একবার বা দু’বার নয়, সাঁই-সাঁইত্রিশ বার!
এই নিয়ে ঠিক সাঁইত্রিশ বার মাংস চুরি হবার পর আর মাথার ঠিক রাখতে পারলো না বাঘ। এ তো চুরি নয়, দিনে ডাকাতি! জঙ্গল কাঁপিয়ে গর্জে উঠলো বাঘ, “হালুম!”
গাছের উপর থেকে সেই ডাক শুনে খ্যাঁ-খ্যাঁ খিঁ-খিঁ করে হাসলো শকুনেরা। হাসবে না কেন? ওরা তো জানে যে বাঘের শিকারে আসলে ভাগ বসাচ্ছে ওরাই। বাঘের উপর ওদের খুব রাগ। কিছুদিন আগে একটা বাচ্চা শকুন গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলো। কোথায় বেচারিকে আবার গাছে তুলে দেবে, তা নয়, বাঘ তার কান মলে তাকে এমনি খামচিয়ে দিয়েছে যে সে বেচারি এখনো যন্ত্রণায় ছটফট করছে আর ভয়ে কোনো কথা বলতে পারছে না। তাই শকুনেরা ঠিক করেছে বাঘকে এমন জব্দ করবে যাতে আর কক্ষনো ও এরকম না করে।
তারপর থেকে বাঘ একটা করে শিকার মেরে নিয়ে আসে আর অনেক উপর থেকে উড়তে উড়তে শকুনেরা লক্ষ্য করে বাঘ কোথায় শিকার লুকিয়ে রাখছে। সেই শিকারের আশেপাশের কোনো একটা বড় গাছের মগডালে ওরা দল বেঁধে অপেক্ষা করে। প্রথমবারের মতো খাওয়া শেষ করে যেই বাঘমশাই একটু অন্য কোথাও হাঁটতে বেরোন, অমনি ওরা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘের শিকার খেতে। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাকি যা কিছু সব চলে যায় ওদের পেটে। বেচারি বাঘ ফিরে এসে দেখে ওর জন্য আর কিছু বাকি নেই।
কিছুদিন আগেও শকুনেরা বাঘের প্রথমবারের মতো খাওয়া শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করতো। কিন্তু দিনকে-দিন ওদের সাহস বাড়ছে। আজকাল ওরা আগে থাকতেই পাথর-ফাথর জোগাড় করে রাখে। বাঘ খেতে বসলেই উপর থেকে উড়তে উড়তে বাঘের গায়ে পাথর ছোঁড়ে। অব্যর্থ টিপ্ ওদের। আর সেই টিপ্ শুধুমাত্র দু’ পা বা মুখ দিয়ে ছুঁড়ে নয়! গায়ে ঢিল লাগার পরে বাঘ একবার রেগে মুখ তুলে ওদের খুব বিচ্ছিরি কিছু গালাগালি দিয়েছিলো। সেই গালাগালি শুনে একটা চ্যাংড়া শকুন বাঘের খোলা মুখে কুকম্ম করে দেয় আর তারপর হাসতে হাসতে বলে, “কেন যে শুধু শুধু মুখ নোংরা করিস!”
সেদিনের পর থেকে বাঘকে খোলা জায়গায় দেখলেই শকুনেরা পাল্লা দিয়ে বাঘের গায়ে কুকম্ম করে চলে। ঘেন্নায় বাঘ হয়তো চান করে এলো নদীতে, তারপর জলের থেকে যেই ডাঙায় উঠলো, আবার ...
কিন্তু আজকে বাঘ সত্যি সত্যি রেগে গেছে। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে শকুন বংশ ধ্বংস করে ছাড়বে। মুশকিল এই, ঠিক কিভাবে যে ওদের জব্দ করবে বুঝে উঠতে পারছে না। লাফিয়ে ব্যাটাদের ধরার উপায় নেই। ওরা ওড়ে অনেক উপরে, বাঘের আওতার বাইরে। আর নিচে যখন নামে তখন খুব সাবধানে, চারদিকে নজর রেখে। ওরা কক্ষনো সবাই একসাথে নিচে নামে না। কয়েকজন উপরে উড়তে থাকে আর সময়মতন বাকিদের সাবধান করে দেয়।
ভাবতে ভাবতে বাঘের মনে পড়লো সেই শিকারী ব্যাটার কথা যাকে বাঘ গত বছরে খেয়েছে। ওর কাছে একটা বন্দুক ছিলো না, যেটা দিয়ে ও বাঘকে গুলি করতে গেছিলো? মাচার উপরে লাফিয়ে বাঘ যখন ওর ঘেঁটি কামড়ে ধরে বন্দুকটা তখন ওর হাত থেকে নিচে পড়ে যায়। নিশ্চয় বন্দুকটা এখনো ঠিক সেই জায়গাতেই রয়ে গেছে। খুব খুশি হয়ে বন্দুকটা নিয়ে এলো বাঘ। অন্তত একটা দুটো শকুনও যদি মরে ক্ষতি কি?
একবছর পড়ে থেকে থেকে বন্দুকটাতে জং ধরে গেছে। গাছের উপর তাক করে ট্রিগারে চাপ দিলো বাঘ। কিন্তু কিছুই হলো না। বরং জোরে চাপ দিতে গিয়ে ট্রিগারটাই ভেঙে দু’ টুকরো হয়ে গেল।
পালকে ঘুণ ধরে যাওয়া বুড়ো এক শকুন, যার দিকে বাঘ বন্দুকটা তাক করেছিল, সে পালিয়ে তো যায়ই নি, বরং গাছের ডালে বসে আরামে ঝিমোচ্ছিলো। ট্রিগার ভাঙার আওয়াজে ঢুলুঢুলু চোখে খুব বড় একটা হাই তুলে সে বাঘের দিকে তাকিয়ে বললো, “কেন যে লোকে পয়সা দিয়ে সিওর-শট কোম্পানির বন্দুক কেনে?”
অগত্যা বাঘ ঠিক করলো যে মাটিতে থেকে নয়, বরং একটা বড় গ্যাস বেলুনে চড়ে উপরে উঠে শকুনদের লাঠিপেটা করবে। বেলুন জোগাড় করে উঠেও পড়লো বাঘ মাটির থেকে। কিন্তু বেলুনটা উপরে ওঠার আগেই একটা হোঁৎকা শকুন চিলের মতন নেমে এসে বেলুনটাকে ঠুকরে ফুটো করে দিলো। ভাগ্গিস খুব উঁচুতে তখনো ওঠে নি বেলুনটা। তবু হুড়মুড়িয়ে নিচে পড়ে গিয়ে সারা গা ছড়ে গেলো বাঘের।
একটা বাচ্চা শকুন তাই দেখে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো, “বাঘের ডানা নেই, তাই না বাবা?”
বাবা-শকুন গম্ভীরভাবে জবাব দিলো, “হ্যাঁ, গাধাদেরও নেই!”
দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছেটাকে আপাতত মুলতুবি রেখে জঙ্গল ঘুরতে গেলো বাঘ। আর ঠিক তখনই দেখা হয়ে গেলো চিতার সাথে।
ছোটবেলায় চিতার সাথে গলায় গলায় ভাব ছিলো বাঘের। কিন্তু কিছুদিন আগে হরিণের বখরা নিয়ে জোর মারামারি হয়ে যায় চিতার সাথে। মারতে মারতে নিজের এলাকা থেকে ওকে খেদিয়ে দিয়েছিলো বাঘ। চিতাকে আবার ওর এলাকায় ঘুরতে দেখে প্রথমে মারতেই ছুটেছিলো বাঘ, কিন্তু তারপরেই একটা কথা মনে হওয়ায় থমকে দাঁড়ালো। বললো,
-- প্রথমে ভেবেছিলাম আবার পেটাবো তোকে। পেটাবো না, যদি আমার একটা কাজ করে দিতে পারিস!
-- কি কাজ সেটা আগে বল, শুনি!
-- তুই তো ভালো গাছে চড়তে জানিস, শকুন মারতে পারবি?
-- শকুন! ছিঃ! তুই শকুন খাচ্ছিস নাকি আজকাল? ছিবড়ে মাংস আর বিটকেল গন্ধ, বমি এসে যায়। তোর খেতে হয় তুই খা, আমি এর মধ্যে নেই।
-- আরে খেতে-টেতে হবে না, শুধু মারবি।
-- কেন? মারবো কেন? কি করেছে ওরা আমার যে ওদের মারবো?
-- তোর কেন কিছু করবে? আমার করেছে। আমার খাবার চুরি করে খেয়েছে।
-- তাই নাকি? খুব ভালো কাজ করেছে।
-- ভালো কাজ করেছে?
-- হ্যাঁ, ভালো কাজ নয়তো কি? মনে আছে আজ থেকে দশ বছর আগে তুই আমাকে খামচে দিয়েছিলি? রক্তে নাক ভেসে গেছিলো আমার!
-- তুই আমায় ল্যাং মারিস নি তার আগে?
-- ল্যাং তো তুইও আমাকে মেরেছিস, পাঁচ বছর আগে ল্যাং মেরে আমাকে নদীর জলে ফেলে দিয়েছিলি? আর একটু হলেই আমাকে কুমিরে খেতো!
-- আমাকে গাধা বললি তার আগে, আর ফেলবো না?
-- আর এই সেই দিন যে আমার শিকার কেড়ে আমাকে বন-ছাড়া করলি?
-- বেশ করেছি। যা বলছি কর, নইলে মেরে তোর সব হাড় গুঁড়িয়ে দেবো।
চিতা একটুও ভয় পেলো না। বরং খেঁকিয়ে উঠে বললো,
-- চলে আয়! জানিস আমি বিয়ে করেছি। আমার শ্বশুর আর শালারাও আমার সাথে লড়বে। এই দ্যাখ!
মাথা নিচু করে হিসহিসিয়ে একটা শিস দিলো চিতা। মুহূর্তের মধ্যে একটা বুড়ো আর ছ-ছ’টা গোবদা জোয়ান চিতা এসে বাঘের দিকে কটমট করে চাইলো।
মনে মনে চিতার শ্বশুরবাড়ির সাথে নিজের শ্বশুরবাড়ির তুলনা করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো বাঘ। তারপর অন্যদিকে হাঁটা দিলো। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এগিয়ে গেলো। অল্প কিছু গাছ রয়েছে এখানে, জঙ্গল খুব ঘন নয়। বেশির ভাগই ছোটো ছোটো ঝোপ। আরও দূরে জঙ্গল ছাড়িয়ে মানুষের রাজত্ব শুরু হয়েছে। লম্বা ঘাসে ভরা মাঠ, ধানের ক্ষেত আর অল্প কিছু বাড়ি।
সেদিকে তাকিয়ে বাঘ দেখে একটু দূরে রাজমিস্ত্রিরা একটা বাড়ি বানাচ্ছে। তাদের সামনে টুপি পরে দাঁড়িয়ে হরশংকর ওরফে হর প্রোমোটার কাজের তদারকি করছে।
এই হর প্রোমোটার লোকটাকে বাঘ মোটেই পছন্দ করে না। একবার রাত্তির বেলা মোষ মারতে গ্রামে ঢুকেছিলো বাঘ। হর প্রোমোটার তখন একটা তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে ওর গায়ে একটা চকলেট বোমা ছুঁড়ে মারে। কিন্তু আজ হর প্রোমোটারকে এখানে দেখে বাঘের মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেলো।
এক লাফে রাজমিস্ত্রিদের সামনে এসে আলতো করে হর প্রোমোটারের ঘেঁটি ধরে তাকে পিঠের উপর চাপিয়ে দিলো বাঘ। তারপর দে ছুট, দে ছুট! একেবারে জঙ্গলে তাকে নিজের ডেরায় ধরে নিয়ে এলো।
ভয়ে হর প্রোমোটারের মুখ চোখ শুকিয়ে গেছে। বাঁ থাবা দিয়ে হরকে একটা বড় গাছের সাথে চেপে, ডান থাবার নখগুলোকে হরর গলার ঠিক কাছে নিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বাঘ বললো, “হর, তোকে খাবো না, যদি আমার একটা কাজ করে দিতে পারিস!”
হরর ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো। বললো, “কি কাজ স্যার, শুধু মুখ ফুটে একবার বলুন, যা বলবেন করতে রাজি!”
-- আমাকে একটা বাড়ি বানিয়ে দিতে হবে। বেশি বড় না, একটা মাত্র ঘর হলেই চলবে।
আনন্দে হরর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
-- শুধু ঘর বানানো! কোনো ব্যাপার নয়, স্যার! আমাকে ছেড়ে দিন, লোকজন জিনিসপত্তর সব নিয়ে আসি -- ইঁট, মাটি, সিমেন্ট …
বাঘ এবারে ঘুঁ ঘুঁ করে ধূর্ত একটা হাসি দিলো।
-- ছেড়ে দেবো? কি পেয়েছিস আমায়? বোকা পাঁঠা? ছেড়ে দিলে আর তোর টিকিটির দেখা পাবো? নে, এক মিনিট সময় দিচ্ছি, শুরু কর বাড়ি বানানো!
হরর মুখ আবার শুকিয়ে গেলো।
-- লোকজন, জিনিসপত্তর না পেলে বাড়ি বানাবো কি করে?
-- লোক ডাক! বল জিনিসপত্তর নিয়ে এখানে আসতে।
হরর সারা গা এবার ভয়ে ঘামে ভিজে গেলো।
-- আমি নিজে যেতে না পারলে এসব জোগাড় হবে কোত্থেকে?
এবারে সত্যি সত্যিই রেগে গেলো বাঘ।
-- তুই মানুষ না গাধা! পকেটের স্মার্টফোনটা বের কর। নম্বর লাগা। তাড়াতাড়ি!
হর বোকার মতো হেসে ফোন বের করলো। তারপর ভয়ে ভয়ে বললো,
-- যদি লোক কেউ না আসে?
-- তবে তুইও আর কোথাও যাবি না! যাবি, তবে আমার পেটে!
-- যদি নেটওয়ার্ক ফেল করে?
-- তবে তোর হার্টও যাতে ফেল করে তার ব্যবস্থা করবো।
কয়েকঘন্টার মধ্যে প্রচুর লোক আর জিনিস এনে ফেললো হর। চব্বিশ ঘন্টা মজুর দিয়ে কাজ করিয়ে দু দিনের মধ্যে সুন্দর একটা ঘর বানিয়ে দিলো বাঘ-মশাইয়ের জন্য। মস্ত একটা কাঠের দরজা সে ঘরে। দরজা বন্ধ করে রাখলে শকুনদের সাধ্য কি সে ঘরের মধ্যে ঢোকে।
ঘর দেখে খুব খুশি হলো বাঘ। এই দু দিন সে হরর গলা থেকে নখ-ওলা ডান থাবাটা এক লহমার জন্যও দূরে রাখে নি। কাজ শেষ হলে হরকে বললো বাঘ, “যা, ঘরে ফিরে যা। যদিও বেশ একটু খিদে-খিদে পাচ্ছে, তবু বাস্তুশাস্ত্রে লিখেছে গৃহপ্রবেশের দিন মানুষ খেতে নেই, তাই তোকে খাবো না।”
অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের স্পিডে দৌড়ে মিস্ত্রিদের নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো হর।
বাঘ বেরোলো শিকারে।
মস্ত একটা হরিণ মেরে নিয়ে এলো বাঘ। এবারে নিজের ঘরে বসে জম্পেশ করে খাবে আর তারপর আধ খাওয়া হরিণটাকে ঘরের ভিতরে রেখে দরজায় তালা দিয়ে দেবে। শকুন বাছারা এখন থেকে আঙ্গুল চুষবে শুধু!
শিকার নিয়ে এসে বাঘ দেখে ঘরের দরজায় মস্ত একটা তালা ঝুলছে। পাশের গাছে এক তরুণ সখী-সখী মার্কা শকুন গা ফুলিয়ে বসে। তার ঠোঁটে একটা চাবি।
বাঘের হাসি পেলো। ওই সব তালা বন্ধ করে ভেবেছে বাঘকে রুখবে! তালা ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিলো বাঘ।
হুড়মুড় করে সারা বাড়িটা ভেঙে পড়লো।
বাড়ি ভাঙার আওয়াজে আশেপাশে যত শকুন ছিলো সব এক জায়গায় জড়ো হয়ে ডানা ঝাপটিয়ে ডানা-তালি দিতে লাগলো। সে কি আওয়াজ! পুরো দু’ মিনিট ডানা-তালি দিলো শকুনেরা। আওয়াজ থামলে সখী-সখী-শকুন মুখ থেকে চাবিটা ফেলে দিয়ে খ্যানখ্যানে গলায় খুব সহানুভূতির সাথে বাঘকে বললো, “হর প্রোমোটার, তাই না? ও তো সিমেন্ট দেয় না!”
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। যদি হর প্রোমোটারকে ফের পাকড়াও করা যায় সেই আশায় মানুষদের বসতির দিকে আবার রওনা দিলো বাঘ। কোনো লাভ হলো না। পাড়ার কুকুরেরা বাঘকে জানালো যে হর প্রোমোটার নাকি বোম্বে বলে অনেক দূরের একটা শহরে চলে গেছে আর যাবার আগে গ্রামের সবাইকে জানিয়ে গেছে যে পশ্চিমবঙ্গে কিডন্যাপিং এত বেড়ে গেছে যে এখানে আর কোনো সৎ লোকের পক্ষে ব্যবসা করে টিঁকে থাকা সম্ভব নয়।
হতাশ হয়ে আবার জঙ্গলে ফিরে আসছিলো বাঘ। হঠাৎ করিম মিঞার বাড়ির পিছন দিয়ে যেতে যেতে ওর মাথায় আরও একটা আইডিয়া এলো। করিম মিঞার মুরগির ব্যবসা। শেয়ালের হাত থেকে মুরগি বাঁচানোর জন্য মুরগিগুলোকে সে খুব শক্ত কিছু খাঁচার মধ্যে আটকে রাখে।
মুরগির খাঁচাতে কাজ চলবে না। তবে আরো বড় খাঁচা পেলে? দেখা যাক আব্দুলের সেই খাঁচাটার কি অবস্থা!
জীবজন্তু ধরবার ব্যবসা ছিলো আব্দুলের। ধরে দেশবিদেশের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় আব্দুল চালান দিতো তাদের। বাঘকে ধরবার জন্যও একটা বড় খাঁচা বানিয়েছিলো আব্দুল। বাঘকে বন্দি করা অবশ্য আর হয়ে ওঠে নি আব্দুলের, বরং বাঘই শনিবারের এক বারবেলায় পেটে পুরেছিলো আব্দুলকে। আব্দুলের মাংসের সেই স্বাদ আজও জিভে লেগে রয়েছে।
আব্দুলের বাড়ি আরও দুটো গ্রাম ছাড়িয়ে, অন্য একটা জঙ্গলের ধারে। দেখা যাক বাঘকে ধরার সেই খাঁচাটা এখনো আছে কিনা।
আছে। একটু মরচে ধরেছে খাঁচার তার আর শিকগুলোতে, তবে ওটা কিছু নয়। এ’ রকম একটা বড় খাঁচা তুলে নিয়ে যেতে পারলেই ঘরের অভাবটা আপাতত মিটে যাবে বাঘের। খাঁচার উপরের ছাতটাকে অবশ্য খাঁচার ভিতর দিক থেকে হোগলা পাতা বা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে শকুনেরা যাতে উপর থেকে কোনো কুকম্ম করে সমস্যা তৈরী করতে না পারে। তবে সেসব পরে করলেও চলবে।
বহু কষ্টে ঘাড়ের উপরে ফেলে সেই বিশাল বড় খাঁচাটাকে জঙ্গলে নিজের ডেরায় নিয়ে এলো বাঘ। তারপর আবার শিকারে বেরোলো। মোটাসোটা একটা হরিণ মেরে বাঘ সেটাকে খাঁচার মধ্যে রাখতে ঢুকলো। অমনি একটা গাঁট্টাগোঁট্টা জোয়ান শকুন এরোপ্লেনের স্পিডে ধাঁ করে গাছের থেকে নেমে এসে খাঁচার দরজাটা বাইরে থেকে আটকে দিলো। অর্থাৎ বাঘমশাই এখন শকুনদের হাতে বন্দি।
গাঁট্টাগোঁট্টা শকুন এবার দরজার সামনে এগিয়ে এলো। বাঘের মনে হলো ওই হলো শকুনদের সর্দার।
গম্ভীর গলায় বাঘ বললো, “দরজাটা খুলে দে শিগগির। নইলে ...”
-- নইলে কি?
বাঘ চুপ করে রইলো।
সর্দার শকুন মুচকি হেসে বললো, “মাথা গরম করে কি তোর কোনো লাভ হবে? বরং আমরা যা বলছি তাই কর!”
বাঘ বললো, “কি করতে হবে?”
সর্দার শকুন বললো, “আমাদের পেট ভরে খেতে দিতে হবে। সবাইকে, সারাজীবন ...”
বাঘ রেগে বললো, “ইয়ার্কি পেয়েছিস? তোদের গুষ্টির পিণ্ডি জোগাবো আমি?”
সর্দার শকুন ফোঁৎ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “তবে আর আমার কিছু করার নেই। যা খারাপ দিনকাল, ভাবলাম আমাদের সারা জীবনের মতো পেট-পুরে খাওয়ার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলো, তা তুই গোঁয়ার্তুমি করে সেটা হতে দিবি না। ঠিক আছে, আমরা অপেক্ষা করি তাহলে, তুই মরলে তোকে খেয়ে পেটটা যদি একটু অন্তত ভরে ...”
বাঘকে খাওয়া ...
বাঘই তো সবাইকে এতদিন খেয়ে এসেছে। বাঘের চেতনা হলো এবার।
ভ্যাবলার মতো মুখ করে বাঘ সর্দার-শকুনকে বললো, “ঠিক আছে, সারাজীবই তোদের সবাইকে ভরপেট খেতে দেবো।”
***
সর্দার শকুন কাঁচা লোক নয়। খাঁচা থেকে ছাড়ার আগে বাঘকে দিয়ে সে রীতিমতন এগ্রিমেন্টে সই করিয়ে সেই এগ্রিমেন্ট জঙ্গলের আদালতে নোটিফাই করিয়ে নিয়েছে। শকুনদের উকিল হয়ে এই কাজটা করে দিয়েছেন চিতার শ্বশুরমশাই স্বয়ং। গোবদা জোয়ান ছয় ছেলেকে বডিগার্ড রেখে, বাঘকে কথায় বার্তায় তিনি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন যে একবার চুক্তিভঙ্গ করলেই বাঘকে তিনি সারাজীবন জেলের ঘানি টানানোর ব্যবস্থা করবেন।
সে দিনের পর থেকে তাই রোজ তিনবেলা শকুনদের খাবার জোগাচ্ছে বাঘ।
বাঘের পক্ষে আরো মুশকিল হয়েছে এই যে শকুনেরা দিনে দিনে সংখ্যায় বাড়ছে। বাঘ ফ্রি-তে খাবার দিচ্ছে শুনে সারা পৃথিবীতে যত শকুন আছে সব এসে বাঘমশাইয়ের ডেরার কাছে বাসা বাঁধছে। ফলে বাঘকে এখন ঘন্টায় ঘন্টায় শিকারে বেরোতে হচ্ছে। এ’সব কারণে বাধ্য হয়ে বাঘমশাই ইদানিং সহজ-শিকার মানুষের দিকে একটু বেশি ঝুঁকেছেন।
এই সময় তাই খবরদার সুন্দরবনে বেড়াতে-টেড়াতে যেও না!
(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)