Entebbe-তে নামবার আগে ওপর থেকে বিশাল Victoria Lake দেখে পুলকিত হ’লাম কিন্তু অ্যারপোর্টে নেমেই এক দুঃসংবাদে সে আনন্দ উধাও হ’য়ে গেল। আমাদের দলের কারোর ব্যাগপত্র এসে পৌঁছয়নি এবং কবে আসবে তারও কোনো ঠিক নেই। কেনিয়া যাবার সময়ও এই রকম দুর্ভোগ হয়েছিল বলে আমরা দু’জন সঙ্গের ব্যাগে আমাদের সাফারির পোশাক ও আরো একপ্রস্থ পোশাক রেখেছিলাম। অগত্যা বিষণ্ণ চিত্তে আমাদের আগামী দশদিনের ড্রাইভার-তথা-গাইড আসিয়োর গাড়িতে ৩৭ কিমি দূরে রাজধানী কাম্পালার দিকে রওনা হলাম।
চলার শুরুতেই দোকান থেকে জল কিনে এনে আসিয়ো বললেন, ‘ঠান্ডা পানি।’ আমরা অবাক হওয়ায় জানালেন যে উনি পড়াশুনোর জন্য কিছুদিন ইন্দোরে ছিলেন। ৫০০ মিলি ঠান্ডা জলের দাম পড়ল ১০০০ শিলিং আর তখন ওদেশে প্রতি লিটার পেট্রল ও ডিজেল যথাক্রমে ৪০১০ শিলিং ও ৩৮৫০ শিলিং। প্রসঙ্গত বলি যে ২০১৯-এ ১০০০ শিলিং মানে আমাদের ২০ টাকা। আসিয়োর কাছে জানলাম যে ওদেশের সরকারি ভাষা হ’ল সোয়াহিলি ও ইংরিজি; এছাড়া প্রচলিত আছে কিছু আঞ্চলিক ভাষাও।
ঝকঝকে শহর কাম্পালার প্রাণকেন্দ্রে নানা দামী হোটেল ও নামী কোম্পানির অফিসের মধ্যে আমাদের হোটেলটি। তার চারদিকে যেমন বড় বড় গাছ তেমনি চমৎকার হোটেলের নিজস্ব বাগানখানা। শহরে ‘ট্যাক্সি’ লেখা ২০ জনের মিনি ভ্যান চলছে যাতে অমানুষিক ভিড়। যাত্রীবাহী স্কুটার বা মোটর সাইকেলকে ওরা বলে ‘Boda boda’। রাত্রে বাসমতী চালের কড়াইশুঁটি দেওয়া পোলাও-এর সঙ্গে মুলোশাক ভাজা খেতে বেশ মজা লাগল। এছাড়া ছিল Peanut sauce সহযোগে সেদ্ধ কাঁচকলা, মাছ ভাজা, ফ্রায়েড চিকেন, বীফ কারি, কেক ও ফল।
খুব ভোরে রওনা হ’লাম কাম্পালার পূর্বদিকে Victoria Lake-এর ধারের শহর Jinja-র উদ্দেশ্যে। এই লেকটি আয়তনে পৃথিবীর দ্বিতীয় বড় Fresh Water Lake ও সবচেয়ে বড় Tropical Lake. অন্যদিকে, এই লেক হ’ল নীলনদের উৎসস্থল যেখানে Jinja থেকে নৌকো করে যাওয়া যায়। হালকা আলো হ’তেই স্পষ্ট হ’ল পথের ধারের কলাবাগান ও ছোট ছোট বাড়ি। তেমনি একটি বাড়ির গায়ে দেখি লেখা আছে ‘আল্লাহ আকবর’ আর তার কয়েকটা বাড়ি পরে একটির গায়ে লেখা ‘Jesus Christ is Able’. আসিয়ো বললেন যে উগান্ডায় ৮০% ক্রীশ্চান ও ১৪% মুসলমান আর বাকিরা অন্য নানা ধর্মের।
আরো এগোতে রাস্তার পাশে পেলাম খেত, কলাবাগান-সংলগ্ন ছোট বাড়ি ও জলা জমিতে থাকা প্যাপিরাস। দু’ঘন্টা লাগল Jinja পৌঁছতে। সেখানে নীলনদের ওপরকার ব্রিজ পার হয়ে গেলাম নদীর তীরে। তার পাশে ব্যাঙ্ক অফ বরোদার তত্ত্বাবধানে এক ছোট বাগান ও তাতে গান্ধিজীর একটি মূর্তি রয়েছে। নদীর দু’ধারের জনবসতি ঢাকা পড়েছে ঘন গাছপালার আড়ালে। আমরা নৌকো করে নীলনদের উৎসস্থল দেখতে চললাম। ওই আধঘন্টার নৌকাবিহারে উপরি পাওনা হ’ল পানকৌড়ি, Pied kingfisher ও Large kingfisher দর্শন। শুনলাম যে এই নদীর শুরুতে যে অংশকে ‘White Nile’ বলে তার জলের ৭০% আসে লেক থেকে ও ৩০% আসে সরাসরি মাটির তলার প্রস্রবণ থেকে। নৌকো থেকে নেমে অল্পক্ষণের জন্য কৃত্রিম এক ছোট দ্বীপে দাঁড়ালাম যার চারদিকে কয়েক জায়গায় জলে ঘুর্ণি দেখা যাচ্ছে। সেখানে জলের মধ্যে একটা গোল চাকতিতে লেখা:
JINJA
WORLD’S LONGEST RIVER
আমাদের পরের গন্তব্য Victoria Lake-এর উত্তর-পূর্বে অবস্থিত Mount Elgon ন্যাশানাল পার্ক যার ভেতর দিয়ে গিয়েছে উগান্ডা ও কেনিয়ার ভৌগোলিক সীমারেখা। এদিকে, গাড়িতে যে এয়ার-কন্ডিশনিং কাজ করছে না আসিয়ো আমাদের তা বলেননি ও পরে তা সারানোও যায়নি। ফলে, পুরো দশটি দিন আমরা গরম ও ধুলোয় নাজেহাল হয়েছি। যদিও সেই কষ্ট ভুলে যেতাম পথের ধারের দৃশ্য দেখে। নদী-পাহাড় ছাড়াও সারাটা দেশ সবুজে সবুজ –
এক জায়গা থেকে দূরে আবছা Mount Elgon দেখতে পেলাম। এক পেট্রল পাম্পে গাড়ির মেরামতির জন্য আমাদের খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হ’ল। সেসময়, আমি ভালো একটা ভাজার গন্ধ পেয়ে তার উৎসের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম একজন বৃদ্ধ এক ঝুপড়িতে, খোলা আঁচে একপাশে খোসাশুদ্ধু আস্ত কাঁচকলা ও অন্যপাশে মাংস ঝলসাচ্ছেন। ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বললাম কিন্তু সেখানকার কিছু খাওয়ার সাহস হ’ল না। পেট্রল পাম্পের দায়িত্বে থাকা শর্টস-পরা ও ঝুঁটি বাঁধা তরুণীটির আর তার ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে মামী গল্প করছিলেন। ভাল লাগল শুনে যে মেয়েটি বড় হয়ে পুলিশ হতে চায়! সারা দেশে যে সবাই ইংরিজি বলে ও দোকানগুলোর সাইনবোর্ড ইংরিজিতে, সেটা আমাদের একটা সুবিধে আর ওদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রমাণ। ছোট-বড় সব জায়গায় স্কুল রয়েছে ও দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ সাক্ষর।
তারপর চললাম কাম্পালার উত্তর-পূর্ব দিকে ৫২০ কিমি দূরে সুদানের দক্ষিণ সীমানা বরাবর ‘Kidepo Valley ন্যাশানাল পার্ক’-এর দিকে। পথে এক জায়গায় লালমাটির মাঠে অস্থায়ী ছাউনিতে নানারকম পসরা নিয়ে বাজার বসেছে। অনেক লোক সেখানে কেনা-বেচায় ব্যস্ত।
একে এতটা লম্বা রাস্তা তায় ভারী বৃষ্টিতে সেই রাস্তার অবস্থা খারাপ, ফলে আমাদের গন্তব্য Kidepo Savannah Lodge-এ পৌঁছলাম রাত সোয়া একটায়। লজ-টি এক টিলার ওপরে বলে গাড়ি ছেড়ে শেষ ২০০ মিটার লজের সহায়কদের টর্চের আলোয় আমাদের হেঁটে উঠতে হ’ল। অতক্ষণ গাড়ির ঝাঁকানিতে এমন অবস্থা যে ওইটুকু চড়াই পথে উঠতেও পা টলমল করছিল ও রীতিমতো হাঁফাচ্ছিলাম। হঠাৎ, আকাশের দিকে চোখ পড়তে অবিশ্বাস্য সুন্দর এক রূপ দেখে মন ভরে গেল। চারদিক নিঃশব্দ ও নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর আকাশের কালো জমিতে জ্বলজ্বল করছে শত শত তারা!
খাওয়ার জায়গাটিতে কাঠের খুঁটির ওপর ঘাসের ছাউনি দেওয়া। ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত আমাদের সামনে যখন পট্যাটো স্যুপ, সালামি, মধু ও মাস্টার্ড সস্ দেওয়া স্যালাড, রুটি, বীফ কারি ও পুডিং এল, মনে হ’ল সে যেন এক স্বর্গীয় ব্যবস্থা! খাওয়ার পর এক বালক টর্চ নিয়ে আমাদের তাঁবুতে পৌঁছে দিয়ে গেল।
সাভানা অঞ্চলে Mount Morungole আর Kidepo ও Narus নদীর উপত্যকায় এই ন্যাশনাল পার্কটি দেশের দশটি ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম। খুব ভোরে সাফারিতে বেরোনোর সময় দেখি আকাশের সেই ঝকঝকে তারাগুলো কে যেন নিপুণহাতে মুছে দিয়েছে - তবে বৃহস্পতি ও শুক্র তখনো জ্বলজ্বল করছে।
দু’পাশে সাভানার মধ্যে দিয়ে মাটির রাস্তায় ঝাঁকানি খেয়ে চলেছি। সাভানা মানে সত্যি দিগন্ত বিস্তৃত ঘাসজমি যার মাঝে মাঝে আকাশিয়া, খেজুর, বাবলা ইত্যাদি গাছ। দূর-দিগন্তের ছোট ছোট পাহাড় ঘেরা জমিতে হলুদ রঙের শুকনো ঘাস ও ছোট সবুজ ঝোপ একটা চমৎকার নকশা তৈরি করেছে।
অনেক রকম পাখি দেখলাম। গায়ে ছিট ছিট Francolin, চকচকে নীল শরীরের Greater blue-eared starling, চোখের চারপাশে বাদামী কাজল-পরা Speckled pigeon, ইত্যাদি।
ওখানে জিরাফ ও জেব্রা-ছাড়া অনেক নতুন প্রাণীরও দেখা পেলাম। যেমন, Waterbuck নামে এক ধরনের antelope যাদের কানের ডিজাইন ও পুরুষদের
লজ-এ ফিরে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় চুপ করে বসে সেই পাহাড়-ঘেরা বিস্তীর্ণ সাভানার বিশালতাকে উপভোগ করছিলাম। তবে, সেই অনুভূতিকে ছাপিয়ে অন্য এক আনন্দে মন ভরে গেল একটু পরে যখন ব্যাগ-এর মধ্যে একজোড়া কাচা মোজা আবিষ্কার করলাম!
বিকেলের সাফারির সময় চড়া রোদ হ’লেও হাওয়াটা গরম হয়নি। ওখানে Euphorbia candelabrum নামে একরকম বিশাল ক্যাকটাস দেখতে পাওয়া যায় যার ডালগুলো গুচ্ছ হয়ে ওপর দিকে উঠে ছড়িয়ে যায়। চেনা পাখি Roller বা নীলকণ্ঠ, Little egret ও Glossy ibis ছাড়া দেখলাম মস্ত White-headed vulture ও বাদামি রঙের পাখি Hamerkop যার লম্বা ঠোঁট ও ছুঁচলো মাথার জন্য ওড়বার সময় তাকে হাতুড়ির মতো দেখতে লাগে।
রাত্রের খাবারে ছিল পাম্পকিন স্যুপ, বেক্ড বীন অন টোস্ট, তিলাপিয়ার ফিশ ফিঙ্গার আর বানানা ফ্রিটার্স উইথ চকলেট সস্। খাওয়াদাওয়া সেরে সেই নিকষ কালো অন্ধকারে, টিলার ওপর থেকে আমরা অনেকক্ষণ মন দিয়ে আকাশ দেখলাম। আমার কর্তা আমাদের কালপুরুষ, তার পায়ের কাছে থাকা Canis major ও তার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র Sirius, Cassiopeia ইত্যাদি চেনাচ্ছিলেন। তবে আমরা যা দেখে সবথেকে মুগ্ধ হ’লাম তা হ’ল ছায়াপথ। অমন স্পষ্ট ছায়াপথ দেখবার সুযোগ তো সহজে পাওয়া যায় না। আবারও রিসর্ট-এর ছেলেরা টর্চ নিয়ে আমাদের যার যার টেন্ট-এ পৌঁছে দিয়ে গেল। চান্দ্রেয়ী একটু সঙ্কোচের সঙ্গে ওর চলনদার বালকটিকে বলল, ‘তারা দেখতে দেখতে দেরি হ’য়ে গেল।’ সে গম্ভীরভাবে জানতে চাইল, ‘তোমরা কোন দেশ থেকে এসেছ?’
--‘ভারতবর্ষ’।
বালক সামান্য ঠাট্টার সুরে বলল, ‘ওখানে আকাশে তারা নেই?’
--‘আছে কিন্তু শহরের আলো ও ধুলোর জন্য আমরা দেখতে পাই না।’
বালকটি প্রত্যয়ী কন্ঠে বলল, ‘আমরা তো রোজ আকাশভরা তারা দেখি!’
পর্ব ২
ভোরে অল্পস্বপ্ল পাখির ডাক শুনছিলাম তাই সকালে উঠে তাদের দেখতে পাবার আশায় লজ-এর মধ্যের শুঁড়িপথ ধরে হাঁটতে বেরোলাম। কোনো পাখি একই সুরে ডেকে চলেছে, কারোর ডাকের মাঝে মাঝে যেন মিষ্টি সুরের কথা রয়েছে কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। দিনের প্রথম আলোয় উপত্যকা আস্তে আস্তে আলোকিত হ’চ্ছে, পরিষ্কার নীল আকাশে মেঘের ছোঁয়াটুকু মাত্র রয়েছে। যতদূরেই দৃষ্টি ছড়িয়ে দিই না কেন সাভানার ঘাস আর কাঁটাঝোপ ছাড়া অনেক দূরে দূরে থাকা আকাশিয়া ও অন্যান্য কয়েকটি গাছ ছাড়া আর কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। আমাদের থেকে অনেকটা দূরে নীচে আরেকটি লজ আছে। শহুরে মানুষের এমন অবাধ দৃষ্টিপাতের সুযোগ তো সহজে আসে না তাই টিলার ওপর থেকে চারদিকের সেই বিস্তৃতি প্রাণভরে দেখছিলাম। পরে আমার সঙ্গীদের কাছে জানলাম যে শেষ রাতে তারা সিংহের ডাক শুনেছে।
সকাল সকাল রওনা হলাম মার্চিসন ফলস ন্যাশানাল পার্ক-এর উদ্দেশ্যে। গাড়ি ছাড়বার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মোজার ওপর দিয়ে পায়ে হুল ফোটার যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করে উঠলাম। তখন দেখা গেল গাড়ির মধ্যে একটা বড় মাছি উড়ে বেড়াছে। আসিয়ো নির্বিকার ভাবে জানালেন যে সেটি Tsetse মাছি। কাগজ দিয়ে তাকে তো মারা হ’ল কিন্তু জ্বালাটা সহজে গেল না। তার সঙ্গে মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা বিজবিজ করতে লাগল, ‘মাছিটা রোগের জীবাণু আনেনি তো!’
পাহাড়ি পথেও দেখছি কলাবাগান! এছাড়া, অনেক তুলো গাছে তুলো হয়ে আছে। ছোট বসতিতে আছে পাতার ছাউনি দেওয়া গোল গোল কুটির। মাটি-পাথরের রাস্তায় চলেছি যেখানে মাইলের পর মাইল ইলেকট্রিক-এর খুঁটি পোঁতা আছে কিন্তু কোনো তার নেই। বরং কুটির, একতলা বাড়ি বা দোকান ইত্যাদির সামনে হেলিয়ে রাখা ছোট ছোট সোলার প্যানেল থেকে লম্বা তার ঘরের ভেতরে গিয়েছে। সরকার ও NGO-রা এদের এই প্যানেল ব্যবহার করা শেখায় যাতে নিজেদের প্রয়োজনের বিদ্যুৎটুকু তারা তৈরি করে নিতে পারে। এছাড়া, জিনজা অঞ্চলে নীলনদ থেকে হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার তৈরি হয়।
লাঞ্চের জন্য আমরা Kitgum বলে দেশের উত্তরের এক শহরে থামলাম। নতুন ঘর বাড়ি, চওড়া পাকা রাস্তা, ট্রাফিক সার্কেল দেখে বোঝা যায় যে সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। পথ চলতে ধনী-দরিদ্র সকলের যে বাড়ি দেখছি তার মূল কাঠামো হ’ল চৌকো বা আয়তাকার যার সামনের দিকে পিলারের ওপর ঢাকা-বারান্দা। যাহোক, আসিয়ো আমাদের একটি সুন্দর রিসর্ট-এর রেস্টুরান্ট-এ নিয়ে গেলেন। সেখানকার খাদ্য-তালিকায় শুধুই ভিন্ডি মসালা, কাশ্মীরি আলুর দম, চিকেন মসালা, ইত্যাদি ভারতীয় রান্না দেখে আমি তো অবাক! আমি চমৎকার স্বাদের বীফ কারি ও হালকা ফুলের গন্ধের ভাত খেলাম।
প্রথমে ভালো রাস্তা ও একটু পরে শালবনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া পাহাড়ি পথে নিচের উপত্যকা দেখতে দেখতে ওপরে উঠতে লাগলাম। দু’ঘন্টায় উত্তরের সবচেয়ে বড় শহর গুলু (Gulu) পৌঁছে গেলাম। সেখানকার Sir Samuel Baker School ওদেশের প্রথম ইওরোপিয়ান স্কুল। ওই ভদ্রলোক একই সঙ্গে এঞ্জিনীয়ার, শিকারী, অভিযাত্রী ও সর্বোপরি দাসপ্রথা বিলোপের আন্দোলনে এক পথিকৃৎ ছিলেন। তাঁর জীবনের নানা রোমহর্ষক কাহিনী এককথায় অবিশ্বাস্য। যাহোক, শহরের ঝকঝকে ঘরবাড়ি, গলফ ক্লাব, অফিস-কাছারি, বড় বড় গাছে-ছাওয়া রাস্তা দেখতে দেখতে গুলু ছেড়ে চললাম। হঠাৎ, আমাদের পাশে দেখি এক জেলখানা। তার কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলাম যে বাসন্তী রঙের পোশাকপরা কয়েদীরা খেলার মাঠে নামছে।
রাস্তায় মাঝে মাঝে দেখছি লোকজন জিনিসপত্র নিয়ে বাস স্টপ-এ অপেক্ষা করছে। কে জানে কখন সেখানে বাস আসে কারণ আমরা পথে তো কোনো বাসের দেখা পাইনি। আবার কোথাও দেখছি মাথায় বোঝা নিয়ে কয়েকটি লোক হাঁটছে বা ‘টু হুইলার’ চলছে কিন্তু সারা পথে আর প্রায় কোনো গাড়ি দেখিনি। পথের দু’পাশের ঘন সবুজের সমারোহে ঝাউ, খেজুর, কলাগাছ পাশাপাশি রয়েছে। গ্রামীণ বাজারে স্তূপ করে সোলার প্যানেল বিক্রি হচ্ছে। বিরাট এক চিনির কারখানা ও চাল কল পার হ’লাম। অনেক জায়গায় রাস্তার পাশে ধান শুকোনো হচ্ছে।
সন্ধের মুখে বিরাট চওড়া নীলনদ দেখতে পেলাম। এখানে তার নাম Albert Nile. তার ওপরের ব্রিজ পেরিয়ে Pakwach নামে দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের আরেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এলাম আমাদের ব্যাগ উদ্ধার করতে। হারানিধি ফিরে পেয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার সেই ব্রিজের ওপর দিয়ে যখন যাচ্ছি, সূর্যাস্ত হচ্ছে।
পার্কে ঢুকতেই একটু দূরে দূরে বসে ছিল Warthog, Olive baboon, Water buck, Hartebeest-এর দল। মনে হচ্ছিল যেন তারা আমাদের অভ্যর্থনা করতে এসেছে। সেখানে আমাদের দু’রাতের আশ্রয় Pakuba Lodge-এ অতিথির সংখ্যা দেখে বুঝলাম যে ওই পার্কটি কতোটা জনপ্রিয়।
সকালে আলো ফুটতেই আমরা সাফারিতে বেরোলাম। আকাশে কালো মেঘ। মাটির পথে Game reserve-এর মধ্যে দিয়ে চলে ঘন্টাখানেকের মধ্যে বেশ কিছু পশু-পাখি দেখে ফেললাম। পাখিরা হল বিরাট Hornbill, লম্বা নখ-ওয়ালা হলদে রঙের Yellow-throated longclaw, White-breasted kingfisher, Brown snake eagle ও এক পত্রহীন গাছে এক ঝাঁক হুল্লোড়ে Piapiac. তার কাছেই আরেকটি নিষ্পত্র গাছে উদাসীন মুখে লেজ ঝুলিয়ে বসে ছিল এক Savannah monkey। দেখা পেলাম
সকলেই আমরা বেশ হালকা মেজাজে। হঠাৎ দেখা গেল রাস্তা ধরে একটি দাঁতাল হাতি সোজাসুজি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আসিয়ো আস্তে আস্তে গাড়ি পেছোতে লাগলেন কিন্তু হাতি একই ভাবে এগোতে লাগল। তার ভাবগতিক দেখে আসিয়োর মনে হ’চ্ছিল যে সেটি বেশ রাগী পুরুষ হাতি। এবারে হাতিটি রাস্তা ছেড়ে পাশের গাছপালার মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল। আসিয়ো গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে গজরাজের সরে যাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন কিন্তু হাতির তেমন কোনো বাসনা আছে বলে মনে হ’ল না।
মিনিট পাঁচ-সাত ওভাবে কাটবার পর, যেন তার শক্তির পরিচয় দিতেই, হাতিটি দুই দাঁতের মাঝে একটা গাছ ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল।
প্রায় সাত-আট মিনিট ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকবার পর হাতিটি হঠাৎ পেছনে ফিরল আর তাই দেখে আসিয়ো জোরে জোরে তালি বাজাতে লাগলেন। তারপর, উনি একটা প্লাস্টিক-এর খালি জলের বোতল মুচড়ে কচকচ আওয়াজ করতেই হাতি আমাদের দিকে পেছন করে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে লাগলো। অল্পক্ষণ আসিয়ো ওইভাবে আওয়াজ করতে করতেই ধীরগতিতে গাড়ি এগোলেন। অবশেষে, একসময় হাতি দাঁড়িয়ে আমাদের ভাল করে দেখে ভেতরে চলে গেল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এরপর যেসব পাখি দেখলাম তা হ’ল উজ্জ্বল হলুদ রঙের Yellow wagtail, লাল পুঁতির মতো চোখে কাজল-পরা Yellow-throated green bee-eater, চকচকে নীল রঙের Long-tailed starling ছাড়া দু’টো Palm-nut vulture। তাদের কালো শরীর, সাদা মাথা ও ডানা আর চোখের রঙ নিয়ে বেশ আকর্ষণীয় চেহারা।
আরো ঘন্টা তিনেক ঘুরে আমরা Oribi, Hartebeest ও অনেক সুন্দর সুন্দর পাখি দেখলাম। সবুজ রঙা Swallow-tailed bee eater, চোখে কালো পট্টি লাগানো Grey-backed fiscal shrike, লাল রঙের Red bishop, পুরু লাল ঠোঁটের Red-billed quelea, নীল মাথা Carmine bee eater, Griffon vulture ও White-backed vulture ইত্যাদি ছাড়া জলে ছিল Purple heron, দীর্ঘচঞ্চু Sand piper ও সাবধানী পা ফেলে হেঁটে যাওয়া উজ্জ্বল-বাদামী Jacana।
স্থানীয় কয়েকটি ছেলে একটা গাছের ডালকে U-এর মতো আকারে বাঁকিয়ে তাতে নাইলনের তার লাগিয়ে বানানো একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিল। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে চমৎকার সেই বাজনা শুনলাম। পার্কে অনেক Sausage tree যার বড় ও ভারী ফল হাতির খুব প্রিয়। মানুষও ওষুধ হিসেবে আর অ্যালকোহল বানানোর জন্য এর ব্যবহার করে।
প্রশস্ত সেই বেগবতী নদীর ওপর থেকে দু’ধারের চোখ-জুড়োনো সবুজ ও পাহাড় দেখতে কী যে ভালো লাগছিল! লঞ্চ ছাড়া জলে ছোট নৌকোও রয়েছে। গাইড মাইকে জানাচ্ছেন কোথায় কী দেখা যাচ্ছে। প্রথমে জলে শুধু একটি জলহস্তীর মাথা দেখা গেল কিন্তু তারপর দেখি সেখানে একপাল জলহস্তী খেলা করছে। তাদের মধ্যে পালের গোদা পুরুষটি মনের আনন্দে জল ছেটাচ্ছে। মাঝখানে এক ছোট সবুজ-দ্বীপ এল। তারপর, গাছের ওপর African fish eagle ও এক পাল হাতি ছাড়া বিশেষ কিছু দেখা যাচ্ছিল না। পারের কাদার মধ্যে Nile crocodile-এর বিরাট মাথাখানা দেখেই দর্শকরা বেশ হই হই করে উঠল। এক পাহাড়ের খাড়া ও ন্যাড়া গায়ে দেখি প্রচুর ফুটো। শুনলাম যে তারমধ্যে ছোটগুলো হ’ল Pied kingfisher-এর আর বড়গুলো Griffon vulture-এর বাসস্থান।
নীলনদের ওপর থাকার সময় তার জন্মের কথা একটু বলে নিই। ৬৬৫০ কিমি লম্বা নীলনদ এক উত্তরমুখী নদী যা পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও নিঃসন্দেহে এটি আফ্রিকার দীর্ঘতম নদী যার অববাহিকায় রয়েছে এগারোটি দেশ। দু’টি প্রধান নদী White Nile ও Blue Nile-এর সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে নীলনদ। এই White Nile-এর ভিন্ন অংশে ভিন্ন নাম; যেমন, ভিক্টোরিয়া লেক থেকে উৎপন্ন নদীটি পরিচিত ‘ভিক্টোরিয়া নাইল’ নামে। নানা পথ ঘুরে ৫০ মিটার চওড়া নদীটি এসে মার্চিসন ফলস-এ মাত্র ৭ মিটার প্রশস্ত এক গিরিকন্দরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে ৪৫ মিটার নিচে এসে সতেজে বয়ে গিয়ে লেক অ্যালবার্ট-এ মেশে। আবার সেই লেক থেকে বেরিয়ে যখন সে প্রবাহিত হয় তখন সে পরিচিত অ্যালবার্ট নাইল নামে। অন্যদিকে, ইথিওপিয়ার Lake Tanna থেকে উৎপন্ন ‘ব্লু নাইল’ সুদানের খারতুমে এসে ‘হোয়াইট নাইল’-এর সঙ্গে মিলিত হয়ে নীলনদ নামে আরো উত্তরে মিশরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে পড়ে।
(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)