আরেকটু এগিয়ে পাহাড়ের গায়ে একজায়গায় লঞ্চ থামল। আমরা ক’জন অতি উৎসাহী পাহাড়ি পথে ফল্স্-এর ওপর অবধি হাঁটা শুরু করলাম আর মামী ও আমার কর্তা সেই লঞ্চ-এই ফিরে গেলেন। একজন গাইড এলেন আমাদের সঙ্গে। রসিক সেই যুবক বললেন যে এই ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘন্টার হাঁটায় তিনটি ভাগ – ‘Warming up, gym and shower.’ ভিন্ন স্তরে ছ’টি জায়গা থেকে মার্চিসন ফলস-কে দেখা যাবে। তাকে বাঁপাশে রেখে, জলের গর্জন শুনতে শুনতে আমাদের সরু পাথুরে পথে ওঠা শুরু হ’ল। গাছপালায় ভর্তি চারপাশ। আমাদের দলের জনা বারোর মধ্যে আমরা তিনজন ভারতীয় ছাড়া, এক মা ও তার দুই বাচ্চা আর তিন-চারটি শ্বেতাঙ্গ যুগল রয়েছে। এইরকম আরো কয়েকটি দল চলেছে। প্রথমে তো খুব উৎসাহ; খানিক হাঁটছি আবার একটু থেমে ছবি তুলছি। এভাবে খানিক উঠে দেখলাম জলের দিক থেকে একটি শুঁড়িপথ আমাদের পথে এসে মিশেছে। সেটি দেখিয়ে নির্বিকারভাবে গাইড বললেন, ‘জলহস্তীরা সাধারণত জল থেকে এই পথে উঠে আসে।’ আরেকটি জায়গা থেকে সরু ও এবড়োখেবড়ো পথে নেমে গেলে কাছ থেকে জলপ্রপাতটি দেখা যায় অর্থাৎ সেটি একটি ‘View point’। সেই পথে একটু এগিয়ে আমি ভয় পেলাম যে ওই ভেজা ও অসমান রাস্তায় আমি পড়ে যেতে পারি। তাই আমার পেছনের তরুণীটিকে জায়গা করে দিয়ে বললাম, ‘আমি ওদিকে আর যেতে পারব না। তোমরা এগিয়ে যাও।’ মেয়েটি এগিয়ে গেল কিন্তু তার সঙ্গী যুবকটি একটু হেসে আমার হাত ধরে View point অবধি নিয়ে গেল। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছিল লালচে ঘোলা জল কেমন গমগম আওয়াজ তুলে প্রচণ্ড ব্যস্ততায় এক স্তর থেকে আরেক স্তরে নামছে। অপরূপ সে দৃশ্য! যুবকটিকে বারবার ধন্যবাদ জানালাম। পথে কঠিন জায়গায় ওই যুবক, অন্য সঙ্গীরা বা গাইড আমার হাত ধরে পার করে দিয়েছেন।
চলার পথে একজায়গা থেকে আরেকটি জলপ্রপাত দেখলাম যাকে নিচ থেকে দেখা যায় না ও তার নাম Uhuru ফল্স। উগান্ডার স্বাধীনতার বছর ১৯৬২ সালে বন্যার সময় ভিক্টোরিয়া নাইল-এর এই নতুন জলপ্রপাতটি তৈরি হয় ও তাই তার নাম Uhuru বা স্বাধীনতা। Uhuru-র সৃষ্টির ফলে মার্চিসন ফলস-এর তেজ নাকি একটু কমেছে। শুনে হাসি পাচ্ছিল যে এই নাকি কম তেজের নমুনা!
অনেকটা পথে রেলিং দেওয়া আছে, কোথাও বা চওড়া ধাপ কাটা। ‘Gym’ বা খাড়া পথটিতে উঠতে হাঁফ ধরছিল, দরদর করে ঘামছিলাম কিন্তু আমি না থেমে মনের জোর করে এগিয়ে গিয়েছি। পথের যে জায়গায় অনেকটা ঢালু, তার একাংশে বসে বসে নেমেছি। জলপ্রপাতটির ভিন্ন ভিন্ন ধাপে সবেগে জল নামছে। ওপর থেকে সেই উন্মত্ত নদীর সরু গিরিকন্দরের মধ্যে দিয়ে নেমে যাওয়া দেখতে কী যে এক অবিশ্বাস্য রকম সুন্দর লাগছিল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সেই উদ্দাম চলা আর শুনছিলাম তার গর্জন। মনে হচ্ছিল যেন শাসন-না-মানা জেদী এক মেয়ে সব বাধা অগ্রাহ্য করে নিজের শক্তি দেখাতে ছুটে চলেছে।
চলার পথে দেখছিলাম যে ওখানকার পাথরে মাইকা থাকায় রোদ পড়ে তা কেমন চকচক করছে। খানিকক্ষণ চমৎকার একটা লালফড়িং উড়ে উড়ে আমাকে সঙ্গ দিচ্ছিল। কিন্তু সেসব দিকে বিশেষ মন না দিয়ে রাস্তায় মন দিতে হচ্ছিল কারণ পাথরের ওপর কোথাও শিকড় আবার কোথাও পাতার আস্তরণ। Gym শেষ হতে পথের ধারে একটু বসে নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে গাইড বললেন যে Sleeping sickness-এর থেকে বাঁচাতে ওই অঞ্চলের রাজার আদেশে ১৯০৭ থেকে ১৯১২-র মধ্যে ১৩,০০০ স্কোয়ার কিমি অঞ্চলের সমস্ত অধিবাসীকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়। এখনো মাঝে মাঝে গাছের গায়ে Tsetse ট্র্যাপ যাতে নিচে নীল ও কালো কাপড়ের ফানেল যার ওপরে উল্টে বসানো সাদা কাপড়ের ফানেল। মাছিরা তাদের খাবার ভেবে নীল ও কালো রঙে আকৃষ্ট হয়ে ভেতরে ঢোকে। কাছে গেলে খাদ্য যে নয় তা বুঝে ওপরে সাদা ফানেলের ফুটো দিয়ে ঢুকে ভেতরে গিয়ে আটকে যায়। গাইড একটা জায়গাকে forest trail বলছিলেন যার বড় বড় গাছের মধ্যে তেঁতুল গাছও রয়েছে ও পথের ওপর বেশ কিছু পাকা তেঁতুল পড়ে আছে। বয়স্ক শ্বেতাঙ্গরা অনেকে একটি বা দু’টি লাঠি নিয়ে হাঁটছেন। মনে মনে ভাবলাম আমারও ওইভাবে তৈরি হয়ে আসা উচিত ছিল।
তৃতীয় স্তরে মানে shower পর্বে হাঁটাটা সহজ হ’ল। যখনি ওপরের দিকের ভিউ পয়েন্ট-এ জলের কাছে যাচ্ছিলাম, সত্যিই জলের ছাঁট এসে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল। পাহাড়ের একদম ওপরে যেখানে পাথরের ওপর দিয়ে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সবেগে নদী বয়ে আসছে, সেই উত্তাল জলের ধারে, নানাভাবে বসে বা দাঁড়িয়ে অনেকে ছবি তুলছিল। সকলের দেখাদেখি আমিও সেদিকে এগিয়ে গেলাম কিন্তু অত কাছ থেকে সেই বাঁধনহীন জলকে দেখে বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর সাহস পেলাম না। অমন ভয়ঙ্কর-সুন্দর দৃশ্য দেখবার সুযোগ জীবনে বারবার যে আসে না সেকথা ভাবতে ভাবতে জঙ্গলের মধ্যে আরেকটু হেঁটে এগোতেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষারত আসিয়োকে দেখে কী যে স্বস্তি পেলাম! তখন, যদিও ঘামে-জলে ভেজা শরীর খুবই ক্লান্ত কিন্তু ওই অপরূপ জলরাশিকে দেখে মন বড় তৃপ্ত। অনেকটা ঘুর-পথে গিয়ে ও গাড়ি-শুদ্ধু ফেরি পার হয়ে পার্কে পৌঁছলাম, যেখানে কর্তা ও মামী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
পর্ব ৩
সেদিন ক্রিসমাস। অন্ধকারের মধ্যে রওনা হ’লাম Kibale Forest ন্যাশানাল পার্ক-এর দিকে। সেদিনও আকাশে কালো মেঘ ও হাওয়ায় ঠান্ডার ছোঁয়া। সরু মাটির পথের দু’দিকে উঁচু ঘাস। কোথাও এক সঙ্গে কয়েকটি কুটির নিয়ে বসতি, কোথাও বা সেই টিউবওয়েল-এর পাশে হলদে প্লাস্টিক-হাতে মানুষের ভিড় আবার কোথাও চারদিক আলো করা কলকে ফুলের মেলা।
বেলা দশটা নাগাদ পৌঁছলাম দেশের পশ্চিমের উল্লেখ্য শহর HOIMA-তে। গাছপালা-ঘরবাড়ি নিয়ে জায়গাটির সঙ্গে বাংলার গ্রামের অদ্ভুত সাদৃশ্য পাচ্ছিলাম। যাহোক, আমাদের toilet-এর দরকার ছিল বলে আসিয়ো সরকার-পরিচালিত এক ওষুধের দোকানের সামনে গাড়ি থামালেন। য়্যুনিফর্ম-পরা দোকানী-মহিলাকে আসিয়ো আমাদের প্রয়োজনের কথা বলতে তিনি দোকানের পেছনে তাঁর বাড়িতে আমাদের নিয়ে গেলেন। toilet মানে অন্ধকার এক ছোট ঘরের মাঝখানে মেঝেতে একটি গর্ত। ব্যবস্থাটি অসুবিধের কিন্তু তার থেকেও বেশি অস্বস্তিকর ও আতঙ্কের তার ঠিক পাশের একটা ছোট ঘর থেকে আসা রাগী কুকুরের রক্ত-হিম-করা গর্জন। অপরিচিত গন্ধে সে পাগলের মতো ডাকছে আর মাঝে মাঝে তার বন্ধ দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে সামান্য মাথা বের করে দাঁত দেখিয়ে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে। মহিলা ইংরিজিতে ‘সিম্বা, চুপ করো, চুপ করো’ বলছেন বটে কিন্তু সিম্বা সেকথা শোনবার ‘পাত্তর’ নয়। আমাদের তো ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। তবে, যখন শুনলাম যে সারাদিন ওকে এইভাবে আটকে রেখে রাত্রে বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন সিম্বার জন্য কষ্টই হ’ল।
আরো কিছুক্ষণ চলার পর দেখি পাশে পাহাড় ও তার গায়ে অবিশ্বাস্য-রকম বিশাল লেক অ্যালবার্ট কিন্তু রাস্তাটা এমন খাড়াভাবে লেক অবধি গিয়েছে যে গাড়ি নিয়ে সেপথে যাওয়া অসম্ভব। গাড়ি থামিয়ে আমরা যখন কীভাবে নিচে যাওয়া যায় তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি, হঠাৎ এক মাতাল-সহ বেশ কিছু স্থানীয় লোকজন আমাদের ঘিরে ধরে নানারকম উপায় বলতে লাগল। অবশেষে আমরা লেক-দর্শন শিকেয় তুলে গাড়ি ঘুরিয়ে একই পথে ফিরে চললাম।
রাস্তার দু’ধারে পরপর Grasshopper trap. এই ব্যাপারটা সম্বন্ধে একটু বলি। ওদেশের একটি প্রিয় খাবার হ’ল ভাজা বা কাঁচা Grasshopper (Nsenene) যা তারা স্ন্যাক্স হিসেবে বা খাবারের সঙ্গে খায়। বর্ষাকালে এই পতঙ্গটিকে ধরবার জন্য এক অভিনব ব্যবস্থা সারা দেশে রয়েছে। বেশ লম্বা কয়েকটি ঢেউ-খেলানো ধাতব পাত কাত করে সার দিয়ে রাখা। পাতগুলোর নিচের অংশ এক একটি বড় ড্রামে ঢোকানো থাকে আর তাদের থেকে একটু ওপরে জ্বলে খুব উজ্জ্বল আলো। পতঙ্গ-শিকারীরা কাঁচা ঘাস জ্বালিয়ে ধোঁয়া দেয় যাতে আলোর দিকে ধেয়ে যাওয়া এই পতঙ্গরা ধোঁয়ায় বেতাল হয়ে ধাতব পাতে ধাক্কা খেয়ে ড্রামের মধ্যে পড়ে। খানিক বাদে বাদে তাদের ড্রাম থেকে নিয়ে বস্তায় রাখা হয়। সাধারণত, ডানা ও পা ছিঁড়ে নিয়ে পেঁয়াজ-সহযোগে তার নিজেরই তেলে এই grasshopper ভাজা হয়। বাজারে বিক্রি করা ছাড়া ট্রাফিক সিগন্যালেও এই মুখরোচক খাদ্যটি বিক্রি হয়।
উগান্ডায় যে প্রায় পাঁচ হাজার শিম্পাঞ্জি আছে তার মধ্যে ১৫০০ আছে এই পার্কে। গবেষণার জন্য ও পর্যটনের উদ্দেশ্যে এখানকার কিছু শিম্পাঞ্জিকে মানুষের সংস্পর্শে আসায় অভ্যস্ত করা হয়েছে। শিম্পাঞ্জিরা সামাজিক প্রাণী ও তারা যে দলে থাকে তাতে ২০ থেকে ১৫০ জন সদস্য থাকতে পারে আর দলের প্রতিটি সদস্যের নির্দিষ্ট পদমর্যাদা থাকে। প্রতিটি দলের দায়িত্বে থাকে একটি পুরুষ শিম্পাঞ্জি। মহিলা শিম্পাঞ্জিরা নিজের দল ছেড়ে অন্য দলে যেতে পারে ও কিছুদিন পরে পুরনো দলে আবার ফিরেও আসতে পারে। সমস্যা হয় তখন যদি তার কোনো সন্তান থাকে। কারণ তাকে পুরনো দলের পুরুষরা খেয়ে ফেলে।
এরা নানারকম আওয়াজ ক’রে ও নানা ভঙ্গির মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে। আসলে, শুধু যে gene-এর গঠনের দিক থেকে শিম্পাঞ্জিরা মানুষের সবথেকে কাছের প্রাণী তাই নয়, তাদের উন্নতমানের বুদ্ধির প্রকাশ দেখা যায় তাদের এই ভাব আদানপ্রদান করার ক্ষমতা ও যন্ত্র (tools) ব্যবহারের প্রাথমিক কুশলতায়।
সেই রাত্রে আমার খুব জ্বর এল। ওষুধপত্রের জোরে তাকে বাগে এনে ভোর হতেই চললাম শিম্পাঞ্জি-দর্শনে। জঙ্গলের মধ্যে পর্যটক কেন্দ্রে পৌঁছে আবার আমাদের শিরে বজ্রাঘাত! ট্রাভেল এজেন্ট ও আসিয়োর ভুলে আমাদের পাঁচজনের জন্য তিনটি মাত্র পারমিট-এর ব্যবস্থা রয়েছে। আসিয়ো প্রচুর চেষ্টা করেও সেই সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারলেন না। আমাদের মধ্যে একমাত্র অমিতের সঙ্গেই কিছু টাকা ছিল যা দিয়ে একটি মাত্র টিকিট কাটা গেল। ওইরকম অবস্থায় মামী জোর দিয়ে বললেন যে উনি জঙ্গলে যাবেন না। অগত্যা, আমরা চারজনই এগিয়ে গেলাম briefing-এর জন্য যেখানে শিম্পাঞ্জি-সকাশে যাওয়ার রীতিনীতি সম্বন্ধে আমাদের বলা হ’ল।
মোটামুটি ত্রিশ জনের জমায়েতে আমরা জনা দশ-বারো ভারতীয়। আমাদের জানানো হ’ল যে ২-৫ ঘন্টার chimpanzee tracking হয়। কোনোরকম আওয়াজ করে আমরা যেন তাদের বিরক্ত না করি বা তাদের মধ্যে কেউ কাছে এলে ভয় না পেয়ে স্থির থাকি, ইত্যাদি। আমাদের চারজনের সঙ্গে যে ranger এলেন তাঁর নাম জেসিকা। সপ্রতিভ মেয়েটির পরনে fatigue, পায়ে গাম্বুট, পিঠে বন্দুক ও মুখে হাসি। বিপদ দেখলে বন্দুকটি নাকি হাওয়ায় চালানোর কথা। জঙ্গলে একটি কাঠের খুঁটিতে লেখা রয়েছে DANGER/HATARI! ছেলেবেলায় দেখা HATARI নামের মুভি-র মানে যে ‘বিপদ’ তা এতদিনে জেনে বেশ মজা লাগল! ওদিকে, আকাশের চেহারা দেখে আমার চিন্তা হচ্ছিল যে বৃষ্টি এলে আমাদের অভিযানটি নষ্ট হবে।
জঙ্গলের নানাধরনের গাছপালার মধ্যে অনেক জায়গায় আদাগাছের মতো ঝোপ ও একরকম বেগুনি মঞ্জরী রয়েছে। চারদিক ভেজা ভেজা। দু’পাশে গাছে ঢাকা রাস্তায় একটু হেঁটে শুঁড়িপথে জঙ্গলে ঢুকলাম। শুরু থেকেই একটা ‘কুব, কুব’ ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। জেসিকা বললেন যে এটি শিম্পাঞ্জিদের এক রকমের ‘ডাক’। মেঘের জন্য আলো কম, তায় ঘন জঙ্গল। কেমন এক ঘোর-ধরা পরিবেশে পাতা মাড়িয়ে ও ডালপালা সরিয়ে জেসিকার পিছুপিছু হেঁটে চলেছি।
আবার হাঁটছি। মিনিট পনেরোর মধ্যে দেখি একটি শিম্পাঞ্জি অনায়াসে গাছের ডালের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমার মনে আশা যে Jane Goodall-এর গবেষণার ওপর তথ্যচিত্রে যেমন এই শিম্পাঞ্জিকে পিঁপড়ের বাসায় কাঠি ঢুকিয়ে দিয়ে পিঁপড়ে খেতে বা পাথর দিয়ে ভেঙ্গে ফলের বীজ বের করতে দেখেছি, অমন কিছু দেখতে পাব! তখনি হঠাৎ মনে হ’ল কোনো মানুষ খুব জোরে জোরে ঝগড়া করছে বা বেধড়ক মার খেয়ে চেঁচাচ্ছে। জেসিকা বললেন, ‘এই যে চিৎকার শোনা যাচ্ছে সেই ডাককে বলে Pant-hoot call. দলের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম শিম্পাঞ্জিদের এই বিশেষ চিৎকার যার আওয়াজ অনেক দূর অবধি যায়। ভিন্ন পরিস্থিতিতে শিম্পাঞ্জিরা ভিন্ন রকমের আওয়াজ করে। এরা যোগাযোগ করতে মুখ দিয়ে আওয়াজ করা ছাড়া ড্রামের মতো গাছের গুঁড়িও পেটায়। দলের অন্যরা ওই কুব-কুব আওয়াজ করে সাড়া দেয়।’
আবার হাঁটা। এবার একটি শিম্পাঞ্জিকে দেখলাম যে আরামে গাছের এক উঁচু ডালে বসে বসে পাতা খাচ্ছে। একটু পরে সেই ডাল থেকে হেঁটে অন্য ডালে গিয়ে বসে দু’হাতে পাতা টেনে এনে খেতে লাগল। কখনো সে দু’দিকে হাত ছড়িয়ে বিশ্রাম নেয়, আবার কখনো পা দুলিয়ে দুলিয়ে দূরের ডাল টেনে এনে পাতা ছিঁড়ে খায়। দেখে দেখে ভাবছিলাম ‘আহা, মহারাজের কী সুখ!’ আমরা তার সেই ভোজন-পর্ব দেখতে দেখতে হাল্কা গলায় আলাপ করে নিলাম আমাদের পাশে দাঁড়ানো হায়দ্রাবাদের পদ্মা ও সুব্রমণিয়ামের সঙ্গে। ওঁরা গরিলা-সঙ্গ করে তারপর এখানে এসেছেন।
জেসিকার কাছে শুনলাম যে শিম্পাঞ্জিরা দিনে প্রায় ছ’কেজি খাবার খায়। তাদের খাবার বলতে লতাপাতা, ফলমূলের সঙ্গে পোকামাকড় থেকে নিয়ে ছোট মেরুদণ্ডী প্রাণীও আছে। সর্বভুক আর কাকে বলে! সেজন্য, শিম্পাঞ্জিদের বাসস্থানের চারপাশে সাধারাণত বানর ইত্যাদি ছোট প্রাণীরা থাকে না। এদের শিকার ধরবার পদ্ধতিটা মারাত্মক। শিম্পাঞ্জি প্রথমে একটা বাচ্চা বাঁদরকে ধরে, তার মা যখন বাচ্চাকে ছাড়াতে আসে তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে বড় বাঁদরটিকে ধরে ফেলে। পূর্ণবয়স্ক শিম্পাঞ্জি ছেলেদের ওজন ৫৫-৬৫ কেজি ও মেয়েদের ৩৫-৪০ কেজি হয়। উচ্চতায় পুরুষরা ফিট চারেক হয়, মেয়েরা একটু কম।
বেশ কাছেই আরেক বীরপুরুষের দেখা পেলাম যে সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতো ঝুলে ঝুলে এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাচ্ছে। আমরা যখন মন দিয়ে তার খেলা দেখছি, উল্টোদিকের গাছ ধরে আরেকটি শিম্পাঞ্জি একই রকম ট্র্যাপিজের খেলা দেখিয়ে আমাদের দিকে আসতে লাগল। আমাদের থেকে একটু দূরে সে বেচারা ডালপালা ভেঙ্গে নিয়ে নিচে এসে পড়ল – এক্কেবারে সেই ‘পপাত চ, মমার চ!’ দর্শকদের সামনে এমনভাবে সম্মানহানি হওয়ায় মুহূর্তের মধ্যে উঠে সে জঙ্গলের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।
জঙ্গলের নানারকম লতাপাতা ও গাছ দেখতে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলাম। একটা গাছের ঋজু কাণ্ডটি টুপির আকারের শক্ত কাঁটায় আবৃত। কোনো এক পাতায় এমন ভাবে পোকারা হলদে রঙের ডিম পেড়ে রেখেছে যে মনে হ’চ্ছে যেন সেখানে ‘ভাজার বড়ি’ শুকোতে দেওয়া হয়েছে। এমনিভাবে আড়াই ঘন্টা জেসিকার সঙ্গে ঘুরে জঙ্গল থেকে যখন বেরোচ্ছি, আকাশে সামান্য রোদের আভাস। কী মন্ত্রে জানি না জেসিকা মাত্র দশ-বারো মিনিটে আমাদের রাস্তায় নিয়ে এলেন আর ঠিক সেখানেই দেখি দাঁড়িয়ে আছেন আসিয়ো ও আমাদের বাহন! রাস্তার ধারে দেখলাম Colobus monkey ও Red-tailed monkey যাদের লেজের অধিকাংশ লালচে বাদামি আর মুখটা যেন সাদা দাড়িতে ভরা।
কটেজ-এ ফিরে হুড়োহুড়ি করে জিনিসপত্র গুছিয়ে যখন রওনা হ’চ্ছি, বাগানে একটি Blue Turaco ঘুরে বেড়াচ্ছে। নীল রঙের লম্বা লেজওয়ালা বড়-সড় পাখিটির মাথায় কালো রঙের মস্ত একটা পম্পমের মতো ঝুঁটি আর হলদে ঠোঁটে যেন লাল লিপস্টিক লাগানো।
পর্ব ৪
আমাদের পরের গন্তব্য হ’ল এই Kibale ন্যাশানাল পার্ক-এর সঙ্গে যুক্ত ও তার দক্ষিণে থাকা Queen Elizabeth ন্যাশানাল পার্ক। যাবার পথে বিষুবরেখা পার হ’লাম। দুপাশে সাভানা। পার্কটি রয়েছে African Western Rift Valley-তে ৮৮৪ - ১,৩৩৭ মিটার উচ্চতায়। সেখানে একদিকে যেমন জঙ্গল থেকে সাভানা আছে, অন্যদিকে তেমনি নানারকম জন্তু ও কয়েক শ’ পাখিও রয়েছে। এই পার্কের এক উল্লেখ্য দর্শনীয় যে ৩২ কিমি লম্বা Kazinga channel, যা লেক জর্জ ও লেক এডওয়ার্ড-কে যুক্ত করে, তার ওপরের ব্রিজ দিয়ে গেলাম। এক জায়গায় দু’পাশের জলাজমিতে প্রচুর প্যাপিরাস হয়ে আছে। যে পাহাড়ি পথে ওপরে উঠছি তার চারদিক সবুজে সবুজ। অত উঁচুতেও আম, কলা ও করবীফুলের গাছ দেখে অবাক হচ্ছিলাম।
সদ্য-ফোটা ভোরের আলো গায়ে মেখে কিছুক্ষণ বাগানে বেড়ালাম। তারপর পাহাড়ের গা বেয়ে থাকা মসৃণ রাস্তায় চলে Queen Elizabeth Conservation Area-তে এলাম। দু’পাশে তৃণভূমি ও কয়েকটি ছাপোষা চেহারার ইঁটের বাড়ি থেকে কাঠের জ্বালের গন্ধ আসছিল। প্রথমেই নজর কাড়ল কয়েকটা Pied crow ও এক বিরাট মাপের Crowned crane. তার কালো রঙের মাথায় আদিবাসী রাজার মতো সাদা কাঠির ‘মুকুট’।
আবার সেই চ্যানেল-এর ওপরকার ব্রিজে এলাম। সামনে পাহাড় ও দু’পাশে সাভানা। একটু পরে গাড়ি পাকা রাস্তা ছেড়ে মেঠোপথে সাভানাতে ঢুকল। এই হ’ল Kasenyi track যার খ্যাতি Ugandan Kob-এর চারণভূমি হিসেবে ও সেইজন্য সিংহ-সহ কিছু শিকারী পশুও এখানে দেখা যায়। অল্প সময়ের মধ্যে দেখা পেলাম Egyptian goose, জিরাফ আর Ugandan Kob-এর।
আমার শরীর ভালো লাগছিল না বলে আমাকে ছাড়া বাকিরা অন্য Volcanic crater-এ Lake Katwe নামের এক লবণ হ্রদ দেখতে গেল। আবারো আমার খুব জ্বর এল তবে ভেজা তোয়ালে ও ওষুধে খানিক সামাল দিলাম। একসময় ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়াতে ডাইনিং হল-এ চা খেতে গেলাম। একলা বসে চা খাচ্ছি আর পাখির ডাক শুনছি। তখন, ওখানকার কর্মচারি মিষ্টি মেয়ে অ্যানাবেল এক প্লেট গরম কাঁচকলা ভাজা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘খাবে?’ আমি দু’টি ভাজা তুলে নিলাম। বেশ লাগল তার স্বাদ ও মেয়েটির ওই আদর। কটেজে ফিরে বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ পূর্ণ নীরবতায় পাহাড় ও নানা ধরনের গাছপালার শোভায় মগ্ন হয়ে রইলাম। এও এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা।
পর্ব ৫
পরদিন ভোরে যখন বেরোলাম, জোর হাওয়া দিচ্ছে ও চারদিকে সুন্দর সূর্যের আলো। অসমান মাটির রাস্তা ধরে ওপর থেকে নামছি। নিচে দু’দিকে সাভানা। চলার পথে দেখলাম Gonolek, লাল ঠোঁটওয়ালা Saddle-billed yellow stork আর hamerkop-এর বিশাল বাসা। অদ্ভুত লাগল জেনে যে এই পাখি এত বড় বাসা বানায় যেখানে সে অন্য পাখিদের থাকতে দেয়! ছোট শুয়োরের মতো দেখতে Bush pig, হাতির ছোট দল ও Olive baboon-ও দেখলাম।
কিছু পরে এল লেক এডওয়ার্ড ও তার পাশের জেলেদের গ্রাম। এই লেকের অন্য দিকে কঙ্গো আর যে রাস্তায় আমরা যাচ্ছি তা সোজা কঙ্গো যাচ্ছে। তারপরে অনেকটা পথ ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলা। সেখানে পরিষ্কার পাতায় রোদ পড়ে চিকচিক করছে। খানিক দূরে দেখা পেলাম সার্থকনামা Red-billed fire finch-এর। এছাড়া, এক খোলা জায়গায় ছিল স্থির হয়ে দাঁড়ানো একশ’র বেশি Topi. তাদের পুরুষদের রঙ গাঢ় বাদামি, মেয়েদের রঙ তুলনায় হাল্কা। Hartebeest এর সঙ্গে Topi-র চেহারায় বেশ মিল আছে, পার্থক্য এই গায়ের রঙ ও কম-ছড়ানো শিং।
এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধি Tree-climbing lion-এর জন্য। পুরো পার্কে ১৪০টি সিংহের ১৫টি এই অঞ্চলে আছে। উল্টোদিক থেকে আসা গাড়ির যাত্রীরা বলছে যে সিংহ দেখেনি। পরিষ্কার নীল আকাশে সামান্য সাদা সাদা মেঘ। একটা গাছে দেখি প্রচুর বেবুন। তাদের একজন অনেক ওপরের এক ডালে এমনভাবে পায়চারি করছে যেন তার বাড়ির বারান্দা! একটু পরে Ishasha নদীর ওপারে কঙ্গো দেখতে পেলাম। এই Ishasha Sector রয়েছে পার্কটির দক্ষিণ দিকে আর এই অঞ্চলে নদীটি কঙ্গোর সঙ্গে উগান্ডার সীমানা তৈরি করেছে। দু’ধারে যে লম্বা লম্বা Spear grass হয়ে আছে তা দিয়ে গোল কুটিরের ছাউনি তৈরি হয়। আরো ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে সিংহ না দেখে আমরা পার্ক থেকে বেরিয়ে এলাম।
আমরা তখন যেমন ক্লান্ত তেমনি ক্ষুধার্ত কিন্তু আসিয়ো যেহেতু ক্যাম্প-এ জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন যে আমরা দুপুরে ওখানে খাব, তাই সেখানে আমাদের জন্য তখনকার কোনো খাবারের ব্যবস্থা ছিল না! আসিয়োর এক বিশেষ গুণ যে তাঁর এমন সব ভুলভ্রান্তিতে আমাদের বিরক্তির প্রকাশ দেখলেও ভদ্রলোক বেশ নির্বিকার থাকতে জানেন। অনেকক্ষণ সময় লাগল খাবার বানাতে।
রিসেপশান থেকে খানিকটT নেমে কাঠের খুঁটির ওপর ছাউনি-দেওয়া পরপর কটেজ। সেই ছাউনি তৈরি হয়েছে কলাপাতার আঁশ মুড়ে ও তার ওপর ঘাস ছড়িয়ে দিয়ে। বাগানে অনেক ফুলের মধ্যে বিশেষ ভালো লাগছিল হলদে রঙের উজ্জ্বল ফুলগুলো। সামান্য রোদ বাকি আছে তখনো। বেশ ঠান্ডা লাগলেও কটেজের বারান্দায় বসে পাখির ডাক শুনছিলাম আর দেখছিলাম ঘন জঙ্গল ও দূরে থাকা তিন সারি পাহাড়। হালকা কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়গুলো অনেকদিন আগে দেখা Nicholas Roerich-এর আঁকা ছবির কথা মনে করাচ্ছিল। খানিক পরে, নিচ থেকে কুয়াশা উঠে এসে আস্তে আস্তে পাহাড়গুলো ঝাপসা করে দিল।
পর্ব ৬
উগান্ডার দক্ষিণ-পশ্চিমে একেবারে কঙ্গোর সীমানায় রয়েছে Bwindi Impenetrable Forest. মোটামুটি ১,১৯০ থেকে ২,৬০৭ মিটার উচ্চতায় থাকা এই অঞ্চলটির শতকরা ৬০ ভাগের উচ্চতা ২০০০ মিটার। ওই জঙ্গলের একাংশ হ’ল Bwindi Impenetrable ন্যাশানাল পার্ক যেখানে নানারকম পশুপাখি-গাছপালা থাকলেও তার প্রসিদ্ধি মাউন্টেন গরিলা-দের জন্য। উগান্ডা ছাড়া রোয়ান্ডা ও কঙ্গোতেও মাউন্টেন গরিলা দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণত ২৫০০ থেকে ৪০০০ মিটার উচ্চতায় এরা থাকতে পছন্দ করে। ২০১৮ সালের গণনা অনুযায়ী সারা পৃথিবীর ১০৬৩টি মাউন্টেন গরিলার মধ্যে উগান্ডার এই পার্কটিতে বিভিন্ন দলে আছে ৪৫৯টি। মানুষের সঙ্গে এদের নানা মিল। কোনো অজ্ঞাত কারণে আজ অবধি মাউন্টেন গরিলাদের কোনো চিড়িয়াখানায় বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
বাসস্থান হারানো ইত্যাদি নানা কারণে এই পাহাড়ি গরিলার সংখ্যা খুব কমে গিয়েছিল। তবে সঠিক সংরক্ষণের ফলে এদের সংখ্যা সাম্প্রতিক কালে বেড়েছে ও ২০০৮ সালে তাদের অবস্থা critically endangered থেকে endangered হয়েছে। Bwindi Impenetrable ন্যাশানাল পার্ক -এ ঊনিশটি গরিলা-দলকে মানুষের সংস্পর্শে আসায় অভ্যস্ত করা হয়েছে। তাতে শুধু পর্যটকরা নয়, গবেষণার জন্য ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরাও উপকৃত হচ্ছেন।
অমন মস্ত চেহারার অধিকারী হ’লে কী হয় গরিলাদের খাবার হ’ল মূলত গাছের কচি ডাল ও পাতা। তবে তারা গাছের ফুল, শিকড় ও ছালও খেয়ে থাকে। এছাড়া, তাদের খাদ্য তালিকায় স্বল্প পরিমাণে আছে ছোট মেরুদণ্ডী প্রাণী। পুরুষ গরিলা সোজা হয়ে দাঁড়ালে ৫ ফিট উচ্চতা কিন্তু ওজন প্রায় ২০০ কেজি। মেয়েরা তার থেকে বেঁটে আর ওজন পুরুষের প্রায় অর্ধেক। ওই বিশাল-দেহী গরিলাদের দেখলে আমাদের ভয় করে বটে কিন্তু স্বভাবে তারা খুব নরম-সরম ও লাজুক আর সহজে কাউকে আক্রমণ করে না। যাবার আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম যে গরিলার থেকে কোনো ক্ষতি হওয়ার থেকে পাহাড় চড়তে গিয়ে পা মচকানোর সম্ভাবনা অনেক বেশি! তখন যদি কথাটার অর্থ পুরো বুঝতাম!
পরদিনের পাহাড়ি-পথে হেঁটে গিয়ে গরিলা-দর্শন নিয়ে আমাদের মনে একটা চাপা উত্তেজনা। রাত্রে শোবার আগে সকালে যা যা লাগবে সব কিছু গুছিয়ে রাখলাম। কর্তা বিশেষ মন দিলেন তাঁর ক্যামেরা ও লেন্স-ইত্যাদি গুছোনোয়। মামী তো যাবেন না কিন্তু সকালে উঠে বোঝা গেল যে কর্তার শরীর ভালো নয় এবং পাহাড়ে চড়ার ধকল নিতে উনি রাজি নন। অতএব, আমরা তিন মূর্তি রওনা হলাম।
প্রথমে সব অভিযাত্রীকে পার্কের অফিসের সামনে খোলা চত্বরে বসিয়ে বলা হ’ল যে গরিলা সংরক্ষণের জন্য ওই Bwindi Impenetrable ন্যাশানাল পার্ক-এর আদিতম অধিবাসী Batwa Pygmy Community-র মানুষদের তাদের নিজেদের বাসস্থান থেকে উৎখাত করা হয়েছিল। যেহেতু তাদের জীবিকার সংস্থানও হ’তো ওই জঙ্গল থেকেই তাই তার ফলে তারা খুব বিপন্ন হয়ে পড়ে। তবে বিভিন্নভাবে কিছুদিন যাবৎ সেইসব বিতাড়িত মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে নানা বয়সের জনা দশ-বারো নারী-পুরুষ বাজনা বাজিয়ে খানিকক্ষণ নাচগান করলেন।
তারপর, আমাদের এই অভিযানের বিধি-নিষেধ জানানো হ’ল। যেমন, অভিযাত্রীদের কারোর সর্দি-কাশি, পেট খারাপ বা কোনো ছোঁয়াচে রোগ থাকলে তার জঙ্গলে যাওয়া নিষেধ কারণ তাতে গরিলারা সংক্রমিত হ’তে পারে। তেমনি, গরিলাদের সামনে গিয়ে হাঁচি, কাশি, জোরে কথা বলা বা আচমকা জায়গা বদল করা যাবে না, তাদের সঙ্গে থাকার মেয়াদ একঘন্টা, ইত্যাদি। অশক্ত বা বয়স্কদের জন্য অল্প হেঁটে একদম কাছের কোনো দলের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে, বাকিদের জন্য ২-৭ ঘন্টার অভিযানের ব্যবস্থা।
আমাদের দলে আমরা তিনজন ছাড়া ছিল বাবা-মা ও তরুণ ছেলেমেয়ে-সহ একটি ডাচ পরিবারের পাঁচজন। এছাড়া, আমার ও চান্দ্রেয়ীর একজন করে ও ডাচ পরিবারের পাঁচজনের জন্য একজন পোর্টার, দলনেতা বেন্সন নামে এক রেঞ্জার ও আর দলের সামনে ও পেছনে একজন করে বন্দুকধারী। ডাচ পরিবারটি আগের দিন একবার এই অভিযান করে অন্য এক দল গরিলা দেখে গিয়েছেন।
সকাল নটায় আমাদের হাঁটা শুরু হ’ল। বয়সে আমি সবচেয়ে বড় বলে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথমে জঙ্গলে ঢুকলাম। মুখে হাসি, বুকে বল ও হাতে লাঠি নিয়ে প্রচুর উৎসাহের সঙ্গে আমার যাত্রা শুরু হ’ল। সঙ্গে রয়েছে আমার পোর্টার টিম। প্রথমেই, সে প্রচুর জল ও কিছু খাবার-সমেত আমার যে পিঠের ব্যাগটি তা নিয়ে নিল। সদ্য-তরুণ, ছিপছিপে চেহারার, হাসি মুখের ছেলেটি তো তখন জানতো না কী এক অলম্বুষের দায়িত্ব সে নিয়েছে! বেন্সন্-এর হাতে তরতরে ধারালো এক machete. এমনিতেই চারপাশে শুধু গাছ ও লতাপাতার ওই ঘন জঙ্গলে সুর্যের আলোর প্রবেশ সহজ নয় তায় সেদিন আকাশের মুখভার তাই আবছা আলোয় পথ চলেছি।
আমার পরনে ফুলহাতা শার্ট, সোয়েটার ও wind cheater, ট্রাউজারের শেষভাগ মোজার ভেতর ঢোকানো, মাথায় টুপি আর পায়ে ট্রেকিং-এর উপযুক্ত উঁচু বুট। প্রথম থেকেই ডানহাতে লাঠি আর বাঁহাতে শক্ত করে টিম-এর হাত ধরে চলছিলাম। পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে এমন গরম লাগতে লাগল যে সোয়েটার-টোয়েটার খুলে ব্যাগে ঢোকালাম। কখনো উঠছি, আবার কখনো নামছি তবে সবসময় সাবধানে পা ফেলে এগোচ্ছি। ক্যামেরাটি গলায় ঝুলছে কিন্তু তাকে ব্যবহার করার কথা একটু পরে আর মাথায়ও আসছে না। মাঝে মাঝে এক এক ঢোঁক করে জল খেয়ে নিচ্ছি। টিমকে কয়েকবার জল দিতে চাইলাম কিন্তু সে খেল না।
গরিলারা মাটিতে গাছের পাতা ও ডালপালা দিয়ে বাসা বানিয়ে তাতে ঘুমোয় ও প্রতি রাত্রে তারা নতুন বাসা বানায়। ট্র্যাকার-রা আগের রাত্রে দেখে রাখে রাত্রে একটা দল কোথায় ঘুমোচ্ছে। পরদিন সকালে তারই সূত্র ধরে গরিলাদের অবস্থান জানতে পারে ও সেইমতো অভিযাত্রী দল এক বিশেষ গরিলা-দলের সন্ধানে যায়। বেনসন একটু বাদে বাদে ফোনে ট্র্যাকারদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের নিয়ে এগোচ্ছিলেন। সেটাও আমার কাছে এক বিস্ময় যে ওই ঘন জঙ্গলে তারা কীভাবে পথ চিনছে। অবশ্য ‘পথ’ বলে তো কিছু ঠিক নেই। কোথাও ডালপালা সরিয়ে পা ফেলা আর কোথাও সরু পায়ে-চলা পথ। নানারকম ছোটবড় গাছের মধ্যে দিয়ে, ঝুলন্ত মোটা লতা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে, লাঠি ও টিম-এর ওপর ভর দিয়ে চলেছি। এই রকম চলতে চলতে দু’জায়গায় গরিলাদের বিষ্ঠা দেখে বেনসন বেশ খুশি হলেন কারণ তার মানে তেনারা কাছাকাছি আছেন। একসময় একটা জায়গায় পৌঁছলাম; সেখানে বড় গাছ নেই কিন্তু জমিতে লতাগুল্মের পুরু আস্তরণ। একটু আকাশ দেখতে পেয়ে আনন্দ হ’ল কিন্তু দলের সঙ্গে তাল মেলাতে এগিয়ে যেতে হ’ল।
প্রায় সোয়া এক ঘন্টা মতো হেঁটে গিয়ে বেশ ক্লান্ত অবস্থায় আমাদের জন্য অপেক্ষারত ট্র্যাকারদের পেলাম। স্থানীয়দের বা ডাচ পরিবারটিকে দেখে মনে হচ্ছিল না এই হাঁটায় ওদের বিন্দুমাত্র পরিশ্রম হয়েছে। ট্র্যাকাররা হদিশ দিল যে একদম কাছেই একটি গরিলা পরিবার রয়েছে। বেন্সন বললেন যে সেখানেই লাঠি, খাবার ও সঙ্গের সব জিনিসপত্র রেখে পোর্টার ছাড়া গিয়ে গরিলা দেখে আসতে হবে কারণ লাঠি ও বেশি লোক দেখলে গরিলারা ভয় পায়। এই বলে, তিনি যেদিকে যেতে বললেন সেটি গাছপালার মধ্যে নিচের দিকে ঢালের জায়গা যেখানে আমার পক্ষে হাঁটা সম্ভব নয়। তাই, আমি নিঃসঙ্কোচে মাটিতে বসে বসে নামতে শুরু করলাম। আমাকে দেখে চান্দ্রেয়ীও সেই পন্থা নিল। অগত্যা, আমাদের দুর্দশায় কাতর হয়ে বেন্সন আমাদের দু’জনের জন্য পোর্টার দিলেন। টিম এসে হাত ধরতে আমার যেন ধড়ে প্রাণ এল। নড়বড় করে এগোচ্ছি। এখন তো লাঠি নামক বিড়ম্বনাটি নেই, তাই এক রকমের স্বস্তি। অন্যদিকে, টিম-এর ওপর পুরো নির্ভর। একজায়গায় পায়ের নিচে এমন অসমান জমি এল যে আমি এক হাতের বদলে দু’হাতে টিম-এর হাত চেপে ধরে প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় ওই জায়গাটা পার হ’লাম। চান্দ্রেয়ী পরে বলল, ‘মনে হচ্ছিল তোমরা বল ড্যান্স করছ।’ যাহোক, সত্যিই বেশ কাছে গরিলাদের দেখা পেলাম ও আমরা থামবার পরপরই দলের বাকিরা এসে গেল।
প্রথমে দেখা পেলাম ওই Bitukura দলের বয়স্ক Silver back পুরুষটির। সে নিচে বসে মাঝেমাঝেই হুপ-হাপ শব্দ করছে, একটু-আধটু নড়ছে-চড়ছে আর পাতা খাচ্ছে। নিয়মমতো, তার থেকে আমরা আট-দশ ফুট দূরে দাঁড়ালাম। জায়গাটা এমন ঢালু যে ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে থাকতেও পরিশ্রম করতে হচ্ছিল। তবে, আমার তখন মনে প্রচুর আনন্দ যে এমন দুর্গম জায়গায় পায়ে হেঁটে এসে আমি বিরল প্রাণীটির দেখা পেয়েছি।
চারদিকে গাছপালায় ভর্তি বলে সেখানে আলো বেশ কম। দূরে, আমাদের উচ্চতার আরেকটি পাহাড় দেখতে পাচ্ছিলাম। শুনলাম যে গরিলা-দলের বাকিরা গাছের ওপর আছে। আমি মন দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বয়স্ক silver back-টিকে দেখছিলাম। হঠাৎ, আমাদের পাশের শ্যাওলা-ভরা হেলানো গুঁড়ি জাপটে ধরে একটি গরিলা সরসরিয়ে নেমে এল। তারপরে সে উৎসাহের সঙ্গে ধাপ-ধাপ করে মাটিতে মারল যাতে প্রচুর পোকা উড়তে শুরু করল। তখন বেন্সন একটা হুপ করে আওয়াজ করতেই সে ভালো ছেলের মতো অমিতের গা ঘেঁসে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেল। বেন্সন বললেন যে ওই আওয়াজ ও ভঙ্গি হ’ল গরিলাটির আনন্দের প্রকাশ। একটু পরপর বাচ্চাদের স্লাইড-এ নামবার মতো ছোট-বড় মিলিয়ে আরো জনা তিনেক গাছ বেয়ে নেমে এল ও জঙ্গলে অদৃশ্য হ’ল। ছোটদের জন্য ঠিক আছে কিন্তু লোমশ, কালো, বিশালদেহী এক পূর্ণ-বয়স্ক প্রাণীর ওই পদ্ধতিতে নেমে আসার দৃশ্যটা পেছনে দাঁড়িয়ে দেখতে ভীষণ মজার লাগছিল।
বেন্সন বললেন যে জার্মানির Max Planck Institute-এর বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে এখানকার যে-কয়েকটি গরিলা পরিবারকে পর্যবেক্ষণ করছে, এই Bitukura পরিবারটি তাদের অন্যতম। গরিলাদের খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক রীতিনীতি, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি হ’ল তাদের গবেষণার বিষয়। গরিলাদের নানারকম কাণ্ড দেখতে দেখতে চোখের নিমেষে যেন এক ঘন্টা কেটে গেল।
গরিলা তো দেখলাম কিন্তু ফেরবার সময় যেন আরো কাহিল হয়ে গেলাম। টিম-এর হাত যে ধরেছি, তা কখনো ছাড়িনি। পথে চান্দ্রেয়ীর জুতোর সোল খুলে গেল। বেন্সন জুতোর ফিতে দিয়ে পায়ের সঙ্গে জুতোটা বেঁধে দিলেন। আমারও দু’বার জুতোর ফিতে খুলে যেতে টিম তা বেঁধে দিয়েছে। আমি জানতাম যে ওই ৩২৭ স্কোয়ার কিমি জঙ্গলে গরিলা ছাড়া শিম্পাঞ্জি, নানাধরনের বাঁদর, প্রচুর পাখি ইত্যাদি আছে। যাওয়া-আসার পথে নানারকম জন্তুর ও পাখির ডাক শুনছিলাম বটে কিন্তু থেমে যে তাদের দেখবার চেষ্টা করব তার উপায় ছিল না। মন শুধু পায়ের দিকে। পায়ের তলায় পটপট করে ডাল ভাঙছে। একে আমার পা খুব বড় আর তাতে যে ভারী বুট তা ডালপালায় জড়িয়ে যাচ্ছে বলে একবার পা ফেলে তাকে আবার তুলে আনতে মুশকিল হচ্ছিল। লাঠিটাও তো নির্বোধের মতো কেবল এদিক-ওদিক ডালপালায় আটকে যায়। তাই, ফেরার পথে আমি বিবেকানন্দের স্টাইলে লাঠিটা একটু উঁচু করে ধরে হাঁটছিলাম। তাতে যদিও লাঠি থাকার ‘উদ্দেশ্য পদে পদে ব্যর্থ’ হচ্ছিল।
শক্তি পাবার আশায় অমিতের দেওয়া একটা কফি লজেন্স মুখে নিয়ে হাঁটছিলাম। কোথায় শক্তি! জঙ্গলের সেই ভয়ঙ্কর চড়াই পথে চলতে গিয়ে আমি একেবারে দম পাচ্ছিলাম না। দু’পা হেঁটেই আমি টিম-এর হাতে টান দিয়ে দাঁড়াতে বলি, দম নিই, কখনো জল খাই, আবার চলি। আমার ইচ্ছে যে মুখ হাঁ করে অনেকটা হাওয়া নিয়ে নিই কিন্তু চারপাশে এমন ছোট ছোট পোকা উড়ছিল যে তিন চার বার (হাত দিয়ে মুখ ঢেকে) ছাড়া সেটা করার সাহস পাচ্ছিলাম না। অনেক জায়গায় পাতায় ঢাকা গর্তও পেয়েছি। একবার আমার পা পড়ল অমন এক গর্তে ও পায়ের পাতা ঘুরে গিয়ে মচকানোর ঠিক আগে আটকালো। আমি ‘আঁক’ করে কাতরে ওঠায় টিম থামল। কোনোক্রমে, দম নিয়ে নিজেকে সোজা করেছি কী করিনি, সে বলল ‘তাড়াতাড়ি হাঁটো – সামনে পিঁপড়ের বাসা।’ একটা নয়, দু’টো নয় সেই পথের ওপর পরপর তিনটে জায়গা বড়বড় পিঁপড়েয় ভরা। সমতলের মানুষের জন্য অতখানি উচুতে অমন চড়াই-উৎরাই সামাল দেওয়ার জন্য যে ফিটনেস দরকার তার অভাবে আমার অবস্থা করুণ। আমি যখন দাঁতে দাঁত চেপে হাঁটছি আর ভাবছি কেন এই দুর্গম পথে এলাম, টিম বেশ ছেলে-ভোলানো সুরে আমাকে বলল, ‘শুনতে পাচ্ছ, আমাদের মাথার ওপর দিয়ে যে প্লেন যাচ্ছে?’
ভাগ্য ভাল যে বেন্সন তার হাতের machete দিয়ে ডালপালা কাটতে কাটতে ‘পথ’ বানিয়ে ৪৫ মিনিটে আমাদের জঙ্গলের বাইরে নিয়ে এলেন। আমি যাবার সময় প্রথম জঙ্গলে ঢুকেছিলাম আর সেখান থেকে বেরোলাম সকলের শেষে, একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থায়। খোলা আকাশের নিচে সমান জমিতে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিলাম কিছুক্ষণ। দলের সবাই হইহই করে একে অপরকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। একটু ধাতস্ত হয়ে আমিও তাতে যোগ দিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম যে গত তিনঘণ্টায় আমার যে অভিজ্ঞতা হ’ল তা যেমন অভিনব তেমনি অবিস্মরণীয়। সকলকে বিদায় জানানোর শেষে আবার আমি টিম-এর হাতটা ধরলাম। এবারে শুধু তাকে প্রাণভরা ধন্যবাদ জানানোর জন্য।
(শেষ)
(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)
ছবি: (*) চিহ্নিত ছবি লেখিকার, বাকিগুলি পূষন আইয়ুবের তোলা