ইন্দোনেশিয়ার সতেরো হাজার দ্বীপমালার ম্যাপে বালি নামক দ্বীপ একটি ছোট্ট ফুটকির মতো। ৯৫ x ১১২ মাইল সাইজের দ্বীপটি পূর্বে লম্বক ও পশ্চিমে জাভার মধ্যে গোঁজা। সুমাত্রা বা বোরনিওর মতো বিরাট দ্বীপগুলির ধারেকাছেও লাগে না। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার সবথেকে বেশি টুরিস্ট এই ছোট্ট দ্বীপেই বেড়াতে আসেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বালি বিশ্ববিখ্যাত। অনুকূল আবহাওয়া, সমুদ্রতট, বনানী ও পাহাড়ের জন্য হিপিরা ’৬০-’৭০ সাল থেকেই এখানে আসতে শুরু করেছিল। এখন দক্ষিণ তীরে, সমুদ্র ঘেঁষে ইয়া বড়ো বড়ো রিসর্ট হোটেল তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়া থেকে দলে দলে কলেজ ছাত্রছাত্রীরা এখানে ছুটি কাটাতে আসে।
আমিও গেছিলাম কয়েক বছর আগে। বালি সম্বন্ধে আগে থেকে বিশেষ কিছু জানা ছিল না। গিয়ে দেখলাম শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, বালির লোকেদের নিজস্ব সৌন্দর্যজ্ঞানও প্রখর, বিশেষ করে স্থাপত্যশিল্পের। প্রতিটি মন্দির, বাড়ির দেওয়াল, গেট থেকে শুরু করে ছোটখাট হাতের কাজ পর্যন্ত সব কিছু নিখুঁত সুন্দর কারুকার্যে ভরা। লোকেরা সবাই নম্র, বিনয়ী ও অতিথিবৎসল। চিৎকার, চেঁচামেচি করাটা ওরা ভীষণ অভদ্র ব্যবহার বলে মনে করে। আরও যেটা প্রথমেই চোখে পড়ে তা হোল ওদের জাতীয় ধর্ম। ইন্দোনেশিয়ার ৯০% লোকেরা মুসলিম, কিন্তু তারই মাঝখানে ছোট্ট বালি একেবারে ৯৯% হিন্দু! এ সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই ছিল না (আমারই অজ্ঞতা)। ভারতের বাইরে নেপাল আর এটাই একমাত্র হিন্দু (??হিন্দুপ্রধান? বালি কি আলাদা দেশ?) দেশ। মুসলিম পরিবৃত হয়েও এরা বেশ শান্তিতেই আছে।
ঐতিহাসিক মতে হিন্দুরা ভারত থেকে প্রথম ইন্দোনেশিয়ায় আসে ১০০ খ্রি.পূ. থেকে। প্রধানত জাভা ও বালিতে এদের বসবাস ছিল, পরে মুসলমানদের আক্রমণের সময় থেকে জাভার পাট চুকিয়ে একমাত্র বালিতেই সব হিন্দুরা একত্র হয়। গত পাঁচশো বছর থেকে এরা ভারতীয় মূল ধর্ম থেকে একেবারে আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়েছে। এটা ঠিক পশুপাখির এক থেকে বিভিন্ন রূপে বিবর্তনের মতই। কীভাবে ও কতটা বদলালো সে বিষয়ে সব হিন্দুই নিশ্চয় কৌতূহলী হবেন।
বেশিরভাগ ভারতীয়দের বালির হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে বিশেষ কোনো ধারণা নেই। কিন্তু উলটোদিকে বালির বাসিন্দাদের ভারত ও ভারতীয় হিন্দুত্ব সম্পর্কে অনেক বেশি জ্ঞান ও কৌতূহল। ভারতের বাইরে একমাত্র বালিতেই আমি হিন্দু বলে বিশেষ সম্মান পেয়েছি, আর সেইসঙ্গে প্রচুর কৌতূহলী প্রশ্নও। ওদের জীবনে অন্তত একবার ভারতে বেড়িয়ে আসার প্রবল ইচ্ছা, জানতে চায় দেশটা কীরকম, ভারতে মন্দিরগুলো কি বালির মন্দিরের মতো, না অন্যরকম। ওখানকার পোশাক, খাবার, ভাষা সবকিছুই এরা জানতে চায়।
বালির ধর্ম ও সংস্কৃতি জানতে হলে আপনাকে নুসা দুয়ার মত সেক্সি, হইচই-ভরা সমুদ্রতট ছেড়ে আসতে হবে দ্বীপের মাঝখানে ছোট্ট, শান্ত শহর উবুদ-এ। আমিও বেশিরভাগ সময় এখানেই ছিলাম। মন্দির, স্থাপত্য, কলাকার্য, শাস্ত্রীয় নাচগান, অভিনয় ইত্যাদির জন্য উবুদ বিখ্যাত। এ ছাড়া শহরটা বেশ শান্ত ছিমছাম। কাছেই একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে, পূজা, অর্ঘ্য পেয়ে সেটা এখন শান্ত। আশপাশে পাহাড়ি উপত্যকায় উজ্জ্বল সবুজ ধানের খেত। প্রতিদিন সকালে দেখতাম শহরে সব দোকান, অফিস, হোটেলের দরজার সামনে ছোট্ট তালপাতায় বোনা টুকরিতে ভগবানের উদ্দেশ্যে একটুখানি ফুলপাতার নৈবেদ্য রাখা। এরা বলে চানাং-সারি।
এখানে প্রতিটি শহরে ও গ্রামে নিজস্ব মন্দির আছে, পুরনোগুলো পাথরে তৈরি আর আধুনিকগুলো সিমেন্টে। সবগুলো ছাত থেকে মেঝে পর্যন্ত অপূর্ব কারুকার্যে ভরা। দু-একটা পরিচিত দেব-দেবীর মন্দির দেখলাম। শিব, বিষ্ণু এমনকি সরস্বতীও। সব মন্দিরই বেশ চুপচাপ, পরিষ্কার, ভিড়হীন। আমি মনে মনে ভাবলাম এরা যদি পুরীর জগন্নাথ বা মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী মন্দির দেখতে যান তো ভিড়ের চোটে হয়তো ভয় পেয়ে ভিরমি খাবেন!
এবার বালির বিবর্তিত হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কিছু তথ্য পরিবেশন করা যাক। গাইড, মন্দিরের পুরোহিত, দোকানদার, এঁদের কাছে ভাঙা ইংরেজিতে প্রশ্নোত্তর ও তার সঙ্গে গুগল ও উইকি-তথ্য মিলিয়ে যা বুঝলাম তাই লিখছি। কোনো ভুলচুক হলে জ্ঞানী পাঠকেরা ক্ষমা করবেন।
বালির ধর্ম অদ্বিতীয়বাদী। নিরাকার একমেবাদ্বিতীয়ম ভগবানকে এরা ‘অচিন্ত্য’ বলে, যার রূপ কল্পনা বা চিন্তাও করা যায় না। তাঁরই অবতার—শিব, বিষ্ণু, পার্বতী, গণেশ ইত্যাদি। বালির লোকেরা ভারতীয়দের মতই কর্মফল ও পুনর্জন্মতে বিশ্বাস করেন।
ভারতের মতো এখানেও চারটি বর্ণের চল— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। কিন্তু একমাত্র ব্রাহ্মণ (মন্দিরের পুরোহিতরা) ছাড়া আর কেউ বর্ণ বা জাতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। সামাজিক কাজকর্মে, বিয়েটিয়েতেও কোন জাতির বালাই নেই। পুরোহিতরা এদেশে সরকার থেকে ভাতা পান (ভারতেও এমন হওয়া উচিত, দুর্নীতি অনেক কমবে।) আর সবচেয়ে বড়ো পার্থক্য এখানে কোনো দলিত বা অস্পৃশ্যজাতি নেই! (ভারতেও এরকম হলে কতো ভালো হতো, তাই না?)
ভারতের মতো এখানেও কয়েকটি প্রধান ধর্মোৎসব পালন করা হয়, দিওয়ালী, শিবরাত্রি, হোলি, দুর্গাপূজা, গণেশপূজা এমনকি ছট উৎসব পর্যন্ত। তবে ভারতের তুলনায় অনেক শান্তভাবে। এছাড়াও প্রত্যেক মন্দিরে মন্দিরপত্তনের দিনটি প্রতি বছর মানা হয়।
এক বিষয়ে বালি ভারত থেকে আলাদা। এদেশের সবচেয়ে বড়ো উৎসব (জানি না এটাকে ঠিক উৎসব বলা যায় কি না, উৎসবের মতো হইচই নেই) হচ্ছে ‘নাইপি’ (nyepi)—এটা এঁদের নববর্ষ। মার্চ-এপ্রিলে পড়ে। এইদিন ভোর ছ’টা থেকে আগামী দিন ছ’টা পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টা সবাই মৌনব্রত পালন করেন। ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, পুরুষ সবাই নিঃশব্দ, কোনো কথা, কোনো কাজ করা যাবে না। স্কুল কলেজ অফিস দোকান হোটেল রেস্তরাঁ সব বন্ধ। শুধু এমারজেন্সি পুলিস, হাসপাতাল ও দমকল খোলা থাকে। আন্তর্জাতিক এয়ারপ্লেনও ওঠানামা করতে পারে না—সব এয়ারপোর্ট, স্টেশন ইত্যাদি বন্ধ। এটা মনে না রাখলে টুরিস্টদের কপালে ভোগান্তি। এদিন শুধু ঘরে বসে ভগবানের আরাধনা করার সময়। আর কিচ্ছু নয়। ভাগ্যিস আমি সেপ্টেম্বর মাসে গেছিলাম।
বালির হিন্দুরা ভারতীয়দের মতোই বীফ খান না। কিন্তু সাদৃশ্যটা ওইখানেই শেষ। বীফ ছাড়া এঁরা সবাই সর্বভূক। পর্ক, মাছ, মুরগি তো সবাই ভালোবাসে, এ ছাড়াও কুকুর, বেড়াল, সাপ, পাখি, জোঁক সবকিছুই খাদ্যতালিকায় পড়ে। এদেশে দুটি প্রধান খাবার—নাসি গোরাং বা পোলাও এবং নাসি চাম্পুর বা ভাজা ন্যুডল। এর সঙ্গে থাকবে নানা রকম মাংস ও সবজি, বেশ নারকোল, লংকা ও মশলা দিয়ে তৈরি। সবুজ বা লাল দুই লঙ্কাই এঁদের প্রিয়।
কোনো ধর্ম বা সংস্কৃতি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। বালিতেও ভারতীয় হিন্দুত্বের ছোঁয়াচ লাগছে। শুনেছি রুদ্রাক্ষ গেরুয়া সম্বলিত সাধুরা ভারতীয় ‘আসল’ হিন্দুধর্ম শেখাতে শুরু করেছেন। আশা করি বালির লোকেরা নিজেদের ধর্মে স্থির থাকতে পারবেন।
অন্যান্য দেশের মতো বালিতেও মন্দির বা কোনো অনুষ্ঠানে যেতে হলে নিয়মমাফিক পোশাকের দরকার। এমনিতেও দ্বীপে পুরুষ বা মহিলা কেউই ছোট হাফপ্যান্ট বা হাতকাটা জামা পরেন না। মন্দিরে ঢুকতে হলে পুরোহিত একটা কোমর থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা লুঙ্গি বা সারং পরিয়ে দেবে। বিকিনি, সুইমসুট শুধু নুসা দুয়ার বিচেই সীমাবদ্ধ।
বালির ভাষা কিছুটা ইন্দোনেশীয় কিছু দক্ষিণ ভারতীয় মেশানো। বেশ কঠিন। শুনেছি স্কুলে ভাষা ও অন্যান্য সাবজেকটের সঙ্গে গায়ত্রী মন্ত্র, ত্রিকাল-সন্ধ্যা ইত্যাদিও বাচ্চাদের শেখানো হয়। ভারতে ক’টা স্কুলে এসব শেখায় বলুন তো?
বালির হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ রামায়ণ ও মহাভারত, তবে রামায়ণটাই বিশেষ জনপ্রিয়। (‘গরুড়’ এদের জাতীয় এয়ারলাইন্সের নাম।) রামায়ণের প্রতিটি দৃশ্য বা ঘটনা এদের শাস্ত্রীয় নাচ, গান, নাটক ইত্যাদির মূল কাঠামো। অনেকটা আমাদের কথাকলি নাচের মতো। বালিতে থাকাকালীন আমার কিছু দেখার সুযোগ হয়েছিল, তারই কয়েকটা ছবি ও ভিডিও যোগ করে দিলাম।
বালিতে প্রতি সন্ধ্যায় কোনো না কোনো মন্দিরের প্রাঙ্গণে ম্যারাপ বেঁধে যাত্রা দলের মতো নাচগানের আয়োজন হয়। অনেক বিদেশী টুরিস্টরাও আসেন। একটি বিশেষ জনপ্রিয় নাচ ‘কিক্যাক’ (kechak)। খালিগায়ে শুধু লুঙ্গিপরা জন কুড়ি বাদক ও গায়করা মাটিতে গোল হয়ে বসে হাততালি দিয়ে গান গায় আর মাঝখানে নর্তক-নর্তকীরা কোন দৃশ্য অভিনয় করে। ভাষা না জানলেও গল্পটা তো আমরা জানি তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না। আরেকটা মুখোশ-নাচ ‘বারং’—সেটা নানা দৈত্যদানবদের নাশ করার দৃশ্য।
মুখোশগুলি বিরাট, রংচঙে, নজর কাড়ার মতোই। আরেকটা আকর্ষণীয় নাচের নাম ‘সঙ্ঘয়ং দেদারি’ (sanghyang dedari)—একে সম্মোহন নাচও বলা যায়। হলুদ রঙের পোশাক পরা একটি ন’-দশ বছরের কুমারী মেয়ে চোখ বুজে নাচতে নাচতে একেবারে ঘোরের মধ্যে চলে যায়। নাচের ঘোরে সে তখন অনেক শক্ত বা অসম্ভব কাজও করতে পারে যেমন বাঁশের খুঁটি বেয়ে ওঠা, এমনকি জ্বলন্ত কয়লার ওপর হেঁটে যাওয়া ইত্যদি।
বালি দ্বীপের একেবারে শেষ দক্ষিণ প্রান্তে, সমুদ্রের তীরে একটা বিশালকায় বিষ্ণুমূর্তি তৈরি করা হয়েছে। গরুড়ের পিঠে আসীন ২০০০ ফুট উঁচু মূর্তিটি তৈরি করতে আঠাশ বছর লেগেছে। আমি যখন গেছিলাম শুধু গরুড় ও বিষ্ণুর মাথাটা তৈরি হয়েছিল। সিমেন্ট দিয়ে তৈরি, পুরোটা সূক্ষ্ম কারুকার্যে ভরা। এটা নাকি সারা পৃথিবীতে হিন্দুধর্মের সবচেয়ে বড় প্রতীক।
বালির হিন্দুধর্মের অনেক বিষয়ে আমি অজ্ঞ। তবে এই বিবর্তিত রূপটা খুবই ইন্টারেস্টিং। এই জন্যই বালি আমার প্রিয় ভ্রমণস্থান। (সুন্দর আবহাওয়া আর সমুদ্র তো আছেই।) আমেরিকা থেকে এতদূর না হলে আমি এখানেই একটা ছোট্ট বাড়ি বানিয়ে থেকে যেতাম। আমার মতে এরা ভারতীয় ধর্মটার অনেক পুরনো, অর্থহীন জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলে শুধু মূল জিনিসটা নিজেদের করে নিয়েছে। বিবর্তনের এই একটা মস্ত উপকার। আমরাও এদের কাছে অনেক পুরনো তথ্য নতুন করে শিখতে পারি।
(পরবাস-৮৫, ১০ জানুয়ারি, ২০২২)