Subscribe to Magazines



পরবাসে চম্পাকলি আইয়ুব-এর
আরো লেখা




ISSN 1563-8685




উগান্ডার জলে-জঙ্গলে


উগান্ডা ভ্রমণের যাত্রা পথ

‘উগান্ডার জঙ্গলে গিয়ে শিম্পাঞ্জি আর গরিলা দেখতে চাও?’ অমিতের এই প্রশ্নে আমরা স্বামী-স্ত্রী দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে চাইলাম। দেশভ্রমণে তো আমরা সদা-উৎসাহী কিন্তু সদ্য বরিষ্ঠ-নাগরিক হওয়া আমাদের জন্য কোনো ‘দুর্গম-গিরি-কান্তারে’ অভিযান মুশকিলের হবে। আমাদের ইতস্তত করতে দেখে অমিত-চান্দ্রেয়ী প্রচুর আশ্বাস দিতে লাগল ও শেষে অমিত যখন বলল যে ওর সত্তরোর্ধ্ব মা-ও ওদের সঙ্গে যাবেন, আমরা সাহস করে রাজি হয়ে গেলাম। অবশ্য, সফরের বিভিন্ন ভাগে আমি ভালোরকম টের পেয়েছি যে আমার ভয়টা অমূলক ছিল না। আবার, সেইসব কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে মনে হয়েছে ‘ভাগ্যি সাহস করেছিলাম, নাহ’লে তো এমন অমূল্য অভিজ্ঞতাও হ’তো না!’ যাহোক, শুরু হ’ল আমাদের যাত্রা।

Entebbe-তে নামবার আগে ওপর থেকে বিশাল Victoria Lake দেখে পুলকিত হ’লাম কিন্তু অ্যারপোর্টে নেমেই এক দুঃসংবাদে সে আনন্দ উধাও হ’য়ে গেল। আমাদের দলের কারোর ব্যাগপত্র এসে পৌঁছয়নি এবং কবে আসবে তারও কোনো ঠিক নেই। কেনিয়া যাবার সময়ও এই রকম দুর্ভোগ হয়েছিল বলে আমরা দু’জন সঙ্গের ব্যাগে আমাদের সাফারির পোশাক ও আরো একপ্রস্থ পোশাক রেখেছিলাম। অগত্যা বিষণ্ণ চিত্তে আমাদের আগামী দশদিনের ড্রাইভার-তথা-গাইড আসিয়োর গাড়িতে ৩৭ কিমি দূরে রাজধানী কাম্পালার দিকে রওনা হলাম।


দু’ধারে রয়েছে ছোট ছোট দোকান ও কলার আড়ত

লেক-এর পাশ দিয়ে চমৎকার রাস্তা আর তার পাশে ও টিলার ওপরে সুদৃশ্য লাল টালির বাংলো। ডিসেম্বরের শেষের দুপুর-রোদ্দুরে চারদিক ঝলমল করলেও হাওয়ায় হিমেল ভাব। প্রচুর গাছপালার মধ্যে বিশেষ করে চোখে পড়ল মস্ত মস্ত ফলে ভরা কাঁঠাল গাছগুলো। জলের ধারে হোটেল ও শপিং মল ছাড়া দু’ধারে রয়েছে ছোট ছোট দোকান ও কলার আড়ত। আসিয়ো জানালেন যে কলা ওদেশের প্রধান খাদ্য। পাকা কলা ছাড়া সেদ্ধ কাঁচকলা চটকে তাতে সস দিয়েও খাওয়া হয়।

চলার শুরুতেই দোকান থেকে জল কিনে এনে আসিয়ো বললেন, ‘ঠান্ডা পানি।’ আমরা অবাক হওয়ায় জানালেন যে উনি পড়াশুনোর জন্য কিছুদিন ইন্দোরে ছিলেন। ৫০০ মিলি ঠান্ডা জলের দাম পড়ল ১০০০ শিলিং আর তখন ওদেশে প্রতি লিটার পেট্রল ও ডিজেল যথাক্রমে ৪০১০ শিলিং ও ৩৮৫০ শিলিং। প্রসঙ্গত বলি যে ২০১৯-এ ১০০০ শিলিং মানে আমাদের ২০ টাকা। আসিয়োর কাছে জানলাম যে ওদেশের সরকারি ভাষা হ’ল সোয়াহিলি ও ইংরিজি; এছাড়া প্রচলিত আছে কিছু আঞ্চলিক ভাষাও।

ঝকঝকে শহর কাম্পালার প্রাণকেন্দ্রে নানা দামী হোটেল ও নামী কোম্পানির অফিসের মধ্যে আমাদের হোটেলটি। তার চারদিকে যেমন বড় বড় গাছ তেমনি চমৎকার হোটেলের নিজস্ব বাগানখানা। শহরে ‘ট্যাক্সি’ লেখা ২০ জনের মিনি ভ্যান চলছে যাতে অমানুষিক ভিড়। যাত্রীবাহী স্কুটার বা মোটর সাইকেলকে ওরা বলে ‘Boda boda’। রাত্রে বাসমতী চালের কড়াইশুঁটি দেওয়া পোলাও-এর সঙ্গে মুলোশাক ভাজা খেতে বেশ মজা লাগল। এছাড়া ছিল Peanut sauce সহযোগে সেদ্ধ কাঁচকলা, মাছ ভাজা, ফ্রায়েড চিকেন, বীফ কারি, কেক ও ফল।

খুব ভোরে রওনা হ’লাম কাম্পালার পূর্বদিকে Victoria Lake-এর ধারের শহর Jinja-র উদ্দেশ্যে। এই লেকটি আয়তনে পৃথিবীর দ্বিতীয় বড় Fresh Water Lake ও সবচেয়ে বড় Tropical Lake. অন্যদিকে, এই লেক হ’ল নীলনদের উৎসস্থল যেখানে Jinja থেকে নৌকো করে যাওয়া যায়। হালকা আলো হ’তেই স্পষ্ট হ’ল পথের ধারের কলাবাগান ও ছোট ছোট বাড়ি। তেমনি একটি বাড়ির গায়ে দেখি লেখা আছে ‘আল্লাহ আকবর’ আর তার কয়েকটা বাড়ি পরে একটির গায়ে লেখা ‘Jesus Christ is Able’. আসিয়ো বললেন যে উগান্ডায় ৮০% ক্রীশ্চান ও ১৪% মুসলমান আর বাকিরা অন্য নানা ধর্মের।


চৌকো ভিতের একতলা বাড়ির এক কোণায় মিনার থাকলে তা মসজিদ

জেনে ভাল লাগলো যে ধর্ম নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে কোনো বিবাদ নেই। ওদেশে মসজিদ বা চার্চের গঠনশৈলী অত্যন্ত সাধারণ। চৌকো ভিতের একতলা বাড়ির এক কোণায় মিনার থাকলে তা মসজিদ আর Spire থাকলে তা চার্চ। সারা দেশে এক জনবসতিতে মসজিদ দেখেছি তো পাশেরটিতে দেখেছি চার্চ।

আরো এগোতে রাস্তার পাশে পেলাম খেত, কলাবাগান-সংলগ্ন ছোট বাড়ি ও জলা জমিতে থাকা প্যাপিরাস। দু’ঘন্টা লাগল Jinja পৌঁছতে। সেখানে নীলনদের ওপরকার ব্রিজ পার হয়ে গেলাম নদীর তীরে। তার পাশে ব্যাঙ্ক অফ বরোদার তত্ত্বাবধানে এক ছোট বাগান ও তাতে গান্ধিজীর একটি মূর্তি রয়েছে। নদীর দু’ধারের জনবসতি ঢাকা পড়েছে ঘন গাছপালার আড়ালে। আমরা নৌকো করে নীলনদের উৎসস্থল দেখতে চললাম। ওই আধঘন্টার নৌকাবিহারে উপরি পাওনা হ’ল পানকৌড়ি, Pied kingfisher ও Large kingfisher দর্শন। শুনলাম যে এই নদীর শুরুতে যে অংশকে ‘White Nile’ বলে তার জলের ৭০% আসে লেক থেকে ও ৩০% আসে সরাসরি মাটির তলার প্রস্রবণ থেকে। নৌকো থেকে নেমে অল্পক্ষণের জন্য কৃত্রিম এক ছোট দ্বীপে দাঁড়ালাম যার চারদিকে কয়েক জায়গায় জলে ঘুর্ণি দেখা যাচ্ছে। সেখানে জলের মধ্যে একটা গোল চাকতিতে লেখা:


এই লেক হ’ল নীলনদের উৎসস্থল (*)

THE SOURCE OF R. NILE

JINJA

WORLD’S LONGEST RIVER

আমাদের পরের গন্তব্য Victoria Lake-এর উত্তর-পূর্বে অবস্থিত Mount Elgon ন্যাশানাল পার্ক যার ভেতর দিয়ে গিয়েছে উগান্ডা ও কেনিয়ার ভৌগোলিক সীমারেখা। এদিকে, গাড়িতে যে এয়ার-কন্ডিশনিং কাজ করছে না আসিয়ো আমাদের তা বলেননি ও পরে তা সারানোও যায়নি। ফলে, পুরো দশটি দিন আমরা গরম ও ধুলোয় নাজেহাল হয়েছি। যদিও সেই কষ্ট ভুলে যেতাম পথের ধারের দৃশ্য দেখে। নদী-পাহাড় ছাড়াও সারাটা দেশ সবুজে সবুজ –


নদী-পাহাড় ছাড়াও সারাটা দেশ সবুজে সবুজ
কফি শুকোচ্ছে, পাশে আমগাছ, কাছেই কলাগাছ
(*)

কখনো জঙ্গল, কোথাও চাষের জমি বা আখের খেত, কখনো প্যাপিরাসের ঝোপ, আবার কোথাও গাছ ভরা সিঁদুর-রঙা আম। অনেক সময় কলা-আম-কাঁঠালের পাশাপাশি পাইন বা ঝাউ গাছ দেখে অবাক হয়েছি!

এক জায়গা থেকে দূরে আবছা Mount Elgon দেখতে পেলাম। এক পেট্রল পাম্পে গাড়ির মেরামতির জন্য আমাদের খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হ’ল। সেসময়, আমি ভালো একটা ভাজার গন্ধ পেয়ে তার উৎসের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম একজন বৃদ্ধ এক ঝুপড়িতে, খোলা আঁচে একপাশে খোসাশুদ্ধু আস্ত কাঁচকলা ও অন্যপাশে মাংস ঝলসাচ্ছেন। ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বললাম কিন্তু সেখানকার কিছু খাওয়ার সাহস হ’ল না। পেট্রল পাম্পের দায়িত্বে থাকা শর্টস-পরা ও ঝুঁটি বাঁধা তরুণীটির আর তার ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে মামী গল্প করছিলেন। ভাল লাগল শুনে যে মেয়েটি বড় হয়ে পুলিশ হতে চায়! সারা দেশে যে সবাই ইংরিজি বলে ও দোকানগুলোর সাইনবোর্ড ইংরিজিতে, সেটা আমাদের একটা সুবিধে আর ওদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রমাণ। ছোট-বড় সব জায়গায় স্কুল রয়েছে ও দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ সাক্ষর।


Sipi নদীর তিনটি ঝরনা Mount Elgon ন্যাশানাল পার্ক-এর বড় আকর্ষণ

আবার পাহাড়ি পথে চলা। খানিক পরে এসে গেলাম Sipi Falls-এর ধারে। Sipi নদীর তিনটি ঝরনা Mount Elgon ন্যাশানাল পার্ক-এর বড় আকর্ষণ। তার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি গুহা থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের খাড়া ও পাথুরে গায়ের পাশ দিয়ে ১০০ মিটার নিচে লাফিয়ে নামছে। সেখানে পাহাড়গুলো একদম অ্যাম্‌ফিথিয়েটারের মতো সবুজ উপত্যকাটিকে ঘিরে রয়েছে। তন্বী ঝরনার রূপ দেখতে দেখতে সেখানেই প্রথম পরিচয় হ’ল ওদেশের জনপ্রিয় খাবার ‘Rolex’-এর সঙ্গে।


আমাদের ‘Egg Roll’ ওখানে ‘Rolled Eggs’ থেকে লোকমুখে ‘Rolex’ হয়ে গিয়েছে

আমাদের ‘Egg Roll’ ওখানে ‘Rolled Eggs’ থেকে লোকমুখে ‘Rolex’ হয়ে গিয়েছে ও দেশের সর্বত্র পথেঘাটে এই খাবারটি পাওয়া যায়।

তারপর চললাম কাম্পালার উত্তর-পূর্ব দিকে ৫২০ কিমি দূরে সুদানের দক্ষিণ সীমানা বরাবর ‘Kidepo Valley ন্যাশানাল পার্ক’-এর দিকে। পথে এক জায়গায় লালমাটির মাঠে অস্থায়ী ছাউনিতে নানারকম পসরা নিয়ে বাজার বসেছে। অনেক লোক সেখানে কেনা-বেচায় ব্যস্ত।


পথের ধারে জামাকাপড়ের হাট (*)

গ্রাম-শহর সর্বত্র মহিলাদের পরনে ছোট বা বড় ঝুলের স্কার্ট ও ব্লাউজ অথবা ফ্রক, পুরুষরা পরে শার্ট-প্যান্ট। মহিলাদের পোশাকের হাতায় শক্ত কিছু দিয়ে কাঁধের কাছটা উঁচু করা। সবসময় দেখেছি যে স্কুটার বা মোটর সাইকেলে দুইএর বেশি যাত্রী বা কখনো বিপজ্জনক পরিমাণে মালপত্র।

একে এতটা লম্বা রাস্তা তায় ভারী বৃষ্টিতে সেই রাস্তার অবস্থা খারাপ, ফলে আমাদের গন্তব্য Kidepo Savannah Lodge-এ পৌঁছলাম রাত সোয়া একটায়। লজ-টি এক টিলার ওপরে বলে গাড়ি ছেড়ে শেষ ২০০ মিটার লজের সহায়কদের টর্চের আলোয় আমাদের হেঁটে উঠতে হ’ল। অতক্ষণ গাড়ির ঝাঁকানিতে এমন অবস্থা যে ওইটুকু চড়াই পথে উঠতেও পা টলমল করছিল ও রীতিমতো হাঁফাচ্ছিলাম। হঠাৎ, আকাশের দিকে চোখ পড়তে অবিশ্বাস্য সুন্দর এক রূপ দেখে মন ভরে গেল। চারদিক নিঃশব্দ ও নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর আকাশের কালো জমিতে জ্বলজ্বল করছে শত শত তারা!

খাওয়ার জায়গাটিতে কাঠের খুঁটির ওপর ঘাসের ছাউনি দেওয়া। ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত আমাদের সামনে যখন পট্যাটো স্যুপ, সালামি, মধু ও মাস্টার্ড সস্‌ দেওয়া স্যালাড, রুটি, বীফ কারি ও পুডিং এল, মনে হ’ল সে যেন এক স্বর্গীয় ব্যবস্থা! খাওয়ার পর এক বালক টর্চ নিয়ে আমাদের তাঁবুতে পৌঁছে দিয়ে গেল।


উঁচু ইঁটের বেদীর ওপর মোটা কাপড়ের তাঁবু

উঁচু ইঁটের বেদীর ওপর মোটা কাপড়ের তাঁবু। তাতে ঢোকা-বেরোনোর জন্য যেটুকু খোলা, তা চেন দিয়ে বন্ধ করতে হয়। তাঁবুর মেঝেতে ত্রিপল বিছানো। পাশের পাকা গাঁথনির বাথরুমে আধুনিক ব্যবস্থা কিন্তু তাঁবু থেকে সেখানে ঢুকতে ছোট্ট যে প্যাসেজটি তাতে রয়েছে গাছের ডাল দিয়ে তৈরি উঁচু বেড়া! তাঁবুর আশপাশে চেনা-অচেনা নানারকম ক্যাকটাস যাদের সারা দেশেই দেখেছি।

সাভানা অঞ্চলে Mount Morungole আর Kidepo ও Narus নদীর উপত্যকায় এই ন্যাশনাল পার্কটি দেশের দশটি ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম। খুব ভোরে সাফারিতে বেরোনোর সময় দেখি আকাশের সেই ঝকঝকে তারাগুলো কে যেন নিপুণহাতে মুছে দিয়েছে - তবে বৃহস্পতি ও শুক্র তখনো জ্বলজ্বল করছে।

দু’পাশে সাভানার মধ্যে দিয়ে মাটির রাস্তায় ঝাঁকানি খেয়ে চলেছি। সাভানা মানে সত্যি দিগন্ত বিস্তৃত ঘাসজমি যার মাঝে মাঝে আকাশিয়া, খেজুর, বাবলা ইত্যাদি গাছ। দূর-দিগন্তের ছোট ছোট পাহাড় ঘেরা জমিতে হলুদ রঙের শুকনো ঘাস ও ছোট সবুজ ঝোপ একটা চমৎকার নকশা তৈরি করেছে।

অনেক রকম পাখি দেখলাম। গায়ে ছিট ছিট Francolin, চকচকে নীল শরীরের Greater blue-eared starling, চোখের চারপাশে বাদামী কাজল-পরা Speckled pigeon, ইত্যাদি।


ফ্রাঙ্কোলিন ও আবিসিনিয়ান হর্নবিল


ব্ল্যাক-হেডেড গোনোলেক ও কারমাইন বী-ঈটার


ফিশ ঈগল ও জায়ান্ট কিংফিশার


পাম-নাট ভালচার ও সোয়ালো-টেইল্‌ড বী-ঈটার

খেজুর গাছে বসা White-backed vulture, লম্বা ও লোমশ গলার Griffon vulture, Ruppell’s vulture ছাড়া দেখলাম বড় বড় চোখের একজোড়া Grey kestrel ও সাপ-ভক্ষক Brown snake-eagle। লম্বা ঠোঁট ও বাহারি ঝুঁটির পরিচিত পাখি Hoopoe-কে দেখে বেশ আপন-আপন লাগল। মজা লাগল মাথায় খাড়াখাড়া চুল আর বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচির মতো তার লম্বা লেজ নিয়ে লাফালাফি করা Speckled mousebird দেখে। কয়েকটি তালগাছে অনেক তাল হয়ে আছে। একটা ন্যাড়া তালগাছে মা Abyssinian hornbill তার বাচ্চা নিয়ে বসে আছে আর বাবা-পাখি খাবার নিয়ে এসে মা-পাখিটিকে দিচ্ছে। এই কালো পাখির মাথায় মস্ত ঝুঁটি, বিশাল লাল ঠোঁট, চোখের চারপাশে নীলরঙের বৃত্ত আঁকা আর জপের থলির মতো গলায় খানিক গোলাপি চামড়া ঝুলে আছে।

ওখানে জিরাফ ও জেব্রা-ছাড়া অনেক নতুন প্রাণীরও দেখা পেলাম। যেমন, Waterbuck নামে এক ধরনের antelope যাদের কানের ডিজাইন ও পুরুষদের


পাটাস মাংকি ও স্যাডল-বিল্‌ড স্টর্ক

প্যাঁচালো শিং বেশ আকর্ষণীয়, সাভানা অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য Patas monkey আর সাদা দাড়িওয়ালা Vervet monkey। ঝোপের আড়ালে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো Oribi-কে দেখে আসিয়ো গাড়ি থামালেন।


ভেরভেট মাংকি ও ওরিবি

এরাও এক রকমের antelope কিন্তু এদের প্রাপ্তবয়স্করাও মাপে দিশি কুকুরের থেকে একটু ছোট হয়। পুরুষদের মাথার ছোট খাড়া খাড়া শিং দেখে হাট্টিমাটিম টিমের কথা মনে পড়ে যায়। খানিক যাওয়ার পর দর্শন পেলাম আরেক রকম antelope-এর যার নাম Jackson’s Hartebeest। এদের চেহারায় হরিণের থেকে যেন বাছুরের ছাপ বেশি। আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল চারটে নধরকান্তি ও বাঁকা দাঁতওয়ালা Warthog। এক জায়গায় Cape buffalo-র এক বিশাল দল রাস্তার পাশ থেকে সোজা আমাদের দিকে এগোতে লাগল। আমরা একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে যেতে, ওরাও থমকে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে চেয়ে রইল।


কেপ বাফেলো; এই জন্তুটির ঘন মেঘের মতো কালো রঙ

এই জন্তুটির ঘন মেঘের মতো কালো রঙ, বড় বড় চোখ, বাঁকানো শিং দেখলে যেমন ভয় লাগে তেমনি মাঝখানে সিঁথি কেটে চুল আঁচড়ানো গম্ভীর মুখটা দেখলে অকারণে হাসি পায়। রাস্তার দু'পাশে ঝোপ যার কোনোটিতে হয়ে রয়েছে টম্যাটোর মতো ফল, খুদে ঘাস ফুল, অচেনা সব ফুল পাতার গন্ধ, ছোট ছোট উইঢিপির মধ্যে দিয়েও পরিচয় হচ্ছিল ওই বিখ্যাত পার্কটির সঙ্গে।

লজ-এ ফিরে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় চুপ করে বসে সেই পাহাড়-ঘেরা বিস্তীর্ণ সাভানার বিশালতাকে উপভোগ করছিলাম। তবে, সেই অনুভূতিকে ছাপিয়ে অন্য এক আনন্দে মন ভরে গেল একটু পরে যখন ব্যাগ-এর মধ্যে একজোড়া কাচা মোজা আবিষ্কার করলাম!

বিকেলের সাফারির সময় চড়া রোদ হ’লেও হাওয়াটা গরম হয়নি। ওখানে Euphorbia candelabrum নামে একরকম বিশাল ক্যাকটাস দেখতে পাওয়া যায় যার ডালগুলো গুচ্ছ হয়ে ওপর দিকে উঠে ছড়িয়ে যায়। চেনা পাখি Roller বা নীলকণ্ঠ, Little egret ও Glossy ibis ছাড়া দেখলাম মস্ত White-headed vulture ও বাদামি রঙের পাখি Hamerkop যার লম্বা ঠোঁট ও ছুঁচলো মাথার জন্য ওড়বার সময় তাকে হাতুড়ির মতো দেখতে লাগে।


মনিটর লিজার্ডের সারা গায়ে সাদা ফুটকি দিয়ে কী সুন্দর ডোরা কাটা!

জলের ধারে এক ৪-৫ ফিট লম্বা Nile monitor lizard পাথরের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে রোদ পোহাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে সরু জিভ বের করছিল। তার সারা গায়ে সাদা ফুটকি দিয়ে কী সুন্দর ডোরা কাটা! সাফারি শেষ হ’ল একপাল হাতি দেখে। আফ্রিকান হাতি আমাদের দেশের হাতির থেকে আকারে বড় ও তাদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দাঁত থাকে। এই দলটিতে নারী-পুরুষ-শিশু সবই ছিল। লজে ঢোকবার সময় খেয়াল করলাম যে তার সাইনবোর্ডের ওপর রাখা একটা মোষের খুলি। দেখলেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগে।

রাত্রের খাবারে ছিল পাম্পকিন স্যুপ, বেক্‌ড বীন অন টোস্ট, তিলাপিয়ার ফিশ ফিঙ্গার আর বানানা ফ্রিটার্স উইথ চকলেট সস্‌। খাওয়াদাওয়া সেরে সেই নিকষ কালো অন্ধকারে, টিলার ওপর থেকে আমরা অনেকক্ষণ মন দিয়ে আকাশ দেখলাম। আমার কর্তা আমাদের কালপুরুষ, তার পায়ের কাছে থাকা Canis major ও তার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র Sirius, Cassiopeia ইত্যাদি চেনাচ্ছিলেন। তবে আমরা যা দেখে সবথেকে মুগ্ধ হ’লাম তা হ’ল ছায়াপথ। অমন স্পষ্ট ছায়াপথ দেখবার সুযোগ তো সহজে পাওয়া যায় না। আবারও রিসর্ট-এর ছেলেরা টর্চ নিয়ে আমাদের যার যার টেন্ট-এ পৌঁছে দিয়ে গেল। চান্দ্রেয়ী একটু সঙ্কোচের সঙ্গে ওর চলনদার বালকটিকে বলল, ‘তারা দেখতে দেখতে দেরি হ’য়ে গেল।’ সে গম্ভীরভাবে জানতে চাইল, ‘তোমরা কোন দেশ থেকে এসেছ?’

--‘ভারতবর্ষ’।

বালক সামান্য ঠাট্টার সুরে বলল, ‘ওখানে আকাশে তারা নেই?’

--‘আছে কিন্তু শহরের আলো ও ধুলোর জন্য আমরা দেখতে পাই না।’

বালকটি প্রত্যয়ী কন্ঠে বলল, ‘আমরা তো রোজ আকাশভরা তারা দেখি!’


পর্ব ২

ভোরে অল্পস্বপ্ল পাখির ডাক শুনছিলাম তাই সকালে উঠে তাদের দেখতে পাবার আশায় লজ-এর মধ্যের শুঁড়িপথ ধরে হাঁটতে বেরোলাম। কোনো পাখি একই সুরে ডেকে চলেছে, কারোর ডাকের মাঝে মাঝে যেন মিষ্টি সুরের কথা রয়েছে কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। দিনের প্রথম আলোয় উপত্যকা আস্তে আস্তে আলোকিত হ’চ্ছে, পরিষ্কার নীল আকাশে মেঘের ছোঁয়াটুকু মাত্র রয়েছে। যতদূরেই দৃষ্টি ছড়িয়ে দিই না কেন সাভানার ঘাস আর কাঁটাঝোপ ছাড়া অনেক দূরে দূরে থাকা আকাশিয়া ও অন্যান্য কয়েকটি গাছ ছাড়া আর কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। আমাদের থেকে অনেকটা দূরে নীচে আরেকটি লজ আছে। শহুরে মানুষের এমন অবাধ দৃষ্টিপাতের সুযোগ তো সহজে আসে না তাই টিলার ওপর থেকে চারদিকের সেই বিস্তৃতি প্রাণভরে দেখছিলাম। পরে আমার সঙ্গীদের কাছে জানলাম যে শেষ রাতে তারা সিংহের ডাক শুনেছে।

সকাল সকাল রওনা হলাম মার্চিসন ফলস ন্যাশানাল পার্ক-এর উদ্দেশ্যে। গাড়ি ছাড়বার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মোজার ওপর দিয়ে পায়ে হুল ফোটার যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করে উঠলাম। তখন দেখা গেল গাড়ির মধ্যে একটা বড় মাছি উড়ে বেড়াছে। আসিয়ো নির্বিকার ভাবে জানালেন যে সেটি Tsetse মাছি। কাগজ দিয়ে তাকে তো মারা হ’ল কিন্তু জ্বালাটা সহজে গেল না। তার সঙ্গে মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা বিজবিজ করতে লাগল, ‘মাছিটা রোগের জীবাণু আনেনি তো!’

পাহাড়ি পথেও দেখছি কলাবাগান! এছাড়া, অনেক তুলো গাছে তুলো হয়ে আছে। ছোট বসতিতে আছে পাতার ছাউনি দেওয়া গোল গোল কুটির। মাটি-পাথরের রাস্তায় চলেছি যেখানে মাইলের পর মাইল ইলেকট্রিক-এর খুঁটি পোঁতা আছে কিন্তু কোনো তার নেই। বরং কুটির, একতলা বাড়ি বা দোকান ইত্যাদির সামনে হেলিয়ে রাখা ছোট ছোট সোলার প্যানেল থেকে লম্বা তার ঘরের ভেতরে গিয়েছে। সরকার ও NGO-রা এদের এই প্যানেল ব্যবহার করা শেখায় যাতে নিজেদের প্রয়োজনের বিদ্যুৎটুকু তারা তৈরি করে নিতে পারে। এছাড়া, জিনজা অঞ্চলে নীলনদ থেকে হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার তৈরি হয়।


মাথায় জলের পাত্র নিয়ে কয়েকটি দল হেঁটে যাচ্ছে

বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যেখানে কোনো বসতি নেই, তেমন পথে হঠাৎ হঠাৎ এক-দু’জন মানুষকে হাঁটতে দেখলে অবাক হয়ে ভেবেছি যে তারা কত দূর থেকে আসছে কে জানে! তেমনি এক জায়গায় রাস্তার পাশে এক টিউবওয়েল থেকে হলদে রঙের আয়তাকার প্লাস্টিক-এর পাত্র হাতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে-পুরুষ জল নিচ্ছে। আমাদের গাড়ি এগোতে দেখলাম মাথায় জলের পাত্র নিয়ে কয়েকটি দল হেঁটে যাচ্ছে। ওইটুকু জলের জন্য তাদের ক’ঘন্টা দাঁড়াতে হয়েছে ও কতোক্ষণ হাঁটতে হয়েছে তাও আমার জানা হ’ল না! কখনো এলো তুলোর গুদামের সামনে তুলো ওজন করানোয় ব্যস্ত লোকজন আবার কোথাও আকাশিয়া গাছের নিচের হাটে রঙিন জামাকাপড়ের পসরা নিয়ে মানুষের ভিড়। এছাড়া, দেশের অনেক জায়গায় দেখেছি চৈনিক উদ্যোগে নানারকম উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে।

লাঞ্চের জন্য আমরা Kitgum বলে দেশের উত্তরের এক শহরে থামলাম। নতুন ঘর বাড়ি, চওড়া পাকা রাস্তা, ট্রাফিক সার্কেল দেখে বোঝা যায় যে সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। পথ চলতে ধনী-দরিদ্র সকলের যে বাড়ি দেখছি তার মূল কাঠামো হ’ল চৌকো বা আয়তাকার যার সামনের দিকে পিলারের ওপর ঢাকা-বারান্দা। যাহোক, আসিয়ো আমাদের একটি সুন্দর রিসর্ট-এর রেস্টুরান্ট-এ নিয়ে গেলেন। সেখানকার খাদ্য-তালিকায় শুধুই ভিন্ডি মসালা, কাশ্মীরি আলুর দম, চিকেন মসালা, ইত্যাদি ভারতীয় রান্না দেখে আমি তো অবাক! আমি চমৎকার স্বাদের বীফ কারি ও হালকা ফুলের গন্ধের ভাত খেলাম।

প্রথমে ভালো রাস্তা ও একটু পরে শালবনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া পাহাড়ি পথে নিচের উপত্যকা দেখতে দেখতে ওপরে উঠতে লাগলাম। দু’ঘন্টায় উত্তরের সবচেয়ে বড় শহর গুলু (Gulu) পৌঁছে গেলাম। সেখানকার Sir Samuel Baker School ওদেশের প্রথম ইওরোপিয়ান স্কুল। ওই ভদ্রলোক একই সঙ্গে এঞ্জিনীয়ার, শিকারী, অভিযাত্রী ও সর্বোপরি দাসপ্রথা বিলোপের আন্দোলনে এক পথিকৃৎ ছিলেন। তাঁর জীবনের নানা রোমহর্ষক কাহিনী এককথায় অবিশ্বাস্য। যাহোক, শহরের ঝকঝকে ঘরবাড়ি, গলফ ক্লাব, অফিস-কাছারি, বড় বড় গাছে-ছাওয়া রাস্তা দেখতে দেখতে গুলু ছেড়ে চললাম। হঠাৎ, আমাদের পাশে দেখি এক জেলখানা। তার কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলাম যে বাসন্তী রঙের পোশাকপরা কয়েদীরা খেলার মাঠে নামছে।

রাস্তায় মাঝে মাঝে দেখছি লোকজন জিনিসপত্র নিয়ে বাস স্টপ-এ অপেক্ষা করছে। কে জানে কখন সেখানে বাস আসে কারণ আমরা পথে তো কোনো বাসের দেখা পাইনি। আবার কোথাও দেখছি মাথায় বোঝা নিয়ে কয়েকটি লোক হাঁটছে বা ‘টু হুইলার’ চলছে কিন্তু সারা পথে আর প্রায় কোনো গাড়ি দেখিনি। পথের দু’পাশের ঘন সবুজের সমারোহে ঝাউ, খেজুর, কলাগাছ পাশাপাশি রয়েছে। গ্রামীণ বাজারে স্তূপ করে সোলার প্যানেল বিক্রি হচ্ছে। বিরাট এক চিনির কারখানা ও চাল কল পার হ’লাম। অনেক জায়গায় রাস্তার পাশে ধান শুকোনো হচ্ছে।

সন্ধের মুখে বিরাট চওড়া নীলনদ দেখতে পেলাম। এখানে তার নাম Albert Nile. তার ওপরের ব্রিজ পেরিয়ে Pakwach নামে দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের আরেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এলাম আমাদের ব্যাগ উদ্ধার করতে। হারানিধি ফিরে পেয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার সেই ব্রিজের ওপর দিয়ে যখন যাচ্ছি, সূর্যাস্ত হচ্ছে।


প্রচুর শুঁটকি ও ভাজা মাছ বিক্রি হ’চ্ছে

রাস্তায় প্রধানত Nile perch-এর প্রচুর শুঁটকি ও ভাজা বিক্রি হ’চ্ছে। আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম মার্চিসন ফলস ন্যাশানাল পার্ক-এ। উগান্ডার দশটি ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে আয়তনে এটি যে সবথেকে বড় তাই শুধু নয়, ওখানে আফ্রিকার প্রধান সব ক’টি স্তন্যপায়ী প্রাণীও পাওয়া যায়। ওই পার্কে ঘাসজমির সঙ্গে সঙ্গে ঘন জঙ্গলও আছে এবং তার প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই মার্চিসন ফলস. ১৮৬২ সালে দুজন ইওরোপিয়ান প্রথম এই অঞ্চলে আসেন কিন্তু ১৮৬৩-৬৪ সালে খুব বিশদে অঞ্চলটি পরিদর্শন করার কৃতিত্ব Samuel Baker ও তাঁর স্ত্রী Florence Baker-এর। Royal Geographical Society-র তৎকালীন প্রেসিডেন্ট Roderick Murchison-এর সম্মানে নীল নদের বিখ্যাত Murchison Falls নামটিও Baker-এরই দেওয়া।

পার্কে ঢুকতেই একটু দূরে দূরে বসে ছিল Warthog, Olive baboon, Water buck, Hartebeest-এর দল। মনে হচ্ছিল যেন তারা আমাদের অভ্যর্থনা করতে এসেছে। সেখানে আমাদের দু’রাতের আশ্রয় Pakuba Lodge-এ অতিথির সংখ্যা দেখে বুঝলাম যে ওই পার্কটি কতোটা জনপ্রিয়।

সকালে আলো ফুটতেই আমরা সাফারিতে বেরোলাম। আকাশে কালো মেঘ। মাটির পথে Game reserve-এর মধ্যে দিয়ে চলে ঘন্টাখানেকের মধ্যে বেশ কিছু পশু-পাখি দেখে ফেললাম। পাখিরা হল বিরাট Hornbill, লম্বা নখ-ওয়ালা হলদে রঙের Yellow-throated longclaw, White-breasted kingfisher, Brown snake eagle ও এক পত্রহীন গাছে এক ঝাঁক হুল্লোড়ে Piapiac. তার কাছেই আরেকটি নিষ্পত্র গাছে উদাসীন মুখে লেজ ঝুলিয়ে বসে ছিল এক Savannah monkey। দেখা পেলাম


জাতীয় পশু 'উগান্ডান কব'

দেশের জাতীয় পশু Ugandan kob-এর মেয়ে-পুরুষের বড় একটি দলের। এরাও এক ধরনের antelope যার পুরুষদের বাঁকানো শিং পেছন দিকে গিয়ে ছড়ানো থাকে। একটা হাতি আপনমনে হেঁটে গেল। এক জায়গায় একদল জিরাফ নিশ্চিন্তে গাছের পাতা খেয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে নীলনদ দেখতে পাচ্ছি আর নাকে আসছে জঙ্গলের গন্ধ। আসিয়ো বলছেন যে ওদেশে Mamba, Adder ইত্যাদি সাপ থাকলেও তাদের খুব বেশি দেখা যায় না।

সকলেই আমরা বেশ হালকা মেজাজে। হঠাৎ দেখা গেল রাস্তা ধরে একটি দাঁতাল হাতি সোজাসুজি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আসিয়ো আস্তে আস্তে গাড়ি পেছোতে লাগলেন কিন্তু হাতি একই ভাবে এগোতে লাগল। তার ভাবগতিক দেখে আসিয়োর মনে হ’চ্ছিল যে সেটি বেশ রাগী পুরুষ হাতি। এবারে হাতিটি রাস্তা ছেড়ে পাশের গাছপালার মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল। আসিয়ো গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে গজরাজের সরে যাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন কিন্তু হাতির তেমন কোনো বাসনা আছে বলে মনে হ’ল না।

মিনিট পাঁচ-সাত ওভাবে কাটবার পর, যেন তার শক্তির পরিচয় দিতেই, হাতিটি দুই দাঁতের মাঝে একটা গাছ ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল।


হাতিটি দুই দাঁতের মাঝে একটা গাছ ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল

তারপর, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে তার মস্ত কান দু’টি নাড়াতে লাগল। তখনি দেখা গেল গাড়ির মধ্যে একটা Tsetse মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে আর পাশের গাছে বসে আছে সুন্দর রঙিন এক Gonolek পাখি। পাখি দেখবো কি, বিপজ্জনক মাছি আর পাগল হাতির দিকেই তখন আমাদের মন!

প্রায় সাত-আট মিনিট ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকবার পর হাতিটি হঠাৎ পেছনে ফিরল আর তাই দেখে আসিয়ো জোরে জোরে তালি বাজাতে লাগলেন। তারপর, উনি একটা প্লাস্টিক-এর খালি জলের বোতল মুচড়ে কচকচ আওয়াজ করতেই হাতি আমাদের দিকে পেছন করে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে লাগলো। অল্পক্ষণ আসিয়ো ওইভাবে আওয়াজ করতে করতেই ধীরগতিতে গাড়ি এগোলেন। অবশেষে, একসময় হাতি দাঁড়িয়ে আমাদের ভাল করে দেখে ভেতরে চলে গেল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

এরপর যেসব পাখি দেখলাম তা হ’ল উজ্জ্বল হলুদ রঙের Yellow wagtail, লাল পুঁতির মতো চোখে কাজল-পরা Yellow-throated green bee-eater, চকচকে নীল রঙের Long-tailed starling ছাড়া দু’টো Palm-nut vulture। তাদের কালো শরীর, সাদা মাথা ও ডানা আর চোখের রঙ নিয়ে বেশ আকর্ষণীয় চেহারা।


আফ্রিকার হাতি, এশিয়ার হাতির চেয়ে অনেক বড়

নানারকম পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। আমরা পশু-পাখি দেখার আশায় এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, তখনি কয়েকটি হাতি এসে আমাদের পথ আটকে দাঁড়াল। আসিয়ো গাড়ি থামালেন। দলের সামনেরটি পতপত করে কান নাড়াচ্ছে আর স্থির দৃষ্টিতে আমাদের গাড়ির দিকে চেয়ে আছে। সে যেন আক্রমণের পদ্ধতি ছকে নিচ্ছে। আর এদিকে আমরা শক্ত হয়ে বসে আছি। বেশ খানিকক্ষণ এমন চলবার পর আসিয়ো গাড়ি স্টার্ট করলেন। তাতেও একজন সরলে আরেকজন পথে আসে। খুব ধীরগতিতে গাড়ি চলল। অবশেষে, গাড়ির আওয়াজেই বোধহয় তারা পথের থেকে সরল কিন্তু পাশের জঙ্গলে গিয়ে একজন গগনবিদারী একটা হাঁক দিল। মনে হ’ল, তাদের রাজত্বে ঢুকে আমরা যে অন্যায় করেছি সেই বিরক্তিটা প্রকাশ করল।

আরো ঘন্টা তিনেক ঘুরে আমরা Oribi, Hartebeest ও অনেক সুন্দর সুন্দর পাখি দেখলাম। সবুজ রঙা Swallow-tailed bee eater, চোখে কালো পট্টি লাগানো Grey-backed fiscal shrike, লাল রঙের Red bishop, পুরু লাল ঠোঁটের Red-billed quelea, নীল মাথা Carmine bee eater, Griffon vulture ও White-backed vulture ইত্যাদি ছাড়া জলে ছিল Purple heron, দীর্ঘচঞ্চু Sand piper ও সাবধানী পা ফেলে হেঁটে যাওয়া উজ্জ্বল-বাদামী Jacana।


টুরাকো ও ক্রাউন্ড ক্রেন

অবশেষে, নীল নদের ধারে বিরাট বড়, সুন্দর সবুজ এক ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড-এ এলাম যেখান থেকে মার্চিসন ফলস দেখতে যাবো। বড় এক গাছের ছায়ায় বসে আমরা যখন সঙ্গে-আনা খাবার খাচ্ছি, পাশের জঙ্গল থেকে এক দাঁতাল হাতি এসে একটা কলকে ফুলের গাছকে মুড়িয়ে খেতে লাগল। তার কাছেই এক গাছে বিশালদেহী এক Marabou stork উড়ে এসে বসল। এই পাখির আকার দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন যে তারা আদৌ উড়তে পারে!

স্থানীয় কয়েকটি ছেলে একটা গাছের ডালকে U-এর মতো আকারে বাঁকিয়ে তাতে নাইলনের তার লাগিয়ে বানানো একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিল। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে চমৎকার সেই বাজনা শুনলাম। পার্কে অনেক Sausage tree যার বড় ও ভারী ফল হাতির খুব প্রিয়। মানুষও ওষুধ হিসেবে আর অ্যালকোহল বানানোর জন্য এর ব্যবহার করে।


বিখ্যাত মার্চিসন ফলস-এর দিকে চলেছি

লঞ্চে করে আমরা নদীর দুই পারের ও জলের প্রাণী দেখতে দেখতে Victoria Nile-এর বিখ্যাত মার্চিসন ফলস-এর দিকে চলেছি। সেখানে যাওয়া-আসায় তিনঘণ্টা লাগে। আমি অবশ্য আমাদের দলের ছোট-দু’জনের উৎসাহে তাদের সঙ্গে এক অভিযানে যাব ঠিক করেছি।

প্রশস্ত সেই বেগবতী নদীর ওপর থেকে দু’ধারের চোখ-জুড়োনো সবুজ ও পাহাড় দেখতে কী যে ভালো লাগছিল! লঞ্চ ছাড়া জলে ছোট নৌকোও রয়েছে। গাইড মাইকে জানাচ্ছেন কোথায় কী দেখা যাচ্ছে। প্রথমে জলে শুধু একটি জলহস্তীর মাথা দেখা গেল কিন্তু তারপর দেখি সেখানে একপাল জলহস্তী খেলা করছে। তাদের মধ্যে পালের গোদা পুরুষটি মনের আনন্দে জল ছেটাচ্ছে। মাঝখানে এক ছোট সবুজ-দ্বীপ এল। তারপর, গাছের ওপর African fish eagle ও এক পাল হাতি ছাড়া বিশেষ কিছু দেখা যাচ্ছিল না। পারের কাদার মধ্যে Nile crocodile-এর বিরাট মাথাখানা দেখেই দর্শকরা বেশ হই হই করে উঠল। এক পাহাড়ের খাড়া ও ন্যাড়া গায়ে দেখি প্রচুর ফুটো। শুনলাম যে তারমধ্যে ছোটগুলো হ’ল Pied kingfisher-এর আর বড়গুলো Griffon vulture-এর বাসস্থান।

নীলনদের ওপর থাকার সময় তার জন্মের কথা একটু বলে নিই। ৬৬৫০ কিমি লম্বা নীলনদ এক উত্তরমুখী নদী যা পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও নিঃসন্দেহে এটি আফ্রিকার দীর্ঘতম নদী যার অববাহিকায় রয়েছে এগারোটি দেশ। দু’টি প্রধান নদী White Nile ও Blue Nile-এর সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে নীলনদ। এই White Nile-এর ভিন্ন অংশে ভিন্ন নাম; যেমন, ভিক্টোরিয়া লেক থেকে উৎপন্ন নদীটি পরিচিত ‘ভিক্টোরিয়া নাইল’ নামে। নানা পথ ঘুরে ৫০ মিটার চওড়া নদীটি এসে মার্চিসন ফলস-এ মাত্র ৭ মিটার প্রশস্ত এক গিরিকন্দরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে ৪৫ মিটার নিচে এসে সতেজে বয়ে গিয়ে লেক অ্যালবার্ট-এ মেশে। আবার সেই লেক থেকে বেরিয়ে যখন সে প্রবাহিত হয় তখন সে পরিচিত অ্যালবার্ট নাইল নামে। অন্যদিকে, ইথিওপিয়ার Lake Tanna থেকে উৎপন্ন ‘ব্লু নাইল’ সুদানের খারতুমে এসে ‘হোয়াইট নাইল’-এর সঙ্গে মিলিত হয়ে নীলনদ নামে আরো উত্তরে মিশরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে পড়ে।

(এর পরে)




(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)