Subscribe to Magazines






পরবাসে সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়ের
লেখা

এবং বই



ISSN 1563-8685




মধুপুরের পাঁচালি

বদলি




খুবই ছোট জায়গা ছিল তখন জগদীশপুর। কে জানে, হয়তো এখনও ছোটই আছে। ছোট্ট স্টেশনের পাশে ছোট্ট চায়ের দোকান—হালরামের। সবাই হালোয়া বলে ডাকত ওকে, কিন্তু ও হালুয়া বিক্রি করত না, পুরীর সঙ্গে এমনিই দিত। মাঝে মাঝে ওখানে নানা বয়সের, নানা শ্রেণীর, নানা প্রদেশের লোক একসঙ্গে বসে আড্ডা মারত।

এই ঘটনার দিন আমি ওখানে ছিলাম না। কয়েকদিন পরে ব্যাপারটা শুনেছিলাম যার কাছে, সেই বৃদ্ধ আমাকে আরো অনেক কিছু বলেছিল, যা নিয়ে মুখ্যত এই লেখা।

ইংরিজি সাল তখন বোধ হয় ১৯৬৪। এক দিন একটা ছোট মাইকার লরি—মাইকা মানে অভ্র—কাঁচা রাস্তা ধরে পশ্চিম দিক থেকে ঢিকুতে ঢিকুতে এসে হালোয়ার দোকানের থেকে একটু দূরে দাঁড়াল। ড্রাইভার আর দুজন লোক নেমে এসে দোকানে চা চাইল। দাম দিয়ে চা খাবে, বসতে চাইতেই পারে, কিন্তু আড্ডাধারীদের কারুরই বেঞ্চি ছাড়বার কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। অগত্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে আগন্তুকরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। বোঝাই গেল প্রকৃতি একটু তাদের ডেকেছে। হালোয়া একটু দূরের একটা ঝোপ দেখিয়ে দিল, চায়ের দাম দিয়ে ওরা সেদিকে গেল। আর যেই না যাওয়া, দোকানের দুজন আড্ডাবাজ উঠে গিয়ে লরির মধ্যে দেখতে গেল উঁকি মেরে।

আমাদের বিহারে (তখনো ঝাড়খণ্ড হয়নি) ব্যাপারটা কিন্তু খুবই স্বাভাবিক। একটা লরি দাঁড়িয়ে রয়েছে, কাছে একজন কেউ নিষ্কর্মা বসে রয়েছে, লরিটা একবার দেখে নিতে হবে না? বাঃ!

ছিটকে ফিরে এল লরির কাছ থেকে ওই দুজন। লরিতে নাকি কাপড় ঢাকা দিয়ে শোয়ানো রয়েছে তিনটি মৃতদেহ!

প্রাকৃতিক কর্ম সেরে লোক তিনজন আর দোকানে এলই না, সোজা লরিতে উঠে হাওয়া। লরির নম্বর পড়ার মতো লেখাপড়া আড্ডায় কারুরই ছিল না।


জগদীশপুরে একটা ফাঁড়ি ছিল বটে, কিন্ত মুলুক থেকে বাঘ উঠে যাওয়ার পর আঠারো ঘায়ের দায়িত্বটা পুলিশের ছোঁওয়ার ওপর বর্তেছে, তাই কেউ আর পুলিশকে খবরটুকু দিল না।

কয়েকদিন পর আমাদের ডাকঘরে অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় হরিলাল বলে আমার পরিচিত একজন অবসরপ্রাপ্ত গোছের বৃদ্ধ আমাকে খবরটা দিল। এবং সেই সঙ্গে বলল যে আমি সঙ্গে থেকে যদি সেই অষ্টাদশ আঘাত সামলে দিই তাহলে সে কোতোয়ালিতে গিয়ে দারোগা মিঞাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে দেবে।

এই হরিলাল এককালে শহরে ড্রাইভারি করেছিল। মিহিজামে। ইঞ্জিন কারখানা তৈরি হওয়া নাগাদ রিটায়ার করে চলে আসে। এই সব কারণে ডরভয়টা একটু কমের দিকে ছিল ওর। কিছুক্ষণ ধরে বুঝিয়েসুঝিয়ে আমিই ওকে আরো সাহস জুগিয়ে কোতোয়ালিতে পাঠিয়ে দিলাম। কী দাঁড়ায় তা আমাকে পরের দিন বলবে, এই কড়ারে।

আরেকটু শিবের গীত শুনে নিন পাঠিকা, ধান কটা তার পরেই ভেনে নেওয়া যাবে।

পরের দিন হরিলাল আমাকে বলল একটা গল্প। সত্যমিথ্যা জানি না। কোডারমা, যেদিক থেকে কাঁচা রাস্তা ধরে লরিটা এসেছিল, এককালে নাকি ছিল সারা পৃথিবীর অভ্রের কেন্দ্র। অভ্র হলো এমন একটা টেঁকসই পদার্থ যার মধ্যে দিয়ে তাপ যায় কিন্ত বিদ্যুৎ যায় না। অনন্য বস্তু, নানা স্থানে অপরিহার্য। কোনো একটা যুদ্ধটুদ্ধর সময়ে জার্মানরা না কারা যেন কৃত্রিম অভ্র বানিয়ে ফেলে, আর তার পর কোডারমার খনিগুলোও নাকি আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসে। তাই ও ব্যবসায়ে নাকি আগের মতো রমরমা আর নেই। অনেক খনি বন্ধ, কিন্ত জঙ্গলে ঝোপে ঝাড়ে নাকি প্রচুর অভ্রের টুকরো পাওয়া যায়। সরকারি বারণ থাকা সত্ত্বেও গ্ৰাম্য আদিবাসী লোকজন সেগুলো কুড়িয়ে ব্যবসাদারদের বিক্রি করে। ঝগড়াঝাঁটি খুনজখম লেগেই থাকে ওদিকে। যারা খুনটুন হয় তাদের কঙ্কালগুলোর আবার শহরের কলেজে বেশ চাহিদা। ওই লরির লাশ তিনটিও শহরে যাচ্ছিল, অন্তত হরিলালের তাই ধারণা।

আমি জিজ্ঞেস করলাম—তুমি চাচা বরখুরদার এ সব জানলে কী করে?

হরিলাল বলল যে বহুদিন ও ওইসব দিকে গাড়ি চালিয়েছে, তারপর, সেও নাকি অনেক কাল, ও "বদলি" হয়ে যায়।

আমি—কী রকম?

হরিলাল যে গল্পটি আমাকে শোনায় সেটিই আমি এবার একটু ছাঁদ বদলে, হয়তো বা একটু রং চড়িয়ে আপনাদের বলছি।


একদিন মিহিজাম শহরে এক বাঙালি ব্যবসায়ীর বাড়িতে উৎসব। বিরাট ভোজের ব্যবস্থা হয়েছে। ভদ্রলোকের একমাত্র ছেলের বউভাত। কলকাতায় বিয়ে হয়েছে দুদিন আগেই। অভ্যাগতরা আসতে শুরু করেছেন। হাকিম সাহেব, পুলিশ সাহেব, ই.আই.আর.-এর ইংরেজ আমলারা, আরো অনেক গণ্যমান্য দিশি বিলিতি লোকজন।

একখানা ঝকঝকে নতুন মোটরগাড়ি এসে দাঁড়ালো। কোনো অতিথি বসে নেই ভেতরে। শুধু বিলিতি উর্দিপরা একজন ড্রাইভার, তার মাথায় একটা টুপি, আর সেই টুপিতে আবার একটা বারান্দা।

হন্তদন্ত হয়ে "কে না কে এসেছেন" ভেবে গৃহস্বামী এগিয়ে আসতে আসতেই আরেকখানা মস্ত বড়ো গাড়ি এসে পড়ল। তারপর সেটার থেকে নেমে এলেন এক ভদ্রলোক। নতুন বরের হকচকিয়ে ওঠা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললেন—কৃষ্ণপ্রসাদের গাড়িটা পৌঁছে দিতে এলাম, বুঝলেন? ওকে বলেছিলাম না? আর মেয়ে আমার পছন্দ করে দুয়েকটি জিনিস কেনাকাটা করে রেখেছিল, সে সব আপনার নতুন বউমাকে আপনারা একটু দিয়ে দিলে কৃতার্থ হব, মেয়েটার আত্মাও সুখী হবে। বউবাজারের ডিজাইন সব পছন্দ হলেই হলো… না না, একদম কিচ্ছুটি না, সোজা কোডার্মা ফিরব… আচ্ছা একটা মিষ্টি দিন।

দুজনেরই চোখ ভিজে।

...

...

বছর তিরিশ আগে কোডার্মার কাছে একটা খনির মালিক ছিলেন এক বাঙালি ব্যবসাদার। অত্যন্ত ভালো ছিলেন ভদ্রলোক। ম্যানেজার, কেরানি, কুলি, কামিন, মেকানিক, ড্রাইভার সবাই ভালোবেসে প্রাণ দিয়ে কাজ করত তাঁর খনিতে। মস্ত ধনীও ছিলেন। বিপত্নীক, একমাত্র মেয়ে শ্যামলীই সংসার চালাত তারানাথবাবুর। আবার প্রায়ই খনিতে চলে যেত সেখানকার কাজ দেখতে আর বুঝতে।

ওই হরিলাল ছিল তারানাথবাবুর সর্দার ড্রাইভার।

যথাসময়ে মিহিজামের এক বাঙালি ব্যবসায়ী হরপ্রসাদবাবুর ছেলের সঙ্গে শ্যামলীর বিয়ে ঠিক হলো। দিনক্ষণ পাকা হলো কয়েক মাস পরে। শ্যামলীর সঙ্গে কথা বলে, হরপ্রসাদবাবুর অনুমতি নিয়ে সবরকম কেনাকাটা করে ফেললেন তারানাথবাবু। কেনা বাকি রইল শুধু কলকাতা থেকে নতুন মোটরগাড়িটি।

কে জানে কী করে, হয়তো খনির ধুলোবালির জন্যেই, হঠাৎ নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হলো শ্যামলীর। কিছুদিন কষ্ট পেল, আসানসোল, গয়ার বড়ো ডাক্তাররাও কিছু করতে পারলেন না, নিজের বিয়ের নির্ধারিত দিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে মেয়েটি।

সিনেমার মতো এই কাহিনীর আরো আছে।

প্রায় বছরখানেক বাদে তারানাথবাবু খবর পেলেন যে হরপ্রসাদবাবু কলকাতায় ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন, কয়েকদিন পর মিহিজামে বউভাতের ভোজ।

পরের দিন হরিলালের গাড়িতে কাজে গিরিডি আসছেন তখনো শোকসন্তপ্ত তারানাথবাবু, গাড়ি গেল বিগড়ে। মেকানিক সব সময়েই সঙ্গে থাকত যন্ত্রপাতি ইত্যাদি নিয়ে, খুটখাট সারানো শুরু হয়ে গেল। আগুনের মতো খরকর সূর্যের হাত থেকে বাঁচতে তারানাথবাবু জঙ্গলের ধারে একটা মোড়া পেতে বসে পড়লেন। একটু ঝিমুনি এসে গেল, চটকা ভাঙল হরিলালের "বাবু, গাড়ি তৈরি" ডাকে।

উঠে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনতে পেলেন পিছন থেকে মেয়ের গলার আওয়াজ—তোমার গাড়ি তো তৈরি হয়ে গেল বাবা, যাকে গাড়ি দেবে বলেছিলে তার কী হলো?

হরিলাল আর মেকানিক ছোকরাও শুনতে পেয়েছিলো, প্রয়াতা দিদিমণির গলাও চিনতে পেরেছিল তারা।

একটু চুপ করে থেকে গাড়ি থামিয়ে রাখতে বলে একটা চিঠি লিখলেন তারানাথবাবু। গিরিডি পৌঁছে হরিলালকে বললেন—এই চিঠি আর এই রাহাখরচ নে, কলকাতায় অস্টিনের দোকানে চিঠিটা দেখালে নতুন গাড়ি পাবি, ভালো করে দেখে নিয়ে তেলটেল ভরে সাবধানে আসানসোলের আপিস বাড়িতে আসবি। আর শোন, এই ফর্দ-মাফিক যা যা লিখলাম কলকাতার আপিসে বলে জোগাড় করবি। যা এখন।

হরিলাল গাড়ি কিনতে গেল গিরিডি থেকে মধুপুর হয়ে কলকাতা, আর মেকানিক গাড়ি চালিয়ে তারানাথবাবুকে ফিরিয়ে আনল কোডার্মায়।

নির্দিষ্ট দিনে নতুন উর্দি-টুপি পরে নতুন মোটর চালিয়ে কলকাতা থেকে গ্ৰ্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে আসানসোল পৌঁছে হরিলাল মালিকের কাছে শুনল যে সে সেদিন থেকে মিহিজামে বদলি হলো, মাইনেপত্র সব ঠিক সময়ে মাসে মাসে পেয়ে যাবে। এখন তাড়াতাড়ি কোডার্মা থেকে আসা বাক্সটাক্সগুলি নতুন গাড়িতে তুলে নিয়ে তারানাথবাবুর গাড়ির সামনে সামনে মিহিজাম চলুক।

এই হলো হরিলালের কোডার্মা থেকে মিহিজাম "বদলি" হওয়ার ইতিহাস!



(পরবাস-৮৩, ১০ জুলাই, ২০২১)