Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে দিবাকর ভট্টাচার্যের
আরো লেখা




ISSN 1563-8685




অকল্পিত

ঢং ঢং করে দেওয়াল ঘড়িটায় সাতটা বাজলো। অর্থাৎ সন্ধে সাতটা। শ্রীপতি রায় তার বৈঠকখানার ঘরে ঢুকলেন। এসে বসলেন তার প্রকাণ্ড হেলানো কাঠের চেয়ারটিতে। সামনে পাতা বিরাট সাদা ফরাসটিতে আগে থেকেই বসে ছিলেন যারা তারা উঠে দাঁড়ালেন। শ্রীপতি হাতের ইশারায় তাদের বসতে বললেন। তারপর সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বললেন — "অনাথ আসেনি?" কেউ কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই দূরে কোথাও যেন বাজ পড়লো। শ্রীপতি বললেন — "আজকের আবহাওয়াটা দারুণ।"

এইভাবেই শুরু হয় প্রতি শনিবারের সন্ধেটা। রায়বাহাদুর শ্রীমন্তকুমার রায়ের দৌহিত্র শ্রীপতি রায়ের পূর্বপুরুষের করা এই বিরাট পুরোনো বাড়ির বসার ঘরে। শ্রীপতি পেশায় আইনজীবী। সপ্তাহের শনি রবি এই দুটো দিন নিজেকে নিজের পেশার বাইরে রাখেন। তখন তার বসার ঘরে এসে জড়ো হয় নানান ধরনের লোকজন। শুরু হয় গল্প আড্ডা । রকমারি কথা। সেখানে কখনোই কোনো মামলা মোকদ্দমার কথার স্থান নেই।

এর মধ্যে শনিবারটা আবার বিশেষভাবে আলাদা। সেদিন শ্রীপতি রায়ের কয়েকজন পছন্দের মানুষ কেবল আসতে পারেন। যেমন মন্মথ দে — অবসরপ্রাপ্ত স্কুলমাস্টার। দ্বিজেন সেন — ছবি আঁকেন ছবি তোলেন । হীরালাল গুপ্ত — গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেতা।

আর আছেন অনাথবন্ধু মিত্র। তিনি যে কি করেন তা কেউই জানে না। মনে হয় কিছুই করেন না। কিন্তু কথায় মানুষকে মুগ্ধ করে দিতে পারেন। বিশেষত গল্পে। নানান ধরনের গল্পের যেন এক অফুরন্ত ভাণ্ডার। আর ওনার বলার ভঙ্গিটা এমন যেন মনে হয় সব কিছু চোখের সামনে ঘটছে। আর প্রতিটি গল্পের শেষে উনি নিজেকে সেই গল্পের মধ্যে এমনভাবে জড়িয়ে দেন যে তারিফ না করে পারা যায় না। এইজন্যই লিখলে হয়তো নাম করতেন। কিন্তু সে দিকে না গিয়ে রীতিমতো অর্থাভাবে দিন কাটান।

মন্মথ, দ্বিজেন আর হীরালালের কাছে তিনি চাপা উপহাস আর তাচ্ছিল্যের মানুষ। কিন্তু শ্রীপতি রায় তার মর্জিমতো কখনোসখনো অনাথবন্ধুর হাতে গুঁজে দেন কিছু টাকাকড়ি। বিশেষত গল্পটা তাকে খুশি করতে পারলে এটা প্রায় নিশ্চিত।

আষাঢ়ের শুরু। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিলো। মাঝে মাঝে উঠছিলো দমকা হাওয়া। শ্রীপতি রায় বললেন —"আজকে আবহাওয়াটা দারুণ। জম্পেশ গল্পের জন্যে আইডিয়াল। আর আজকের দিনেই অনাথ এলো না।"

মন্মথ বললেন — "এমন কিছু ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে না যে আসা যায় না।"

দ্বিজেন বললেন — "বিরাট কিছু দূর থেকে আসতে হয় তা তো নয়।"

হীরালাল বললেন — "অন্য শনিবার গুলোয় সবার আগে এসে বসে থাকে।"

"আজও তাই এসেছিলাম," — বলতে বলতে ভিজে ছাতাটা গুটিয়ে ঘরে ঢুকলেন অনাথবন্ধু। ঝড়বৃষ্টি হতে পারে বুঝে একটা ছাতা চেয়ে আনলাম ভাইপোর দোকান থেকে।"

শ্রীপতি বললেন — "বোসো। বোসো। ভিজে যাও নি তো?"

অনাথবন্ধু একগাল হেসে বললেন — "না রায়মশাই! ছাতাটা বেশ নির্ভরযোগ্য।"

শ্রীপতি বললেন — "তাহলে এবারে তোমার একটা গল্প শুরু করো।"

হীরালাল মুচকি হেসে বললেন — "তোমার এই ছাতার মতো নির্ভরযোগ্য একটা গল্প।"

দ্বিজেন শূন্যে আঙুল নেড়ে বললেন — "স্টোরিটা পিকটোরিয়াল হলে ইন্টারেস্টিং হয়।"

মন্মথ গম্ভীর গলায় বললেন — "যেন কিছুটা অথেনটিসিটি থাকে।"

শ্রীপতি গড়গড়ার নলটা মুখে নিতে নিতে বললেন — "আরে ও আগে শুরু তো করুক। আর এর মাঝে কেউ ওকে কোনো ভাবেই ইন্টারাপ্ট কোরো না। অনাথ তুমি একটানা বলে যাও দেখি।"

অনাথবন্ধু সবার মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন — "সে বহু কাল আগের কথা। যে সময় মানুষ পাপ করলে ভয় পেতো মাথায় বাজ পড়বে ভেবে আর পুণ্যের জোরে বিশ্বাস করতো আগুনের ভিতর দিয়ে পার হয়ে আসা যায়। আসলে মানুষগুলো ছিলো ভালোমন্দে সহজভাবে বিশ্বাসী।"

শ্রীপতি রূপোর গড়গড়ায় একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন — "হুম।"

মন্মথ দে অনাথবন্ধুর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে মাস্টারিসুলভ গম্ভীর গলায় বললেন — "তা হলে সেই সময় সাধারণত কেউ অন্যায় করতো না।"

দ্বিজেন সেন চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন — "করলে বাজ পড়তো — আর সেই বাজ পড়ার ছবিটাই যেন এই গল্পে দেখতে পাচ্ছি।"

হীরালাল গুপ্ত আবার মুচকি হেসে বললেন — "একটা দারুণ ড্রামাটিক এলিমেন্ট আছে গল্পটার মধ্যে মনে হচ্ছে।"

শ্রীপতি চোখ বন্ধ করে ভুরু কুঁচকে বললেন — "আহ্! ওকে বলতে দাও না।"

অনাথবন্ধু আবার বলতে আরম্ভ করলেন — সেই সময়ে ছিলো এক উঠতি বণিক। যার ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠছিলো। কিন্তু এক বিরাট ঝড়ের ধাক্কায় একই দিনে তার দু-নৌকোভর্তি জিনিস জলে তলিয়ে গেলো। যার দাম ছিলো বিরাট পরিমাণ। ফলে মহাজনদের কাছে বিপুল ধারের অঙ্ক মিটিয়ে দেওয়ার কোনো উপায়ই রইলো না আর তার কাছে। এদিকে আশেপাশে কেউই ছিলো না যে এই বিপুল ধারের দায়িত্ব নিতে পারে। এই অবস্থায় তার বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে গেলো পুরোপুরি। সেই সময়ে তার কানে এলো এক সাধুর কথা। যিনি নাকি ইচ্ছে করলে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। এইভাবে তিনি নাকি অনেকের অবিশ্বাস্য সব উপকার করেছেন।

— "তা আমার কাছে এলে কি কত্তে বাপ? আমায় দেখছো তো ন্যাংটা ভিখিরি মানুষ — আর আমি তোমায় দেবো ওইসব ধনদৌলত! তুমি তো আচ্ছা পাগল হে! ভাগো! ভাগো এখান থেকে--" বললেন সেই সাধুটি।

একথা শুনে লোকটি তো গেলোই না বরং সাধুটির দিকে এগিয়ে গিয়ে তার পাদুটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাঁউমাউ করে বলতে লাগলো — "আমাকে এভাবে তাড়িয়ে দিলে এই পাহাড় থেকেই ঝাঁপিয়ে নিজেকে শেষ করে দিতে হবে আমায় — আপনি যদি তাই চান তো তাই হোক।"

সাধুটি লোকটির হাতদুটো ধরে বললেন — "আরে করো কি করো কি — এভাবে পায়ে পড়ে নাকি কেউ — ওঠো ওঠো — মাথা তুলে উঠে দাঁড়াও বাপ আমার।"

লোকটি আগের মতোই হাঁউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো — "আমি জানি — আপনিই শুধু পারবেন আমায় উদ্ধার করতে।"

সাধুটি এবার নিজে হাতে করে লোকটিকে উঠিয়ে দাঁড় করালেন তার মুখোমুখি। গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন লোকটির মুখের দিকে। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন — "মাথা নীচু করে থাকলে হবে? মুখ তোল। আমার দিকে তাকা।"

লোকটি কাতরভাবে তাকালো তার দিকে।

সাধুবাবা লোকটির চোখে চোখ রেখে বললেন — "এই ধার শোধ দিতে না পারলে কী হবে?

লোকটি কোনো উত্তর না দিয়ে আবার মাথা নীচু করলো।

সাধুবাবা লোকটির পিঠে হাত দিয়ে বললেন — "কী হবে তাহলে বল্।"

"আমার বাঁচার আর কোনো উপায় থাকবে না — আর তখন আমার বুড়ি মা, বৌ, বাচ্চা দুটোর কী দশা হবে সেই দিন কে জানে?" বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো সেই লোকটি।

"বুঝলাম। কিন্তু আমার কাছে কিই বা পাবি বল্। কিই যে দিই তোকে," — আস্তে করে বললেন সেই সাধুবাবা।

"পারছি না — আর পারছিনা এভাবে — আমায় দুদণ্ডের জন্য একটু শান্তি দিতে পারবেন বাবা?" — চোখের জল মুছতে মুছতে বললো সেই বিধ্বস্ত লোকটি।

"ওরে বাবা! শান্তি? আমার সে দেওয়ার ক্ষমতা কোথায়? আমার কাছে কি আছে দেখতে পাচ্ছিস না?"— উত্তর দিলেন সেই সাধুবাবা।

লোকটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সাধুবাবার মুখের দিকে। সাধুবাবা লোকটির ওই ফ্যালফ্যালে চোখের উপর চোখ রেখে কেমন এক অদ্ভুত স্বরে বলে উঠলেন — "যা দেবো তা নিয়ে যেতে পারবি তো?"

লোকটি নিশব্দে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। সাধুবাবা "দেখি কি পাই এখন--" বলে ওই আধো অন্ধকার গুহার ভিতরে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ ডানদিকে ঘুরে সেদিকের দেওয়ালের একটা লম্বা ফাটলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে র‌ইলেন। কয়েক মুহূর্ত সেদিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকার পর এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলেন সেই ফাটলটার দিকে। — "আরে বাচ্চু! আয়! আয়! ভাগ্যিস তোকে দেখতে পেলাম," বলে খপ করে ওই দেওয়ালের ফাটল থেকে কি যেন একটা তুলে নিলেন। তারপর নিজের বসার জায়গায় এসে সামনের পোঁটলা থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করে দেওয়াল থেকে সদ্য তুলে আনা জিনিসটা ওই কাগজের উপর ফেললেন। আর ওই লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন — "নাও বাপ আমার! নিয়ে নাও। আর খুব যত্ন করে নিয়ে যাও। এইই তোমার সব কষ্ট দূর করবে। সব শান্তি এনে দেবে।"

লোকটি সমস্ত ব্যাপারটা এতক্ষণ দূর থেকে লক্ষ্য করছিলো। সাধুটির কথায় খুব আঁতকে উঠে হয়ে তাকালো তার দিকে।

সাধুবাবা গম্ভীর গলায় বললেন — "সময় নষ্ট কোরো না। যাও।"

লোকটি যেন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে দাঁড়ালো সেই কাগজটার সামনে।

"কি হোলো? নিয়ে নাও।" — গম্ভীর গলায় বললেন সেই সাধুবাবা। গুহার ভিতর তার সেই কথাগুলো যেন গমগম করে বাজতে বাজতে ফিরে এলো লোকটির কানে। লোকটি তাকালো ওই কাগজটার দিকে। আর তখনই সমস্ত শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠলো তার। তারপর চোখ বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত যেন পাথরের মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে রইলো সে।

"বুঝতে পারলাম .... এইবার বুঝতে পারলাম .... আমার নতুন করে কিছু করার আর কোনো উপায় নেই .... কোনো রাস্তা নেই নতুন জীবনে ফিরে আসার .... দুদণ্ডের জন্যে শান্তি চেয়েছিলাম একটু আগেই — তাই ইনি আমার জীবনে বরাবরের জন্যে শান্তি আনার বন্দোবস্ত করলেন এইভাবে...." — দুচোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবছিলো সে।

"তবে তাই হোক" — নিজেকেই উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে সে এগিয়ে গেলো ওই কাগজে রাখা জিনিসটার দিকে। তারপর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ওই সাধুটির মুখের দিকে। তারপর কয়েক মুহূর্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে র‌ইলো ওই কাগজের উপরে রাখা জিনিসটার উপর। সেখানে তখন গোল হয়ে পড়েছিলো কাঁচা সোনার রঙের একটা প্রকাণ্ড পাহাড়ি কাঁকড়া বিছে। যার বিরাট দাঁড়াদুটো কারো শরীরে বিঁধলে মরণযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তার পরমায়ু শেষ হ‌ওয়া নিশ্চিত।

বিছেটাকে হাতের মুঠোয় নেওয়ার আগের মুহূর্তে তার চোখে ভেসে উঠলো তার ছোট্ট মেয়েটির মুখটা। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় যাকে খুব বকেছিলো একটা পুতুলের বায়না করার জন্য।

এইবার লোকটি বিছেটার কাছে গিয়ে শান্তভাবে দাঁড়ালো। খুব আলতো করে ছুঁলো ওর গাটা। তারপর গোটা শরীরটা। আর কি আশ্চর্য ব্যাপার যে বিছেটা এতটুকু নড়লো না চড়লো না — চুপচাপ পড়ে রইলো মাটির ঢেলার মতো। এইবার লোকটি যেন খুব যত্ন করে ওই কাগজটা দিয়েই মুড়ে ফেললো বিছেটাকে। তারপর ওই মোড়কটা হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালো সাধুটির সামনে।

"কি হোলো আবার? পেয়ে গেছিস তো। এবার বিদেয় হ। আর কাজ হয়ে গেলে আমার জিনিস আমায় ফেরৎ দিতে ভুলিস না যেন--" তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন সেই সাধুবাবা।

লোকটি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সাধুবাবার মুখের দিকে তাকিয়ে। সাধুবাবা এবার লোকটির চোখে চোখ রেখে বললেন — "যাও। এখুনি বাড়ি চলে যাও। আর খুব সাবধানে নিয়ে যাও এটাকে। হয়তো রাস্তায় যেতে যেতেই হঠাৎ তোমার সব দুঃখ কষ্টের শেষ হয়ে যাবে এই বাচ্চুর জন্যে।" — বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন সেই সাধুবাবা।

লোকটি আর কোনো কথা না বলে মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেলো ওই আধো অন্ধকার গুহার থেকে। হাতে শক্ত করে কাগজের মোড়কটি ধরে।

এরপর বাড়ি ফেরার পথ ধরলো সে। অত্যন্ত দুর্গম পথ। ঘন বনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে যেন শেষ হতেই চায় না। ক্লান্তিতে শরীর এলিয়ে পড়ে। এত সত্ত্বেও সে তার ডান হাতে প্রাণপণে চেপে ধরেছিলো ওই কাগজের মোড়কটাকে। কারণ সে ভালোভাবেই জানতো একটু অসাবধান হলেই ওই মোড়ক থেকে বেরিয়ে পড়বে তার মৃত্যুদূত। তাই সে ঠিক করেছিলো বাড়ির সামনে এসেই সমস্ত শক্তি দিয়ে যত দূরে পারে ছুঁড়ে দেবে ওই যমদূতকে। অবশ্য এর ঢের আগেই এই রাস্তায় চলতে চলতে যখন ইচ্ছে সে করতে পারে এই কাজটা। কিন্তু সাধুবাবার ওই মুখ আর জ্বলজ্বলে চোখ দুটোর কথা মনে হতেই তার ভয় হয়। "একে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে বলেছেন সাধুবাবা — না করলে আবার কি সর্বনাশ হবে কে জানে--" এই ভেবেই কোনোক্রমে মোড়কটিকে নিয়ে চলছিলো সে গভীর অরণ্যের ভিতর দিয়ে।

হঠাৎ তার মনে হোলো ডান হাতটা বেশ ভারি ভারি লাগছে। আর ওই ডান হাতেই তো শক্ত করে ধরে রাখা আছে কাগজের মোড়কটা। যার মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে সেই মৃত্যুদূত। ভাবতে ভাবতেই ওই হাত থেকে ফস্কে পড়ে গেলো মোড়কটা। আর সেটা এইভাবে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দারুণ ভাবে চমকে উঠলো সে। টের পেলো ঠং করে একটা আওয়াজ হয়ে সোনালী রঙের কিছু পড়ে গেলো মাটিতে। মাঝ দুপুরের সূর্যের আলো সেটার গা থেকে ঠিকরে বেরিয়ে ধাঁধিয়ে দিলো তার চোখদুটো ।

সোনার বিছে! প্রকাণ্ড একটা সোনার বিছে! যার চোখ দুটো জ্বলজ্বলে লাল পাথরের! তার মানে ওই বিছেটাই! সাধুবাবার কি আশ্চর্য ক্ষমতা! ওই ভয়ঙ্কর জীবটা এমন সোনার জিনিস হয়ে গেছে! — অবাক হয়ে ভাবলো সে। কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে একটা গাছের ডাল দিয়ে দূর থেকে ঠেলা দিয়ে দেখলো কি হয়। বিছেটা উল্টে গেলো। এবার খুব সাবধানে তার গায়ে আঙুল ছোঁয়ালো লোকটি। টের পেলো তপ্ত ধাতব স্পর্শ। এইবার সেটাকে হাতে করে তুলতে গিয়ে বুঝলো সেটা রীতিমতো ভারি। তাই দু হাতে খুব যত্ন করে সেই সোনার বিছেটাকে মাটি থেকে তুলে ওই কাগজেই মুড়ে ফেললো সে। তারপর মাথায় ঠেকালো সেই মোড়কটাকে। সেটা সাধুবাবাকে উদ্দেশ্য করে না সোনার বিছেকে উদ্দেশ্য করে কে জানে!

এরপর লোকটি যেন নতুন উদ্যমে প্রায় দৌড় মেরে চলতে লাগলো তার বাড়ির দিকে। আর বাড়িতে পৌঁছনোর পরেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খুব সাবধানে খুললো ওই মোড়কটা। "ঠিক আছে তো? ... নাকি আবার?..."— চাপা সংশয়ে একটু কেঁপে উঠলো সে মোড়কটা খোলার সময়। মোড়ক খুলতেই আবার বেরিয়ে পড়লো সেই ঝকঝকে নিরেট সোনার বিছেটা। এবার ভালো করে লক্ষ্য করে সে দেখলো শুধু চোখ নয় — এর বিরাট দাঁড়া দুটোর পাশেও রয়েছে দুটো ছোট্ট ঝকঝকে পাথর।

উত্তেজনায় সারা রাত ঘুমাতে পারলো না সে। সকাল হতেই ছুটলো স্যাকরার কাছে। স্যাকরার হাতে জিনিসটা দিয়ে সে উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে বসে রইলো। স্যাকরাটি অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আলো ফেলে আতস কাচ দিয়ে দেখতে থাকলো জিনিসটাকে। 'নকল নাকি?' — প্রশ্নটা গলায় এসে আটকে গেলো তার। আর ঠিক তখনই স্যাকরাটি বলে উঠলো — "এটা রেখে কতো চাইছো তুমি?"

স্যাকরাটি জিনিসটা দেখেই বুঝেছিলো শুধু নিরেট সোনা নয় — এর মাথায় যে পাথর কটা বসানো আছে তার দাম যা তাতে এ জিনিস তার হাতে এলে সারাজীবন আরামে কেটে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধিও এলো। জিনিসটা বন্ধক রেখে এমন পরিমাণ অর্থ সে ওই লোকটির হাতে ধরিয়ে দেওয়ার কথা সে ভাবলো যা এই চালচুলোহীন লোকটার পক্ষে ফেরৎ দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়।

কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই স্যাকরাটি লোকটির হাতে যে পরিমাণ অর্থমূল্য ধরিয়ে দিলো তা তার প্রত্যাশার অনেক বেশিই। "যাও — নিশ্চিন্তে যাও — সময়মতো শোধ দিয়ে দিও — কোনো তাড়া নেই — তোমার জিনিস নিরাপদেই থাকবে।" — লোকটির পিঠে হাত দিয়ে যেন খুব আন্তরিক ভাবে বললো স্যাকরাটি। আর মনে মনে ভাবলো — ‘যা দিলাম তা তোমার মতো হাভাতে কোনো দিনই শোধ দিতে পারবে না।'

আর লোকটিও মহা খুশি হয়ে ওই নগদ নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। তার চোখে তখন অনেক স্বপ্ন। নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করার। সবার ধারটার শোধ দিয়ে আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করার ভাবনা। এবং যেমন ভাবনা তেমন কাজ শুরু হোলো তার পরদিন থেকেই। আর সেই কাজ যে এতো তাড়াতাড়ি এমন বিরাট চেহারা নেবে তা সে ভাবতেই পারেনি। ভাগ্য যেমন একদিন তার সবকিছু হঠাৎ কেড়ে নিয়েছিলো তেমনই হঠাৎ ফিরিয়ে দিতে শুরু করলো বিরাট ভাবেই।

তাই এর কিছুকাল বাদেই লোকটি এসে হাজির হোলো সেই স্যাকরার বাড়িতে। স্যাকরাটি ভেবেছিলো আরো কিছু অর্থের সন্ধানেই এসেছে এই হতভাগাটা। সেক্ষেত্রে এবার কতো দিয়ে তাকে বরাবরের মতো বিদেয় করা যায় সে কথাই সঙ্গে সঙ্গে মনে হোলো স্যাকরাটির। কিন্তু সে হতভম্ব হয়ে গেলো লোকটির ব্যবহারে।

"এই নাও ভাই — যা দিয়েছিলে তার চেয়ে একটু বেশিই দিলাম তোমায় — এবার আমার জিনিসটা হাতে হাতে দিয়ে দাও এক্ষুণি।" — গম্ভীর ভাবে বললো লোকটি। স্যাকরাটির মনে হোলো যা দেখছে তা সত্যি না স্বপ্ন! কদিন আগের ভিখিরি লোকটা বলে কি? আর এত অল্প সময়ে এই নগদ নিয়ে এ এলো কেমন করে? সে থতমত খেয়ে তাকালো লোকটির দিকে।

"হাঁ করে তাকিয়ে আছো কেন? গুনে দেখো — যা দিয়েছিলে তার চেয়ে বেশিই ফেরৎ করলাম — এবার আমার জিনিসটা দাও — দেরি হয়ে যাচ্ছে--" বেশ ধমকের সূরেই বললো লোকটি। স্যাকরাটি লোকটির এই আমূল পরিবর্তনে চমকে গেলো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই সোনার বিছেটা তুলে দিলো লোকটির হাতে। বেশ দামি কাপড়ে মুড়ে রাখা ছিলো সেটিকে। লোকটি সেই কাপড়ের ভিতর থেকে সোনার বিছেটাকে বের করে বেশ খুঁটিয়ে দেখে গম্ভীর ভাবে বললো — "ফেরৎ নেওয়ার সময় সব যাচাই করে নেওয়া ভালো।"

এরপর বাড়ি এসে লোকটি খুব যত্ন করে সোনার বিছেটাকে তুলে রাখলো একটা বহুমূল্য কাঠের বাক্সে। ভাগ্যের কৃপায় তার তখন ব্যবসার খুবই বাড়বাড়ন্ত। যেমন অর্থবল। তেমনই লোকবল। আর সেই মতোই কাজের বোঝা। এইভাবে কখন কত সহজেই যে তার বিরাট বাড়ি হোলো — ছেলে মেয়েদের বহু ধুমধাম করে বিয়ে থা দিয়ে সুন্দর ঘরসংসার হোলো এমন অনায়াসে যে তার কোনো ভার‌ই যেন তার গায়ে পড়লো না।

কিন্তু হঠাৎ একদিন মাঝরাতে লোকটির মনে হোলো তার ডান হাতটা যেন সে ওঠাতেই পারছে না। তখনই তার মনে পড়লো বহু দিন আগের সেই ঘটনার কথা ... সেই ভয়ঙ্কর দুর্দিনের কথা ... যখন সে সেই সাধুবাবার গুহা থেকে বেরিয়ে ডান হাতে শক্ত করে সেই কাগজের মোড়কটা ধরে গভীর বনের ভিতর দিয়ে এগোচ্ছিলো .... হঠাৎ হাতটা যেন অবশ হয়ে ফস্কে মাটিতে পড়েছিলো সেই মোড়কটা ... আর তখনই তার চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিলো .... এরপর যেন সত্যিই জীবনটা সোনার হয়ে গেলো তার....

ভাবতে ভাবতে হাতটা আরো অবশ হতে লাগলো তার। সেই সময় তার মনে হোলো এ নিশ্চয়ই ওই সাধুর অলৌকিক ক্ষমতার ফল। তিনি বলেছিলেন কাজ হয়ে গেলে তার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিতে। কতকাল কেটে গেছে কিন্তু জিনিসটা দেওয়ার কথা তার মাথা থেকে একেবারেই বেরিয়ে গেছে। অথচ সেটা সে রেখে দিয়েছে কতো যত্ন করে!

"নাহ ... আর দেরি নয় ... আগামী কালের সকালটা যদি দেখতে পাই ..., তাহলে কাল‌ই যাবো ওই সাধুবাবার কাছে ...বয়স হয়ে গেছে বলে সেই গভীর বনের ভিতর দিয়ে যাওয়া এখন বেশ শক্ত ... তা হোক ... যেতে আমাকে হবেই .. নয়তো ওই সাধুর অভিশাপ..." — ভাবতে ভাবতে রাত শেষ হয়ে ভোর হয়ে গেলো লোকটির চোখের সামনে।

ভোর হতেই সে বেরিয়ে পড়লো ওই কাঠের বাক্সটা একটা কাপড়ের থলিতে নিয়ে ওই সাধুর সঙ্গে দেখা করার জন্যে। বহু দূরের পথ। শরীরের সেই জোর‌ও আর নেই। কিন্তু সে যাবেই। কারণ তার মনে হয়েছে —এখনো সময় আছে বিছেটাকে ফিরিয়ে দেওয়ার .... হয়তো সাধুবাবার রাগের কারণে আবার দুর্যোগ আসতে শুরু করেছে তার জীবনে .... সেই জন্যেই মাঝরাত থেকে ডান হাতটা কেমন অবশ হয়ে গেলো .... এইসব ভাবতে ভাবতে সে অতিকষ্টে ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাটতে লাগলো সেই সাধুবাবার ডেরার দিকে।

হাঁটতে হাঁটতে তার মনে পড়তে লাগলো সেই পুরোনো দিনের কথাগুলো ....যখন সর্বস্ব খুইয়ে শেষ আশা মনে করে আসছিলেন এই বনের পথেই.... তারপর দেখা হোলো সাধুবাবার সঙ্গে...আর তারপর গুহার ফাটল থেকে বেরিয়ে আসা সেই ভয়ঙ্কর পাহাড়ি বিছে....ভাবতে ভাবতে সে পৌঁছে গেলো সেই গুহাটার সামনে।

গুহায় ঢুকতে গিয়েই তার মনে হোলো —’অনেক দিন তো হয়ে গেলো.... সাধুবাবা বেঁচে আছেন তো? ... আর যদি নাও থাকেন তাহলেও ওই সোনার বিছে সমেত বাক্সটা ওই গুহাটায় রেখে আসবো ... তাহলেও কিছুটা দায়মুক্ত হবো আমি...’

গুহায় ঢুকেই তার মনে হোলো এখানে সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে বরাবরের মতো ... সেই একই রকমের আবছায়া ... গুহার দেওয়ালের ফাটল ... গাছের ঝুরি ... বহু কাল আগে যেমন সে দেখেছিলো এখনো হুবহু তাই ... কিন্তু সাধুবাবা? ... ওই তো তার বসার জায়গাটা ... কিন্তু ফাঁকা ... তাহলে কি ...? — যেই না ভেবেছে সে এই কথা তখনই শুনতে পেলো — "এতদিনে বুঝি কাজ মিটলো?" — সেই গমগমে গলা — পিছন থেকে শোনা গেলো — নির্ভুলভাবে।

"এদিকে আয়! ... এনেছিস তো বাপ আমার জিনিসটা?" — সেই এক‌ই কন্ঠস্বর! — এক‌ইরকম কথা বলার ভঙ্গি! — চমকে উঠে পিছনে তাকালো লোকটি। আর তখনই দেখতে পেলো সেই সাধুবাবাকে — শুয়ে আছেন মাটিতে — ঘাসপাতার বিছানায়। সে কিছুটা ভয়ে কিছুটা ভক্তিতে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো সাধুবাবার দিকে। তারপর মাথাটা সাধুবাবার পায়ের কাছে ঝুঁকিয়ে আমতা আমতা করে বলতে লাগলো —

—"দেরি হয়ে গেলো অনেক ... আপনার আশীর্বাদে‌‌ই ... নতুন করে বেঁচে উঠে ... এতো কাজের মাঝে.."

"চুপ! একেবারে চুপ! এই জিনিস আমি তোকে দিয়েছিলাম হতভাগা?"— সাধুবাবার হঠাৎ এমন ধমকানিতে চমকে গেলো লোকটি। প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে সে বললো —

"হ্যাঁ বাবা — এই জিনিসটাই — বাক্সটা খুলে দেখুন — যেমনটি দিয়েছিলেন হুবহু তেমনই আছে — ওর গা থেকে এককণাও সোনা নিই নি আমি — একটা পাথরের টুকরোও তুলি নি ওটার থেকে —দেখুন দেখুন — বলতে বলতেই বাক্সটা হাতে নিয়ে সেই সাধুর সামনে নিয়ে এলো লোকটি।

"এইভাবে দিয়েছিলাম তোকে? এই বাহারি বাক্সে করে?"— তীব্র দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন সাধুবাবা। "সেই কাগজের মোড়কটা ফেলে বাহারি বাক্সে ভরে এনেছিস কেন রে?"— অতি কর্কশভাবে বললেন তিনি। লোকটি এইধরনের ঘটনা ঘটবে তা ভাবতেও পারেনি। সে বাক্সটার সামনে জড়ভরতের মতো দাঁড়িয়ে র‌ইলো। সাধুবাবা এবার একটু নরম হয়ে বললেন — "যাক গে। এবার দে। আমার জিনিস আমার হাতে দিয়ে দে। দিয়ে বিদেয় হ।"

লোকটি এবার একটু আশ্বস্ত হয়ে হয়ে বাক্সটা খুলে সোনার বিছেটা সাধুবাবার হাতে তুলে দিতে গেলো। আর সেটা করতে গিয়েই চমকে উঠলো সে। দেখতে পেলো সেখানে সেই সোনার বিছেটি আর নেই। তার বদলে বাক্সের মধ্যে শুঁড় নেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা প্রকাণ্ড জ্যান্ত বিছে! তার মানে সেই ভয়ঙ্কর বিছেটাই! আবার জ্যান্ত হয়ে উঠেছে! লোকটি আঁতকে উঠে একটু পিছিয়ে গেলো। আর তখন‌ই শুনতে পেলো সাধুবাবার গম্ভীর কন্ঠস্বর — "কি হোলো — দে।"

লোকটি একবার সাধুবাবার মুখের দিকে তাকালো তারপর ওই বিছেটির দিকে তাকালো। সাধুবাবা এবার খুব নরম গলায় বললেন — "দাঁড়িয়ে র‌ইলি কেন? ওকে হাতে করে তুলে নিয়ে আয় আমার কাছে।" লোকটি বিছেটির দিকে হাত বাড়াতে যেতেই যেন থরথর করে কেঁপে উঠলো তার শিরদাঁড়া। থরথরিয়ে উঠলো তার সমস্ত শরীরটা।

"কি হোলো রে? ভয় পাচ্ছিস বুঝি?" — গমগমে গলায় বলে উঠলেন সেই সাধুবাবা। তারপর হো হো করে উচ্চ স্বরে হেসে বললেন — "বাচ্চু! ওরে বাচ্চু রে! দ্যাখ দ্যাখ কি মজার ব্যাপার! তোকে এখন এই মানুষটা ভয় পাচ্ছে! হাতে করে তোকে তুলে নিয়ে আসতে বললাম আমার কাছে তাতে ভয়ে কাঁপছে তোর সামনে এসে! দ্যাখ! দ্যাখ! কি কাণ্ড!"

লোকটি এবার খুব ভয়ে ভয়ে তাকালো একবার সাধুবাবার দিকে আরেকবার ওই বিছেটির দিকে। সাধুবাবা লোকটির দিকে আগুনে দৃষ্টি দিয়ে অতি কর্কশভাবে বলে উঠলেন — "লজ্জা করে না? এইভাবে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে? কি মনে হচ্ছে এখন? যদি কামড়ে দেয় তাহলেই সব শেষ? সব ভোগবাসনার ইতি! তাইনা? আর যেদিন আমার কাছে প্রথম এসেছিলিস সেদিন এই বিছেটাকেই কিভাবে নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলি মনে পড়ে?" লোকটি কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো।

"আয় রে বাচ্চু আয়! নিজে নিজেই চলে আয় আমার কাছে। ও এখন তোকে আর ছোঁবে না। ও যেদিন নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলো — ওর হাতে কিচ্ছু ছিলো না — আর মাথায় ছিলো শুধু মরার চিন্তা — তাই সেদিন ও তোকে হাতে নিয়েছিলো — আজ যে ওর দুহাত ভর্তি অর্থ — যদি কামড়ে দিস — তাহলে তো ওর সমস্ত সুখের শেষ হয়ে যাবে নিমেষেই — স্বার্থের জন্যে এরা শয়তানের সাহায্য নেয় দুহাতে — আর কাজ মিটে গেলে সব ভুলে মেরে দিয়ে সাধুর ভজন গায় — দুঃখ করিস না — এসব সভ্য মানুষের নিয়ম — নিজে নিজেই চলে আয় রে বাচ্চু--" কথাগুলো বলতে বলতে সাধুবাবা তার ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন। আর বিছেটাও সরসর করে বাক্স থেকে নেমে সাধুবাবার বাড়ানো হাতের উপর উঠে পড়লো।

"যা বাচ্চু! যা! এবার নিজের ডেরায় চলে যা!" — বলতে বলতে সাধুবাবা বিছেটাকে ছুঁড়ে দিলেন সামনের দেওয়ালের দিকে। বিছেটাও গিয়ে পড়লো ওই দেওয়ালের একটা ফাটলের ওপর। তারপর তার শুঁড়দুটো নাড়তে নাড়তে ঢুকে গেলো ওই ফাটলের মধ্যে।

এই পর্যন্ত বলে অনাথ ঘোষ একটু থামলেন।

শ্রীপতি রায় চোখ বন্ধ করে বললেন — "তারপর?"

মন্মথ দে, দ্বিজেন সেন আর হীরালাল গুপ্ত প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলেন — "হ্যাঁ — তারপর — তারপর?"

অনাথ ঘোষ চুপ করে বসে র‌ইলেন।

শ্রীপতি রায় চোখটা একবার খুলে অনাথবন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললেন — "বেশ ভালোই তো চলছিলো — এর শেষটায় কি হোলো বলো?"

সঙ্গে সঙ্গে মন্মথ গম্ভীর ভাবে বলে উঠলেন — "হ্যাঁ। শেষ-টাই তো আসল।"

দ্বিজেন সেন হাতের আঙুল মটকাতে মটকাতে বললেন — "নয়তো গল্পটার তো কোনো মানেই হয় না।"

হীরালাল মুচকি হেসে বললেন — "শেষটা ভুলে যাও নি তো?"

অনাথবন্ধু কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করেই রইলেন। বহু কাল আগে কোনো বিদেশি ছোটো গল্পে এমন এক সাধু আর বণিকের ঘটনাটি পড়েছিলেন। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভাইপোর দোকানে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে সেটিকেই সাজিয়ে গুজিয়ে নিয়েছিলেন নিজের মতো করে। কারণ তখন তার একটা গল্পের খুব প্রয়োজন। গত দুদিন ধরে তিনি কপর্দকশূন্য। ঠিকমতো একটা গল্প যদি রায়মশাইকে শোনানো যায় তাহলে আসার সময় খুশি হয়ে সবার চোখের আড়ালে উনি নগদ কিছু হাতে গুঁজে দেবেন। সেইমতো ভেবে গল্পটাকে সাজিয়ে বললেন অনাথবন্ধু। কিন্তু শ্রীপতি রায়ের মুখে "তারপর" কথাটা শুনে মনে হোলো গল্পের এই শেষটা তার মনমতো হয় নি। তাহলে উপায়? শ্রীপতি রায়ের এই টাকাটার উপর অনেক ভরসা করেই যে তিনি এসেছেন। মাথাটা হঠাৎ ঝিমঝিম করে উঠলো অনাথবন্ধুর।

"আরে ওই লোকটার তারপর কি হোলো বলো--" গড়গড়ার নল মুখ থেকে সরিয়ে বললেন শ্রীপতি রায়।

"লোকটাই তো এই গল্পের প্রোটাগনিস্ট।" — অনাথবন্ধুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন মন্মথ দে।

"ওই লোকটাকে দিয়ে গল্পের শুরু, তাহলে ওকে দিয়েই শেষ হলে তবে ব্যাপারটার ড্রামাটিক ইমপ্যাক্ট আসে।" — ঠোঁটে হালকা হাসি রেখে বললেন হীরালাল।

"লোকটা এরপর গেলো কোথায় সেটা তো বলতে হবে।" — হাতের কব্জি দুটো মটকাতে মটকাতে বললেন দ্বিজেন।

অনাথবন্ধু সবার মুখের দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে তাকালেন কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর খুব আস্তে করে বললেন — "লোকটি বাড়ি ফিরে এসে একটি কাগজে কিছু লিখে রেখেছিলো। যার কিছু দিন বাদেই সে মারা যায়।" —বলে চুপ করে গেলেন অনাথবন্ধু।

"কি লিখেছিলো?" — প্রশ্ন করলেন শ্রীপতি রায়।

"ওই বিছের বিষয়ে কিছু কথা।" — বললেন অনাথবন্ধু।

"এরপর বহু কাল বহু যুগ কেটে গেছে .... কবে মরে ভূত হয়ে গেছে সেই সব লোকজন ... কিন্তু সেই লেখাটা আছে .... আর সেটিকে আমি দেখেছি ..... পড়েছি বারবার .... বিশেষ করে আমার সবচেয়ে দুঃখের দিনে ...." যেন অনেক দূরের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই বলতে থাকেন অনাথবন্ধু। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন অনাথবন্ধুর মুখের দিকে।

"ওখানে ওই বিশেষ ধরনের বিছের কথা বিশদ করে বলেছেন তিনি। যে বিছে সময়বিশেষে নিরেট সোনার হয়ে যায়। ওই লেখাটা পড়ে আমিও ওই বিছের সন্ধানে গিয়েছিলাম। কারণ আমি তো আজন্মের হাভাতে।" — ভাঙাচোরা গালে হাসি এনে বলছিলেন অনাথবন্ধু। সেই হাসি মুখটা দেখতে যেন বেশ অস্বস্তি হোলো অন্যদের।

"দেখা পেয়েছিলে?" — গড়গড়ার একটা লম্বা টানের সঙ্গে বলেছিলেন শ্রীপতি রায়।

"তা পেয়েছিলাম।" — হাসিমুখেই উত্তর দিয়েছিলেন অনাথবন্ধু।

"এইবার গাঁজাখুরি শুরু হয়ে গেলো।" —বলেছিলেন হীরালাল।

"বানিয়ে বলতে গেলেও একটা দক্ষতা লাগে।" — বলেছিলেন মন্মথ। "প্রমাণ দেখাতে পারো?”— বললেন দ্বিজেন।

"অবশ্যই--" বলে অদ্ভুতভাবে হাসলেন অনাথবন্ধু। তারপর বলতে শুরু করলেন — "তখন আমারও খুব খারাপ অবস্থা। সে দিন আমার যেন হঠাৎ করে একটা ঘটনায় পায়ের তলার মাটি সরে গেলো। পরের দিনটা কিভাবে কাটবে ভাবতে পারছিলাম না। তখনই মনে পড়লো ওই লেখাটার কথা। আমার অন্ধ বিশ্বাস ছিলো ওই লেখাটার প্রতিটি অক্ষরের ওপর। সেইমতো বিছেটার সন্ধান করলাম। আর সেটাকে পেয়েও গেলাম ঠিক জায়গায়। এরপর তো আমার পরীক্ষার পালা। আমি কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যেও ভয় পাই নি — কিংবা কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব আসে নি মনে একটি বারের জন্যেও। তাই সহজেই বিছেটাকে হাতে তুলে নিলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেলো বিছেটা।" — এই পর্যন্ত বলে অনাথবন্ধু একটু থামলেন। সবাই তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো উদগ্রীব হয়ে।

"সোনার? পুরোটাই?" — চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞাসা করলেন দ্বিজেন।

"গায়ে পাথর লাগানোও ছিলো?" — মুচকি হেসে বললেন হীরালাল।

"সে আমাদের দেখার সৌভাগ্য হোলো না--" বলে চোখ থেকে চশমা খুলে মুছতে লাগলেন মন্মথ।

দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে নটা বাজলো। ঠিক এইসময় নিয়ম করে রায়মশাই উঠে পড়েন। আর ওঠার সময় মাঝে মাঝে সবার চোখের আড়ালে অনাথবন্ধুর হাতে কিছু টাকাকড়ি গুঁজে দেন। তাই অনাথবন্ধু বুভুক্ষুর মতো বসেছিলেন ওই টাকাটার প্রত্যাশায়। কিন্তু শ্রীপতি রায় তখনো তার চেয়ার ছেড়ে উঠলেন না। এগিয়ে এসে অনাথবন্ধুর হাতে কিছু গুঁজে দিলেন না। বরং অনাথবন্ধুর দিকে কেমন একটা আড়চোখে তাকিয়ে বললেন — "আমারও এখন টাকাকড়ির অবস্থা ভালো নয় — তাই জিজ্ঞেস করছি — তা ওই বিছেটা এখন কোথায়?"

অনাথবন্ধু অদ্ভুতভাবে শ্রীপতির চোখে চোখ রেখে বললেন — "আমার কাছে।"

মুহূর্তের জন্য ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে উঠলো শ্রীপতির মুখে। বললেন — "দেখাতে পারবে?"

অনাথবন্ধুর চোখে যেন একটা ঝিলিক খেলে গেলো — বললেন — "দেখুন না — নিতে পারেন যদি — আমার কাছ থেকে।" — বলেই ডান হাতের পাঞ্জাবির আস্তিনটা হঠাৎ কনুই অবধি গুটিয়ে হাতটা মেলে ধরলেন সবার সামনেই। আর তখনই দেখা গেলো সেখানে ঠিক বিছের মতো দেখতে একটা বীভৎস ভাবে পুড়ে যাওয়া ক্ষত — যেটা দেখতে হুবহু একটা বিরাট বিছের মতো — ঠিক তেমনই লম্বাটে — সামনে দুটো মোটা দাঁড়া — পিছনে ল্যাজটা একটু বেঁকা - এমনই আকারের গোলাপি রঙের একটা বিশাল পোড়া ঘা।

"আমার চরম বিপদের দিনে আমিও মরীয়া হয়ে একটা কিছু করতে গেছিলাম — তাই এই আমার পাওনা পেয়েছিলাম।" — কেমন একটা ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন অনাথবন্ধু — "পারবেন? কেউ পারবেন? আমার শরীর থেকে এই বিছেটা নিয়ে নিতে?"

কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে অনাথবন্ধু মিত্র তার বিধ্বস্ত প্রায় অভুক্ত শরীরটাকে ঠিকরে বের করে নিলেন ওই বৈঠকখানার বাইরে।



(গল্পটি একটি ল্যাটিন আমেরিকান উপকথার দ্বারা প্রাণিত।)



(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)