সালটি ছিল ১৯৭৫ বা ১৯৭৬ - আমি তখন কলেজের ছাত্রী। বহুল-প্রচারিত এক বাংলা দৈনিকের সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ পড়ে আমার খুব ভাল লাগে। লেখাটির শিরোনাম বোধহয় ছিল ‘আমাদের মফস্বল এখন কতোটা আলোয়’। বন্ধুদের সঙ্গে লেখাটি নিয়ে আলোচনা করবার সময় তাদের মধ্যে-ই কেউ জানাল যে লেখিকা বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসুর কনিষ্ঠা কন্যা। লেখাটিকে যত্ন করে আমার সংগ্রহে রেখে দিয়েছিলাম। রুমিদির সঙ্গে তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে সেই আমার প্রথম পরিচয় হ’ল।
আমার বিয়ের পর - মূলত আমার শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে শোনা নানা গল্পে - আমি জানলাম বুদ্ধদেব বসুর পরিবারের সঙ্গে আইয়ুব পরিবারের কতোখানি হৃদ্যতা ছিল। আমার শ্বশুর-শাশুড়ির বিয়ের পর শাশুড়ি-মার যেহেতু নিজের পরিবারের সঙ্গে প্রায় সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, বন্ধুরা ওঁদের জীবনে সর্বদাই এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ছিলেন। শ্বশুরমশাই-এর পরিচিত যে সমস্ত বিদগ্ধজন বিশেষভাবে আমার শাশুড়ি-মাকে আপন করে নেন, বসু-দম্পতি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। অন্যদিকে, বয়সের দিক থেকে ওঁদের দুই কন্যা আমার শাশুড়ি-মায়ের বয়সের কাছাকাছি হওয়ায় ওঁদের সঙ্গেও মার এক বিশেষ সখ্যতা তৈরি হয়। আমার স্বামী পূষনের জন্মের পর প্রতিভা বসু একটি সোনার আংটি দিয়ে নবজাতককে আশীর্বাদ করেছিলেন। আমাদের যখন বিয়ে হয় সেসময়ে বুদ্ধদেব বসু প্রয়াত ও আমার শ্বশুরমশাই একান্তই রোগক্লিষ্ট আর ভিন্ন কারণে প্রতিভামাসি ও আমার শাশুড়ি-মায়ের চলৎশক্তি ছিল সীমিত। বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রতিভামাসি আসতে পারেননি কিন্তু আমাকে একখানি সুন্দর আসমানি রঙের শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন আর পূষনকে দিয়েছিলেন একটি পেন। পরে, প্রতিভামাসি একদিন ওঁদের নাকতলার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আমাদের খুব আদর করে নানাপদে খাইয়েছিলেন।
বন্ধু হলেও প্রতিভামাসি আমার শাশুড়ি-মায়ের অভিভাবক-স্থানীয়া ছিলেন এবং উনি তাঁর প্রিয় প্রতিভাদির সঙ্গে নিয়মিত ফোনে কথা বলতেন ও নানা বিষয়ে পরামর্শ নিতেন। আমার শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যুর পর প্রতিভামাসির পরামর্শে আমার শাশুড়ি-মা বাবার ঘরের আসবাবপত্র বদল করে ওঁর ঘরটিকে আমাদের শোবার ঘর করে দেন। চরম শোকের সঙ্গে এ একরকম বোঝাপড়া করবার চেষ্টা। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে যিনি স্থির থেকেছেন, সেই প্রতিভা বসু তাঁর পুত্রের মৃত্যুতে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলেন। মাকে উনি বলেছিলেন, ‘গৌরী, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজন আগে যাবো, তার জন্য তৈরী ছিলাম কিন্তু এই পুত্রশোক আমাকে যেন ধ্বংস করে দিল’। শারীরিক কষ্ট সত্ত্বেও মা প্রতিভামাসির সঙ্গে দেখা করতে ওঁদের নাকতলার বাড়িতে যেতে ভালবাসতেন। তেমন কোনো সময়ে আমরা কলকাতায় থাকলে আমরাও মার সঙ্গী হ’তাম। সেইরকমই একবার আমরা প্রতিভামাসির আমন্ত্রণে বুদ্ধদেব বসুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। খোলা ছাদে সকলের বসবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ও মৈত্রেয়ী দেবীর আবৃত্তি শুনেছিলাম, মনে পড়ে। সেদিন আমার আলাপ হয়েছিল রুমিদির কন্যা তন্নিষ্ঠার সঙ্গে ও তার সুন্দর ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। তন্নিষ্ঠা তার অল্পদিন পরেই পি এইচ ডি করতে বিদেশে যাচ্ছিল বলে আমাদের কথাবার্তা প্রধানত সেসব নিয়েই হয়েছিল।
রুমিদির প্রসঙ্গে ফিরি। ১৯৮৪ সালে পূষন এক কনফারেন্সে যোগ দিতে আই আই টি কানপুরে যায়। সেখানে তখন জীবনের অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা সামলে রুমিদি অধ্যাপক রামিন্দর সিং-এর সঙ্গে সংসার শুরু করেছেন। খোঁজ-খবর করে পূষন গিয়ে রুমিদির সঙ্গে দেখা ক’রে ওঁকে অবাক করে দেয়। বহু বছর পর পূষনকে দেখে উনি খুব খুশী হয়েছিলেন। অনেক আদরযত্ন-গল্প ইত্যাদির শেষে ফেরার সময় পূষনের সঙ্গে রুমিদি নিজের তৈরী এক বোতল চমৎকার টোম্যাটো সস্ দিয়েছিলেন। সেবার রুমিদির আরেক গুণে আমি মোহিত হলাম।
এরপর, রুমিদির লেখার এক ঝলক পাই ১৯৮৯ সালে। তখন উনি ওঁকে লেখা ওঁর বাবার কিছু চিঠি ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ করছিলেন। আমরা তখন বিদেশে কিন্তু আমার এক বান্ধবী তার থেকে এখানে উদ্ধৃত অংশটুকু আমাদের জ়েরক্স করে পাঠায় যেখানে কোনো একটি চিঠির টিকায় রুমিদি ওঁর পুত্র বুয়ানের (অনির্বাণ) ও পূষনের ছেলেবেলার কথা লিখেছিলেনঃ ‘শিশু হিসেবে বুয়ানের চেহারা সত্যিই চিত্তহারী ছিলো। যেমন ছিলো আইয়ুব-গৌরীদির পুত্র পূষনের। এরা দু’জনেই পরে এমন গোঁফ-দাড়ি সমৃদ্ধ চশমাচোখে পাকাপোক্ত পুরুষ হয়েছে যে ছোটবেলার চেহারার আভাসটুকু পাওয়া যায়না।’ সেইসঙ্গে, আমার বান্ধবীটি প্রকাশিত হতে থাকা সেই চিঠিগুলির প্রশংসাও করেছিল। মনে আছে, অমন মনোগ্রাহী চিঠিগুলি পড়বার সুযোগ পেলাম না বলে তখন আমার খুব আক্ষেপ হয়েছিল। সে সুযোগ আসে ২০১৬ সালে যখন চিঠিগুলির সংকলনটি রুমিদি নিজেই আমাদের উপহার দেন। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
প্রসঙ্গত বলি যে রুমিদির পুত্র অনির্বাণ ও কন্যা তন্নিষ্ঠা দু’জনেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি-সম্পন্ন বিজ্ঞানী। বিদেশে প্রতিষ্ঠিত দুই সন্তান ও তাদের পরিবারের সঙ্গে উনি মাঝে মাঝে কিছুদিন কাটিয়ে আসতেন ও তাদের সকলকে নিয়ে রুমিদি সর্বদা খুব তৃপ্ত ছিলেন। ওঁর কথাবার্তায় স্পষ্ট হ’তো যে তারা দু’জন নিজেদের পেশা ও সংসার নিয়ে শত ব্যস্ত থাকলেও মায়ের সঙ্গে তাদের ছিল নিবিড় যোগাযোগ।
বিদেশ থেকে ফিরে আমরা মুম্বাইতে কর্মজীবন শুরু করি। আমার শাশুড়ি-মায়ের কাছ থেকে কলকাতার অন্যান্য পরিচিতদের সঙ্গে মাঝে মাঝে প্রতিভামাসি ও তাঁর পরিবারের অন্যান্যদের খবর পেতাম। ওঁর কাছে শুনেছিলাম যে ১৯৯৬ সালে অধ্যাপক সিং-এর অবসরগ্রহণের পর রুমিদির উৎসাহেই ওঁরা কলকাতায় গিয়ে সংসার শুরু করেছেন। তখন, রুমিদি নতুন উৎসাহে যে সমস্ত কাজে ব্যাপৃত হয়ে পড়েন তার মধ্যে ছিল ১৯৯৮ সালে বুদ্ধদেব বসুর নব্বই বছরের জন্মদিন পালন ও তাঁর সমস্ত পাণ্ডুলিপি ও বই-এর সংরক্ষণ, ‘বিকল্প’ নামে এক প্রকাশনা সংস্থা শুরু করা, মা-এর দেখাশোনা করা ও তাঁকে লেখায় উৎসাহ দেওয়া আর সেইসঙ্গে অভিনব একটি ছবি (পেইন্টিং)-র বিপণি স্থাপনা করা, ইত্যাদি।
২০০৩ বা ২০০৪ সালে আমার শাশুড়ি মায়ের লেখা নিয়ে এক সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করার ব্যাপারে কিছু সাহায্যের জন্য আমি প্রথম রুমিদিকে ফোন করি। সেদিন উনি সন্তান-স্নেহে আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। তার পরেও যখনি কথা হয়েছে বা দেখা হয়েছে আমাদের প্রতি ওঁর স্নেহ-ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছেন। সেই থেকে ওঁর সঙ্গে আমার ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আমার শ্বশুর-মশাই ও শাশুড়ি-মার রচনাগুলির প্রকাশ ও সেইসব পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ ইত্যাদি নিয়ে ওঁর কাছ থেকে নানা উপদেশ পেয়েছি। সেসব ছাড়াও দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের আরো নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হ’তো। রুমিদির মতো এতো সহজ, সুন্দর, আন্তরিক ব্যবহার খুব বেশি মানুষের মধ্যে দেখিনি।
রুমিদির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ২০০৫ সালের ৭ই মে ওঁদের কলকাতার বাড়িতে। যাঁর গুণের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয় এবং যিনি আলাপচারিতায় অত্যন্ত স্নেহময়ী, তাঁর স্নিগ্ধ রূপ ও রুচিসম্পন্ন সাজসজ্জা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সেদিনও অনেকক্ষণ গল্প হয়েছিল আর আলাপ হয়েছিল স্বল্পভাষী রামিদার সঙ্গে। প্রথম দেখায় আমার মনে হয়েছিল যে প্রতিভামাসির মতো রুমিদিও যেন এক ঝর্ণা-ধারা যাঁর জীবনীশক্তি তাঁর পরিপার্শ্বকে উজ্জীবিত করে চলেছে ও যিনি আয়ত্ত করেছেন পরিশীলিত ভাবে জীবনকে উপভোগ করবার মন্ত্র। অন্যদিকে, রামিদা ধীর-স্থির এক প্রাজ্ঞ ঋষির মতো মানুষ যাঁর সান্নিধ্য পেলে মন শান্ত হয়।
সেদিন, ওঁর প্রকাশনা সংস্থা ‘বিকল্প’ থেকে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসু-র ‘ভোজনশিল্পী বাঙালি’ বইটি রুমিদি আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে আমি যখন ওঁকে জানালাম যে ‘আমাদের মফস্বল এখন কতোটা আলোয়’ পড়ে আমার খুব ভাল লেগেছিল, উনি খুব খুশি হয়েছিলেন আর বলেছিলেন যে ঐ লেখাটির কোনো কপি ওঁর কাছে নেই। তাই, তার কিছুদিন পরে আমার ‘স্ক্র্যাপ বুক’-এর সেই ত্রিশ বছরের পুরনো, লাল হ’য়ে যাওয়া কাটিংটা রুমিদিকে দিয়ে আমি ভারী আনন্দ পেয়েছিলাম।
সেবারে ও পরে কয়েকবার, রুমিদিদের কলকাতার বাড়িতে পদার্পণ করে চারিদিকে ওঁদের সূক্ষ্ম শিল্পবোধের পরিচয় দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। দেশ-বিদেশের নানারকম শিল্পসামগ্রী ছাড়া রুমিদি পৃথিবীর নানাজায়গা থেকে পাথর সংগ্রহ করতে ভালবাসতেন। সুন্দরের প্রতি এই আগ্রহ রুমিদির হওয়া তো স্বাভাবিক। ওঁর পিতৃ পরিবারে – বিশেষ করে ওঁর পিতার – শিল্পকলায় এক গভীর আগ্রহ ছিল। রুমিদির নিজের কথায়ঃ বাবা আমাকে চিঠিতে লিখেছিলেন ‘ডিগ্রী যদি না আনতে পারো তো ক্ষতি নেই কিন্তু যেখানে যাবে আর্ট ম্যুজিয়াম গুলো দেখে আসবে।’ অন্যদিকে, যামিনী রায়ের সঙ্গে বসু-পরিবারের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। রুমিদি তাঁর চার বছর বয়সের জন্মদিনে যামিনী রায়ের কাছ থেকে শিল্পীর নিজের আঁকা ছবি উপহার পেয়েছিলেন। এমন সৌভাগ্য ক’জন শিশুর হয়!
২০১৬ সালে রুমিদি ও রামিদার সঙ্গে পূষন ও আমি হাসি-গল্পে-ভরা চমৎকার একটি দিন কাটিয়েছিলাম। সাবেকী আদলে বাটি-চাপা ভাত ও বড়ি-দিয়ে-শাক ইত্যাদিতে শুরু করে অসাধারণ এক দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের পর সেদিনের পরিবেশিত সুস্বাদু টম্যাটোর চাটনির রন্ধন প্রণালীটি আমি শিখতে চেয়েছিলাম। রুমিদি নিজে বলতেই পারতেন কিন্তু উনি ওঁর সহায়িকা, বিভাদিকে বললেন, ‘তুমি তো রেঁধেছ – তুমিই চম্পাকলিকে শিখিয়ে দাও।’ বিভাদি তাঁর খাতা খুলে একেবারে বরাবর মাপ সহযোগে আমাকে সেই চাটনি রাঁধা শেখালেন। রান্নার পাশাপাশি আমি আরো যা শিখলাম তা হ’ল কীভাবে যথাযথ উৎসাহ ও সম্মান দিয়ে চারপাশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে জীবনে চলতে হয়।
সেদিনই বই-আকারে প্রকাশিত সেই চিঠির সংকলনটি রুমিদির কাছ থেকে আমরা উপহার পাই। বইটি পড়ে আমি এমনি মুগ্ধ হয়ে যাই যে ‘পরবাস’ পত্রিকায় তার একটি সমালোচনা লিখি। সেখানে আমার অনুযোগ ছিলঃ ‘সম্পাদিকা সম্বন্ধে বলি যে এমন যাঁর জীবনবোধ, এতো চমৎকার যাঁর ভাষাজ্ঞান, এমন বিশাল যাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার – তাঁর কাছ থেকে আমাদের পাঠককুলের অনেক প্রত্যাশা। তাই দময়ন্তী বসু সিং-এর পিতার মতো আমারও অভিযোগ উনি সাহিত্য সৃষ্টিতে বিশেষ মনোযোগ দেন না ব’লে।’ লেখালেখির ব্যাপারে রুমিদির একটা অদ্ভুত আলস্য ছিল জানতাম বলে আমি সমানেই ওঁকে লিখতে উৎসাহিত করতাম। রুমিদির কাছে শুনেছি যে ওঁর পুত্রও ওঁকে এ ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ দিতেন। উনি লিখতে শুরুও করেছিলেন তবে তা নিয়ে প্রশ্ন করলে বলতেন যে শারীরিক কারণে বেশী লেখালেখি করতে পারছেন না।
২০১৭ সালের ২৫শে মার্চ রুমিদির সঙ্গে আমাদের শেষ দেখা। সেদিন আমাদের কন্যার বিবাহ উপলক্ষ্যে কলকাতায় আয়োজিত প্রীতিসম্মেলনে উনি এসেছিলেন ও সেখানে অনেক পুরনো পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হওয়ায় খুব খুশিও হয়েছিলেন। যখনি ওঁর সঙ্গে কথা হ’তো, রুমিদি বলতেন, ‘মুম্বাইতে তোদের কাছে কয়েকদি্নের জন্য বেড়াতে যাবো’ কিন্তু সেই বেড়াতে আসায় বাদ সাধছিল ওঁর নানা রকমের শারীরিক কষ্ট। সেসব সত্ত্বেও কথাবার্তায় ওঁর আন্তরিকতা ও নানা বিষয়ে উৎসাহ একই রকমভাবে প্রকাশ পেতো।
রুমিদি সম্বন্ধে একটি কথা বিশেষ ভাবে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। সাধারণত, রুমিদি নিজেকে খুব অগোছালো, অনিয়মে অভ্যস্ত, আবেগতাড়িত একজন মানুষ বলে বর্ণনা করতে ভালবাসতেন। কিন্তু যখন ওঁর জীবনের কথা ভাবি তখন তার ঠিক উল্টো কথাটাই মনে হয়। ওঁর বিদেশে থাকাকালীন নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পি এইচ ডি শেষ করা, দেশে ফিরে বিচ্ছিন্নভাবে চাকরি, সংসার, দু’টি কৃতী সন্তান মানুষ করা ইত্যাদি খুব সহজ ব্যাপার ছিলনা যে তা বুঝতে অসুবিধে হয়না। আর জীবনের দ্বিতীয় পর্বে কলকাতা-অধ্যায়ে সুন্দর করে স্বামী-সংসার পরিচর্যার সঙ্গে প্রকাশনা সংস্থা ও ‘আর্ট গ্যালারি’ পরিচালনা করা, মা-এর যত্ন ও মা-বাবার লেখার সংরক্ষণ করা, সম্পাদনা করা ইত্যাদি নানাবিধ কাজ যেমন সুষ্ঠুভাবে করেছেন তা প্রমাণ করে উনি কতোখানি কর্মদক্ষ মানুষ ছিলেন। প্রসঙ্গত বলি যে ওঁর এই ‘আর্ট গ্যালারি’ স্থাপনার মূল চিন্তাটি ছিল অভিনব – শিল্পপ্রেমী মধ্যবিত্ত যাতে পেইন্টিং কিনতে পারেন সেই জন্য উনি ঐ ‘আর্ট গ্যালারি’-তে নামী শিল্পীর ছোট ‘কাজ’ রাখতেন।
সম্পাদনা ছাড়া আর যে ধরনের লেখা রুমিদির কাছ থেকে আমরা পেয়েছিলাম তার মধ্যে উল্লেখ্য হ’ল ‘পরবাস’ পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প ‘চতুর্থ পুরুষ’। এই অনবদ্য কাহিনীটিতে উনি অনায়াস দক্ষতায় বিবৃত করেছেন মানব-মনের জটিলতা। পরবর্তীকালে, কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মাসকাবারি’ পত্রিকাতে গৌরী আইয়ুব-আবু সয়ীদ আইয়ুব আর কবি অজিতকুমার দত্তের পুত্র চিত্ররথ দত্তকে নিয়ে দু’টি স্মৃতিচারণাতে পাই রুমিদির সংবেদী মন ও কুশলী লেখনীর চমৎকার নিদর্শন। পিতৃবন্ধু আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্বন্ধে উনি লিখেছিলেন, ‘…আমাদের মতো খুব কাছ থেকে যাঁরা তাঁকে দেখেছেন ও জেনেছেন, তাঁদের কাছে তিনি ছিলেন রূপ এবং গুণের সমন্বয়ে তৈরি এক সূক্ষ্ম রুচিবোধের অসাধারণ মানুষ’। আবার, ওঁর পিতার সঙ্গে আইয়ুবের সম্পর্ক নিয়ে রুমিদির বিশ্লেষণটি ছিল বিশেষ মুল্যবান ও আধুনিক প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয়ঃ ‘…সাহিত্যরুচিতে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের মতবিরোধ হয়েছে। কিন্তু দু’জনেই জানতেন, তাঁদের বন্ধুতার সঙ্গে দুই সমালোচকের ভিন্নমত পোষণের অধিকারের কোনো বিরোধ নেই। সত্যি বলতে কী, দু’জনেই গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন সাহিত্যিক তর্কের সদর্থক ভূমিকায়, বিশ্বাস করতেন ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তার অধিকারে, বিশ্বাস করতেন খোলা মনে পরস্পরের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তায়, যা শেষ পর্যন্ত তাঁদের আজীবন পারিবারিক প্রীতিবদ্ধতার সবচেয়ে বড় কারণ’। একই রচনায় গৌরী আইয়ুব প্রসঙ্গে উনি লিখেছিলেন, ‘গৌরীদির লাবণ্য, মধুর স্বভাব, হাসিমুখ, উষ্ণ উপস্থিতি, প্রথম দর্শনেই আমাদের সকলকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি আমাদের প্রজন্মেরই মানুষ হওয়াতে খুব সহজেই কাছে এসেছিলাম আমরা…’। রচনার শেষভাগে উল্লেখ রয়েছে তাঁর প্রিয় গৌরীদিকে নিয়ে কাটানো এক হাসি-গল্পে ভরা দিনের যেদিন হাসিমুখে ও মৃদু গলায় গৌরী আইয়ুব মন্তব্য করেছিলেন, ‘যদি জানতাম আইয়ুব দীর্ঘদিন বাঁচবেন, আমিও হয়তো একটু নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারতাম’। সেই নিরাসক্তভাবে উচ্চারিত মন্তব্যটি রুমিদির নিজের পরিবারের অপ্রত্যাশিত নানা দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ায় ও তার ফলে তিনি যে স্বগতোক্তি করেন তার গভীরতা পাঠককে ভাবায়ঃ ‘অদৃষ্ট যদি সত্যি অ-দৃষ্ট না হত, মানবজাতি অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যেত। কোন অপঘাত আমার জন্য, আমার প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা করে আছে, একথা কেউ আমরা অগ্রিম জানতে চাইনা। মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু শুধুমাত্র ভবিষ্যৎ অজানা বলেই আমরা জীবনকে এত উপভোগ করি’।
চিত্ররথ (ডাকনাম টুটু) দত্তের মৃত্যুর (২১শে এপ্রিল, ২০১৬) অব্যবহিত পরে লেখা রুমিদির স্মৃতিচারণায় বর্ণিত হয়েছে ‘কবিতা ভবনে’ বসু ও দত্ত পরিবারের মিলিত সংসার যাত্রার আখ্যান। সেখানে, ওঁর নিজের জীবনের কথায় এসে উনি বলেন, ‘গত কুড়ি বছর ধরে আমার জীবনের একটা বৃহৎ্ অংশ অতিবাহিত হচ্ছে মা-বাবার রেখে যাওয়া বিশাল কাজের দায়িত্ব পালন করে। জানি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যতোভাবে সম্ভব তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণের সব কাজ আমাকে একলা করে যেতে হবে আমৃত্যু।’ বন্ধু-বিয়োগের কষ্ট নিয়ে রচিত লেখাটি শেষ হয়েছে এক অমোঘ সত্য উচ্চারণেঃ ‘টুটু নতুন করে মনে করিয়ে দিল, আমাদের প্রজন্ম এবার সমাপ্তির পথে। আমাদের ‘কাল’ শেষ হতে চলেছে’। অতি অল্পদিনের মধ্যেই রুমিদির শেষ কথাটি সত্য হ’ল! তবে, নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে ‘কাল’ শেষ হ’লেও যেভাবে নানা উদ্যোগে সফল ভাবে নিজেকে ব্যস্ত রেখে, নতুন চিন্তাকে বাস্তবায়িত করে ও সর্বোপরি মানুষকে ভালবেসে রুমিদি সারা জীবন কাটিয়ে গেলেন তাতে উনিও ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের’ কাছে নিঃসন্দেহে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
পরবাস-এ প্রকাশিত রুমিদির লেখা
(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)
ছবিঃ লেখক