যাচ্ছিলাম পাখির খোঁজে। এখানে একটানা লম্বা শীতের পর একটু বাইরে বেড়াবার জন্য প্রাণ আনচান করে। এপ্রিল মাসটায় ঝাঁকেঝাঁকে পরিযায়ী হাঁস, বক, সারস, পেলিকান, পানকৌড়ি ইত্যাদি জলপ্রেমী পাখিদের আনাগোনা। সবাই দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলেছে। ওমাহা থেকে প্রায় তিনশো মাইল উত্তর পশ্চিমে একটা ভারি সুন্দর নদী নিওব্রারা, তারই আশেপাশে জলাজঙ্গল ভর্তি পাখির দল।
এক ছুটির দিনে ফ্লাস্ক ভরতি চা, ক্যামেরা ও দূরবীন নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেশ সুন্দর দিন, নরম রোদ্দুর, হাওয়ায় হাল্কা শীতের আমেজ, বেশ মনের আনন্দে ঘুরছি, হঠাৎ চোখে পড়ল একটা সাইনবোর্ড-- Monowi--জনসংখ্যা-১! একটা শহরে মাত্র একজন বাসিন্দা? এ আবার কিরকম শহর? তাহলে তো পৃথিবীর সবথেকে ছোট্ট শহরই হবে, একজনের থেকে তো কম লোক হতেই পারেনা। এমন জায়গা কি না দেখে ফিরে যাওয়া যায়?
ব্যাস, পাখি দেখা মাথায় রইল। আমরা সব কিছু ফেলে Monowi-র খোঁজে চললাম। জায়গাটা খুবই ছোট্ট--এক বর্গমাইল-এরও কম, একটা হাইওয়ে চলে গেছে মধ্যিখানে, তারই একপাশে ইতস্তত ছড়ানো ভাঙা, পরিত্যক্ত ছোট ছোট কয়েকটা বাড়ি, জানলার কাঁচ ভাঙা, ছাদে ফুটো, চারদিকে লম্বা আগাছার জঙ্গল। একজন বাসিন্দার শহরে এর থেকে বেশি কিই বা আশা করা যায়।
অন্যান্য বড়ো শহরের মত মনওইতেও আছে মেয়র--এলসি নিজেই। আছে ট্যাক্স-দেনেওয়ালা--এলসি নিজেই নিজেকে ট্যাক্স দেন। বার চালাবার জন্য লিকর লাইসেন্সও তিনি নিজেই নিজেকে দিয়েছেন। বিনা লাইসেন্সে তো বার চালানো বেআইনি। হাইওয়ে ও তিন চারটি ট্রাফিক লাইট-এর দেখাশোনার জন্য সরকার থেকে টাকাও পান।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? এলসির বয়েস চুরাশি। তাঁর এক ছেলে কিছুদূরে বড়ো শহরে থাকে, মনওই-এর ভার নেবার ইচ্ছে নেই। তাছাড়া নতুন করে সরকারী কাগজপত্র করাবার খরচও আছে। (আপনারা পাঠকেরা একটি ছোট্ট নিজস্ব শহরের অধিকারী হতে চান কি? তাহলে এই আপনার সুবর্ণ সুযোগ।)
একজন বুড়োমানুষকে এরকম একা একা থাকতে দেখে আমার নিজেরই চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু দেখলাম এলসি-র প্রতিবেশীরা রোজ দোকানে এসে আড্ডা মারেন, কফি খান আর এলসিকে সঙ্গ ও উপদেশ দেন। দরকার পড়লে সব রকম সাহায্যও করেন। দোকানে আশেপাশের গাঁয়ের লোকেদের আনাগোনা লেগেই আছে। এবং সবাই সবাইকে চেনে। দেখে আশ্বস্ত হলুম যে এখনো এসব জায়গায় প্রতিবেশীদের দেখাশোনা করার চলটা বজায় আছে। এলসিকে বিদায় জানিয়ে আমরা ফিরে চললাম। আবার আদৌ দেখা হবে কিনা কে জানে।
(পরবাস-৭১, ৩০ জুন ২০১৮)