সর্পবীজ
হেমন্ত-বিকেলে মাঠে গায়ে কাঁটা-দেওয়া হিম পড়ে।
বেড়িয়ে উঠোনে এসে ঘষা ধোঁয়াশায় বসে
কী ভাবো কী পড়ন্ত প্রহরে?
পোষাকের নীচে যত চোরকাঁটা থাকে লেগে
স্মরণাগতর মতো পায়ে আশ্রয় মেগে
খুঁটে তা উঠোনে ফ্যালো আত্মগত নিরাবেগে
অজান্তেও কিছু ঝরে পড়ে।
ঋতু ফুরিয়েছে আজ, পাতাঝরা কাঁটাসাজ
সময়ের অভ্রান্ত আঁচড়ে।
বাতাসের স্পর্শে শোনো নিরাশানিঃশ্বাস দেহহীন।
নিঃশব্দ সে শীতশ্বাসে পাঁশুটে আকাশে ভাসে
স্মৃতিছবি সঙ্গতিবিহীন।
রোদের যে-ওমটুকু শালের মতন গায়ে
পড়ে ছিল, সেও ক্রমে শতদীর্ণ কাঁথায়
বদলালো। ছেঁড়া আলো মুখে-পড়া সন্ধ্যায়
শেষ হয়ে গেল আজ দিন।
শুখো মৌচাক ঝোলে ন্যাড়া মহুয়ার কোলে
মৌমাছিরা কোথায় বিলীন।
খেয়াল করোনি কবে সর্পকুশ ছাড়িয়ে নখেতে
ফেলেছিলে আনমনে সময়ের এ-উঠোনে
দায়ভাগ থেকে মুক্তি পেতে।
জানতে না, সে-অঙ্কুর অঙ্কুশেতে বেড়ে শেষে
এ নেভা হেমন্তকালে বিষদাঁত মেলে এসে
হঠাৎ ছোবল মেরে পায়ে অতীতের বেশে
নীল করে দেবে এ-জগতে—
বিদায়ী সাপের মাপে স্মৃতি ছেড়ে রেখে যাবে
ফেলে-দেওয়া ফাঁপা খোলসেতে।
জলতটে তুমি
এ তো ভিজে বালি। তুমি এইখানে খেলাঘর পাতবে?
এখানে সাগর আসে মাঝে মাঝে। বিবাগী কল্লোল
মুছে দেয় যত লেখা আঁকাবাঁকা সোনালি সঙ্কট,
মিলে যায় যত চাওয়া, অপ্রত্যাশা, অচির জমিতে।
এখানে কি কোনোদিন স্থিতধীর কুঁড়ে কি প্রাসাদ
কালপুরুষের সঙ্গে সম্বন্ধ পাতায়? শুধু কর্কটকঙ্কাল
স্তূপীকৃত পড়ে থাকে। অসময় এখানে স্বরাট্।
হাওয়ার ঝাপটা আসে হুহু করে। অসংলগ্ন কাঠ
দড়ি দিয়ে বেঁধে কারা ঊর্মিতে সওয়ার—মুঠে ধরা
জীবনের হাল। তুমি দৃষ্টিতে তাদের গেঁথে মিহি বালি দিয়ে
যত দৃঢ় দুর্গ গড়ো, জোয়ারের জল
তত বেশি পা ভেজায়। আঙুলের খাঁজে খাঁজে বালি
ভবিষ্যনির্দেশ করে। তবু তুমি খেলাঘর গড়ো।
পা ডুবিয়ে দেখেছো কি, কতদূর নীচে মোটা জমি
পেশল আঘাত করে গোড়ালিতে, সবল আশ্বাস
স্নায়ু বেয়ে উঠে আসে? শেকড়ে যে নির্মম পেষণ
মাটি হানে, তা-ই ফোটে কুসুম-উল্লাসে।
এবার অতলে নামো। পা ডোবাও—
ভাঙা কাঁচ, লোহা, বালি, ঝিনুকের ছুরি
চিরে দেবে। তারই নীচে স্বপ্নের প্রস্তুতি।
ভিলানেল: সে যাবে না
দেয়ালে কে মাথা ঠোকে। দোর খুলে দিই : সে যাবে না
অন্ধকূপ জুড়ে তার চোখ-বোজা পা-চারি থামিয়ে
বাইরে, যেখানে নীল ফুলে বাঁকা ঝলকায় সোনা
সকালে। অপরাজিত আলো দোলে, ঊর্ণাজালে বোনা
কাঁচের শিশিরহারে শির্শির্ শিহর ছাপিয়ে
দেয়ালে কে মাথা ঠোকে। দোর খুলে দিই : সে যাবে না
যেখানে শালিখ ডাকে সঙ্গিনীকে তার, যায় শোনা
ফড়িঙেরা ওড়ে স্বচ্ছ ডানা মেলে বাতাস কাঁপিয়ে
বাইরে, যেখানে নীল ফুলে বাঁকা ঝলকায় সোনা
সপ্রতিভ রোদে। ঘাসে গাছের পত্রালী আলপনা
আঁকে। বুঝি সেইখানে ভয় আছে ভেবে ভয় পেয়ে
দেয়ালে কে মাথা ঠোকে। দোর খুলে দিই : সে যাবে না
মাথার আঁধার থেকে প্রভাতী বাগানে। জানাচেনা
আশঙ্কা জাগায়, তাই উচ্ছল জীবন গেলে বয়ে
বাইরে, যেখানে নীল ফুলে বাঁকা ঝলকায় সোনা
সেখানে যাবে না। শুধু অন্ধকারে গাঢ় দুর্ভাবনা
অনন্ত উদ্বেগ আর একগুঁয়ে পায়চারি নিয়ে
দেয়ালে কে মাথা ঠোকে। দোর খুলে দিই : সে যাবে না
বাইরে, যেখানে নীল ফুলে বাঁকা ঝলকায় সোনা।
(পরবাস-৮৪, ১০ অক্টোবর, ২০২১)