে খুব। টুকটাক জিনিস ছিল হাতের কাছে। দলা পাকিয়ে থলিতে ভরে। লালধুলো উড়ছে। দৌড়ে রাস্তা পার হল গণা।
এখনও অ্যাম্বুলেন্সটা দাঁড়িয়ে! তবে স্টার্ট দিয়েছে। হুটার চলছে। আতঙ্কের তরঙ্গ ছড়িয়ে পাশ দিয়ে হুশ। বেরিয়ে গেল। এক ঝলক ভেতরে দেখল। বেগুনী শাড়ি সাদা এপ্রনে কে শুয়ে আছে?নাকে অক্সিজেন নল। লতিকাদের কেউ মনে হচ্ছে। ... লতিকা কি?... লতিকা নয় তো!
গণা উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে। গাড়িটা মোড়ের মাথায়। এক্ষুনি ঘুরে অদৃশ্য হবে। তার আগে...যদি ভালো…করে দেখা যায়..
(পরবাস-৮২, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)