Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines





পরবাসে উদয় চট্টোপাধ্যায়ের
লেখা


ISSN 1563-8685




শব্দ এক অর্থ একাধিক

দুই স্কুল পড়ুয়াকে খুব বিভ্রান্ত হতে দেখা গেল ‘জহর’ শব্দের অর্থ নিয়ে। একজন বলল, জহর মানে বিষ -- রাজপুতানার ক্ষত্রিয় রমণীরা জহরব্রত করে সম্মানরক্ষা করতেন। অন্যজন জোর দিয়ে বলল, জহর যদি বিষ হয় তাহলে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম জহরলাল কেন? জহরের মানে হল রত্ন। অভিধান খুলে দেখলেই তারা বুঝতে পারত যে দুটো অর্থই ঠিক। বিষ অর্থে বাংলায় জহর শব্দটি এসেছে ফারসি থেকে, আর রত্ন অর্থটি আরবি থেকে। রত্নের ব্যবসায়ী তাই জহরি বা জহুরি। জহরত জহরের আরবি শব্দের বহুবচনের রূপ -- অর্থ মণিমুক্তা। তবে একটা ভুল থেকেই গেল -- ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম জহরলাল ছিল না, ছিল জওয়াহরলাল। হিন্দিতে বা ইংরেজিতে তাঁর স্বাক্ষর এই বানানেই, তবে লোকমুখে তা হয়ে দাঁড়িয়ে্ছে জওহরলাল ।তিনি ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হলেও তাঁর নামটি রত্ন অর্থবাহী নয়, নামটির অর্থ হল বিজয় বা বিজয়ী, এবং শব্দটি এসেছে স্ংস্কৃত থেকে। এক বিভ্রান্তির তো অবসান হল, কিন্তু বিভ্রান্তিকর এরকম বহু শব্দ রয়েছে বাংলাভাষার শব্দভাণ্ডারে, যাদের বেশ কিছু তৎসম। তাদের মধ্য থেকে কয়েকটিকে বেছে নিয়ে আ্লোচনার সূত্রপাত করা যাক।

অর্থ শব্দটিকে দিয়েই শুরু হোক। ‘অর্থই অনর্থে্র মূল’ বহুপরিচিত এই প্রবাদবাক্যটিতে অর্থ অবধারিতভাবে বোঝাচ্ছে ধনদৌলত বা টাকাপয়সা। অর্থের অপর অর্থ তাৎপর্য বা মানে, এবং সেই অর্থও অনেকসময় অনর্থে্র কারণ হতে পারে। নাহলে একই শব্দে কী করে সতত-সঞ্চরণশীল মেঘ আর স্থাণু পর্বত উভয়কেই বোঝাতে পারে? অথচ বলাহক আর জীমূত তাই বোঝায়। অব্দ -- যার চলতি অর্থ বৎসর -- অভিধান জানাচ্ছে তার অর্থও পর্বত বা মেঘ হতে পারে। পর্বতের তাহলে আর বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ হয়ে যেতে বাধা কোথায়! এই যে নিশ্চল বোঝাতে স্থাণুর প্রয়োগ হল তারও অর্থ বহুবিধ – গোঁজ বা খোঁটা, স্তম্ভ, শাখাহীন বৃক্ষ, উইঢিপি, শিব। ‘স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে’ লিখে মধুসূদন শিব অর্থের সঙ্গে আমাদের পরিচয় স্থায়ী করেছেন, কিন্তু অন্য অর্থগুলো অব্যবহারের দরুন এখন অপরিচিত হয়ে উঠেছে। ভিন্নার্থবাহী আরও অনেক শব্দের সম্বন্ধেও এই এক কথাই খাটে, অভিধানে থাকলেও তারা বিস্মৃত। ভারতচন্দ্র লিখেছেন, ‘মাতঙ্গ পড়িলে দরে, পতঙ্গ প্রহার করে’। গর্ত অর্থে দরের এই প্র্য়োগ এখন আর চলে না ।তেমনই চলে না পর্বতের ফাটল, ক্ম্প বা ভয় অর্থে এর ব্যবহার। তবে চলতি অর্থ দাম বা মূল্য ছাড়াও এর প্রয়োগ রয়েছে মান বা মর্যাদা বোঝাতে (উঁচুদরের শিল্পী), ক্ষরণ বোঝাতে (দরবিগলিত অশ্রু), প্রবল বোঝাতে (দরদর করে ঘাম ঝরছে), ঈষৎ বোঝাতে (দরকাঁচা)। দরদালান বোঝায় ঘরের সংলগ্ন ঘেরা বারান্দা। এরকম অপ্রচলিতের দলে পড়ে পারানির কড়ি অর্থে আতর, উদ্বিগ্ন অর্থে উৎকলিত, পায়ের গোড়ালি অর্থে ঘটিকা, দীপ্তি অর্থে ছায়া, প্রদীপের সলতে অথবা বস্ত্রের প্রান্ত অর্থে দশা, চৌকাঠ অর্থে দেহলি, দাঁড়িপাল্লা অর্থে ধাড়া, ঘরের দেওয়ালের ঝুল অর্থে ধুন্ধুমার, আকাশ অর্থে নাক, কণ্ঠহারের লকেট অর্থে নায়ক, গ্রন্থ অর্থে নিবন্ধ, রন্ধন অর্থে পচন।

মেঘ বললেই আকাশের কথা মনে হয়। আকাশ এবং মেঘ উভয়েরই অর্থবাহী অভ্র -- আকাশ আর মেঘ উভয়কেই স্পর্শ করে বলে আমরা বলি অভ্রংলেহী পর্বত। আবার অভ্র বলতে বোঝায় হালকা চকচকে এক খনিজ যা তাপপ্রতিরোধের কাজে ব্যবহৃত হয়, চাকচিক্য আনতে যার গুঁড়ো মেশানো হয় আবিরে। অম্বরও বোঝায় আকাশ --‘অম্বরচুম্বিত ভাল হিমাচল’, আবার তা বোঝায় বসন বা বস্ত্র -- সেই অর্থে অর্থবান হয়ে ওঠেন পীতবস্ত্রধারী পীতাম্বর কৃষ্ণ, দিগবসনা দিগম্বরী কালী, মোহময় হয়ে ওঠে নীলাম্বরী পরিহিতার নীল যমুনা অভিসার ।আকাশের সূর্য আর মাটির আকন্দকে এক শব্দে ধরে রেখেছে অর্ক, চাঁদ আর পদ্মকে অব্জ। পদ্মফুলের অনেক প্রতিশব্দ -- অব্জ, অম্বুজ, নীরজ, সরোজ, সরসিজ, সরোরুহ, পঙ্কজ, পুষ্কর, পুণ্ডরীক, নলিনী, শতদল, ইন্দিবর, তামরস, কমল, কোকনদ। কোকনদে এসে থমকে দাঁড়াই, অভিধান এর অর্থ জানাচ্ছে লাল পদ্ম আর লাল শালুক। কুমুদও পদ্ম আর শালুক, যদিও পাল্লা ভারী শালুকের দিকে -- কেন না কৌমুদী হল জ্যোৎস্না, রাত্রে ফোটা শালুককে সে আলোকিত করে বলেই তার এই নাম। আবার যে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গকে আলোকিত করে তা-ও কৌমুদী (ব্যাকরণ কৌমুদী)। একই ভাবে চন্দ্রিকা একাধারে জ্যোৎস্না এবং আলোকদায়িনী ব্যাখ্যা। জ্যোৎস্না অর্থবোধক দীপিকাও ব্যবহৃত হয় গ্রন্থাদির ব্যাখ্যা বোঝাতে, এর আর এক অর্থ হল প্রদীপ। আতপ সূর্যকিরণ বা সূর্যের আলো, সেই আলোর অর্থসাদৃশ্যে চন্দ্রাতপ অবশ্যই জ্যোৎস্না, কিন্তু তার চলতি অর্থ চাঁদোয়া বা শামিয়ানা।

বহু তৎসম শব্দের ভিন্নার্থ আমাদের দিশাহারা করে, কেন না এই সব ভিন্ন ভিন্ন অর্থের সান্নিধ্যসূত্র বড়ো ক্ষীণ, কখনও তারা সম্পূর্ণ বিপরীত। আহব বোঝায় যুদ্ধ এবং যজ্ঞ। ইরন্মদ বোঝায় ব্জ্র, সমুদ্রের আগুন বাড়ব এবং সেইসঙ্গে হাতি। ইরা অর্থাৎ জলে মত্ত হয়ে খেলা করে বলেই হাতির এই অভিধা। ইরা জল বলেই সমুদ্রের নাম ইরাবান বা ইরাবৎ, নদীর নাম ইরাবতী। সমুদ্র বা ইরাবৎ মন্থন করে উঠেছিল বলে ইন্দ্রের হাতির নাম ঐরাবত। কিন্তু ইরার প্রধান অর্থ পৃথিবী, অন্যান্য অর্থ অন্ন বাক্য, যদিও তারা অপ্রচলিতের দলে। ইলা-ও মুখ্যত পৃথিবী, তার আরও অর্থ পাচ্ছি জল বাক্য ধেনু সুরা। করণ্ড মৌচাক, আবার ফুলের সাজি। করভের অর্থ কবজি থেকে কড়ে আঙুলের মূল, হস্তিশাবক, উট বা উটশাবক এবং অশ্বতর। কর্ণিকা কানের গয়না, পদ্মের বীজকোষ, বৃন্ত, লেখনী। ঈষিকা কাশতৃণ, হাতির চোখের গোলক, তুলি। ভগ বোঝায় ছয়টি বিশিষ্ট গুণ -- ঈশ্বরত্ব, বীর্য, যশঃ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য – এই সবের অধিকারী যিনি তিনি ভগবান, কিন্তু এই ভগ শব্দ আরও বোঝায় সৌভাগ্য (যার থেকে সুভগ), এমন কী স্ত্রী-যোনি এবং মলদ্বার। এই সব দেখেশুনে ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’-এর হাল্লারাজের মতো বলতে ইচ্ছে করে ‘শব্দ কি কম পড়িয়াছিল ?’ আমাদের বিভ্রান্তি বাড়ায় আরতির একই সঙ্গে নিবৃত্তি আর গভীর আসক্তি অর্থে, সবেরতপতীর যুগপৎ সূর্যপত্নী ছায়া এবং সূর্যকন্যা অর্থে। জিষ্ণুর অর্থ জয়ী, কিন্তু বিশিষ্টভাবে উদ্দিষ্ট বিষ্ণু ইন্দ্র এবং অর্জুন এই তিনজনের প্রত্যেকেই। একই গজ শব্দে বোঝায় বিশালকায় হাতি আর কপিত্থভুক অতিক্ষুদ্র এক কীট। গো এক অর্থে গোরু, অন্য অর্থে পৃথিবী – ‘গো ব্রাহ্মণ হিতায় চ’-তে প্রথম আর গোস্বামীতে দ্বিতীয় অর্থটি নিহিত। গোত্র যে বংশ আর পর্বত উভয়েরই দ্যোতক, ভারতচন্দ্রের ‘গোত্রের প্রধান পিতা মুখবংশজাত’-তে তারই প্রকাশ।

কর্ণকে আমরা কান বলেই জানি, কিন্তু কর্ণধার কারোর কান ধরে থাকে না, ধরে থাকে নৌকার হাল। জ্যামিতিতে কর্ণ হল চতুষ্কোণ ক্ষেত্রের এক কোণ থেকে বিপরীত কোণ পর্যন্ত অঙ্কিত সরলরেখা। কর হাতের এক প্রতিশব্দ, কিন্তু ‘কর গোণা’ হাত-গোণা নয় -- আঙুলের দাগ ধরে সংখ্যা গণনা করা। কর হাতির শুঁড়ও, সেটা পরিষ্কার হয় হাতির করী নাম মনে পড়লে। করের আর অর্থ কিরণ (‘আজি এ প্রভাতে রবির কর’), এবং রাজস্ব, যার ভারে অনেক সময়ই আমাদের বিব্রত হতে হয় ।চরণ পায়ের এক প্রতিশব্দ, কিন্তু যখন বলা হয় ‘করিছে্ চরণ বিচরণ’ তখন তার অর্থ হয়ে ওঠে ভ্রমণ। ভুলে গেলে চলবে না চরণ কবিতার পঙক্তিও ।ছত্রও কবিতার পঙক্তি বা অক্ষর-পঙক্তি, কিন্তু তার বহুল পরিচিতি ছাতা হিসেবেই। ছত্রের আর এক অর্থ বিতরণ স্থান -- সত্র থেকে উদ্ভূত -- অন্নসত্রে বা অন্নছত্রে যার দর্শন মেলে। দর্শন কি শুধু দেখা বা দৃষ্টিপাত? ভীষণদর্শন বা সুদর্শন কোনকিছুর চেহারা বা আকৃতির বর্ণনা, যা অবশ্য অবলোকন-সঞ্জাত। জীবনানন্দের কবিতায় ‘সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে’-র সুদর্শন কিন্তু অতি নগণ্য এক উড়ো পোকা। দর্শন আবার জ্ঞান যুক্তি ও প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত শাস্ত্র বা তত্ত্ব -- আমরা পরিচিত ষড়দর্শন বা পাশ্চাত্য দর্শন কথাগুলির সঙ্গে। তনু শব্দটির অর্থ কী? অবশ্যই শরীর -- ‘তরুণ তনু এত রূপরাশি বহিতে পারে না বুঝি আর’। কিন্তু যখন পড়ি ‘তনু দেহটি সাজাব তব আমার আভরণে’ কিংবা ‘আমার তনু তনুতে বাঁধনহারা/ হৃদয় ঢালে অধরা ধারা’, তখন তনু বিশেষণ হয়ে বোঝায় কৃশ অথচ কমনীয়। এই তনু থেকেই হয়েছে তন্বী।

তৎসম ছেড়ে আমাদের ঘরোয়া কিছু শব্দের ভিন্নার্থের পরিচয় নেওয়া যাক। ঘরোয়া বললে ঘরের নামটাই মনে হবে সর্বাগ্রে। ঘর বলতে বোঝায় বাড়ি বা বাসভবন, আর কখনও বা নির্দিষ্ট দ্যোতনায় প্রকোষ্ঠ বা কক্ষ -- পড়ার ঘর, বসবার ঘর ।কিন্তু যখন বলা হয় ‘পয়ত্রিশ ঘর তাঁতি্র বসত, ব্যাবসা জাজিম বুনে’, তখন ঘর বোঝায় পরিবার। ‘কিন্তু তারা উচ্চঘর, কংসরাজের বংশধর’ -- ঘর এখানে বংশ বা কুল। জামায় বোতামের ঘর এক চেরা ছিদ্রমাত্র ।চাল আমাদের নিত্যব্যবহার্য চাউল বা তণ্ডুল, আবার তা কাঁচাঘরের ছাউনি বা আচ্ছাদন। চালচলনের চাল হল আচার-ব্যবহার ।বাজি জেতার জন্যে দাবার চাল আর চালবাজির চাল এক নয়। চালচিত্র বলতে বুঝি প্রতিমার পিছনে স্থাপিত চিত্রিত গোলাকার পট। প্রতিমার প্রসঙ্গে এসে যায় ডাকের সাজ, যেটা হল প্রতিমার শোলা বা রাংতার কাজ। ‘ডাকের কথা’ হল খনার বচনের মতোই বাংলায় প্রচলিত কিছু প্রবাদ-প্রবচন; ডাক খনার মতোই অনির্দিষ্ট কোন ঐতিহাসিক চরিত্র। ‘পাখির ডাকে ঘুমিয়ে উঠি, পাখির ডাকে জেগে’—এখানে ডাক বুলি বা কথা, মেঘের ডাকে তা হল গর্জন। নিলামে ডাক ওঠে, ডাকে চিঠি পাঠানো হয়, সমাজে কারো কারো নামডাক হয় – বোঝাই যাচ্ছে এই তিন ক্ষেত্রে ডাকের তিন অর্থ।

নামডাকের সূত্র ধরেই নামের অর্থ অন্বেষণ করা যাক। নাম ব্যক্তি বা বস্তুর অভিধা, যে শব্দ দিয়ে তার পরিচয় নির্দিষ্ট হয়। ‘সে বেশ নাম করেছে’ বললে নাম হয়ে দাঁড়ায় খ্যাতি, কিন্তু ‘আজই তোমার নাম করছিলাম’-এ নাম হল স্মরণ। ধর্মের নামে বলা মানে ধর্মের দোহাই দিয়ে বলা। ‘নাম জপ করা’ বিশিষ্টার্থে ইষ্টনাম ।কাজের নামে ছুটি নিয়ে পিকনিকে গেলে সেটা হল অজুহাত, কিন্তু ‘কাজের নাম নেই, শুধু খেলা’ -- নাম এখানে আভাসমাত্র; নামমাত্র বা নামগন্ধও তাই। ‘সে নামেই নেতা’ বললে বোঝানো হয় নেতার যোগ্য কাজ সে করে না। নাম ডোবানো বললে বিমূর্ত নামকে কোন নদী বা ডোবায় নিমজ্জিত করার কথা বলা হয় না, বলা হয় সুনাম নষ্ট করার কথা ।‘বংশের নাম রেখেছে’ বললে নামকরণ বোঝায় না, বোঝায় সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখা।

শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর এক গল্পে কড়া নিয়ে খুব মজা করেছেন। বাসের ভিড়ে কোন সহযাত্রী পায়ের কড়ায় লাগছে বলে চেঁচিয়ে উঠলে শিবরাম তাঁকে বলেন কড়াটা পায়ে না রেখে হাতে রাখলেই তো হয়। ভদ্রলোক অপমানিত বোধ করে তাঁর পা উপরে তুলে দেখাতে চেষ্টা করেন তাঁর পায়ের কড়া এবং বলেন পায়ের কড়া হাতে নেওয়া কি সম্ভবপর ?অবশ্যই ঠিক কথা। শিবরাম কিন্তু পায়ের সেই মাংসপিণ্ডকে কড়া বলে মেনে নিতে পারেন নি, তাঁর মনে হয়েছিল ওটাকে বড়জোর মাংসের বড়া বলা যেতে পারে কিংবা কড়া না বলে চাটু-- কড়া বলাটা নেহাতই ওটার চাটুকারিতা। এক রান্নার পাত্রের বদলে অন্য এক রান্নার পাত্রের কথা মনে হয়েছিল তাঁর, কিন্তু কড়া ধাতুনির্মিত বলয় হয়ে যে কারোর হাতের শোভাবর্ধন করে সেটা মনে পড়লে তাই নিয়ে কিছু রঙ্গ রসিকতা করতে ছাড়তেন না। পুরানো দিনের আর্থিক লেনদেনের কড়ি কড়া নামেও চলত -- যার জন্যে কড়াকিয়া, এখনকার পাটিগণিত হতে যা নির্বাসিত। পাঁচালিতে পাচ্ছি ছদ্মবেশী সত্যনারায়ণ রাজাকে বলছেন ‘কড়ার ভিখারি আমি, পায়ে কেন পড়ো ?’ রবীন্দ্রনাথের গানে পাচ্ছি ‘ঘাটে বাঁধা দিন গেল রে, মুখ দেখাবি কেমন্ করে/ হাতে নাই রে কড়াকড়ি’ ।কিন্তু ‘সেখানে প্রবেশের খুব কড়াকড়ি’ বললে সেটা টাকাকড়ি বোঝায় না, বোঝায় কঠোর বাধানিষেধ ।এই কড়া যখন বিশেষণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, তখনও তার নানা অর্থ -- কড়া শাসন, কড়া আওয়াজ, কড়া কথা, কড়া মেজাজ যথাক্রমে কঠোর, কর্কশ, কটু এবং উগ্র।

এইসূত্রে আরও কয়েকটি ভিন্নার্থবোধক বিশেষণ শব্দকে দেখা যাক ।‘কাঁচার’ অর্থবৈচিত্র্য রীতিমতো চমকপ্রদ ।কাঁচা ফল বলতে বোঝায় অপক্ব ফল, কিন্তু কাঁচা সবজি বা মাংস হল আরাঁধা বা অসিদ্ধ সবজি বা মাংস। কাঁচা ইট--অদগ্ধ ইট, কাঁচা বাড়ি --মাটির তৈরি বাড়ি, কাঁচা বয়স --তরুণ বয়স, কাঁচা বুদ্ধি --অপরিণত বুদ্ধি, কাঁচা ঘুম --অপূর্ণ ঘুম, কাঁচা কাজ --অপটুভাবে করা কাজ, অঙ্কে কাঁচা বললে বোঝায় অঙ্কে অদক্ষ। কাঁচা রসিদ হল সাময়িকভাবে প্রদত্ত রসিদ, কাঁচা পয়সা বোঝায় সহজলভ্য অর্থ। কাঁচা চুলের অর্থ কালো চুল, কিন্তু কাঁচা সোনা --বিশুদ্ধ সোনা, কাঁচা কাঠ --অশুষ্ক কাঠ, কাঁচা রং --অস্থায়ী রং, কাঁচা মাল --শিল্পদ্রব্য তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদান ।ছোটো, যা সাধারণ অর্থে বড়োর বিপরীত –অর্থাৎ ক্ষুদ্র -- ছোটো কাজ, ছোটো নজর, ছোটো লোক এই সব প্রয়োগে তা বোঝায় হীন, নীচ কিংবা হেয়। অনুজ -- ছোটো ভাই --বয়স বাড়লেও ছোটোই থেকে যায়। ‘সে তোমার থেকে ছোটো’ বললে বোঝায় অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সি। ক্ষমতায় পদে বা মর্যাদায় নিম্নতর অর্থে বলা হয় ছোটো বাবু, ছোটো সাহেব বা ছোটো আদালত। মুখ ছোটো হয়ে যাওয়া মানে সম্মানহানি। ছোটো গলায় কথা বলার অর্থ অনুচ্চস্বরে কথা বলা। ‘বড়ো যদি হতে চাও ছোটো হও তবে’ --এখানে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বিনীত বা নম্র হতে।

বাংলায় আগত বেশ কিছু বিদেশী শব্দও কালক্রমে একাধিক অর্থবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জহর শব্দটির ভিন্নার্থের নিদর্শন দিয়েই আলোচনা শুরু করা হয়েছিল ।সদৃশধ্বনির জবর শব্দটিকে দেখা যাক। জবর জলসা কিংবা জবর আয়োজনে এর অর্থ জাঁকালো। জবর জিনিস বলতে বোঝায় উৎকৃষ্ট জিনিস। এর অর্থ হতে পারে বলিষ্ঠ (জবর পালোয়ান), জোরালো (জবর মা্র), কঠোর (জবর শাস্তি)। জবর খবর বলে খবরটা যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝানো হয়। বাংলায় জবরদস্তি বোঝায় জুলুম, কিন্তু যে জবরদস্ত শব্দ থেকে এর উৎপত্তি সেই জবরদস্তের অর্থ পরাক্রমশালী। অবশ্য পরাক্রমশালীরাই ‘জোর যার মুলুক তার’ দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে অপরের উপর বলপ্রয়োগে কুণ্ঠিত হয় না ।জবরজং বোঝায় বিশদৃশভাবে জাঁকালো পরিধেয় -- জং-এর অর্থ এখানে যুদ্ধ বা মরিচা নয়। পোশাকে ব্যবহৃত নকশা আর রং মানানসই না-হয়ে পরস্পরের সঙ্গে বিবদমান এই অর্থই প্রতিভা্ত জবরজং শব্দটিতে। খাতির বোঝায় সমাদর -- ‘সেখানে সে খুব খাতির পেল’। কিন্তু ‘তার খাতিরেই কাজটা হল’ বললে বুঝতে হবে তার প্রভাবে। ‘তার সঙ্গে আমার যথেষ্ট খাতির আছে’ --এখানে খাতির বোঝাচ্ছে সৌহার্দ্য। যদি কেউ বলে ‘সত্যের খাতিরে এ-কথা বলতেই হচ্ছে’, তার অর্থ হবে সত্যের কারণে। গরম বিশেষ্যে উষ্ণতা বিশেষণে উষ্ণ এই দুটি তৎসম শব্দকে নিত্য ব্যবহারে প্রায় নির্বাসিত করেছে। আমরা বৈশাখের গরম কিংবা গরম জল গরম হাওয়া বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কথার গরম বললে তা বোঝায় ঔদ্ধত্য, টাকার গরম বললে অহংকার। পেট গরম বললে পেটের উত্তাপের হেরফেরের কথা বলা হয় না, বোঝায় পেটের গণ্ডগোল। গরম জামা নিজে গরম নয়, গরম রাখে এই অর্থ বোঝায়। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে আমরা বলি বাজার গরম, টাটকা খবরকে গরম খবর, উগ্র মেজাজকে গরম মেজাজ, উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থাকে গরম পরিস্থিতি।

কথ্যভাষায় প্রসঙ্গসূত্রে শব্দের অর্থ বদলে যায়। একই শব্দ বিভিন্ন বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে যে সব অর্থ জ্ঞাপন করে ভাষা ব্যবহারকারীর মনে সেই শব্দের সঙ্গে সেই অর্থটি অচ্ছেদ্যভাবে গেঁথে যায়। এই সব অর্থগুলির মধ্যে একটি, কখনও বা একাধিক, অর্থ মুখ্য, অর্থাৎ আভিধানিক, অন্যান্যরা গৌণ ।মুখ্য অর্থই সব গৌণ অর্থের উৎস, কিন্তু কালক্রমে গৌণ অর্থেরা এমন প্রাধান্য বিস্তার করে যে মুখ্য অর্থের সঙ্গে তার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। ‘কথা’ শব্দটিকে ধরা যাক। ‘আমরা কথা বলি’ -- কথা এখানে বচন বা উক্তি, কিন্তু ‘মহাভারতের কথা’–য় কথা হল আখ্যান। আমরা কথা দিলে বা রাখলে তা হয় প্রতিশ্রুতি ।কারোর সঙ্গে কথা বললে তা হয় আলাপচারিতা। কাউকে দুকথা শুনিয়ে দেওয়া মানে কটুবাক্য বলা ।কারোর কথায় কাজ করার অর্থ কারো পরামর্শে বা প্ররোচনায়, কখনও বা আদেশে। যখন বলি ‘ভুল হলে কোন কথা শুনব না’, তার অর্থ বোঝায় ওজর বা কৈফিয়ত। ‘কথায় বলে কয়লা ধুলেও যায় না ময়লা’ -- কথা এখানে প্রবাদ ।কথাসাহিত্যের কথা কল্পনাধর্মী বর্ণনা ।তেমনই ‘মাথা’ শব্দটির ক্ষেত্রে তার মূল অর্থ মস্তককে ছাপিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দ্যোতনা আসে যখন আমরা বলি --অঙ্কে তার মাথা নেই, ছেলেটা মাথায় কিছু রাখতে পারে না, রাম তার গুরুকে মাথায় করে রেখেছে, ছেলেটা চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করছে, হরিবাবু গ্রামের মাথা, মাথা নেই তার মাথাব্যথা, তার কথার কোন মাথা নেই, গাছের মাথায় একটা লোক উঠেছে, দোকানটা মোড়ের মাথায়, ‘চুপ করো মাথা খাও, রোদ্দুরে যেয়ো না’, মাথা খাটিয়ে কাজ করো’ -- কথা শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় যথাক্রমে প্রবণতা, স্মরণশক্তি, সম্মান, কাঁপিয়ে দেওয়া, প্রধান, চিন্তাশক্তি, অর্থ, শীর্ষ, পথের সংযোগস্থল, প্রতিশ্রুতি দান এবং চিন্তা করা।

শেষ দুটি উদাহরণের সূত্র ধরে আসা যাক ক্রিয়া সমন্বয়ে শব্দের অর্থ পরিবর্তনে ।এর উদাহরণও প্রচুর ।মাথা খাটানো যে অর্থ প্রকাশ করে লোক খাটানো, টাকা খাটানো, মশারি খাটানো তা করে না। ‘খাই খাই’ কবিতায় সুকুমার রায় খাওয়ার অর্থভিন্নতার অনবদ্য উদাহরণ সংকলিত করেছেন অনবদ্য উপস্থাপনায়। মহাজনে সুদ খায়, দারোগায় ঘুষ খায়, বাবু যান হাওয়া খেতে, চাপকান দাড়িতে খাপ খায়, যুদ্ধে সৈন্যরা গুলি খায়, পাঠশালায় ছেলেরা বেত খায় গালি খায়, কেউ ভয় খেয়ে খাবি খায়, ভিখারিরা তাড়া খায়, কত লোকে দিন আনে দিন খায়, হোঁচটের চোট খেয়ে খোকা কান্না ধরে আর মা চুমু খেয়ে তাকে প্রবোধ দেন, কেউ গুঁতো খায় চড় খায় লাথি খায়, আছাড় খেয়ে কারো মাথা ঝিমঝিম করে, কেউ ভ্যাবাচাকা খায়, আমরা গরমে বাতাস খাই শীতে হিমশিম খাই। খাওয়া এখানেই শেষ হয় নি। কানমলা খেয়ে বেহালার গান খোলে, ঘটিবাটি টোল খায়, খোকারা দোল খায়, বোকারা পদে পদে ঘাবড়িয়ে ঘোল খায়, আকাশে ঘুড়ি গোঁত্তা খায়। কেউ ফেল করে মুখ খেয়ে ঘরে এলে শুভার্থীরা তাকে আদাজল খেয়ে লাগতে বলেন। এত সব খেয়ে মন না ভরলে তাঁর বিধান ‘খাও তবে কচুপোড়া, খাও তবে ঘণ্টা’। তবু খাওয়ার আরও অর্থ বাকি থেকে যায়। আদর খাওয়া, সাপে খাওয়া, নেশায় খাওয়া, তেল খাওয়া, চোখের মাথা খাওয়া -- এই সব প্রয়োগে খাওয়ার ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনা। বাঙালিরা সব কিছুই খায়, পান করে না-- বিড়ি খায়, সিগারেট খায়, চা খায়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল বিহার থেকে বাংলা ঢোকার কিছু আগে ট্রেনে এক চা-বিক্রেতার ঘোষণা, ‘জিন লোগোকা চায় পীনা হ্যায় আভি পী লিজিয়ে, ইসকে বাদ আপকো চা খানা পড়েগা’।

‘অ্নন্তপারং কিল শব্দশাস্ত্রম্‌”। ক্রিয়া সমন্বয়ে অর্থ পরিবর্তনের আর একটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনায় ইতি টানা যাক। ক্রিয়াটি ‘দেখা’। দেখা কি শুধুই্ দর্শন বা অবলোকন? খেয়ে দেখা মানে খেয়ে খাদ্যটির সম্বন্ধে মতামত গঠন, দেখে শেখা মানে প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভ, ভেবে দেখা মানে চিন্তা করা ।মজা দেখা হল উপভোগ করা। যখন বলি, ‘বইয়ের শেষ পাতাটা দেখো তো’--সেটা বোঝায় পাঠ করা ।যখন বলি, ‘আর দেখে লাভ নেই’ সেটা বোঝায় বিবেচনা করা। যখন বলি ‘আর একটু দেখি’, সেটা বোঝায় অপেক্ষা করা। দেখার তৎসম প্রতিশব্দ দর্শন, যার আর এক অর্থ তত্ত্বজ্ঞান -- জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সোপান হিসাবে ‘দেখা’ তার মূল অর্থ অবলোকনকে ছাপিয়ে গেছে।

শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে কোন শক্তিশালী লেখকের লেখায় তার ভিন্নার্থ প্রয়োগ ঘটলে। ব্যাকরণে এর নাম আর্ষপ্রয়োগ। যখন রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘এই বেতসের বাঁশিতে পড়ুক তব নয়নের পরসাদ’, মন্তব্য উঠেছিল বেতসের বাঁশি কী করে হয়, বেতস তো বেত। রবীন্দ্রানুরাগী বিদ্বজ্জনেরা এই প্রয়োগের সমর্থনে বলেছিলেন দাশরথি রায়ের ‘আমার ধর্মাধর্ম হল কোদণ্ড স্বরূপ’-এ কোদণ্ড তার মূল অর্থ ধনুকের বদলে ব্যবহৃত হয়েছে কোদাল অর্থে এবং লোকে তা মেনে নিয়েছে, এখন থেকে বেতস-ও আর এক অর্থ পেল বাঁশ।

শুধু আমাদের ভাষায় নয়, এক শব্দের নানা অর্থের নিদর্শন সব ভাষাতেই মেলে। ইংরেজিতে Conductor শব্দটি ব্যবহৃত হয় পরিচালক বোঝাতে, আবার পরিবাহী বোঝাতে ।Cultivation চাষ, আবার অনুশীলন। Bar বললে বোঝায় মদ পরিবেশনের জায়গা, উকিলসভা বা ওকালতি, বাধা, ডাণ্ডা। Sun একাধারে সূর্য আর রোদ্দুর। Fan পাখা এবং গুণগ্রাহী। Dear প্রিয় এবং মহার্ঘ ।Verb+Preposition/Adverb সংযুক্ত শব্দগুলির (যেগুলি group verb নামে পরিচিত) অর্থবৈচিত্র্যের সীমা নেই -- fall in/fall out, come across/come round, pass out/pass away, put up/put out -- এ রকম হাজার উদাহরণ। জার্মানে Reich মানে ধনী, আবার রাজ্য। Zug বোঝায় ট্রেন, মিছিল, সেনাবাহিনি, ধাক্কা ইত্যাদি নানা অর্থ। রাশিয়ানে ‘মেসিত্‌স্‌’ বোঝায় মাস আর চাঁদ। ‘মাশিনা’ মেশিন আর মোটর গাড়ি দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়। ইংরেজির মতো রাশিয়ানেও ক্রিয়ার সঙ্গে উপসর্গ যোগে অর্থের বদল হয় -- মূল ক্রিয়াপদ ‘ভেরনুত্‌’-এর অর্থ ফিরিয়ে দেওয়া। ‘জাভেরনুত্‌’-এর অর্থ মোড়া বা মলাট দেওয়া, ‘পেরেভারনুত্‌’-এর অর্থ ঘুরিয়ে দেওয়া। ‘এক্ষাত্‌’ মানে বাহনযোগে যাওয়া, ‘পাএক্ষাত্‌’ বোঝায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে বাহনযোগে যাওয়া, ‘প্রিএক্ষাত্‌’ বাহনযোগে আসা। শব্দের অর্থভিন্নতা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে।

তথ্য স্বীকারঃ

১। সংসদ বাংলা অভিধান (সাহিত্য সংসদ, কলকাতা), ২০০৩

২। ভাষার ইতিবৃত্ত – সুকুমার সেন (আনন্দ, কলকাতা), ২০১৫



(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)