বজ্র - অনভ্যস্তশ্রমে তোমায় প্রথমেই অতিরিক্ত কাতর না হতে হয় সেজন্য প্রথম পত্তনের স্থানে ফল এবং জলের অপ্রতুলতা না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরদিবসে দৃষ্টি দেওয়া হল - ফল ইত্যাদির প্রাপ্তি যেন না ঘটে, সেদিকে। তোমায় বিভ্রান্ত করার জন্য অনুচরেরা দূর অরণ্যে বানরের শব্দ করলেও এবার তুমি বিভ্রান্ত হলে না। যদিও ওই ধ্বনি যে প্রকৃত বানরের নয়, তুমি তা বুঝতে পার নি। গতদিন তোমার লক্ষ্যভেদের দক্ষতা প্রমাণিত হয়েছিল বাণাঘাতে অমৃতফল সমূহ ভূপতিত করায়। তুমি যে সঞ্চয়ী এবং দূরদর্শী, তা প্রমাণিত হল। তুমি কিছু ফল রক্ষা করলে এবং পরদিন প্রাতে তার দ্বারা উদরকে শান্ত করলে। ফলপ্রাপ্তি না হওয়া সত্ত্বেও মৃগয়া না ক'রে, বরং বিপরীতক্রমে আহত মৃগশিশুর পরিচর্যা ক'রে পরিচয় রাখলে দয়ালুতারও। দিনের প্রান্তভাবে মৎস্যশিকার ক'রে আহার সংস্থানের সুবন্দোবস্ত করে তুমি ক্ষান্ত হলে না। ভোজনান্তে অবশিষ্ট মৎস্যমাংস পাতায় বেঁধে সঙ্গে নিয়ে গাছে উঠলে। পরদিনের বন্দোবস্ত।
বিদ্যুৎ প্রশ্ন করলেন - এইখানে আমরা আবার সপ্রশ্ন হচ্ছি। ফল তুমি বৃক্ষতলে রেখে বৃক্ষারোহণ করেছিলে, মৎস্যের বেলায় তা করোনি। হেতু?
কুমার হেসে বললেন - প্রিয়সখি! এমন প্রতিপদে মেধা, বুদ্ধি এবং বিবেচনার পরীক্ষা চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন হতে পারে। পারে না? আমায় অপ্রতিভ করতে চাও?
বিদ্যুৎ নির্ঝরের শব্দে হেসে ফেললেন - বিনয় কোরো না।
কুমার বললেন - গৌণ কারণ, নারিকেল সংগ্রহের দিন পর্যন্ত এমন আশঙ্কার উদয় হয়নি যে আমার প্রতি প্রতিনিয়ত দৃষ্টি রাখা হচ্ছে বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। প্রধান কারণ - ঐ ফল মাটিতে রাখলে তা কাউকে আকর্ষণ করবে না। কিন্তু অগ্নিপক্ক আমিষ বহুদূর হতে মাংসাশীদের আকর্ষণ করবে।
বজ্র - যথার্থ। অতঃপর তুমি নিশ্চিন্তে নিদ্রা গেলে। আমরাও নিশ্চিন্তে তোমার যথাসর্বস্ব হরণ করলাম। আমরা বলতে আমার অনুচরেরা।
কুমার - এর গৌণ কারণটি আমিই বলছি। সেটি হল - আমায় আরো পরীক্ষার মধ্যে ফেলা। খাদ্য ব্যতিরেকে আমার কী গতি হয়; অস্ত্র ব্যতিরেকে আমি রণে ভঙ্গ দিই কিনা ইত্যাদি। ঠিক কিনা? এবার প্রধান কারণটি বল।
বজ্র - প্রধান কারণ ভারমুক্ত করা। অনঙ্গপুরীর রাজধানী নাতিউচ্চ পর্বতে এবং রাজধানী ভবন তার শিখরে হলেও অধিকাংশ জনবসতি পর্বতের পাদস্পর্শী সমতলে। তুমিও তাই পার্বত্যপথে প্রায় অনভ্যস্ত। কারণ অনঙ্গপুরীর রাজভবন পর্বতশিখরে হলেও সমতলের সঙ্গে যোগরক্ষাকারী পথ সুনির্মিত এবং তুমি অশ্বারোহণে অভ্যস্ত। চিরদিন সুখলালিত। প্রথমেই গুরুতর শ্রমসাধ্য পরীক্ষার সম্মুখীন। খাদ্যাভাবগ্রস্ত। তার উপর প্রায় একটি অস্ত্রাগার বহন করে চলেছিলে! স্মরণ কর, কী পরিমাণ ক্ষুৎপিপাসাগ্রস্ত হয়ে তুমি মনোবল সম্বল ক'রে এগোচ্ছিলে। অল্প-অল্প দূরে তোমায় বিশ্রাম নিতে হচ্ছিল। তোমার স্বেদস্নাত শরীর এবং ঘননিঃশ্বাসিত বক্ষ আমায় বাধ্য করল প্রতিবিধানের উদ্যোগ নিতে।
কুমার - এখানেও কি তোমায় মানে তোমার অনুচরদের ...
বজ্র, সহাস্যে - না, অরণ্যসীমা পর্যন্তই তাদের ক্ষেত্র ছিল। পর্বতগাত্রে পদার্পণ মাত্রই ঘটনাপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নিই আমরা। 'আমরা' কথাটি এইখানেও গৌরবার্থে বহুবচন নয়। তবে অতিথির কিছু করণীয় ছিল না প্রত্যক্ষভাবে। প্রথম পদক্ষেপ ধারাস্নানের আয়োজন।
কুমার চকিত হয়ে বললেন - সে তো বারিবর্ষণ!
বজ্র হাসলেন - সত্য। কিন্তু বর্ষণ প্রকৃতির ইচ্ছায় হয়নি। হয়েছে - বজ্র-বিদ্যুৎ সহযোগে।
কুমার বিস্ময়াভিভূত হয়ে - সে কী!
বিদ্যুৎ হেসে উত্তর দিলেন - দানবী মায়া!
বজ্র - এই পর্বে প্রত্যক্ষ ভূমিকা আমাদের দুই ভ্রাতাভগ্নীর থাকলেও পরোক্ষ ভূমিকা কিন্তু আমাদের প্রিয়বান্ধবীর। সে সময় তার ব্যাকুলতা ...। আচ্ছা! আমি এ বিষয়ে মৌন হলাম।
কুমার বজ্রের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলেন - সহাস্য বিদ্যুতের অন্তরালে কমলিনীর কমলাননখানি পুণ্ডরীক হতে কোকনদে রূপান্তরিত হয়েছে। নতমুখে তিনি আত্মগোপন করে আছেন প্রিয়বান্ধবীর তনুদেহের আশ্রয়ে। আশ্চর্য এক অনুভূতি হল তাঁর। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্য দ্রুত প্রসঙ্গান্তর করে বললেন - সে তো ভালোই ছিল। কিন্তু তার ফলে যে শিলাপতন আরম্ভ হয়ে গেল!
বজ্র বজ্রধ্বনিতে অট্টহাস্য করে উঠলেন - সরলপ্রাণ যুবক! শিলাস্খলনও প্রাকৃতিক কারণে হয়নি।
কুমার আপাদমস্তক আলোড়ন অনুভব করলেন। রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলেন - সেকি! সেও কি ...
বজ্র বললেন - এখনও কি ব্যাখ্যা করতে হবে!
কুমার অপলকে চেয়ে রইলেন। বজ্র বললেন - অভিমান হল কি সখা?
কুমার রুদ্ধস্বরে বললেন - দানবরাজ! আমার শরীর চূর্ণ হয়ে যেতে পারতো! প্রতিদ্বন্দ্বীর আচরণ এইরকমই হওয়ার কথা বটে, কিন্তু সখার কর্তব্য বোধহয় অন্যরকম।
বজ্র বামবাহু দিয়ে বেষ্টন করে ধরলেন কুমারকে। সখা! গঞ্জনা দিতে চাওয়া তোমার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু মনে করে দ্যাখো, একটি শিলাও তোমার অঙ্গস্পর্শ করেনি। করেছে?
কুমার বললেন - সে কি দৈবের ঘটনা নয়?
বজ্র বললেন - স্মরণ কর - প্রথমে একটি ক্ষুদ্র শিলা তোমার অবস্থান থেকে দূরে পতিত হয়। তাতে মনস্ক হও। তখন একটি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ শিলা তোমার নিকটবর্তী স্থানে এসে পতিত হয়। তুমি সহজেই আত্মরক্ষা কর সরে গিয়ে। আত্মরক্ষার উপায় অন্বেষণে তোমার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে শৈলশিরার অপর পার্শ্বের শিখরে। পাশমোচন কর তুমি। তখনই অন্যান্য প্রস্তরসমূহ যাত্রা করে। তার কয়েকটিই ঘাতক হতে পারত। কিন্তু বিগত কয়েকদিনে তোমার ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও তার রূপায়ন সম্পর্কে আস্থাবান হয়েই আমরা ভীত হইনি। তুমি সঠিক লক্ষ্যে পাশক্ষেপণ, সঠিক সময়ে লম্ফপ্রদান এবং অপরপার্শ্বে অবতরণ করেছিলে।
কুমার একটু চুপ থেকে বললেন - আমি লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারতাম! লম্ফপ্রদানে বিলম্ব হতে পারতো!
বজ্র প্রত্যয়ের হাসি হাসলেন - পারতে এবং পারতো। কিন্তু আমরা তো নিদ্রিত ছিলাম না। তোমার উপর পতিত হওয়ার পূর্বমুহূর্তে শিলা রেণু-রেণু হয়ে উড়ে যেত।
কুমার আশ্চর্য হলেন - কী রকম?
বজ্র মৃদু অভয় হাসি হাসলেন - বজ্রপাতে।
- বজ্রপাত?
বিদ্যুৎ হেসে উঠলেন - অগ্রজ শুধু চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য বা লিপিরচনাতেই নয়, রাজ্য এবং অস্ত্রচালনায়ও সমান দক্ষ।
কুমার দক্ষিণ বাহু দ্বারা বজ্রকে আবদ্ধ করলেন - সখা! তোমার প্রতি মুহূর্তের অনাস্থা মার্জনা কর।
বজ্র বামবাহু দ্বারা কুমারকে বেষ্টন করলেন - মার্জনা কিসের! তাহলে আর সখ্য কী! প্রকৃতপ্রস্তাবে তুমি আরোহণের ক্রমে তির্যকভাবে অভীষ্ট পথ থেকে সরে যাচ্ছিলে তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছলে তোমাকে ইচ্ছিত সংক্ষিপ্ততর পথে নিয়ে এলাম।
কুমার লজ্জিতভাবে বললেন - আর সব প্রাঞ্জল হলেও একটি প্রসঙ্গ আদৌ আলোকিত হয়নি যার আমি এযাবৎ সমাধান করতে পারিনি। কুমারী কমলিনী এই পুরে আসার পর না হয় এই কয়দিন আমারই মতো বন্দিনী না হয়ে সঙ্গিনী হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু হরণের মুহূর্তে এমন কী কৌশল অবলম্বিত হয়েছিল যে পুরবেষ্টনকারী রক্ষকেরা আভাসমাত্র পায়নি অথচ তখন ছিল রজনীর প্রথম যাম মাত্র। এও কি দানবী মায়া?
শুধু যে বজ্রই অট্টহাস্য করে উঠলেন, তাই নয়; কুমার পরমাশ্চর্য হয়ে দেখলেন - দুই বান্ধবী একে অপরকে অবলম্বন করে উতরোল হাস্যে উদ্বেল হয়ে উঠেছেন। তিনি ধৈর্য ধারণ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
অনেকক্ষণ ধরে অফুরন্ত হাস্য করে আত্মসংবরণ করলেন তিনজন। বিদ্যুৎ দুহাতে প্রিয় সখীকে বেষ্টন করে বললেন - মায়া অবশ্যই। তবে দানবী নয়, মানবী।
কুমার বিপন্নভাবে বললেন - বোধগম্য হল না।
কমলিনী বিদ্যুতের বক্ষে মুখ লুক্কায়িত করে বললেন হাস্যতরল কণ্ঠে - আভাস পাবে কী করে! লিপি তো আর সখার হাত দিয়ে শয়নকক্ষে যায়নি। গিয়েছে আমার হাত দিয়ে। সখা তো অন্তঃপুরে প্রবেশই করেনি। আমিই অন্তঃপুর হতে উদ্যানে প্রস্থান করেছিলাম।
বিস্ময়ে কুমারের বাক্রোধ হল। বজ্র তাঁর অবস্থা দেখে সদয় কণ্ঠে বললেন - কুমার! আমি ব্যাখ্যা করছি। তবে এজন্য অনেক পশ্চাৎ হতে আরম্ভ করে উজানে চলে আসতে হবে ক্রমে ক্রমে।
পুরাকাল থেকে দানব মানবে দ্বন্দ্ব। সে দ্বন্দ্ব রূপকথার কাল পর্যন্ত চলে এসেছে। কিন্তু সব কিছুরই একসময় শেষ হয় বলে ক্রমশঃ দানবেরা ক্ষান্তি দেয়। দানবেরা, কারণ সাধারণত তারাই ছিল শক্তিশালী। যে কোনো রূপকথার গল্পতেই দেখা যায়, তারা বিশালকায়, অমিত শক্তিধর, মায়াবী বলে বর্ণিত। তবে মূলার মতো দাঁত, ভাঁটার মতো চোখ, বড় বড় নখ ইত্যাদি কতদূর কল্পনা, কতদূর অতিরঞ্জন, কতদূর বাস্তব - তা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। কারণ, সুদূর অতীতে অরণ্যে-পর্বতে বসবাসকারীদের সমতল নগরবাসীদের তুলনায় আকার-প্রকার, আচার-আচরণ এবং রীতি-নীতিতে ভিন্ন প্রকৃতির হওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক।
কুমার হেসে ফেললেন - আমি সে কথা গ্রাহ্য করতে একান্তই অপারগ। আমার দৃষ্টির সম্মুখে যে দুটি অপরূপ উদাহরণ দেখছি, তারা কি নিতান্তই ব্যতিক্রম?
সকলেই হেসে উঠলেন। বজ্র বললেন - কুমার! সম্মুখ প্রশংসা নিন্দার তুল্য। জানো তো সেকথা? যাইহোক, যা বলছিলাম - বিদ্বেষ এতদূর বৃদ্ধি পায় যে সমতলবাসীরা দানবের এক জাতীয় প্রাণী বলতেও অস্বীকার করে। যে সব যোদ্ধারা অতীতে দানবদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন, তাঁদের সেইসব স্মৃতিরঞ্জিত উপাধি প্রদান, কাউকে প্রশংসা করতে হলে ঐ বীরের নাম উল্লেখ না করে সেই উপাধিটি উল্লেখ করা - এসব অভ্যাস, এমনকি স্বভাবে পর্যবসিত হয়। এতে করে যে একটি জাতির সকলের প্রতি নিষ্ঠুরতা এবং অকরুণ অবজ্ঞা প্রকাশ করা হয়, সে বোধ এমনকি বিদ্বান এবং পরিশীলিতদেরও লোপ পায়। তোমার স্মরণে আছে নিশ্চয়ই, দুর্ভাগ্যক্রমে ঐরকম এক পৌরাণিক দেবতার সঙ্গে আমার সবিশেষ সাদৃশ্য আছে বলে তুমি আমায় প্রথম দর্শনে প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলে - 'দানবাধিপতি? না দানবারি?' - তুমি কিন্তু নিজের অজান্তেই বিষ্ণুর নামের পরিবর্তে তাঁর ঐ উপাধি ব্যবহার করেছিলে। করতে চেয়েছিলে সম্মান। কার্যত হল অসম্মান।
অনুশোচনায় রাজপুত্রের মুখ মলিন হল। কমলিনী দ্রুত বলে উঠলেন - সখা! প্রকৃত প্রস্তাবে দুটি শব্দের ধ্বনিঝংকার সমতাযুক্ত বলেই ঐ ত্রুটি। ...
বজ্র একখানি হাত রাজপুত্রের পৃষ্ঠে রক্ষা করলেন - সখা! পরিতাপ কোরো না। আমি সে কথা অনুধাবন করেছি। এখন আমার পরবর্তী বক্তব্য শোনো। আমার চিন্তাশীল পূর্বপুরুষেরা এই বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করেন। ক্রমশ এই চর্চা বৃদ্ধি পায় এবং আমার পিতামহ এ নিয়ে কতকগুলি তত্ত্ব সৃষ্টি করেন। তাঁর একটি হল - নিজেদের পরিচয় প্রকাশ না করে দনুর পুত্রেরা যদি মনুর পুত্রদের কাছাকাছি হয় এবং পূর্বেকার অবিবেচনাপ্রসূত আচরণগুলি না করে, তাহলে তারা বুঝতে পারবে না যে মানবদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে না দানবদের সঙ্গে। পরবর্তীকালে একথা প্রকাশ পেলে প্রথমে তাদের পক্ষে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না এবং পরে তারা তাদের ভ্রম বুঝতে পেরে তা সংশোধনে সচেষ্ট হবে। এই পথই হবে ইতিবাচক।
পিতামহ এই তত্ত্ব উদ্ভাবন করলেও তা কার্যে পরিণত করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি অকালে প্রয়াত হন। তাঁর আরদ্ধ কর্মভার তুলে নেন তাঁর তরুণ পুত্র - মেঘ। আমার পিতা। সিংহাসনে আরোহণ করে প্রথমেই তিনি গূঢ়পুরুষদের এক অভিনব বাহিনী গঠন করেন। তাঁরা প্রেরিত হন বিভিন্ন রাজ্যে। নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁরা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় সংবাদ ও তথ্যাদি প্রেরণ করতে থাকেন। এমন দূত অনঙ্গপুরী এবং পদ্মনাভপুর - উভয় রাজ্যেই আছে।
কুমার চমকিত হলেন। বিদ্যুৎ বললেন - সখা! এখন কী তোমার কাছে এই প্রহেলিকা স্বচ্ছ হয়েছে যে কিভাবে তোমার প্রিয় ব্যঞ্জনগুলির সংবাদ আমি অবগত হয়েছি?
কুমার শিরসঞ্চালন করলেন। বজ্র বলে চললেন - ক্রমে তিনি দেখলেন, অনঙ্গপুরী এবং পদ্মনাভপুর - এই দুই রাজ্যই সব দিক দিয়ে প্রাগ্রসর এবং নেতৃস্থানীয়। অন্যান্যরা তুলনাত্মকভাবে পশ্চাৎপদ। তখন এই দুই রাজ্যের প্রতি অধিকন্তু মনোযোগী হওয়া গেল। কারণ অনঙ্গপুরী এবং পদ্মনাভপুরের রাজন্যবর্গ এবং জনপদবাসীরা যদি কোনো নীতি গ্রহণ করেন, তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
এই ব্রত উদ্যাপনের লক্ষ্যে অগ্রসর পিতা উপলব্ধি করেন অন্যকে সংশোধন করার মতো বা তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল নিজেকে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করা। তপস্যার ক্ষেত্ররূপে তিনি জনপদ হতে দূরে এই বিশ্রামভবন, এই মেঘকেতন নির্মাণ করান। তারপর আত্মনিয়োগ করেন সাধনায়। তিনি যে প্রথমাবধি উপলব্ধির কোন স্তরে উপনীত হয়েছিলেন; তা উপলব্ধি করতে হলে তাঁর এই সাকার স্বপ্ন 'মেঘকেতন'কে অন্তর দিয়ে অনুভব করতে হবে। আশা করি ইতিমধ্যেই তুমি তা করেছ। তোমার স্বপ্নিল দৃষ্টি সেই কথাই ঘোষণা করে।
কুমার নম্র শ্রদ্ধাভিভূত স্বরে বললেন - করেছি। এই কদিনের অনভ্যস্ত গুরু পরিশ্রমে ক্লান্ত আমার মন এখানে প্রকৃতই বিশ্রাম পেয়েছে। এই অনন্যসাধারণ শিল্পসৃজন মনকে নিমেষে নিয়ে যায় রাগ-দ্বেষ-শোক-শ্রান্তিহীন এক সুষমার জগতে। এই পুঞ্জিত মেঘের মতো প্রাসাদ; এই মেঘলীন হংসবলাকার মতো অলিন্দ, শীর্ষ, বাতায়ন; অলংকৃত প্রতিটি স্থান - আমি যত দেখছি, তত অভিভূত হচ্ছি। এ তো বাস্তব নয়, স্বপ্ন।
বজ্র প্রীত হয়ে বললেন - যথার্থ বলেছ। দানব-জনপদ এমন প্রত্যন্ত প্রদেশে অবস্থিত যে এমনিতেই এখানে বহিরাক্রমণের সম্ভাবনা নেই। তার উপর দানবকুল প্রথমাবধি প্রবলপ্রতাপী। ফলে রাজ্য বা সীমান্তরক্ষা নিয়ে শিরঃপীড়া ছিল না। দানবজনপদ এবং তার চতুর্পাশ্বস্থ সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল, প্রাকৃতিক সম্পদে অসাধারণ সম্পদবান। দিগ্বিজয়ের নিরর্থকতা বহুপূর্বেই উপলব্ধ, ফলে পরিত্যক্ত হয়েছিল। পরিশ্রমী দানবকুল নিরুদ্বিগ্ন শান্তিতে প্রাচুর্য উপভোগ করে হিংসা এবং তামসিকতার সংশ্রব ত্যাগ করেছিল। তবুও পিতৃদেব সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন। দানবকুলের প্রাচীন সম্পদ মায়াবিদ্যার একনিষ্ঠ সাধনা করেন তিনি এই 'মেঘকেতন'-এ। অনন্যসাধারণ প্রতিভার বলে ঐ বিদ্যার বহু লুপ্ত অংশ পুনরুদ্ধার করেন, বহু জ্ঞাত অংশের উন্নতিসাধন করেন এবং কতিপয় নূতন সংযোজন করেন। এসব সাধারণ্যে প্রকাশ করেননি। পাছে সুখসম্ভোগ অথবা অন্য কোনো তুচ্ছ উপলক্ষ্যে এই জ্ঞানের অপচয় করা হয়। কিন্তু শুধুমাত্র নিজের মধ্যেও আবদ্ধ রাখেননি। শৈশবাবধি প্রথমতঃ আমাকে, পরবর্তীকালে বিদ্যুৎকেও, তাঁর আর মাতৃদেবীর সাধনসঙ্গী করে নিয়েছিলেন।
জ্ঞান সাধনা এবং মহৎচিন্তা করতে করতে জনক এবং জননী এমন এক স্তরে পৌঁছে যান যে রাজ্যপরিচালনার জন্য কালক্ষয় করাও তাঁদের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তখন তাঁরা আমাকে রাজপদে অভিষিক্ত করে নিজেরা চলে যান আরো প্রত্যন্ত প্রদেশে। প্রায় অজ্ঞাতবাসে। প্রায় বলার কারণ এই যে আমরা দুজন ভিন্ন আর কেউ তাঁদের অবস্থিতির খবর জানে না। 'মেঘকেতন' আমাদের দুইজনের জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজেদের সাধনপীঠ তাঁরা সেখানে প্রস্তুত করে ফেলেছেন। ক্রমাগত উচ্চমার্গে বিচরণের ফলে তাঁদের কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, কর্ম ইত্যাদির ভেদরেখা বহুকাল লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের যাবতীয় প্রয়োজন তাঁরা স্বহস্তে সম্পাদন করতেন প্রয়োজনে। আমাদেরও সেই দিক হতে সক্ষম করে গড়ে তুলেছিলেন। আজ যে বিদ্যুতের রন্ধনকলার অত প্রশংসা তুমি করেছো, সেও তারই ফলশ্রুতি।
পিতা এবং মাতা লোককল্যাণের জন্য সুখবিলাস উপেক্ষা করে নির্জনবাসের জন্য প্রস্থান করার পর সব কিছুর প্রত্যক্ষ দায়িত্ব এসে পড়ে আমার আর বিদ্যুতের উপর। গূঢ়-পুরুষবর্গ নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করে চললেও আমরা পিতৃমাতৃ আদর্শে নিজেরা প্রতিটি কর্তব্যকর্ম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করি। 'মেঘকেতন' বিরামভবন মাত্র না থেকে আমাদের নিত্যসহচর, সুহৃদ, সখা হয়ে ওঠে।
সপ্তাশ্ববাহন সপ্রশ্ন হলেন - মায়ামুকুর থাকতে গূঢ়পুরুষবর্গের প্রয়োজন কী?
বজ্র - মায়ামুকুরের সীমা নদীর অপর তীর পর্যন্তই। নিরবচ্ছিন্ন কর্মের থেকে অবসর আমি প্রায়ই গুপ্ত সংক্ষিপ্ত পথে মহানদীর তীরবর্তী অঞ্চলে পরিভ্রমণ করতাম একাকী। ক্রমশঃ নদীর অপরতট আমাকে দুর্নিবার আকর্ষণে টানতে থাকে। একদিন আমি নদী অতিক্রম করে এ পর্যন্ত অদৃষ্ট ঐ সুন্দরজগতে প্রবেশ করি।
একযোজন নদীপবনসেবিত মালভূমি অতিক্রান্ত হলে পদ্মনাভপুরের রাজ উপবন। কুমার! তুমি অনুমান করতে পারো - পর্বতবাসীর চোখে সমতলের শোভা কত নূতন! আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কখন যে সেই মলয়মর্মরিত পুষ্পসুরভিত বীথিপথে পরিভ্রমণ আরম্ভ করেছি, নিজেই জানিনা।
সপ্তাশ্ববাহন বললেন - ব্যাঘাত সৃষ্টির জন্য ক্ষমা কর। প্রশ্ন না করে পারছি না। তোমার কোনো রাজকর্মচারীর সঙ্গে আকস্মিক সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনার কথা মনে হয়নি? ক্ষুৎপিপাসায় আর্ত বোধ করনি একবারও?
বজ্র - কুমার! তুমিও তো ঐ উদ্যান অতিক্রম করে এসেছো। কারো দর্শন পেয়েছিলে কি? পদ্মনাভপুর অনঙ্গপুরীর মতোই সুশাসিত সমৃদ্ধ দেশ। প্রজাকুল এত সম্পদশালী যে নিজেদের ভূসম্পত্তি, উদ্যান ইত্যাদি সুবিন্যস্ত রাখার পর রাজ-উদ্যানে প্রবেশের অবসর তাদের ক্কচিৎ হয় এবং প্রবেশ অবাধ, তাই উদ্যানরক্ষকের প্রয়োজন হয়না। মহারাজ পদ্মনাভ প্রজাদের পুত্রবৎ জ্ঞান করেন, তারাও রাজপরিবার এবং রাজভবন, রাজোদ্যান ইত্যাদিকে স্বীয় জ্ঞানে তার হিতসাধন করে। বৎসরের বিশেষ বিশেষ সময়ে রাজকীয় কর্মী এবং পুরবাসীবৃন্দ একযোগে ঐ সুবিশাল সুবিন্যস্ত উদ্যানে প্রবেশ করে তাকে আরো বিন্যস্ত, আরো রম্য করে দিয়ে আসে। বৎসরের অন্যান্য সময়ে রাজ উদ্যান থাকে একান্তবিহার অভিলাষীর স্বর্গ। ক্ষুধাতৃষ্ণার সাধ্য কী সে উদ্যানে প্রবেশ করে! নিয়মিত ব্যবধানে অজস্র ফলবান বৃক্ষ। এমন সুচিন্তিতভাবে সেইসব বৃক্ষশ্রেণী বিন্যস্ত যে বৎসরের যে কোনো ঋতুতেই কোনো না কোনোটির ফলবান হবার সময়। সুপেয় বারিপূর্ণ সায়র কিছুদূর অন্তর।
আমি কোনো মানবের দর্শন পেলাম না। পেলাম এক মানবীর।
- এই পর্যন্ত বলে বজ্র কমলিনীর প্রতি প্রীতিস্নিগ্ধ দৃষ্টিপাত করলেন - প্রিয়বান্ধবী! আমি বহুক্ষণ যাবৎ একা বাগ্বিস্তার করছি। আমার কণ্ঠও শুষ্ক হয়ে উঠেছে। এই উপাখ্যানভাগ কিছু তুমি, কিয়ৎপরিমাণ আমি - এইভাবে বিবৃত করি এসো।
কমলিনী শিরশ্চালন করে আগ্রহপ্রকাশ করলেন।
কমলিনী সূত্র ধরলেন - আমি প্রতিপ্রশ্ন করলাম, - তুমি কে? - উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে বালিকার মতো বলে ফেললাম - তুমি নিশ্চয়ই পরদেশী? না হলে এমন প্রশ্ন তো করতে না!
বজ্র - আমার সমস্ত অন্তঃকরণ মথিত হল। এমন সহজ সুরে প্রথম দর্শনে যে স্বচ্ছন্দে আলাপ করতে পারে, যে তাকে আপন মনে না করার অবসর দেয় না। বললাম - একমুহূর্ত আগে তাই ছিলাম। কিন্তু এখন আর তা মনে করতে পারছি না।
কমলিনী - আমি এই মহিমময় যুবাপুরুষকে আপাদমস্তক অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করে বললাম - তুমি নিশ্চয়ই কোনো রাজা বা রাজপুত্র! তোমার কটিতে তরবারি, শিরে উষ্ণীষ, কর্ণে সুবর্ণকুণ্ডল, কণ্ঠে মুক্তাহার, অঙ্গে রাজোচিত আবরণ-আভরণ ...। আমি আমার পরিচয় দিয়েছি। এবার তোমার পরিচয় প্রদান কর।
বজ্র - আমি প্রমাদ গণলাম। এখনই কি আর পরিচয় দেওয়া চলে! মুখে বললাম অবশ্য। কিন্তু আমার এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় পরিচয় - অতিথি। তাই নয় কি? তাহলে আগে আতিথ্য কর।
কমলিনী - আমি বিলক্ষণ অপ্রতিভ হলাম। বললাম - অতিথি সৎকার রাজভবনেই সম্ভব। তোমাকে তাহলে রাজভবনে যেতে হবে। তারপর হেসে বললাম - উদ্যানে কি আতিথ্য করা যায়! সেখানে সমপ্রাণ সখা-সখীরা মিলিত হয়ে আনন্দ-উৎসব করে।
বজ্র - আমি ধন্য হয়ে গিয়ে বললাম, তবে থাক আতিথ্য। সখা করে নাও আমায়।
কমলিনী - আমি প্রথমাবধি এই দেবদর্শন রাজপুরুষের সুমার্জিত আচরণে, সুললিত বাণী শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এখন এই সাকাঙ্খপ্রীতির বাক্যে অভিভূত এবং চরিতার্থ হয়ে বললাম - তাই নিলাম। তবে তুমি আমার সখা হলে?
বজ্র - আমি মুগ্ধ হৃদয়ে বললাম - একবার নয়, সহস্রবার। তুমিও তবে আমার সখী? অন্যথা করবে না তো কখনো? তবে বল একবার - সখা!
কমলিনী - আমি বলললাম - এই প্রস্ফুটিত পদ্মমালিকাকে স্পর্শ করে উচ্চারণ করছি - সখা! তুমি আমার সখা! - জেনো এই পদ্মমালিকা স্পর্শ করে অনান্তরিক শপথ করা আমার সাধ্যাতীত। কার স্মরণে গাঁথছি এই মালা, জানলে তুমি আমার কথায় সংশয় করতে পারবে না আর।
বজ্র - আমি ব্যগ্র উৎসুকতায় বললাম - কার স্মরণে সখি?
কমলিনী - আমি সংবিৎ ফিরে পেয়ে লাজে অবনতমুখী হলাম। কেন যে ওকথা উচ্চারণ করে ফেললাম! কেউ তো আমাকে শপথ করতে বলেনি!
বজ্র - আমি অনুযোগ করে বললাম - প্রিয় সখি! এই না তুমি বললে আমি তোমার সখা! এই কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই না বলেছিলে উদ্যানে সমপ্রাণ সখা-সখীরা মিলিত হয়ে আনন্দ-উৎসব করে! আমাকে যদি সমপ্রাণ মনে কর, তবে বল সে আনন্দের কথা। উৎসব করি দুজনে।
কমলিনী - আমি এই স্নেহপূর্ণ অভিমানে সাড়া না দিয়ে পারলাম না। নতনয়ন তুলে বললাম - সখা! তোমায় সমপ্রাণ মনে করে বলছি - এই মালিকা তাঁর স্মরণে রচনা করছি, আমি যাঁর বাগ্দত্তা। কুমার সপ্তাশ্ববাহন। অনঙ্গপুরীর মহারাজ অনঙ্গদেব এবং মহারাণী নীলিমার নন্দন। চেনো তো অনঙ্গপুরী?
বজ্র - আনন্দে আমার নয়ন অশ্রুপূরিত হল। কোন শুভক্ষণে আজ যাত্রা করেছিলাম! পিতামাতাকে স্মরণ করে বললাম - চিনি বইকি। তোমার ধ্যানের যে ধন, তাকেও চিনে নেবো। আমি একহাতে আমার হৃদয়, অন্য হাতে আমার তরবারি স্পর্শ করে, আমার দুই ঈশ্বর - আমার জনক-জননী, এবং তোমার নামে শপথ করে বলছি - শুধু তোমার পরম সখা আমার সখা হবেন না, আমি এবং আমার যত প্রিয়জন, সবাই তাঁর সখ্যলাভে ধন্য মনে করব নিজেদের।
কমলিনী - আমি আহ্লাদিত হয়ে বললাম - তবে এবার বলো, আমার সখা ভিন্ন তোমার অন্য পরিচয় কী?
বজ্র - আমি বললাম - বলি। তবে স্মরণ থাকে যেন, আমি তোমার সখা। - এই বলে দিলাম আমার পরিচয়।
কমলিনী - আমি ঘোর অবিশ্বাসে বললাম - রহস্য করছো বুঝি আমার সাথে! তুমি কখনো দানব হতে পারো!
বলতে বলতে কমলিনী লজ্জায় হেসে ফেললেন - সখা! তারপর যা বলেছিলাম, তা আর আমাকে দ্বিতীয়বার বলতে বলো না। পারব না আমি। ...
বজ্র - বিদ্যুৎ হেসে উঠলেন। সপ্তাশ্ববাহনও হেসে ফেলে বললেন - বুঝেছি। কাউকেই বলতে হবে না। আমাদের দুজনের কারোরই দোষ নয়। শৈশবাবধি যা জেনে এসেছি ...। যাক - বল, বল - তারপর কী হল?
বজ্র - সেই থেকে প্রগাঢ় সখ্য। কমল আমার মুখে শুনে বিদ্যুৎকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়; আমি ওর মুখে এবং বিদ্যুৎ আমার মুখে শুনে তোমায় দেখার জন্যে অস্থির হই।। প্রতি সপ্তাহে দুজনে এ প্রথম মিলনের স্থানটিতে মিলিত হই। আমাদের স্বপ্নের কথা আলোচিত হয়। ও আমাদের আদর্শে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়। শেষে দুজনে মিলে এই বুদ্ধি করি। অবশ্য বিদ্যুৎ ও এর মধ্যে জড়িত ছিল, তবে পরোক্ষভাবে। আমি লিপি রচনা করি। উত্তীর্ণ সন্ধ্যায় কমল তা তার শয্যার উপর বিস্তৃত করে অলিন্দপথে উদ্যানে চলে আসে। আমি তাকে আমার বায়ুরথে দ্রুত নিয়ে আসি। পরদিন ব্রাহ্মমুহূর্ত থেকে তুমি এই নাট্যে আর এক অভিনেতা। এরপরও কি এই মুহূর্তে কিছু বলার আছে?
সপ্তাশ্ববাহন স্বপ্নোত্থিতের মতন মৃদু হাসলেন। বিদ্যুৎ বললেন - 'এরপর' আর এই মুহূর্তে নয়। সখা! তুমি এবং সখী আসায় আমরা সুখের সপ্তম স্বর্গে অবস্থান করছি। কিন্তু তোমায় এই যাত্রা কিছুতেই অধিক দিন এখানে অতিবাহিত করতে বলতে পারিনা। অগ্রজ যা বলছিলেন, মনে আছে তো?
বজ্র দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন করলেন। সপ্তাশ্ববাহন ম্লান ভাবে বললেন - আছে। প্রত্যূষেই যাত্রা করব আমি।
বিদ্যুৎ বললেন - এবং এবার একা নয়। পদ্মাক্ষী রাজকন্যাসহ।
কমলিনী বিদ্যুৎকে বুকে টেনে নিলেন - রাজকন্যা তো একটি নয়। দুটিকেই নেওয়া যাবে তো? ব্যবস্থা করি তাহলে?
বিদ্যুৎ লজ্জায় কমলিনীর বক্ষে আত্মগোপন করে বললেন - সখী যেন কী!
কমলিনী কপোলে চুম্বন করলেন তার - সখীকে নিয়েও কি প্রাণ খুলে রহস্য করা যাবে না? লাভ কি তবে এমন সখা-সখীতে?
বজ্র রহস্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললেন - আচ্ছা কমল! মহানদী পর্যন্ত তো সবাই একসঙ্গেই যাব। তারপর? সখা যখন তোমায় নিয়ে পদ্মনাভপুরে প্রবেশ করবে তখন কী হবে? সবাই প্রথমেই দানবের বিকট ছিন্নমুণ্ড দেখতে চাইবে না?
সপ্তাশ্ববাহন দুহাতে তাঁকে গাঢ় আলিঙ্গন করলেন।
বিদ্যুৎ কমলিনীর বুক থেকে মাথা তুলে বললেন - রজনী গভীর হল। এখন শীঘ্র চল। নৈশাহারের আয়োজন করি। দ্রুত শয়ন না করলে প্রত্যূষে যাত্রা অসম্ভব।
রজনী গভীর। চতুর্দিক নিশিচর বিহঙ্গের সঙ্গীত ব্যতিরেকে নিঃশব্দ। পূর্ণচন্দ্রের দাক্ষিণ্যে যামিনী বিভোরা।
কুমার সপ্তাশ্ববাহন সুখশয্যায় কেবলই পার্শ্ব-পরিবর্তন করছেন। আশ্চর্য হয়ে চিন্তা করছেন - অরণ্যে বৃক্ষশাখায় বিগত কয়দিন তিনি অকাতরে নিদ্রা গিয়েছেন। আজ কেন রাজপর্যঙ্কে শয়ন করেও নিদ্রাকর্ষণ হচ্ছে না!
ক্রমশঃ অসহনীয় হয়ে উঠল। - যাই। প্রাসাদ শীর্ষে দণ্ডায়মান হই গিয়ে। ভাবলেন তিনি - শীতল নৈশপবনে নিশ্চয়ই তপ্ত মস্তিষ্কের শুশ্রুষা হবে।
সন্ধ্যাকালে যেখানে উপবেশন করেছিলেন, সেই যুগ্মমরালের সম্মুখে দণ্ডায়মান হলেন তিনি। এইখানে তাঁকে বেষ্টন করে তিনটি সোনার হৃদয় প্রহর অতিক্রম করেছে। স্মরণ করে পরম মমতায়, স্নেহে শ্রদ্ধায় দুহাতে স্পর্শ করলেন মরাল দুটিকে। অস্ফুটে বললেন - কমলিনী! সখা! সখী! আমিও তোমাদের ভালোবাসি। ...
বাম স্কন্ধে কোমল স্পর্শ। চকিতে ঘুরে দাঁড়ালেন কুমার। কমলিনী! কমলিনী বিভোরস্বরে বললেন - কুমার! জয় হোক তোমার! এই তো আমি চেয়েছিলাম। আমার দয়িত যেন শাস্ত্র এবং শস্ত্রসর্বস্ব এক রাজপুরুষমাত্র না হন। তিনি যেন হন কোমলপ্রাণ স্নিগ্ধ হৃদয় একমানব। একজন আদর্শ বান্ধব আদর্শ জীবনসঙ্গী।
কুমার বিহ্বলকণ্ঠে বললেন - ঘুম কি আসেনি কমলিনী?
কমিলিনী আরও এক পদ অগ্রসর হয়ে আসেন - ঘুম কি আসে কুমার? তোমারই কি এসেছে?
কুমার বললেন - না কুমারী। কিন্তু কেন আমাদের ঘুম আসেনি?
কমলিনী তেমনিভাবেই বললেন - সে তো আমরা দুজনেই জানি। আমি ভেবেছি তোমার কথা আর ...
কুমার একই স্বরে বললেন - আমি ভেবেছি তোমার কথা .. আর ...
কমলিনী বললেন - আর আমরা দুজনেই ভেবেছি, চন্দ্রকিরণের চাইতেও স্নিগ্ধ, কুসুমের চাইতেও কোমল, আকাশের চাইতেও উদার দুটি হৃদয়ের কথা। আমার একটি নিবেদন শুনবে? অনুমতি দাও তো বলি!
কুমার বললেন - আমাকে বলবে তুমি। এর জন্যে অনুমতি?
কমলিনী ব্যাকুলভাবে বললেন - আজ সেই প্রতীক্ষিত পূর্ণিমা। তুমি না জানলেও আমি তো এর অর্থ জানতাম। নিজের প্রতিজ্ঞা আর স্বপ্ন - এই দুই নিয়ে এতদিন কাটিয়েছি। শেষ পর্যন্ত কার জয় হবে, এই নিয়ে ভাবনা ছিল। ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো যেদিন সখার উদয় হল সেদিন থেকে আর ভাবনা ছিল না। আর সখীর আবির্ভাবে সব দিক কানায় কানায় ভরে উঠল। আজ এই দুটি দেব-দেবীর জন্যে এমন তীব্র-মধুর স্বাদের মধ্য দিয়ে পেলাম তোমায়। কালই তো আমরা যাত্রা করব! সাময়িক ভাবে বিচ্ছেদ হবে তোমার এবং আমার প্রিয় এই দুজনের সাথে। এসো! কিছুক্ষণ একে অপরকে স্পর্শ করে মিলিতভাবে কামনা করি - যেন কখনো কোনো কারণেই চিরবিচ্ছেদ না ঘটে আমাদের ..। আর .. যখন কোনো কারণে সাময়িকভাবে আমরা একসাথে থাকব না, যেন আমাদের সকলের ভালোবাসা ঘিরে থাকে আমাদের সকলকে। ...
প্রিয়বান্ধব! প্রিয়বান্ধবী! আমরা তোমাদের রইলাম। তোমরা আমাদের থেকো।
(পরবাস-৫৩, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)