Subscribe to Magazines






পরবাসে গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য-র
আরো লেখা


ISSN 1563-8685




অনিরুদ্ধ আর দুটো কাক

কালে পর্দা সরিয়েই অনিরুদ্ধ কাক দুটোকে দেখতে পেয়েছিল। সামনের আমগাছটায় বসে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

“হুশহুশ!”

অনিরুদ্ধ জানলার কাঁচে থাপ্পড় মারে। কিন্তু কাকেদের ভ্রূক্ষেপ নেই। শেষে বিরক্ত হয়ে পর্দা টেনে দিয়েছিল।

দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকার ঘটেছিল বাড়ি থেকে বেরনোর সময়ে। সামনের গেটের ওপর তারা নবাবী চালে বসেছিল, অনিরুদ্ধর গতিবিধির ওপর নজর রাখছিল।

ব্যাস, তারপর থেকে সারা রাস্তায় যখনই অনিরুদ্ধ ট্র্যাবফিকে দাঁড়ায়, কাক দুটো উড়ে এসে তার গাড়ির বনেটে বসে। বলাই যায়, এরা যে সেই দুটো কাক তার গ্যারান্টি কি? কিন্তু অনিরুদ্ধ জানে, এরা তারাই। একটা একটু বড়ো, আরেকটা ছোট। কা-কা করে না, ডানা ঝাপটায় না। শুধু অনিরুদ্ধর দিকে ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।

থাকুক গে।

অনিরুদ্ধর আজ কাক নিয়ে ভাবার সময় নেই। এমনিতেই তার নার্ভাস লাগছে। কারণ সে একটা গর্হিত কাজ করতে চলেছে।

“ঠিক গর্হিত বলা চলে কি?” মনে মনে ভাবে অনিরুদ্ধ। “পিংকি কি এর থেকে আলাদা কিছু করেছে?”

বেশ কিছুদিন হল পিংকির সঙ্গে বিয়ের বাঁধন আলগা হয়ে এসেছে। আলগা অবশ্য পিংকির দিক থেকেই হয়েছে। জিমে ঢোকার পর থেকে সে অনিরুদ্ধর সঙ্গে দুটো কথা বলারও প্রয়োজন মনে করে না। মনে করবেই বা কেন... যাই হোক, অনিরুদ্ধও একটা ওয়েবসাইটে নজর রাখছিল। কাল সাহস করে বুকিং করে ফেলেছে। এস্কর্ট সার্ভিস।

পাশের সীটে রাখা মোবাইলটা তুলে একবার দেখে নিল অনিরুদ্ধ। আজকেই বলেছিল তো? হ্যাঁ, আজ বেলা একটায়, ভিস্তা হোটেলে।

ট্র্যাকফিকের আলো আবার সবুজ হয়ে গেছে। অনিরুদ্ধ গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

ভিস্তা হোটেল বাইরে থেকে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কাঁচের দরজা দিয়ে ঢুকে চকচকে রিসেপশন — সবই কেমন যেন চেনা চেনা। অনিরুদ্ধ কি আগেও এখানে এসেছে? নাকি আজকাল সব হোটেলের লবিই একই রকমভাবে সাজানো হয়?

নির্দেশ অনুযায়ী অনিরুদ্ধ দু'ঘণ্টার জন্য ঘর বুক করে নিল। উর্দি পরা বেয়ারা ঘর অবধি পৌঁছে দিল। সঙ্গে লাগেজ নেই দেখে একটা বিশ্রী হাসি হেসে বেরিয়ে গেল।

রাগে অনিরুদ্ধর গা রি রি করে উঠল।

আমার পয়সায় আমি ফুর্তি করব, তোর তাতে কি?

ঘরটা খুব বড়ো নয়। এক কোনায় একটা ডবল খাট পাতা, অন্য কোনায় টেবিল আর দুটো চেয়ার। বিচ্ছিরি গোলাপি রঙের দেওয়াল, তার গায়ে একটা টিভি, একফালি আয়না, আর একটা ছবি আটকানো আছে।

অনিরুদ্ধ চমকে উঠল। ছবিতে আবার সেই কাক দুটো!

এসি চলা সত্ত্বেও অনিরুদ্ধর গরম লাগতে শুরু করেছে। সে কোটটা খুলে একটা চেয়ারে ভাঁজ করে রেখে দিল। এক গ্লাস জল খেয়ে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করল। একবার মনে হল ছুটে পালিয়ে যায়। কোটটা আবার গায়ে পরে নেবে কি না ভাবছে এমন সময়ে দরজায় টোকা পড়ল।

“কাম ইন।”

দরজা খুলে গেল। মেয়েটি ঘরের ভেতর ঢুকে এল। হ্যাঁ, ছবিতে যেমন দেখেছিল হুবহু সেরকমই। অনিরুদ্ধকে দেখে আংটি পরা সরু হাত বারিয়ে দিল।

“শায়রি দে।”

অনিরুদ্ধও নিজের হাত বাড়িয়ে দিল।

“অনিরুদ্ধ বোস।”

শায়রি একটা চেয়ারে বসে পড়ল। অনিরুদ্ধ ওয়ালেট থেকে দু'হাজার টাকার নোট বের করে টেবিলের ওপর রেখে দিল। ওয়েবসাইটে লেখা ছিল, টাকা দিলে তবেই সময় শুরু হবে।

“থ্যাংকস।”

শায়রি নিজের ছোট্ট চামড়ার ব্যাগে টাকাটা ঢুকিয়ে নিল।

দু'হাজার টাকা, অনিরুদ্ধর কানে হঠাৎ পিংকির গলাটা ভেসে এল।

সে আজকের পিংকির গলা নয়, তেরো বছর আগে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল, সেদিনের পিংকির গলা।

আমার পিংকির গলা...

অনিরুদ্ধ তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে। ম্যাডাক্স স্কোয়ারের প্যান্ডেলে পিংকিকে দেখেই প্রেমে পড়ে গেছে।

“তোমার একটা ছবি তুলতে দেবে?”

বন্ধুদের ওস্কানি পেয়ে সাহস করে গিয়ে বলে ফেলেছিল।

পিংকি একবার ঠান্ডা চোখে ওর আপাদমস্তক মেপে নিল।

“দু'হাজার টাকা দাও, তাহলে একটা ছবি তুলতে দেব।”

বোধহয় ভেবেছিল এইভাবে কাটিয়ে দেবে। কিন্তু অনিরুদ্ধ নাছোড়। দুটো ছবির বদলে পকেট খালি করে চার হাজার টাকা দিয়ে এসেছিল। তারপর বন্ধুদের কাছে কি প্যাঁকটাই খেয়েছিল।

ভাবতে ভাবতে অনিরুদ্ধর কেমন যেন লাগে।

“না, দাঁড়াও!”

শায়রি জুতো খুলতে শুরু করে দিয়েছে। অনিরুদ্ধ হাত বারিয়ে বারণ করল।

“আমি এসব করতে পারব না।”

“প্রথমবার এসেছেন বুঝি?” শায়রি চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করল। “একটু উইস্কি বলব? রিল্যাক্স করতে হেল্প করবে।”

“না,” অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ল, “কিচ্ছু লাগবে না।”

শায়রি তার ফর্সা সরু কাঁধ ঝাঁকাল।

কি রোগা মেয়েটা, কিছু খায় না?

“আমি কি তাহলে চলে যাব?”

“না,” অনিরুদ্ধ হঠাৎ কি খেয়ালে বলে উঠল, “তোমাকে এক ঘণ্টার টাকা দিয়েছি তুমি পুরো এক ঘণ্টা থাকবে। আর আমার কথা শুনবে।”

শায়রির একটা ভুরু হালকা উঠে গেল।

“বেশ, বলুন কি বলার আছে।”

বাইরে গুলি চলার মতো আওয়াজ হল। মনে হয় কোন গাড়ির টায়ার ফাটল। অনিরুদ্ধ ক্লান্তভাবে খাটের এক কোনায় বসে পড়ল। দেওয়ালের কোথাও একটা ঘড়ির কাঁটা নড়ছে। টিক...টিক...টিক...

“আমার সঙ্গে কথা বলার কেউ নেই,” অনিরুদ্ধ বুড়ো আঙুল দিয়ে চোখ দুটো চেপে ধরে বলতে শুরু করল। “আমার বউয়ের আমার জন্য সময় নেই। আর আমার মেয়ে...আমার দশ বছরের একটা মেয়ে আছে... সেও নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত।”

অনিরুদ্ধ ওয়ালেট খুলে একটা ছবি বার করে শায়রিকে দেখাল। শায়রি একবার চোখ বুলিয়ে ফেরত দিয়ে দিল।

“শুরুতে কিন্তু এরকম ছিল না।”

“এরকম থাকলে কি আর শুরু হত?” শায়রির হাসিতে বিদ্রুপের ইঙ্গিত।

“পিংকি তখন বাড়ি থেকে পালানোর কথা ভাবছিল,” অনিরুদ্ধ যেন শায়রির কথা শুনতেই পায়নি। “ও মডেলিং করতে চায় কিন্তু বাড়ি থেকে কিছুতেই মানবে না। উত্তর কোলকাতার রক্ষণশীল পরিবার। এই নিয়ে পিংকির সঙ্গে নিত্য অশান্তি হত। এমন সময়ে আমার সঙ্গে দেখা। আমি বললাম, কোন চিন্তা নেই। আমি তোমাকে সব ব্যবস্থা করে দেব। নিজের পয়সা দিয়ে ওর পোর্টফলিও বানালাম, বিভিন্ন এজেন্সির কাছে নিয়ে গেলাম। কি না করেছি। ওর বাড়ির লোক জানতে পেরে এমন ক্ষেপে গেল আমার সঙ্গে দেখে করাই ব্যান করে দিল...”

অনিরুদ্ধ হাসতে শুরু করে দিল। আনন্দহীন তেতো হাসি।

“আর আজ সেই আমার জন্যেই পিংকির সময় নেই। যেদিন থেকে ওই হারামজাদা ফিরোজের সঙ্গে দেখা হয়েছে।”

“অফ কোর্স...”

“মানে?” অনিরুদ্ধ ঝাঁঝিয়ে উঠল। “এতে অফ কোর্সের কি আছে?”

শায়রি কাঁধ ঝাঁকাল।

“আপনার মতো মানুষ সাধারণত কোন এক ফিরোজের কারণেই হোটেল ভিস্তায় আসে।”

“ওঃ”, অনিরুদ্ধ আবার শান্ত হয়ে বসল। “আমি ভাবলাম তুমি বলছ আমি পিংকির যোগ্য নই।”

“পিংকি আপনাকে নিজের যোগ্য মনে করে?”

অনিরুদ্ধ আয়নার ফিকে তাকাল। মাথায় টাক পড়ে যাচ্ছে, সিগারেট খেয়ে দাঁত খয়েরি হয়ে গেছে, ভুঁড়ি বেড়েছে, চোখ দুটো টকটকে লাল... সঙ্গে সঙ্গে ফিরোজের টানটান সুপুরুষ চেহারাটা মনে পড়ে গেল।

“আমি একটা আই টি কোম্পানিতে দিনে বারো ঘণ্টা সময় কাটাই!” রাগে ফেটে পড়ল অনিরুদ্ধ। “নিজের সব শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে আমি টাকা উপার্জন করছি, যাতে ওই শালী জিমে যেতে পারে, স্পা-পার্লারে গিয়ে আরাম করতে পারে! তারপরেও ও কোন সাহসে মনে করে আমি ওর যোগ্য নই?”

শায়রি খিলখিল করে হেসে উঠল।

“বাড়ি গিয়ে এসব কথা বউকে বলুন না। দেখবেন, কেমন ছুটে আপনার কাছে ফেরত চলে আসে।” অনিরুদ্ধ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।

“অবশ্য পিংকিও সংসারের জন্য নিজের অনেক শখ-আহ্লাদ ছেড়ে দিয়েছে। মডেলিং ছেড়ে দিয়েছে। আমি কাজের লোকের রান্না খেতে পছন্দ করি না বলে রান্না শিখেছে। কাকলি — আমাদের মেয়ে — ওকে মানুষ করছে। কিন্তু...” বিরক্তিতে টেবিল চাপড়ে উঠল অনিরুদ্ধ, “তার মানে তো এটা নয় যে অন্য কারুর সঙ্গে অ্যাফেয়ার করবে!”

“অনেক সময়ে সংসারের চাপে পড়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন উত্তেজনা বেঁচে থাকে না,” শায়রি নির্লিপ্তভাবে বলল। “আপনি হয়তো পিংকিকে সেভাবে সময় দিতে পারছেন না।”

পিঠে চাবুক পড়ার মতো করে অনিরুদ্ধ কেঁপে উঠল। দেওয়ালের দিকে চোখ চলে গেল। কাক দুটো ছবির ভেতর থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন এক্ষুনি অনিরুদ্ধর চোখদুটো খুবলে নেবে। অনিরুদ্ধ তাড়াতাড়ি অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিল।

“আমি চেষ্টা করেছি...” শুকনো ঠোঁটের ওপর জিভ বুলিয়ে নিল অনিরুদ্ধ। কোথাও একটা ফোন বাজছে। কেউ উত্তর দিচ্ছে না। বেজে বেজে ফোনটা থেমে গেল। থামার পরেও অনিরুদ্ধর মাথার মধ্যে বাজতে থাকল।

“চেষ্টা করেছেন বুঝি?” শায়রি ঠোঁট ফুলিয়ে নিষ্ঠুরভাবে বলে উঠল। “তাহলে আর কি, শ্রেষ্ঠ স্বামীর তকমাটা গিয়ে নিয়ে আসুন।”

“চোপ!” অনিরুদ্ধ শায়রির দিকে তেড়ে গেল। “আমাকে অপমান করার জন্য দু'হাজার টাকা দিই নি তোমাকে!”

শায়রি কেঁপে সরে গেল।

“সরি।” কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “এই ফিরোজকে আপনার বউ চিনল কি করে?”

“কে জানে!” অনিরুদ্ধ তাচ্ছিল্যভরে বলল, “বলে নাকি ওর জিম ইনস্ট্রাকটর। হলে তো ভালোই, এই ছুতোয় আমার বউয়ের সারা গায়ে হাত বোলাচ্ছে!”

“তার কোন মানে নেই!” শায়রি মনে হয় একটু বিরক্ত হয়েছে। বোধহয় সেও জিমে যায়।

“শপিং করতে নিয়ে যায় আমার বউকে,” অনিরুদ্ধ বলেই চলেছে। “কফি খেতে নিয়ে যায়, মেয়েকে আঁকার ক্লাসে নিয়ে যায়...”

“কাউকে তো এসব করতে হবে। আপনি তো সারাদিন বাড়িতেই থাকেন না।”

“আমাকে আর ওদের প্রয়োজন নেই! ওই ফিরোজ হারামজাদা আমারই বাড়িতে বসে আমার মেয়ের সঙ্গে মোনোপলি খেলে! মেয়েটাও তেমনি বজ্জাত হয়েছে। সারাক্ষণ শুধু ফিরোজকাকু এই আর ফিরোজকাকু ওই। তোর স্কুলের খরচ ফিরোজকাকু দেয়? দামি জামা, গুষ্টির খেলনা, বার্থডে পার্টি — এসব খরচ ওই শালা ফিরোজ দেয়?”

অনিরুদ্ধ নিজের মুখের ওপর হাত বোলাল।

“আমি ওদের মুখ দেখে বুঝতে পারছি। ওরা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। ওরা কিছু বলে না কিন্তু আমি বুঝতে পারি...ওরা পা টিপে টিপে ঘোরে, নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে, সবসময় পালানোর পথ খোঁজে...”

“তাহলে ওদের পালাতে দেন না কেন?”

“পারব না,” অনিরুদ্ধর গলা ভেঙে আসে, “আমি একা থাকতে পারব না...”

শায়রি হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল।

“সময় হয়ে গেছে। আমি উঠলাম।”

অনিরুদ্ধ হোটেলের ভাড়া চুকিয়ে বেরিয়ে আসে, কিন্তু শায়রিকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। ক্ষয়ে যাওয়া চেতনার প্রান্তে সে মাকড়সার মতো জাল বুনতে থাকে। অনিরুদ্ধ বুঝতে পারে, আবার তাকে শায়রির সঙ্গে দেখা করতে হবে।

ঘরোয়া জীবন ততক্ষণে নরক হয়ে উঠেছে। পিংকির সঙ্গে কথা তো দূর অস্ত, মুখ দেখাদেখি অবধি বন্ধ হয়ে গেছে। অনিরুদ্ধ একাই ঘুম থেকে ওঠে, জলখাবার খায়, স্নান করে, অপিস যায়। শুধু কাক দুটো ওকে ভোলে না। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখে, এক মুহূর্তের শান্তি দেয় না।

শায়রির সঙ্গে দেখা হলে সে সব চিন্তা অনিরুদ্ধর শরীর থেকে গলে বেরিয়ে যায়। আগে পিংকির সঙ্গে কথা বলেও এরকমই লাগত। পিংকির সঙ্গে শায়রির অনেক মিল আছে। যদিও শায়রি চরিত্রহীন। চলতি বাংলায় বলতে গেলে আরো খারাপ শব্দ ব্যবহার করতে হয়।

পিংকিই বা কম যায় কিসে?

শায়রি জিজ্ঞাসা করে,

“পিংকির সঙ্গে মিটমাট হল?”

অনিরুদ্ধ হেসে ওঠে।

“মিটমাট? আমি বলিনি, আমার স্ত্রী একটি বারাঙ্গনা?.. সরি।”

বলতে বলতে চুপ করে যায় অনিরুদ্ধ। কথাটা শায়রির সামনে বলা উচিত হয়নি।

শায়রি অবিচলিত মুখে দু'হাজার টাকা গুছিয়ে তুলে রাখে।

“পিংকিকে আপনি কি বলে ডাকেন তা দিয়ে আমার কিছু আসে যায় না।”

অনিরুদ্ধ নিশ্চিন্ত মনে খাটে গিয়ে বসে। যাক, শায়রি তাহলে সব কথা গায়ে মেখে ঝামেলা করার মেয়ে নয়। হঠাৎ নাকে একটা বিচ্ছিরি গন্ধ এসে লাগল। অনিরুদ্ধ নাকে রুমাল চেপে ধরল।

“কিসের গন্ধ আসছে জানো?” শায়রিকে জিজ্ঞাসা করল, “মনে হয় কিছু একটা পচেছে।”

“পাশের বাড়িতে ট্যানারি আছে তো, জানেন না?” শায়রি নখ ফাইল করতে করতে উত্তর দিল।

“ও তাই জন্যে...বাপ রে, নাড়িভুঁড়ি উলটে আসছে।”

“অন্য কোথাও দেখা করলেই তো পারতেন,” শায়রি অনিরুদ্ধর চোখে চোখ রেখে বলল। “বার বার এখানে কেন আসেন?”

অনিরুদ্ধ চারিদিকে তাকিয়ে দেখে। এই ঘরটা তার এত চেনা কেন? হোটেলের রিসেপশনে দাঁড়িয়েও চেনা চেনা লেগেছিল...

তারপর এক মূহুর্তে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল।

“অনেক দিন আগের কথা,” অনিরুদ্ধ স্বপ্নাবিষ্টর মতো বলতে থাকে, “পিংকির বাড়ি থেকে আমার সঙ্গে মেশা বারণ করে দিয়েছিল, ওর মা কিসব দিব্যিটিব্যিও দিয়েছিল। কিন্তু ওসব করে কি আটকে রাখা যায় নাকি? পিংকি বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার ছুতো করে আমার কাছে চলে এল। আমি আগেই রেজিস্ট্রির নোটিস দিয়ে রেখেছিলাম। দুজনে বিয়ে করে আসানসোল চলে গেলাম পালিয়ে। ওখানের একটা ছোট হোটেলে আমাদের হানিমুন কেটেছিল। ঠিক এরকম একটা ঘরে...পুরো হিন্দী সিনেমার মতো।”

শায়রি ভোঁতা চোখে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। চুলের একটা গোছা আঙুলে জড়াচ্ছে আর খুলছে। বোঝাই যাচ্ছে অনিরুদ্ধর কথায় খুব একটা উৎসাহ পাচ্ছে না।

“পাবেই বা কেন,” অনিরুদ্ধ ভাবে, “ওর তো বিয়ে হয়নি, তাই এসব জিনিসের মজাটা বোঝে না।”

শায়রির বিয়ে হয়েছে কি না অনিরুদ্ধ তা জানে না। ধরে নিয়েছে যে হয়নি। নাহলে ব্যাপারটা খুব বিশ্রী দাঁড়াবে।

কে যেন অনিরুদ্ধর নাম ধরে ডাকছে। দরজায় ধাক্কা মারছে। না, দরজা নয়, জানলায়। অনিরুদ্ধ তাকিয়ে দেখে সেই কাক দুটো। এখানেও খুঁজে খুঁজে চলে এসেছে। অনিরুদ্ধ ছুটে গিয়ে পর্দা টেনে দিল। আওয়াজটা দূরে মিলিয়ে গেল। অনিরুদ্ধ শায়রির দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

“কাক দুটোকে দেখলে? সমানে আমার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য আমার নিস্তার নেই!”

শায়রি যেন এই প্রথম অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে দেখল।

“সত্যিই তো! আপনাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এক কাজ করুন না, খাটে বসুন আমি পিঠে মালিশ করে দিচ্ছি।”

অনিরুদ্ধর মনে সন্দেহ জাগে।

“তার জন্য একস্ট্রা টাকা লাগবে নাকি?”

শায়রি খিলখিল করে হেসে ওঠে।

“না না...যার জন্য টাকা দিয়েছেন সে কাজটা তো হচ্ছে না। তার বদলে এটা।”

অনিরুদ্ধ নিঃশব্দে শার্ট খুলে বসে পড়ল। শায়রি তার পেছনে বসে গিঁট পড়া পেশীগুলোয় নরম আঙুল চালাতে লাগল। অনিরুদ্ধর আরামে ঘুম এসে গেল।

“এক ঘণ্টা হয়ে গেলে কিন্তু বলবে আমাকে,” অনিরুদ্ধ জড়ানো গলায় বলল, “আমি আরো এক ঘণ্টার টাকা দেব না।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, সময় হয়ে গেলেই জানাব।”

“এই জন্যেই তোমাকে আমার এত ভালো লাগে,” অনিরুদ্ধ হেসে উঠল, “আমি জানি, তুমি আমাকে ঠিক এক ঘণ্টা সময় দেবে। না এক মিনিট বেশি, না এক মিনিট কম। বাকিরা এরকম করে না, জানো। নিজেদের জগতে ডেকে আনে, এমনভাবে যেন সারা জীবনের জন্যে নেমন্তন্ন করছে। তারপর একদিন বলে 'এবার যাও, তোমার সময় শেষ।' আমি বুঝে উঠতে পারি না হঠাৎ কেন আমার সময় শেষ হয়ে গেল।”

“এরকম আপনার সঙ্গে অনেকবার হয়েছে বুঝি?”

অনিরুদ্ধর চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।

“আমি খুব ছোট ছিলাম তখন বাবা মারা যায়। যখন থেকে মনে আছে আমার জগতে শুধু আমি আর মা ছিলাম। কোন বন্ধুবান্ধবও ছিল বলে মনে নেই। মাকে ছাড়া কিছু জানতাম না। তারপর মা আবার বিয়ে করল। মার নতুন স্বামী আমাকে রাখতে চাইল না। মা আমাকে দিম্মার কাছে পাঠিয়ে দিল। আমি বোঝার আগেই মার সঙ্গে আমার সময় শেষ হয়ে গেল। দিম্মার বাড়ি গিয়ে প্রথমে খুব অসুবিধা হত। তারপর আস্তে আস্তে দিম্মাকে ভালোবাসতে শুরু করলাম। কিন্তু দিম্মাও বেশিদিন আমার কাছে রইল না। হার্ট অ্যাটাক। আবার আমি বোঝার আগেই মাই টাইম ওয়াস আপ।”

শায়রি অনিরুদ্ধকে জড়িয়ে ধরল। আলতো করে, উষ্ণভাবে, মমতাভরে। ঠিক যেমন মা তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরে। অনিরুদ্ধর মনে হল, কতদিন তাকে এভাবে কেউ জড়ায় নি।

“পিংকি বলেছিল ও আমার কষ্টটা বোঝে। ও বলেছিল ওর জীবন থেকে আমাকে কখনো বের করে দেবে না।”

“কিন্তু এখন আপনার মনে হচ্ছে ও নিজের কথা রাখবে না?” শায়রি আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল।

অনিরুদ্ধ প্রাণপণে শায়রির হাত দুটো চেপে ধরল। যে কথাটা ভাবতেও ভয় করছিল, অবশেষে তার জিভ দিয়ে গলে বেরিয়ে এল।

“আমার মনে হচ্ছে আমার সময় শেষ হয়ে গেছে...”

দেওয়ালের ছবিটার দিকে তার দৃষ্টি চলে গেল। কাক দুটো লাল, জ্বলন্ত চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ... …

শেষবার যখন অনিরুদ্ধ হোটেল ভিস্তায় গেছিল, তখন তার অবস্থা সঙ্গিন।

“ওরা চলে গেছে,” শায়রির কাঁধে ওপর কান্নায় ভেঙে পড়েছিল অনিরুদ্ধ। “পিংকি, কাকলি, দু'জনেই...”

শায়রি সরে এল। তার দু'চোখ ইস্পাতের মতো হয়ে গেছে।

“চলে গেছে মানে?”

“আমাকে একা ফেলে চলে গেছে...”

“কি করেছ তুমি?”

অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। চোখের সামনে শায়রি আর পিংকির মুখ দুটো মিলেমিশে যায়।

“কি করেছ তুমি?” পিংকির আর্তনাদ অনিরুদ্ধর কানে ভেসে আসে। “ফিরোজকে ধরে মেরেছ? তুমি কি গুণ্ডা নাকি?”

সরু হাত দিয়ে পিংকি অনিরুদ্ধর বুকে ধাক্কা দেয়। অনিরুদ্ধ তখন রাগে অন্ধ হয়ে গেছে। নিজের সব শক্তি দিয়ে পিংকির হাত চেপে ধরে মুচড়ে দেয়।

“তুমি একটা পিশাচ!” পিংকি চেঁচাতে থাকে, “তোমার এই নোংরা সন্দেহবাতিক সহ্য করে করে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি! তোমার জন্যে আমার কেরিয়ার গেছে, বন্ধুবান্ধব গেছে, আত্মীয়স্বজন গেছে...”

“তাদের দিয়ে কি হবে?” অনিরুদ্ধ রাগে গর্জন করে ওঠে। “আমি আছি তাতে যথেষ্ট হচ্ছে না? বাজারের মেয়েছেলে কোথাকার!”

এক মুহূর্তের জন্য পিংকি স্থির হয়ে যায়। তারপর বলিষ্ঠ কণ্ঠে ডাক দেয়,

“কাকলি! তোমার জামাকাপড় গুছিয়ে নাও। আমরা এই মুহূর্তে এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাব!”

চোখের কোণ দিয়ে অনিরুদ্ধ দেখতে পেল ছোট বজ্জাতটা ঘরের ভেতর ঢুকেছে। মায়ের মতোই হয়ে উঠছে দিন দিন।

“যাবেটা কোথায় শুনি?” অনিরুদ্ধর হাতে কখন যেন একটা পাথরের ফুলদানি উঠে এসেছে। “তোমার ফিরোজ তো এখন হাসপাতালে!”

“ফিরোজ?” পিংকির চোখেমুখে নিবিড় ঘৃণা ফুটে উঠেছে। “অবশ্য তোমার মতো জানোয়াররা বন্ধুত্বের পরিভাষা বুঝবেই বা কি করে? তোমরা তো নারী-পুরুষের মধ্যে একটাই সম্পর্ক বোঝ।”

সিনেমার মতো পুরো দৃশ্যটা অনিরুদ্ধর চোখের সামনে ঘটে গেল। তারপর সবকিছু মুছে গিয়ে শুধু শায়রির মুখটা পড়ে রইল।

“পিংকি বলেছে আমি বুঝি না,” ফিসফিস করে বলল অনিরুদ্ধ, “কিন্তু আমি বুঝি। তোমার আর আমার সম্পর্কটা কি বন্ধুত্বের নয়?”

“আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন,” শায়রি অনিরুদ্ধকে বিছানায় ঠেলে দেয়। “আপনি খুব ক্লান্ত। একটু ঘুমিয়ে নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“ঘু্মোব?,” বলতে বলতেই অনিরুদ্ধর চোখ বুজে আসে। “তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?”

দড়াম করে দরজাটা খুলে গেল। অনিরুদ্ধর সামনে একজন উর্দি পরা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। অনিরুদ্ধ বিছানায় উঠে বসল।

এত অনিরুদ্ধর নিজের শোওয়ার ঘর! হোটেল ভিস্তা কোথায় গেল?

“দুটো বডিই পাশের ঘরে আছে,” বলতে বলতে আরেকজন পুলিশ ঘরে ঢুকে এল। “মনে হচ্ছে ফুলদানি দিয়ে মাথা থেঁতলে দিয়েছে।”

আরেকজন কেউ ঘরে আছে। অনিরুদ্ধ চিনতে পারল। উলটোদিকের বাড়িতে থাকে। মিসেস সেন।

“তিন-চার দিন ধরে দরজা খুলছে না, কাজের লোক এসে ফিরে যাচ্ছে, অথচ আলো পাখা অন আছে। পিংকি...মানে শায়রি, শায়রি দে — ওর বউ, তাকেও বারান্দায় দেখছি না, মেয়েটাকেও না। ফোন বেজে যাচ্ছে, তারপর কি বিশ্রী পচা গন্ধ...”

অনিরুদ্ধ শায়রির দিকে তাকাল।

“এরা এসব কি বলছে?”

“বলছে তোমাকে ওদের সঙ্গে যেতে হবে,” শায়রি হাসিমুখে জানাল।

অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়াল। পরের মুহূর্তেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। যেন অনেকদিন বিছানা থেকে ওঠে নি। পুলিশরাই তাকে ধরে ধরে একটা গাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলল। গাড়ি স্টার্ট দিল। কাক দুটো সারা রাস্তা ফুর্তি করতে করতে চলল।

এখন অনিরুদ্ধ একটা অন্য বাড়িতে থাকে। এখানে সবই সাদা। বিছানা সাদা, বালিশ সাদা, দেওয়াল সাদা, সিলিং সাদা...যারা অনিরুদ্ধর সঙ্গে দেখা করতে আসে তাদের পোশাকও সাদা। সবকিছু শান্তিপূর্ণ, শুধু কাক দুটো সব মাটি করে। অনিরুদ্ধর মাথার ওপর উড়ে বেরায়, ঠোকর মারে। খেয়াল করে শুনলে কিসব যেন বলেও ওঠে। বড়োটা বলে “তুমি একটা পিশাচ!”

আর ছোটটা বলে“বাবা, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ!”

শায়রি অবশ্য দিনরাত অনিরুদ্ধর পাশে থাকে। ও বলেছে, অনিরুদ্ধর সময় আর কখনো শেষ হবে না।

কথাটা শুনলে অনিরুদ্ধ একটু ভরসা পায়।



(পরবাস-৮৩, ১০ জুলাই, ২০২১)