Subscribe to Magazines





পরবাসে উদয় চট্টোপাধ্যায়ের
আরো লেখা


ISSN 1563-8685




প্রসঙ্গ : অভিশাপ

কুনের শাপে কি গোরু মরে? নিঃসন্দেহে, না। মরলে গোবংশ অনেক আগেই নির্বংশ হয়ে যেত। বরং হয়েছে উলটোটাই—শকুনবংশই এখন ধ্বংসের পথে। তার কারণ অবশ্য গোরুদের দেওয়া কোন অভিশাপ নয়, নিতান্তই অরণ্য উচ্ছেদের ফলে শকুনদের বাসস্থানের ঘাটতি। পরিবেশবিদরা এখন উঠেপড়ে লেগেছেন শকুনদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাপনায়। তাঁদের উদ্যম সফল হোক! প্রবাদটির অর্থ অবশ্য ভিন্নতর। প্রবাদটি বুঝিয়ে দিতে চাইছে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে কোন অভিশাপ ফলপ্রসূ হতে পারে না। তাহলে রাজনৈতিক নেতারা, বিশেষত একনায়কতন্ত্রী নেতারা, শুধু অভিশাপ দিয়েই বিরোধীদের নিপাত করতে পারতেন, অথবা বিরোধীরা আর নিপীড়িত জনতা পীড়নকারী শাসকবর্গের। খুবই সহজ হত ব্যাপারটা – প্রয়োজন পড়ত না কূটনৈতিক তৎপরতার, আন্দোলনের কিংবা মাঝেমধ্যেই পেশী আস্ফালিত করার। আমরা আশা করতে পারি ‘এই পথে এপথেই আলো জ্বেলে জ্বেলে পৃথিবীর ক্রমমুক্তি’ না হলেও পৃথিবী আরও কয়েক শতাব্দী টিকে থাকবে।

অভিশাপের অর্থ অন্যের অমঙ্গল কামনা। মানুষ সামাজিক জীব – একান্ত ব্যক্তিগতভাবে বেঁচে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। স্রেফ বাঁচার তাগিদেই ব্যক্তিমানুষ সমাজের অন্যান্য মানুষদের উপর নির্ভরশীল। তবে অন্যের অমঙ্গল কামনা কেন? এর উত্তর মিলবে ডারউইনের (Darwin) ‘Struggle for existence and struggle for supremacy’র তত্ত্বে। কোন প্রজাতিকে টিকে থাকতে হলে প্রাথমিক শর্ত হল অন্যান্য প্রজাতির থেকে তাকে শারীরিক বা মানসিকভাবে সমৃদ্ধতর হতে হবে। এই শর্ত মেনে সেই প্রজাতি বেঁচে থাকার ছাড়পত্র পেলে তারপর এসে যায় ব্যক্তিগত বা প্রজাতিগতভাবে অপরাপর ব্যক্তি বা প্রজাতির উপরে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। এটা একটা জীনগত স্বাভাবিক প্রবণতা, যা বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে ডকিন্‌সের (Dawkins) বহুপঠিত আর বহু-আলোচিত বই ‘The Selfish Gene’এ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে গোরুর মৃত্যুকামনায় শকুনের অভিশাপ কিছু অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সে অভিশাপ ফলে না। শকুনকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয় প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই—‘করেংগে ইয়া মরেংগে।’ মানবিক ক্ষেত্রেও এই একই নীতি। তাহলে বারবার অভিশাপের প্রসঙ্গ আসে কেন?

মানবেতিহাসে অভিশাপ কিছু অর্বাচীন প্রসঙ্গ নয়, বরং তা সুপ্রাচীন। আমাদের দেশের রামায়ণ মহাভারত পুরাণাদিতে তার অসংখ্য উদাহরণ মিলবে, এবং অন্য দেশের পুরাণ উপাখ্যানেও। মহাভারত দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। মহাভারতের আদিপর্ব শুরু জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞস্থলে বৈশম্পায়নের মহাভারত বর্ণনার বৃত্তান্ত দিয়ে, যার কথারম্ভেই রয়েছে কচ-দেবযানীর উপাখ্যান। রবীন্দ্রনাথের ‘বিদায় অভিশাপ’ পাঠের সুবাদে বাঙালি পাঠকের কাছে এই উপাখ্যান অতিপরিচিত। দেবগুরু বৃহস্পতি পুত্র কচকে অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কাছে পাঠিয়েছিলেন মৃত-সঞ্জীবনী বিদ্যা শিক্ষালাভ করতে। সহস্র বৎসর গুরুগৃহে থেকে আর গুরুকন্যা দেবযানীর মনোরঞ্জন করে কচ এই বিদ্যা আয়ত্ত করেন। কচের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে দানবরা তাঁকে বধ করে তাঁর দেহভস্ম সুরায় মিশিয়ে শুক্রাচার্যকে পান করায়। দেবযানীর উপরোধে শুক্রাচার্য তাঁর উদরস্থ শিষ্যকে সঞ্জীবনী বিদ্যা দান করে আদেশ করেন তাঁর উদর বিদীর্ণ করে বেরিয়ে এসে তাঁকে এই মন্ত্রের সাহায্যে প্রাণদান করতে। শুক্রাচার্য গাত্রোত্থান করে সুরাপানের প্রতি এই অভিশাপ দিলেন, যে মন্দমতি ব্রাহ্মণ মোহবশে সুরাপান করবে সে ধর্মহীন ও ব্রহ্মহত্যাকারীর তুল্য পাপী হবে। দেখা যাচ্ছে এই অভিশাপপ্রদান কারো অনিষ্টকামনায় নয়, বরং এক সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে, যাতে সুরাপানে ব্রাহ্মণেরা দুর্মতিগ্রস্ত না-হয়ে পড়েন। তবে অভিশাপপর্ব তখনো শেষ হয় নি। কচ নানা যুক্তি দিয়ে দেবযানীর প্রণয়প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে দেবযানী কচকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে তার পিতার কাছ থেকে অধিগত বিদ্যার প্রয়োগ সে করতে পারবে না। রবীন্দ্রকবিতায় কচ দেবযানীকে কোন অভিশাপ না-দিয়ে তার সুখী জীবন কামনা করেছিলেন। মহাভারতের উপাখ্যানে কিন্তু কচ দেবযানীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে সে কোন ব্রাহ্মণসন্তানকে পতি হিসাবে পাবে না। হয়েছিল সেটাই—দেবযানীর বিবাহ হয়েছিল ক্ষত্রিয়রাজ যযাতির সঙ্গে। এই যযাতি-দেবযানী থেকেই পুরু অথবা কুরুবংশের উৎপত্তি। কুরুনন্দনদের ভ্রাতৃবিরোধই মহাভারতের মূল উপজীব্য।

যযাতির সর্বকনিষ্ঠ পুত্র পুরুর রাজপদ প্রাপ্তির পিছনে রয়েছে যযাতির প্রতি তাঁর শ্বশুর শুক্রাচার্যের অভিশাপ। বিবাহের পর দেবযানীর অনুগমন করেছিলেন শর্মিষ্ঠা। তিনি ছিলেন দানবরাজ বৃষপর্বার পুত্রী, এবং নেহাতই ভাগ্যদোষে তাঁকে দেবযানীর দাসী হতে হয়েছিল। শুক্রাচার্য যযাতিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন শর্মিষ্ঠাকে সসম্মানে রাখতে কিন্তু শয্যাসঙ্গিনী না-করতে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে যযাতি আর শর্মিষ্ঠার বিবাহ হয়েছিল, এবং তাঁদের তিনটি পুত্র হয়েছিল যাদের সর্বকনিষ্ঠ পুরু। ক্রুদ্ধা দেবযানী পিতা শুক্রাচার্যের কাছে এই নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন, যার ফলে শুক্রাচার্য ক্রুদ্ধ হয়ে যযাতিকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে দুর্জয় জরা তাঁকে গ্রাস করবে। শাপ প্রত্যাহারের জন্য যযাতি অনুনয় করলে শুক্রাচার্য বলেছিলেন এই জরা যযাতি অন্যকে দিতে পারবেন। যৌবনভোগে অতৃপ্ত যযাতি তাঁর পাঁচপুত্রকে ডেকে তাঁর এই জরার ভার তাদের মধ্যে যে কোন একজনকে নিতে বললেন। একমাত্র পুরু ছাড়া অন্য চার পুত্র তাঁর এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করল। সহস্র বর্ষ যৌবনসুখ উপভোগ করেও অতৃপ্ত যযাতি উপলব্ধি করলেন ‘ন জাতু কামঃ কামানুপভোগেন শাম্যতি/ হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেন ভূয় একাধিবর্ততে’ – অর্থাৎ, কাম্যবস্তুর উপভোগে কখনও কামনার শান্তি হয় না, ঘৃত সংযোগে অগ্নির ন্যায় তা আরও বৃদ্ধি পায়। যযাতি পুরুকে তাঁর যৌবন প্রত্যর্পণ করে তাঁকে রাজপদে অভিষিক্ত করলেন।

পুরুর অনেকখানি অধস্তন পুরুষ দুষ্মন্ত – কণ্ব মুনির আশ্রমে প্রতিপালিতা শকুন্তলার সঙ্গে তপোবনে যাঁর সাক্ষাৎ, প্রণয় এবং গান্ধর্ব বিবাহ। এই শকুন্তলাকেও হতে হয়েছিল অভিশাপের শিকার। এই বৃত্তান্ত মহাভারতে নেই, কিন্তু কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলমের’ মাধ্যমে এর প্রসিদ্ধি। দুষ্মন্ত রাজধানীতে ফিরে গেছেন অভিজ্ঞান হিসাবে তাঁর রাজ-অঙ্গুরীয় শকুন্তলাকে প্রদান করে এবং লোক পাঠিয়ে তাঁকে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এর মধ্যে কণ্ব মুনিরআশ্রমে দুর্বাসা মুনির আবির্ভাব এবং বিরহকাতরা শকুন্তলা তাঁর প্রতি মনোযোগ না-দেওয়ার অপরাধে অভিশাপ বর্ষণ – ‘যার কথা ভেবে তুমি আমাকে অবজ্ঞা করলে সে তোমাকে চিনতেই পারবে না।’ লঘুপাপে গুরুদণ্ড বিধানের এক নিদর্শন। অনন্য নিদর্শন বলা যাচ্ছে না, কেন না পুরাণ-আখ্যানে এতদৃশ অভিশাপপ্রদানের উদাহরণ একাধিক।

মহাভারতের আদিপর্বে রয়েছে অণীমাণ্ডব্যের উপাখ্যান। ঊর্ধ্ববাহু তপস্বী মাণ্ডব্যের আশ্রমে কিছু তস্কর তাদের অপহৃত ধন লুকিয়ে রেখেছিল। রাজরক্ষীরা এই ধন উদ্ধার করে মাণ্ডব্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও মৌনব্রতে থাকায় তিনি কোন উত্তর দেন নি। চোরদের সঙ্গে তাঁরও শূলদণ্ডের আদেশ হল, কিন্তু তপস্যার প্রভাবে তিনি জীবিত রইলেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে রাজা তাঁকে শূল থেকে নামালেন, কিন্তু শূলের অগ্রভাগ (অণী) তাঁর পশ্চাদ্দেশে রয়ে গেল। পরে একদিন তিনি ধর্মকে প্রশ্ন করেছিলেন কোন্‌ কর্মের ফলে তাঁর এই শাস্তিভোগ। ধর্ম বলেছিলেন বাল্যকালে তিনি একটি পতঙ্গের পুচ্ছদেশে তৃণ প্রবিষ্ট করেছিলেন, তাই এই ফল। অণীমাণ্ডব্য বললেন, আপনি লঘুপাপে আমাকে গুরুদণ্ড দিয়েছেন, তাই আমার শাপে আপনি শূদ্র হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন। এই অভিশাপের ফলে ধর্মকে দাসীর গর্ভে বিদুর হয়ে জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল। গল্পের এখানেই শেষ নয়। অণীমাণ্ডব্য বিধান দিলেন চতুর্দশ বৎসর বয়সের মধ্যে কেউ কিছু করলে তা পাপ বলে গণ্য হবে না। আমাদের দেশের বর্তমান সমাজবিধানে মোটামুটিভাবে এটাই অনুসৃত হয়ে চলেছে, শুধু বয়সটাকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ষোলো।

দীর্ঘতমার ক্ষেত্রে লঘুপাপে নয়, প্রায় বিনাপাপেই গুরুদণ্ড হয়েছিল। ঋষি উতথ্যের পত্নী মমতার গর্ভিণী অবস্থায় তাঁর দেবর বৃহস্পতি বলপ্রয়োগে সংগমের চেষ্টা করলে গর্ভস্থ শিশু দীর্ঘতমা তার পা দিয়ে পিতৃব্যের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করেছিল। ক্রোধে বৃহস্পতি তাকে অভিশাপ দেন যে সে অন্ধ হয়ে জন্মাবে। পরবর্তীকালে দীর্ঘতমা ঋষি হিসাবে গণ্য হয়েছিলেন, যদিও তাঁর নৈতিক চরিত্র ছিল অতি হীনমানের। এই ঋষি দীর্ঘতমার ঔরসেই বলিরাজার পত্নী সুদেষ্ণার গর্ভে ক্ষেত্রজ পাঁচ পুত্র উৎপাদিত হয়েছিল — যাদের নাম অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুণ্ড্র আর সুহ্ম – আর তাঁদের নামেই খ্যাত হয়েছিল ভারতের পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি রাজ্য।

মহাভারতের আদিপর্বের সূচনাই হয়েছে এক অভিশাপ প্রসঙ্গ দিয়ে। পরীক্ষিৎপুত্র জনমেজয় এবং তাঁর ভ্রাতারা যজ্ঞস্থলে প্রবেশ করা এক কুকুরকে প্রহার করলে সেই কুকুর তার মাতা দেবশুনী সরমার কাছে গিয়ে অভিযোগ জানাল। বিনাদোষে পুত্রকে প্রহার করার অপরাধে সরমা জনমেজয়কে অভিশাপ দিলেন যে তাঁর উপর অতর্কিত বিপদ এসে পড়বে। শাপমোচনের জন্য যজ্ঞার্থে তাঁকে এক উপযুক্ত পুরোহিতের সন্ধান করতে হয়েছিল। এই যজ্ঞের পরিণতি কী হয়েছিল মহাভারতকার আমাদের জানান নি, তবে জনমেজয় বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর সর্পসত্র যজ্ঞের জন্য। এই যজ্ঞস্থলেই বেদব্যাস-শিষ্য বৈশম্পায়ন মহাভারত বিবৃত করেছিলেন।

জনমেজয় সর্পসত্র বা সর্পনিধন যজ্ঞ করেছিলেন মহাসর্প তক্ষকের দংশনে তাঁর পিতা পরীক্ষিতের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। এই মৃত্যুর পিছনেও রয়েছে এক অভিশাপের ইতিহাস। অভিমন্যু-উত্তরার পুত্র পরীক্ষিতকে রাজ্যসমর্পণ করে পাণ্ডবেরা বানপ্রস্থ অবলম্বন করেছিলেন। পরীক্ষিৎ একদিন মৃগয়াকালে একটি বাণবিদ্ধ মৃগের পশ্চাদ্ধাবন করছিলেন। জঙ্গলমধ্যে তপস্যারত শমীক নামে এক মুনিকে মৃগের বিষয়ে প্রশ্ন করে কোন উত্তর না-পেয়ে ক্রোধবশে এক মৃত সর্প মুনির স্কন্ধে পরিয়ে দিলেন। শমীক এ বিষয়ে কোন ক্রোধ প্রকাশ না-করলেও এই বৃত্তান্ত শুনে তাঁর পুত্র শৃঙ্গী ক্রোধান্বিত হয়ে অভিশাপ দিলেন, যে আমার নিরপরাধ পিতার স্কন্ধে যে মৃত সর্প দিয়েছে সেই পাপীকে সপ্তরাত্রির মধ্যে মহাবিষধর তক্ষক নাগ দংশন করবে। শমীকের অনুরোধ সত্ত্বেও শৃঙ্গী তাঁর অভিশাপ প্রত্যাহার করেন নি। পরীক্ষিৎ আত্মরক্ষার জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ নিলেও তক্ষকের হাত থেকে রক্ষা পান নি -- অভিশাপের অন্তিম দিনে সূর্যাস্তসময়ে আহারকালে একটি ফল থেকে নির্গত তক্ষকের দংশনে তাঁর প্রাণনাশ হয়।

সাপ নিয়ে পরিহাসের মারাত্মক আর এক পরিণতি হয়েছিল জনমেজয়ের পরবর্তীকালে। ঋষি সহস্রপাৎতৃণনির্মিত এক সাপ নিয়ে ভয় দেখিয়েছিলেন তাঁর ঋষিবন্ধু খগমকে। খগম ভয়ে মূর্ছিতহন, এবং সংজ্ঞালাভ করে সহস্রপাতকে অভিশাপ দিয়ে ডুণ্ডুভ অর্থাৎ ঢোঁড়া সাপে রূপান্তরিত করেন। বহু বর্ষপরে রাজা রুরুর দর্শনলাভে তাঁর শাপমুক্তি ঘটেছিল। এটাও তো লঘুপাপে গুরুদণ্ডের আর এক নিদর্শন।

জনমেজয়ের সর্পসত্র যজ্ঞে তক্ষকের প্রাণরক্ষা হয় জরৎকারুর পুত্র আস্তীকের হস্তক্ষেপের ফলে। যজ্ঞে সর্পদের প্রাণ যাওয়ার পিছনেও রয়েছে অভিশাপের ইতিহাস। মহর্ষি কশ্যপের দুই পত্নী—বিনতা ও কদ্রু। বিনতার পুত্র অরুণ ও গরুড়, কদ্রুর পুত্র সাপেরা। একদিন ইন্দ্রের অশ্ব উচ্চৈঃশ্রবাকে দেখে কদ্রু আর বিনতা তর্ক করলেন এই অশ্বের বর্ণ কী। বিনতা বললেন, শ্বেত; কদ্রু বললেন, এর পুচ্ছলোম কৃষ্ণ। অবশেষে এই পণ স্থির হল যে তাঁরা অশ্বটিকে ভালো করে দেখবেন এবং যার কথা মিথ্যা হবে সে সপত্নীর দাসী হবে। কদ্রু তাঁর সর্পপুত্রদের বললেন উচ্চৈঃশ্রবার পুচ্ছলগ্ন হতে, যাতে তা কৃষ্ণবর্ণ বোধ হয়। যে সব সর্পেরা সম্মত হল না কদ্রু তাদের শাপ দিলেন, তোমরা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে দগ্ধ হবে। মাতৃপ্রদত্ত শাপ খণ্ডন করার জন্য সর্পরাজ বাসুকি তাঁর ধার্মিক ভ্রাতাদের সঙ্গে মন্ত্রণা করে জানতে পারলেন তপস্বী পরিব্রাজক জরৎকারুর ঔরসে বাসুকির ভগিনীর গর্ভে – যাঁর নামও দৈবক্রমে জরৎকারু এবং যিনি মনসা নামে প্রসিদ্ধা – আস্তীক নামে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করবেন, এবং তিনিই ধার্মিক সর্পগণকে রক্ষা করবেন। আস্তীক তাঁর প্রভাব আর কৌশলের সাহায্যে তাঁর মাতৃবংশজাত সর্পকুলকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

অন্যদিকে মায়ের দাসীত্ব মোচনের জন্য সাপেদের শর্ত অনুযায়ী গরুড় অমৃত নিয়ে আসতে উদ্যত হলেন। পথিমধ্যে ক্ষুধার্তবোধ করায় তাঁকে এক সরোবরতীরে যুদ্ধরত এক গজ আর কচ্ছপকে ভক্ষণ করতে হয়েছিল। এরা কোন সাধারণ গজকচ্ছপ ছিল না। বিভাবসু নামে এক কোপনস্বভাব মুনি ধনবিভাগের জন্য পীড়াপীড়ি করায় তাঁর ভাই সুপ্রতীককে হস্তী হতে অভিশাপ দিয়েছিলেন; প্রত্যুত্তরে সুপ্রতীকও জ্যেষ্ঠকে কচ্ছপ হতে অভিশাপ দিয়েছিলেন।সমানে সমানে দীর্ঘস্থায়ী বিবাদ বাংলা প্রবচনে তাই গজকচ্ছপের লড়াই।

মহাভারতের পাতা উলটে গেলে পদে পদেই পাওয়া যাবে আরও অনেক অভিশাপের বৃত্তান্ত। ভীষ্মের জন্মলাভই তো অভিশাপের কারণে। পূর্বজন্মে তিনি ছিলেন অষ্টবসুর একজন দ্যু-বসু। স্ত্রীর অনুরোধে অন্যান্য বসুদের সঙ্গে তিনি বশিষ্ঠের কামধেনু অপহরণ করেছিলেন। বশিষ্ঠ তাঁদের অভিশাপ দেন মানুষ হয়ে জন্মাতে। বসুদের অনুনয়ে বশিষ্ঠ অন্যান্যদের শাপের মেয়াদ এক বৎসর করেছিলেন, কিন্তু প্রধান অপরাধী দ্যু-বসুর ক্ষেত্রে তা হল দীর্ঘমেয়াদী।মানবীগর্ভে জন্ম এড়াতে বসুরা গঙ্গাকে অনুরোধ করেন মর্ত্যে গিয়ে তিনি যেন তাঁদের পুত্ররূপে প্রসব করেন। গঙ্গা রাজি হন এবং পরমাসুন্দরী কন্যারূপে মর্ত্যে অবতরণ করেন। তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয়ে শান্তনু বিবাহপ্রস্তাব দেন। তাঁর কোন কাজে শান্তনু কোনরকম বাধা দিতে পারবেন না এই শর্তে গঙ্গা সম্মত হলেন। সাত পুত্রের জন্মের পরেপরেই গঙ্গা তাদের জলে নিক্ষেপ করেছিলেন, কিন্তু অষ্টম পুত্র অর্থাৎ ভীষ্মের বেলায় শান্তনু বাধা দিলেন। তখন রাজাকে নিজের পরিচয় দিয়ে গঙ্গা তাঁকে পরিত্যাগ করে অন্তর্হিত হলেন। সুদীর্ঘ জীবনে শুধু কর্তব্যপালন করে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শরশয্যায় ইচ্ছামৃত্যু বরণ করে ভীষ্ম অবশেষে শাপমুক্ত হয়েছিলেন।

মৃগের ছদ্মবেশে মৈথুনরত মুনি কিমিন্দমকে তির ছুঁড়ে মেরেছিলেন কৌরবরাজ পাণ্ডু। মরণোন্মুখ মুনির কাছ থেকে নেমে এসেছিল অভিশাপ – সঙ্গমকালেই মৃত্যু ঘটবে পাণ্ডুর। অভিশাপ ফলেছিল। দুই রাজমহিষীর গর্ভে পুত্র উৎপাদনে অক্ষম হওয়ায় তাঁকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের। তার ফলেই কুন্তীর তিন আর মাদ্রীর দুই সন্তানলাভ। কিন্তু কোন এক বসন্তের সন্ধ্যায় রূপবতী মাদ্রীকে দেখে পাণ্ডু সংযত থাকতে পারেন নি। ফলে তাঁর মৃত্যু, এবং মাদ্রীর সহমরণ। ভারতযুদ্ধের শেষে শতপুত্রহারা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন পাণ্ডব ভাইরা, সঙ্গে কৃষ্ণ বাসুদেব। ভীমকে আলিঙ্গনের মুহূর্তে কৌশলী কৃষ্ণ এগিয়ে দিয়েছিলেন লৌহভীম, যা ধৃতরাষ্ট্রের আলিঙ্গনে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছিল। এটা ছিল ভীমের প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের অনুচ্চারিত অভিশাপ। ভীম রক্ষা পেয়েছিলেন কৃষ্ণের দূরদর্শিতায়, কিন্তু কৃষ্ণ নিজে গান্ধারীর অভিশাপ প্রত্যাহত করতে পারেন নি – তাঁকে মরণবরণ করতে হয়েছে যাদবদের স্বজননিধন প্রত্যক্ষ করে।

মহাভারতের ট্র্যাজিক নায়ক কর্ণের ট্র্যাজিক মৃত্যুর পিছনে রয়েছে দুটি অভিশাপ। সূতপুত্র হিসাবে পরিচিত হলেও তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল, হয়তো বা জন্মসূত্রে পাওয়া ক্ষত্রিয়রক্তের গোপন প্রভাবে। অনেক অস্ত্রশিক্ষা করে পরশুরামের কাছে দিব্যাস্ত্র শিক্ষার জন্য তাঁকে ব্রাহ্মণ পরিচয় দিতে হয়েছিল, কেন না পরশুরাম কোন অব্রাহ্মণকে অস্ত্রশিক্ষা দিতেন না। একদিন পরশুরাম যখন তাঁর কোলে মাথা রেখে নিদ্রা যাচ্ছিলেন তখন এক বজ্রকীট তাঁর জানু বিদীর্ণ করে পরশুরামকে দংশন করে। পরশুরাম জেগে উঠে কর্ণের এই অব্রাহ্মণোচিত সহিষ্ণুতা দেখে তাঁর আসল পরিচয় জানতে চান। কর্ণ যথার্থ পরিচয় দিলে পরশুরাম ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিলেন, কপট উপায়ে সে যে অস্ত্র লাভ করেছে কার্যকালে তা তার স্মরণ হবে না। ইতোপূর্বে অস্ত্রাভ্যাসকালে অসাবধানতার ফলে কর্ণ এক ব্রাহ্মণের হোমধেনুর বৎসকে শরাঘাতে বধ করার অপরাধে সেই ব্রাহ্মণ কর্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে যুদ্ধকালে তাঁর রথচক্র গর্তে পড়বে এবং তাঁর মহাভয় অর্থাৎ মৃত্যু উপস্থিত হবে।

দুটি অভিশাপই ফলেছিল। তবে কর্ণ তো জন্মমুহূর্ত থেকেই অভিশপ্ত। তিনি ছিলেন কুন্তীর কানীন পুত্র। লোকলজ্জার ভয়ে কুন্তী তাঁকে জন্মমুহূর্তেই নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। পিতৃগৃহে পরিচর্যায় তুষ্ট করে ঋষি দুর্বাসার কাছ থেকে কুন্তী বর হিসাবে পেয়েছিলেন এক মন্ত্র, যার দ্বারা তিনি যে দেবতাকে আহ্বান করবেন তাঁর প্রসাদে কুন্তীর পুত্রলাভ হবে। কুমারী কুন্তী কৌতূহলবশে সূর্যকে আহ্বান করেছিলেন, এবং তার ফলেই কর্ণের জন্ম। সেই কর্ণকে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার মুহূর্তে কুন্তীর কি মনে হয় নি দুর্বাসার বর তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল এক অভিশাপ? দুর্বাসা প্রসঙ্গে কিন্তু একটা প্রশ্ন এসে যায়। মহাভারতে উল্লিখিত নাহলেও কালিদাসের কাব্যে কণ্বের আশ্রমে দুর্বাসার আবির্ভাব দেখতে পাওয়া যায়, এবং তাঁর দেওয়া অভিশাপের কারণেই দুষ্মন্তের বিস্মৃতি আর শকুন্তলার হেনস্থা। প্রশ্ন হল, দুর্বাসা কুন্তীর সমসাময়িক হলে তিনি বহুপ্রজন্ম পূর্ববর্তী শকুন্তলার সমসাময়িক হতে পারেন কী করে! হয়তো এক সহজ অনুমান এর উত্তর হতে পারে – কোপনস্বভাব যে কোন মুনি বা ঋষি পুরাকালে দুর্বাসা নামেই অভিহিত হতেন।

অভিশাপের দৌড়ে রামায়ণ কিছু পিছিয়ে নেই। রামায়ণ রচনার উৎসমূলেই রয়েছে অভিশাপ প্রসঙ্গ। তমসা নদীর তীরে মৈথুনরত ক্রৌঞ্চদম্পতির একটিকে ব্যাধের শরাঘাতে নিহত হতে দেখে বাল্মিকীর কণ্ঠ থেকে নির্গত হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত অভিশাপ –

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চ মিথুনাদেকমাবধীঃ কামমোহিতম্‌।

--- নিষাদ তুই কোনদিন প্রতিষ্ঠালাভ করবি না, কারণ তুই কামমোহিত ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে বধ করেছিস।

শোকসঞ্জাত এই ছন্দোবদ্ধ গীতযোগ্য রচনাকে তিনি শ্লোক নামে অভিহিত করলেন এবং নারদের মুখ থেকে অনতিপূর্বে শোনা রামচরিত কথাকে শ্লোকের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করতে ব্রতী হলেন।

রাজ্যাভিষেক মুহূর্তে কৈকেয়ীর চক্রান্তে রামচন্দ্রের বনগমনের পর পুত্রশোকে দশরথের মৃত্যু হয়েছিল। এর পিছনে ছিল এক অন্ধ মুনির অভিশাপ। তখন তিনি যুবরাজ। একদিন রাত্রিকালে শিকার করতে বেরিয়ে তিনি অন্ধ এক মুনিদম্পতির একমাত্র পুত্রের নদীতে জলের কলস ভরার শব্দকে হাতীর জলপানের শব্দ মনে করে শব্দভেদী বাণ নিক্ষেপ করেছিলেন। শোকাহতমুনি দশরথকে পুত্রশোকে মৃত্যুর অভিশাপ দেন। এই অভিশাপ দশরথ এড়াতে পারেন নি।

রামায়ণের বালকাণ্ডে রয়েছে ভগীরথের মর্ত্যে গঙ্গা আনয়নের কাহিনি, তাড়কা রাক্ষসী বধের কাহিনি, অহল্যা উদ্ধারের কাহিনি এবং ত্রিশঙ্কুর কাহিনি। এদের সবগুলোর সঙ্গে রয়েছে অভিশাপ প্রসঙ্গ। রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ রাজা সগরের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া ফিরে না-আসায় সগরের ষাট হাজার পুত্র তাঁর অন্বেষণে বেরিয়ে কপিল মুনির আশ্রমের কাছে ঘোড়াটিকে চরতে দেখেন। কপিল মুনিকে ঘোড়া অপহরণকারী সাব্যস্ত করে কটূক্তি করতে থাকলে ক্রুদ্ধ মুনির অভিশাপে তাঁরা ভস্মীভূত হন। তাঁদের পৌত্র ভগীরথ তপস্যাবলে ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করে সুরনদী গঙ্গাকে মর্ত্যে আনয়ন করেন। গঙ্গার পুণ্যসলিল স্পর্শে ভস্মরাশি থেকে উত্থিত হয়ে সগরপুত্রেরা স্বর্গলাভ করেন।

যক্ষ সুকেতুকন্যা তাড়কা ব্রহ্মার বরে সহস্র হস্তীর বল লাভ করে। কোন এক অপরাধের কারণে তার পতি সুন্দকে অগস্ত্য মুনি নিধন করেন। প্রতিশোধ নিতে তাড়কা ও তার পুত্র মারীচ অগস্ত্যকে ভক্ষণ করতে গেলে তাঁর শাপে তাড়কা বিকৃতবদনা রাক্ষসীর রূপ পায়, মারীচও রাক্ষস হয়ে যায়। তাদের অত্যাচার থেকে যজ্ঞকারী মুনিঋষিদের রক্ষা করতে বিশ্বামিত্রের নির্দেশে বালক রামচন্দ্র তাড়কাকে শরাঘাতে নিহত করেন এবং মারীচের বক্ষে আঘাত করে তাকে শতযোজন দূরের মহাসাগরে নিক্ষেপ করেন। রামচন্দ্রের বনবাসকালে এই মারীচই স্বর্ণমৃগের রূপ ধারণ করে সীতাকে প্রলুব্ধ করে, এবং তার ফলেই রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ।

তাড়কা নিধনের পর বিশ্বামিত্রের সঙ্গে মিথিলায় রাজর্ষি জনকের যজ্ঞশালায় যাওয়ার পথে এক নির্জন পরিত্যক্ত আশ্রমে রামচন্দ্র অহল্যা উদ্ধার করেছিলেন। অহল্যা ছিলেন ব্রহ্মার সৃষ্ট পরম রূপবতী এক কন্যা যাঁকে ইন্দ্র পেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ব্রহ্মা তাঁকে জিতেন্দ্রিয় ও তপঃসিদ্ধ মহামুনি গৌতমের হাতে পত্নী হিসাবে সমর্পণ করেছিলেন। একদিন নিভৃতে গৌতমের ছদ্মবেশ ধরে ইন্দ্র অহল্যার সাথে মিলিত হন। ঘটনা অবগত হয়ে গৌতম ইন্দ্রকে নপুংসক হওয়ার অভিশাপ দিলেন। অহল্যাকে অন্যের অদৃশ্য হয়ে বায়ুমাত্র ভক্ষণ করে অনাহারে ভস্মশয্যায় অনুতাপে অতিবাহিত করার অভিশাপ দিয়ে বললেন বহুসহস্র বৎসর পরে দশরথপুত্র রামের দর্শনে তাঁর শাপমুক্তি ঘটবে। কৃত্তিবাসের রামায়ণে কিন্তু রয়েছে এর একটু ভিন্নতর রূপ -- গৌতমের অভিশাপে অহল্যা প্রস্তরীভূত হয়েছিলেন এবং রামচন্দ্রের পাদস্পর্শে তাঁর উদ্ধারলাভ হয়েছিল।

যখন এদিক বা ওদিক কোনদিকেই যাওয়ার অবস্থা থাকে না – ন যযৌঃ নতস্থৌঃ – সেটাকে বলা হয় ত্রিশঙ্কুর অবস্থা। ত্রিশঙ্কুর হয়েছিল কী? তিনি ছিলেন রামের পূর্বপুরুষ ইক্ষ্বাকুবংশীয় এক রাজা। তাঁর আকাঙ্ক্ষা হয়েছিল যজ্ঞ করে সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার।কুলগুরু বশিষ্ঠ বলেছিলেন, তা অসাধ্য। ত্রিশঙ্কু বশিষ্ঠের শত পুত্রের কাছে প্রার্থনা জানালে সেখানেও প্রত্যাখ্যাত হলেন। ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি অন্যত্র চেষ্টা করবেন জানালে বশিষ্ঠপুত্রেরা তাঁকে চণ্ডাল হওয়ার শাপ দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বামিত্রের শরণাপন্ন হলে বিশ্বামিত্র তাঁর তপস্যালব্ধ শক্তির বলে ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গে প্রেরণ করলেন, কিন্তু দেবগণসহ ইন্দ্র তাঁকে মাথা নিচু করে ভূমিপতিত হওয়ার অভিশাপ দিলেন। পতনোন্মুখ ত্রিশঙ্কুর জন্য বিশ্বামিত্র নতুন এক নক্ষত্রলোক সৃষ্টি করলেন। জ্যোতিশ্চক্রের বহির্দেশের সেই নক্ষত্রলোকই হল ত্রিশঙ্কুর অবস্থানভূমি।

শ্রীরামচন্দ্র শাপমুক্ত করেছিলেন শাপগ্রস্ত এক রাক্ষসকে -- তার নাম কবন্ধ। সীতাহরণের পর সীতার অন্বেষণে রামলক্ষ্মণ যখন অরণ্যে বিচরণ করছেন তখন মুণ্ডহীন দীর্ঘবাহু এবং উদরে মুখবিশিষ্ট এক কদাকার রাক্ষস তাঁদের ভক্ষণ করতে এল। তাঁরা খড়্গাঘাতে তার দুই বাহু ছেদন করলে রাক্ষস নিজের পরিচয় জানিয়ে বলল যে সে শ্রী নামক দানবের পুত্র, নাম দনু। স্থূলশিরা নামের এক ঋষিকে উত্যক্ত করার কারণে তাঁর অভিশাপে সে কদাকার রূপ প্রাপ্ত হয়। শাপের অবসানের নিমিত্ত প্রার্থনা জানালে ঋষি বললেন, যখন রাম তার বাহু ছেদন করে বিজন বনে তাকে দগ্ধ করবেন তখন সে নিজের রূপ ফিরে পাবে। রামচন্দ্র তার অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন করলে পূর্বরূপ প্রাপ্ত হয়ে সে রামচন্দ্রকে সন্ধান দিয়েছিল বানর অধিপতি সুগ্রীবের, যাঁর সহায়তায় রামচন্দ্র সীতা উদ্ধারের উদ্যোগ নিতে পেরেছিলেন।

রামায়ণ মানেই রামরাবণের কাহিনি, রামের হাতে রাবণের নিধনে যার উপসংহার। এর পরের ঘটনাবলির—সীতার বনবাস, রামের সভায় লবকুশের রামায়ণ গান, সীতার দ্বিতীয়বার অগ্নিপরীক্ষার জন্য রামের নির্দেশ, সীতার পাতালপ্রবেশ এবং তৎপশ্চাৎ রামের বিলাপ আর সরযু নদীতে আত্ম বিসর্জন ইত্যাদির – কাহিনি বিবৃত হয়েছে যে উত্তরকাণ্ডে, অনেকের মতে তা প্রক্ষিপ্ত। সে যাই হোক, এই উত্তরকাণ্ডেই বিবৃত হয়েছে রাবণের জন্মবৃত্তান্ত, তাঁর পরাক্রান্ত এবং অনাচারী হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত আর রাবণবধের জন্য বিষ্ণুর নরদেহী রাম হয়ে জন্ম নেওয়ার পশ্চাৎপট। এদের সবগুলোর সঙ্গেই জড়িত রয়েছে ছোটোবড়ো অভিশাপ প্রসঙ্গ।

রাবণ বিশ্রবা মুনির পুত্র হলেও ক্রুরকর্মা রাক্ষস হয়ে তাঁকে জন্ম নিতে হয়েছিল, তাঁর মা কৈকসী (নিকষা নামেই বেশি পরিচিত) অশুভ প্রদোষকালে বিশ্রবার সান্নিধ্য কামনা করেছিলেন সেই অপরাধে। রাবণ উগ্র তপস্যায় ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করে বর প্রার্থনা করেছিলেন তিনি যেন পক্ষী নাগ যক্ষ দৈত্য দানব রাক্ষস ও দেবগণের অবধ্য হন, মানুষকে তিনি তৃণজ্ঞান করেন। সেই বরে বলীয়ান হয়ে রাবণ কুবেরপুরী বরুণপুরী যমপুরীতে অভিযান চালিয়ে জয়ী হলেন। এই পরিক্রমাকালে তিনি দর্শন পেলেন বিষ্ণুকে পতিরূপে পেতে হিমালয়ে তপস্যারতা বৃহস্পতিপুত্র কুশধ্বজের রূপবতী কন্যা বেদবতীর। তাঁকে পত্নী হিসাবে পাবার প্রস্তাব জানিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে রাবণ তাঁর কেশাকর্ষণ করেন। নিজেকে মুক্ত করে অগ্নিতে আত্মাহুতি দেওয়ার পূর্বে বেদবতী রাবণকে বলেছিলেন, তাঁকে বধ করার জন্য কোন ধার্মিকের অযোনিজ কন্যারূপে তিনি পুনর্বার জন্মগ্রহণ করবেন। পরবর্তী জন্মে তিনিই জনককন্যা সীতা।

লঙ্কায় প্রত্যাবর্তনের পথে রাবণ তাঁর দৃষ্টিপথে পড়া রাজা ঋষি দেব বা দানবের সুন্দরী কন্যাদের হরণ করে বিমানে তুলে নিয়ে যাবার সময়ে বিলাপরতা কন্যারা রাবণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, এই দুরাত্মা রাক্ষসাধম যেমন পরস্ত্রী ধর্ষণ করছে সেইরূপ পরস্ত্রী হতেই তার মৃত্যু হবে। এই যাত্রাপথেই রাবণ কুবেরপুত্র নলকুবেরের অভিসারিকা অপ্সরা রম্ভাকে বলপূর্বক মিলনে বাধ্য করায় নলকুবের রাবণকে অভিশাপ দেন যদি সে পুনর্বার কোনও রমণীর উপর বলপ্রয়োগ করে তবে তার মস্তক সপ্ত খণ্ডে ভগ্ন হবে। এই অভিশাপই রাবণকে সীতার উপর বলপ্রয়োগ থেকে বিরত করেছিল।

রাম বিষ্ণুর অবতার। বিষ্ণুকে নরদেহ ধারণ করতে হয়েছিল এক অভিশাপের কারণেই। দেবগণ কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে দৈত্যেরা মহর্ষি ভৃগুর পত্নীর শরণাপন্ন হলে তিনি তাদের অভয় দেন। বিষ্ণু ক্রোধান্বিত হয়ে চক্র দ্বারা ভৃগুপত্নীর শিরচ্ছেদ করেন। পত্নীকে নিহত দেখে ভৃগু অভিশাপ দিলেন, তাঁর অবধ্যা স্ত্রীকে ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হয়ে বধ করার জন্য বিষ্ণুকে মানবজন্ম নিতে হবে এবং বহুবর্ষব্যাপী পত্নীবিয়োগ ভোগ করতে হবে। ঋষির অভিশাপ নারায়ণ বিষ্ণুও খণ্ডন করতে পারেন নি।

দেখা যাচ্ছে, নারায়ণের প্রতি ভৃগুর অভিশাপ বাদ দিলে বাকি সব অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে দুর্বলতর ব্যক্তির উপরে, বড়ো জোর সমপর্যায়ের ব্যক্তির উপরে। ভৃগু ব্যতিক্রম হতেই পারেন। তাঁর তপস্যার জোরে তিনি ভগবানের বুকে পদাঘাত করার স্পর্ধা এবং ক্ষমতা রাখতেন, অন্যদের যা সাধ্যাতীত। আর দেখা যাচ্ছে অভিশাপ প্রদানের কারণগুলি হল ক্রোধ, আত্মাভিমান, শোক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতা, যা সমাজের দুর্বলতর শ্রেণির ব্যক্তিমানুষের অনায়ত্ত। তাই অভিশাপ প্রদানের পরিবর্তে দুর্বলতর শ্রেণির মানুষের প্রয়োজন নিজেদের অধিকার বজায় রাখার জন্য সংঘবদ্ধ হওয়া—যা পরশুরাম রাজশেখর বসুর ‘ভীমগীতা’য় কৃষ্ণের পরিচারক তোক্কমল্ল অন্য এক পরিচারক চোক্কমল্লকে উপদেশ দিয়েছিলেন। আর স্বীয় স্বার্থসাধনকল্পে অভিশাপ? তা নৈব নৈব চ। সেটা ফলপ্রসূ হওয়ার নয়। তাই শকুনকে নিবৃত্ত হতেই হবে গোরুকে অভিশাপ দিতে।


তথ্য সহায়তা:

১। মহাভারত (সারানুবাদ) – রাজশেখর বসু (এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স, কলকাতা)

২। রামায়ণ (সারানুবাদ) -- রাজশেখর বসু (এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স, কলকাতা)

৩। মহাভারত, ১ম খণ্ড –কালীপ্রসন্ন সিংহ অনুবাদিত (পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, কলকাতা)

৪। পরশুরাম রচনাবলী, ১ম খণ্ড (এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স, কলকাতা)



(পরবাস-৮৫, ১০ জানুয়ারি, ২০২২)



অলংকরণঃ অনন্যা দাশ