Subscribe to Magazines






পরবাসে
দিলশাদ চৌধুরী

আরো লেখা


ISSN 1563-8685




এখানে ঈশ্বর বাস করেন না

ময়টা রমজান মাসের শেষের। চাঁদ দেখা কমিটি চাঁদ খুঁজে না পাওয়ায় ঈদ আসি আসি করেও আসতে পারছে না। টিভিতে সাতদিন-ব্যাপী ঈদের অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন রমজানের আগে শুরু হয়ে এখনো চলছে। বিজ্ঞাপন দেখে মনে হয় একই নাটক ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে সাত দিন ধরে দেখাবে। চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আসিফ বিরক্ত হয়। আজকাল কি আর কোন ভালো কাহিনীর নাটক হয় না!

—এত না ঘুরাইয়া কোন এক জায়গায় রাখ। দেখি দুই একটা নাটক। দেশীয় জিনিস, আমরা না দেখলে যাইবে কই! বলে ওঠে রমিজ।

রমিজ, সাব্বির আর আসিফ একটা ছোট ফ্লাটবাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। সাব্বির স্টুডেন্ট মানুষ, রমজানের শুরুতেই বাড়ি চলে গেছে। রয়ে গেছে রমিজ আর আসিফ। আসিফ কাজ করে একটা গার্মেন্টসের একাউন্টস সেকশনে। ওয়ার্কারদের সবার বেতন না মেটা অব্দি তার ছুটি নেই। আর রমিজ সহজে বাড়ি যায় না, ঈদে চাঁদেও না। ৫৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে বাড়ি যাওয়ার চেয়ে সে সেই টাকাটা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়া বেশি উপযুক্ত মনে করে। রমিজের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না।

—দেশী জিনিস বলে আর তোল্লাই দিস না। তোরে দেশী বলে যদি পদ্মার পচা ইলিশ খাওয়াইয়া দেয়, তুই খাবি?

—ধর, যদি একটু কড়াভাজা দিয়া দেয় তাইলে তো আর গন্ধ থাইকবে না। একটু পাতলা ডাল আর পোড়া মরিচ হইলে ভাতে ডইলে খেয়ে ফেলুম।

—হ... যেমন সাব্বিরের আম খাইছিলি!

—তায় কি করতাম! আমের কেজি কত জানস?

আসিফ না হেসে পারে না। কিন্ত তার একটু অপরাধবোধও হয়। রমিজদের বাড়ির অবস্থা এমন যে পচা ইলিশও তারা স্বাদ করে খেয়ে নেবে। সাব্বির তার বাড়ি থেকে আম এনেছিল। কয়েকটা আম আনতে আনতে চাপ লেগে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। সাব্বির ফেলে দিত, রমিজ প্রায় কেড়ে এনে পচা জায়গাগুলো কেটে ফেলে দিয়ে আমগুলো খেয়েছিল।

—তোর টিকেট কয়টায়?" রমিজ জিজ্ঞেস করে।

—দুপুরে, আড়াইটায়। সকালে একবারে ব্যাগ নিয়া বের হব। হিসাবের খাতাগুলা শেষবারের মত মিলাইয়া ওইখান দিয়াই বাসস্টান্ড যাব। বলে আসিফ।

—আম পাইলে আম আনিস। বাড়ির গাছের আম আনবি, দেইখা আনবি। এই সিজনের আমে পোক থাকে, ল্যাদা পোক। অবশ্য পোকরা আম মিষ্টি বেশি।

—আচ্ছা। আনবোনে।

টিভির রিমোট রমিজের হাতে দিয়ে আসিফ শুয়ে পড়ে। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। সারাদিনের ক্লান্তির ফলে ঘুমকে আর ডেকে আনতে হয় না।

ভীষণ গরম, ভ্যাপসা যাকে বলে। বাসে আসিফ সিট পেয়েছে একদম পেছনের দিকে। অবশ্য উপায়ও ছিল না। একদিন পরেই ঈদ, তাই ভিড়ও বেশি। শেষের দিকের সিটই সই, সিট যে পাওয়া গেছে তাই অনেক। ব্যাগটা নিয়ে সে সিটে গিয়ে বসে, পাশের যাত্রী এখনো আসেনি। জানালাটা খোলার চেষ্টা করেও খুলতে পারে না। পুরনো বাস, জানালা সম্ভবত জাম হয়ে গেছে বৃষ্টির পানিতে। সকাল থেকেই টুকিটাকি বৃষ্টি পড়ছে। কিন্ত তাতে গরম তেতে ওঠা ছাড়া কোন কাজ হচ্ছে না। আসিফ ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে চুমুক দেয়। সিটটা সামান্য পেছনে হেলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসে। কিছুক্ষণ পরেই বাস চলতে শুরু করে। তার পাশের সিটটা তখনো খালি। তাই সে পায়ের উপর রাখা ব্যাগটা সেখানেই চালান করে দেয়। সকালে তাড়াতাড়ি ওঠার কারণে আর বাসের দুলুনিতে চোখ লেগে আসে। কিছুক্ষণ ঝিমানোর পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে টেরই পায় না সে।

প্রায় ঘন্টা দেড়েক ঘুমানোর পর উঠে দেখতে পায় পাশের সিটে যাত্রী। কখন যে এলো ঘুমের কারণে বুঝতেই পারেনি। এদিক-ওদিকে চোখ দিয়ে ব্যাগটা খোঁজ করে সে। না দেখতে পেয়ে পাশের যাত্রীটিকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায় সিটের উপরের ব্যাগ রাখার জায়গায় সে ব্যাগটি রেখে দিয়েছে। আসিফ নিশ্চিন্ত হয়। ব্যাগের মধ্যে সোনার চেইন আছে একটা। বড় আপার ছেলে হয়েছে গতমাসে, মা মুখ দেখে কিছু দিতে পারেননি। তাই, বাক্স হাতড়ে একজোড়া পুরনো দুল পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারই সাথে বোনাসের টাকা মিলিয়ে চেইন কেনা হয়েছে। হারিয়ে গেলে সর্বনাশ হবে।

ব্যাগ থেকে বের করে কুড়কুড়ে ক্রিম এন্ড অনিয়ন চিপস চিবুতে থাকে আসিফ। এই ফ্লেভারটা তার পছন্দের। প্রিংগেলস চিপসের এই ফ্লেভারটা আরও মজার, বসের রুমে থাকে। মাঝেমধ্যে রুমে গেলে বস খেতে দেয়। সে একবার দোকানে গিয়ে দাম করেছিল। দোকানি বলেছিল ২৩০ টাকা, দুটো নিলে সে ২১৫ করে দিতে পারবে। শুনে ঢোক গিলেছিল আসিফ। ২১৫ করে হলেও দুটো ৪৩০ টাকা। এই টাকায় পুরো মাসের তরকারি কেনা যায়। প্রিংগেলসের আশা ত্যাগ করলেও কুড়কুড়ে চিপসের সেম ফ্লেভার দোকানে দেখে দশ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে আসে। খেতে খারাপ না, প্রায় একই রকম। কিন্ত পরিমাণে খুবই কম, শুরু করতে না করতেই শেষ হয়ে যায়। তখন আসিফের নিজেকে খুব অসহায় লাগে। জিভ দিয়ে আঙুলের ডগা ভিজিয়ে প্যাকেটের কোণে লেগে থাকা গুঁড়ো বের করে খায়। যদিও এতদিন রেখেছে, কিন্ত আজ গরম আবহাওয়া আর বাস জার্নির কারণে রোজা বাদ দিয়েছে সে।

চিপসটা শেষ করে আসিফ দ্বিতীয় দফা ঘুম দেয়। ঘুমের মধ্যে সে যেন উড়ে চলে যায় তার গ্রামে। সেখানে মা আছে, ছোট ভাইটা আছে আর আছে সেই মুন্‌সি বাড়ির মেয়েটা। মা এখনো কিছু বলেনি, কিন্তু ছোট ভাইটার মুখে শুনেছে তার জন্য মুন্‌সি বাড়ির মেয়েটাকে আনতে চায় মা।

মেয়েটিকে সে দেখেছে। খুব ফর্সা নয়, চোখদুটো চাইনিজদের মত। চাইনিজচোখা মেয়েরা সাধারণত খুব ফর্সা হয়। এ মেয়েটি তেমন নয়। কিন্তু ব্যবহার খুব মিষ্টি, খুব নাকি কথা বলে। তাতে অবশ্য কিছু না। মা বলেন যারা বেশি কথা বলে তাদের দিলটা সাফ হয়। ওইতো, ওইতো দেখা যাচ্ছে। পুকুরধারের তালগাছের সারির নিচে মেয়েটা দাঁড়িয়ে। হায় হায়! মেয়েটা সরে না কেন! উপর থেকে তাল পড়ে যদি মাথাটা ফেটে যায়!

— ভাই, ও ভাই!

লাফ দিয়ে জেগে ওঠে আসিফ। ঘোরলাগা চোখে তাকায়। ওহ, সে তাহলে স্বপ্ন দেখছিল। সামনে তাকিয়ে দেখে বাস সম্পূর্ণ খালি। হেল্পার ছেলেটা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে।

—চলে আসছি?

—না ভাই। বাস নষ্ট হইয়া গেছে। যে যার মত চইলা গেছে। চেক করতে আইসা দেখি আপনি পিছনে ঘুমাইতেছেন। তাই ডাইকা তুললাম। সন্ধ্যা হইছে অনেকক্ষণ আগে। তাড়াতাড়ি বাইর হন।

—তাহলে এখন কি করব?

—এইডা তো হাইওয়ে। গাড়ি দাঁড়াইব না। সবাই যা করছে তাই করেন। নাইম্যা সোজা হাঁইট্যা ডান দিকের রাস্তাডা ধইরা বাম দিকে যাইবেন। একটা বাজারের মত আছে। ওইখান দিয়া টেম্পুতে কইরা সদরে গেলে গাড়ি পাইবেন। তারপর পৌনে এক ঘন্টার রাস্তা।

—ঠিক আছে। তাইলে তেমনই করি।

আসিফ বাস থেকে ব্যাগ নিয়ে নেমে হাঁটা লাগায়। পিচঢালা সুন্দর রাস্তা, দুপাশে জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দূরে আলো দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। হয়ত আশপাশের গ্রামগুলোর ঘরবাড়ির আলো। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে রাস্তাটা সম্পূর্ণ দেখতে পায় সে। অনেকদূর চলে গেছে, কোনও বাঁকও দেখা যাচ্ছে না। হেল্পারটা কোন বাম দিকে যেতে বলল! অনেকক্ষণ ধরেই হেঁটে যাচ্ছে সে। ডান বামের কোন লক্ষণই নেই। পাশের জঙ্গলে নেমে যাওয়া যায়, কিন্ত এই গরমে সাপখোপ থাকাই স্বাভাবিক। হঠাৎ দূরে একটা আলোর বিন্দু দেখা গেল। আসিফ প্রায় দৌড়ে এগোতে লাগল। কিছুদূর যেতেই আলোর উৎস স্পষ্ট হল। বাজার না? হ্যাঁ, একটা বাজারই বটে। হেল্পারটার উপর মনে মনে চটল সে। বললেই হত যে সোজা যাবেন, তা না... ডানে গিয়ে বামে, বামে গিয়ে ডানে... উফ! যাক বাবা, বাজার পাওয়া গেছে।

আসিফ জোরে জোরে হেঁটে বাজারে গিয়ে ঢোকে। এখন দেখতে হবে টেম্পু কোথায় পাওয়া যায়। এদিক ওদিক তাকিয়েও টেম্পুর কোন দিক-দিশা পায় না সে। অসংখ্য দোকান দেখা যাচ্ছে, কিন্তু যানবাহন দেখা যাচ্ছে না কোন। না রিক্সা, না অটো, না ভ্যান। হয়ত বাজারে যাতে চলাচলে অসুবিধা না হয় সেইজন্য যানবাহন বাইরে কোথাও রাখা আছে, তাই ভাবে সে। তা হোক, কোন দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেই তো পাওয়া যাবে সন্ধান। আসিফ এগিয়ে যায় একটা মুদির দোকানের দিকে।

—এই যে ভাই, টেম্পু পাওয়া যাবে কোথায়?

—পাওয়া যাবে... খুঁজে দেখুন, ঠিক পাওয়া যাবে।

আসিফের একটু অদ্ভুত লাগে। দোকানি ঠিক তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না, তার মাথারও প্রায় তিন-চার ইঞ্চি ওপরে তাকিয়ে কথা বলছে। তার চাহনিটাও কেমন ঘোলা ঘোলা। ঠোঁটের কোণে হালকা একটা ঝুলিয়ে রাখা হাসি। যেন অন্য দুনিয়ার লোক।

—পাওয়া তো যাবে বুঝলাম। কিন্তু কোনদিকে পাওয়া যাবে?

—যেদিকে খুঁজবেন সেদিকেই পাওয়া যাবে। এখানে ঈশ্বর ছাড়া সব পাওয়া যায়। খুঁজে দেখুন ভালো করে।

আসিফের মনে হয় লোকটা হয়ত পাগল। কিন্তু হয়ত বদ্ধ পাগল না। তাই হয়ত দোকানে বসিয়ে রেখেছে আত্মীয়রা। এরকম অনেক মাথাখারাপ লোক দেখেছে সে। সব ভালো, কিন্ত কথাবার্তা উলটাপালটা। তাদের গ্রামেই আছে একজন, লোকমান চাচা। মাথাটা সামান্য এলোমেলো, তাই পরিবারের লোকজন দোকান করে দিয়েছিল। বিয়েও হয়েছিল ঠিকঠাক, তারপর সে একদিন যা কাণ্ড করেছিল...! থাক, এগিয়ে যাওয়া যাক তারচেয়ে। সে এগিয়ে যায় আরেকটা দোকানের দিকে।

—ভাই, টেম্পু স্ট্যান্ডটা কোনদিকে?

—খুঁজুন, নিশ্চয়ই পাবেন। এ তো আর ঈশ্বর নয় যে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।

এ লোকটিরও সেই একই চাহনি, একই হাসি। কথাও বলছে মাথার ওপরদিকে তাকিয়েই। আসিফ অন্য দোকানগুলোর দিকে তাকায়। খুব সাধারণ, অন্যান্য বাজারের দোকানের মতই। কিন্ত দোকানদারদের সবার মুখের ভাব একই রকম। সব দোকানেই খদ্দের আসছে যাচ্ছে। আসিফ খেয়াল করে দেখে খদ্দেররাও দোকানদারদের মাথার উপরের দিকে তাকিয়েই কথা বলছে।

আসিফের এবার ভয় করতে লাগল। কিন্তু সে আতঙ্কিত হলো না। বাজারের ওপারেই তো আবার হাইওয়ে, বেরিয়ে গেলেই হয়। টেম্পু সে পরে দেখা যাবে। আসিফ নিচের দিকে মাথা দিয়ে হাঁটতে থাকে। কোনদিকে তাকায় না, চোখটা সামান্য খুলে হাঁটতে থাকে, হাঁটতেই থাকে। অনেকক্ষণ হাঁটার পর সে মুখ তোলে, কিন্তু এ কি! যেখান থেকে শুরু করেছিল, সে তো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সে পেছনের দিকে তাকায়, সেদিকেও বাজার। সামনে তাকায়, তাও বাজার। এই বাজারের কি কোন শেষ নেই!

আসিফ দৌড়াতে শুরু করে। মানুষদের ঠেলে ঠেলে সে দৌড়াতে থাকে। দৌড়ে দৌড়ে হাঁপিয়ে ওঠার পর সে দাঁড়ায়। পিঠের ব্যাগটাকে দশগুণ ভারী লাগছিল তার। হাঁটুতে ভর দিয়ে জিরিয়ে নেয়ার পর মুখ তুলে দেখে সেই প্রথম দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সে। এবার আসিফ হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে, তার নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। গায়ে চিমটি কেটে সে পরখ করে। নাহ, এ স্বপ্ন নয়! হায় ঈশ্বর! এ কোথায় এল সে!

কাঁদতে কাঁদতে আসিফ টের পায় তার পাশে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে। মুখ তুলে দেখে এক মধ্যবয়সি লোক, তার মুখের ভঙ্গিও দোকানিদের মতই। একটা অদ্ভুত খুশি খুশি ভাব, কিন্তু কেমন অবাস্তব! লোকটা ইশারায় আসিফকে তার পেছন পেছন আসতে বলে।

চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে আসিফ লোকটির পেছন পেছন যায়। সারি সারি দোকানের পাশ দিয়ে একটা রাস্তার মত চলে গেছে। রাস্তার শেষে একটা বড় দোকান, রাস্তার দুপাশে ঘন অন্ধকার। লোকটি বড় দোকানটার মধ্যে ঢোকার ইশারা করে চলে গেল। আসিফ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ঢুকবে কি ঢুকবে না, বুঝতে পারছিল না। তারপর ইতস্ততভাবে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার একটি পাল্লা খুলে দোকানটায় প্রবেশ করল। দোকানটা আধো অন্ধকার, তারমধ্যে এক কোণে একটা চেয়ার পেতে একটা প্রায়বৃদ্ধ লোক বসে আছে। আসিফ এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে:

—সদরে যাওয়ার রাস্তাটা বলবেন। আমি হারিয়ে ফেলেছি।

লোকটি চোখ তুলে তার দিকে তাকালো। একে যেন একটু স্বাভাবিক লাগছে। আসিফের ভয় একটু কমল।

—দয়া করে বলুন না। আমার ফেরাটা খুব জরুরি।

—কি করে বলব বলো! আমি তো আর ঈশ্বর নই, আর এখানে কোন ঈশ্বর থাকেন না। ঈশ্বর থাকলে নিশ্চয়ই সাহায্য করতেন। আর দয়া করতে বলছ? দয়া এখানে পাবে না।

—কেন? পাব না কেন?

—দয়া আসলে ঈশ্বর সংশ্লিষ্ট। যারা দয়া করে, তারা দয়া করে কারণ তারা মনে করে যে তাদের দয়ার বদলে ঈশ্বর তাদের দয়া করবেন। এখানে ঈশ্বর নেই, তাই দয়াও নেই।

আসিফ এবার আবার কেঁদে ফেলে।

—দেখেন, ঈশ্বর থাকুক বা না থাকুক, আমাকে এখান থেকে বের করে দেন।

—তা কি করে হয়! এখানে যারা একবার আসে তারা আর বের হতে পারে না। একেবারে মৃত্যুর পর। ঈশ্বর থাকলে হয়ত বের হতে পারতে, যেহেতু ঈশ্বর নেই তাই....

—আপনারা মৃত্যুও বলতেছেন, আবার ঈশ্বর নাইও বলতেছেন! মৃত্যুর পর তো সবাই ঈশ্বরের কাছেই যায়...

—ভুট্টা থেকে পপকর্ন হতে দেখেছ?

—হ্যাঁ...

—সে তো তাপ পেলে আপনিই হয়। ঈশ্বরের কি কাজ। তেমনি জন্ম মৃত্যু এমনিই হয়, ঈশ্বরের কিছু নেই। পপকর্ন খেয়ে নিলে পেটে যায়, মানুষ মরে গেলে মাটি হাওয়ায় মিশে যায়। ঈশ্বরের কাছে যায় কে বলল!

—আপনারা প্রার্থনা করেন না?

—নাহ, আমরা শুধু কাজ করি।

—অপরাধ হয় না?

—অপরাধ কি? অপরাধ তো নির্ণয় হয় ঈশ্বরের সাপেক্ষে। ঈশ্বরের বিপরীত যা তাই অপরাধ। ঈশ্বর নেই, তাই অপরাধও নেই।

—আপনাদের এইখানে তো তাইলে বেশি অপরাধ হওয়ার কথা.... ঈশ্বর যেখানে নাই, সেইখানে বিচার হয় না। অপরাধ বাইড়া যায়।

—ঈশ্বর যেখানে আছে, সেখানে কি খুব বিচার হয়?

আসিফ স্তম্ভিত হয়ে যায়। এ কোথায় এসে পড়ল সে! লোকগুলা কি পাগল!

—দেখেন, অত কথায় কাজ নাই। আমাকে এইখান থেকে বের হওয়ার পথ বলে দেন।

—পথ খুঁজে নাও। এখানে খুঁজলে সব পাওয়া যায়। তবে সময় আর বেশি নেই। রাতের মধ্যে যদি পথ খুঁজে না পাও, তবে...

—তবে?

—তবে নিজেই দেখতে পাবে।

লোকটি মুচকি মুচকি হাসে। আসিফ দরজার দিকে যেতে গিয়ে আবার ফিরে আসে।

—আপনারা কারা? এটা কোন জায়গা?

—আমাদের কোন নাম নেই। এই জায়গারও কোন নাম নেই। অন্তত আমি জানি না।

—আপনি কোথা থেকে আসছেন?

—জানি না তো। মনে হয় যেন সারা জীবন ধরে এখানেই আছি।

—আপনি অন্যদের মত না।

—আমার মত আরও আছে। যারা খুব হতাশ থাকে, তারা অন্যরকম হয়ে যায়।

লোকটি আবার মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। আসিফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর ঘুরে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। এই পাগলের এলাকায় থাকবে না সে, কিছুতেই না। ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সে। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে পা বাড়ায়। আজ রাতের মধ্যে যেভাবেই হোক তাকে বাইরে যাওয়ার রাস্তা বের করতেই হবে।

বড় দোকানটা থেকে বেরিয়ে আসিফ হাঁটতে থাকে। হঠাৎ তার মনে পড়ে, তার পকেটে তো ফোন রয়েছে। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই হতবাক হয়। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে নেটওয়ার্কের জায়গায় ক্রস চিহ্ন উঠে রয়েছে। আসিফ ফোন রিস্টার্ট দিয়ে আবার চেষ্টা করে। কিন্ত না, ফোন যে কে সেই। সে আশপাশে তাকায়, সরু একটা রাস্তার ওপর সে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার দুধারে ঘন অন্ধকার। ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে সে অন্ধকারে চলা শুরু করে। মাটির উপর দিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটার পর সে পেছনে ফিরে তাকায়। নাহ, পেছনেও ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। যেখান থেকে হাঁটা শুরু করেছিল সেই জায়গাটাও দেখা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ এভাবে হাঁটার পর সে দৌড়তে শুরু করে। ওইতো, ওইতো সামনে আলো দেখা যাচ্ছে। কিন্ত এ কি! জায়গাটা যেন পরিচিত মনে হচ্ছে। আসিফ বিস্মিত হয়, গতি কম করে আস্তে আস্তে দেখে সে ফিরে এসেছে আবার সেই বড় দোকানটার সামনে, যেখান থেকে সে শুরু করেছিল।

আসিফ নিরাশ হয়ে বসে পড়ে। এ কেমন জগৎ! এ কি কেবলই এক গোলকধাঁধা! এর ভেতর থেকে কি সে কোনদিনই বের হতে পারবে না?!

সে আবার ফিরে যায় সেই লোকটির কাছে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহে পা যেন আর চলছিল না তার। দরজার পাল্লা ঠেলে ঢুকে সে কাঁপা পায়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে লোকটির চেয়ারের কাছে। "আমাকে মুক্তি দিন, মুক্তি দিন আমাকে। আমার মায়ের কেউ নেই, আমার ভাইটা ছোট। আমার বোনের ছেলেটাকে সোনার কিছু না দিলে আমার মায়ের মুখ থাকবে না বেয়াই বাড়িতে। আমাকে ফিরতে দিন! দয়া করুন! দয়া করুন!"

দুই বছর পেরিয়ে গেছে। আসিফ বসে আছে তার দোকানে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এলইডি লাইটের কাছে কয়েকটা সবুজ কাচপোকা ওড়াউড়ি করছে। কিছুক্ষণ পর ডানদিকে হাঁটতে হাঁটতে আসা একটা ছেলেকে দেখা গেল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ছেলেটি এসে জিজ্ঞেস করলঃ

— টেম্পু স্ট্যান্ডটা কোনদিকে ভাই?

— খুঁজুন, খুঁজলেই পেয়ে যাবেন। এখানে ঈশ্বর ছাড়া সব পাওয়া যায়।

তার চোখ ঘোলাটে, ঠোঁটের কোণে এলোমেলো হাসি আর দৃষ্টি ছেলেটির মাথার তিন-চার ইঞ্চি ওপরে।



(পরবাস-৮২, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)