পরবাসে
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের

আরো লেখা

এবং বই


ISSN 1563-8685




পরিক্রমা

|| ৬ ||

বেলাগাঁও ছোট জায়গা। ফলের বাজারে গৌরদাসবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। স্ত্রীর জন্য বেদানা কিনছেন। কুশল বিনিময়ের পর জানালেন, ডক্টর মিশ্রর পরামর্শ বোধ হয় কাজ দিচ্ছে। অল্প হলেও গৌরদাসবাবুর স্ত্রী যেন বর্তমান সময়ের দিকে হাঁটি-হাঁটি পায়ে চলতে শুরু করেছেন। ডাক্তার বলেছেন ঘরের মধ্যে ভূতের মত বসে থাকলে চলবে না। মানুষজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে হবে, কথা বলতে হবে। সময়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করাটা জরুরি। গৌরদাসবাবু ভাবছেন একজন পেইং গেস্ট রাখবেন। ছেলের ঘরটা তো খালিই পড়ে আছে। বলতে বলতে ভদ্রলোকের গলা ভারী হয়ে এল। জয়ন্তর মনে পড়ে গেল জিতেন বাসা খুঁজছে। গৌরদাসবাবুর ফোন নম্বর নিয়ে রাখল জিতেনের সঙ্গে কথা বলে দেখবে। সঞ্জয় আর জিতেন যে বাসাটায় থাকে সেটা সঞ্জয়ের নামে নেওয়া, জিতেন আর বাসু পরে এসে জুটেছিল। সঞ্জয় ইদানীং বিয়ে করার জন্য খেপে উঠেছে। বৌ নিয়ে এলে জিতেনকে নতুন বাসা খুঁজে উঠে যেতে হবে।

সঞ্জয়ের বিয়ে আগেই হয়ে যেত, ভারতের উত্তরাঞ্চলের হিন্দিবলয়ের ছেলেদের পাশ দিয়ে চাকরি পেতে না পেতেই বিয়ে-শাদি হয়ে যায়। সরকারি চাকরি হলে তো আর কথাই নেই। সোমত্থ মেয়েদের বাপেরা দরজার সামনে লাইন লাগিয়ে দেয়। সঞ্জয়ের বিয়ের দেরি হবার জন্য এককথায় তার বন্ধু-বান্ধবরাই দায়ী। বছর খানেক আগে এক জায়গায় তার বিয়ের মোটামুটি ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সঞ্জয় দেহাত গিয়ে পাত্রীটাত্রী দেখে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়ে এসেছিল। এমনকি দহেজের মূল্য নিয়ে দু’পক্ষের দরদস্তুরও শুরু হয়ে গিয়েছিল। শোনা গিয়েছিল মেয়ের বাপ গাড়িও দেবে। সঞ্জয় সাদা মনে কথাটা বন্ধুদের জানিয়েছিল। জয়ন্ত বলেছিল, ছিঃ, তোর লজ্জা করবে না দহেজ নিতে? বিজন বলেছিল, তোর কাছ থেকে এটা আশা করিনি সঞ্জু। জিতেনও সুযোগ পেয়ে ফোড়ন দিয়েছিল, দেখিস, ঠকিয়ে তোকে কম দামে কিনে না নেয়। বাসু ফুট কেটেছিল, বিয়ের পর বৌ যদি খোঁটা দেয়, তার বাপের দেওয়া গাড়ি চড়ছিস, কী জবাব দিবি?

সঞ্জয় বন্ধুদের কথায় বাবাকে দহেজ নিতে মানা করে দিয়েছিল। সেই শুনে সঞ্জয়ের বাবা আক্ষরিক অর্থেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন। বলে কি ছেলে? ওরে বেওকুফ, দহেজ না নিলে ভাই-বেরাদরিতে মান থাকবে? মাথা কাটা যাবে না? তাছাড়া দামড়ি বোনগুলোর বিয়ে দেব কী করে? সঞ্জয় বলেছিল, বোনেদের বিয়ের টাকা আমি জোগাড় করে দেব। সঞ্জয়ের বাবা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। সঞ্জয় গোঁ ধরে বসেছিল, দহেজ নিলে বিলকুল ঘোড়িতে চড়বে না। অগত্যা নিরুপায় হয়ে সঞ্জয়ের বাবা মিনমিন করে হবু সম্বন্ধীকে কথাটা জানিয়েছিলেন। সেই ভদ্রলোক বাপের জন্মে এমন কথা শোনেননি। ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ, সরকারি চাকরি করে, অথচ বলছে দহেজ নেবে না, ব্যাপারটা কী? নিশ্চয়ই বড়রকমের কোনও ঘোটালা আছে। ছেলে সুস্থ স্বাভাবিক নয়, তার গুরুতর কোনও খোট আছে। পাত্রীপক্ষ অবিলম্বে বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। বেশ কিছুদিন সেই শোকে মুহ্যমান হয়ে বসেছিল সঞ্জয়। আবার মেয়ে দেখা শুরু হয়েছে। সঞ্জয় বলেছে, এবার বন্ধুরা দহেজ-ফহেজ নিয়ে ফালতু জ্ঞান দিতে এলে মারামারি হয়ে যাবে।

জয়ন্ত জিতেনকে গৌরদাসবাবুর ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলল। সংক্ষেপে মহাপাত্র পরিবারের বর্তমান দুঃসময়ের কথাও জানিয়ে দিল। পরের দিন বাজারে দেখা হতে জিতেন বলল, সপ্তাহান্তে গৌরদাসবাবু আলাপ করতে ডেকেছেন। তুই যাবি নাকি সঙ্গে?

দময়ন্তীও ছিল পাশে, জিতেন বলল, ভাবি, তুমিও চলো, তোমাদের দেখলে ভদ্রলোক ভরসা পাবেন।

দময়ন্তী বলল, জিতুদা, তোমার নিজের ওপর দারুণ বিশ্বাস তো।

জিতেন বলল, কী করব বলো? জগন্নাথ নিজের গায়ের রঙের মত রং দিয়েছেন আর ছোট থেকে পান-বিড়ি খেয়ে খেয়ে দাঁতগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। দেখে লুচ্চা লাফাঙ্গা না ভেবে বসে।

দময়ন্তী হেসে বলল, ভাবলেই হল? ভয় নেই, তোমার ক্যারাক্টার সার্টিফিকেট দেবার জন্য শনিবার সন্ধেবেলা আমরা তোমার সঙ্গে যাবখন।

জিতেন বলল, জগন্নাথের কৃপায় ঘরের বন্দোবস্ত হয়ে গেলে তোমাদের দু’জনকে কচি পাঁঠার ঝোল খাওয়াব। অথেন্টিক ওড়িয়া কুইজিন। খেলে হাত চেটে কূল পাবে না।

গৌরদাসবাবু দরজা খুলে ওদের আপ্যায়ন করে বসালেন। মুখ দেখে মনে হল ওরা আসায় বেশ খুশি হয়েছেন। জিতেন ঘর নিক বা না-নিক অন্তত কিছুটা সময় গল্পগুজবে কেটে যাবে। স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে এলেন ভেতর থেকে। পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সঙ্গে। উৎফুল্ল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ওরা চা খাবে কি না। গৌরদাসবাবুর স্ত্রীকে দেখে একটু অগোছালো লাগল। ওরা আসবে জানত। তবু মুখে সামান্যতম প্রসাধন নেই, চুল আঁচড়ানো নেই ঠিক করে, কথাবার্তাও কিঞ্চিৎ অসংলগ্ন। কথা যা বলার গৌরদাসবাবুই বলছিলেন। জয়ন্তরা পুণে ঘুরে এসেছে শুনে জিজ্ঞেস করছিলেন কোথায় কোথায় গিয়েছিল, কেমন লেগেছে... এইসব। ওঁর স্ত্রী চুপ করে পাশে বসে ছিলেন। জয়ন্ত হঠাৎ নজর করল তিনি একদৃষ্টে জিতেনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আচমকা স্বামীর হাত চেপে ধরে জিতেনের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ও কে?

গৌরদাসবাবু বললেন, আলাপ করিয়ে দিলাম তো, ওর নাম জিতেন। তিনি জোরে মাথা নেড়ে বললেন, না। তুমি আমায় মিথ্যে কথা বলছ। গৌরদাসবাবু যতই বোঝাতে চেষ্টা করেন, ভদ্রমহিলা অবুঝের মত মাথা নাড়েন। শেষে গৌরদাসবাবু বললেন, শোনো উমা, তুমি এক কাজ করো। ওদের জন্য সামোসা আর খাজা এনেছি। কিচেনে রাখা আছে। তুমি চা বানাও, চা-য়ের সঙ্গে সবাই মিলে খাওয়া যাবে। ভদ্রমহিলা জিতেনের ওপর সন্দিহান দৃষ্টিপাত করতে করতে উঠে গেলেন। গৌরদাসবাবু ওদের বললেন, কিছু মনে কোরো না তোমরা। বিপ্র চলে যাবার পর থেকে কখন কী বলে, কখন কী করে কোনও ঠিক নেই। ডাক্তার বলছে, ঠিক হয়ে যাবে। তবে সময় লাগবে।

চা জলখাবার খেয়ে গৌরদাসবাবু বিপ্রর ঘরটা দেখাতে নিয়ে গেলেন। অ্যাটাচড বাথ নিয়ে ঘরটা আয়তনে বেশ বড়। ঘরটার একটা দরজা ডাইনিং স্পেসে খোলে আর একটা লিফট লবিতে। প্রাইভেসির জন্য চাইলে ডাইনিং স্পেসের দরজাটা বন্ধ রেখে অন্যটা দিয়েও জিতেন বাইরে যাতায়াত করতে পারে। গৌরদাসবাবু সে দরজার চাবি জিতেনকে দিয়ে দেবেন। ওরা দেখল বিছানা পাট-পাট করে পাতা, আলনায় জামা-কাপড় ঝুলছে, বেডসাইড টেবিলে বই উলটে রাখা, শুধু ছেলেটা নেই। গৌরদাসবাবু বললেন, জিতেন এলে আলনা কাবার্ডের জিনিসপত্র খালি করে দেবেন। রান্নার লোক দু’-বেলা রান্না করে দিয়ে যায়। জিতেন ইচ্ছে করলে ওঁদের সঙ্গেই খাওয়াদাওয়া করে নিতে পারে। বাইরে খেলেও আপত্তি নেই, তার মর্জি।

ঘর দেখে মোটামুটি পছন্দই হয়ে গেল জিতেনের। ভাড়া, খাবার জন্য খরচ নামমাত্র, গৌরদাসবাবুর মূল উদ্দেশ্য কথা বলার একজন লোক পাওয়া যাবে। তাতে যদি স্ত্রীর কিছুটা মানসিক শুশ্রূষা হয়। আগের বাসা ছেড়ে দেবার আগে একবার সঞ্জয়ের সঙ্গেও কথা বলা দরকার। দু’-এক দিনের মধ্যে ফাইনাল জানাবে বলল জিতেন। ওরা উঠে পড়ার তোড়জোড় করছিল, গৌরদাসবাবুর স্ত্রী জিতেনকে দেখিয়ে বললেন, এ কী, ও কোথায় যাচ্ছে?

গৌরদাসবাবু অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন, বললেন, উমা, ওরা ওদের ঘরে ফিরে যাচ্ছে।

গৌরদাসবাবুর স্ত্রী অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলেন। যেন কিছুতেই বুঝতে পারছেন না - অন্য দু’জন যায় যাক, জিতেন কেন চলে যাচ্ছে। গৌরদাসবাবু ওদের বিল্ডিঙের নিচে এগিয়ে দিতে এসে বললেন, উমা আজকাল লোকজনের সঙ্গে একদম দেখা করতে চায় না। কেউ এলে আমায় বিরক্ত করে, আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করে কখন সে যাবে। চলে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। তোমাদের বেলায় দেখলাম অন্যরকম ব্যবহার করল।

জিতেন বলল, আঙ্কেল, তুমি চিন্তা কোরো না। আন্টি ভাল হয়ে যাবে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমায় জানাব কবে নাগাদ শিফট করতে পারব। ততদিন ঘরের ব্যাপারে তুমি অন্য কারো সঙ্গে কথা বোলো না।

গৌরদাসবাবুর একবার জিতেনের মাথায় হাত রাখলেন। তারপর পিছন ফিরে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। হয়তো চোখের জল আড়াল করলেন, কে জানে? ফেরার পথে তিনজনের কেউই কথা বলছিল না। পাতলা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে তিনজনে হেঁটে যাচ্ছিল। জীবনে কখনো কখনো কথার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। মানুষ তখন মুখ বুজে নিজের ভেতরেই খুঁড়তে থাকে, খুঁড়তে থাকে... কখন জল ওঠে।

*

জীবন হালদার কোরিডোরেই জয়ন্তকে ধরেছিল। হেঁড়ে গলায় পাড়া জানিয়ে অভিযোগ করেছিল, “শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে উপলক্ষ্যে ধামাকা পার্টি দিয়েছ, ভায়া। আমাদের একবার জানালে না।”

জয়ন্ত একটু লাজুক লাজুক মুখ করে বলল, “এত তাড়াতাড়ি সব হয়ে গেল, জানাবার সুযোগই পেলাম না দাদা।”

জীবন হালদারের মুখ দেখে অবশ্য মনে হল না বিয়ের পার্টির নেমন্তন্ন না পেয়ে খুব আহত হয়েছে। বস্তুত জয়ন্তর কথা ভাল করে শুনল বলে মনে হল না। জয়ন্তর কথা শেষ হবার আগেই খাদে গলা নামিয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে একটা জরুরি পরামর্শ ছিল।”

জয়ন্ত ভয়ানক আশ্চর্য হল। জীবন হালদার তার পরামর্শ চাইছে... ভাবা যায়? ভুরু কুঁচকে বলল, “বলুন...”

হালদার সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিক জরিপ করে বলল, “আসলে আমার কলকাতায় ট্রান্সফার নেওয়ার খুব দরকার, বুঝলে? আরজেন্টলি...”

জয়ন্ত তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমি তার কী করব?”

হালদার বিমর্ষ ভাবে বলল, “আরে ভাই, বস কিছুতেই মানতে চাইছে না। ভাবলাম তুমি যদি একটু সুপারিশ করে দাও। তোমার সঙ্গে তো বসের দহরম-মহরম আছে, তোমার কথা বস নিশ্চয়ই ফেলতে পারবে না।”

জয়ন্ত বলল, “মুম্বাইতে তো আপনার বছর বারো হয়ে গেল। এতদিন পরে হঠাৎ কলকাতায় ট্রান্সফার নেবার কী দরকার পড়ল?”

হালদার একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “সমস্যাটা একটু গোপনীয়...”

জয়ন্ত বলল, “কিন্তু অ্যাপ্লিকেশানে তো একটা কারণ লিখতে হবে কেন ট্রান্সফার চাইছেন।”

হালদার বলল, "কী যে বলি! ঝামেলাটা তোমার বৌদিকে নিয়ে...”

জয়ন্ত একটু ঘাবড়ে গেল। হালদার ভিটভিটে শয়তান। কী প্যাঁচ কষছে কে জানে! নিরীহ গলায় বলল, “হালদারদা, বিজনকে ডাকি বরং। ওর মাথায় অনেক ফন্দি-ফিকির আসে।”

হালদার একটু থমকাল, বলল, “বিজনকে ডাকবে? আচ্ছা এক কাজ করো। এই হট্টমেলায় নয়, ক্যানটিনে আসতে বলো। আরামসে কথা বলা যাবে।”

জয়ন্ত ফোন করল। বিজন বলল, “মালটাকে কাটিয়ে দিতে পারলি না?”

জয়ন্ত এ প্রান্তে চুপ করে আছে দেখে বোধহয় বুঝল, সে আতান্তরে পড়েছে, বলল, “আচ্ছা, তোরা ক্যানটিনে চলে আয়। আমি আসছি।”

দু’জনকে কোনার দিকের একটা টেবিলে টেনে নিয়ে গেল হালদার। থিতু হয়ে বসে বলল, “কী করে যে বলি, তোমরা আমার ছোট ভাইয়ের মত।”

বিজন বলল, “হালদারদা, নখ্‌রা বাদ দিয়ে বলুন কী হয়েছে।”

হালদার বলল, “বলার মত সে কি আর কিছু রেখেছে? তোমাদের বৌদি মানে আমার বৌ প্রেমে পড়েছে। একটা উঠতি বয়সের ছোকরার সঙ্গে লটঘট করে বেড়াচ্ছে। জায়গা বদল হলে যদি মন বদলায়। তাই কলকাতায় ট্রান্সফারের চেষ্টা করছিলাম,” হালদার হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে ঝুঁকে পড়ে জয়ন্তর হাত দুটো ধরে বলল, “ভাই, বসকে বলে একটা বন্দোবস্ত করে দাও, প্লীজ।”

জয়ন্ত মুখ ফসকে বলে ফেলল, “সে কী! বৌদি... এই বয়সে প্রেম!”

হালদার চেয়ারে ফিরে গেল, ঝুনো নারকোলের মত শুকনো গলায় বলল, “তবে আর বলছি কী? এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড কেউ কোনওদিন দেখেছে না শুনেছে?”

বিজন বলল, “দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনাদের একটা মেয়েও আছে না?”

হালদার বলল, “বাচ্চা মেয়েটাকে ইস্কুলে পাঠিয়ে দু’-জনে ইল্লুতি করে। পাড়াপড়শিরা সব দেখেছে। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে ভাই।”

জয়ন্ত বলল, “আপনি বৌদির সঙ্গে কথা বলেছেন?”

হালদার বলল, “বলিনি আবার, সে সব কথা অকপটে স্বীকার করেছে। বলেছে, কী করব, ছেলেটাকে দেখে মায়া হয়, না বলতে পারি না।”

বিজন বলল, “আরে দাদা, এই নিয়ে এত পরেশান হবার কী আছে? পোষাচ্ছে না তো ডিভোর্স দিয়ে দিন। বাত খতম, পয়সা হজম।”

হালদার বলল, “সেখানেই তো আসল সমস্যা। সে তাকেও ধরে থাকবে আবার আমাকেও ছাড়বে না। মানে গাছেরও খাবে তলারও কুড়োবে, এই আর কী! কিছু বলতে গেলেই ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদে। বলে আমি চলে গেলে তোমায় দেখবে কে? যত বলি, তোমায় সে সব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, আমি ম্যানেজ করে নেব, সে বলে, আমারও তো একটা দায়িত্ব আছে না কি?”

বিজন বলল, “হালদারদা, আপনার সমস্যা জটিল। এমনিতে সমাধান হবে না, মাথা খেলাতে হবে। আপনি চট করে কাউন্টার থেকে দু’-কাপ কফি নিয়ে আসুন। আমরা ততক্ষণ চিন্তা করি।”

হালদারের কফি খাওয়ানোর খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। তাও বিজনের কথা ফেলতে পারল না। উঠে গেল। বিজন বলল, “খচ্চরটা কলকাতায় ট্রান্সফার নেওয়ার জন্যে আষাঢ়ে গপ্পো ফেঁদেছে।”

জয়ন্ত বলল, “ব্যাপারটা সত্যি নয় বলছিস?”

বিজন বলল, “খবর নিতে হবে। সত্যি হলেই বা কী? বৌ প্রেম করছে মানে ট্রান্সফার নিতে হবে? এ কী মগের মুলুক নাকি?”

জয়ন্ত বলল, “হালদার নিজের বৌয়ের নামে যা সব কেচ্ছা করছে সেগুলোও খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।”

বিজন বলল, “ডিভোর্স দিলে খোরপোশ দিতে হবে তাই আলবাল বকছে। দাঁড়া ওর ব্যবস্থা করছি।”

হালদার দু’কাপ কফি নিয়ে ফিরে এল। বিজন কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “ছেলেটা কে? চেনেন নাকি? আপনার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় আছে?”

হালদার বলল, “চিনব না কেন, নেহাতই গোবেচারা টাইপের, কলোনির বাইরেই থাকে। মেয়ের ইস্কুলের মিউজিক টিচার, বাড়িতে আসত মেয়েকে গীটার শেখাতে... সে যে এমন দু’-নম্বরি করবে কে জানত!”

বিজন ভুরু কোঁচকাল, “সে কী বলে?”

হালদার বলল, “তার সঙ্গে কথা বলিনি। আগে ঘর সামলাই, তারপর বার... চাকরি ছেড়ে তো আর ঘরে বসে বৌ পাহারা দিতে পারি না। তাই ভাবছিলাম ট্রান্সফার পেলে একটা সুরাহা হয়।”

ঘুরে ফিরে সেই এক কথা। জয়ন্ত দেখল হালদারের চুল উস্কোখুস্কো, চোখের কোল বসা। কে জানে, হয়তো সত্যি কথাই বলছে। লোকটা যে অস্থির হয়ে আছে চেহারা থেকে স্পষ্ট। বিজন বলল, “হালদারদা, এত উতলা হলে কী করে চলবে? ট্রান্সফার চাইলেই তো আর পেয়ে যাবেন না। অন্য কোনও উপায় আছে কিনা ভেবেছেন?”

হালদার হাত উল্টিয়ে বলল, “আর কী উপায়? তোমরাই বলো। আমার কিছু মাথায় আসছে না।”

বিজন বলল, “আমার কথা যদি শোনেন তবে বলি, চাপ নেবেন না, বরং চাপ দিন।”

হালদার একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, বলল, “মানে?"

বিজন বলল, “ছেলেটাকে গোপনে ডেকে বলুন, সে যে বৌদি মানে আপনার মিসেসের সঙ্গে প্রেম করছে আপনি জেনে গেছেন।”

হালদার অনিশ্চিত ভাবে বলল, “তাতে কার কী লাভ হবে?”

বিজন বলল, “ভয় দেখান ওর স্কুলে জানিয়ে দেবেন যে ও স্টুডেন্টের মায়ের সঙ্গে ইন্টুপিন্টু করছে। স্কুলের রেপুটেশান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে কথা বলে ওর চাকরি খেয়ে দেবেন।”

হালদার যেন একটু আশার আলো দেখতে পেল, বলল, “তাতে কাজ হবে বলছ?”

বিজন জোর দিয়ে বলল, “হবে না মানে? নির্ঘাত হবে। দেখবেন বাছাধন সুড়সুড় করে আপনার কথামত কাজ করছে। বৌদিকে ছেড়ে একদম লেজ তুলে পালাবে।”

হালদার দুঃখ-দুঃখ গলায় বলল, “সে না-হয় হল, কিন্তু তোমাদের বৌদির কী হবে? ছেলেটার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে যদি কিছু একটা করে বসে?” বলে কেমন উদাস হয়ে ক্যানটিনের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

জয়ন্ত বিজনের মুখের দিকে তাকাল, মনে হল সে হাসি চাপছে, তড়িঘড়ি বলল, “সেটা একটা ভাবনার কথা বটে।”

বিজন কফিতে শেষ চুমুকটা লাগিয়ে বলল, “হালদারদা, সেক্ষেত্রে একটাই উপায়। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেটার সঙ্গে বৌদির বিয়ে দিয়ে দিন।”

হালদার বিজনের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল সে মস্করা করছে কি না। দেখল বিজনের মুখে অটুট গাম্ভীর্য। একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “সেটা কি ভাল দেখাবে? নিজের বৌ!”

বিজন হালদারকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “যুগ বদলে গেছে দাদা। ওই সব আদ্যিকালের বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট নিয়ে একদম পড়ে থাকবেন না। তাছাড়া ভেবে দেখুন এই ব্যবস্থায় খোরপোশের ঝামেলাও থাকবে না।”

হালদার ঘাড় নাড়লেন, “তা ঠিক, কিন্তু মেয়েটার কী হবে?”

বিজন বলল, “মেয়ে যদি মায়ের সঙ্গে যেতে চায়, যাবে। কাছাকাছিই তো বাড়ি বললেন ছেলেটার। যখন ইচ্ছা হবে গিয়ে দেখে আসবেন। মাঝে মাঝে মেয়ে আর তার সৎ বাবা যখন স্কুলে থাকবে বৌদির সঙ্গে গিয়ে প্রেম করে আসবেন। এখন সেই ছেলেটা আপনার বৌয়ের সঙ্গে প্রেম করছে। তখন আপনি তার বৌয়ের সঙ্গে করবেন। যেমন কুকুর তেমন মুগুর।”

হালদারকে দেখে মনে হল বন্দোবস্তটা তার মনঃপূত হয়েছে। পরকীয়ার প্রস্তাবে কে না আহ্লাদিত হয়! বিজন বলল, “বিয়ের পার্টিতে আমাদের নেমন্তন্ন করতে ভুলবেন না যেন।”

*

মা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “দমু, কতদিন পর তোর সঙ্গে কথা বলছি…”

বাড়িতে ভিডিও কল করেছিল দময়ন্তী। পুণে থেকে ফিরে বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলেছিল। মাতাজির আশ্রমের কড়া সিকিউরিটির কথা জানিয়েছিল। চুঁচড়ো থেকে পুণে, পেছনে লেগে থাকা লোকটার কথা বলেছিল। দময়ন্তী কোথায় যাচ্ছে কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে জেনে কার কী লাভ কে জানে? দময়ন্তীর ধারণা লোকটার সঙ্গে আশ্রমের কোনও যোগাযোগ আছে। বড়বাবু বলেছিলেন, তার মানে আশ্রম কর্তৃপক্ষ তোমার কার্যকলাপ নিয়ে এখনও উদ্বিগ্ন। যাইহোক তদন্ত চলছে। জানোই তো তদন্তের কাজে ধামাচাপা দেবার লোক অনেক। তবে আপাতত তোমার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করাতে কোনও অসুবিধে নেই। কারণ ওরা এই মুহূর্তে কোনও হঠকারিতা করবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

জয়ন্ত বলেছিল, ঝপ্‌ করে বিয়ের কথাটা বাড়িতে বলে বোসো না। আমি দাদাকে বলি বাবাকে বুঝিয়ে বলতে, তারপর বাবাকে সঙ্গে করে তোমাদের বাড়ি গিয়ে জানাতে। সবার মাথা ঠান্ডা হলে তাল বুঝে তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বোলো। দময়ন্তী বলেছিল, বাবা রাগ করবে! মানবে না কিছুতেই। জয়ন্ত ভরসা দিয়েছিল, ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

বাবা বলল, “আমাদের একবার জানালে না পর্যন্ত?” অসন্তুষ্ট হলে বাবা দময়ন্তীকে তুই ছেড়ে তুমি করে বলে, বলল, “আমি শ্রীমন্তবাবুর সঙ্গে কথা বলেছি। এখানে বড় করে তোমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান করব, না বলতে পারবে না।”

দময়ন্তীর চোখ ছলছল করছিল, বলল, “খুব ইচ্ছে করছে তোমাদের কাছে যেতে।”

মা জিজ্ঞেস করল, “কবে আসবি দমু?”

জয়ন্ত বলল, “এই তো ছুটি নিলাম, এক্ষুণি ছুটি পাব না। ডিসেম্বরে যাব। আর তো মাস দু’য়েক।”

বাবা-মার সঙ্গে কথা বলে মন ভাল হয়ে গেল দময়ন্তীর। জয়ন্তকে বলল, “এখন শুলেই তো নাক ডাকিয়ে ঘুমোবে। রোদ পড়ে গেছে, চলো হেঁটে আসি।”

জয়ন্ত গড়িমসি করছিল। দময়ন্তী ওকে ঠেলা দিয়ে তুলে বসিয়ে দিল। দু’জনে বেরিয়ে দেখল একটা আশ্চর্য সুন্দর হলুদ আলো উঠেছে। হাইওয়ের সমান্তরাল একটা পিচ রাস্তা বেলাগাঁওকে দু’ভাগ করে, নালা টপকে পাহাড়ের কোলে গিয়ে চড়েছে। ওরা আগে কোনোদিন এদিকটায় আসেনি। লোক-বসতি কম, গাছ-পালা ঝোপ-জঙ্গলের ওপর ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। আজ হাঁটতে-হাঁটতে চলে এল। পাহাড়ের ওপরে একটা মন্দির, সাদা দেওয়াল, নীল চূড়া, পাকদণ্ডী রাস্তা উঠে গেছে। জয়ন্ত বলল, “একদিন পাহাড়ে চড়ে মন্দিরটা দেখে আসব।”

দময়ন্তী বলল, “এলেই হয়!”

পিচ রাস্তার শেষে একটা উঁচু কম্পাউন্ড ওয়ালে ঘেরা দোতলা বাংলো-বাড়ি। লোহার গেট অর্ধেক খোলা, দু’দিকে বোগেনভেলিয়ার লতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম আলোয় দেখল গেটের পাশের থামের ওপর পাথরে লেখা – শান্তিনীড়। জয়ন্ত বলল, “প্লাজার ম্যানেজার এই বৃদ্ধাশ্রমটার কথাই বলছিল মনে হচ্ছে।”

দময়ন্তী বলল, “চলো, ভেতরে গিয়ে দেখি।”

ভেতরে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা। সবুজ লনের ধারে ধারে বেলি-যূথী-অপরাজিতার কেয়ারী। একটা লোহার বেঞ্চ ফাঁকা পড়ে আছে। লনের মাঝখান দিয়ে একটা পাথরে বাঁধানো সরু পথ বাংলোর বারান্দায় গিয়ে উঠেছে। শহরের কোলাহল থেকে দূরে শান্ত পরিবেশ। বারান্দা পেরিয়ে মনে হয় বৃদ্ধাশ্রমের অফিস ঘর, আলো জ্বলছে। ওরা দরজায় উঁকি মেরে দেখল ম্যানেজারবাবুটি একটি ডেস্কটপ কম্প্যুটারের স্ক্রিনে চোখ লাগিয়ে বসে আছে। জয়ন্ত বলল, “আসতে পারি?”

ম্যানেজারবাবু ওদের দেখে নিরতিশয় উৎফুল্ল হল, বলল, আসুন, আসুন... আমার কী সৌভাগ্য, আপনারা এসেছেন। তার আনন্দ দেখে জয়ন্ত ভয় পেল। ব্যাটা ভুল করে ভেবে বসেনি তো যে তারা হোটেলের মত বৃদ্ধাশ্রমেও অগ্রিম বুকিং করতে এসেছে। বলল, বেড়াতে বেড়াতে এদিকটায় চলে এসেছিলাম, ভাবলাম ভেতরটা একবার দেখে যাই।

ম্যানেজার বলল, খুব ভাল করেছেন। দিনের আলো থাকতে থাকতে এলে চারদিকটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারতাম। সামনের ফুল বাগান তো আসার সময় দেখেছেন, আবাসিকরা বাড়ির পেছনে আনাজের চাষ করেছেন, টোম্যাটো, বেগুন, কাঁচা লঙ্কা। উঠোন ঘিরে গ্রিনহাউস বানিয়ে অর্কিড লাগিয়েছেন। এক ভদ্রলোক আছেন, ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারে চাকরি করতেন। তিনিই উদ্যোগ নিয়ে করেন, সবাই হাত লাগায়।

জয়ন্ত বলল, আর এক দিন আসব বেলা থাকতে থাকতে, ভাল করে দেখে যাব। ম্যানেজার বলল, আজ খার রামকৃষ্ণ মিশন থেকে প্রজ্ঞানন্দজি মহারাজ এসেছেন। ট্রাস্টি বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের ভক্ত, মিশনে দীক্ষা নিয়েছেন। উনি ব্যবস্থা করেছেন মাসে দু’-তিনবার কোনও না কোনও মহারাজ এসে ধর্মকথা শুনিয়ে যান। প্রজ্ঞানন্দজি খুব ভাল বক্তা। যখন কথা বলেন মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। চাইলে কিছুক্ষণ বসে যেতে পারেন।

জয়ন্ত কেটে পড়ার তাল করছিল। তার ধারণা কম বয়সে ধর্মকথা শুনলে গায়ে অ্যালার্জি বেরনোর সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু দময়ন্তী ছাড়ল না। সে ধর্মকথা শুনবেই। ম্যানেজার ওদের সঙ্গে করে নিয়ে গেল। একটা বড়সড় হলঘরে বেশ কিছু বয়স্ক মানুষ প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসে আছেন। একদম সামনে একটা ডিভানে এক গেরুয়াধারী সৌম্যদর্শন সাধু পদ্মাসনে শিরদাঁড়া সোজা করে সমাসীন। তিনি ধীর লয়ে, মৃদু কণ্ঠে কিছু বলছেন। জয়ন্তরা সবার পেছনে দুটো চেয়ার টেনে বসে পড়ল। সবাই চুপ করে শুনছেন বলে মহারাজের কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তিনি ঠিক ধর্মকথা বলছিলেন না, সাধারণ গল্পগাছা করছিলেন, সামনে বসে থাকা মানুষদের সুখদুঃখের খবরাখবর নিচ্ছিলেন। মাঝেমঝে শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী শোনাচ্ছিলেন। ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত শান্তির পরিমণ্ডল তৈরি হচ্ছিল।

মহারাজের কথা শেষ হলে ম্যানেজার ওদের দুজনকে ডেকে মহারাজের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল, পরিচয় দিল, এঁরা দত্তাজির বন্ধু - বলে। দময়ন্তী মহারাজের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল, জয়ন্ত হাত জোড় করে। মহারাজ দু’জনকেই হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। বললেন, খারের রামকৃষ্ণ মঠে আসবেন। ভাল লাগবে। জাগতিক নানা কারণে সর্বদাই আমাদের মন বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। ওখানে গিয়ে ঠাকুরের মূর্তির সামনে দু’দণ্ড বসলে দেখবেন আপনা থেকেই মনের চঞ্চলতা কেটে যাচ্ছে।

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ওখানে গেলে আপনার সঙ্গে দেখা করা যাবে কি?

মহারাজ ওদের নিজের মোবাইল নম্বর দিলেন। বললেন, ফোন করে নেবেন একটা। যদি মুম্বাইতে থাকি নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে।

শান্তিনীড় থেকে বেরিয়ে দময়ন্তী বলল, “আজকের দিনটা খুব ভাল কাটল।”

যে রাস্তা ধরে এসেছিল, সে রাস্তা ধরেই ফিরে যাওয়া। দিনের আলোয় অসুবিধে হয়নি। এখন হচ্ছে। রাস্তাটার এখান-ওখান পিচ উঠে খোয়া বেরিয়ে গেছে, বর্ষার পর এই অঞ্চলের সব রাস্তারই এই হাল হয়। শহরের প্রান্তসীমায় বলে কর্পোরেশনের নজরে আসেনি এখনও। দু’-ধারের ঝুপসি গাছপালাগুলো ল্যাম্পপোস্টের আলো আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে, সাবধানে অন্ধকার ডিঙিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। জয়ন্ত দময়ন্তীর হাত ধরল। এমন নয় দময়ন্তীর খুব সমস্যা হচ্ছিল। চশমাধারী জয়ন্তরই হোঁচট খাবার সম্ভাবনা বেশি। তবু এই মনোযোগ দময়ন্তীর ভাল লাগল। জয়ন্তর হাত হাতের মধ্যে চেপে ধরে হাঁটতে লাগল।

বাংলোটার পাশে একটা নতুন কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। কুলি-কামিনদের কতকগুলো অস্থায়ী ঝুপড়ি। প্লাস্টিকের আচ্ছাদনের অন্তরাল থেকে ব্যাটারি লাইটের ছটা আসছে। খোলা আকাশের নিচে কাঠকুটো জড়ো করে রান্না বসিয়েছে এক পরিবার। তারা ছাড়া আশেপাশে লোকজন নেই। অথচ দু’-আড়াইশো মিটার হেঁটে গেলেই আলো ঝলমল সেক্টর মার্কেট। দুই অসম যাপনের কী আশ্চর্য সমান্তরাল সহাবস্থান!

একটা ঝাঁকড়া-মাথা অশ্বত্থ গাছের নিচে একটা বাইক পার্ক করা। একজন মানুষ দাঁড়িয়ে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল সে কোনদিকে যাবে ঠাহর করতে পারছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার রাস্তার এদিক, একবার ওদিক দেখছে। মনে হয় হদিশ জানার জন্য লোক খুঁজছে। ওরা কাছাকাছি যেতে সেও এগিয়ে এল। ওরা দেখল - অমিতাভদা। ওদের দেখে যেন চিনতে পারল না, হয়তো অন্ধকার বলেই, জিজ্ঞেস করল, “ভাইসাব, ইধার কোই গ্যারাজ হ্যায় কেয়া?”

জয়ন্ত বলল, “অমিতাভদা, আমি জয়ন্ত। চিনতে পারছ না?”

অমিতাভদা সময় নিল। চোখের ওপর হাত ঘষে বলল, “আরে তাইতো, হংসমিথুন! এদিকে কোথায় এসেছিলে?”

জয়ন্ত বলল, “এমনিই বেড়াতে বেড়াতে... কী হয়েছে তোমার? বাইক খারাপ হয়ে গেছে?”

অমিতাভদা বলল, “না, না, সব ঠিক আছে, তোমরা এগোও। আমি আসছি... শান্তিনীড়ে একটা কাজ আছে, সেটা সেরেই। তোমরা কালভার্ট পেরোবার আগেই তোমাদের ধরে ফেলব।”

*

মোহিতে ভুরু তুলে বলল, “আপনে পুছা ইসি লিয়ে বাতা রাহা হুঁ। বাসুদেব রাও উস রাত জনিকো সাত আট কল কিয়া থা। মগর একহি কল মিনট ভর কে লিয়ে চলা। বাকি সব ব্ল্যাংক থা।”

মোহিতে বিজন আর জয়ন্তকে পুলিশ স্টেশনে ডেকেছিল। জনির ছবি দেখানোর জন্য। পুলিশের আর্টিস্ট প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনে স্কেচ করে দিয়ে গেছে। দময়ন্তী বলল, আমিও যাব, চলো। মোহিতে ওদের তিনজনকে বসতে বলে ছবিগুলোর কপি আনতে পাঠিয়েছিল একজনকে। তার ফিরতে সময় লাগছিল, সেই অবসরে ওরা টুকটাক কথা বলছিল। তদন্ত কতদূর এগোল, জনির কোনও পাত্তা পাওয়া গেল কি না। মোহিতে বিশেষ আশা দেয়নি। জয়ন্তর মনে পড়ে গেল অমিতাভদা কল ডিউরেশনের ব্যাপারে মোহিতের কাছে খবর নিতে বলেছিল। মোহিতেকে জিজ্ঞেস করল, বাসু আর জনির কথোপকথন কতক্ষণ ধরে চলেছিল, মোহিতে চেক করেছে কি না। মোহিতে প্রথমে তা-না-না-না করছিল, বলতে চাইছিল না। জয়ন্ত বলল, ভাউ, আমাদের উদ্দেশ্য আপনাকে সাহায্য করা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন এসব কথা পাঁচকান হবে না।

মোহিতে নিজেই বলল, “কুছ তো ঘাপলা হ্যায়। বাকি কল জনি লিয়া নেহি হোগা। পতা নেহি। উও বদমাশ যব তক মিল না যায়ে তব তক মাজরা কেয়া হ্যায় সমঝমে নেহি আ রাহা হ্যায়।”

জয়ন্ত ভাবছিল এক মিনিটে বাসু আর জনির কী এমন কথা হয়ে থাকতে পারে যে জীবন দিয়ে তার দাম চুকোতে হল। জিজ্ঞেস করল, সেই রাতের আগে কখনও বাসু জনির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল কি না। মোহিতে বলল, না। এবং সেটাও খুব একটা কম আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। ওরা চুপ করে বসে ছিল। কথা এগোচ্ছিল না। দময়ন্তী দেখছিল শান্তিপুরের পুলিশ স্টেশন আর বেলাগাঁওয়ের পুলিশ স্টেশনে খুব একটা তফাৎ নেই। সেই একই স্যাঁতসেঁতে চুনকাম করা দেওয়াল, পুরনো কাঠের টেবিলে ডাঁই করে রাখা ফাইল। একটা লোক রট আয়রনের জালিতে গোটা দশ বারো চায়ের গেলাস বসিয়ে নিয়ে এসেছিল। টেবিলে টেবিলে ঘুরছিল। মোহিতে জিজ্ঞেস করল ওরা চা খাবে কি না। বিজন হ্যাঁ বলল। হাত বাড়িয়ে কাটিং চায়ের গেলাস নিয়ে চুমুক দিল। জয়ন্ত, দময়ন্তী নিল না। মোহিতে বলল, জনির ফোন নম্বরটা তোমরা রাখতে পার। বাই চান্স তোমাদের কারোর ফোনে কল এলে আমায় সঙ্গে সঙ্গে খবর দেবে।

মোহিতের লোক একটা বড় খামে স্কেচের কপি নিয়ে এল। গোটা আট দশ মুখাবয়ব, সামনে থেকে, পাশ থেকে, বিভিন্ন কোণ থেকে... কোনও ছবিতে জনির সরু গোঁফ, গাল ভর্তি রুক্ষ দাড়ি, কোনোটায় ফ্রেঞ্চকাট। মোহিতে নিজের টেবিল থেকে ফাইলপত্তর সরিয়ে ছবিগুলো পাশাপাশি সাজিয়ে ওদের দিকে চোখ তুলে তাকাল। বলল, ভাল করে দেখুন চিনতে পারেন কি না। বাসুর সঙ্গে কোনওদিন দেখেছেন লোকটাকে?

ওরা তিন জন ঝুঁকে পড়ে দেখছিল। কোঁচকানো কালো চুল, ঘোড়ার মত লম্বাটে মুখ, চৌকো চিবুক, উঁচু ধ্যাবড়া নাক। জয়ন্ত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, এই মুখ কোনওমতেই অমিতাভদার হতে পারে না। অমিতাভদার খড়গ নাসা, নাকের আগা সত্যিই যেন শান দেওয়া অস্ত্র। তাছাড়া চোখের আকৃতি, চিবুকের গড়নও আলাদা। শিল্পীর আঁকায় কিছুটা বিকৃতি থাকতে পারে, তাই বলে এই মুখকে অমিতাভদার বলে ভুল করা যায় না। কিছু কিছু মুখ থাকে যে মুখে চোখ নাক ঠোঁট আলাদা করে সুন্দর নয়, কিন্তু সব মিলিয়ে একটা আকর্ষণ থাকে, এই মুখটা সেই রকম। ভাল করে দেখলে একটা নিষ্ঠুরতার আভাস পাওয়া যায়। তার জন্য ঠোঁটের কোনার ভাঁজ দায়ী কি না কে জানে? ছবির লোকটার ঠোঁট অমিতাভদার তুলনায় অনেক পুরু। জয়ন্ত দেখল, বিজন বা দময়ন্তীও চেনা কোনও মানুষের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছে না। দময়ন্তী ফিসফিস করে বলেই ফেলল, “একটাই শান্তি, অমিতাভদা নয়।”

মোহিতে ওদের লক্ষ করছিল। দময়ন্তীর বাংলায় বলা কথাগুলো অর্ধেক বুঝে বলল, “হাঁ, হাঁ, উনকো জরুর দিখায়েঙ্গে। আপলোগ ভি কোশিশ কিজিয়ে। কুছ পহেচানা-সা লাগ রহা হ্যায়?”

ওরা তিন জনেই ঘাড় নেড়ে না বলল। চেনা কারো সঙ্গে কোনও মিলই পাচ্ছে না। মোহিতে বলল, "আচ্ছেসে দেখিয়ে, শায়েদ বান্দেনে আভি চেহ্‌রা ঢাকনে কে লিয়ে দাড়ি-মোচ বাঢ়ায় হোগা।”

জয়ন্ত বলল, “নেহি মোহিতেজি, হাম ইস আদমিকো নেহি পহেচানতে। কভি নেহি দেখা।”

মোহিতে দৃশ্যতই হতাশ হল। বলল, বাসুর দাদাকেও দেখাতে পারলে ভাল হত। তিনি কবে আসছেন?

বিজন বলল, আজকেই আসার কথা ছিল। কী কাজে আটকে পড়েছেন। কাল পরশুর মধ্যে পৌঁছে যাবেন।

মোহিতে হাত ওলটাল, কী আর করা যাবে। বলল, কাছাকাছি পুলিশ স্টেশনগুলোতে ছবির কপি পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওরা যদি কোনও হদিশ দিতে পারে।

পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে দময়ন্তী বলল, “আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। মিছিমিছি অমিতাভদাকে সন্দেহ করছিলাম।”

বিজন বলল, “তাতে আর কী আছে? একদিন অমিতাভদাকে বাড়িতে ডেকে মাংস রান্না করে খাইয়ে দিও, পাপস্খালন হয়ে যাবে। আমাকে আর রাধিকাকেও ডেকো যেন, ভুলে যেও না।”

দময়ন্তী হেসে বলল, “তোমাদের একসঙ্গে থাকার পার্টিটা কিন্তু এখনও ডিউ, সেটা কবে হচ্ছে?”

বিজন বলল, “এনি ডে। আমরা তো তোমাদের মত রান্নাবান্না করতে পারি না। যেদিন বলবে রেস্তোরাঁ থেকে অর্ডার করে দেব। কবে আসবে বলো?”

পুলিশ স্টেশনের বাইরে খানিকটা ঘাসহীন খোলা জায়গা। সেখানে অবরে-সবরে সকালের দিকে পুলিশ-প্যারেড হয়। অফিস যাওয়ার সময় দু’-একবার চোখে পড়েছে। জয়ন্ত দেখল, অনেকগুলো ভাঙাচোরা গাড়ি, স্কুটার, মোটরবাইক এক ধারে পড়ে আছে। হয়তো কোনও দুর্ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ তুলে এনে রেখেছিল। তাদের মালিকেরা সম্ভবত ভবসিন্ধুর মায়া কাটিয়ে অন্যলোকে পাড়ি দিয়েছে। পরে আর ওয়ারিশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। রঙ জ্বলে ছাল-চামড়া উঠে তাদের এখন এমন অবস্থা যে খোদ মালিকেরাও ওপর থেকে নেমে এলে চিনতে পারবে না। সেদিকে তাকিয়ে জয়ন্ত বলল, “হেয়ার স্টাইল পালটে দিলেই একটা মানুষের হুলিয়া বদলে যায় আর এ তো শুনে শুনে আঁকা... কে জানে, হয়তো দেখেছি লোকটাকে কোথাও।”

দময়ন্তী বলল, “যে লোকটা জনিকে চিনত, মানে যার কথা শুনে আর্টিস্ট ছবি এঁকেছে, সে নিশ্চয়ই ছবিগুলো দেখে বলেছে যে জনি বলে চেনা যাচ্ছে। না-হলে কি আর মোহিতে আমাদের ডেকে দেখাত?”

জয়ন্ত বলল, “তা ঠিক, তবে আমার কেবলই মনে হচ্ছে আমরা কিছু ভুল করছি।”

বিজন বলল, “শুনেছি ভ্রূ চেঁচে ফেললেও নাকি মানুষকে চেনা যায় না।”

জয়ন্ত বলল, “মেয়েরা তো আখছারই পার্লারে গিয়ে ভ্রূ প্লাক করে আসে, তাই বলে কি...” বলেই জিভ কাটল।

বিজন হেসে বলল, “মেয়েদের চেনা কি এতই সহজ ভেবেছিস?”

দময়ন্তী বলল, “বিজুদা, ভাল হবে না বলছি!”

জয়ন্ত হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দময়ন্তী বলল, “কী হল? দাঁড়ালে কেন?”

জয়ন্ত কপালে মুষ্টিবদ্ধ হাত ঠুকে বলল, “লোকটাকে আমি আগে দেখেছি।”

দময়ন্তী আর বিজন দু’জনে সমস্বরে বলল, “কোথায়?"

জয়ন্তর চোখ ঝকঝক করছিল, দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “তুমিও দেখেছ। মনে করার চেষ্টা করো।”

দময়ন্তী অধৈর্য হয়ে বলল, “হেঁয়ালি কোরো না। কোথায় দেখেছি? তাড়াতাড়ি বলো।”

জয়ন্ত বলল, “আমরা ভাবছিলাম দাড়ি-গোঁফ রেখে লোকটা নিজের মুখ ঢাকবার চেষ্টা করবে। সাধারণত অপরাধীরা সেটাই করে। কিন্তু এই মক্কেল বেজায় সেয়ানা। ঠিক তার উল্টো কাজ করেছে।”

দময়ন্তী জয়ন্তর দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর জয়ন্তর হাতে টান দিয়ে বলল, “চলো, এক্ষুণি মোহিতেকে বলে পুণের মাতাজির আশ্রমে ফোর্স পাঠানো দরকার। অনেক দেরি হয়ে গেছে। পুরুত ঠাকুর এখনও সেখানে বসে আছে কি না ভগবানই জানে।”


(এর পরে)



(পরবাস-৮৪, ১০ অক্টোবর, ২০২১)