Subscribe to Magazines



পরবাসে দিবাকর ভট্টাচার্যের
আরো লেখা




ISSN 1563-8685




শাশ্বত মানসযাত্রী হংসে

"সৃষ্টি করতে হবে আমায়—ছবিতে—কবিতায়—কিংবা সুরে যা কেউ কখনো রচনা করতে পারেনি—তাই করতে হবে আমায়—ঈশ্বরের সৃষ্টির মতো যা কিনা চিরন্তন, শাশ্বত—নয়তো এ পৃথিবীতে আমার আসার কোনো অর্থ নেই—"

এই কথাগুলো নিজের মনে নিজেকে অসংখ্য বার বলতেন তিনি।


অল্প বয়স থেকেই তিনি ছিলেন এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ। জন্মগত প্রতিভা ছিল বহু বিষয়ে। সুন্দর আঁকতে পারতেন। লিখতে পারতেন চমৎকার কবিতা। গানের গলাও ছিল সহজাত । যুবাবয়সেই এত সব গুণের অধিকারী হয়েও তিনি ভবিষ্যতের লক্ষ্যে যেন স্থির হতে পারছিলেন না। এই অস্থিরতা ছিল তার চরিত্রের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য।

এই অস্থিরতার মধ্যেই তিনি একদিন বসে পড়লেন রং-তুলি নিয়ে। আঁকতে লাগলেন একের পর এক ছবি। বিরাট সমুদ্রের সাথে আকাশের দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া, গভীর অরণ্যের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ, ভোরের আলোয় ঝলমলে প্রকাণ্ড অট্টালিকা—এইসব দৃশ্যগুলো নিজের কল্পনায় ভাসিয়ে এঁকে যেতে লাগলেন একটা একটা করে। তারপর শুরু করলেন মুখচিত্র অর্থাৎ প্রতিকৃতি আঁকতে। সেও তার কল্পনার রেখায় আর রঙে। হাস্যময়ী মোহিনী রমণী, অশীতিপর ক্লান্তমুখ বৃদ্ধ, অবাকদৃষ্টি শিশু, এমনি তাঁর নিজেরও কয়েকটি আত্মপ্রতিকৃতি তিনি এঁকে ফেললেন যেন এক আশ্চর্য উন্মাদনায়।

কিন্তু কোনোটাই তাঁর মনের মতো হল না। মনে হল ছবিগুলো যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে বলছে—"আমরা কি সত্যিই এরকম দেখতে?" এমনকি তাঁর নিজের মুখের ছবিটাও যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে উপহাস করছে বলে মনে হল তাঁর। মাথা নীচু করে ছবিগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে তিনি বসে পড়লেন ঘরের এক কোণে। অনেকক্ষণ কেটে গেল এভাবে এক গভীর বিষণ্নতায়। ঘরের মধ্যেই অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল একটি বইয়ের উপর—"এক চিত্রশিল্পীর আপনকথা"। ব‌ইটি টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন তিনি। এবং পড়ে যেতে লাগলেন গভীর মনোযোগে। ব‌ইটি যখন পড়া শেষ হল তখন রাত শেষ হয়ে দিনের আলো ফুটে উঠেছে।

সেই সঙ্গে আলো ফুটে উঠল তাঁর মনের মধ্যেও। কারণ ওই ব‌ইয়ের কয়েকটি পঙ্‌ক্তি যেন এক আশ্চর্য আলো ঠিকরে দিল তার বিমর্ষ মনের আঁধারে। 'চোখের সামনে যা পড়ে থাকে তাকে ভালো করে দেখলে বুঝবে কত গল্প কত কবিতা লেগে আছে তাদের গায়ে—আগে সেগুলোকে ভালো ভাবে দ্যাখো—তাদের ছবি আঁকো—তারপর কল্পনার রাজ্যে ঢুকো'— ব‌ইটির এই কথাগুলো যেন তাঁর অন্তরে মণিমানিকের মতো ঝলমল করে উঠল। তিনি ব‌ইটি বন্ধ করে সামনের দিকে তাকালেন। দৃষ্টিটা যেন সহসাই বদলে গেছে তাঁর।

চোখের সামনেই তিনি দেখতে পেলেন তাঁর দাদুর আমলের বেতের চেয়ারটিকে। যথেষ্ট পুরোনো—একদিকের হাতলটা বেঁকে গেছে অনেক দিন আগেই। পিঠের হেলান দেওয়ার জায়গায় বেতের জালিগুলো এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে কিছুকাল ধরে। পিছনের একটা পায়াও কমজোরী হয়ে গেছে ইদানিং। তবুও এটি তাঁর একটি প্রিয় জিনিস। একা ঘরে এই চেয়ারে বসলে কত কি যে ভাবনার ঢেউ আসে তাঁর মনে।

তখন‌ই তাঁর মনে হল এই চেয়ারটিই তাঁর আঁকার এক দারুণ বিষয়বস্তু। তাই আবার তিনি আঁকতে শুরু করলেন নতুন উদ্যমে। নানান কোণ থেকে—এক এক রকমের অন্ধকারে—ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তিনি বেশ কয়েকটি ছবি আঁকলেন ওই বেতের চেয়ারটির। এবারেও কিন্তু একটি ছবিও তাঁর পছন্দ হল না। চেয়ারটির দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হল সেটি যেন তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলছে—"কিচ্ছু হয়নি—কিচ্ছু হয়নি একটাও।"

—"কেন? কেন? হয়নি বলছ কেন?"—তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

—"কারণ তুমি যা আঁকলে আমি তা ন‌ই,"—উত্তর এল সেই পুরোনো বেতের চেয়ারের কাছ থেকে।

—"তার মানে?"

—"মানে তোমার কল্পনা তোমার স্বাভাবিক দৃষ্টিকে ঢেকে দিয়েছে—তোমায় দেখতে হবে তোমার নিজের চোখ দিয়ে— অভ্যেস করতে হবে নিজের চোখকে ব্যবহার করে ..."

চেয়ারের কথাগুলো মাঝপথে থামিয়েই বলে উঠলেন তিনি—"থামো! থামো! উপদেশ দেওয়া বন্ধ করো—যেভাবে চাইছি সেই ভাবে ছবি আঁকা হবে না আমার দ্বারা—ছবি না হোক—কিছু না কিছু আমি সৃষ্টি করবোই একদিন—কিন্তু এই ভাবে ঘরে বসে থাকলে কিচ্ছু হবে না কোনোদিন..."

— এইসব কথাগুলো হঠাৎ ফুঁসে ওঠা ঘূর্ণিঝড়ের মতো তোলপাড় করে উঠল তাঁর মনে। তারপর নিজের প্রতি এক চরম বিক্ষোভে তিনি বেরিয়ে পড়লেন তাঁর বাড়ি থেকে। মধ্যরাতের অন্ধকারে। যেন একটা ভূতে পাওয়া মানুষের মতো। বেরোনোর সময় মনে হল ওই চেয়ারটি যেন অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে বলছে—"আমি জানি—তুমি ফিরে আসবে—আর আমি অপেক্ষা করে থাকব সেই দিনটার জন্য।"

****

তখন বাইরের মধ্যরাতের আকাশটার মাঝখানে প্রকাণ্ড চাঁদটাকে ঘিরে অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছিল। দূর থেকে ভেসে আসছিল একটা বাজনার আবছা সুর। তিনি যেদিকে এগোতে থাকলেন সেদিকেই ক্রমশ জোরালো হয়ে ভেসে আসছিল বাজনার আওয়াজটা। তখন‌ই মনে পড়লো তাঁর যে আজ একটি বিশেষ তিথি। তাই পূর্ণিমার আলোয় জোয়ারের সাথে ভেসে আসছে এই বাজনার আওয়াজ। অর্থাৎ এ রাত এক বিশেষ উৎসবের।

উনি এসে পৌঁছলেন সেই বিখ্যাত নদীটির ধারে। সেখান থেকেই আসছে এই বাজনার আওয়াজ। উনি দেখলেন সেখানে অজস্র মানুষের মেলা। উৎসবের আনন্দে ভাসছে চারিদিক। তাঁর মনে হল এই আনন্দধারাকে যদি রূপ দিতে পারতেন তাঁর হৃদয়ের শব্দে কিংবা সুরে। উপরের আকাশের দিকে একবার তাকালেন তিনি। মনে হল যদি পারতেন এই পূর্ণ চাঁদের মায়াকে মানুষের এই আনন্দের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে নিজের সৃষ্টি দিয়ে!

এরপর তাঁর নিজের মনে ঢেউয়ের মতো ভেসে আসতে লাগল কত শব্দ কত ছন্দ কত সুর—সেগুলো যেন তাঁকে ঘিরে বলতে লাগল—'আমায় নাও—আমিই মিলিয়ে দেব।' কিন্তু তাঁর মনোমতো হচ্ছিল না কোনোটাই। এদিকে রাত শেষ হতে চলল। সেই প্রকাণ্ড চাঁদটা একটা হলুদ ফলের মতো আকাশ ছুঁয়ে নিঃশব্দে নেমে এল সেই নদীর কিনারায়। শেষ রাতে হুল্লোড়ের পর সবাই তখন ঘরমুখো।

ঠিক সেই সময়েই তিনি শুনতে পেলেন এক আশ্চর্য স্বর। যেন এক অমর্ত্য উচ্চারণ। তিনি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন সেই শব্দকে অনুসরণ করে। এবং একটু এগোতেই দেখতে পেলেন এক প্রবীণ মানুষকে। তিনি তন্ময় হয়ে আছেন অপার দিগন্তের দিকে তাকিয়ে। আর তাঁরই মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে যেন একের পর এক মহৎ স্তোত্র। অপলক মুগ্ধতায় তিনি তাকিয়ে র‌ইলেন সেই উদ্গাতার দিকে। তাঁর মনে হল এই সেই গায়ত্রী যার খোঁজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি।

ঠিক তখনই প্রায় অন্তর্যামীর মতোই সেই প্রবীণ মানুষটি তাকালেন তাঁর দিকে। বললেন—"যুবক! তুমি কি কিছু বলবে?”

মুগ্ধ বিস্ময়ে তিনি উত্তর দিলেন—'এইসব শব্দ দিয়ে সুর দিয়ে কি ভুবন রচনা করলেন আপনি।’ তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন—'এই কলাকৌশলটা আমায় যদি দয়া করে শিখিয়ে দেন তাহলে আজীবন আপনার দাস হয়ে থাকব।'

বৃদ্ধ মানুষটি যেন এক প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাঁর চোখের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন—'তাহলে আমার সঙ্গে এসো।’

নিজের এই অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে তিনি অবাক হলেন। তাই এক পরম মুগ্ধতায় তিনি অনুসরণ করতে লাগলেন সেই প্রবীণ মানুষটিকে। প্রায় নিরুচ্চারেই কাটল তাঁর দীর্ঘ পথচলা। এক গহন অরণ্যের ভিতর দিয়ে সেই পথ এসে শেষ হল এক বিরাট পাহাড়ি ঝরনার সামনে। সেখানে অজস্র রঙিন ফুলে-ভরা গাছে ছেয়ে রয়েছে চারিদিক। অসংখ্য পাখির ডাকের সাথে ঝরনার জলের আওয়াজ মিলেমিশে যেন এক অপূর্ব ধ্বনি হয়ে থিরথির করে কাঁপছে চারিদিকে। দিনের প্রথম আলো যেন সোনার গুঁড়োর মতো ঝরে পড়ছে সেই ঝরনার জলের স্রোতে। তিনি অপলকে তাকিয়ে দেখতে থাকলেন চারিদিক। সংবিৎ এল সেই আশ্চর্য মানুষটির কন্ঠস্বরে।—"যে নদীর ধারে তুমি দাঁড়িয়েছিলে, এই তার উৎসস্থল।"

"তোমার নামটা জানা হয়নি যুবক। যদিও সে নাম জানার‌ও কোনো প্রয়োজন নেই আমার। আমার কথায় তুমি এতটা পথ আমার সঙ্গে এলে, তাই আমি তোমায় জানাচ্ছি যে আমি একাই এখানে সাধনা করি। শব্দের আর সুরের সাধনা।" কথা নয় যেন এক অতল গভীর মায়াবী স্বর। তিনি অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে র‌ইলেন ওই প্রবীণ মানুষটির দিকে। এর পরেই ওই বিস্ময়ের ঘোর গভীর ভাবে ব্যাপ্ত হয়ে গেল তাঁর জীবনে।

তাই তিনি সহজেই ভুলে গেলেন তাঁর আপনজনদের। বাবা মা ভাই বোন এমনকি প্রেয়সী বাগদত্তাটিকেও। নিজের লোকালয়, জন্মভিটে, এমনকি নিজের একান্ত প্রিয় পড়ার ঘরটিকেও ভুলে গেলেন যেন অনায়াসে। কারণ তাঁর চোখে তখন সৃষ্টির স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নের রচয়িতা ওই আশ্চর্য প্রাচীন মানুষটি। তাঁর কাছে ভাষার আর ভাবের ঈশ্বর। শব্দের আর সুরের প্রভু। তাই তিনি তখন জগৎ-সংসার ভুলে ওই বৃদ্ধ কবি ও গায়কের গীতিতে মগ্ন হয়ে গেলেন সহজেই।

ওই প্রবীণ কবির কত আশ্চর্য রকমের শব্দের ব্যবহার—কত অপূর্ব ছন্দের প্রয়োগ—কত বিস্ময়কর সুরের মূর্ছনা—যেন এক বিপুল ইন্দ্রজাল বিছিয়ে দিল তাঁর চেতনার ভুবনে। তিনি ভুলে গেলেন তাঁর এযাবৎ অর্জিত কাব্যকলার যাবতীয় উপাদান। তাঁর বাগবিদ্যার সমস্ত ভাণ্ডার যেন তাঁর কাছে সহসা অচল বলে মনে হল। তিনি মোহিত হয়ে র‌ইলেন ওই বৃদ্ধ কবির প্রতিটি শব্দে ও সুরে। শুরু হল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যেন এক নতুন ছাত্রজীবন। এইভাবে সুরের আর শব্দের অজস্র কৌশল আয়ত্ত করতে করতে কেটে গেল তাঁর জীবনের বেশ কিছুকাল।

একদিন মধ্যরাতে আকাশের প্রকাণ্ড চাঁদটার পাশ থেকে পরপর কয়েকটি তারা খসে পড়তে দেখলেন তিনি। তাঁর চোখের সামনেই দূরের উজ্জ্বল নীল আকাশ থেকে ঝলমলে তারাগুলি কোন গভীর অন্ধকারে তলিয়ে গেল নিঃশব্দে। তখন‌ই কেন কে জানে এতকাল বাদে তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল তাঁর বাগদত্তার মুখটি। তারপরেই ছবির মতো ভেসে এল তার বাবা মা পরিবারের সবার মুখগুলো। তিনি নিশ্চুপে বেরিয়ে পড়লেন গীতিকারের সেই আশ্রয় থেকে। মধ্যরাতে। একা। এক দুর্নিবার আবেগে।

শেষ রাতের আবছা অন্ধকারে তিনি পৌঁছলেন তাঁর বসতবাড়িটির সামনে। তাঁর চোখের সামনেই অন্ধকার কেটে গিয়ে দিনের প্রথম আলো ফুটে উঠল তাঁর অতি প্রিয় বাসস্থানটির গায়ে। দূর থেকে লুকিয়ে তিনি দেখতে পেলেন তাঁর বাড়ির আপনজনেরা দিন শুরুর দৈনন্দিন কাজে নেমে পড়ল যথারীতি। উনি নিঃশব্দে চলে এলেন সেইখান থেকে তাঁর বাগদত্তার বাড়ির সামনে। সেখানেও লুকিয়ে দেখলেন এক‌ই দৃশ্য। মেয়েটি তার রোজকার কাজ শুরু করে দিয়েছে নিয়মমাফিক। হঠাৎই তাঁর নিজেকে খুব শূন্য বলে মনে হল। মনে হল এদের সবার কাছে তাঁর নিজের থাকা-না-থাকা আজ মূল্যহীন। তখন‌ই তিনি ফিরে চললেন সেই অরণ্যের গভীরে। ওই আশ্চর্য পুরুষের আশ্রয়ে। ওই বৃদ্ধ কবি ও গীতিকার মানুষটি শুধু স্মিত হেসেছিলেন তাঁর সেই নতমুখে ফিরে আসা দেখে।

ফলে আবার শুরু হল তাঁর ওই আশ্রমিক দিনযাপন। অক্লান্ত পরিশ্রমে ওই প্রবীণ ঋষিকল্প মানুষটির থেকে তিনি ধীরে ধীরে আয়ত্ত করলেন অজস্র শব্দজাল—অসংখ্য দুরূহ ছন্দ—অপার সুরের সম্ভার। এর আরো কিছু কাল পর আরেক পূর্ণিমার রাতে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে চেষ্টা করছিলেন দূরের ওই মেঘজ্যোৎস্নার রূপটি কথায় আর সুরে নিখুঁত ভাবে গেঁথে ফেলতে। রাত শেষ হয়ে দিনের আলোর আভায় আকাশ ভরে গেল। কিন্তু তাঁর মনোমতো কথা আর সুর মিলল না।

এরপর প্রতিরাতেই তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন ওই জ্যোৎস্নাকে তাঁর কথায় আর সুরে একাকার করে দিতে। সেই বিপুল পূর্ণিমা যথাসময়ে ক্ষয়ে গিয়ে ঘোর অমাবস্যার রূপ পেল। কিন্তু তাঁর এত বছরের সাধনার বিদ্যায় সেই যথার্থ সৃষ্টিটি কিন্তু কখনোই রচনা হল না। তিনি উপলব্ধি করলেন—তাঁর অজস্র অক্ষর শব্দ সুরের ভাণ্ডারে যেটা নেই তা হচ্ছে একটি একান্ত অনুভবের আলো। সেই আলোর দীপিকাটিই ছিল তাঁর কৈশোর আর সদ্য যৌবনের সম্বল। পরবর্তী জীবনে শেখা বিপুল কথা ও সুরের সম্ভারে তাঁর ওই অন্তরদীপটি কখন যে নিভে গেছে তা তিনি বুঝতেই পারেন নি।

তখন তাঁর মনে হল—'তাহলে কি লাভ হল এত বছর ধরে—এত পরিশ্রম করে—এমন ত্যাগ স্বীকার করে এই কাব্যকৌশল শিখে? যদি তাতে নিজের অনুভবের আলোটি এমন ভাবে ম্লান হয়ে যায়? তাহলে যা এত কষ্ট করে লিখলাম তা কি শুধুই কলাকৈবল্য?' ভাবতে ভাবতে এক গাঢ় বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল তার সমস্ত মনটা। এক ভয়ঙ্কর কষ্টে কেটে গেল তাঁর এক বিনিদ্র রাত।

দিনের প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঘরের বাইরে এলেন তিনি। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন সেই বৃদ্ধ কবির ঘরের দিকে। দেখলেন ওই প্রবীণ মানুষটি চোখ দুটি বন্ধ করে নিজের আসনে বসে আছেন ধ্যানস্থের মতো। মুখে লেগে রয়েছে এক আশ্চর্য স্মিত হাসি। এই দৃশ্যটি দেখামাত্রই হঠাৎ যেন তাঁর মনের পশুশক্তিটি ঠিকরে বেরিয়ে এল তাঁর স্বাভাবিক চরিত্রকে ধুলিস্যাৎ করে। তিনি সামনে পড়ে থাকা একটি পাথরের খণ্ড দুহাতে তুলে আছড়ে ফেলতে গেলেন ওই বৃদ্ধের মাথায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই চোখদুটি মেলে অতি স্নিগ্ধ নয়নে তাঁর দিকে তাকালেন সেই বর্ষীয়ান মানুষটি। তাঁর হাত থেকে পাথরের খণ্ডটি পড়ে গেল চারিদিকের নিঃস্তব্ধতাকে বিকটভাবে চুরমার করে।

"তোমার আরো একটা বিষয় শেখার বাকি আছে.... শূন্যতার অভিজ্ঞান.... রিক্ততার রাগিণী.... সেজন্য তুমি আমার এখানে থাকতে পারো .... আবার চলে যেতেও পারো ... যেকোনো জায়গায় ... নিজের ইচ্ছার পথে.... এই মুহূর্তেই .... কিংবা পরে.... যে কোনো মুহূর্তে... কারণ তোমার কাছে আমার অস্তিত্ব শুধুই অনুভবে।"—যেন এক আশ্চর্য স্তোত্রের মতো বৃদ্ধের কথাগুলি ভেসে এল তাঁর দিকে। নতমুখে বিপুল নীরবতায় তিনি আবার নিজেকে সমর্পণ করলেন ওই বৃদ্ধ কবির পায়ে। কিন্তু এবারের এই সান্নিধ্য ছিল সামান্যই।

কারণ পরদিন সকালেই ওই বৃদ্ধ মানুষটিকে আর কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না। তিনি উন্মাদের মতো খুঁজে বেড়ালেন ওই উপত্যকার সর্বত্র—সেই গভীর অরণ্যের দুর্গমে—আর ওই নদীর উৎস থেকে তার দীর্ঘ গতিপথ ধরে। কিন্তু কোথাও সেই প্রাচীন মানুষটির সন্ধান মিলল না। মাথার উপরের প্রকাণ্ড আকাশটি তাঁর একমাত্র সঙ্গী হয়ে র‌ইল এই অস্থিরমুহূর্তে। এক অসহনীয় শূন্যতার মাঝে যেন এক অনন্ত রিক্ততার সঙ্গীত তিনি শুনতে পেলেন তখন‌ই।

শূন্যতার বিপুল ভার মাথায় নিয়ে তিনি ফিরে গেলেন তাঁর আবাল্যের বসতভূমিতে। এসে দাঁড়ালেন তাঁর জন্মভিটার সামনে। এক নতুন দিনের আলোয়। আর যা দেখলেন তা তাঁর কাছে মর্মান্তিক। সেই বসতবাড়িটি প্রায় ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে। বুঝলেন তাঁর আপনজনরা কেউই আর নেই সেখানে। সেখান থেকে তিনি গেলেন তাঁর বাগদত্তার বাড়িটির সামনে। সে বাড়িটি যেন পুরোপুরি বদলে ফেলেছে তার চেহারা। সেই গাছে ঘেরা ছোট্ট বাড়িটির জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এক প্রকাণ্ড অট্টালিকা। তাঁর পরিচিত কোনো মুখ‌ই দেখা গেল না সেখানে। ইতস্তত ঘুরে ফিরে তিনি বুঝলেন যে কেউই চিনতে পারছে না তাঁকে। তিনিও দেখা পাচ্ছেন না কোনো বাল্যকৈশোরের মানুষজনের। তাঁর মনে হল তাঁর আত্মীয় বন্ধু পরিজনরা অনেকেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আর বাকিরা হয়তো স্থানান্তরে অন্য ভিটেয় চলে গেছে সময়ের নিয়মে। কারণ এই সময়ের ব্যবধানটি তো সামান্য নয়। প্রথম যৌবনে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আর এখন এই প্রৌঢ় বয়সের ভার নিয়ে আবার ফিরে এসেছেন পুরোনো মাটিতে। এক প্রগাঢ় বিষন্নতা ঘনিয়ে এল তাঁর মনে। দিনের শেষ আলোর সাথে সাথে।

কিন্তু এর খানিকক্ষণ পরেই তিনি চমকিত হলেন দূরাগত এক বাদ্যের আওয়াজে। সে যেন কোনো এক উৎসবের সঙ্গীত ধ্বনি। ভেসে আসছে দূর থেকে। তাঁর মনে হল এই সুরের মূর্ছনা কি সত্যিই দূরে কোথাও কেউ সৃষ্টি করছে না কি তা ভেসে আসছে তার অতল চেতনা থেকে—বহু যুগের স্মৃতির ইন্দ্রপুরী থেকে? তিনি যেন সম্মোহিতের মতো অনুসরণ করতে করতে চললেন ওই সঙ্গীতের তরঙ্গকে। এবং শেষ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছে যা দেখলেন তাতে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।

তিনি দেখলেন সেই নদীর তীর... সেই অজস্র মানুষের সমারোহে... সেই উৎসবের বর্ণোজ্জ্বল প্লাবন... আর বিপুল আনন্দগীত.... আর দূরের আকাশে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না... যেন কত বছর আগেকার সেই ছবিটিকে হুবহু তাঁর চোখের সামনে কিভাবে এনে হাজির করল! কিংবা তিনি হয়তো কোনো অলীক পথে চলে গেছেন জীবনের দীর্ঘ এতগুলি বছর পিছিয়ে! কিন্তু আরো কয়েক মুহূর্ত পরে তিনি যেন নিজের সংবিৎ ফিরে পেয়ে বুঝলেন যা দেখছেন তা অতি বাস্তব।

হঠাৎই যেন তিনি বুঝলেন কিছু কিছু ব্যাপার সময়ের সঙ্গে বদলায় না। যেমন এই চৈতালী চান্দ্রোৎসব। মানুষজনের পোষাকের ধরন পালটেছে—বদলেছে তাদের চলাফেরা আর কথাবার্তার ধরন—কিন্তু বদলায়নি তাদের মুখের আনন্দ—উদ্ভাস, নয়নের গাঢ় প্রেমের ভাষা। আর সেই সাথে বদলায়নি ওই দূরের আকাশের ওই বিপুল পূর্ণিমাটি। আর তখনই তিনি ওই সমবেত মানুষের আনন্দের প্লাবনকে প্রকৃতির সেই অপরূপ উদ্ভাসের সঙ্গে একাকার করে মিলিয়ে দেওয়ার কথা আর সুর গেঁথে ফেললেন এক আশ্চর্য দৈববলে। যে ভাষা আর ভাবের অভাবে, যে সুরের আর ছন্দের হীনতায় তিনি সবকিছু ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ঠিক এইরকম এক উৎসবের রাতে সেই ভাষা, ভাব, ছন্দ, সুর যেন বিপুল সম্ভারে নিবেদিত হল সহসাই। তাঁর মনে হল তাঁর এই দীর্ঘকালের সাধনা এতদিনে সার্থক হল।

এক পরমতৃপ্তির আবেগে তিনি কি মনে করে আবার এসে দাঁড়ালেন একটি সামান্য লন্ঠন হাতে নিয়ে তাঁর জীর্ণ বসতবাড়িটির সামনে এবং ধীর পায়ে প্রবেশ করলেন সেই পরিত্যক্ত অন্ধকার বাড়িটিতে। দীর্ঘ কাল না বসবাস করলেও আশৈশব বিজড়িত সেই বাড়ির প্রতিটি সিঁড়ির ধাপ, প্রতিটি ঘরের ভিতর বাহির তিনি এখনো চোখ বন্ধ করে পার হতে পারেন। তাই স্বল্প আলোতেও তিনি স্বচ্ছন্দে উঠে এলেন তাঁর নিজস্ব ঘরটিতে। এবং অবাক হয়ে দেখলেন প্রায় ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া ঘরটিতে এখনো সেই বেতের চেয়ারটি এক কোণে পড়ে আছে।

"কি হল? খুব অবাক হচ্ছ? বলেছিলাম না? আমি অপেক্ষা করে থাকব—তোমার ফিরে আসার জন্য—আর আমি জানতাম যে তুমি আসবেই--"—যেন এক অদ্ভুত কন্ঠস্বর ভেসে এল ওই চেয়ারটির দিকে থেকে। তিনি বিরাট বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। আবার শুনতে পেলেন সেই অলৌকিক কন্ঠস্বর—"তাহলে এবার আমায় নিয়ে কোন গীত রচনা করবে কবি?" তিনি একথার কোনো উত্তর না দিয়ে নিষ্পলকে দেখতে থাকলেন কি অদ্ভুত ভাবে শেষ রাতের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ নেমে এসেছে ওই চেয়ারের পিছনে—তাঁর হাতের লন্ঠনের হলুদ আলো আর দূরের শেষ রাতের পূর্ণিমার আলো মিলেমিশে কেমন একটা আশ্চর্য আলো আঁধার সৃষ্টি করেছে ওই ভেঙে পড়া চেয়ারটিকে ঘিরে।

তিনি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে র‌ইলেন ওই চেয়ারটির দিকে। এতকাল ধরে আয়ত্ত করা বিপুল শব্দ ও সুরের মহাসমুদ্রে তিনি ডুব দিয়ে খুঁজতে থাকলেন ওই ভগ্ন পরিত্যক্ত চেয়ারটির বর্ণনার উপযুক্ত শব্দ, যথাযোগ্য সুর। প্রাণপণ চেষ্টা করেও তিনি কিছুই পেলেন না। ব্যর্থ চোখে সেই দিকে তিনি তখন শুনতে পেলেন—"কি হল কবি? তুমি নীরব কেন?" অক্ষরমালার অনন্ত নিখিলে নিবিষ্ট হয়েও তাঁর দুহাতে এখন গভীর অভাব। তাই তিনি নতমুখে নিরুত্তর র‌ইলেন। নিজেই নিজেকে নিঃশব্দে বললেন—"আমি এবারেও পারলাম না। কিন্তু কেন?"

ধ্বংসপ্রায় চেয়ারটি যেন কোনো অলৌকিক ক্ষমতায় শুনতে পেল তাঁর সেই কথাটি। "কারণ যে কথা আর সুরের ঐশ্বর্যের অধিকারী তুমি আজ হয়েছো—তাতে শুধু এক মধুগন্ধে ভরা ভুবনের কথাই তুমি বলতে পারো—তোমার সুর ওই দূরের নীহারিকা থেকে নদীর ঢেউয়ের রূপে ভেসে যায়—তুমি মহান কবি— প্রেমের নিখিল ভুবনে তুমি মহারাজ—মানুষের—প্রকৃতির আর ঈশ্বরের প্রেমে তোমার আমি যেখানে ডুবে গেছে সেখানে আমার কোনো স্থান নেই। স্থান নেই আমার মতো অন্ধকারে পড়ে থাকা ভগ্ন কুৎসিত শেষগতির যাত্রীদের। এই বিপুল রিক্ততার জগতে তুমি তো আসন পাতো নি কবি।"—কথাগুলো যেন ভেসে এল এক অদ্ভূত বায়বীয় স্বরে ওই ধূলিধূসর ভগ্ন চেয়ারটির দিক থেকে।

মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে হল ওই চেয়ারটিকে দুহাতে তুলে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিতে ঘরের বাইরে—যাতে একেবারে দুচোখের সীমানার বাইরে চলে যায় ওই বস্তুটি— কিংবা একেবারে শেষ হয়ে যায় এই অসহ্য অস্তিত্বটি। তারপরেই মনে হল—ছি ছি—কি ভয়ঙ্কর অশুভ ভাবনা গ্রাস করছে তাঁকে। তাঁর মনে হল ওই চেয়ারটির কথাগুলো তো অসত্য নয়। তিনি তো সত্যিই জীবনের যাত্রাপথের আনন্দগান গাইতেই চেয়েছেন। এই নষ্টভ্রষ্টদের শেষগতির দিকে তাকিয়ে দেখেননি কোনোদিনই।

"আমি আসি। আবার দেখা হবে নিশ্চয়ই। ওই চেয়ারটির দিকে তাকিয়ে এই কথাগুলি বলে যেন ভূতগ্রস্তের মতো হঠাৎই যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই তিনি বেরিয়ে গেলেন নিজের ওই জন্মভিটা থেকে। শেষ রাতের আবছা অন্ধকারে বহুযুগ আগে যেভাবে তিনি চলে গিয়েছিলেন নিজের বসতভিটাটি ছেড়ে ঠিক সেই ভাবে।

আবার শুরু হল তাঁর পরিক্রমা। এবং এ এক অন্যতর যাত্রা। এতকাল মানুষের এত আনন্দ গীত রচেছেন—এত কাল ধরে এত কঠিন সাধনা করেছেন—শ্রেষ্ঠ কবি হ‌ওয়ার কামনা করেছেন—এত বছর ধরে—এবার এই বিপুল সাধনা কামনার অজস্র গীত কোথায় এসে মিশেছে তার তো তাঁকে দেখতেই হবে। যে পথে পথে জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলেন সেই পথের শেষ কোথায় তা তাঁকে জানতেই হবে।

অত‌এব তিনি যাত্রা করলেন। আবার। কিন্তু অন্য পথে। অন্য জগতে। পরিত্যক্ত, বিকৃত, নষ্টভ্রষ্টদের অনুজ্জ্বল ভুবনে। সেখানে গিয়ে তাঁর এতদিনের সাধনার সমস্ত কথা ও সুর চূর্ণ হয়ে পড়ে গেল ওই ভয়াবহ শীতলপাতালে। তিনি প্রবেশ করলেন আরেক ভাষার রহস্যে, আরেক সঙ্গীতের ধ্বনিতে। সেই অভ্রান্ত অসুন্দর জগতে মগ্ন হয়ে কেটে গেল তাঁর আরো বেশ কিছুকাল। তিনি অনুভব করলেন ওই নষ্টনিখিলের বিপুল গহন।

এইভাবে জীবনের অস্তাচলে এসে মহাভুবনের সব আনন্দবেদনা যেন একাকার হয়ে গেল তাঁর চেতনায়। এতদিনে মহাকবির সংজ্ঞা লেগে গেছে তাঁর গায়ে। শ্রেষ্ঠ রচয়িতা হ‌ওয়ার আজন্মের আকাঙ্ক্ষা সারাটা জীবন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে কত বিচিত্র গহনপথে। তারপর শ্রেষ্ঠ কবির শিরোপা এসে বসেছে তাঁর মাথায়। কিন্তু এখন ক্রমশ ভারাক্রান্ত মনে হয় এই শিরোভূষণ। তাই এই প্রান্ত কালে এসে খ্যাতি আর প্রাপ্তিতে সর্বদা বিজড়িত তিনি ভারমুক্ত হতে চান প্রতিনিয়ত। ইচ্ছে হয় ফিরে যেতে সেই নিঃস্ব নির্ভার যুবাকালে। সেই ভাবনার গতিতেই তিনি একদিন আবার এসে দাঁড়ালেন তাঁর সেই ধ্বংসপ্রায় বসতবাড়িটির সামনে। দিনের প্রথম আলোয়। একান্তে।

সেই ঘরবারান্দার জীর্ণ অস্তিত্বের মধ্যে এসে তিনি যেন অবলীলায় পিছিয়ে গেলেন বহুবছর। তাঁর মনে হল যেন গত জন্মের আশ্রয়ে স্থির হয়ে আছে এই ধ্বংসস্তূপ। তিনি যেন সম্মোহিতের মতো সেই জীর্ণ সমারোহের মধ্য দিয়ে উঠে এলেন তাঁর অতি প্রিয় নিজের ঘরটিতে। আর সেখানে ঢুকেই তাঁর চোখে ধাক্কা দিল এক বিরাট শূন্যতা। তাঁর সেই বেতের ভাঙা চেয়ারটি আর নেই। এক অদ্ভুত শূন্যতা যেন স্তূপ হয়ে আছে সেখানটিতে।

সেই শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হু-হু করে ভেসে আসতে লাগল অতীতের অনেক ছবি। এই চেয়ারটির ভার তিনি বয়ে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরে। সেই প্রথম যৌবনের দিনগুলো থেকে। এই চেয়ারটির সঙ্গে এক আশ্চর্য সম্পর্কে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন নিঃস্ব অবস্থায় সেই সদ্যতরুণ বয়সে। আবার ফিরেও এসেছিলেন প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পৌঁছে কাব্যকলায় বহুবেত্তা হয়ে। কিন্তু ফের চলে যেতে হয়েছিল নতমুখে হীনমন্যে। এতদিন বাদে আবার এসেছেন খ্যাতি আর প্রাপ্তির শ্রেষ্ঠ শিরোপাটা খুলে ওই চেয়ারটিতে রেখে দেবেন বলে। কিন্তু এবারও যেন তাকে তুচ্ছ করে সেই চেয়ারটিই উধাও হয়ে গেছে কোথাও। এক অসহনীয় শূন্যতায় স্থির হয়ে র‌ইলেন তিনি। ভারমুক্ত তিনি হতে চেয়েছিলেন কিন্তু যেন নিঃস্ব হয়ে গেলেন এখন। মাথা নীচু করে তিনি বেরিয়ে গেলেন ওই বাড়িটির থেকে।

এরপর থেকে আর নতুন করে কোনো শব্দ নয়, সুর নয়, শুধু রেখা ও রঙের জগতে আবার ডুবে গেলেন তিনি। ছন্দ সুর কাব্যের ইন্দ্রজাল থেকে বহুদূরে গিয়ে আদিম রেখা আর রঙের ভুবনে তিনি প্রকাশ করতে থাকলেন তাঁর চেতনাকে। একের পর এক অজস্র ছবিতে।

'... পূর্ণিমার রাত শেষ হয়ে চলেছে.... পড়ন্ত চাঁদটা লেগে আছে ছাদের আধভাঙা পাঁচিলের কিনারায়.... আর তার সামনে পড়ে আছে পুরোনো হাতলভাঙা একটা বেতের চেয়ার.... চেয়ারের ছায়াটা লম্বা হয়ে এগিয়ে এসেছে সামনের দিকে....'

— এইরকম একটি আণবিক মুহূর্তের ছবি আঁকলেন তিনি এক দীর্ঘ রাত্রিতে। ছবিটি আঁকার পর ওঁর মনে হয়েছিল ওই দূরের চাঁদ, ছাদের পাঁচিল, হাতলভাঙা চেয়ার সবাই যেন সমস্বরে তাঁকে বলছে—"নিখুঁত! নিখুঁত!"

ঠিক তখনই উনি নিজেই নিজেকে যেন বললেন—"যাক—তাহলে এতদিনে একটা সার্থক সৃষ্টি করতে পারলাম।"

ওঁর কথাটা শেষ হ‌ওয়ার সাথে সাথেই যেন চেয়ারের ছায়াটি বলে উঠল—"এবার সময় হয়েছে তোমার।"—বলতে বলতে ছায়াটি যেন ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে স্পর্শ করল তাঁকে। না কি উনিই স্পর্শ করলেন ওই ছায়াটিকে?


কিন্তু এরপরেই তিনি স্থির হয়ে গিয়েছিলেন ...

সারা জীবন ধরে নানা সুরের নানা রেখার আকুল ধারাকে মিলিয়ে দেবার চেষ্টায় আত্মহারা হয়ে হঠাৎই এক শেষ রাতে নিজের সৃষ্টির সামনে তিনি হঠাৎই লুটিয়ে পড়ে স্থির হয়ে গিয়েছিলেন —হয়তো —একটি নমস্কারে...

....আর তখনই কারো সমস্ত গান আর সুর যাত্রা করলো এক শাশ্বত মানসযাত্রী হংসে।




(পরবাস-৮৩, ১০ জুলাই, ২০২১)