(একে চন্দ্র, দু’য়ে পক্ষ। সমুদ্র মন্থনেও দুই দল, এ ধরেছে শেষনাগের মাথা তো ও মুড়ো। এদিকে বিষ্ণুর মোহিনী মায়ায় সব লণ্ডভণ্ড। উঠল গরল, উঠল অমৃত। ভাই–ভাই ঠাঁই–ঠাঁই হল। আজও সেই দায় বয়ে চলেছি আমরা। এটি তারই এক আখ্যান, এক বাঙাল কিশোরের চোখে। এর ইতিহাস হওয়ার দায় নেই।)
সিরিয়াস সিনেমায় সত্যজিৎ-মৃণাল এবং ঋত্বিক। প্রথম দুজনের দ্বৈরথে ‘এ ক্রো- ফিল্ম ইজ এ ক্রো- ফিল্ম’ এবং ‘এ ফিল্ম ইজ এ ফিল্ম’ আমাদের মহাবচনের বাঁধানো খাতায় উঠে গেছে।
সত্যজিৎ এবং মৃণালকে কেন্দ্র করে দুটো মহা সিনে ক্লাব, আঁতেলদের আড্ডা? কিন্তু দুই দশকের মধ্যে শহর-শহরতলী এবং মফস্বলে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছিল একগাদা সিনে ক্লাব। আমার এক বন্ধুর ছিল ছ’টা ক্লাবের কার্ড। ওর সঙ্গে গেছি কখনও নতুন তৈরি নন্দন, কখনও গোর্কি সদন। কিউবান, আমেরিকান, চেক ফিল্ম। জনগণেশের (আম্মো) বেশির ভাগ ইচ্ছেটা আনসেন্সর্ড বিদেশি ফিল্ম দেখার আশায় ডানা মেলে!
জনপ্রিয় সিনেমায় উত্তমকুমার এবং সৌমিত্রকে ঘিরে ভক্তদের দুটো শিবির। কিন্তু মহানায়িকা সুচিত্রার ধারে কাছে কোন নায়িকা নেই। “সুপ্রিয়া যেন সোফিয়া লোরেন” বলে একটি সিনেমার বিজ্ঞাপন ছিল বটে, ধোপে টেঁকেনি।
দূরদর্শন আসেনি, তাই আকাশবাণীর সংবাদ পরিবেশক এবং ভাষ্যকার বিজন বোস, ইভা নাগ, নীলিমা সান্যাল, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং খেলার মাঠের অজয় বসু, কমল ভট্টচাজ এবং পুষ্পেন সরকারদের প্রায় কাল্ট স্ট্যাটাস।
বেতার নাটক হত সম্ভবত প্রতি বৃহস্পতিবার রাত আটটায়। অধিকাংশ নাটকের প্রযোজনায় বাণীকুমার — মহালয়ার প্রোগ্রামটির জন্য বাঙালি আজও যাকে বছরে একবার স্মরণ করে। নাটক হত ‘তটিনীর বিচার’, 'মাধবীকঙ্কণ’, ‘কানু কহে রাই’। একবার শুনেছিলাম শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রের অভিনয়ে ‘ছেঁড়াতার’।
কিন্তু আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার আসল আকর্ষণ ছিল শনি-রোববারের ‘অনুরোধের আসর’। তাতে পুজোর সময় বিশিষ্ট শিল্পীদের যে ৭৫ আরপিএমের রেকর্ড বেরোত (দু’পিঠে দুটো), তার গানগুলো বাজানো হত। সেসব দিনে বিবিধ ভারতীর অনুকরণে --ঝুমরিতলাইয়া থেকে বচকামল--অনুরোধকর্তাদের নাম-ঠিকানা বলা হত না, কোন রেডিও জকি থাকত না। ফলে গান অনেক বেশি শোনা যেত। বিশেষ করে প্রতিবছর সলিল চৌধুরির কথা ও সুরে লতা এবং হেমন্তের গানগুলোর আলাদা জনপ্রিয়তা ছিল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কথা বলা বাহুল্য। মনে পড়ছে শচীনকর্তা, মানবেন্দ্র, তরুণ, দ্বিজেন, তালাত মামুদ এবং আশা ভোঁসলে, ইলা বসু ও আলপনার কথা। তখন আজকের মত ঘন ঘন অ্যালবাম বেরোত না। রেডিওয় রোজ সকালে নিয়ম করে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি ও অতুলপ্রসাদ শোনা যেত। আর ছিল পল্লীগীতি, লোকগীতি শব্দটার চল ছিল না।
এভাবেই চোঙাওলা হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দম দেওয়া কলের গান আজ মিউজিয়াম পিস। কুকুরের ছবিওলা ‘সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন’ স্লোগান অপ্রাসঙ্গিক। অপ্রাসঙ্গিক নিবের কলম এবং সুলেখা কালি — রয়্যাল ব্লু বা জেট ব্ল্যাক।
চলুন, রেলে চড়ে সেই ষাট বছর আগের কোলকাতায় নামা যাক। তবে আমার অন্যতম বন্ধু কল্লোল দাশগুপ্তের তৈরি এই ভিডিওটি “এ ওয়াক ইন দ্য পার্ক স্ট্রিট” দেখে নিতে পারেন। তাতে পাবেন কোলকাতার ৯০ বছর বয়েসি ইহুদি মহিলার স্মৃতিতে ১৯৪০-৬০ সালের পার্ক স্ট্রিটের ফোটোগ্রাফ। লিংক দিচ্ছিঃ https://www.youtube.com/watch?v=DrQyLPob5Fc
বাঙালির গল্প রেলগাড়ি বাদ দিয়ে হয় নাকি? অপু-দুর্গা? রবীন্দ্রনাথের রেলগাড়ি নিয়ে গল্প কবিতাগুলো? রেলের চাকরিসূত্রেই বাঙালি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে, উপনিবেশ গড়েছে।
ধরুন, আপনি পঞ্চাশ-ষাটের দশকে হাওড়া স্টেশনে নেমেছেন। প্ল্যাটফর্ম কুল্লে ১৫টি। নতুন স্টেশন, মানে সাউথ অংশটা তখন কারো স্বপ্নেও ধরা দেয়নি। ট্রেনে তিনটে ক্লাস — ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ডক্লাস। ঠিক যেন পরীক্ষার মার্কশিট। সেকেন্ড ও থার্ডক্লাসের তফাৎ একটাই। কাঠের বেঞ্চিতে রেক্সিনের গদি আছে অথবা নেই। চোখে পড়বে ট্রেনের গদি এবং দেয়াল সব তাতে সবুজ রঙ আর বাইরে ট্রেনের গায়ে ইঁটের মতো লালরঙ।
কয়লার ইঞ্জিন। কান ফাটানো কু-উ-উ শব্দে সিটি মেরে দুলতে শুরু করে, তারপর ভোঁস ভোঁস শব্দে চলে এবং জল ছাড়ে, ঠিক যেন বুনো মোষ। জানলা দিয়ে ধোঁয়া থেকে চুঁইয়ে আসা কয়লার গুঁড়ো জামাকাপড়ে চুলে এবং চেহারার ছাপ ফেলে যায়। তবে চলার ছন্দে কাহরবা বাজে — ধাগে নাতি নাকা ধিন, ধাগে নাতি নাকা ধিন। বাচ্চাদের কানে বাজে — তুমি থাক, আমি যাই; তুমি থাক, আমি যাই।
এসি মানে আজকের “বাতানুকুলিত কামরা”? না মশাই। আর ইন্টারক্লাস নাম শুধু গল্পের বইয়ে বেঁচে আছে।
কিন্তু দুটো পরিবত্তোন ওই দুই দশকে হয়েছিল।
এক, ১৯৫৭ নাগাদ এল ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন, শুধু লোক্যাল ট্রেনের জন্যে। বড়দের হাত ধরে দেখতে গেলাম — সবুজ হলুদ রঙ, হুইসল দেয় শাঁখের আওয়াজে।
আর দুটো হুইসিল বাজিয়েই স্পীড তোলে। তাই গেটের কাছে দাঁড়াতে এবং ফুটবোর্ডে ঝুলতে মানা। সে বছর ইস্টার্ন রেল কোলকাতা ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে হইচই ফেলে দিল। চুনী-বলরাম- ভেঙ্কটেশ-ধনরাজ-ওমর-সালাউদ্দিনদের ভিড়ে সবাই শুনল দুটো নতুন নাম — রাইট আউট পিকে ব্যানার্জি এবং কোচ তেজেশ ওরফে বাঘা সোম। আর ওদের লেফট হাফ নিখিল নন্দী সম্ভবত ন্যাশনাল টিমে জায়গা পেয়েছিলেন।
কিন্তু প্রতিভাবান অল্পবয়েসি অসীম সোম ওই ইলেক্ট্রিক ট্রেন হঠাৎ স্পীড নেওয়ায় পা হড়কে ট্রেনে কাটা পড়লেন। এই শোক বাবা তেজেশ সোম সামলে উঠতে পারেননি। ইস্টার্ন রেল, যতদূর জানি, দ্বিতীয়বার লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়নি।
দুই, কয়েক বছর পর ষাটের গোড়ায় এল থার্ড ক্লাস স্লীপার। সামান্য রিজার্ভেশন চার্জ দিয়ে প্রত্যেক সারিতে তিনটে করে সবুজ কাঠের পাটাতন, তাতে গদি জুড়ল আরও ক’বছর পরে। এরপর সেকেন্ড ক্লাস বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেছে ডাকগাড়ির ডাইনিং কার, তার জায়গায় এসেছে প্যান্ট্রি কার।
দূর দূর! কীসে আর কীসে! চাঁদে আর পোঁদে! নেতাজি বনাম পেঁয়াজি? তখনও রেলের একটা ক্লাস ছিল, ব্রিটিশ যাবার পরেও। কয়লার ইঞ্জিন বিদেয় নিয়েছে, মাঝে দু’দশক ডিজেল ইঞ্জিন। চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্ক্স পটল তোলায় একসময়ের ‘কারানগরী’ (অমল দাশগুপ্তের এই নামের বইটি দেখুন) আজ মৃত।
সে যাকগে, আপনি যদি বিশালকায় হোল্ড-অল আর স্যুটকেস নিয়ে নেমেছেন তো লালজামা লালগামছা কুলিদের শরণাপন্ন হতেই হবে। আজকের নীল বা সবুজ জামা কোথায়? হারিয়ে যাবার ভয় নেই, সবার হাতে তাবিজের মতো করে বাঁধা পেল্লায় এক একটি পেতলের চাকতি, তাতে নম্বর লেখা। ওটা মনে রাখলেই হবে। ট্যাক্সির প্রি-পেড বুথ বা স্ট্যান্ড কিস্যু নেই। মিটারে যায়, শেয়ারে যায়। কখনও সামান্য দরাদরি। দুই থেকে পাঁচটাকায় হাওড়া থেকে পার্কসার্কাস।
হালকা মালপত্র হলে ট্রাম বা বাসে চড়ে বসুন। সাবওয়ে উড়ালপুল কিছু হয়নি। ফলে ট্র্যাফিক জ্যাম, বড়বাজার পেরিয়ে হ্যারিসন রোড — আজ মহাত্মা গান্ধি রোড — বা ডালহৌসি পেরোতে পেরোতে আধঘন্টা। ট্রামে ফার্স্টক্লাসের ভাড়া দশ নয়া পয়সা, সেকেন্ড ক্লাসের আট। দশ নম্বর বাসে দোতলা আছে। তাতে চড়ে দশ পয়সায় পার্কসার্কাস ট্রাম ডিপো বা বেকবাগান স্টপে নামুন।
মাইরি! ঢপ দিচ্ছি না, মিথ্যে বললে পরের জন্মে কালীঘাটের ঘেয়ো কুকুর হয়ে জন্মাব।
তখন টাকার দাম ছিল। আমার বাবা ১৯৪৯ সালে মিলিটারিতে ৬৫ টাকা মাইনে পেয়ে বিয়ের টোপর পরেছিলেন। আমাদের পার্কসার্কাস বাজারের সামনে তিনকামরা বাড়ির ভাড়া ছিল ৪৮ টাকা। ৬০ বছর পেরিয়ে গেল, বাড়ির মালিকানা তিনবার হাতবদল হল, কিন্তু ভাড়া সেই ৪৮ টাকা।
পঞ্চাশের দশকে এক পয়সা ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কোলকাতায় বড় আন্দোলন হয়েছিল, গুলি চলেছিল, লোক মারা গেছল।
সে যাকগে, আপনি ট্রামলাইন পেরিয়ে নাসিরুদ্দিন রোডের পাশ কেটে ঝাউতলা রোড, পার্ল রোড হয়ে ধাঙড় বাজারের সামনে সার্কাস হোটেলের উল্টোদিকে ১ নম্বর সার্কাস মার্কেট প্লেসের আঙিনায় চার আনার রবাবের বলে ক্রিকেট খেলতে থাকা বাচ্চাদের পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ১সি ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে খটখটিয়ে কড়া নাড়লেন। তার আগে দরজার পাশে সবুজরঙা লেটার বক্সে — যার গায়ে সাদা রঙ দিয়ে লেখা “দি রয়েজ” — আঙুল ঢুকিয়ে দেখলেন কোনো চিঠিপত্তর পড়ে আছে কিনা?
আজকাল কেউ কাউকে চিঠি লেখে না, কর্নেলকে না, বাবা-মাকে না, অফিসের বসকে না, প্রেমিকাকেও না। তার বদলে চলছে ই-মেল, মোবাইলে মেসেজ ও হোয়াটস অ্যাপ।
কেউ আর টেলিগ্রামে “মাদার ইল, কাম শার্প” লিখে মিথ্যে বার্তা পাঠায় না। বন্ধ হয়ে গেছে টেলিগ্রাম বিভাগ, চলন উঠে গেছে পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ডের। পাপ বিদেয় হয়েছে।
এবং সুকান্তের ‘রানার’ কবিতা বা তারাশংকরের ‘ডাক-হরকরা’ গল্প এখন অপ্রাসঙ্গিক।
(আপনি কি সচেতন যে এই হাঁটা পথে আপনি পেরিয়ে এলেন শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রের নিবাস, বহুরূপী দলটির আবাস, সৈয়দ মুজতবা আলী ও আবু সয়ীদ আয়ুব/অম্লান দত্তের আস্তানা? এবং পবন দাস বাউলের ভবিষ্যতের সাধনসঙ্গিনী মিমলু সেনের মাইকা? কমিউনিস্ট পার্টির দক্ষিণ কোলকাতার কমিউন১ ?)
তবে এ সেই অবনীর খোঁজে রাতের কড়া নাড়া নয়, এখন সকাল। একজন টুথব্রাশ গোঁফের খাকি হাফপ্যান্ট এসে সাইকেল থেকে নেমে দুটো খবরের কাগজ গোল পাকিয়ে শণের দড়ির টুকরো জড়িয়ে টিপ করে ছুঁড়েছে, একটা বারান্দার রেলিং টপকে দোরগোড়ায় পড়েছে। আর একটা রেলিঙয়ে ধাক্কা খেয়ে ফের নীচে। এই মানুষগুলোকে বলা হত কাগজের ‘হকার’। ও পড়ন্ত বল লুফে নিয়ে আবার ছুঁড়ল — এবার নির্ভুল লক্ষ্যে। এখন বাংলায় ফিল্ডিঙয়ের মান নেমে গেছে, তাই অমন হাতের টিপওলা হকার দেখা যায় না। সবাই বারান্দা থেকে ঝোলানো দড়ির ফাঁসে কাগজটি গুঁজে খালাস। অবশ্যি তখন বেশিরভাগ বাড়িই ছিল দোতলা।
যাক, কড়ানাড়ায় কেউ একজন দরজা খুলেছেন, মুখে এক গাল হাসি — আয় আয়, ভেতরে আয়! সব ভালো তো?
আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে কারও বাড়ি যাওয়া? সে যে ভারী মানহানিকারক! বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ঢুকতে অনুমতি নিতে হবে? ছ্যাঃ!
মানছি, তখন প্রাইভেট স্পেসের ধারণাটা বাঙালিদের মধ্যে ছিল না। ছোটদের চিঠিপত্তর খুলে পড়া বড়রা অবশ্যকর্তব্য মনে করতেন, মানে ছোটদের ভালোর জন্যেই, -- ওরা কী বোঝে?
ওসব ‘সাহেবিয়ানা’ এসেছে ইদানীং ঘরে ঘরে ল্যান্ডলাইন আর বিশেষ করে ‘মুঠোফোনে’র দৌলতে।
তখন অমন ভারী ভারী লোহার কড়া প্রায় ৯৫% বাড়িতে। আজকে ওই হাতকড়ার মতন কড়া উঠে গেছে, তার জায়গায় এসেছে স্টিলের বা পিতলের ছিটকিনি –যাতে কড়ার মতনই তালা লাগানো যায়। আর এখন কড়া নাড়তে হয় না। প্রায় সব বাড়িতেই দরজার পাশে কলিং বেল। আগে কলিং বেল থাকত হাতে গোনা ঘরে--ডাক্তারবাবুর মতো পেশাদার বা অন্য হোমরাচোমরাদের বাড়িতে। আমাদের মতো হিংসুটে বাচ্চারা পা টিপে টিপে এসে কলিংবেল টিপে দিয়ে দৌড়ে পালাত।
আহাহা, টেলিফোন? সে তো সাদাবাঘের মতই বিরল। ডাক্তার, উকিল বা রাজনৈতিক নেতা এবং উচ্চপদস্থ আমলাদের কাজের জিনিস, কিন্তু আমাদের চোখে এক স্ট্যাটাস সিম্বল মাত্র। ওষুধের দোকানে গিয়ে নামমাত্র পয়সায় ফোন করা যেত। তবে এসটিডি’র জায়গায় ছিল ট্রাঙ্ককল। বুক করে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকুন। কখন ডাক পাবেন খোদায় জানেন।
তেমনই এক ‘সশ্রম একদিনের কারাদণ্ড’ ছিল কয়লাঘাটায় রেলের রিজার্ভেশন অফিসে লাইন দিয়ে ট্রেনের বুকিং করা। এর চেয়ে সিনেমা হলে ৬৫ পয়সার লাইনে দাঁড়ানো ছিল অনেক সোজা।
তখন কম্পিউটার আসেনি। সব কাউন্টারে সব ট্রেনের বুকিং হত না। ধরুন, ভিলাই যাবেন বলে বোম্বে মেলের জন্যে ফর্ম ভরে লম্বা লাইনের পেছনে দাঁড়ালেন। ঘন্টা দুই পরে যখন আপনার পালা এল তখন কাঁচ বা তারের জালের পেছনে বসা ধুতিশার্ট পরা ভদ্রলোক চশমার ফাঁক দিয়ে একনজর চোখ বুলিয়ে জানালেন – সিট/বার্থ নেই, শেষ হয়ে গেছে।
আপনি করুণ চোখে জানতে চাইলেন – বোম্বে এক্সপ্রেসে আছে কিনা?
--সেটা কি করে বলা যায়? এখন নতুন ফর্ম ভরে লাইনে দাঁড়ান। আপনার আগে ক’জন এক্সপ্রেসের জন্যে লাইনে আছেন তা তো জানিনে।
তাই ঝাঁকড়া বাবরিচুলো কাঁচাপাকা দাড়ি সত্যেন্দ্রনারায়ণ পিত্রোদা বা স্যাম পিত্রোদা আমার চোখে মস্ত বড় জাদুকর, পিসি সরকারের চেয়েও। কারণ আজ নিজের ঘরের টেলিফোন থেকে দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তে কথা বলা, এবং যে কোনো কাউন্টার থেকে যে কোনো ট্রেনের বা প্লেনের টিকিট বুক করা যায়। আর এসবই সম্ভব হয়েছে ওনার ম্যাজিক ওয়ান্ডের ছোঁয়া লেগে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিলিটারির স্বার্থে ওরা ডিডিটি দিয়ে মশককুল ধ্বংস করল। ম্যালেরিয়া তিনদশকের মতো বিদেয় হল। কিন্তু বাঙালির গড়ে উঠল চায়ের অভ্যেস। এটা বোধহয় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসার অ্যান্টিডোট। ফলে হাতমুখ ধুয়ে আপনি দেখলেন জয়েন্ট ফ্যামিলির ঘরে ঘরে বাড়ির ছেলেবৌ, মেয়েরা চা পৌঁছে দিচ্ছে। এর মধ্যে আপনি বাড়ির কর্তার পায়ে হাত ছুঁইয়ে নিজের অ্যাটেন্ডেন্স খাতায় তুলে এসেছেন।
তখন রিফিউজি হয়ে আসা সংযুক্ত হিন্দু পরিবারে ‘লিপটন’, গ্রীন লেবেল, হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট – এসব অগুরুগন্ধের চা আয়ত্তের বাইরে। শুধু নামগুলো মুখে মুখে ঘোরে। লাল চা বা চিনি ছাড়া চা ‘ইন থিং’ হয়নি। সবাই খায় কেটলিতে দুধে ফোটানো লিকার চা – একেবারে ‘আসাম-গগন-হতে’ আসা ‘শ্যামল-রসধরপুঞ্জ’ এবং ‘কাথলি-জল-উচ্ছল’ কেস।
এবার চায়ের কাপ হাতে বসে পড়ুন -- জামাকাপড় না ছাড়লে সবেধন নীলমণি কাঠের চেয়ারে, ছেড়ে ফেললে লুঙ্গি পরে মাটিতে বাবু হয়ে। তারপর খবরের কাগজ হাতে নিয়ে প্রাত্যহিক আড্ডায় মেতে উঠুন। এই জয়েন্ট ফ্যামিলি নামক দাদুর দস্তানায় তিনটি কামরা, এবং ছাতের চিলেকোঠা মিলিয়ে সতেরো জন প্রাণী থাকে। আর সব বাড়িতেই একটা মাত্র বাথরুম পায়খানা।
এখনকার নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে সেটা অসম্ভব। আর আজকাল দুটো ওয়াশরুম ছাড়া বেঁচে থাকা কী কঠিন কালীদা!
খবরের কাগজ বলতে দুটো বাঙলা এবং দুটো ইংরেজি কাগজ। আনন্দবাজার ও যুগান্তর। স্টেটসম্যান ও অমৃতবাজার।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড? নাঃ; বাঙালি নাক সিঁটকাতো।
এছাড়া টাচলাইনের ধার ঘেঁষে খেলে বেড়াত বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘দৈনিক বসুমতী’ ও কমিউনিস্ট পার্টির “স্বাধীনতা”। কংগ্রেসের ‘লোকসেবক’ এবং ‘জনসেবক’ নামক ট্যাবলোগুলো কলকে পেত না।
সাহিত্যিক ম্যাগাজিন বলতে সাপ্তাহিক দেশ। বেরোত মোটা কাগজে। লেটারিং সত্যজিৎ রায়ের। ভেতরটি সাদা কালো। কোন রঙিন ছবির বালাই নেই। কিন্তু তার নিয়মিত বিভাগে বিশ্ববিচিত্রা, বিজ্ঞান জগৎ, সাহিত্য, সঙ্গীত। নাটক সিনেমা, পুস্তক সমালোচনা। তাতে অন্ততঃ দুটো ধারাবাহিক উপন্যাস বেরোত। যেমন বিমল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘একক দশক শতক’ ও ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’। বিমল করের ‘খড়কুটো’, মুজতবা আলীর ‘শবনম’, শংকরের ‘কত অজানারে’ এবং ‘চৌরঙ্গী’। অচিন্ত্য সেনগুপ্তের ‘প্রথম কদম ফুল’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের “সূর্যমুখী”, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের “এই তার পুরস্কার”। সমরেশ বসুর ‘অচিনপুরের কথকতা’ এবং রমাপদ চৌধুরীর ‘এখনই’ ও ‘দ্বীপের নাম টিয়ারং’। মনে পড়ছে সন্তোষ কুমার ঘোষের দুই খণ্ডে “শ্রীচরণেষু মাকে” এবং “সুচরিতাসু তোমাকে”; প্যারিস বাসের পটভূমিকায় শিল্পী মিলন মুখোপাধ্যায়ের “মুখ চাই মুখ” এবং ধনঞ্জয় বৈরাগী ছদ্মনামে নাট্যকার তরুণ রায়ের ইংল্যান্ডে প্রবাসী বাঙালির জীবন নিয়ে একটি উপন্যাস।
ওতে একটা লাইন ছিলঃ ‘জয়টার কি কোন পছন্দ নেই? কী দেখে মারিয়ার প্রেমে পড়ল? তোবড়ানো গাল, সারাক্ষণ সর্দিতে নাক ভ্যাড় ভ্যাড় করছে!”
ক্লাস ফাইভে পড়ি। মেমসায়েবের নাকও সর্দিতে ভ্যাড় ভ্যাড় করে জেনে বড় স্বস্তি পেয়েছিলাম।
এছাড়া বের হত তুখোড় সব স্মৃতিকথা। যেমন দিলীপ কুমার রায়ের সুভাষ চন্দ্র বসু্র সঙ্গে স্কুল ও কলেজের দিনগুলো নিয়ে “স্মৃতিচারণ”, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের “কেউ ভোলে না কেউ ভোলে” -- নজরুলের সঙ্গে বর্ধমানের চুরুলিয়া ও আসানসোলের স্কুলের দিনগুলো; পুণ্যলতা রাওয়ের সুকুমার-লীলা মজুমদার-সারদারঞ্জনের গল্প আর অ্যানেকডোটে ভরা “ছেলেবেলার দিনগুলি”, প্রবোধচন্দ্র সান্যালের বৈঠকী আড্ডার স্মৃতি “বনস্পতির বৈঠকে”, মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের “দক্ষিণের বারান্দা”, অরুণকুমার সরকারের অনুবাদে “অ্যান ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি” পড়ে মুজতবা আলির সিরিয়াল লেখা। আর নারায়ণ গাঙ্গুলির “সুনন্দর জার্নাল” ও ফাদার দ্যতিয়েনের “ডায়েরির ছেঁড়া পাতা”র কথা না বললে ঠাকুর পাপ দেবেন। আর রম্যরচনায় গৌরকিশোর ঘোষের “ব্রজদার গুল্পসমগ্র” এবং সাংবাদিক তরুণ কুমার ভাদুড়ির চম্বলের ডাকাতদের নিয়ে রিপোর্তাজ – “অভিশপ্ত চম্বল”।
পুজোসংখ্যার উপন্যাস? খালি দুটো নাম বলছি — সুনীল গাঙ্গুলির প্রথম উপন্যাস “আত্মপ্রকাশ” এবং পরপর দু’বছর সমরেশ বসুর “বিবর” এবং “প্রজাপতি”। বিবর নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে যে ঝড় উঠেছিল তা তুলনাহীন।
এই ঐতিহ্যের পর আজকের “দেশ”? সাপ্তাহিক থেকে পাক্ষিক হয়েছে বলাই যথেষ্ট।
তখন মাছ বলতে রুইমাছ, দু’টাকা সের মানে বেশ দাম। কাতলা এবং মৃগেল এর পরে। ভেটকি, আড় মাছ তারও পরে। তারপরে শোল, কালবাউস ইত্যাদি। ইলিশ মাছ বরাবরই রাজকুমার। কিন্তু দামে রুইয়ের থেকে খুব একটা বেশি নয়। বোয়াল, কই, শিঙিমাগুর, এর পরে। আর ছোটমাছ ছিল অকুলীন। ট্যাংরা, পাবদা, বাটা বাচা, পুঁটি, মৌরলা, খলসে, সোনাখড়কে, ছোট চিংড়ি - এদের বেশি ভাও দেওয়া হত না । কমদামে পাওয়া যেত। গলদা চিংড়ি আজকের মতো পাওয়া যেত না। বিয়েবাড়িতে ভেটকির চেয়ে রুইমাছ ভাজাই হত। চালের সের আট আনা। পাঁঠার মাংস সের একটাকা। মুরগী দুটাকা। সরষের তেল গণেশ মার্কা একটাকা সের।
সের ও মণের বদলে গ্রাম ও কিলোগ্রাম, মানে মেট্রিক পদ্ধতি এল পঞ্চাশের শেষে। কিন্তু বাঙালি বহুদিন ব্রিটিশ পদ্ধতিকেই ব্যবহারে ধরে রাখল। জমিতে আজও কাঠা-বিঘে চলে। একর/হেক্টর বাঙালি নেয়নি। আমাদের মেট্রিক পদ্ধতি বোঝাতে ফর্মুলা দেয়া হল — “ডেকে হেঁকে কিল মারো”! মানে ডেকা-হেক্টো-কিলো-মিরিয়া-- আমার আজও সড়গড় হয় নি। অনেকদিন চলেছে চারপয়সায় এক আনা, তারপর আট আনা, ষোল আনায় একটাকা। ২৫ ন প (নয়াপয়সা) তে চার আনা হয়ে ১০০ পয়সায় একটাকা বড্ড খিটকেল লেগেছে। ধীরে ধীরে পঞ্চম নাকি ষষ্ঠ জর্জ নাকি অষ্টম এডওয়ার্ড বা কুইন ভিক্টোরিয়ার মুখ খোদাই করা এবং শুরুর তামার এক পয়সা দু’পয়সা ফুটো পয়সা সিকি আধুলি উধাও হল। বাঙালি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
সেসময়, মানে ষাটের দশকের সেকন্ড হাফ অব্দি পুরো প্যাকেট কিনলে চার্মিনার কুড়ি পয়সা, কিন্তু হলদেটে মোটা কাগজের প্যাকেটের ভেতরে ফিনফিনে কোনো র্যাপার থাকত না। ১৯৬৭ সালের জুলাই মাস থেকে ভেতরে র্যাপার জড়ালো আর প্যাকেটের দাম আটাশ নয়াপয়সা হল। খুচরো কিনলে পাঁচ পয়সায় দুটো চার্মিনার, অথবা একটা পানামা। রকের আড্ডায় রব উঠল – চারু এবার গেরস্ত হল!
সিনেমা হলে সামনের দুটো সারির কথা বলি। আলেয়াতে (ছারপোকাওলা কাঠের সীট) ৪১ পয়সা, অরুণাতে ৫০ পয়সা, মেট্রো–লাইটহাউস-নিউ এম্পায়ার এবং এলিটে ৬৫ পয়সা। উজ্বলা-বসুশ্রী-ভারতী এবং আমাদের গড়িয়ার পদ্মশ্রীতে ৬৫ পয়সা। তখন না ছিল মল, না আইনক্স।
ছেলেছোকরারা সিনেমার ফার্স্ট শো দেখার জন্যে লাইনে বসত। কারণ ওই প্রথম দুটো সারির টিকিটে অ্যাডভান্স বুকিং হত না। শুরুর এক-আধঘন্টা আগে হলের গায়ে একটা কোল্যাপসিবল গেট একটু করে খুলে গুণে গুণে দারোয়ান ভেতরে ঢোকাত, ফলে লাইন ম্যানেজ করা নিয়ে ঝাড়পিট স্বাভাবিক ছিল। আর দারোয়ানের ঠ্যাঙের ফাঁক বা বগলের তলা দিয়ে স্লিপ কেটে বা ভিড়ের মাথায় চড়ে ঘাড়ের ওপর দিয়ে ডাইভ মেরে ঢুকে পড়া বিশেষ প্রশংসার ব্যাপার ছিল। দারোয়ান হাত-পা চালাত। সবাই ভয় পেত মেট্রোর সফিস্টিকেটেড চেহারার ছ’ফুট চেকার বা বসুশ্রীর ডোরাকাটা চাড্ডিপরা টিকিধারী দারোয়ানকে।
ক্লাস টেনে পড়ি। হাফপ্যান্ট পরে মেট্রোর ৬৫ পয়সার লাইনে দাঁড়িয়েছি। ফিলিমটি সোফিয়া লোরেন অভিনীত ‘টু উইমেন’, আলবার্তো মোরাভিয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় গল্প।
ওই ছ’ফুটিয়া আমাকে ঘাড় ধরে লাইন থেকে বের করে দিল — ‘এ’ সার্টিফিকেট মার্কা ফিল্ম যে! একজন বলল — পরের বার ফুলপ্যান্ট পরে এসো খোকা।
ছুটির দিনে বাঙালি সপরিবারে যেত চিড়িয়াখানা, বেলুড় মঠ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, যাদুঘর এবং আরও পরে বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম। বড়রা অনেকে থিয়েটার দেখতে যেতেন উত্তর কোলকাতায়। স্টার-বিশ্বরূপা-রঙমহল-- এই তিনটি হলে হত ব্যবসায়িক নাটক। শিশির ভাদুড়িদের দিন শেষ; রাসবিহারী সরকার জাঁকিয়ে বসেছেন। কিছু নাটক যেমন ‘উল্কা’ এবং ‘সেতু’ সুপারহিট। রঙ্গনা হল এল আশির দশকে।
তখন অ্যাকাডেমি-রবীন্দ্র সদন—নন্দন-শিশির মঞ্চ-জ্ঞান মঞ্চ কিছুই হয় নি। শম্ভু মিত্র মশাই বাঙলা রঙ্গমঞ্চের জন্যে দিল্লি কোলকাতা দরবার করে জমি ও মঞ্চের জন্য পাবলিকের থেকে চাঁদা তুলেও জমিটমি না পেয়ে সবাইকে পয়সা ফেরৎ দিলেন।
আমাদের দেশে হাকিম নড়ে তবু হুকুম নড়ে না।
উৎপল দত্তের লিটিল থিয়েটার গ্রুপ মিনার্ভা মঞ্চের লীজ নিয়ে অন্যধরনের প্রোডাকশন একের পর এক করে চলেছেন। বড়াধেমো কয়লাখনির দুর্ঘটনা নিয়ে “অঙ্গার”, নৌ-বিদ্রোহ নিয়ে “কল্লোল”, নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান নিয়ে “তীর”। দক্ষিণে মঞ্চ বলতে মুক্তাঙ্গন। সমস্ত গ্রুপ থিয়েটার এবং গণনাট্য সংঘ ওখানেই ভাল ভাল কাজ করেছে। শৌভনিক, নক্ষত্র, নান্দীকার, থিয়েটার ওয়ার্কশপ—নাটকের স্বর্ণযুগ। সবিতাব্রত দত্ত, জ্ঞানেশ মুখুজ্জে, শ্যামল সেন, বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, অজিতেশ, রুদ্রপ্রসাদ, কেয়া চক্রবর্তী, মনোজ মিত্র, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় – সবাই ওই সময়ের ফসল। অসীম চক্রবর্তী এবং কেতকী দত্ত প্রতাপ মেমোরিয়াল হলে ‘বারবধূ’র রেকর্ড শো করে বিখ্যাত হলেন। কিন্তু বাম মর্যাল পুলিসের কাছে ‘অপসংস্কৃতি’ বলে গাল খেলেন। এছাড়া সেই প্রথম কোলকাতার নাটকের মঞ্চে ক্যাবারে নাচ দেখা গেল। মিস শেফালী এ’ব্যাপারে বিশেষ উল্লেখ এবং সম্মানের দাবি রাখেন। আর বলা উচিত আলোকসম্পাতে তাপস সেনের কথা। এত অল্প আয়োজনে অমন উচ্চমানের শৈল্পিক আলো!
বাদল সরকারের ব্যাপারটাই আলাদা। বাঙালির বুঝতে একটু সময় লাগল। প্রথম দিকে ওই মুক্তাঙ্গনে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ তার বক্তব্যের ভার এবং আঙ্গিকের ধারে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পরে ওঁর প্রসেনিয়ম মঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসে অঙ্গন মঞ্চে দর্শকদের গোল করে বসিয়ে (টিকিটের একটাই দাম — এক টাকা!) প্রপ, মঞ্চসজ্জা বা আলোর মায়া বাদ দিয়ে শুধু দলগত অভিনয়, শরীরকে ব্যবহার করে নাটক! তাতে নায়ক-নায়িকা প্রায় বাদ! ‘ভোমা’, ‘মিছিল’, সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস, স্পার্টাকাস, সাগিনা, গণ্ডী – এসব তখন বাঙালির জন্যে নতুন অনুভব।
জ্যোছন ঘোষ দস্তিদারদেরও একটা ঘরানা ছিল। দলটার নাম বোধহয় কর্ণিক।
বিজন থিয়েটার অনেক পরে। মধুসূদন মঞ্চ তৈরি হয়নি। ঢাকুরিয়া ব্রীজ চালু হয়নি। আমাদের কোলকাতা শুরু হত যোধপুর পার্ক থেকে। তার দক্ষিণে মানে সারি সারি রিফিউজি কলোনি।
আমাদের মতো বুড়োদের চোখে আজ মঞ্চে মধ্যমেধার দাপাদাপি!
আমি জন্মেছিলাম মেডিক্যাল কলেজের জেনারেল ওয়ার্ডে, স্থানাভাবে মাটিতে পাতা বিছানায়। তাতেও একজন ইন্টার্নের সুপারিশ লেগেছিল। তিনি আমাদের আত্মীয় বটেন। কোলকাতার সরকারি হাসপাতালে রোগীর ভিড় বেড়েছে বই কমেনি। হ্যাঁ, সম্পন্ন লোকজনের জন্যে গলাকাটা টারিফে অনেক প্রাইভেট হসপিটাল হয়েছে। পুরনো দিনে এলএমএফ নামক মেডিক্যাল ডিপ্লোমাধারী থেকে এমবিবিএস ডাক্তার – সবাই আমাদের চোখে ধন্বন্তরি। এখন এমডি বা এমএস না হলে পুরো ডাক্তার ধরা হয় না।
আগে ছিল উত্তর কোলকাতার জন্যে নিমতলা, দক্ষিণ কলকাতার জন্যে কেওড়াতলা। অবশ্য কিছু মাইনর শ্মশান ছিল। যেমন কাশীপুরে রতনবাবু ঘাট, গড়িয়ার কাছে বোড়ালে একটি। কিন্তু তাতে কাঠ পুড়িয়েই দাহ করতে হত। এখন ধীরে ধীরে সব শ্মশানেই ইলেক্ট্রিক চুল্লি। আর একগাদা সৎকার সমিতির সুসজ্জিত গাড়ি এসে সম্মানের সঙ্গে শবদেহটি নিয়ে যায়। আগের মতো মাঝরাতে পিলে চমকানো — বল হরি! হরি বোল? আজ আর শোনা যায় না।
তাহলে বদল কোথায় হল? শুধু বহিরঙ্গে? তা কেন? অন্তরঙ্গেও হল বইকি! বাঙালির ঘরে এবং বাইরে দখিন হাওয়ার ছোঁয়া। টেকনোলজি ও অন্তর্মন।
আজকে বাঙালির ঘরে মাটিতে পাত পেড়ে কেউ খায় না। বাঙালি খায় চেয়ার টেবিলে, অবশ্য কাঁটা-চামচ-ছুরি নয়, হাত দিয়েই। ফলে বিদেয় নিয়েছে কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি, চাটাইয়ের বা কাপড়ের আসন। জেলের কয়েদিদের মতো কলাই করা বাসন (এনামেল) মগ অল্পদিনেই বিদায় নিয়েছিল। কাঁসার বাসন বেশ কিছুদিন চলল, তারপর স্টেনলেস স্টিল। এখন সবাই খান চিনেমাটির বা কাঁচের বাসনে।
কয়লার ধোঁয়া বা কেরোসিন স্টোভের গনগনে আগুনের বদলে কুকিং গ্যাস, হাঁড়িকুড়ি ডেকচির বদলে প্রেসার কুকার, শিলনোড়ায় মশলা বাটার জায়গায় গুঁড়ো মশলা ও মিক্সি গ্রাইন্ডার। এসব নিঃসন্দেহে রান্নাঘরের আবহাওয়াকে করেছে স্বাস্থ্যকর এবং কমিয়ে দিয়েছে রান্নার পেছনে সময়।
এর ফলে সকড়ি এঁটোকাঁটা — মানে ভাতের ছোঁয়া, খেতে খেতে জলের গ্লাস বা অন্য বাসন ছোঁয়া – নিয়ে বিধিনিষেধ শিথিল হয়েছে।
আছড়ে আছড়ে কাপড় ধোয়ার বদলে ওয়াশিং মেশিনের ব্যবহার মুক্তি দিয়েছে পরিশ্রম ও সময়ের অপব্যয় থেকে। মেয়েরা এখন ঘরেতেও নিজের জন্যে অনেকটা সময় বের করতে পাচ্ছেন।
প্রতি আবাসনে কমোড যুক্ত ওয়াশরুমের সংখ্যা বেড়েছে। বাঙালির ঘেন্নাপিত্তি কিছু কমে গেছে? পটি বলে শব্দটি এখন আমাদের চলন্তিকায় ঢুকে পড়েছে।
সাধনা দন্তমাঞ্জন, ফরহান্স, নিম টুথপেস্ট, মার্গো সাবান বীণাকা টুথপেস্ট গেছে। টিঁকে আছে কলগেট, এবং সাম্রাজ্য বাড়িয়েই চলেছে। তেল-সাবান-শ্যাম্পু- ফেস ওয়াশ, বডি ওয়াশের অনেক বৈচিত্র্য। নারকোল তেল মাথায়, সরষের তেল গায়ে এবং হামাম সাবান শরীরে জাতীয় সহজ ফর্মূলা বাতিল। আজ আমরা স্নানের সময় ধুঁধুলের খোসা নয়, ‘লুফা’ দিয়ে গা’ ঘসি।
আগে মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েরা বিউটি পার্লারে যেত না। তাতে প্রায় জাত এবং ক্যারেকটার চলে যেত। বাঙালির চোখে তখনও সব পার্লারই ম্যাসাজ পার্লার। বোঝো!
এখন অনায়াসে মেয়েরা এবং ছেলেরা পার্লারে যায়, পেডিকিওর করায়। আজকের প্রজন্ম অনেক সৌন্দর্যসচেতন, নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে সচেতন। তাই জিমে যাওয়া ছেলেমেয়ে সবার জন্যে একটি স্বাভাবিক ঘটনা।
পাড়ায় পাড়ায় দর্জিরা টিঁকে আছে বটে, কিন্তু মল থেকে রেডিমেড ব্র্যান্ডেড জামাকাপড় কেনার চলন বেড়েছে। বাঙালি অনেকদিন ফটরফটর করা শস্তা হাওয়াই চটি ছেড়ে বন্ধ জুতো এবং স্নিকার্স ধরেছে।
ক্যান্সারের বিজ্ঞাপনে সিগারেট খাওয়া কমেনি, শুধু চারমিনার পানামার মত জনতা সিগারেট গায়েব, অথচ জর্দা দোক্তার বদলে হিন্দিবলয় থেকে আসা গুটকা খাওয়া বেড়েছে।
চুমুটুমুর ব্যাপারে বাঙালির নতুন প্রজন্ম অনেক বোল্ড। পুরনো দিনে এর জন্যে খুঁজতে হত লেকের ধারে লিলিপুলের পাশে একটা গাছের নীচের আড়াল। জোড়ায় জোড়ায় পিঠে পিঠ। অথবা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা চিড়িয়াখানায় আড়াল খুঁজে সবার আঁখি এড়ানো। এ’ব্যাপারে পুরুষসঙ্গীর সক্রিয়তা চোখে পড়ত। ইদানীং শহর কোলকাতায় দেখেছি ছেলেটি যেন সাংখ্যদর্শনের নিষ্ক্রিয় পুরুষ। আর প্রকৃতিস্বরূপ নারী অনায়াসে ছাতা খুলে বা ওড়নায় ঢেকে নিচ্ছে যুগলের মাথা এবং মুখ।
নে যত পিপিং টমের দল!একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় এ’নিয়ে অস্বস্তি হয় কিনা জানতে চাইলে সে অকপটে বলে – জ্যেঠু, অস্বস্তি কিসের? আমরা তো এভাবে বাকি দুনিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে এক নিজস্ব ভুবন গড়ে তুলি। তাতে মগ্ন হয়ে যাই।
তোরা হল্লা করে করবি কি তা বল!
স্ট্রিট ফুড বা রেস্তোরাঁয় খাবার ব্যাপারে মেয়েরা অনেক উদ্যোগী, কারণ অনেকেরই নিজস্ব আয় বা স্বতন্ত্র জীবিকা। হরদম দেখি নানান ধরনের কাজে এগিয়ে এসেছে গড়িয়া সোনারপুর বা রাজপুরের মত এলাকার মেয়েরা। মেট্রো স্টেশনে আলাপ হতে একটি মেয়ে আমাকে কার্ড দেখিয়ে বলে এই ঠিকানায় মডেলিং-এর জন্যে ইন্টারভিউ দিতে ডেকেছে। এই সংস্থাটির নাম শুনেছেন? একা যাওয়া সেফ হবে?
মেয়েরা আজকে পেট্রল পাম্পে ইউনিফর্ম পরে গাড়িতে তেল ভরে দেয়। সোনাগাছিতে দুর্গাপুজো করে। আজকে যৌনকর্মী একটি স্বীকৃত শব্দ। পুরনো দিনে মাস মাইনে পেলে মুখ লুকিয়ে সোনাগাছি বা হাড়কাটা গলিতে ঢুঁ মেরে আসা যেত। কিন্তু সেখানে তাদের মেয়েকে পড়াতে বা ড্রইং বা অভিনয় শেখাতে যাওয়া? এই ভণ্ডামি থেকে কোলকাতা এখন অনেক মুক্ত।
রাস্তায় কাঁকর, কাঁচের টুকরো এবং পেরেক সবই আছে, তবু না হাঁটলে পথ ফুরোয় না। এই প্রজন্মের মেয়েদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি।
বলতে চাইছি — বহিরঙ্গের যে পরিবর্তন চোখে পড়ছে তার খানিকটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে উন্নত প্রযুক্তি ও ভোগ্যপণ্যের প্রবেশের ফল, বাকিটা আসলে বাঙালির ঘরের মধ্যে মূল্যবোধে পরিবর্তনের প্রকাশ।
ছোটবেলায় কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি মেয়েকে সন্ধ্যে সাতটা পেরিয়ে বাড়ি ঢোকার অপরাধে মায়ের মুখঝামটা গালমন্দ মুখ বুজে সহ্য করতে দেখেছি। কারণ মেয়েছেলে হয়ে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার হওয়ার দুঃসাহস!
এখন এমন কথা উচ্চারণ সংবিধান-বিরুদ্ধ। রাতের শহর আর ছেলেদের একচেটিয়া গোচারণভূমি নয়।
ঘরের বৌয়ের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। সে শুতে যাবে সবার শেষে রান্নাঘর গুছিয়ে, অথচ উঠবে সবার আগে। শ্বশুর-শাশুড়ি উঠে দেখবেন বৌমা ওঠেনি? সেকী! কী লজ্জা! অথচ তার স্বামীদেবতার আবদার এবং নানান বায়নাক্কা মিটিয়ে ঘুমুতে দেরি হয়েছে। এদিকে বাপের সুপুত্তুর নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছেন, তাতে কি, ও যে পুরুষ।
এসব একেবারে পালটে গেছে। এখন বৌমা রোজগেরে। সে কখন উঠবে সেটা তার মর্জি। ঘরের কাজের মাসির মাইনে সেই তো দিচ্ছে। সকাল বেলার চা? সেটা কখনও শাশুড়ি, কখনও শ্বশুর বা স্বামী এবং কখনও সে নিজে পালা করে করছে। ছেলেরা মেনে নিয়েছে যে ‘পতি পরম গুরু’ লিখে বাঁধিয়ে দেয়ালে টাঙানোর দিন আর ফিরবে না। ঘরের কাজে, বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো এবং স্কুলে পৌঁছে দেয়া —এসবে তাকেও হাত লাগাতে হবে।
কাজের মাসি? মাস-মাইনের কড়ারে অন্যের ঘর সামলাতে আসা মহিলাকে ‘ঝি’ বলা আজ ‘স্যাক্রিলেজ’, তাকে কাজের মাসি বলাটা পরিবর্তিত মূল্যবোধের বড় ইঙ্গিত।
সবচেয়ে বড় কথা মেয়েদের শরীর তার নিজস্ব। তার ব্যক্তিগত জীবনের সব নির্ণয় সে নিজে নেবে। কার সঙ্গে মিশবে, কাকে বিয়ে করবে, কবে মা হবে, আদৌ হবে কিনা — এসব তার একান্ত ব্যক্তিগত নির্ণয়। সে কাউকেই আগেকার দিনের মতো কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নয়।
‘তোমার শ্বশুরের খুব ইচ্ছে শিগগির যেন নাতি-নাতনির মুখ দেখেন, নইলে বাড়ি বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে।’ এসব বলা যে অসভ্যতা সেটা বাঙালি পরিবার শিখেছে।
সত্যজিতের ‘মহানগর’ সিনেমায় বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে যে নতুন মূল্যবোধের অঙ্কুর আমরা দেখেছিলাম, আজ অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে সেই গাছ তার ডালপালা মেলে রোদ্দুর গায়ে মেখে হাসছে।
তথ্যসূত্র:
(১) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস "দর্পণ"
(ক্রমশ)
(পরবাস-৮৪, ১০ অক্টোবর, ২০২১)