Subscribe to Magazines






পরবাসে সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়ের
লেখা

এবং বই



ISSN 1563-8685




মধুপুরের পাঁচালি

অ্যাল্‌ফন্সো




ন্ডনের সেন্ট প্যাঙ্ক্রাস স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে ডোভার। তারপর ফেরিতে ফ্রান্সের ক্যালে। আবার ট্রেন ধরে ইটালির ব্রিন্দিসি - পরে ওটা ব্রিন্দিসির বদলে ফ্রান্সের মার্সেলেস হয়ে যায়। তারপর "মুলতান" বা "মলডাভিয়া" জাহাজে পোর্ট সৈয়দ, এডেন হয়ে বম্বে। আবার ট্রেন। ইম্পিরিয়াল ইন্ডিয়ান মেল। ব্যালার্ড পিয়ারের গায়ে মোলে রেল স্টেশন থেকে ছাড়ত। চারটি বিলাসবহুল ইওরোপীয়ান ক্লাস কামরা, একটি কামরা রান্নাঘর, একটি রেস্টোরেন্ট-কাম-বার, একটি নেটিভ অ্যাটেন্ড্যান্টস ও ক্রূ, একটি ইংরেজ গার্ড আর মালপত্র ও চিঠিচাপাটি। বিশ্বশ্রেষ্ঠ এই রেলগাড়িতে চেপে পেনিনসুলার অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল কোম্পানির শ্বেতাঙ্গ যাত্রীরা জবলপুর, "এলাহাবাদ" হয়ে কলকাতা পৌঁছতেন। যাঁদের টিকিট রেঙ্গুন বা সিঙ্গাপুরের তাঁরা হাওড়া ঘাট থেকে ফেরি পেরিয়ে উট্রাম ঘাটে ওই কোম্পানিরই জাহাজ পেয়ে যেতেন। তক্ষুণি।

ট্রেনটির অংশীদার ছিলেন ওই P&O কোম্পানি। আরো অংশীদার ছিলেন গ্ৰেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে, ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে। এটি কিন্তু চিরাচরিত চার নম্বর ডাউন ভায়া এলাহাবাদ বম্বে মেল নয়। এতে কৃষ্ণাঙ্গরা স্থান পেতেন না।

এলাহাবাদ কথাটি, লক্ষ করে থাকবেন, ইনভার্টেড কমার মধ্যে। তার কারণ, যদিও রূটটা মোটামুটি বোঝাবার জন্য via Allahabad বলা হতো, কিন্ত এলাহাবাদে ঢুকে, ইঞ্জিন উলটে আবার পিছিয়ে বেরোতে অনেক সময় লেগে যেত, আর সেই জন্যে একটি loop line দিয়ে "ইম্পিরিয়াল" এলাহাবাদ এড়াতো। এখন ওই লূপে হয়েছে "এলাহাবাদ ছেওকি" স্টেশন। সরি, "প্রয়াগরাজ ছেওকি" স্টেশন।

১৯৬২র শেষ দিকে চালু হলো স্বল্পজীবী হাওড়া বম্বে বাই-উঈকলি জনতা এক্সপ্রেস। ভায়া পাটনা, এলাহাবাদ। শুধু থার্ড ক্লাস কামরা থাকত। এবং সেই পুরনো সময় বাঁচানোর তাগিদে ছেওকি লূপ নিতো ট্রেনটি, এলাহাবাদ এড়িয়ে। নাম কিন্ত সেই ভায়া এলাহাবাদ। ছেওকিতেও দাঁড়াত না ও ট্রেন।

১৯৬৩ সালের গ্ৰীষ্মে দুটি ক্রেট ভর্তি করে কিছু অ্যাল্‌ফন্সো আম বম্বে থেকে "এলাহাবাদ" যাওয়ার চেষ্টা করছিল। ভ্রান্তিবশত ওই ট্রেনটিতে করে। বহুদূর চলে আসার পর ঝাঝায় লোকের নজরে পড়ে যায় ততক্ষণে বেওয়ারিশ হয়ে যাওয়া নিরীহ ওই ক্রেট দুটি।

দাবানলের চেয়েও দ্রুতগতিতে ওই সুসংবাদ আমাদের মধুপুরে পৌঁছে যায়। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে হুঈলারের আশপাশ ভরে যায় আমাদের দলে। চূড়ান্ত উত্তেজনা - সময় থাকলে হয়তো গার্ড আর ড্রাইভারকে মালা পরিয়ে দেওয়া হতো। আমাদের সুপরিচিত ঝাঝা-আসানসোল "অ্যাংলো" গার্ডসায়েব কাঁচুমাচু মুখে তাকিয়ে রইলেন, বিজয়োল্লাসে আমরা ক্রেট দুটিকে হুঈলারের ঘরে ঢুকিয়ে নিলাম।

বিহারিদের মাস্টার-সাব, যিনি বাঙালিদের ছিলেন মাস্টার-মশাই, আদতে স্টেশনমাস্টার, তিনি এগিয়ে এসে আমাদের গোলমাল থামিয়ে প্রথমেই একটা কাগজে গার্ড সাহেবকে দিয়ে সই করিয়ে নিলেন। পরে জেনেছিলাম যে কাগজটিতে নাকি লেখা ছিল যে দুটি ক্রেটের মাল পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল বলে মধুপুর জংশনে নামিয়ে দিতে হয়েছে।

ততক্ষণে একটা লোহা দিয়ে চাড় লাগিয়ে ক্রেট ভেঙ্গে পাটনা থেকে সদ্য আসা সার্চলাইট কাগজে কয়েকটা আম মুড়ে গার্ডসাহেবের কামরায় তুলে দেওয়া হয়েছে। হাসিমুখে সিটি বাজিয়ে সবুজ নিশান উড়িয়ে তিনি আসানসোলের দিকে ট্রেন নিয়ে চলে গেলেন।

আর তার পর রেলবাবুরা আমাদের সবাইকে চারটে করে আম বিতরণ করলেন। প্রায় রোলকল ডেকে। নতুন ধরনের ফিকে গন্ধে চারিদিক যাকে বলে ম' ম' করছিল। আমাদের মধ্যে কেউ কখনো ওই আম চক্ষে দেখিনি। বোম্বাই আম বলতে আমরা অন্য একটা আম জানতাম, তার সঙ্গে ক্রেট ভেঙে বার করা ওই আমের কোনো সম্পর্কই ছিল না।

খেয়ে দেখা গেল অসাধারণ মিষ্টি আমগুলো। তবে আমি অন্যদের মতো ওখানে দাঁড়িয়ে অসভ্যতা করে ওই আম খাইনি। বাড়ি নিয়ে গিয়ে দিদাকে কী সব বুঝিয়েছিলাম। ওই বন্ধু-টন্ধু জামাইবাবু-টামাইবাবু এই রকম আর কি।

অসামাজিক জনসাধারণের এই ধরনের আচরণের জন্যই বোধ হয় ভারতীয় রেলের আজ এই দুরবস্থা।

তা আমি আর তার কী করব বলুন?



(পরবাস-৮৩, ১০ জুলাই, ২০২১)