Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines






পরবাসে
জয়ন্ত নাগ-এর

লেখা


ISSN 1563-8685




আসা-যাওয়ার পথের ধারে


আসা-যাওয়ার পথের ধারে; কালীকৃষ্ণ গুহ; প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০১৭; ছোঁয়া পাবলিশার্স, কলকাতা, প্রচ্ছদঃ রাজদীপ পুরী; পৃষ্ঠাঃ ১৭৬; ISBN: 978-93-82879-82-4

ম্প্রতি প্রকাশিত কালীকৃষ্ণ গুহর ভিন্ন স্বাদের ‘আসা যাওয়ার পথে ধারে’ গদ্যগ্রন্থটি পড়বার সুযোগ হল। বইটির সূচিপত্র দেখে লেখাগুলোর গতি-প্রকৃতি বা চরিত্র বোঝার কোন উপায় নেই। লেখক যে একজন কবি তা স্পষ্ট করেছেন প্রতিটি গদ্যের কাব্যিক নামকরণের মধ্যে দিয়ে। প্রতিটি লেখার শিরোনাম অপূর্ব এবং সব মিলিয়ে এক ধরনের রহস্যময়তা সৃষ্টি করা হয়েছে। যা একটা গদ্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে তেমন একটা চোখে পড়ে না। তাই শুরুতেই একটা কৌতূহল হয়। এক অনামিক প্রত্যাশা তৈরি হয়।

প্রথম লেখাটি চিত্রকর প্রকাশ কর্মকার-কে নিয়ে। যিনি ২০১৪ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। খুব সংক্ষেপে এই চিত্রশিল্পীর জীবন, ওঁর কাজ ও ব্যক্তিগত সান্নিধ্যের কথা ধরা হয়েছে এই লেখায়। প্রকাশ কর্মকারের শিল্পী-জীবন লেখকের একটি কবিতায় যথার্থই উঠে এসেছে এইভাবে — দীর্ঘ পথের চলায়/ এইটুকু যায় বলা/প্রকাশ কর্মকার/মাপেন অন্ধকার। লিখেছেন আরোও ক’জন গুণীজনদের নিয়ে, তাঁদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে। তাঁদের মধ্যে যেমন আছেন খুব পরিচিত বড়মাপের মানুষ (জীবনানন্দ দাশ, শম্ভু মিত্র, অম্লান দত্ত, শঙ্খ ঘোষ, রবিন মণ্ডল, আলাউদ্দিন খাঁ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, ইত্যাদি) আবার স্বল্প পরিচিত কিন্তু অসাধারণ কথাকার সুভাষ ঘোষাল বা মিত্রা চট্টোপাধ্যায়ের মতো গুণীজনও আছেন। উঠে এসেছে মফস্বলের বেশ কিছু গুণী কবির কথা, তাঁদের কবিতার কথা। লিখেছেন রামপ্রসাদ সেনকে নিয়েও। প্রসঙ্গ এসেছে সোক্রাতেস, পিকাসোরও। আর সব চাইতে বেশি এসেছে, বারবার এসেছে রবীন্দ্রনাথের কথা। সব লেখাই দুর্লভ তথ্যে সমৃদ্ধ এবং প্রাণবন্ত, কিন্তু নাতিদীর্ঘ। অকারণ কোন শব্দ ব্যয় করা হয়নি। প্রতিটি শব্দই যেন অনিবার্য। যেমনটি আমরা দেখি কবিতার ক্ষেত্রে। এই পরিমিতিবোধ লেখাগুলোকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অতিকথনে মূল বিষয় বা বক্তব্য হারিয়ে যায়নি। বরং তা সরাসরি পাঠকের কাছে পৌঁছে গেছে। এছাড়া অমিয় চক্রবর্তী, উৎপল বসু, আলোক সরকার, জয়দেব বসু সহ অনেকের কবিতার ছোট ছোট পঙ্‌ক্তি লেখাগুলো আলোকিত করেছে, বিষয়বস্তুকে আরো প্রাণময় করেছে। জীবনের গভীর তত্ত্ববিষয়ক গদ্যলেখায় (কোন কাব্য আলোচনা নয়) এরকম প্রসঙ্গোচিত কবিতার ব্যবহার বাংলাসাহিত্যে খুব কম চোখে পড়ে--যা মূল বিষয়কে ত্বরান্বিত করেছে। লেখাগুলোতে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। এখানেই লেখকের কৃতিত্ব।

লেখক প্রাসঙ্গিক ভাবেই অনেক গদ্যে ধর্মের প্রসঙ্গ এনেছেন। তবে বাংলাভাষার বেশিরভাগ লেখক ধর্ম বিষয়ে লেখালেখি নিয়ে যেরকম ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’-র মতো একটা সূক্ষ্ম চালাকি করেন এই লেখাগুলো সেই চালাকি থেকে, অসৎ উদ্দেশ্য থেকে একেবারে মুক্ত। লেখক ধর্ম বিষয়ে তাঁর অবস্থান খুব স্পষ্ট করে প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে কোনরকম রেখেঢেকে বলা নেই। দার্শনিকতার বাতাবরণে কোথাও এড়িয়ে যাওয়া নেই অথবা কোন ধূম্রজাল সৃষ্টি করার বিভ্রান্তিমূলক অপচেষ্টা নেই। এটা পরিষ্কার হয় যখন লেখক নির্দ্বিধায় বলেন—

‘বস্তুত বৈদিক যুগের ঋষিরা স্তব রচনা করেছিলেন প্রকৃতির উদ্দেশে — সূর্য মাটি জল হাওয়া ওষধি বা বৃক্ষের উদ্দেশে — কোন ঈশ্বরের উদ্দেশে নয়। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণার জন্ম হয় কিছু পরে।’

এই উক্তিটি উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে লেখক স্পষ্ট করেন যে ‘ঈশ্বর’ আসলে মানুষের সৃষ্ট একটি ধারণা মাত্র। আবার লেখক এটাও সরাসরি বলেন যে ‘নাস্তিক্য বা জড়বাদও হিন্দুত্ব’ অথবা ‘চর্বাকপন্থী ভাবুকদের দেশে, সাংখ্যদর্শনের দেশে নাস্তিক্যও ধর্ম।’ এবং খুব দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ‘সমস্ত ধর্মকে — ধর্মের যুক্তি ও নৈতিকতাকে প্রশ্ন করা হোক। সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মশিক্ষা বন্ধ করে মুক্তচিন্তার রাস্তা প্রাসারিত করা হোক।’

এই বইটি বিষয়ে আরেকটি কথা বলা খুব জরুরী--লেখক ওঁর সমসসাময়িক অনেক গুণী কবিদের নি:শর্ত প্রশংসা তো করেছেনই, তাছাড়া দ্বিধাহীন সুখ্যাতি করেছেন অনেক অজানা অনুজপ্রতিম কবিদের কবিতার। বর্তমান সময়ে এরকম ঘটনা তেমন একটা চোখে পড়ে না। অথচ আমরা জানি বুদ্ধদেব বসু যদি তাঁর সমসাময়িক কবিদের গুণগত মান নিয়ে ‘কবিতা’ পত্রিকার মাধ্যমে উচ্চকন্ঠ না হতেন তাহলে হয়ত জীবনানন্দ, সমর সেন, বিষ্ণু দের মতো কবিদের চিনতে আমাদের আরও অনেকগুলো বছর অপেক্ষা করতে হত। যদিও ইন্টারনেটের যুগে সময় বদলেছে। তবুও অনুজপ্রতিম কবি-লেখকদের বিষয়ে অগ্রজ কবি-সাহিত্যিকদের নি:স্বার্থ প্রশংসার একটা বড় ইতিবাচক ভূমিকা এখনও আছে এবং তা যে ভবিষ্যতেও থাকবে তা বলাই বাহুল্য। তবে আমরা এক অদ্ভুত সময়ে বসবাস করছি। সম্প্রতি এই সময়ের আলোচিত কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এক আড্ডায় বলছিলেন যে এখন কলকাতায় কোন অনুষ্ঠানে যদি কোন কবি বা লেখকের আলোচনা বা কবিতা পাঠ শুনে শ্রোতারা স্বত:স্ফূর্তভাবে অনেক করতালির মাধ্যমে তাকে অভিনন্দিত করে, তাহলে রাতারাতি সে অন্য কবি-লেখকদের শত্রু হয়ে যায়, সম্পর্কটা আর আগের মতো থাকে না। এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে অন্যের প্রশংসা কিছুতেই আর সহজভাবে নিতে পারি না। কালীকৃষ্ণ গুহ নিজে একজন বড় মাপের কবি হয়েও অন্যের প্রশংসা করতে কোন কার্পণ্য করেননি। তাই এই ব্যাপারে কালীকৃষ্ণ গুহর এই ভূমিকাকে বিশেষভাবে সাধুবাদ জানাই। বইমেলায় লেখকের আবিষ্কৃত ক’জন ‘মফস্বল’ বা কলকাতার বাইরের কবির কবিতার উদাহরণ দিলেই তা স্পষ্ট হবে যে ওঁর প্রশংসা অমূলক নয়, উদ্দেশ্যমূলক নয়। যেমন — ‘পিতা প্রপিতামহের/মহিমায় এ মাটি। সোঁদা গন্ধ/উপত্যকার কোল ঘেঁষে জন্মখেলায়/মেতে ওঠে ত্রিশূল।' (সোনালি বেগম), ‘এইখানে চন্দ্রহার পুঁতেছি ব্রাহ্মণ/চারপাশে গায়ত্রী ঘোরাও/মাটিটুকু সোনা হোক/ আমার সোনার চাঁদ উদিত আকাশে/চন্দ্রমুখী চেয়ে চেয়ে আলো নাও/ আলো নাও রমণী/' (সুবোধ পরামানিক) ‘আধো ক্ষত ঢাকা পড়ে প্রেমে।/পুরো প্রেম বিক্ষত/নখের আঁচড়ে।' (দুর্বা চট্টোপাধ্যায়) ‘সুপারি গাছের মাথায়/নবমীর চাঁদ দেখা দিয়েছে সবে/ আমি তোমার রূপকথা পড়ছি।/রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে যদিও আলো জ্বলে উঠেছে/তবুও বিকেলের শেষ আলোতে রামধনু/এঁকেছি তোমার রূপকথা।' (রত্না ঘোষ) ‘তোমার সংকোচবোধ/ ঘিরে দেবো এ শরীর দিয়ে/যেখানে যেটুকু প্রেম/কেড়েকুড়ে আনবো ছিনিয়ে।' (সুদেষ্ণা বসু) এভাবেই এই বইটি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় বালুরঘাটের অসাধারণ কবি মনিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়ার ‘জোনাকির বাতিঘর’ নামের কাব্যগ্রন্থটির সঙ্গে। অথবা আমরা জানতে পারি সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আতপ্ত আতপ’ নামের কবিতার বইয়ের কথা।

এই বইয়ের একটা বড় অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের জীবন এবং সৃষ্টিকর্ম বিষয়ে বেশ ক’টা লেখা আছে। যার মাধ্যমে কিছু স্বল্পশ্রুত বা অজানা তথ্য পেয়ে যাই, যেমন — রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বিশুদ্ধ জড়বাদী বিশুদ্ধ বর্বর ... মানুষ আছে তার দুই ভাবকে নিয়ে, একটা তার জীবভাব, আর একটা বিশ্বভাব।’ অথবা ‘আমরা যাকে ব্রহ্মানন্দ বলি তাও মানবের চৈতন্যে প্রকাশিত আনন্দ।’ এরকম অনেক উদ্ধৃতি আছে যা রবীন্দ্রনাথকে অন্যভাবে বুঝতে বা চিনতে সাহায্য করে। এছাড়াও আরও তথ্য বা কিছু ঘটনার কথা জানা যায় এই লেখাগুলো থেকে। যেমন — রবীন্দ্রনাথ, ভগিনী নিবেদিতা ও স্বামী বিবেকানন্দের ভিতরকার এক রহস্যজনক ঠান্ডা লড়াই বা টানা-পোড়েনের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক। আরেকটি লেখায় উঠে আসে রবীন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগরের মধ্যে কিছু বিষয় নিয়ে যে মতান্তর ছিল তার কথা। এরকম অনেক তথ্য বা সংক্ষিপ্ত দার্শনিক আলোচনা রয়েছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়। কিন্তু বিশেষ উপস্থাপনার গুণে তা কখনোই পাণ্ডিত্য জাহির করার মতো মনে হয়নি। তাই বইটি সবমিলিয়ে একজন যত্নবান মননশীল পাঠকের কাছে এক জরুরী পাঠ হতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

এই বইতে মোট ৩৬-টি গদ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে কিছু লেখায় উত্থাপিত বিষয় আরেকটু বিস্তারিত ভাবে পরিবেশিত হলে পাঠকের প্রাপ্তি অনেক বেশি হত। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে — ‘যে-বিষাদ নশ্বরের অনায়াস অর্জন’-এ যুক্তিবাদ ও ধর্ম বিষয়ে, ‘পথিক হাওয়া’-তে হিন্দুধর্ম ও মুক্তচিন্তা প্রসঙ্গে, ইত্যাদি। আসলে, এই বিষয়গুলো বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। তা না-হলে টুকরো টুকরো মন্তব্যে পাঠকের উৎসাহ জেগে উঠতে উঠতেই তা হারিয়ে যায় অথবা উৎসাহের অপমৃত্যু হয়। হয়ত ইচ্ছে করেই লেখক এইসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পথে গিয়ে লেখাগুলোর গতি রোধ করতে চাননি, নিরস তাত্ত্বিক প্রবন্ধে রূপান্তরিত করতে চান নি। তবুও পরবর্তী সংস্করণে এটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ অর্থবহ। নি:সন্দেহে এই বইটি বাংলা গদ্যসাহিত্যে একটি বিশেষ সংযোজন। অনেক পাঠকের মধ্যে বইটি ছড়িয়ে পড়ুক। এবং এর বিষয়গুলো অনেক মানুষের আলোচনার বিষয় হোক সেটাই একান্ত চাওয়া।



(পরবাস-৬৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)