Subscribe to Magazines



পরবাসে কমলিকা সান্যালের
লেখা


ISSN 1563-8685




চেতনের সুর

মোহন এসে বেমক্কা এক খোঁচা মেরে বলল, “ওঠ, ওঠ! অনেক আরাম করেছিস।”

উফ, আবার আরম্ভ করেছে। একটু পা-টান করছিলাম, এক্ষুনি আবার উঠতে হবে? খেলাম যে কিছুক্ষণ আগেই।

“চল, চল, ওঠ! সব ফ্যামিলিগুলো এই সময়ই বেরোয়।”

আমি বেশ জোরের সঙ্গেই আপত্তি করলাম। সাধারণত আমি মোহনের সব দাবীদাওয়াই মেনে নিই। কিন্তু আজ আমার শরীরটা বিশেষ জুৎ লাগছে না।

কিন্তু মোহন মোটে পাত্তা দিল না। আজ ওর রোজগার হয়নি কোনোই, তাই বোধহয় চিন্তায় পড়ে গেছে, আমার মেজাজের দিকে দৃকপাতও করছে না। উফ, ঘাড়ে-চড়া পাবলিক একেই বলে।

কি আর করি। বেরোলাম দুজনে। এদিক ওদিক উৎসুকভাবে তাকাতে তাকাতে চলেছে মোহন, আমার একটুও উৎসাহ নেই। বেশ কয়েকবার হাই উঠল।

আসলে আমি এই অঞ্চলের নই। কাজের জন্য এতদূরে আসা, কিন্তু এখানে আমার মন লাগে না। ভাই-বোনগুলোকে কতদিন দেখিনি। এতদিনে ওরাও এখানে ওখানে কাজে লেগে পড়েছে নিশ্চয়ই।

ধ্যুর, বাজে জায়গা। দেশের মত গরম লাগে না এখানে ঠিকই, কিন্তু খাবার দাবার ঠিক পছন্দ নয় আমার। আশেপাশে কত্ত লোকজন। এত ভীড় ভালো লাগে না। না, সবসময় ভালো লাগে না তা নয়, কিন্তু মাঝে মাঝে বিরক্তিকর লাগে।

হঠাৎ মোহন দুইবার খোঁচাল আমায়। অর্থাৎ কাস্টমার আসছে, শুরু করতে হবে।

ব্যাজারমুখে মনে মনে মনে মোহনের পিণ্ডি চটকাতে চটকাতে বালির ওপর থেবড়ে বসে পড়লাম। কাস্টমাররা কাছে এগিয়ে এল। তিনজন। দু’জন বড়, একজন ছোট, গোল্লা গোল্লা চোখ করে আমারই দিকে তাকিয়ে আছে। অপ্রস্তুত ভাবটা কাটাতে একটু গলা খাঁকারি দিলাম। এদের ঘোরাতে নিয়ে যেতে হবে এবার। আধ ঘণ্টা, তার বেশি না। জল, জল, আর জল। আর তার পাশে তিন ছটাক বালি। তা এত দেখার কি আছে কে জানে।

মোহনটা কাস্টমারদের সাথে বকবক জুড়ে দিল। আমি চুপচাপ সমুদ্রের দিকে দেখতে দেখতে চলতে আরম্ভ করেছি, কাস্টমারদের দিকে মন দেওয়ার ইচ্ছেই নেই কোনো। কানে ভেসে এল যে ও আমারই কিছু গল্প বলছে। বলুক। ও বলে মন্দ না। কাস্টমাররা বেশ মজা পায়।

ধ্যুর। কিছু ভালো লাগে না। সূর্যটা ডুবছে। আমি বাড়ি যাব।

হঠাৎ শব্দটা শুনতে পেলাম।

এত লোকের কথাবার্তা, চারপাশের সবরকম আওয়াজ ছাপিয়ে সেই শব্দ আমার কানে পৌঁছাল। অনেকদিন, অনেকদিন শুনিনি।

আমি মাথা ঘুরিয়ে ভীড়ের মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ। দেখতে পেয়েছি। ওই যে ছেলেটা। ওর মুখে ওর সেই যন্ত্র। আর তার থেকে বেরিয়ে আসছে সেই শব্দ। চমৎকার, চমৎকার সে শব্দ।

সমুদ্রের ঢেউগুলো যেমন তীরে এসে আছড়ে পড়ছে, আমার মনের মধ্যেও যেন সেই শব্দের ওঠা নামা তেমনই আছড়ে পড়ছে। যেমন সবসময় পড়ে।

শুনতে শুনতে হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আমার আর খারাপ লাগছে না। পায়ের ব্যথা, মুখের বিস্বাদ ভাব, কাজের একঘেয়েমি, কোনো কিছু যেন আর গায়েই লাগছে না। আঃ, জীবনটা খুব একটা খারাপ জিনিস না। যেমন, এইরকম শব্দ শোনা যায় মাঝে মাঝে। মোহনের যত্ন পাওয়া যায়। সারাদিনের খাটনির পর ঘুমের মত ভালো জিনিস উপভোগ করা যায়।

খুশিতে আমিও গলা ছাড়লাম।

******

“একি! উটটা এমন ডাকছে কেন?” উৎপলবাবু সভয়ে প্রশ্ন করলেন মোহনকে। মিষ্টি অবশ্য বেশ মজাই পাচ্ছে মনে হচ্ছে। স্মিতাদেবী শক্ত করে মেয়ের হাত ধরে মোহনের দিকে তাকালেন, মুখে অস্বস্তির ছাপ।

মোহন জানে কারণটা। চেতন এরকমই করে বাঁশির সুর শুনলে। শুধু বাঁশি বললে ভুল হবে, যে কোনো সুরেলা বাজনার শব্দ শুনলেই। সুবলটা ওর মেলার বাঁশিটা নিয়ে অনেকদিন পর এদিকে এল। কটকের স্কুলে ভর্তি হয়েছে তো, তাই আর আগের মত দেখা হয় না।

সেবার কি কাণ্ডটাই না হল। একটি ট্যুরিস্ট ছেলে তার মাউথ অর্গ্যানটা বাজাচ্ছিল বালির ওপর বসে। গানের তিন কলিও বাজায়নি বেচারা, চেতন লাফাতে লাফাতে প্রায় তার ঘাড়ে গিয়ে পড়ে আর কি! আর সাথে জুড়েছিল তার ঊষ্ট্র-রাগিণী। যেমন এখন জুড়েছে।

এই জগতে জগন্নাথ কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটান!

মোহন বড় আদরে হাত বুলোল চেতনের লম্বা গলায়। “ব্যস, ব্যস, চেতন!”

জয়সলমীরের চেতন চুপটি করে দাঁড়ায় পুরীর সমুদ্রসৈকতে। মোহন এমন করে বললে সে কখনো অবাধ্য হয় না।

ব্যাস। আজকে এটাই শেষ ট্রিপ। আজ আর চেতনকে খাটাবে না মোহন। সুবলকে আজ সন্ধ্যায় ধরে নিয়ে আসতে হবে ডেরায়। বাঁশি সমেত।






(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)