Subscribe to Magazines






পরবাসে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যর লেখা :

বই


ISSN 1563-8685




প্রিয়জাহ্নবী

প্রেম আর নেশায় একটা মিল হল, যখন প্রথম ধরে তখন টের পাওয়া যায় না যে ধরছে। টের যখন পাওয়া যায় তদ্দিনে অস্তিত্বের একেবারে গভীরে তার শেকড় ছড়িয়েছে। তার থেকে আর ছাড়ান নেই। তা গঙ্গার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও সেইরকম। যে-কোনো গঙ্গা নয়। নৈহাটির গঙ্গা। আজ সেই গল্প বলি।

ভারী গুরুগম্ভীর জীবন আমাদের। সমাজঠকুরের আইনকানুন মেনে চরিত্রের শরীরে ধোয়া তুলসিপাতার মুখোশটিকে জড়িয়ে তবেই পথে বেরনো চলে, তা অন্দরমহলে সে যা-ই চলুক না কেন। তাই, একটু অসোয়াস্তি হয় বইকি। বিধি বহির্ভূত প্রেমকথা কি না!

তবে তারপর নিজেকে সাহস দিলাম এই বলে যে রসশাস্ত্রটাও পণ্ডিতদের নজরে নেহাত খারাপ কিছু তো আর নয়! অতিবড়ো পণ্ডিতের কেতাবের বর্ম ভেঙে কোনো নয়নবান যে তাঁর হৃদ্‌কমলে ধুম লাগায়নি কখনো এ-কথা তিনি কখনো জাঁক করে বললেও সে মিছেকথা তন-মন-ধনের মালকিনটির শ্রবণের আড়ালেই বলে থাকেন।

সে যাই হোক। আসল কথায় আসি। তার সঙ্গে প্রথম দেখা যখন, তখন তার এই নায়কের বয়েস সাড়ে চার। মাথায় মানসিকের জটা নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে চলেছি তারকেশ্বরের দিকে। যাবার আগে ভালোদিদি বলল, "ভাই দেখিস গঙ্গা পেরিয়ে রেলগাড়ি যাবে।" অতএব রেলের গাড়ি চেপেই আমার প্রবল কৌতূহল, নদী বেয়ে গাড়ি যাবে কখন?

তখনও আমি কোনো নদী দেখিনি জীবনে। মা বলেছিল, সে নাকি জল দিয়ে তৈরি রাস্তার মতন। তা মিনিটদশেক গাড়ি চলবার পর গাড়ি গিয়ে উঠল জুবিলি ব্রিজে। তখন শীতের কুয়াশামোড়া শহরের ঘুম ভাঙাচ্ছে প্রথম রোদ। বিস্তীর্ণ জলরাশির বুকে ভাসমান নৌকাগুলি তার আলোকপ্রসাদ পায়নি তখনো। জলে বেয়ে ওঠা কুয়াশার স্তম্ভগুলোয় সোনালী রঙ ধরছিল। তাদের বুকে নিয়ে, দুপাশের ঘুমন্ত নগরীদের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে বয়ে চলেছে গৈরিকতনু স্বর্গসরসী।

জানালার শিকে গাল চেপে ধরা অপাপবিদ্ধ বালকের হৃদয়ে প্রশান্তযৌবনা নিদ্রালসা রূপসীর সেই আসা। ভালোবাসা কাকে বলে জানতাম না। একটা দম বন্ধ করা অনুভূতি হয়েছিল মনে আছে। একপলকের জন্য মনে হয়েছিল, আমি ওই প্রসারে ডুব দিতে চাই।

তারপর ঝঞ্ঝা এল। ছ-বছরে পা দিইনি তখনও। স্কুল থেকে পড়সি ডেকে নিয়ে গিয়ে দেখাল, উঠোনে বাবার মৃতদেহ শুয়ে আছে।

আবার ফিরে গিয়েছিলাম গঙ্গার কাছে। সেদিন রাত্রে। মুক্তারপুর শ্মশানে। প্রিয়জনের আড়াল থেকে বালকটি দেখেছিল মানুষের শরীর পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া। তারপর, শীতের অন্ধকার রাত্রে নাভিমূলের পাত্র হাতে নেমে গিয়েছিলাম তার বুকে। শৈশব ও পিতার দেহাবশেষ, এই দুটিকেই সর্বনাশীর কোলে বিসর্জন দিয়ে সেই প্রথম আমার, তার অঙ্গস্পর্শের রাত। এমনি করেই সুখেদু:খে তার সঙ্গে আমার আলাপ পর্বের সূচনা। কখনো ঈশ্বরী ভাবিনি তাকে। কখনো মোহিনী, কখনো বাপখাগি রাক্ষসী এমন নানান রূপে তাকে দেখতে দেখতে কখন নিজের অজান্তেই বড়ো হয়ে যাচ্ছিলাম টের পাইনি।

সেই বড়ো হয়ে উঠতে থাকবার দিনগুলোতে মোহিনী ফের মায়াজাল ছড়াল। এইবারে তার সেই ষড়যন্ত্রে অংশীদার কখনো মা, কখনো ঠাকুমা কখনো বড়ো জামাইবাবু।

ঠাকুমার কথাই বলি গোড়ায়। অ্যাতোটুকু টুলটুলে বুড়ি। ফর্সা যেন চিনেমাটির পুতুল। তার গোরা অঙ্গে সাদা থান মানাত ভালো। কখনো নববর্ষে কিংবা গ্রাম বাংলার হাজারো তিহার পরবে অথবা নেহাতই এমনি এমনি কখনো ভোরবেলা উঠে তিনি চলবেন গঙ্গা নাইতে। সঙ্গে যাবে কে? কেন, বংশের দীপ নাতি আছে যে!

তারপর প্রথম রোদ ছোঁয়া নদীর জলে শান্ত অবগাহন। মৃদুগামী সুস্বাদ স্রোতে নিজেকে ডুবিয়ে দেবার আনন্দের মধ্যেও উচ্ছ্বাস দেখাবার জো নেই। গুরুজনের শাসন আছে কড়া। তোমার ভালোলাগার উচ্ছ্বাসে ছিটকে ওঠা পায়ের জল আর কারো গায়ে লাগবে কেন?

তারপর পাড়ে উঠে কলসিতে কলুষনাশিনীর জল বয়ে নিয়ে পথ চলা। নদী চলল সঙ্গে। কখনো ঠাকুমার কাঁখে তো কখনো নাতির কোলটিতে চড়ে।

শহর জুড়ে মানুষের পাশাপাশি হরেক দেবদেবীর বাসা। ব্রহ্মময়ী, মহাকালী, বুড়োশিব, পঞ্চানন। তাঁদের মন্দিরে, গাছতলার আস্তানায় সেই জল খানিক খানিক বিলোতে বিলোতে অবশেষে বাড়ির পাশে এসে অশ্বত্থতলায় শেকড়ের চাপে স্থানচ্যূত হওয়া ছোট্ট দেউলের দেবতার শরীরে অবশিষ্ট জলটুকু ঢেলে বাড়ি ফেরা। তখন ঠাকুমার মাথার ভেজা গামছা শুকিয়ে কাঠ। আমার পায়ে হাঁটু অবধি তীর্থরেণু।

তবে হ্যাঁ উচ্ছ্বাসের দাপাদাপির সুযোগটা পেতাম বড়ো জামাইবাবুর সঙ্গে। বড়দির বিয়ে হল শাস্ত্রীপাড়ায়। রেলপাড় থেকে ব্রিজ উজিয়ে দিদির বাড়িতে থাকতে এলেই দুপুরবেলা জামাইবাবুর সঙ্গ ধরা, গঙ্গায় স্নানে যাব।

এলএমসি মাঠের ও-দিকটার বাঁধনহীন আঘাটায় নেমে জামাইবাবু গম্ভীর হয়ে শিবহেন দাঁড়িয়ে আছেন বুক জলে। আর তাঁকে ঘিরে ঘিরে জলের সঙ্গে ঘন্টাভর অফুরান খেলা। নদী সব বুঝত। স্রোতের গতি কমিয়ে আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিত। আমার কানে কলকলিয়ে কথা বলত। সে কূজনের অর্থ নেই, মিষ্টত্ব আছে--মানে যেমনটা হয়ে থাকে আরকি।

তবে সে-সবই তো গুরুজনের হাত ধরে নদীর কাছে যাওয়া। সে যাওয়াতে আনন্দ আছে, কিন্তু প্রাইভেসির খানিক অভাব। প্রিয়সান্নিধ্যে কে-ই বা আর গার্জেন নিয়ে যেতে চায়!

তা সে সমস্যার আংশিক সমাধানও বের করে নিয়েছিলাম নিজেনিজেই। আমার ইশকুল তখন গঙ্গাপাড়ে। বয়েজ ইশকুল। দুরন্ত কিশোরকালের টিফিনবেলায় স্কুলের বেড়া পেরিয়ে একছুটে গঙ্গার ঘাট। বাঁশি বাজিয়ে লঞ্চ যায়, আসে। জোয়ারে জল বাড়ে, ভাঁটায় নেমে যায়। কাদা মাখা ছেলেরা কত সুখে ঝাঁপ দেয় লঞ্চে চেপে মাঝগঙ্গায় গিয়ে! আমি তখন সাবধানে বসে থাকি পাড়ে। হিংসেয় জ্বলেপুড়ে যাই তাদের নদীর সঙ্গে এহেন ভালোবাসার মাখামাখি দেখে। আমার পরনে বিদ্যার্থীর নিষ্কলঙ্ক সাদা জামা, সাদা প্যান্ট। তাতে কাদার ছিটে লাগিয়ে টিফিনের পর ক্লাশে ফিরলে দোর্দণ্ড হেডস্যারের ডোরাকাটা কথা বলা বেত মনে করিয়ে দেবে, ও কলঙ্ক আমার জন্যে নয়।

তারপর, দেখতে দেখতে স্কুল ফাইনালের গণ্ডি পেরোলাম। গঙ্গা পেরিয়ে চুঁচুড়ার নামকরা প্রাচীন ইশকুল। এইবার সেখানে বিদ্যার্জনের পালা।

আহা ছোটোবেলার সেই বড়ো লোভের চোখে তাকিয়ে দেখা টিফিনবেলার লঞ্চ! এইবার তার ভেতরে চেপে দু’বেলা গঙ্গা পারাপার! সে যে কী ভীষণ মুক্তির আনন্দ, তা কাকে বোঝাই!

অতএব ফের জড়িয়ে এল নদীর ভালোবাসা। নতুন পথে। লঞ্চের জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আঙুলের ডগায় ছুটন্ত জলের শিরশিরে ছোঁয়া! সেই স্পর্শসুখ নিতে নিতেই আবার বিনোদিনী গার্লসে পড়তে যাওয়া নৈহাটির কোনো ফ্রক পরা কন্যের দিকে আড়ে আড়ে দৃষ্টি দেয়া--আমি কেমন বীর! তুই পারিস? নীচ থেকে তাই দেখে ছুটন্ত গঙ্গা খলখল হাসে ঢেউ তুলে। হিংসেও নেই কোনো। যেটুকু ভালোবাসা দিলে দিলে, তাই নিয়েই খুশি। সুখ দেবে তার চতুর্গুন। ফ্রি। আনকন্ডিশনাল।

সেই ভালোবাসা পেতে পেতেই কখন যেন কিশোরটি পুরুষ হয়ে উঠছিল। নিরাপত্তার গণ্ডি ছেড়ে দুঃসাহসে ভর করে তার নদীর কাছে যাবার পালা শুরু হয়েছে তখন। কখনো উদ্দাম বৃষ্টির প্রাক-মধ্যাহ্নে লঞ্চের নিরাপত্তা ছেড়ে বইখাতা বগলে চেপে বসি দাঁড়টানা নৌকোয়। ধূসর, অস্বচ্ছ বৃষ্টির চাদর ঢাকা নদীর ছুটন্ত জলের বুকে ছাতা মাথায় বসে থাকি অনেক মানুষের মধ্যে একলা। গলুইতে জলের ছলাৎ ছলাৎ, দাঁড়ের কট কট, হুমহুমে হাওয়া আর বৃষ্টির একটানা মৃদু ডাক মিলে এক অলীক বাস্তবের পটভূমি রচে দেয় নদী আমার জন্য।

ক্বচিৎ দেখা হয়ে যায় তার বুকে জাল টেনে তুলতে থাকা মেছুড়েদের সঙ্গে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে হঠাৎ কখনো তাদের তুলে আনা জালে খেলে যায় রুপোলি বিদ্যুৎ। জলের নিশ্চিন্ত আবাস ছেড়ে মৃত্যুর হাওয়ায় ভেসে ওঠা ইলিশ মা এক চকিত ঝলক দিয়েই স্থির হয়ে যায় নৌকাগর্ভে তার শেষ শয্যাটির বুকে।

এইসব দিনগুলোতে ঠিক সময়ে ইশকুলে আর পৌঁছোনো হত না আমার। স্রোতের টানে কখনো চুঁচুড়ার ঘাটের বদলে গিয়ে নৌকো লাগত ষণ্ডেশ্বরতলার ঘাটে, কখনো বা বয়ে যেতাম সেই চন্দননগরে। ঠিক সময়ে ক্লাশে পৌঁছোনো হত না। তখন, ইশকুলের কাছাকাছি এসে অঙ্কের ডেঞ্জারাস মাস্টার এবং ডিসিপ্লিনারিয়ান নিমাই কুণ্ডুর নজরে পড়বার ভয়ে টুক করে ঢুকে যাই মহসিন কলেজের সামনের গলিটাতে। সেখানে একটা নীচুমত ঘাটে গিয়ে জলে পা ডুবিয়ে বসে বসে টিফিনটাইম তক কাটিয়ে তারপর ছেলেদের ভিড়ের আড়াল নিয়ে ইশকুলে ঢুকে আসা।

তারপর, ক্লাশের ক্যালকুলাস আর সমারসেট মম-এর জ্ঞানগর্ভ পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে চোখের সামনে বয়ে যেত খানিক আগে কাটিয়ে আসা নদীর ছবি। কখনো তার ধূসর শরীরে ভেসে চলেছি একটি কাষ্ঠখণ্ডের ভরসায়, কখনো বা নির্জন ঘাটে তার বৃষ্টিহানা জল এসে আমার পা ছুঁয়ে চলেছে তখন। বৃষ্টি হয়ত শেষ, কিন্তু তবু ঘাটের ওপরে ছাতা ধরে থাকা অশ্বত্থ, রুদ্রপলাশ, অর্জুনের দল তখনও কবোষ্ণ জলের ফোঁটায় ভিজিয়ে দিয়ে চলে আমাদের।

এই স্কুলের ক্লাশরুমে বসেই গঙ্গার আরেকটি ভয়ঙ্করী রূপ দেখতে বড়ো ভালো লাগত। জানালার নীচের ঘাট। তার কাছ দিয়ে মাঝিরা নৌকো বেয়ে যায়। ক্লাশের জানালা দিয়েই গলা উঁচিয়ে তাদের খানিক ক্ষেপিয়ে দিলে তারা চিল্লিয়ে গাল পাড়ে। সে আমাদের দারুণ আমোদের বিষয় হত।

তবে এক একদিন দেখতাম আমাদের সেই খোঁচাখুঁচিতে মোটে কান নেই তাদের। তাড়াহুড়ো করে নৌকো পাড়ে বেঁধে ফেলতেই ব্যস্ত। ঘাট থেকে পাড়ে উঠে আসছেন স্নান করতে আসা মানুষজনও।

তারপর দূর থেকে অদ্ভুত একটা ছরছর, গোঁ গোঁ শব্দ ভেসে আসত। ক্লাসরুমের নিরাপদ দূরত্ব থেকে চোখ মেলে দেখতাম, গৈরিকা সুন্দরী রুষ্টা হয়েছেন। করাগেটেড টিনের মত ভাঁজে ভাঁজে ফুলে ওঠা জলস্তর তার স্রোতের বিরুদ্ধে উঁচু হয়ে উত্তরমুখে ছুটে চলেছে মহারঙ্গে।

তীব্র উত্তেজনা হত ভেতরে ওই দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে। যাকে ভালোবাসি সেই চেতনার সূচনা থেকে, যার কাছে আসি, যার বুকে ভাসি, যার অন্দরে আমার অবগাহনের হাজারো স্মৃতি, সেই শান্ত, মন্দগামিনী, মৃদুভাষিণীর এমন রূদ্ররূপ ভয় যত না দেখায়, টান বাড়িয়ে দেয় তার শতগুণ।

শনিবারের দুপুরে হাফছুটির পর একটা নিষিদ্ধ মজার ব্যাপার ছিল। নদীর পাড়ে দুই পার্ক। প্রেমনগর আর রূপনগর। রূপনগর পার্ক হল গিয়ে আবার জেলার ‘ভুক্তিপতির আবাস’-এর গা ঘেঁষে। ভুক্তিপতির ইংরিজি ঠিক জানি না, তবে বড়োসড়ো সরকারি কেউকেটা তো বটেই। কারণ পাঁচিলঘেরা সে বাড়ির ভেতরে ফুটবল খেলা যায় এতটা জায়গা, আর স্বপ্নের প্রাসাদ টাইপের একটা সাহেবি প্যাটার্নের বাড়ি ছিল।

তা শনিবার বিকেলবেলা এই রূপনগর পার্কের কোণে এসে জড়ো হওয়াটা আমাদের অবশ্যকর্তব্য ছিল। কারণ এইখানে তাঁর দেখা মিলবে সেদিন। তিনি ভুক্তিপতির বাড়ির কন্যে, গঙ্গার সখী। খেলোয়াড়দের মত চেহারা। আর তেমনই সুন্দরী।

বিকেল তিনটে বাজতে না বাজতে আমাদের কুতূহল তুঙ্গে। সময় হয়েছে। এবং নিরাশ হতাম না কখনই। একেবারে ঘড়ির কাঁটা মেনেই সাড়ে তিনটে নাগাদ তাঁর আগমন। সঙ্গে সহকারীরা একটি রবারের ডিঙি নিয়ে চলেছেন জলের দিকে। খানিক বাদে আউটবোর্ড মোটরের গোঁ গোঁ শব্দ ও তার পরেই সেই প্রিয় দৃশ্য... উজানে বা ভাঁটায়, পনিটেল হাওয়ায় ভাসিয়ে ভুক্তিপতির বাড়ির কন্যা চলেছেন নদীর সঙ্গে জলবিহারে।

বলাবাহুল্য মাঝেমধ্যেই স্বপ্নে উদিতা হতেন তিনি। তখন আমি ও সেই যুবতী একটি রবারের ডিঙিতে চেপে ভেসে চলতাম প্রশস্ত গঙ্গার বুকে। আমাদের ঘিরে তার দুটি পাড় সরে সরে যেত। সূর্য ডুবত। আকাশে তারা ফুটত। নদীর জল, দৃশ্যরূপ ছেড়ে শুধুই শব্দ হয়ে যেত তারপর... আমার চেতনাকে ঘিরে ছেদহীন, ইমার্সিভ এক কলধ্বনি।

দৃশ্যগুলো আর দেখি না, কিন্তু মাঝেমাঝে ওই শব্দটা আজও আমাকে জ্বালায়। বড্ডো জ্বালায়। সিনহা এখন বিলেতে বেজায় বড়ো বৈজ্ঞানিক। চক্কোত্তি গবমেন্টের আমলা। চাঁদ নার্সিং হোম চালায় এখন। দেব নাম করা কলেজের আরো নাম করা মাস্টার। আচ্ছা হ্যাঁ রে, তোদের সেই রূপনগর পার্কের কোণটিতে বসে ভুক্তিপতির বাড়ির কন্যের নদী বেয়ে চুল উড়িয়ে ভেসে যাওয়ার কথা মনে পড়ে? নাকি আমি একাই সে-সব স্মৃতিকে মাথায় বয়ে নিয়ে চলেছি?

কলেজিয়েট স্কুল ছেড়ে কলেজের পথে রওনা হলাম যখন, একটা মনখারাপ কাজ করছিল আমার মধ্যে। দু’বছরের এই গভীর ভালোবাসাবাসিকে ছেড়ে এইভাবে চলে যাওয়া। কার ভালো লাগে? তখন প্রথম প্রথম কিছুদিন ফাঁক পেলেই তার কাছে এসে বসে থাকতাম। ফেরিঘাট, কাঁঠালপাড়া ঘাট, লোহাঘাট, আড্ডা ছিল সব জায়গায়।

আস্তে আস্তে সেইসব আড্ডায় নদী সরে যাচ্ছিল পশ্চাৎপটে। আলোচনা ভেসে চলত নতুন দিনের কবিতা, বিপ্লব ও সহপাঠিনীদের নিয়ে। নদীটি থাকত আড়ালে, এক তালে স্বরজে-পঞ্চমে সুর ধরে রাখা তানপুরাটির মত। যতক্ষণ থাকে, তার মূল্য বোঝা যায় না। যখন থেমে যায় তখন ফাঁকা ঠেকে। কী যেন নেই বলে বোধ হয়। কোথাও তাল কেটে যায় যেন।

তারপর একসময় সেই তালটাও গেল কেটে। চাকরি নিয়ে চলে গেলাম মহানন্দার পাড়ে। নতুন জীবন, কাজ, পড়াশোনা, প্রেম-ভালোবাসার উদ্দাম স্রোতে গঙ্গা হারিয়ে গেল আমার কাছ থেকে। জীবন তখন বাঘের মত লাফিয়ে পড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে আমাকে। কাজের সূত্রে যাতায়াতের পথে মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে দেখা হয়। মনে মনে একটিদুটি কথা, খানিক প্রিয় সম্ভাষণ। তারপর যার যার পথে চলে যাওয়া। সে রইল তার নতুন আশিকদের নিয়ে। আমি চললাম আমার পথে আমার জীবন বেয়ে।

এর অনেক কাল বাদে, একবার হরিদ্বারের গঙ্গায় গিয়ে একবার তাকে মনে পড়েছিল। মানে, আমার নৈহাটির গঙ্গাকে। একটা মুহূর্তের ঝলকে সবগুলো স্মৃতি উঠে এসে মোচড় লাগিয়েছিল বুকে।

সেদিন ব্রহ্মকুণ্ডে গিয়ে সন্ধেবেলা প্রদীপ ভাসিয়েছি। পূর্বপুরুষের আত্মার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায়, তাঁদের স্মৃতিতে পত্রপুটে ভরা একরত্তি আলো।

জলে দুলে দুলে প্রদীপ চলেছে ভাঁটার দিকে। চেয়ে চেয়ে তাই দেখছি এমন সময় কচি গলায় কে যেন বল, “মাম্মি ইয়ে দিয়া কেয়া বগয়র বুঝকে সমন্দর তক এইসে হি চলতি যায়েগি?”

জবাবে মৃদুকন্ঠের সেই অমোঘ মানুষ ভোলানো উত্তর, “হাঁ বেটা। গঙ্গা মাইয়া ইসকো লেকে সমন্দরকে পাস জরুর পহুঁচা দেগি। আপকে পিতাজিকে পাস...”

হয়ত পিতৃহীন শিশুটির বাবা সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিলেন অকালে। কে জানে। কিন্তু আলাপচারিটা হঠাৎ করেই বুকের ভেতরে প্রবল শক্তিতে বন্ধ করে রাখা একটা দরজা খুলে দিয়ে গেল আমার। আমার ঝাপসা চোখের সামনে তখন ফের সেই ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারির এক রাত্রের গঙ্গা। তার বুকে মৃত পিতার নাভিমূল ভাসিয়ে দেয় এক অবোধ বালক।

দূরে জলের বুকে আমার প্রদীপটি তখনো নিভু নিভু দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে আমার বাল্যসহচরীকে অস্ফুটে অনুরোধ করেছিলাম ব্রহ্মকুণ্ডে দাঁড়িয়ে, “যদি কখনো আমায় ভালোবেসে থাক, যদি আমি তোমায় ভালোবেসে থাকি, তাহলে ও-প্রদীপকে তুমি ভাসিয়ে নিয়ে যেও, সহস্র নগর পার করে আমার প্রিয় শহরের কূল বেয়ে, তার দক্ষিণের সেই ঘাটটির বুক ছুঁয়ে, যেখানে একদিন তোমার বুকে শৈশবকে চিরতরে ভাসিয়ে দিয়ে জীবনের পথে এসে দাঁড়িয়েছিল এক বালক।”

আমার গঙ্গা আমার সে-কথা রেখেছিল কি না জানি না। তবে ভাবতে ভালো লাগে, হয়ত সে কথা রেখেছিল। হয়ত সেই প্রদীপ ভেসে গিয়েছিল লোহাঘাট, ফেরিঘাট, কাঁঠালপাড়া ঘাট হয়ে মুক্তারপুরের শ্মশানের কোল ছুঁয়ে, সমুদ্রের পথে। হয়ত...





(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)