Subscribe to Magazines




পরবাসে সাগরিকা দাসের আরো লেখা



ISSN 1563-8685




কলম কার

চায়ের কাপটা নিয়ে এসে আবার লেখার টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসলাম। এই চেয়ারে বসেই আজ রাতটা কাটবে আমার। শনিবারের রাতগুলো এটাই আমার রুটিন। সারা সপ্তাহ তো অফিসের হাজার একটা ঝামেলা সামলাতেই কেটে যায়। লেখালেখির জন্য তাই শুধু শনিবার রাত আর রোববারটাই বরাদ্দ থাকে। আজ অবশ্য সন্ধ্যের পরে অনবধানে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল একেবারে রাত সাড়ে দশটায়। চোখে-মুখে জল দিতেই জম্পেশ খিদে পেয়ে গেল। চাকরি সূত্রে এই শহরে আমি একাই থাকি। তাই খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে ওই আপনা হাত জগন্নাথ সিস্টেম চলছে। ফ্রিজ হাতড়ে বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না। এই দাউদাউ খিদে পেটে নিয়ে কিছু রাঁধতেও ইচ্ছে করছে না। অতঃপর টু মিনিট ন্যুডলসই ভরসা। সেটাই দু-প্যাকেট সাবাড় করে, এক কাপ ঘন চা করে নিয়ে এসে আবার বসলাম মাঝপথে আটকে থাকা লেখাটা নিয়ে। লেখালেখির শখটা আমার ছোটো থেকেই ছিল। গত কয়েক বছরে সেটাই বেশ পরিচিতি পেয়েছে। প্রথম সারির কিছু ম্যাগাজিনে নিয়মিত আমার লেখা গল্প-উপন্যাস ছাপা হয় এখন। এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু গত কয়েকমাস যাবৎ একটা অদ্ভুত সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। না, ঠিক সমস্যা নয়। বরং একটা অস্বস্তির বোধ তৈরি হয়েছে। ব্যাপারটা শুরু থেকেই বলা যাক।

মাস আষ্টেক আগে একটা প্রথম শ্রেণির দৈনিকের জন্য একটা ছোটো গল্প লিখেছিলাম। একটা বাস অ্যাকসিডেন্টকে কেন্দ্র করে ছিল গল্পটা। পত্রিকা দফতরে লেখাটা মেল করার পরদিনই ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা। রাতে বাড়ি ফিরে টিভিতে খবর দেখছিলাম। একটা বাস অ্যাকসিডেন্টের খবর দেখে চমকে উঠেছিলাম। হুবহু আমার লেখা গল্পের ঘটনা যেন বাস্তবে ঘটেছে। ঘটনার স্থান, কাল, পাত্রের সঙ্গে গল্পের এত মিল! শুধু নামগুলোই যা আলাদা। একি সম্ভব? ব্যাপারটা কাকতালীয় মনে করে পরদিনই মন থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলাম জোর করে। দিন পনেরো পরেই আবার একটা ম্যাগাজিনের জন্য গল্প মেল করেছিলাম। এবারের গল্পটা ছিল একজন বিত্তশালী কিন্তু বয়স্ক এবং নিঃসঙ্গ মানুষের ওপর। জোর করে এলাকার শাসক দল তাঁর বাড়ি দখল করে নিয়ে তাঁকে হত্যা করে। অদ্ভুত ভাবে এই প্লটটাও বাস্তব ঘটনার খবর হিসেবে আমার চোখে পড়ল দিনদুয়েক পরেই। এবার আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। জানি, এগুলো কোনটাই অস্বাভাবিক বা অসম্ভব ঘটনা নয় আজকের দিনে। কিন্তু আমার কেমন জানি খটকা লাগল। আমরা লেখকরা অনেক সময়ই খবরকে গল্পের প্লট করে তুলি। তবে আমার কেন জানি না বারবার মনে হচ্ছে, আমার ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটাই হচ্ছে। ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্য পরের দুটো গল্পের প্লট একটু অন্যরকম সাজিয়েছিলাম। একটা গল্প ছিল একজন বিখ্যাত চিত্রকরকে নিয়ে। যে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছেও আচমকা একদিন ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়ে বিবাগী হয়ে যায়। কারণ তার কিছু পুরনো অপকর্মের পাপবোধ তাকে দিনরাত তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। অন্য গল্পটা ছিল সেকেন্ড হুগলী ব্রিজের ভেঙে পড়ার ওপরে। আমি একশ শতাংশ নিশ্চিত ছিলাম এই প্লট দুটো কিছুতেই বাস্তব জীবনে খবরের শিরোনামে আসতে পারবে না। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণিত করে সত্যিই একজন বিখ্যাত চিত্রকর হঠাৎ অবসর নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে প্রায় নির্বাসনে চলে গেলেন। আমার ভ্যাবাচাকা ভাবটা কাটতে দিনকতক সময় লেগেছিল। তারপর ভাবলাম, যাক, সেকেন্ড হুগলী ব্রিজটা অন্তত বেঁচে গেল। হ্যাঁ, সেটা বেঁচে গেল বটে তবে তার বদলে পরপর পোস্তা, উল্টোডাঙ্গা আর মাঝেরহাট ব্রিজগুলো একে একে ভেঙে পড়তে লাগল। আমার তখন পাগল পাগল লাগছিল। লিখতে বসলেই মাথা ঝিমঝিম করছিল, হাত কাঁপছিল। তারপর থেকে লেখালেখি বন্ধই করে দিয়েছিলাম।

সেই ঘটনার প্রায় মাসদুয়েক পরে, গতসপ্তাহে একটা নামি পত্রিকা দফতর থেকে বিশেষ সংখ্যার জন্য আমন্ত্রণমূলক লেখা পাঠানোর মেল পেয়েছি। সত্যি বলতে কী, অফারটা অ্যাক্সেপ্ট করার লোভ সামলাতে পারিনি। সেই সঙ্গে এই সুযোগটা পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে দেখে একটু চাপা গর্বও অনুভব করেছিলাম। কিন্তু মুশকিলটা হল লেখা শুরু করার সময়। গল্পের প্লট যে কী দেব সেটাই মনস্থির করতে পারছিলাম না প্রথমে। আগে যখন নিয়মিত লিখতাম তখন ল্যাপটপের সামনে একবার গুছিয়ে বসলেই হুড়মুড়িয়ে আঙুল চলত কিবোর্ডে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্য রকম। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা অদ্ভুত খেয়াল চাপল। এবারের প্লটটা যদি একেবারে অবাস্তব বা পরাবাস্তব জাতীয় কিছু হয়? তাহলে তো আর সেটা বাস্তব জীবনের ঘটনা হয়ে আমাকে তাড়া করতে পারবে না। ভাবনাটা মাথায় আসতেই তরতরিয়ে লেখা বেরোতে লাগল আঙুল দিয়ে। দাঁড়ান, গল্পটা আপনাদেরও বরং বলি। গল্পের নাম এখনও ঠিক করিনি। লেখাটা শেষ হলে তারপর নাহয় সেটা ভাবা যাবে।

১ রাস্তার ওপারে মিউনিসিপ্যালিটির কলে মুখ ধুতে গেছিল খিদ্দা। পাশের আস্তাকুঁড়টার দিকে অভ্যাসবশেই চোখ চলে গেছিল ওর। আস্তাকুঁড়টার গা ঘেঁষে যে উঁচু পাঁচিলটা উঠেছে সেটা একটা আবাসনকে ঘিরে রেখেছে। ওই আবাসনের ভেতরে খিদ্দাদের মতো মানুষের ঢোকা বারণ। তাতে খিদ্দার অবশ্য কিছু যায়-আসে না। ফেলে দেওয়া হাবিজাবি জিনিস থেকে পলিথিন আর প্লাস্টিকের প্যাকেট বেছে বিক্রি করে দিন চলে খিদ্দার। বাসি আনাজের খোসা, দুধের প্যাকেট, পচা তরকারির সঙ্গে মাখামাখি হয়ে খালি হয়ে যাওয়া বিলিতি মদের বোতল, সেন্টের শিশি, রঙচঙে উপহারের বাক্স, হাতভাঙা পুতুল, তোবড়ানো খেলনা আরও নানা জিনিসপত্রে ডাঁই হয়ে রয়েছে জায়গাটা। মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি আসতে এখনও প্রায় ঘন্টাখানেক দেরি আছে। তার আগেই দরকারি জিনিসগুলো বেছে সরিয়ে ফেলতে হবে। নিজের বস্তাটা নিতে সবে ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল খিদ্দা, ভাঙা পুতুলটার পায়ের নিচে তখনই চোখ পড়ল ওর। একটা রঙচটা মানিব্যাগ। খিদ্দার বহুদিনের শখ একটা মানিব্যাগের। হোক না একটু পুরনো, রঙচটা, তবুও আস্ত একটা মানিব্যাগ তো! হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা তুলে নিল ও। ভোলাটা আজকাল বহুত রেলা দেখায়। ভোলার দাদা রাখু যেদিন থেকে ওই আবাসনে দারোয়ানের চাকরিটা পেয়েছে সেই দিন থেকে ভোলার রেলা আর দেখে কে! ওই উঁচু পাঁচিলের ওপারে কত সুন্দর সুন্দর আর কী কী জিনিস আছে তার খতিয়ান শুনিয়ে শুনিয়ে রোজ খিদ্দার মাথা খারাপ করে দেয়। আবার বলে কিনা রাখুকে দারোয়ান বলা যাবে না। গেটকিপার বলতে হবে। হুঁঃ, বড়া আয়া ইংলিশ বোলনেওয়ালা। আজ খিদ্দারও সুযোগ এসেছে। ভোলার বোলতি বন্ধ করে দেবে একদম। ভোলার কথা ভাবতে ভাবতে আনমনেই পার্সটা খুলে ফেলেছিল খিদ্দা। আর তারপর ওর নিজেরই বোলতি বন্ধ হবার জোগাড়। ব্যাগের ঠিক মাঝখানের খোপটায় একগোছা গোলাপি রঙের নোট ঠাসাঠাসি করে রাখা। একসঙ্গে এতগুলো টাকা জীবনে কোনোদিন চোখে দেখেনি খিদ্দা। আশপাশে একবার চোখ বুলিয়ে চট করে ব্যাগটা প্যান্টের ভেতরের দিকের ছোট পকেটে চালান করেই হনহন করে ঘরের দিকে পা বাড়ালো ও। খেয়ালই হল না, হাত-পা গুলোয় তিড়তিড় করে কাঁপুনি ধরেছে ওর।

রাস্তার উল্টোদিকে পৌঁছেই মনে হল, ঘরে এতলোকের মাঝখানে টাকাগুলো শান্তিতে গুনতে পারাটা মুশকিল হবে। বাবা-মা, বড় দুই দাদা, ছোট ভাই, বোন সব্বাই প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দেবে। তাছাড়া রাখু, ভোলা, কমলি, পচা সবকটা এখন বস্তিতেই ক্যাচর ক্যাচর করছে। ওদের চোখ বাঁচিয়ে টাকাগুলো হজম করা খিদ্দার কম্ম নয়। শালাদের শকুনের চোখ আর কুত্তার নাক। ঠিক গন্ধ শুঁকে শুঁকে হাজির হয়ে যাবে। মনে মনে ওদের বাপ-বাপান্ত করতে করতে খিদ্দা গঙ্গার দিকে হাঁটতে শুরু করল। এই দিকের ঘাটটা ভাঙা। তাই সচরাচর এরাস্তায় কেউ আসেটাসে না। গঙ্গার ধারে পুরনো বটগাছটার নিচে, ভাঙা বেদিটাতে গুছিয়ে বসে চারদিক ভালো করে দেখে নিল খিদ্দা। না, কেউ কোত্থাও নেই। নিশ্চিন্ত মনে এবার টাকাগুলো ধীরে সুস্থে গুনতে লাগল খিদ্দা। পুরো কুড়িটা গোলাপি পাতা। মানে চল্লিশ হাজার টাকা। অঙ্কটা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে না পেরে দ্বিতীয়বার গুনল। এবার আরও আস্তে, আরো সাবধানে। নাঃ, কোনো ভুল নেই। পুরো চল্লিশ হাজার টাকার মালিক এখন খিদ্দা। সবকটা নোট খুব সাবধানে মুড়ে আবার ছোট পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো ও। ব্যাগের মালিক খোঁজখবর নিতে শুরু করার আগেই টাকাটা নিয়ে কেটে পড়তে হবে। গঙ্গার ঘাট ছেড়ে মেন রোডের দিকের রাস্তাটায় লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করল খিদ্দা। উল্টো দিকের সরু রাস্তা ধরে একটা মেয়ে খুব ধীর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে একটু অদ্ভুত লাগল খিদ্দার। বেশভূষা দেখে তো বেশ বড় ঘরেরই মনে হচ্ছে। কিন্তু চোখদুটোয় কেমন যেন ঘোর লাগা দৃষ্টি। আশপাশের কিছু যেন দেখতেই পাচ্ছে না। সাতসকালে এই ফাঁকা, ভাঙা ঘাটে কী করতে এসেছে কে জানে! বড়লোকেদের কত যে অদ্ভুত রকমসকম থাকে মাইরি!

মেন রোডের দিকে কিছুটা এগিয়েও আবার বস্তির দিকে ফিরতে শুরু করল খিদ্দা। পকেটে এতগুলো টাকা নিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানোর সাহস হচ্ছে না ওর। নিতাইদার সাইকেল সারাইয়ের দোকানের ঘড়িতে দেখল ন'টা বেজে দশ। সকালের হাওয়ার ঠান্ডা ভাবটা কেটে গিয়ে চড়চড়িয়ে রোদ উঠে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে বিল্লার চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। খিদেতে পেটটা চুঁই চুঁই করছে।

—এ বিল্লা, একপ্লেট কচুরি-আলুরদম আর একটা বড় চা দে তো। বলতে বলতেই দোকানের সামনের নড়বড়ে বেঞ্চিটাতে সন্তর্পণে বসল।

—সাতসকালে এত রঙ কীসের রে খিদ্দা? লটারি জিতেছিস নাকি? উনুন থেকে গরম চায়ের কেটলি নামাতে নামাতে কথা ছুঁড়ে দিল বিল্লা।

বিল্লার কথায় মুহূর্তে সতর্ক হয়ে উঠল খিদ্দা। অন্য সময়ে হলে এভাবে আওয়াজ দেওয়ার জন্য বিল্লার সঙ্গে হয়ত ঝামেলা লেগে যেত ওর। কিন্তু এখন মটকা গরম করলে চলবে না। বিল্লার কাছে চায়ের দরুনই হয়তো শ-খানেক টাকা ধার জমা হয়ে গেছে। এদিকে পকেটে ওই চল্লিশ হাজার টাকা ছাড়া আর মাত্র পাঁচ টাকার একটা কয়েন পড়ে আছে। এঃ, বড়লোকি খাবারের অর্ডার দেওয়াটা বড্ড বোকামি হয়ে গেছে। একটু সামলে নিয়ে ও এবার নরম গলায় বলল — এ ভাই, বড্ড খিদে পেয়েছে। আজকের দিনটা দে, কালকেই তোর সব হিসাব চুকতা করে দেব। মাইরি বলছি।

—অ্যাঃ, কোথাকার কোন মায়ের পেটের ভাই এলেন আমার! কবে থেকেই তো শুনে আসছি 'কাল দেব'। সেই কালটা যে কবে আসবে সে শালা উপরওয়ালাও জানে না।

—আব্বে, রাগ করছিস কেন? বললাম তো কাল ঠিক দিয়ে দেব।

—রাগ করিনি। খিদে পেয়েছে, খা। ফালতু টাকা দেখাস না। ঠকাস করে একপ্লেট কচুরি-আলুরদম খিদ্দার সামনে বেঞ্চের উপর নামিয়ে দিল বিল্লা।

বড়রাস্তার মুখেই বিল্লার এই দোকানটায় ভরদুপুর আর মাঝরাত ছাড়া প্রায় সবসময়ই খদ্দেরের আনাগোনা লেগেই থাকে। তাদেরই কেউ কেউ খিদ্দার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে। আড়চোখে সেদিকে একবার দেখে নিয়ে ও খাওয়ায় মনে দিল। বিল্লার দিলটা সাফ কিন্তু মুখটা বহুত কড়ওয়া। কচুরি খেতে খেতে চিন্তা করতে লাগল ও। টাকাটা দিয়ে কী করা যায়? একটা ঝক্কাস দেখতে ফোন কিনলে হয়। রাখুর যেমন আছে!

মা অনেকদিন থেকেই ঘ্যানর ঘ্যানর করছে ঘরের চাল সারাতে হবে। বৃষ্টি হলেই ঘরে জল ঢুকে একহাঁটু হয়ে যায়। দাদারা গ্যারেজে কাজ করে যা টাকা পায় তার বেশিরভাগটাই নিজেদের জন্য খরচা করে। বাবার দোকানের কাজটায় সংসার চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। টাকাটা দিয়ে ঘরের চালটা সারিয়ে নিলে হয়!

বাড়িওলা আরশাদ বুড়োর কাছে সেলামির পাঁচহাজার টাকা এখনও ধার আছে। ওটাও তো দিতে হবে। ছুটকি আর ফেকুর জামার খুব দরকার। কাজের বাড়ি থেকে যে জামাগুলো মাকে দিয়েছিল সেগুলোর একটাও ওদের মাপে হয়নি। সবগুলোই দাদাদের আর বাবার হয়েছে। মায়েরও কিছু জামা কাপড় কিনলে হয়। চটিও লাগবে একজোড়া। নাকি টাকাটা সংসার খরচের জন্য মায়ের হাতেই দিয়ে দেবে? ধুর, তাতেই বা কী লাভ হবে? গুষ্টিসুদ্ধ সব গিলেই তো শেষ করে দেবে। নিকুচি করেছে! এ শালা সংসার না রাক্ষসের হাঁ? খালি প্লেটটা একদিকে সরিয়ে রেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়ল খিদ্দা। হাতটা ধুয়ে সেই জগ থেকেই ঢকঢক করে কিছুটা জল গলায় ঢেলে কিছুটা সরে গিয়ে দোকানের পাশে আগাছা ভরা ফাঁকা জমিতে নেমে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে টানতে লাগল। একটু আগে যে টাকাটা ওর অনেক বলে মনে হচ্ছিল, কাজে লাগাতে গিয়ে সেটাই এখন কম পড়ে যাচ্ছে। অস্থির পায়ে আগাছার ওপরেই খানিক পায়চারি করল ও। এদিক ওদিক দেখে একসময়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল।

ধীরে ধীরে বিল্লার সামনে এগিয়ে গেল খিদ্দা। — বিল্লা, তুই আগেরদিন বলছিলিস না পাশের জমিটা এখনও কেউ ভাড়া নেয়নি? তোর দোকানটা বাড়াবি?

—দোকান বাড়াব? পাগলা নাকি? অত টাকা কোথায়?

—ধর, যদি টাকা পাওয়া যায়? ...মানে আমি যদি জোগাড় করে দিই? ফিফটি ফিফটি পার্টনারশিপ। রাজি?

—টাকা দিবি তুই? বিল্লা প্রথমে অবাক চোখে চেয়ে থাকে। তারপরই হো হো করে হেসে উঠে বলল—শালা, চুরিফুরি করছিস নাকি আজকাল? নাকি সক্কাল সক্কালই টেনে রেখেছিস? বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা উপর দিকে তুলে একটা ইঙ্গিত করল বিল্লা।

স্থির চোখে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে খিদ্দা বলল—তুই ইয়ার-দোস্ত। তারপর এতদিন দোকান চালাচ্ছিস। তোর একটা অভিজ্ঞতা আছে। তাই তোকেই ফাস্টে বললাম। রাজি নোস তো এবার পটলাদার সঙ্গে সরাসরি কথা বলি। ছোটমোট করে হলেও একটা ভাতের হোটেল আমি দেবই এখানে। মা-টাকে আর লোকের বাড়ি কাজ করতে দেবে না। এখানেই রান্না করবে। বাবা-দাদারাও যদি হাত লাগায়...।

—ওই খিদ্দা। তুই সত্যি সত্যিই...? মানে…। বিল্লা এবার কৌতূহলী হয়ে সামনে এগিয়ে এল।

—বললাম তো একবার। কানে শুনতে পাস না? খেঁকিয়ে উঠল খিদ্দা।

—তুই দুপুর নাগাদ একবার আসবি? সকালের এই খদ্দের কটা একটু সামলে নিই। তারপর একসাথে যাব পটলাদার কাছে।

—তুই সাথ দিবি?

—হ্যাঁরে পাগলা। সবাই মিলে ঠিক দাঁড় করিয়ে দেব দোকানটা। দেখিস।

বিল্লার কথায় মনের জোরটা দ্বিগুণ হয়ে গেল খিদ্দার। পটলাদা কাউন্সিলারের ডানহাত, ব্যবসায়ী সমিতির মাথাতেও ওই কাউন্সিলার আর ওদের দলের লোকজন আছে। এদিককার কোনো জায়গায় ব্যবসা করতে গেলে আগে ওখানে থেকে পারমিশন করাতে হবে। খিদ্দার একার পক্ষে ওদের ম্যানেজ করা মুশকিল হত। যতই হোক, নতুন একটা কাজে হাত দিতে যাচ্ছে। এ লাইনে একজন চেনাজানা লোক হাতে থাকলে ভরসা বাড়ে।

।।২।।

ভাঙা বেদিটার উপর বসে একমনে জলের দিকে চেয়ে আছে স্নিগ্ধা। গঙ্গার ধারে এই ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা চোখে-মুখে সাময়িক স্বস্তি দিচ্ছে। গত দুদিন ধরে দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি ও। তবুও এ পোড়া চোখে ঘুমের লেশমাত্র কই? মনের মধ্যে দিনরাত তো তোলপাড় করছে সেই একটাই দৃশ্য। অভি শেষে কিনা এইভাবে…!

প্রায় ছবছরের সম্পর্ক ওদের। সেই কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে প্রথম পরিচয়। ছফুট লম্বা, নিয়মিত শরীরচর্চা করা স্বাস্থ্য, ফর্সা গালে সযত্নে ট্রিম করা দাড়ি, ক্রিকেট ব্যাট হাতে কলেজ ক্যাম্পাসের মাঠে রানের ঝড় তোলা অভি, তখন যেকোন মেয়ের হার্টথ্রব। অথচ সেই অভি ধরা দিল কিনা স্নিগ্ধার মত একটা অতি সাধারণ মেয়ের কাছে। বন্ধুরা বলাবলি করত, না চাইতেই স্নিগ্ধা নাকি হাতে চাঁদ পেয়ে গেছে। সারাদিন বইয়ের ভাঁজে মুখ গুঁজে থাকা স্নিগ্ধার অবশ্য সেসব কথা কানে ঢুকত না। সে তখন ব্যস্ত পড়াশোনা আর প্রজেক্ট নিয়ে। তার ওপর ছিল অভির নানান জুলুমবাজি। আজ পড়া বুঝিয়ে দে, কাল প্রজেক্ট ফাইল রেডি করে দে, পরশু কোনো স্যারের ক্লাস করা হয়নি তার নোটস কপি করে দে। স্নিগ্ধা কোনোদিনই মুখের উপর না বলতে পারত না। আর অভির চোখদুটোর দিকে তাকালে তো আরই দুর্বল হয়ে পড়ে ও। অভিও কি সেটা বুঝতে পেরেছিল? আর তাই ওকে এভাবে...চোখের পাতায় জমে ওঠা বাষ্পরা এতক্ষণে টপ টপ করে ঝরে পড়ল স্নিগ্ধার কোলের ওপর।

ফাইনাল ইয়ারে ক্যাম্পাসিংয়ে একটা এমএনসিতে স্নিগ্ধা রিক্রুটেড হয়েছিল। সেভেন পয়েন্ট ফাইভ পার অ্যানাম। পুনেতে পোস্টিং। সেদিন বিকেলে প্রায় উড়তে উড়তে অভির কাছে পৌঁছেছিল স্নিগ্ধা। খবরটা শুনেই অভির মুখে মেঘ জমল—এবার কী হবে সি? আমি কলকাতায় আর তুই পুনেতে? তুই তো জানিস, আমার কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। যাস না প্লিজ! টানা টানা চোখদুটো তুলে সেই নরম দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ছেলেটা। নিজের ভেতরে মোমের মত একটু একটু করে গলে যাচ্ছিল স্নিগ্ধা।

টানা তিনদিন নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করেছিল ও। কলকাতায় অভিদের তিনপুরুষের পারিবারিক ব্যবসা। ওদের চেন অফ আউটলেটস, 'উদিচি' এখন ফ্যাশন দুনিয়ার ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। ওই বাড়ির ছেলে হয়ে অভির ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসাটা হয়ত নিছক একটা খেয়াল। কিন্তু স্নিগ্ধার তো জীবনের প্রথম পাওয়া চাকরি। ওর এত বছরের স্বপ্ন, এত রাত জাগা কষ্ট, ওর স্কুলটিচার বাবার কতো পরিশ্রমের ফল এই চাকরি ...স্নিগ্ধা ছাড়তে পারেনি সহজে।

পুনেতে যাওয়ার পর থেকে শুরু হল নতুন সমস্যা। সারাদিন অফিসে কাজের চাপ, নতুন শহরে, নতুন পরিবেশে অচেনা মানুষজনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চাপ, অপটু হাতে ঘরের কাজ ম্যানেজ করার চাপ, তারপর রাতে ভিডিও চ্যাটে অভির মান-অভিমান সামলানোর চাপ। এতগুলো চাপের মাঝে জেরবার জীবনে শুধুমাত্র নিজের জন্য সময় বের করা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল ক্রমশ। গভীর রাতে স্নিগ্ধা যখন ভিডিও কলে অন হত, তখন চোখেমুখে একরাশ ক্লান্তি আর মনখারাপ এসে পাশাপাশি বসত। প্রথম প্রথম অভি রাগ করত, ঝগড়া করত। তারপর একটা সময় চুপচাপ হয়ে গেছিল। নিজে থেকে খুব একটা ফোন করত না। স্নিগ্ধা ফোন করলেও দু-চারটে কথা বলার পরেই ছেড়ে দিত। ওই উপেক্ষা সহ্য করে বেশিদিন থাকতে পারেনি স্নিগ্ধা। ঠিক দেড় বছরের মাথায় চাকরিটা ছেড়ে চলে এসেছিল কলকাতায়।

এখন মনে হচ্ছে, কী সাংঘাতিক ভুলটাই না করেছিল সেদিন! নিজের বোকামির জন্য সবচেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে ওর নিজের ওপরই। আজ যদি ওর চাকরিটা থাকতে, অভি সুযোগই পেত না ওকে এভাবে অপমান করার। স্নিগ্ধা কলকাতায় চলে আসার পর থেকেই মার্কেটের অবস্থা দিনদিন খারাপ হচ্ছিল। মাস কয়েকের মধ্যেই রিসেশন নামের দৈত্যটা এসে পুরো বাজারটাই খেয়ে ফেলল। এই অবস্থায় নতুন চাকরি খুঁজে বের করা, খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার থেকেও কঠিন। তবুও স্নিগ্ধা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অভি ওর এই চেষ্টার দাম দিল কোথায়!

স্নিগ্ধা কলকাতায় আসার পর থেকেই অভি কেমন যেন দূরে দূরে থাকছিল। স্নিগ্ধা তখনও বুঝতে পারেনি। নাকি চায়নি? ছেলেটার অভিমান হয়েছে ভেবে আরও বেশি করে সময় দিতে চেয়েছে সম্পর্কটায়। গত সপ্তাহে অভি নিজেই জানাল সবকথা।

সাদার্ন অ্যাভিনিউ-এর যেদিকটা কালীঘাট মেট্রো স্টেশনের দিকে চলে গেছে, সেখানেই একটা গলির মুখে বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল স্নিগ্ধা। বিকেলের পড়ে আসা আলো আর পশ্চিমের আকাশের ঘনিয়ে আসা কালো মেঘ দুইয়ে মিলে মায়াবী করে তুলেছিল সময়টা। ঝরে পড়া ফুলে লাল হয়ে যাওয়া রাস্তাটা দেখে স্নিগ্ধার ভীষণ ইচ্ছে করছিল অভির হাত ধরে ওই রাস্তায় হেঁটে যেতে। ঠিক তখনই লেটেস্ট কেনা বাইকটা চেপে অভি সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। মুহূর্তে স্নিগ্ধার চোখ চলে গেছিল অভির পেছনে বসা ব্লু জিন্স আর হলুদ টপ পরা, গোল্ডেন ব্লন্ডেড লম্বা চুলের সুন্দরী মেয়েটার দিকে। অভি নেমে এসে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ওদের—মিট মাই ফিয়ঁসে তিতির। অ্যান্ড দিস ইজ মাই এক্স স্নিগ্ধা। তিতির নামের মেয়েটা ভদ্রতাসূচক দুএকটা কথা বলেই ফোন কানে নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে অন্য দিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অভি তখন এগিয়ে এসেছিল স্নিগ্ধার দিকে। স্নিগ্ধার খুব কাছে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলেছিল—তুই ঠিকই বলেছিলিস সি। ভেবে দেখলাম, তোর আর আমার মধ্যে অনেক ডিফারেন্স। সে সোশ্যালি বল বা ইকনমিক্যালি। উই কুড নট মেক আ ম্যাচ। বেটার উই শ্যুড ওয়াক অন আয়র ওন পাথ। বেস্ট অফ লাক ফর ইয়র ফিউচার অ্যান্ড অল। টেক কেয়ার। বাই।

সেই মুহূর্তে স্নিগ্ধা বোধহয় বোবা হয়ে গেছিল। নাহলে ওর তো তখন চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছিল—এই কথাগুলো তোকে আমি কবে বলেছি, অভি? তোর কথা, তোর ইচ্ছেগুলো তুই আমার নামে চালাচ্ছিস কেন? কেন? আমার স্ট্যাটাস কি তুই আজ প্রথম জানলি?..." আরো কত কিছুই হয়ত বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু একটা আওয়াজও ওর গলা দিয়ে বেরোয়নি।ওর চোখের সামনে দিয়ে সেই ফুলে ঢাকা লাল রাস্তাটা ধরে ওরা দুজনে বাইকে চেপে চলে গেছিল।

সেদিনের পর থেকে প্রথম কদিন সবসময় খুব কষ্ট হত। কষ্টের চোটে মাঝে মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসত। তারপর একদিন সবকিছু কেমন বেবাক ফাঁকা হয়ে গেল ওর। মনে হতে লাগল, বেঁচে থাকার মতো কী আছে ওর জীবনে? চাকরি নেই, অভি নেই, নর্থবেঙ্গলের বাড়িতে ফিরে গিয়ে সবার সামনে দাঁড়ানোর সাহসটুকুও আর অবশিষ্ট নেই ওর। তারচেয়ে এই নদীটাই ভালো। কেমন বয়ে চলেছে সারাজীবন ধরে। ওকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাক এভাবে অনন্তকাল ধরে। বেদিটা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও। এই গঙ্গার ঘাটটা একদম শুনশান। আস্তে আস্তে জলে নেমে গেলে কেউ দেখতেও পাবে না। গুটি গুটি পায়ে জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল স্নিগ্ধা। তখনই পায়ের নিচে কী যেন চাপা পড়ল। স্নিগ্ধা নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিল জিনিসটা। একটা রংচটা, পুরনো পার্স। ব্যাগটা বেশ ফুলে আছে। কৌতূহলে পার্সটা খুলে ভেতরে চোখ রাখল ও। দুহাজারের নোটে ঠাসা রয়েছে ব্যাগটা। হতভম্ব স্নিগ্ধা আশপাশে তাকাল। কেউ কোত্থাও নেই। পার্সের অন্য খোপগুলো ফাঁক করে দেখতে গেল ও। যদি ব্যাগের মালিকের কোনও কন্ট্যাক্ট নম্বর বা কার্ড-টার্ড পাওয়া যায়। কিন্তু টাকার চাপে অন্য খোপগুলো খোলাই যাচ্ছে না। স্নিগ্ধা আবার ফিরে গিয়ে ওই বেদিটার ওপর বসল। কিছু টাকা বের করে নিয়ে ব্যাগের অন্য খোপগুলো ফাঁক করে দেখল। কোথাও কোনো কাগজপত্র নেই। আশ্চর্য তো! এতগুলো টাকা সুদ্ধ ব্যাগটা কার খোয়া গেল? চিন্তায় ভ্রুদুটো কুঁচকে গেল স্নিগ্ধার। সবটাকাগুলো বের করে গুনতে শুরু করল ও। সাড়ে তিন লাখ। এত টাকা এভাবে পার্সে নিয়ে কেউ ঘোরে নাকি আজকাল? সঙ্গে কোনও কাগজপত্রও নেই। এখন এর মালিককে খুঁজে বের করাই তো দুঃসাধ্য হয়ে যাবে। আচ্ছা, এক কাজ করলে তো হয়। ও যদি পার্সটা লোকাল থানায় জমা করে দেয়? যার জিনিস হারিয়েছে সে নিশ্চয়ই থানায় গিয়েই খোঁজ করবে। আইডিয়াটা মনে ধরল স্নিগ্ধার। উঠে দাঁড়িয়ে, পার্সটা জিন্সের পকেটে গুঁজে, নদীর উল্টোমুখে রাস্তাটার দিকে হাঁটতে শুরু করল ও।

কিছুদূর গিয়েই অন্য একটা কথা মনে হতে দাঁড়িয়ে পড়ল স্নিগ্ধা। আচ্ছা, পার্সে তো কোনও নামঠিকানা লেখা নেই। পুলিশ কি আদৌ জিনিসটা আসল মালিকের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে? আদৌ যদি কেউ খোঁজ করতে না আসে? পুলিশ কি উপযাচক হয়ে এই পার্সের মালিককে খুঁজবে? প্রশ্নগুলোর উত্তরে স্নিগ্ধার মনে শুধু না, না, না-ই শোনা যাচ্ছিল।

নানান সম্ভাবনার কথা চিন্তা করতে করতে আনমনেই একটা বাসে উঠে পড়ল ও। বেশ কিছুক্ষণ পরে বাসটা দাঁড়িয়ে পড়তেই ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। সামনে তাকিয়ে নেতাজি মূর্তিটার দিকে চোখ পড়তেই সমে ফিরল। এইরে, শ্যামবাজার মোড়ে কী করতে এলো ও? আবার কিছুটা উজান যেতে হবে। বাস থেকে নামার কথা ভাবতেই মনে পড়ল ওর পকেটে ওই পার্সটা ছাড়া এই মুহূর্তে একটা টাকাও নেই। ততক্ষণে সিগন্যালে সবুজ আলো জ্বলে উঠেছে। বাসটাও ২৭০ডিগ্রি ঘুরে ভুপেন বোস অ্যাভিনিউতে ঢুকে পড়েছে। স্নিগ্ধা চট করে সিট ছেড়ে কন্ডাক্টরের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল—এটা দমদমপার্ক যাবে না? কন্ডাক্টর বিরক্তি মেশানো দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে টিং টিং করে ঘণ্টা বাজিয়ে বাস থামিয়ে স্নিগ্ধাকে নামিয়ে দিল। ধীরেসুস্থে রাস্তা পেরিয়ে হাল্কা পায়ে হেঁটে রাজচন্দ্রপুরের দিকের রাস্তাটায় ঢুকে পড়ল স্নিগ্ধা। নিজের মনেই কিছুটা হাসল ও। দমদমপার্কে ওর বাড়ি নয়। তিনকুলে কেউ থাকেও না। শুধুমাত্র সঙ্গে খুচরো টাকা না থাকায় কন্ডাকটরকে বোকা বানানোর জন্য ভুল জায়গার নাম বলেছিল ও। ওর বাড়ি তো আসলে টালাপার্কের পেছনদিকে। না, আসলে বাড়ি নয়। ওটা ওর কলকাতার ঠাঁই। বাড়ির কথায় হঠাৎই বড্ড মন খারাপ হল ওর। ও মরে গেলে বাবা-মা-বোন সবারই তো অনেক কষ্ট হবে। আচ্ছা, অভিরও কি কষ্ট হবে? মনে তো হয় না। অভির কথা মনে পড়তে নিজের অজান্তেই মুখ বেঁকাল স্নিগ্ধা। এখান থেকে বড়জোর মিনিট পনেরো হাঁটলেই বাড়ি পৌঁছে যাবে ও। তিরতির করে একটা সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া বইছে। এখনও রোদ্দুর ওঠেনি সেভাবে। এই ফাঁকা ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে ওর। সামনের ওই পার্কটাকে বাঁদিকে রেখে এঁকেবেকে রাস্তাটা গিয়ে সেই বাগবাজারেই উঠেছে। ওখান থেকে ডানদিকে ঘুরে বি টি রোডটা পেরিয়ে গেলেই নিজের পাড়ায় ঢুকে পড়বে ও। আচ্ছা, এই টাকাগুলো দিয়ে একটা স্টার্ট আপ চালু করলে তো হয়। মরে যাওয়ার আগে অন্তত একটা চেষ্টা করতে তো কোনও ক্ষতি নেই। বিশেষত হঠাৎই যখন এতগুলো টাকা নিজে থেকেই হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিল। কিন্তু অন্যের টাকা এভাবে নেওয়াটা কি ঠিক হবে? ছোটো থেকেই তো শিখে এসেছে, 'না বলিয়া পরের দ্রব্য গ্রহণ করাকে চুরি করা বলে', 'পরের জিনিস আত্মসাৎ করা পাপ', এই ধরনের কিছু কথা। তবে এই ব্যাপারটা আদৌ কি চুরি বা পাপের পর্যায়ে পড়ে? ও তো জানেই না এই পার্সটার আসল মালিক কে? কিছুক্ষণ নিজের মনের সঙ্গে লড়াই চালানোর পড়ে স্নিগ্ধা একটা সিদ্ধান্ত নিল। আপাতত টাকাগুলো ওর কাছেই রাখবে। যদি কখনও এর আসল মালিকের খোঁজ পাওয়া যায় তখন অবশ্যই ফিরিয়ে দেবে। কথাটা মনে হতেই আত্মহত্যার পরিকল্পনাটা আপাতত স্থগিত রাখল ও। আর ঠিক তখনই ওর খেয়াল হল, অনেকক্ষণ থেকে একটা লোক যেন ঠিক ওর পিছু-পিছুই আসছে। লোকটা কি ওকে ফলো করছে? কিন্তু কেন? তাও এই সাতসকালে? সন্দেহটা পরীক্ষা করার জন্যই একটু জোরে পা চালাল ও। লোকটার হাঁটার গতিতে কোনও পার্থক্য হল কিনা ঠিক বুঝতে পারল না। তবুও সাবধানী হতে গিয়ে একটা কাজ করল ও। চট করে একটু এগিয়ে রাস্তার মোড়টা ঘুরেই খুব সতর্কতার সঙ্গে ব্যাগের টাকাগুলো নিজের জিন্সের হিডেন পকেটে চালান করে ব্যাগটা রাস্তার ধারে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর হনহন করে এগিয়ে গেল বড় রাস্তার দিকে।

।।৩।।

সদ্য ঘুমভাঙা চোখে মেয়েটাকে দেখে একটু থতমত খেয়েছিল পার্থ। বছর পঁচিশের একটা স্মার্ট, ঝকঝকে মেয়ে। প্রায় দৌড়োনোর ভঙ্গিতে মেন রোডের দিকে এগিয়ে গেল। ওপরের এই বারান্দা থেকে একঝলক দেখে যদিও সবকিছু স্পষ্ট বোঝা যায় না সবসময়, তবে একে দেখে তো এপাড়ার নয় বলেই মনে হচ্ছে। যাওয়ার সময় মেয়েটা কী যেন একটা ছুঁড়ে দিল রাস্তার ওপাশের ঝোপটায়।…

ব্যাস, এটুকুই আপাতত লেখা হয়েছে। এরপরেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কখন। চায়ের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে আবার লিখতে শুরু করলাম পরের অংশটা।

… পার্থ খুব সাবধানে রেলিঙের ওপর আরও একটু ঝুঁকে পড়ে ওপাশের ঝোপটা একবার দেখার চেষ্টা করল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আসলে এই বাড়িটার ঠিক সামনেই রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে। রাস্তার ওপাশটা তাই এখান থেকে দেখা যায় না। বিরক্ত পার্থ আরও একবার বিড় বিড় করে নিজের স্বর্গীয় বাবার আদ্যশ্রাদ্ধ করতে যাচ্ছিল, তখনই একটা লোককে মেয়েটার পেছনে আসতে দেখে থমকে দাঁড়াল। লোকটা ঠিক এই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝুঁকে পড়ে ওপাশের ঝোপের ধার থেকে কিছু একটা কুড়িয়ে নিল। তারপর এই বাড়ির কোণের দিকে সরে এসে খুব সাবধানে খুলে ফেলল মুঠোটা। পার্থ আরও একটু ঝুঁকে দাঁড়াল। আরিব্বাস! লোকটার দুহাতের তালুর মধ্যে একটা টাকা ভরা মানিব্যাগ। কিন্তু মেয়েটা এতগুলো টাকা হঠাৎ ঝোপের ধারে ফেলে গেল কেন? কেসটা একটু কাল্টিভেট করতে হচ্ছে তো! হাত বাড়িয়ে খাটের ছত্রিতে রাখা দিন সাতেকের না-কাচা কালো টি-শার্টটা টেনে নিয়ে তাতে মাথা গলাতে গলাতে নড়বড়ে ভাঙা সিঁড়িটা দিয়ে নিচে নেমে গেল পার্থ। এই রাস্তাটুকু পেরিয়ে যাওয়ার আগেই লোকটার নাগাল পেতে হবে। নিচে নেমে অবশ্য লোকটাকে দেখতে পেল না ও। তবে কি মালটা টুক করে বড় রাস্তার দিকে সটকে গেল? তা হলেই তো চিত্তির। বড় রাস্তার ওপরে এখন অনেক লোকজন। লোকটাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। ডানদিকে বাগবাজার স্ট্রিটের দিকে ঘুরতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল পার্থ। রমেনদা বলে, যে কোনও কাজ করার আগে ঠিকঠাক চিন্তা করাটাই আসল খেলা। স্থানীয় কাউন্সিলর রমেন দত্ত পার্থর রাজনৈতিক গুরু। পার্থর বাবা তপন রায় এই রমেন দত্ত লোকটাকে দুচক্ষে দেখতে পারত না। পার্থকে খালি জ্ঞান দিত — রমেন দত্ত আর তার দলবল পার্টি-পলিটিক্সের নামে গুন্ডামি করে বেড়ায়। রায়বাড়ির একটা প্রেস্টিজ আছে। এবাড়ির ছেলে হয়ে ওই ছোটলোকদের দলে ভিড়ো না পার্থ। হুঁঃ, প্রেস্টিজ মাই ফুট। ওই রকম ভাঙাচোরা শরিকি বাড়িতে, কপালজোরে পাওয়া দেড়খানা ঘরে সারাজীবন বাস করল আর প্রেস্টিজ ধুয়ে খেল যে লোক, তার ফালতু বুকনিতে কান দিতে পার্থর বয়ে গেছে। ওর এখন অনেক টাকা চাই, পাওয়ার চাই, একটা সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাট চাই, দামি বাইক, ঘড়ি, জুতো, সুন্দরী বউ... এককথায় একটা ঝাঁ চকচকে জীবন চাই। ওর মতো একটা পাতি পাস-গ্র্যাজুয়েটের কাছে এই সবকিছু একসাথে পাওয়ার সহজ রাস্তার নামই এখন রমেন দত্ত। রমেনদাই তো ওদের শিখিয়েছে, সবসময় চোখকান খোলা রাখতে। আর তাই তো আজ সক্কাল সক্কাল এমন একটা লটারি লেগে গেল কপালে। কিন্তু লোকটা গেল কোনদিকে? পার্থ একটু ভেবে দেখল। মেয়েটা গেল ডানহাতে বাগবাজার স্ট্রিটের দিকে। অতগুলো টাকা হাতে পেয়ে লোকটা নিশ্চয়ই ওই মেয়ের পেছনে আর যাবে না। সুতরাং নিশ্চিন্ত মনে পার্থ বাঁদিকের রাস্তাটা ধরল। সুবলটাকে একবার ডেকে নিতে হবে। দুজনে একসাথে থাকলে লোকটা বেগড়বাই করার সাহস পাবে না।

।।৪।।

ট্রেনটা হাওড়াতে যখন ঢুকল তখন সবে ভোরের আলো ফুটেছে। দেখে বেশ অবাক হয়েছিল সুগত। দূরপাল্লার ট্রেন লেট করবে এটাই যেন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে নির্ধারিত সময়ের ১ঘণ্টা আগেই ট্রেন স্টেশনে ঢুকে পড়লে অবাক হওয়ারই কথা। স্টেশন চত্বর ছেড়ে বাইরে বেরোতেই হাওড়া-ডানলপ রুটের একটা ফাঁকা বাসও পেয়ে গেল ও। মনে মনে ভাবল, সাত সকালেই বাড়িতে পৌঁছে বেশ চমকে দেওয়া যাবে সবাইকে। ওকে এভাবে আচমকা দেখে দিয়ার মুখের অবস্থাটা কী হবে ভেবেই আনন্দ হল সুগতর। কাল সন্ধ্যেতেও দিয়া যখন ফোন করেছিল, এসি টু-টিয়ারের নিঃশব্দ কামরায় বসে নিচু গলায় সুগত বলেছিল—একটা মিটিং চলছে। একটু পরে কল করছি। তারপর আর ইচ্ছে করেই ফোন করেনি। দিয়া বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে পারে না। তাই রাতের দিকে ঘুরিয়ে ফোন করার আর চান্স ছিল না। প্রায় চারমাস পড়ে বাড়ি ফিরছে ও। বিয়ের পর থেকে এই প্রথম দিয়াকে ছেড়ে এতদিন আলাদা থাকা। হায়দ্রাবাদে নতুন অফিসে বদলি হওয়ার পরে দম ফেলার ফুরসত ছিল না এই ক'মাস। এদিকে দিয়ারও অফিসে সেভাবে ছুটি মিলছিল না। আজ যখন সুযোগ এসেছে, একেবারে সামনে হাজির হয়ে সারপ্রাইজই দেবে দিয়াকে। বাসটা কিছুদূর এগোতেই টুকটুক করে সবকটা সিট ভর্তি হয়ে গেল। বেশিরভাগই কলেজের মেয়ে। কিছু আধাঘুমন্ত স্কুলের বাচ্ছাও আছে, বাবা কিম্বা মায়ের সাথে। বাচ্ছাগুলোকে দেখে ওর মায়া লাগল। আহারে, অতটুকু মানুষ, স্কুল ড্রেস-বইয়ের ব্যাগ-জলের বোতলে যেন একটা সাজানো পুতুল। সাত সকালে বাসে উঠেই বাবা-মায়ের কাঁধে মাথা রেখে আবার ঘুমের দেশে। কেন যে এত ছোট বয়সে বাবামায়েরা এদের স্কুলে পাঠায়! সেই মুহূর্তেই সুগত স্থির করে ফেলল ওর ছেলে-মেয়ে যাই হোক, এত ছোটো বয়সে স্কুল, নৈব নৈব চ।

বাসটা মনীন্দ্র কলেজের সামনে পৌঁছতেই হইহই করতে করতে মেয়েদের দলটা নেমে গেল। সুগতও সিট ছেড়ে এগিয়ে গেল গেটের দিকে। কলেজ ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে বাঁদিকের রাস্তাটায় ঢুকে পড়ল ও। এই ভেতরের রাস্তা দিয়ে একটু হেঁটে গেলে শর্টকাট হয়। অনেকদিন পরে নিজের শহরে, নিজের পাড়ায় হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে ওর। পাড়ার ভেতরে এখনও সেভাবে মানুষের জেগে ওঠার লক্ষণ নেই। সকালের হাল্কা ঠান্ডা পরিবেশে চারদিকের নিস্তব্ধতা একটা ভালোলাগার আবেশ তৈরি করেছে। হাত পাঁচ-ছয় দূরে একটা মেয়ে ধীর গতিতে হাঁটছে। হাঁটার ছন্দ দেখে মনে হচ্ছে, মেয়েটা নিজের মনে কিছু একটা চিন্তা করছে। মানুষ যখন হাঁটতে হাঁটতে কোনও চিন্তায় ডুবে যায়, তখন তার হাঁটার ছন্দটা এমন একমাত্রিক হয়ে যায়। সুগতও নিজের মনে হাঁটতে লাগল। পার্কটাকে বেড় দিয়ে কিছুটা এগোনোর পরেই সামনের মেয়েটা আচমকা হনহন করে হাঁটতে শুরু করল। সুগতর একটু অদ্ভুত লাগল। ও মেয়েটার দিকে নজর রেখে এগোতে লাগল। পরের মোড়টার কাছে পৌঁছেই মেয়েটা ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে সামনে এগিয়ে ভাঙা বাড়িটার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওই ভাঙা বাড়িটার সামনেই রাস্তাটা বেঁকে গিয়ে মোড় তৈরি করেছে। সুগতর এবার খটকা লাগল। একটু পা চালিয়েই এগিয়ে গেল ও। রাস্তার ওপাশে ঝোপের মধ্যে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলে হনহন করে এগিয়ে গেল মেয়েটা। কী ফেলে গেল ওটা? সুগত এগিয়ে গেল ওদিকে।

মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে হতবুদ্ধির মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সুগত। এত টাকা এভাবে অবলীলায় ঝোপের মধ্যে কেউ ফেলে দিতে পারে নাকি? পর মুহূর্তেই মনে হল, টাকাগুলো নকল নয় তো? কিন্তু তাহলেই বা এভাবে ফেলে যাবে কেন? ব্যাগটা হাতে নিয়েই মেয়েটার পেছনে দৌড় লাগাল সুগত। খানিকটা দৌড়ে গিয়ে মেন রোডে ওঠার পরেও মেয়েটাকে আর দেখতে পেল না ও। ব্যাগটা উল্টে-পাল্টে ভেতরের দিকের খোপগুলো ঘেঁটেও কোনও নামঠিকানা না পেয়ে সুগত স্থির করল ব্যাগটা পুলিশ স্টেশনেই জমা করে দেবে। এতগুলো টাকা, তাও আসল না নকল ভগবানই জানে, এ জিনিস সঙ্গে রাখা মানে নিজের বিপদ বাড়ানো। এই জায়গাটা থেকে শ্যামপুকুর থানাটাই কাছে হবে। সুগত তাই এখন থেকে ইউ টার্ন নিয়ে আবার সেই পাড়ার ভেতরের রাস্তাটাই ধরল।

ভাঙা বাড়িটা পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে ওই পার্কটার কাছে পৌঁছতেই বাঁদিকের একটা সরু গলি থেকে দুটো ছেলে বেরিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়াল। কালো টি-শার্ট পরা একটা ছেলে এগিয়ে এসে বলল—এই তো চাঁদু। এতক্ষণ কোথায় হাওয়া খাচ্ছিলে? তাড়াতাড়ি মালটা হ্যান্ডওভার করো দিকি। তারপর এখান থেকে সোওজা ফুটে যাও। ছেলেটার কথা বলার ধরনটা বিশ্রী লাগল সুগতর। সাতসকালে পাড়ার মধ্যে এভাবে গুন্ডামিটা বরদাস্ত করতে পারল না ও। চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল—কীসের কথা বলছেন বলুন তো? আপনাদের বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি তো আপনাদের ঠিক চিনতে পারলাম না...। অন্য ছেলেটা এবার তেড়ে এল—ওসব চেনা-চিনি করতে যেও না, মামা। কেস পুরো বিলা হয়ে যাবে। তার চেয়ে ভালোয় ভালোয় মালটা ছাড়ো। এইমাত্র যেটা ওই রাস্তার পাশ থেকে টুক করে তুলে নিলে সেটা সোনা ছেলের মত আমাদের ফেরত দাও। ছোটবেলায় কেউ শেখায়নি, পরের জিনিস গাপ করতে নেই?

সুগত ঠিক করল, এত সহজে এদের কাছে মাথা নোয়াবে না। হেসে জিজ্ঞেস করল — জিনিসটা আপনাদের বুঝি? কালো টিশার্ট বলল — হুম। ওটা আমার। হাত ফস্কে পড়ে গেছিল ওপরের বারান্দা থেকে। এখন ফেরত দিন।

—বেশ তো। আমি ওটা নিয়ে শ্যামপুকুর থানাতে জমা দিতেই যাচ্ছিলাম। আপনিও নাহয় সঙ্গে চলুন। ওখানে আপনার পরিচয় দিয়ে জিনিসটা ফেরত নিয়ে নেবেন।

কালো টিশার্ট এবার হিসহিস করে উঠল—শালা, মাজাকি হচ্ছে? পার্থ রায়ের সঙ্গে মাজাকি? এই, সুব্লা, ধর তো চেপে মালটাকে। শালা সাতসকালে হাত গন্দা না করিয়ে ছাড়বে না। কথাগুলো বলতে বলতেই ওরা দুজনে মিলে ওই সরু গলির ভেতরের দেওয়ালে চেপে ধরল সুগতকে। সুগত হাতটুকু নাড়ানোর সুযোগও পেল না। তার আগেই ছেলেদুটো ওকে পিছমোড়া করে চেপে ধরে ওর পকেট আর পিঠের ব্যাগটা হাতড়াতে শুরু করল। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না। মানিব্যাগটা সুগতর প্যান্টের ডান পকেটেই ছিল। ছেলেদুটো ওটা হাতে পেয়ে যেতে সুগতর মনে মনে খুব আফসোস হচ্ছিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই ওই কালো টিশার্টের গলায় চাপা হুংকার শুনে ওর নিজের গলা শুকিয়ে গেল। ছেলেটা বলল—যাহ্‌শশালা, পার্স তো পুরো খালি! এইটুকু টাইমের মধ্যে মাল কোথায় পাচার করল রে? এই সুব্লা, ভালো করে খোঁজ তো। রাগের চোটে মানিব্যাগটা রাস্তার ওপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল ছেলেটা। কৌতূহল চাপতে না পেরে সুগত ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখতে গেল। তাতে কালো টিশার্টের রদ্দা এসে পড়ল ওর ঘাড়ে আর পিঠে। মেরুদণ্ড বরাবর তীব্র কথায় কঁকিয়ে উঠল ও। আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কিছু না পেয়ে দুজনেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। দমাদ্দম কিল-লাথি-ঘুসির সঙ্গে অকথ্য গালিগালাজ চলল কিছুক্ষণ। তারপর ওভাবেই ওকে ফেলে রেখে চলে গেল ওরা। চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগের মুহূর্তেও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সুগত ভাবছিল—টাকাগুলো তবে গেল কোথায়?

কিছুক্ষণ পরে, গলির ভেতরের বাড়িটার লোকজন রাস্তায় বেরোতে গিয়ে সুগতকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে থানায় খবর দিল। পুলিশ এল অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে। ওরা সুগতকে নিয়ে গেল, সঙ্গে ওর যাবতীয় জিনিসপত্র। পাড়ার ভেতরে সাতসকালে এমন কাণ্ড ঘটেছে, তাই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ টুকরো টুকরো আলোচনা চলল। তারপর বেলা গড়ালে যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

দুপুরের দিকে একটা ভবঘুরে রোজ এসে পার্কের বেঞ্চে শুয়ে থাকে। এই পার্কটার বেঞ্চগুলো বেশ ভাল। সিমেন্ট বাঁধানো, মাথায় ছাউনি ঢালা। দুপুরের রোদটুকু থেকে মাথা বাঁচানোর বেশ মোক্ষম জায়গা। আজও লোকটা শুয়েই পড়েছিল। হঠাৎই চোখ গেল হাতদুয়েক দূরে একটা মানিব্যাগের দিকে। একটু ছেঁড়া ছেঁড়া, পুরনো একটা ব্যাগ। লোকটা সোজা হয়ে উঠে বসল। কী ভেবে এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা তুলে নিল নিচু হয়ে। তারপর ভেতরটায় চোখ বুলিয়েই লোকটার চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। লোকটা হঠাৎ দুহাত ওপরে তুলে নিজের পায়ের ওপর বার দুয়েক চরকি পাক খেয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নেচে নিল। তারপর দুহাত জড়ো করে আকাশ পানে কাকে যেন নমস্কার করতে লাগল।

*****

গল্পটা শেষ করে বার দুয়েক নিজে পড়ে নিলাম। এটা আমার একটা মানসিক খুঁত বলতে পারেন। বানান, শব্দের গঠন, দাঁড়ি, কমা, টাইপো সবকিছু একাধিকবার খুঁটিয়ে না দেখে লেখা মেল করতে কেমন যেন মন খুঁতখুঁত করে। গল্পের নাম দিলাম "মানিব্যাগ"। এই মুহূর্তে এছাড়া অন্য কোনও নাম মাথায় আসছিল না। সবকিছু মিটিয়ে মেলটা "সেন্ড" করে চেয়ার ছেড়ে উঠলাম যখন, বাইরে কাক আর বিভিন্ন পাখির ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে। আমার এই ফ্ল্যাটবাড়ির থেকে একটু দূরেই একটা মসজিদ আছে। সেখানে ভোরের আজান শুরু হয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি পৌনে পাঁচটা বাজে। নাঃ, এখন আর শুয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে চোখে-মুখে জল দিয়ে একটু ফ্রেশ হলে বরং বেশি ভালো লাগবে। প্রায় চারমাস পরে সাতদিনের জন্য একটা ছুটি ম্যানেজ করা গেছে। আজ রাতের ট্রেনে কলকাতা ফিরব। সেই আনন্দেই মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। এখন আর শুলে ঘুম আসবেও না।

ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে পড়লাম। চোখে মুখে জল দিয়ে একটু খোলা হাওয়ার জন্য বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দিনের এই সময়টা আমার সবচেয়ে প্রিয়। বেশ শান্ত, স্নিগ্ধ রূপে প্রকৃতিকে পাওয়া যায়। বারান্দার সুদৃশ্য রেলিঙে হাতের ভর দিয়ে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালাম। আমাদের এই ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে বেশ চওড়া রাস্তা। সারাদিন লোকজনের কোলাহলে মুখরিত হয়ে থাকে। এখন কী সুন্দর নিস্তব্ধ চারদিক। রাস্তার উল্টোদিকেই উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা দামি আবাসন। আবাসনের পাঁচিল ঘেঁষেই নোংরার ঢিপি জমেছে। ইস, কী অবস্থা! মিউনিসিপ্যালিটি কি আজকাল কাজ করা ছেড়েই দিয়েছে? আর মানুষেরও আক্কেল বলিহারি! রাস্তার ধারে এইভাবে কেউ ময়লা ফেলে? বিশেষত, জায়গাটার পাশেই যখন একটা কল লাগানো রয়েছে। ওই নোংরা জায়গায় দাঁড়িয়ে কেউ কলটা ব্যবহার করতে পারবে? আমার ভাবনার মধ্যেই দেখি, একটা বছর কুড়ির ছেলে এগিয়ে গেল ওই কলের কাছে। ছেলেটার পোশাকআশাক দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ নিম্নবিত্ত ঘরের। ছেলেটা ওইখানে দাঁড়িয়েই বেশ পরিপাটি করে মুখ ধুলো। তারপর ফিরে যাওয়ার ঠিক আগেই এগিয়ে গেল ওই ময়লার স্তূপের দিকে। এটা-ওটা সরিয়ে শেষে হাতে তুলে নিল একটা ছেঁড়াখোঁড়া মানিব্যাগ। ব্যাগটা দু আঙ্গুলে ফাঁক করে দেখেই আশপাশে একবার তাকাল। তারপর ব্যাগটা ওর প্যান্টের কোমরের কাছে কোনও পকেটে পুরে হনহন করে চলে গেল অন্য দিকে। খেয়াল করিনি, এরই মধ্যে কখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি। নিজের অজান্তেই চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে আসছে আমার। গলা শুকিয়ে কাঠ। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? কিন্তু সেটা তো একেবারেই অসম্ভব। তবে কি যশের লোভে নিজেকেই এভাবে শেষ করে ফেললাম? একটু আগে নিজের হাতেই লিখে দিলাম আমার মৃত্যুপরোয়ানা? সুগতর চরিত্রটা যে আমার ব্যক্তিজীবনের আধারেই…না না না, এভাবে মৃত্যু আমি চাই না। কিছুতেই না। কিন্তু ভবিতব্যকে আটকাব কীকরে? সমস্ত শরীর জুড়ে তিরতির করে কাঁপুনি শুরু হয়েছে। আমি কিছুতেই এই কাঁপুনি থামাতে পারছি না।

**************




(পরবাস-৮২, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)