ISSN 1563-8685




ছত্তিশগড়ের চালচিত্র


|| বড়জাত-মেজজাত-ছোটজাত-বজ্জাত ||

(১)

জকাল গঙ্গারাম লাফটার ক্লাবের সভ্য হয়েছে। বিলাসপুরে জোনাল অফিসে পোস্টিং পাওয়ার পর ওর বড্ড একা একা লাগছিল। সহকর্মীদের মধ্যে কেউ চেনা নয়, ওর ব্যাচেরও নয়। হেল্‌থ চেক-আপে ধরা পড়েছে রক্তে শর্করা সীমান্তরেখা ছুঁই ছুঁই করছে। ওর গোমড়ামুখ দেখে বৌ বলল--রোজ সকালে কোম্পানি গার্ডেনে গিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি কর, অনেকে যায়। আর হু-হু-হা-হা ক্লাব জয়েন কর।

--হু-হু-হা-হা ক্লাব?

--ইংরেজি নাম লাফটার ক্লাব, কিন্তু পাড়ায় সবাই বলে হু-হু-হা-হা। আসলে সাতসক্কালে, মেয়ে-মদ্দ-জোয়ান-বুড়ো সবাই মিলে একে অন্যের পিঠ থাপড়ায়, হাতে হাত মেলায় আর জোরে জোরে হা-হা-হা-হা, হু-হু-হু-হু করে হাসির ভান করে।

--কাজ-কম্ম নেই, খামোকা হাসবে? তার জন্যে কেলাব?

--আরে ও একটা ব্যায়াম, তবে একা-একা নয়, তোমার ভাল লাগবে।

গঙ্গারাম বৌয়ের উপরোধে ঢেঁকি গিলল, ক্লাবের মেম্বার হল।

কিন্তু হাসি যে কি কঠিন? তাও বিনা প্ররোচনায়। ওর পিঠে থাবড়া কসিয়ে হাসতে থাকা এক প্রৌঢ় বোঝালেন যে হাসলে বডির মধ্যে যে কেমিক্যাল রিয়্যাকশন হয়, মেটাবলিজমে পজিটিভ এফেক্ট হয়। তা সে হাসি জোর করেই হাসুন আর পেটে সুড়সুড়ি লাগলে!

দু'হাত তুলে এইসব হাসাহাসি ও শ্বাসের ব্যায়ামের পর অল্পবয়েসি ও মহিলারা বাড়ি যায়। গোটা পাঁচেক রিটায়ার্ড ও আধা-রিটায়ার্ড বুড়ো ঘাসের ওপর বসে গুলতানি করে, প্লাস্টিকের গ্লাসে চা খায়, এ ওর পেছনে লাগে; তারপর রোদ্দুর চড়লে নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে বাড়ি যায়।

গঙ্গারামের পিঠে থাবড়া মারা প্রৌঢ় তামসকর হলেন এই সংঘের প্রেসিডেন্ট, দশাসই চেহারার ভদ্রলোক, রিটায়ার্ড ডিএসপি। আর সেক্রেটারি হলেন শুঁটকো খেঁকুরে দেওয়ানজি, রেজিস্ট্রি অফিসের বড়বাবু, রিটায়ার করতে ছ'মাস বাকি।

কেমন করে যেন গঙ্গারাম এই বুড়োদের ঘাসে বসে ফুটকাটা আড্ডারও সদস্য হয়ে পড়ল। ও বসে থাকে এককোণে, রা কাড়ে না। অবশ্যি কেউ ওর মতামত চায়ও না।

কেননা বুড়োগুলো সবাই পুরনো বন্ধু, কেউ কেউ এই শহরেই জন্মেছে, বাকিরা কর্মসূত্রে এখানে এসে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। ওদের হাঁটুর বয়েসি গঙ্গারামকে কেউ লক্ষ্য করে না। কিন্তু চা আসলে ও বাদ পড়ে না, আর পালা করে দামটা চুকোনোয় ওর নম্বরও লেগে যায়।

এদের আড্ডায় বসে গঙ্গারামের যেন কপালের ওপর আর একটা চোখ খোলে। সত্যি, সংসার যে কতবড় হরেকরকমবা তা এতদিন গঙ্গারাম জানতো না।


এই যেমন সেদিন তামসকরজি বললেন--আচ্ছা, গোপালদাস, একটা কথা বল দেখি। অনেকদিন তোকে জিগ্যেস করব করব করছি।

সদরবাজারে ফার্টিলাইজার শপের মালিক গোপালদাস কেশবানী মৃদু মৃদু হাসেন।

--বলেই ফেল।

--সত্যি বলবি তো? এই যে প্রত্যেক রোববারে তোকে দেখি সকাল দশটায় গোলবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে একগাদা ফুটপাথের বাচ্চা, জুতো পালিশদের জিলিপি খাওয়াতে আর প্রত্যেককে আট আনা করে দিতে--ব্যাপারটা কি? কোন ব্রত-টত রেখেছিস নাকি?

গোপালদাসের মুখের থেকে কান এঁটো করা হাসি মিলিয়ে যায়।

বলছি, বলে উনি গম্ভীর হয়ে বাকি চারজনের মুখের দিকে তাকান। সবার চোখে অদম্য কৌতূহল।

তামসকর ঝামরে ওঠেন--এই আমাদের কাছে লুকোবি না। সত্যি কথা বলবি।

গোপালদাসের চেহারায় আবার সেই হাসি উঁকিঝুঁকি মারে।

--দাদা, সক্কালে এখনো কাকে গু খোটেনি, মিথ্যে বললে ধম্মে সইবে? বলছি।

আবার একটু দম নিয়ে শুরু করেন--কি জান, প্রথম জীবনে আমি গোলবাজার পাড়াতেই থাকতাম। এখন ভাবি এই যে পথশিশুগুলো, অজ্ঞাতকুলশীল। এদের মধ্যে ক'জন আমার নিজের ঔরসজাত তা কে জানে। আমার স্বভাব কেমন ছিল তা তো তোমাদের জানা। এদের প্রতি কিছু কর্তব্য তো আছে। তাই প্রত্যেক রোববারে--'

সবার মুখে এক বিচিত্র হাসি ফুটে উঠেছে।

তামসকর ঘোষণা করেন--এমন সত্যি বলার জন্যে গোপালদাসের আজকের চায়ের পয়সাটা আমি দেব।

জাত নিয়ে কথাঃ ২

আজ তক্কাতক্কি জমে উঠেছে রাজনীতি নিয়ে। তামসকর হলেন আরএসএস ঘেঁষা বুদ্ধিজীবী। বিশ্ব হিন্দু পরিষদকেও চাঁদা দেন। সিদ্ধকামনা বজরঙ্গবলী মন্দিরের পরিচালন সমিতিতেও ট্রেজারার। কাল গেছিলেন পুণে থেকে বামপন্থীদের আমন্ত্রণে আসা কোন বক্তার পুরাণকথার নতুন ব্যাখ্যা শুনতে।

সবাই আজ ধরে বসেছে--কেমন হল বামপন্থীদের পুরাণ নিয়ে সেমিনার? ওরা কি জানে হিন্দুপুরাণের? ওরা তো মস্কোয় বৃষ্টি হলে কোলকাতা-দিল্লিতে ছাতা নিয়ে রাস্তায় বেরোয়। খুলে বলুন দিকি।

---আর বোল না। ওরা পুণে থেকে আনিয়েছিল শরদ পাতিল বলে এক বুদ্ধিজীবিকে। উনি বললেন--যুধিষ্ঠিরের আসল বাপ হল বিদুর। এটা নাকি মহাভারতে ইশারায় বলা আছে। আর বললেন লাঙলের ফাল থেকে উঠে আসা ভূমিসূতা সীতাকে ব্রাহ্মণ্যবাদের আইকন শূদ্রকতপস্বী হত্যাকারী রামের বিরুদ্ধে বামেদের দলিতদের আইকন হিসেবে দাঁড় করানো উচিত, নইলে দক্ষিণপন্থী পলিটিক্সের সঙ্গে পেরে উঠবে না।

---সে কি?

--আরে হ্যাঁ, লোকটা আগে মহারাষ্ট্রের সিপিএম লীডার ছিল। কিন্তু বলল--ভারতবর্ষে ক্লাস নয় কাস্ট, শ্রেণী নয় জাত হল বেসিক সামাজিক এনটিটি। এইটা না বুঝে খালি ক্লাস-ক্লাস করে আজকে কম্যুনিস্টদের এই হাল। আসলে অধিকাংশ দলিতরা হল সর্বহারা।

এবার মুখ খুলেছেন বিমল মিশ্র, সারাজীবন রামমনোহর লোহিয়ার চ্যালাগিরি করে বুড়োবয়সে অযোধ্যাকাণ্ড থেকে রামভক্ত হয়েছেন।

--যাকগে, ওর কথা ছাড়ুন। কিন্তু কাঁসিরাম-মায়াবতীর পার্টি তো জাত ভাঙিয়েই খাচ্ছে। শোননি, "ব্রাহ্মণ-ঠাকুর-বানিয়া-ছোড়, বাকি সবই ডিএসফোর।" ওরাই নাকি মেজরিটি? মানে দলিতের দল।

--দূর! মায়াবতীও এখন হালে পানি না পেয়ে ব্রাহ্মণদের দলে টানছে। আগের শ্লোগান বদলে ফেলেছে।

আর শহরে কিসের জাত? নীলকমল হোটেলে যে ছোকরাগুলো চা এনে দেয়, এঁটো ডিস নিয়ে যায়, জলের গেলাস নিয়ে আসে ওরা কি জাত বলতে পারবে? জিগ্যেস করার সাহস আছে?

--মাথা খারাপ! হরিজন অত্যাচার নিরোধক আইনে জেলে পুরে দেবে।

--কচু করবে! কয়েক হাজার টাকা ট্যাঁকে পুরে ছেড়ে দেবে।

--তাই কি কম ঝামেলা! একেই তো রিজার্ভেশনের চোটে ভদ্রলোকের ছেলেপুলেদের চাকরি পাওয়া মুশকিল!

বর্মাজী দু'হাত তুলে বললেন--আজকাল যখন জাতের ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে গেছে তখন সাতসকালে এইসব ফালতু বকোয়াস করে সময় নষ্ট করছি কেন? সন্তোষ ভবনে গিয়ে চা খেলে হয় না?

--সত্যিই ছত্তিশগড়ে জাত নিয়ে কিছু নেই? গুরবাইন-ডবরি হত্যাকাণ্ড ভুলে গেলে? যাতে ওই গাঁয়ে মধু সিং-পোক্কল সিং ঠাকুরদের সশস্ত্র দল গোটা বস্তি ঘিরে ফেলে সতনামীদের ঘর পুড়িয়ে প্রায় চারশ' জনকে মেরেছিল? ওদের মেয়ে বাচ্চা সবাইকে চ্যাংদোলা করে আগুনে ফেলে দিয়েছিল।

ক্ষেপে গেলেন তামসকর।

--ফালতু কথা বলবে না, বিমল! রিয়েলিটি কি? ওসব সত্তরের দশকের কথা। তখন অনেকটা বাড়িয়ে বলা হয়েছিল। আর মামলা সুপ্রীম কোর্ট অব্দি গড়িয়েছিল। আমাদের দলের অ্যাডভোকেট কেশরবানীজি মামলা লড়েছিলেন। সুপ্রীম কোর্টে সবাই ছাড়া পেয়ে যায়। তুমি কি কোর্টের চেয়ে বেশি জান?

--কেন খুঁচিয়ে ঘা করছ বিমল? তুমি কি বাঙালী? না কি পাশের বাড়ির বাঙালী বৌদির হাতের চা খেয়ে খেয়ে ওদের স্বভাব পেয়েছ?

সবাই হেসে ওঠে। বিমল মিশ্র ভাঙলেও মচকাবেন না। মনে মনে চটেছেন। কথা ঘোরানোর চেষ্টায় বললেন--বাঙালীরা খুঁচিয়ে ঘা করে? যা খুশি বললেই হল?

---আলবাৎ করে। ওদের সবসময় উত্তেজনার আগুন চাই। কোথাও কিছু নেই এক বাঙালী ফিল্মমেকার সত্যজিৎ রায় না কে, ব্যাটা বিদেশে দেশের গরীবি বেচে নাম কামিয়েছে, প্রেমচন্দের সদগতি গল্প নিয়ে সিনেমার শ্যুটিং করতে সোজা হাজির রায়পুর জেলার পলারিতে। ভাবটা যেন যত জাতপাতের ঝামেলা ছত্তিশগড়েই। বাঙ্গাল মেঁ কুছ নহীঁ। আরে ইউপির গ্রাম নিয়ে কবে প্রেমচন্দ কী লিখেছিল তা নিয়ে তুই ছত্তিশগড়ে কেন এলি? আমরাও ছাড়িনি।

যখন ডিডি-১ গোটা দেশে এক রোব্বারে সদগতি দেখাচ্ছিল, আমরা বয়কট করে রায়পুর দূরদর্শনে হেমামালিনীর মা ফিলিম দেখাতে বাধ্য করেছিলাম।

--যা বলেছ, এসব খুঁচিয়ে ঘা করা ছাড়া আর কি! জাতপাত আছে, থাকবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বানিয়ে গেছেন, গীতায় পড়নি? " চাতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টঃ / গুণকর্মবিভাগশঃ"।

---তবে জাতপাত নিয়ে ছোঁয়াছুত? ঘেন্না? আগের মত নেই। অনেক বদলে গেছে।

এবার বিমলের হাসির পালা।

--তাহলে মানছ যে জাতপাত আছে, রূপ বদলে, ঘেন্না নেই।

বেশ, আমি প্রস্তাব রাখছি যে আমাদের মধ্যে থেকে কোন চারজন জাতপাত ছোঁয়াছুঁয়ি নিজেদের কিছু গল্প বলুক। তার থেকে একটা ছবি ফুটে উঠবে।

---আর তুমি শালা তার থেকে কপি-পেস্ট করে "ছত্তিশগড়ে জাতিভেদের পরিবর্তিত রূপ" গোছের একটি ধারাবাহিক ফিচার "নবভারত" পত্রিকায় লিখে ফাঁকতালে কিছু টাকা কামিয়ে নেবে।

বিমল স্থানীয় হিন্দি দৈনিকের প্রবীণ সাংবাদিক, কিছু ফিচারও লেখেন। এবার ওনার চেহারায় একটা ফিচেল হাসি ফুটে উঠেছে।

--যাকগে, শুরু কে করবে? আমি বলি কি চুপচাপ বসে থাকা ওই ব্যাংকে কাজ করা গঙ্গারাম দেবাংগনকে দিয়েই শুরু করা যাক।

--আমি? না-না।

দেবাংগন সংকোচে সিঁটিয়ে যায়।

তামসকর পিঠে হাত রাখেন।

--লজ্জা করলে চলবে না। এখানে সবাই আপলা মানুস। গ্রামীণ ব্যাংকের সুবাদে গাঁয়ে-গঞ্জে ঘুরেছ, দশরকম দেখেছ। একটা জম্পেশ করে শোনাও দেখি। তাহলে পর পর দুবার তোমার চায়ের পয়সা মাপ।

গঙ্গারামের গল্পঃ

আমি আর কি বলব! আমি হলাম দেবাঙ্গন। মানে কোস্টা অর্থাৎ তাঁতি। মুসলমান হলে জুলহা, আর হিন্দু হলে কোস্টা। তা আমার দাদা-পরদাদা তাঁত বুনতেন। তানা-বানা এইসব দাদিমার কথায় শুনতাম। আমাদের ঘরে নাকি কোসা মানে তসর বোনা হত। চক্রধরপুর-চাইবাসা থেকে কোসার ফল আনা হত, পিসি, দাদিমা সবাই মিলে গরম জলে সেই ফলগুলো চুবিয়ে ভেতরের পোকাগুলোকে মেরে ফেলত, নইলে ওরা রেশমের সুতো কেটে বেরিয়ে যাবে। তারপর সুতো খুলে লাটাইয়ে জড়িয়ে বাড়ির আঙিনায় এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত মেলে দিয়ে ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেবার মত ওতে মশলা মাখিয়ে শুকনো হত। তারপর শুরু হত কাপড় বোনা। দাদাজি বুনতেন থান, শাড়ি এইসব।

একবার কোরবা স্টেশনে নেমে শর্টকাটে রেললাইন পেরোতে গিয়ে উনি পা মচকে পড়ে গেলেন আর ওঁর ওপর দিয়ে মালগাড়ি চলে গেল।

বাবা তাঁত বুনতে চাইত না। স্কুল পাশ করে কোরবার আইটিআই থেকে ফিটারের কাজ শিখে ভিলাই ইস্পাত কারখানায় চাকরি পেয়ে গেল। ব্যস, আমাদের পরিবার মানে দাদিমা-বুয়াজি সব চলে এল ভিলাইয়ে বাবার কোয়ার্টারে। আমার জন্ম ভিলাইয়ে। সেক্টর-২ তে একটা ভাল স্কুল, সেখান থেকে পড়েছি। জাতপাতের বালাই খুব একটা টের পাইনি।

শুধু দেখতাম আমার স্কুলের বন্ধু খারে। ওরা লালা মানে কায়স্থ। ওদের জাতিধর্ম হল কলম পেশা। ওরা নিজেদের চিত্রগুপ্তের বংশজ মনে করে। ওদের কায়স্থ সমাজের একটা আলাদা সমিতি, হলঘর আছে। সেখানে চিত্রগুপ্ত মহারাজের একটা দাঁড়িগোঁফওলা মূর্তি আছে। আর বছরে একদিন চিত্রগুপ্তের পুজো হয়। সেদিন ও স্কুলে আসত না। ওখানে কাগজ-কলম নিয়ে পুজোয় যেত।

আর এক বন্ধু ছিল দুবে, ব্রাহ্মণ। ওদের বাড়ি গিয়েছি। আন্টির হাতের খাবার খেয়েছি। খালি ওর যেবার জনেউ মানে উপনয়ন সংস্কার হল তখন ও সাতদিন ন্যাড়ামাথা হয়ে বাড়িতে ছিল। অনেক গিফ্ট পেল। খুব খাওয়াদাওয়া হল। কিন্তু তাতে শুধু ক্লাসের ব্রাহ্মণ ছেলেদের নেমন্তন্ন করেছিল।

হ্যাঁ, ক্লাসে জনাদুই সতনামী ছেলেদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বটে, ভলপহরি আর ধৃতলহরে। ওরা টিফিনের সময় আরেক দিকে গিয়ে আলাদা বসে খাবার খেত, আমাদের সাথে ভাগাভাগি করত না। আমি ডাকলেও এড়িয়ে যেত। শেষে দুবে আমাকে বারণ করল। বলল ওদের সঙ্গে একসাথে টিফিন খাওয়া যায় না। ওদের রান্নাঘর নোংরা থাকে। ওরা একরকম তেল মাথায় দেয় যেটার গন্ধ বিচ্ছিরি।

আমার একটু কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু কিছু বলিনি।

ও হ্যাঁ, রশিদ বলে একজন মুসলমান বন্ধু ছিল। ঈদের দিনে ডাকত। আমরা সবাই যেতাম, বিরিয়ানি খেতাম। কিন্তু আমাদের পুজোয় ওদের ডাকা হত না। আর দুবেদের বাড়িতে রশিদ কিছু খেলে ওর বাটি ও গেলাস আলাদা করে রাখা হত। পরে ধোয়া হত।

আমার দাদিমা বলতেন যে ছত্তিশগড়ের আসল মূল লোকেরা হল এই বিশ্বকর্মা মানে লুহার, প্রজাপতি মানে কুম্‌হার আর দেবাঙ্গন মানে তাঁতি, এরা। ব্রাহ্মণ কায়স্থ সব বিহার আর ইউপি থেকে এসেছে। ব্রাহ্মণরা হল সরযূপারী অর্থাৎ সরযূ নদীর ওপারের লোক আর কনৌজিয়া মানে কান্যকুব্জের লোক।

--থাম তো হে ছোকরা! বকবক করে মাথা ধরিয়ে দিলে। কোথায় নিজের ব্যক্তিগত অনুভব থেকে একটা সলিড গল্প শোনাবে তা না একেবারে মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট খুলে বসেছে। আমরা তোমার দ্বিগুণ বয়েসি। ওসব জানা আছে। নতুন কিছু শোনাও নয় তো আজকের সবার চায়ের দাম দাও।

খেঁকিয়ে উঠেছেন খেঁকুরে দেওয়ানজি। গঙ্গারাম ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে চুপ মেরে যায়।

বর্মাজি উৎসাহ দেন। --আরে ও বাচ্চা ছেলে, ধমকাচ্ছেন কেন? এ বার ও ঝক্কাস কিছু ঠিক শোনাবে। বাগড়া দেবেন না। শোনাও হে তোমার কিস্সা-কহানী। ধর, চাকরি জীবনে ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে যদি কিছু দেখে থাক।

--আজ্ঞে, আমি প্রথমে ব্যাংকে যখন প্রবেশনে ছিলাম একসঙ্গে পাঁচজন অফিসার মেস করে থাকতাম। তিনজন ব্রাহ্মণ আর একজন মুসলিম। যতদিন রান্নার লোক পাওয়া যায় নি ততদিন আমরা সবাই মিলে রান্না করতাম। মানে আমি বাসন ধুয়ে দিতাম আর চাল পরিষ্কার করতাম। সৈয়দ তরকারি কাটতো। পেন্‌ঢারকর আটা মাখত, পাঠক তরকারি রাঁধত। ত্রিবেদী পরোটা বানাত, ডাল আর ভাত রাঁধত।

আমি শহরের ছেলে। গাঁয়ের দিকের কথা বলার আদব কায়দা জানতাম না। জানতাম না যে খালি ব্রাহ্মণদের লোকে "প্যার লাগি" (পেন্নাম হই গো) বলে আর উত্তরে ব্রাহ্মণদের হাত তুলে "খুশ রহো" (ভালো থেকো) বলতে হয়। অন্য জাতদের সবাই বলবে --"জয় রামজীকে" (রামজির জয় হোক) বা "রাম রাম"। প্রত্যুত্তরে আমাদেরও ওই "জয় রাম" বলাই রেয়াজ। আমি কি ছাই অতশত জানি! দেখি গাঁয়ের লোক ব্যাংকে ঢুকে আমাদের সবাইকে "প্যার লাগুঁ সাহাবমন" বলছে। আর চৌবে, পেন্‌ঢারকর পাঠকেরা সবাই হাত তুলে "খুশ রহো" বলছে। দেখাদেখি আমিও গ্রাহককে হাত তুলে "খুশ রহো" বলতে লাগলাম। সাথীরা মুচকি হেসে মুখচাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। ভাবলাম আমার ছত্তিশগড়ি আদবকায়দা রপ্ত করার চেষ্টা দেখে ওরা খুশি হয়েছে।

ধাক্কা লাগল সাতদিন পরে।

মেসে খেতে বসে পাঠক বলল--দেবাঙ্গন, তুমি পাবলিককে হাত তুলে "খুশ রহো" কেন বল?

--মানে? তাহলে কি বলব? তোমরাও তো বল। তাই বলি।

পেন্ঢারকর---আমরা বললেই তুমি বলবে? এটা কেমন কথা হল? আমরা হলাম ব্রাহ্মণ, এটা ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ। তুই ব্যাটা তাঁতি, তোর কি করে এমন আস্পদ্ধা হল?

আমার মনে হল যেন তলপেটে কেউ ঘুঁষি মেরেছে। অপমানে হাত-পা কাঁপছে। বললাম--বিশ্বাস কর, আমি এসব জানতাম না। আগে তোমরা কেউ বল নি। আমায় পাব্লিক যদি "প্যার লাগি মহারাজ" বলে তবে আমি কী বলব?

--বলবে "জয় রামজীকে!" তাহলেই ওরা বুঝতে পারবে যে তুমি ব্রাহ্মণ নও। যা না তা সাজার চেষ্টা কর কেন?

--আমি জানতাম না। সত্যি বলছি।

চৌবে বলল, "হ্যাঁঃ জানতাম না! জ্যাদা ভোলে মত বনো। কই সৈয়দ তো কখনো ওরকম বলে না। খালি তুমিই জানতে না। আসলে প্রক্সিতে উঁচুজাতের সম্মান পেতে ভাল লাগে।"

আমার গলা দিয়ে ভাত নামছিল না। গলা বুঁজে এসেছিল।

--খাওয়া নিয়ে নখরা কর না। খেয়ে ওঠ। দানে দানে মেঁ লিখা হ্যায় খানেওয়ালে কা নাম। আমরা তোমার বন্ধু, তোমায় পছন্দ করি। তোমার ভালর জন্যেই ভুল শুধরে দিচ্ছি। এটাকে অন্য ভাবে নেয়ার দরকার নেই।

গঙ্গারাম চুপ করল।

তামসকর সবার দিকে তাকালেন।

সেক্রেটারি দিওয়ানজী রায় দিলেন--তেমন জমেনি। একদিনের চায়ের পয়সা মাপ করা যেতে পারে, তার বেশি নয়। এবার অগুনতি নামহীন বাচ্চার বাপ গোপালদাস, তোমার গল্প শুরু কর। আমরা জানি যে তোমার গল্পে বেশ খানিকটা পেঁয়াজ-রসুনের ঝাঁঝ থাকবে, কিন্তু জম্পেশ হওয়া চাই।

গোপালদাস কেশবানীর গল্পঃ জাত যায় কোথা দিয়ে?

গোড়াতেই একটা কথা বলে নিই। আমি হলাম সিন্ধি, মানে পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লোক। আমার বাপ-ঠাকুর্দা দেশভাগের দাঙ্গায় সব হারিয়ে পায়ে হেঁটে দিল্লি পৌঁছে যান। সেখানে কিছু করার চেষ্টা করেন। তারপর তাউজি মানে জেঠু ব্যবসাটা ভাল করে দাঁড় করান। কিন্তু পরিবারের অমতে বিয়ে করায় বাবাকে আলাদা করে দেয়া হয়েছিল। উনি শ্বশুরের বন্ধুর হাত ধরে ছত্তিশগড়ে এসে আস্তে আস্তে জঙ্গল এলাকায় জমিজিরেত করে মুদিদোকান ও ধানচালের ব্যবসায় উন্নতি করেন। তারপর বিলাসপুরে গোলবাজারে একটি দোকান খোলেন। আমি ওই পাড়ায় বড় হয়েছি। তারপরে বহুদিন আশি কিলোমিটার দূরে কাঠঘোরা জনপদে দোকান চালাই। শেষ বয়সে বিলাসপুরে সিমেন্টের দোকান করেছি। আমার শিক্ষামূলক গল্পটি সেই কাঠঘোরা প্রবাসের সময়ের।

---তোমার গল্প, তাও শিক্ষামূলক? ল্যাংগোটের বুকপকেট?

বিমলের টিপ্পনি।

--কেন, ওর গল্প শিক্ষামূলক হতে পারে না?

বর্মাজি জিগাইলেন।

তামসকর হাত নেড়ে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বল্লেন--দূর! দূর! ও দেবে শিক্ষে? ও হল বাৎস্যায়নের চতুর্দশ রিপ্রিন্ট পড়ে পাশ করা ছাত্তর। চৌষট্টি কামকলা ছাড়া কিছু জানে নাকি?

গুঁফো খেঁকুরে দেওয়ানজির চেহারায় বিচিত্র হাসি ফুটে উঠেছে।

--আহা, বলতে দিন না! সিন্ধি ব্যাটা তো সিন্ধিদের মতই বলবে। ওদের রকমসকমই আলাদা। জানেন তো, ওদের ফুলশয্যার রাতে একটি করে নারকেল দেয়া হয়। পরদিন সকালে বাড়ির কর্তা নতুন বিয়ে হওয়া ছোঁড়াটাকে জিগ্যেস করেন যে নারকেলের জল ভালো ছিল না পচা?

সবাই হেসে ওঠে। গঙ্গারাম লজ্জা পায়। এবার গোপালদাস বলেন--হচ্ছিল জাত নিয়ে কথা, এর মধ্যে ওসব টেনে আনলে কেন? বেশ, যখন আমাদের রীতি-রেয়াজ নিয়ে কথা তুলেছ তখন জানিয়ে দিই যে আমাদের সিন্ধি সমাজে তোমাদের ভারতীয় হিন্দুদের মত জাতপাত নিয়ে অমন কড়াকড়ি নেই।

--মানে?

--মানে হল জাতটাত আছে, কিন্তু ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে কোন ছুঁতমার্গ নেই। আমাদের দূর্গ সরকারী কলেজের অধ্যাপক চন্দানী জাতের হিসেবে প্রায় ছয় ধাপ নীচে, তাতে ওঁর আমার জামাইবাবু হতে আটকায় নি। আমরা আছি তৃতীয় ধাপে।

আর আমাদের সমাজে কেউ ভিক্ষে করে না। রাজধানী রায়পুর থেকে চোদ্দ কিলোমিটার দূরে মানা ক্যাম্পে বাঙালী উদ্বাস্তু আছে। ওরা এসেছে পূর্ব পাকিস্তান মানে আজকের বাংলাদেশ থেকে। আর আমরা এসেছি পশ্চিম থেকে। আমাদের দুই রিফিউজির মধ্যে কত তফাৎ!

আমাদের বস্তিতে কেউ রিফিউজি হয়ে এলে আমরা যত ঘর আছি সবাই একমাস ধরে ওদের একটি টাকা, একবাটি চাল আর একটা করে ইঁট দেব।

ওই প্রথম একমাস, ব্যস্। ততদিনে ও কিছু চাল খেয়ে কিছু বেচে নগদ টাকা দিয়ে শাকপাতা কিনে রাস্তায় বসে বা চায়ের দোকান খুলে চা বিক্কিরি করে সামান্য হলেও কিছু আয় করা শুরু করে দেবে। আর অতগুলো ইঁট মাটি দিয়ে জুড়ে একটা মাথাগোঁজার মত ঝোপড়পট্টি গোছের বানিয়ে নেবে। একবছর পরে দেখুন ও দাঁড়িয়ে গেছে।

আচার্য কৃপালনী, বেনজির ভুট্টো সব সিন্ধু প্রদেশের। শিক্ষার হার আমাদের মধ্যে পাঞ্জাবীদের থেকে একটু বেশি।

এই বলে গোপালদাস কেশবানী গর্বিত চোখে সবাইকে দেখে, তারপর সিগারেটের প্যাকেট বের করে বিমলকে একটা বাড়িয়ে দেয়।

আবার খেঁকিয়ে উঠেছেন দেওয়ানজী।

--এত আডবানীজীর ইলেকশন ক্যাম্পেন! তোর মশলাদার গল্প কোথায়? ফাইন লাগবে।

--দাঁড়ান, বলছি।

একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে গোপালদাস বলতে শুরু করে।

--জাত-টাত যায় কোথা দিয়ে? মানে যেমন প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেলে মৃতদেহের মুখটা খোলা থাকে বা নাকের পাটা ফুলে ওঠে। কারো কারো ক্ষেত্রে পা ফেটে রক্ত বেরিয়ে চিতা নিভে যায়। কারো পায়খানা হয়ে যায়। তখন ওইসব দেখে আন্দাজ লাগানো যায় প্রাণবায়ু কোথা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

--যত্ত বাজে কথা। পায়ুদ্বার দিয়ে যেটা বেরোয় সেটা প্রাণবায়ু নয় অপানবায়ু। ব্যাটা সিমেন্ট-ব্যাচা সিন্ধি, সব তাতেই মিলাবট, সবেতেই ভেজাল দেয়া? শাস্ত্রচর্চাতেও?

--ভাইগে! ভাইগে! ব্যস্ ব্যস্ ! তোমাদের শাস্ত্রচর্চার ঠেলায় আমাদের গল্পের পায়ুদ্বার ফেটে যাচ্ছে। ওকে বলতে দাও দিকি!

--ইয়ার্কি না! স্বামী বিবেকানন্দ এই নিয়ে বাল্যাবস্থায় গভীর গবেষণা করেছিলেন।

এবার তামসকরের আরএসএস সত্তা জেগে উঠেছে।

--তোর পায়ুদ্বারের চর্চায় স্বামীজিকে নিয়ে টানাটানি করছিস কেন? বাজে মালকে সিন্ধিসুলভ চকচকে মোড়কে মুড়ে ছাড়বি?

--বিশ্বাস করুন, স্বামীজির ডাকনাম ছিল বিলে। সেই বিলে যখন দেখল যে তার উকিল বাবার নানা জাতের মক্কেলের জন্যে জাতের লেবেল লাগানো আলাদা আলাদা হুঁকো রাখা আছে, নইলে জাত যাবে, তখন সে এক সকালে সব গুলো হুঁকোয় গুড়ুক গুড়ুক টান মেরে দেখতে লাগল যে জাত ব্যাটা যায় কেমন করে?

তা এ নিয়ে আমিও কিঞ্চিৎ প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষা পেয়েছিলাম প্রথম যৌবনে, সেটাই বলতে চাইছি।

আমার বয়েস তখন বছর বাইশ। কাটঘোরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে বাবার চালু করা কিরানা বা মুদিদোকান সামলাচ্ছি। পনেরদিনে একদিন বিলাসপুরে বাবার কাছে যাই। হিসেব বোঝাই, পরামর্শ নিই। তখন না ছিল টিভি, না ভিডিও। সময় কাটাতে ওই এক ট্রানজিস্টার রেডিও। বিবিধ ভারতী ও রেডিও সিলোন। মাঝে মাঝে আমার নামও "আপ কী পসন্দ" প্রোগ্রামে শোনা যায়। --ছত্তিশগড় কী বিলাসপুর সে কাকা গোপালদাস! আপ শুননা চাহতে হ্যাঁয় মেরি স্বপ্নো কী রানী কভী আয়েগি তো!

তখন আমরা সবাই রাজেশ খান্নার ফ্যান। উনিও সিন্ধি। তাই ওনাকেও কাকা বলা হয়। যেমন মারাঠিদের ভাউ বা বাঙ্গালীদের বাবুমোশায়।

আমি তখন চুলের ছাঁটে, বেলবটম আর পাঞ্জাবীতে কথা বলার ঢংয়ে একদম রাজেশ খান্নার ডুপ্লিকেট। নিজেকে ভারি লেডি কিলার ভাবি। ফরসা রংয়ের কদর যে কত তা ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে টের পেতাম। প্রায় দিনই একটা দুটো গাঁয়ে যেতে হত।

সেখানে ছোট ছোট দোকানে মাল সাপ্লাই দিতাম, পেমেন্ট আদায় করতাম। আর গুরমিটিয়া, স্বর্ণা, আই আর এইট ও দুবরাজ ধানের দর দেখে দাঁও লাগাতাম। খাটতাম খুব। সন্ধেবেলা যেতাম ঢাবায়। রোজ এক বোতল বিয়ারের সঙ্গে একটি রোস্টেড চিকেন খেতাম।

আর বলতে লজ্জা নেই তখন শরীর জেগে উঠত। বয়সের ধর্মে নারীসঙ্গের ইচ্ছে বড় প্রবল ছিল। ভয়-ডর কম। তবে কাউকে ঠকাতাম না, জোর করতাম না। উপহার দিয়েছি কখনো কখনো, কিন্তু টাকা দিয়ে লাইনের মেয়েদের কাছে কখনো যাইনি।

আপনারা মানবেন তো ছত্তিশগড়ের মেয়েরা একটু স্বাধীনচেতা। আপন মর্জি কা মালিক। শরীর নিয়ে ছুঁতমার্গ কম। ব্রাহ্মণ- কায়স্থদের কথা বাদ দিন। ওরা বাইরে থেকে এসেছে। কিন্তু মাটি-ঘেঁষা ছত্তিশগড়ি মেয়েদের বিশেষ করে সতনামী সম্প্রদায়ের মেয়েদের স্বাধীনতা রয়েছে বরের সঙ্গে বনিবনা না হলে অন্য কোন পছন্দের মানুষের কাছে চুড়ি পরে তার ঘরে গিয়ে ওঠার। ওদের সমাজে এই বিয়ের স্বীকৃতি আছে। এমন স্ত্রীকে বলা হয় 'চুড়িহাই পত্নী'।

তা মাঝে মাঝেই চোখে পড়ত কারো কারো চোখে লজ্জা লজা ভাল লাগা। দো তিন বার নজরে চার হো গয়ে তো বাত বন জাতি থী। এর মধ্যে অবিবাহিত-বিবাহিত, যুবতী-কিশোরী সবাই ছিল। এমনকি আমার থেকে বয়সে বড়রাও বাদ যায় নি।

--তা তোমার শিকার করা হরিণীর সংখ্যাটি কত? বিমল হাসি চেপে জিগ্যেস করে।

--আপনি খেতে বসলে ক'টা রুটি খান? গুনে গুনে খান কি? আমি গুনি নি।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম। নদী বা পুকুর থেকে দল বেঁধে জল আনার সময় কেউ কেউ হাসি ছুঁড়ে দিত। কারো কারো আলটপকা ছুঁড়ে দেয়া মন্তব্য কানে আসত--কিত্তে গোরে-চিট্টে হ্যায় রে! লাগতা হ্যায় ছুঁ লেনেসে ময়লা হো জায়েগা।
(কি ফর্সা! কি ফর্সা! মনে হয় ছুঁয়ে দিলে ময়লা হয়ে যাবে।)

সে এক ফাল্গুনের সন্ধে। পালির কাছে আমের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মোটর সাইকেল করে যাচ্ছি চোখে পড়ল একা একটি মেয়ে ঝুড়ি করে কচি আম কুড়িয়েছে। কিছু কোঁচড়ে ভরেছে কিন্তু পড়ে যাচ্ছে। আমি ফটফটি থামিয়ে কাছে গিয়ে দুষ্টু হেসে বললাম--কিছু সাহায্য করতে পারি। ডোহার দুঁহু কা?

ও মিষ্টি হেসে বলল--লাগবে না। এ আমার রোজকার বনিভূতি। মালিকমনকে ঘর লে জানা হ্যায়। কর লেব। (এসব আমার নিত্য খাটাখাটনি। মালিকদের ঘরে পৌঁছুতে হবে। হয়ে যাবে।)

--কিছু কিনে তোর বোঝা হালকা করি? কত করে দিবি?

হেসে বলল--পয়সা নেব না। তুই এমনি দুটো আমার সঙ্গে এখানে বসে খা।

তাই হল। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। মহুয়া ও আমের মুকুলের গন্ধে মাতাল বাতাস। কি করে যেন আমরা সেই আমবাগানে ঘাসের মধ্যে শুয়ে পড়লাম। আর কি বলব! ওর শরীরের থেকে আসা এক মাদক গন্ধ! এমনটি আর পাইনি।

যখন হুঁশ ফিরে এল, তখন রাত হয়েছে। কৃষ্ণপক্ষের রাত। তারায় ভরা আকাশ। আমরা উঠব। আমের ঝুড়িটা ওর মাথায় তুলে দেব। আমার বুকের ভেতর কেমন করে উঠল। আমি পাশ ফিরে ওর গালে একটা আলতো চুমো খেলাম।

তারপরই যেন হঠাৎ বাজ পড়ল। আমার গালে পড়েছে ঠাস্ করে এক কড়া হাতের চড়। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি, যেন কালকেউটে ফণা তুলেছে। ওর চোখ দুটো রাগে জ্বলছে। মুখে গালাগালির ঝড়।

--রোঘা! বেররা! তোর আঁখি ফুট জায়ে। তোর মুঁহ মেঁ কিড়ে পড়ে। (তোর চোখ ফেটে যাক, তোর মুখে পোকা পড়ুক।)

পতা নেই তঁয় কোন জাত-কুজাত! মোলা ঝুঠা কর ডারে! মোর জাত-ধরম ভ্রস্ট হো গয়ে?

(তুই কোন জাত-টাত কিছু জানা নেই, আমাকে এঁটো করে দিলি? আমার জাত ধম্ম বলে কিছু রইল না!)

তামসকর বল্লেন--তো চুমু খেলেও জাত যায়?

দিওয়ানজি বল্লেন--দুদিনের চায়ের পয়সা মাপ!

এই গল্পটা বুড়োদের আড্ডায় শিলাজিৎ সেবনের কাজ করল। সবাই বেশ নড়েচড়ে বসেছে। তিননম্বর গল্পটা বলার জন্যে বর্মাজি ও বিমল মিশ্রের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। শেষে তামসকর রুলিং দিলেন যে এসব নিয়ে মিশ্রের বেশি বাই, তাই শেষ গল্পটা ও বলবে। আগে বর্মাজি।

উনি বীমা কোম্পানির ডেভলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে নাম করেছিলেন। গ্রামীণ এলাকার বীমা করায় রেকর্ড করে প্রাইজ-টাইজ পেয়েছেন। আজকাল কেতাদুরস্ত শার্টপ্যান্ট-টাই ছেড়ে ধুতি-কুর্তায় নেমে এসেছেন। রক্তে শর্করা ও চাপ বৃদ্ধি হওয়ায় মদ ছেড়েছেন, কিন্তু বাবা-জর্দা দিয়ে মিঠা পাত্তি পান খাওয়াটা একটু বেড়েছে। একটি দোনা মুখে পুরে সবার দিকে একটু লজ্জা-লজ্জা ভঙ্গিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর খানিকটা পিক গিলে আরম্ভ করলেন।


বর্মাজির গল্পঃ

--নারীর কোন জাত হয় না। ওদের না উপনয়ন হয়, না সুন্নত। কিন্তু একদিক দিয়ে ওরাই দলিত। ওদের বেদমন্ত্রে অধিকার নেই। তাই পুজোআচ্চার সময় উচ্চবর্ণের লোকজন ওঁ বলবে। কিন্তু শূদ্র ও নারী বলবে 'নমঃ'। নারী পুরোহিত হতে পারে না। নারী মসজিদে গিয়ে নমাজ পড়তে পারে না। এই তো সেদিন পুরীর শংকরাচার্য নিশ্চলানন্দ সরস্বতী বিলাসপুরে "লোকস্বর" পত্রিকার মালিকের বাড়িতে তিনদিন ছিলেন। আমাদের সতর্ক করে বললেন--কোলকাতায় এমনি অধর্ম হয়েছিল। বছর দশেক আগে উনি সেখানে এক মহিলাকে বেদপাঠ করতে বাধা দিয়েছিলেন। বাঙালীরা শোনেনি। সেই পাপে আজও বঙ্গ পিছিয়ে রয়েছে।

আমাদের তুলসীদাসও কম যান না। বিনা দোষে সীতামাইয়াকে বনবাস দেয়া রামজীকে 'মর্যাদা পুরুষোত্তম' বানিয়ে দিলেন। আর লিখলেন-- "চোর-ঢোর-গাঁওয়ার-শূদ্র অউ নারী,
এহি সব হ্যায় তাড়ন অধিকারী'।

(চোর-মোষ-গাঁইয়া-শূদ্র ও নারী,
এদের সামলে রাখতে চাই লাঠির বাড়ি।)

--আবার!

প্রায় শংকরাচার্যের মতই খেঁকিয়ে উঠলেন খেঁকুরে দেওয়ানজি।

--কত করে বোঝাই, ওরে! একটা সোজা-সাপটা গল্প বল্। তোকে বুদ্ধিজীবী বা সোশ্যাল অ্যানথ্রোপলজিস্টের চাপকান পরতে হবে না। বরং পোঁটলিবাবা হয়ে যা! নইলে ফাইন করব। সবাইকে লস্যি খাওয়াতে হবে।

--দেখুন, এটা তো মানবেন যে আপনাদের সবার থেকে ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে গাঁয়ে ঘোরার অভিজ্ঞতা আমার একটু বেশি। সে বাঙ্গোবাঁধের ওদিকে অজগরবাহার রোডের পাশে তুঙ্গা-সতরেঙ্গা হোক বা নাগলোক হওয়ায় বিখ্যাত ফর্সাবাহার তপকরা এলাকাই হোক বা মারবাহীর ভালুক-লকড়বাঘা অধ্যুষিত জংগলী গ্রামগুলো--কিছুই বাদ যায় নি।

তাই আমি কোন একটা নিটোল গল্প বলব না। যা বলব তা হল ছোট ছোট কিস্সা দিয়ে তৈরি জাতপাতের কোলাজ। যদি অনুমতি দেন তো বলব, নইলে বিমলই বলুক।

--আচ্ছা, আচ্ছা,--বেশি ভাও খেও না, তুমিই বল।

আমি প্রথম জীবনে চাকরি করেছি মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভের। গ্ল্যাক্সো-র গ্ল্যাক্সো-লুপিন প্রক্টর গ্যাম্বল, সবগুলোতেই বছর -দুবছর ধরে কাজ করে, গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে তারপর জীবনবীমার কাজ ধরি। সেবার বারাদ্বার বলে হাওড়া-বম্বে লাইনের একটি ছোট প্যাসেঞ্জার হল্ট স্টেশনে নেমে সারাদিন কাছাকাছি কিছু ওষুধের দোকান, তিনজন ডাক্তারবাবুর সঙ্গে বকবক, স্যাম্পল ও লিটারেচার গছানো ও সাতদিনে নতুন অর্ডারের আশ্বাসবাণী--ইত্যাদি নিত্যকর্ম করে ঢাবায় খেয়ে রাত্তিরে নির্জন পি-ডব্লু-ডি রেস্ট হাউসের বিছানায় লম্বা হয়ে একটি রগরগে 'সত্যকথা' গোছের ম্যাগাজিন খুলে চোখ বোলাচ্ছি এমন সময়--ভেতরে আসতে পারি?

ভেতরে ঢুকেছে একটি বছর তিরিশের ছেলে, নাম গণেশরাম 'চালাক'। ঢুকেই টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখে ফ্লাস্ক ভর্তি চা, আর ঠোঙায় মুড়ে আনা কিছু পেঁয়াজি বড়া ও গোটাকয় কাঁচালংকা।

--স্যার, রাতের খাওয়া সেরেছেন? আচ্ছা, তাতে কি, চা তো সবসময় খাওয়া যায়। ছত্তিশগড়ে তো আমরা ভাত খাওয়ার পরও চা খাই, ভালো হজম হয়।

এই বলে দুটো ডিসপোজেবল কাপে করে চা ঢেলে একটি আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আমি নিস্পৃহভাবে চায়ে চুমুক দিয়ে কোন কথা না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। মতলবটা কী? কেন এইসময় এসেছে?

ছেলেটির বাবা সন্তরাম ধৃতলহরে পাশের গাঁয়ের প্রান্তিক এলাকায় অস্পৃশ্যদের পাড়ায় থাকে। ওদের ধোপা নাপিত আলাদা। সন্তরাম খুব ভাল ইঁট বানায়। মানে ইঁটভাটার মিস্ত্রি। ছোটখাট বাংলাভাটা, ও নিজে লীজ নিয়ে দীপাবলীর পর শুরু করে, আর বর্ষা আসার আগে প্রায় সবকটা ইঁট বেচে-টেচে ফুরসৎ। তখন হাতে কিছু কাঁচা পয়সা, খায়দায়, আর জুয়ো খেলে হেরে যাবার আনন্দে।

ছেলে গণেশরাম জয়জয়পুর ব্লকের শেঠানী চম্পাবাঈ স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছে। বাপের জাত ব্যবসায় ওর ঘোরতর আপত্তি। নিজের পদবী পাল্টে এফিডেভিট করে 'চালাক' লিখছে। তা চালাক চতুর বটে, স্থানীয় ইডিয়মে বহোত চলতা-পূর্জা আদমী, বাংলায় চালু মাল।

এই বারাদ্বার ব্লকে আমার কোম্পানীর ওষুধ বিক্রির নেটওয়ার্কের জন্যে ওকে রিক্রুট করেছিলাম। দেখা গেল ভুল করিনি। কিছুদিনের মধ্যেই ও চাণক্যনীতির মূল --সাম-দান-দণ্ড-ভেদ প্রয়োগ করে অন্য প্রতিযোগীদের প্রায় বাজার থেকে আউট করে দিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ও খানিকটা প্রশ্রয় পেতে লাগল।

সে না হয় হল, কিন্তু এখন? এই সময়ে? আমি আবার নকল ওষুধ বা একসপায়ার্ড ওষুধ অজ-পাড়াগাঁয়ের দোকানে চালিয়ে দিয়ে দু'পয়সা উপরি লাভের খেলায় নেই।

--স্যার! আপনার অস্বস্তি বুঝতে পারছি, কিন্তু আজ না বললেই নয়। অনেক ভেবেছি, কিন্তু আপনি ছাড়া কেউ বুঝবেনা।

(এই রে! যে ভয় করছিলাম!)

--কী ব্যাপার? বল, আমি শুনছি।

--আচ্ছা স্যার, বলতে পারেন--আমাদের নামগুলোই কেন অমন হয়?

--মানে?

--ধরুন, আপানাদের ছেলেমেয়েদের নাম হয় অনিল, সুনীল, শিবশংকর, রাকেশ, নির্মল, বিজয়, অনীতা, সুনীতা, পার্বতী, লক্ষ্মী, সুমেলা, মালা, নির্মলা।

আর আমাদের টুরা-টুরিদের দেখুনঃ
খোরবহরা (খোঁড়াকালা), দুকালু (আকালে জন্মানো), সুকালু, মহেত্তর (মেথর), লেড়গারাম (ক্যাবলাকান্ত), বিসাহুরাম (বেচারাম), মন্টোরা, কলকাতিহা (কোলকাতাওলা), নোনিবাঈ (খুকি), শনীচরিন, ইতওয়ারিন, বুধবারিন, মেহতরিন, চামরিন (চামার মেয়েছেলে), দুজবাঈ, তীজবাঈ এইসব।

বলুন, এমন কেন হয়? নামগোত্রেও এই অসাম্য এই অবিচার কেন?

এই অতর্কিত হামলায় আমি বেসামাল। কী বলব ভেবে পাই না। শেষে বললাম--এর কী উত্তর দেব? তুমি তোমার ছেলেমেয়ের ভালো নাম রাখ না, কে মানা করেছে?

--শেষে আপনিও এই বললেন? আপনি অমন বাঁধাগতের দায়সারা উত্তর দেবেন ভাবিনি। এরম তো সবাই বলে। চাইলেই কি যা-খুশি নাম রাখা যায়? ধরুন যদি আমার ছেলের নাম রাখি অমিতাভ, আর মেয়ের নাম রাখি জয়া বা রেখা, তাহলে পাড়ায়, স্কুলে টিটকারির চোটে ওরা ঘরে পালিয়ে আসবে।

বলা হবে--চিটি কো পংখ নিকলী হ্যায়। (পিঁপড়ের পাখা গজিয়েছে রে!) ফিলিম স্টার হতে চায়।

--তা কেন? বামন-ঠাকুর-বানিয়াদের ছেলেমেয়েদেরও তো অমন নাম হয়। দিলীপকুমার সোনী, রাজকাপুর শুক্লা আর দেবানন্দ তিওয়ারি তো এই বারাদ্বার মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং বিরোধী দলে কাউন্সিলরের নাম।

--আপনাকে কি করে বোঝাই বলুন? এইসব নাম তো উঁচুজাতের ছেলেমেয়েদের যুগ যুগ ধরে রাখা হচ্ছে, ফিলিম স্টারদের ঠাকুর্দাদেরও আগে। কাজেই ওদের নাম নিয়ে কোন কথা হয় না, কেউ হাসে না।

--ঠিক আছে। কিন্তু উঁচুজাতের ছেলেমেয়েদেরও চামাররায়, চামড়াসাউ, মহেতররাম, মহেতরীন বাঈ, খোরবহরা, লেড়ভেরোয়া এইসব রাখা হয়, তাহলে তোমার খুঁতখুঁতুনি কিসের?

--সে তো আরো খারাপ! আপনি জানেন কেন এইসব নাম ওরা রাখে? কখন রাখে? জানলে পরে বলতেন না।

শুনুন, যখন পর পর ক'টা বাচ্চা জন্ম নিয়ে অকালে মরে যায়, তখন বামন-ঠাকুর-বানিয়াদের ছেলেমেয়েদের এইসব নামকরণ হয় যাতে যমের নজর না লাগে। কাজলের টিপ পরানোর মত। আসলে আমরা যে যমের অরুচি।

আমি কথা খুঁজে পাই না।

--বর্মা তো বলল গল্পের কোলাজ বানাবে। বেশ কটা ছোটখাট আদখ্যাঁচড়া কিসসা দিয়ে ফুটে উঠবে ইদানীং কালের জাতপাতের ছবি। তাই এখনো কোন মন্তব্য করছিনে। আর একটা হোক।

একটি পান মুখে দিয়ে খানিক চিবিয়ে পিক গিলে একটু পিচ করে পাশে ফেলে বর্মাজি শুরু করলেন। গঙ্গারাম সভয়ে পাশে সরে দেওয়ানজির পেছনে গিয়ে বসল। বর্মাজি দেখেও দেখলেন না।

--একটা ছন্নছাড়া প্রেমের গল্প বলি? আসলে এটা আমার প্রথম জীবনের চাকরি করার দিনের গল্প। তখন একটা চেনাজানার মাধ্যমে কোলকাতার একটা ছোট দেশি কোম্পানিতে ঢুকেছি। ওরা 'কুমারেশ' বলে ছোট বাচ্চাদের পেটব্যথা, পেটফাঁপা এইসবের চিকিচ্ছের জন্যে একটা গ্রাইপ ওয়াটার মিকশ্চারের দেশি সংস্করণ গোছের ওষুধ বিক্রি করত ছোট শিশিতে।

এই কোম্পানিগুলোতে মাইনে খুব খারাপ ছিল। প্রমোশনের আশাও নেই। আসলে একসময়ের নামকরা এই কোম্পানির প্রোডাক্টের রেঞ্জ খুব ছোট, বিজ্ঞাপন নেই। অনেক সাবস্টিটিউট বাজারে এসে গেছে।

যাই হোক, তখন সেই সব মুফলিশির দিনে, মানে যখন আট আনার এক ভাঁড় চা কিনে খেতে দু'বার ভাবতে হত, তখন আমরা ক'জন দুমাসে একবার কোরবার কাছে কাটঘোরা মহকুমার দোকানে সাপ্লাই দিতে গেলে শস্তায় থাকার জন্যে ছুরি গাঁয়ের গৌঁটিয়ার থেকে একটা ঘর মাসিক চল্লিশ টাকায় ভাড়া করেছিলাম।

ইঁটের দেয়ালে সুরকির জোড়, মাটির মেজে, খাপরার ছাত, খাটা পায়খানা--এই ছিল অবস্থা।

বাসস্টপ থেকে হেঁটে ওই ভাড়ার ঘর অব্দি আসতে ঘরের কাছে একটি বাড়ির সামনে আমাদের পায়ের গতি কমে যেত। বাঁদিকের একটি মাটির বাড়ির উঁচু দাওয়া থেকে আমাদের দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে মুচকি হাসছে এক কৃষ্ণসুন্দরী। কষ্টিপাথরে খোদা যক্ষিণীমূর্তির মত তার দেহবল্লরী। আমাদের তখন প্রথম যৌবন, বিশ-বাইশের বেশি নয়।

ঘরে এসে আচার আর একটা শুকনো তরকারি দিয়ে রুটি খেতে খেতে আমাদের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হত এই নিয়ে যে ও চারজনের মধ্যে কার দিকে তাকিয়ে হেসেছে?

শেষে ফয়সালা হল যে চারজনের মধ্যে মেজরিটি যেদিন যার নাম ঠিক করবে সে বাকিদের সিগ্রেট খাওয়াবে।

একই লাইনে ছিল ডাক্তার জয়সোয়ালের চেম্বার। আয়ুর্বেদের ডিগ্রি নেয়া ভদ্রলোক আরএমপি লাইসেন্স নিয়ে অনায়াসে অ্যালোপ্যাথিক প্র্যাকটিস করতেন। ওঁর সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা থাকত--
হম সেবা করতে হ্যাঁয়,
ঈশ্বর চাঙ্গা করতে হ্যাঁয়।

(আমরা শুধু সেবাযত্ন করি,
রোগ সারিয়ে তোলেন ঈশ্বর,)

কম্পাউন্ডার শংকর ইয়ার্কি করে বলতঃ
"ঈশ্বর চাঙ্গা করতে হ্যাঁয়,
হম নাঙ্গা করতে হ্যাঁয়।"

তা সেই ডাক্তার জয়সোয়াল একদিন আমাদের থেকে কিছু আয়ুর্বেদিক টনিক নেয়ার সময় বলে উঠলেন-- এসব কি শুনছি? তোমরা নাকি ওই ব্ল্যাকবিউটির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি কর? ভুগবে একদিন। সতর্ক করে দিলাম।

--ব্ল্যাকবিউটি? কার কথা বলছেন?

--ঠিক বুঝতে পারছ, ওই যে কেউটে সাপের মত মেয়েটা, বুটন বাঈ। ওর স্বভাবচরিত্র ভাল নয়। কিন্তু ও বিবাহিত। ওর স্বামী কিন্তু নজর রাখছে।

--মানে?

--মানে একদিন তোমরা রাম-ক্যালানি খাবে।

--ভাইয়া, আমরা কিছু করিনি। ওই তো আমাদের দেখে হাসে।

--মানছি, এই গাঁয়ে ওর আশিকের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু তোমরা হলে বাইরের লোক। তোমরা সেই লিস্টিতে ঢুকতে যাচ্ছ কেন? আর বাড়াবাড়ি করলে পরে পেচ্ছাবে যন্ত্রণা হবে। ফুলে উঠবে, পুঁজ হবে। তখন সেই আমার কাছেই ইনজেকশন লাগাতে আসবে। কাজেই বলি কি--

দিন যায়। আমরা একটু সতর্ক চলাফেরা করি। কৃষ্ণসুন্দরী বুটন বাঈয়ের ঘরের পাশ দিয়ে চলার সময় একেবারে এনসিসি প্যারেডের "আইজ্ ফ্রন্ট" কম্যান্ডের মত করে সোজা তাকিয়ে দ্রুত পায়ে এলাকাটা পেরিয়ে যাই।

এর মধ্যে একদিন ভর সন্ধেবেলা খবর এল ব্ল্যাক বিউটিকে ভূতে ধরেছে! আর থাকা যায়? প্রতিবেশি হলে কিছু কর্তব্য তো থাকে!

তাই আমরা চারজন গম্ভীর চিন্তিত মুখ করে ভূতের ভর দেখতে বুটন বাঈয়ের ঘরের দাওয়ায় পৌঁছে গেলাম।

ওর স্বামী কোমল নামদেব আমাদের খাতির করে চাটাই পেতে বসাল। জল আর বাতাসা দিল। পাশের দোকান থেকে পানামা সিগ্রেট আনিয়ে দিল। দাওয়ার ওপর, নিচে রাস্তায় এবং ঘরের ভেতরে মেয়েমদ্দ-ছেলেবুড়ো মিলে জনা বিশেক হবে।

বারান্দায় মালসায় আগুন, ধূপ-ধুনো, আর পোড়ানো হয়েছে হলুদ ও লাল লংকা। নীলশাড়ি পরা ব্ল্যাকবিউটির কাজলটানা বড় বড় চোখগুলো অস্বাভাবিক লাল। কিন্তু দৃষ্টিতে বড় ক্লান্তি। ওর চারপাশে যা হচ্ছে তার সঙ্গে ওর যেন কোন সম্পর্ক নেই। গ্রামসেবকের চাকরি করা আমোল সিং মারকাম নিজেকে আদিবাসী বৈগা পুরোহিত বলে। ও লোকজনের দাঁতের থেকে মন্ত্র পড়ে পোকা বের করে, কোমরে যন্ত্রণা হলে হাত চালিয়ে কোমর থেকে পাথরের গুটি বের করে বা পীলিয়া ব্যামো হলে (জন্ডিস) জলপড়া করে রোগীর হাত ধুয়ে অনেকখানি হলুদগোলা জল বের করে রোগ সারায়।

নগদ একশ' টাকা ও একটা ধুতি দেবার কড়ারে কোমল নামদেব ওকেই ধরে এনেছে। ও ব্ল্যাকবিউটির সামনে পান-সুপুরি, কুমকুম সাজিয়ে পুজো করে এখন হাতে তুলে নিয়েছে ঝাঁটা।

সবাই উদ্বিগ্ন। এইবার ঝাঁটার বাড়ি খেয়ে ভূত বলবে সে কে? মানে কার আত্মা এসে বুটন বাঈকে ভর করেছে। কি চায়? কি শর্তে ওকে ছেড়ে যাবে?

কিন্তু শুরুতেই অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স। বৈগা পুরোহিত আমোল সিং ওকে আস্তে করে এক ঘা ঝাঁটার বাড়ি মেরে প্রায় প্রেমিকের গলায় জিগ্যেস করল--তঁয় কৌন হস্? কাবর আয়ে হস্? কৈসে এলা ছোড়বে?

অমনি সেই শ্রান্ত-ক্লান্ত বুটন বাঈ এক ঝটকায় কেড়ে নিল ঝাঁটা, তারপর উঠোন সাফ করার ঢঙে খোদ বৈগাকেই দিল কয় ঘা।

আমোল সিং একেবারে পপাতধরণীতলে।

বাচ্চারা হেসে কুটিকুটি।

কিন্তু কাছাকাছি বসে পালোয়ানগোছের দুটো লোক ওকে ধরে ফেলে বারান্দার থামের গায়ে পিছমোড়া করে বাঁধল। বুটন বাঈয়ের মুখে তখন গালাগালির স্রোত বইছে।

এবার কথা উঠল এই ভূত বা পেত্নীকে কি করে কাবু করা যায়? অধিকাংশের মত হল গরম লোহার শিক দিয়ে ছ্যাঁকা দিতে হবে।

তাহলেই প্রেতাত্মা সত্যিটা কবুল করবে।

কিন্তু লোহার শিক গরম করতেই ব্ল্যাক বিউটির স্বামী কোমল কাঁদো কাঁদো হয়ে হাত জোড় করে বলল--ওর শরীরটা কদিন ধরে ভাল যাচ্ছে না। তাই ওকে এই কঠিন পরীক্ষা থেকে আজ রেহাই দেয়া হোক। আমি নিজে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বাইরের থেকে শেকল তুলে দিচ্ছি, আর মীরা দাতারের দরবারের দেয়া তাবিজ হাতে বেঁধে দিচ্ছি। মনে হয় কাল সকাল নাগাদ ঠিক হয়ে যাবে। নইলে কাল সন্ধেবেলা কঠিন দাওয়াই।

দ্রুত ভীড় পাতলা হতে থাকল। মিনি-মাগনা এমন তামাশা দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে বেশিরভাগ লোক চাপা গলায় শাপ-মন্যি করতে করতে গেল।

শেষে আমাদের মত জনাদশেক ছ্যাঁচড়ালোক এঁটুলির মত ওদের বাড়িতে আটকে রইল। বেশিরভাগই আত্মীয় ও প্রতিবেশি।

সবাই একমত--কাজটা ঠিক হল না। 'ওলা বকরোয়ানা রইসে'।

অর্থাৎ, প্রেতাত্মা কে এবং কেন এসেছে সেটা কবুল করানো খুব দরকার। দু'একজন ভিন্নমত পোষণকারী মিনমিন করে চুপ করে গেল।

সবচেয়ে চড়া গলা বুটন বাঈয়ের ছোটভাই আনন্দরাম কেওটের। একটু মদ গিলে ওর গলা যেন ট্রাকের হর্ন।

ওর উত্তেজিত বক্তব্য হল ওর একমাত্র ছেলে গত বছর ছয়মাসের মাথায় একদিনের জ্বরে মারা যায়। নির্ঘাৎ কেউ নজর দিয়েছিল। কে সেই দুষ্ট আত্মা? দিদির ওপরে ভর করা ভূতটাকে ঠিকমত জেরা করলেই জানা যেত।

কথায় কথায় কেউ বলল--এই মিনমিনে মেয়েলি গলার বৈগা আমোল সিং মারকাম কোন কম্মের নয়। আমাদের অন্য বৈগা আনা উচিত। হয় শহমুড়ির শান্তিরাম অথবা টাঙ্গামার গাঁয়ের রামসজীবন বৈগা।

এই শুনে খেপে উঠে আমোল সিং বল্লো--ওই সব বৈগাগুলো অনপড়, গাঁওয়ার। ওরা ধর্মকর্মের কী জানে?

ব্যস, এবার শুরু হয়ে গেল ধর্ম কাকে বলে? ধর্মাচরণের সাচ্চা অধিকারী কে? বিতর্ক-বিতণ্ডা এবার মাতালদের চিৎকারে পরিণত হল।

আনন্দরাম উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে লাগল--"ধর্ম কী? এসব নিয়ে খামোকা জল ঘোলা কর না। ওসব লেখাপড়া জানা শহুরে বাবুদের আর গাঁয়ের পোঙ্গা পণ্ডিতদের কাজ। আমি বলছি--যার যেটা কাজ সেটাই ধর্ম। যেমন নুনুর কাজ সুসু করা। তাহলে সেটাই নুনুর ধর্ম। সবার উচিত অন্যের ব্যাপারে নাক না গলিয়ে নিজের নিজের ধর্ম পালন করা।

দেখ, নুনু যদি সুসু না করতে পারে তখন সবাই মিলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় কি না?

তখন যার সঙ্গে ওদের ছত্তিশের সম্পর্ক, সেই হরিশ উঠে বলল--আনন্দ ঠিক বলেছে। অধর্ম থেকেই যত গণ্ডগোল।

দেখ, জাতিধর্মও একটা মূল ধর্ম।

আমি বলছি সবার জাতিধর্ম পালন করা উচিত। এখন এই কোমল নামদেব হল ছিপিয়া। এদের জাতব্যবসা হল মেয়েদের প্রসাধনদ্রব্যের ব্যবসা করা। এই নামদেবরা হাটে-বাজারে চুলের কাঁটা, ফিতে, নকল খোঁপা, কাঁচের চুড়ি, নানারঙের টিপ, আলতা, কুমকুম এই সব নিয়ে বসে। এটাই ওদের ধর্ম।

--ঝেড়ে কাশো দেখি! কী বলতে চাও? আমাদের কোমলও তো হাটে-বাজারে ওইসব নিয়ে বিক্কিরি করে। তাতে কী খ্যানত হল?

--কিন্তু ও যে এই কালিন্দী বুটনকে বিয়ে করেছে? ওরা তো ক্যাওট! এদের থেকে নীচু জাত। এই বিয়ে করে ও সমাজের জাত-বিরাদরির নিয়ম ভেঙেছে। সেই পাপে আজ ওর এই যন্ত্রণা।

আদমী কে শুধু দিল কা বাত নহীঁ, দিমাগ কা ভি শুননা চাহিয়ে।

--কিন্তু তার জন্যে তো সমাজ ওকে শাস্তি দিয়েছে। নামদেব সমাজের বৈঠকে সেই সাত বছর আগে থেকেই ওকে একঘরে করে দিয়েছেঃ

"শ্রীমান কোমল নামদেব পিতা স্বর্গীয় কৈলাস নামদেব সাকিন ছিপিয়াপাড়া, গ্রাম ছোটকিছুরি, তোমাকে সমাজ-বিরাদরির বাহিরে নিম্ন ক্যাওট জাতির বুটন বাঈকে বিবাহ করার অপরাধে আজি হইতে জাতিচ্যুত করা হইল। আজি হইতে ইহার নামদেব সমাজে ওঠাবসা-ধোপানাপিত বন্ধ। আমাদের সমাজের কোন ব্যক্তি বা পরিবার জন্ম-মৃত্যু-বিবাহাদিজনিত ক্রিয়াকর্মে বা অনুষ্ঠানে ইহাকে আমন্ত্রিত করিবে না। কোন শুভকর্মে সামাজিক অনুষ্ঠানে ইহার পদার্পণ নিষিদ্ধ। কেহ এই নির্দেশের অবহেলা করিলে অনুরূপভাবে দণ্ডিত হইবে।"

তারপর থেকে ওর ভাইয়েরাও ওর বাড়িতে আসে না বা কোন কাজেকম্মে ডাকে না। তবে ওর খুব বড় অসুখ হলে দু-একবার খোঁজখবর নিয়েছে।

যখন শাস্তি পেয়েছে তখন সব চুকেবুকে গেছে। নতুন করে আর কি পাপ হবে?


আমরা উঠে পড়ি। রাত্তিরে শোয়ার আগে বন্ধুদের মধ্যে কথা হয়।

--আরে, এই সাদাসিধে দেখতে ছিপিয়া জাতের কোমল নামদেব তো গুরুদেব লোক!

--হ্যাঁ রে! প্রেমের জন্যে বাপ-মা-ভাই-বোন-সমাজ সব ছেড়েছে, আবার নিজের গাঁয়েই রয়েছে।

--বুকের পাটা আছে মাইরি! তুই পারবি এরকম?

--না বাবা! আমার সাহস হয় না।

--কিন্তু লোকটা বৌকে কেমন ভালবাসে দেখলি? কিন্তু সবাই যে বলে মেয়েমানুষটা ছমক-ছল্লো, ধান্দাবাজ? কেমন হিসেব মিলছে না।

কদিন পরে ডঃ জয়সোয়ালের কম্পাউন্ডার শংকরের সঙ্গে কথায় কথায় বলিঃ সেদিন ব্ল্যাক বিউটিকে ভূতে ধরে ছিল। তখন জানলাম ওদের ভালবাসার বিয়ে, তাই ওরা জাতের বাইরে। তাহলে তোমরা মেয়েটার চরিত্র নিয়ে এমন সব উল্টোপাল্টা কথা বল কী করে?

--অ! আপনারা ওই আমোল সিং বৈগার ভূত নামানোর ফালতু তামাশা দেখতে গেছলেন বুঝি?

--না না, খোঁজ নিয়েছি। ঘটনাটা সত্যি। শনিবারের বারবেলায় ও বামনডবরি পুকুরটা থেকে চান করে ভিজে কাপড়ে ফিরছিল। তখন নিমগাছের নিচের থেকে যাওয়ার সময় ওকে ভূতে ধরে, ও গোঁ গোঁ করে পড়ে যায়, মুখ দিয়ে ফেনা ওঠে। শুধু আত্মাটা কে সেটা জানা হয় নি।

--এত শুনেছেন আর এটা শোনেন নি যে মেয়েটা আগের দিন কষে মদ খেয়েছিল। তখন কোন গ্রাহক মিনিমাগনা দিয়ে থাকবে। আর মেয়েটা বাঁজা, সাতবছর হল বিয়ে হয়েছে কিন্তু কোন টুরাটুরি হয় নি। ওর গত একবছর ধরেই হিস্টিরিয়ার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে।

--কিন্তু চরিত্রের ব্যাপারটা?

--দেখুন, আপনাদের শহুরে ফান্ডার সঙ্গে মিলবে না।

শুনুন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই গাঁয়ে-গঞ্জে পেটে ছেলে না ধরলে মেয়েদের ইজ্জত থাকে না। তারপর যে জাত খুইয়েছে তার সম্মান আরও কম। আর বাঁজা কথাটা গাঁয়ের মেয়েদের কাছে গালির মত। তাই মেয়েটা এদিক-ওদিক শুতো, যদি পেটে ছেলে আসে। ও মানত না ওর দোষ। কিন্তু পরে দেখা গেল ওরই শারীরিক অক্ষমতা। ততদিনে অভ্যাস খারাপ হয়ে গিয়েছে। আর গরীবের ঘরে দু'পয়সাও আসছে। ফলে গাঁয়ের অনেক বড় মানুষ, মায় আমাদের ডাক্তারবাবুটিও ওর আশিক।

--কিন্তু ওর স্বামী টের পায় না কি করে?

--কেন পাবে না? কিন্তু পেটে টান পড়লে? তাই দু'পক্ষই চক্ষুলজ্জা বাঁচিয়ে চলে।

--কি রকম?

--ধরুন, আজ আমাদের নগরশেঠ ললিত আগরওয়াল ওকে রাতে ডেকেছে। তাহলে ললিতজী দিনের বেলায় মেয়েটার স্বামী কোমল নামদেবকে ডেকে বলবে--আজ যা তো কোসমন্দা গাঁয়ে, গাঁড়া মহল্লার শিবরাজ গাঁড়ার বাড়িতে। ছ'মাস আগে বউয়ের চিকিৎসার নাম করে তিনশ' টাকা ধার নিয়েছিল তার পর থেকে এদিকে মাড়াচ্ছেই না। টাকা আদায় না করে ফিরবি না। রাত্তিরে ওখানেই থেকে যাবি। এই নে কুড়ি টাকা। আর আমার তিনশ টাকা মূল, ৩% হারে ছ'মাসের ৫৪টাকা সুদ ও তোর যাতায়াত ও তলওয়ানা মোতাবেক আরও ৫০টাকা আদায় করে নিবি।

এখন কোমল খেলাটা বুঝে যাবে। শেঠজি রাত্তিরটা ওর বৌয়ের সঙ্গে কাটাতে চান। তাই ও রাত্তিরটা কোসমন্দা গাঁয়েই কাটাবে, আর তিনশ' র জায়গায় ১০০ টাকা এবং নিজের উপরি তিরিশ টাকা নিয়ে পরের দিন ফিরবে।

প্রেমিক যুগলের নিজেদের মধ্যে এই "আঁখমিচোলি" বা 'কানামাছি' খেলার গল্প শুনে আমরাও ভোম মেরে যাই। আর ফেরার পথে বলি--এ হতে পারে না। এসব শংকর রাস্কেলের বানানো টকঝাল গল্প, ও ডাক্তারবাবুকে বদনাম করতে চায়।


তারপর বহুদিন ছুরি গাঁয়ে যাওয়া হয় নি। কোরবার দিকে বিজনেস বেড়ে গেছে। গেবরা কয়লা খাদানের দিকে নতুন টাউনশিপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে আমার কোম্পানির নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছি। এমন সন্ধের মুখে দর্জিবাজারে দেখা শংকরের সঙ্গে।

--কোন কথা শুনছি না। আজ চলুন আমার বাড়িতে, ক্লাবে নতুন ক্যারম বোর্ড কেনা হয়েছে, আমার বাড়িতেই রাখা থাকে। --বেশি কিছু না, রাত্তিরে মাংসের ঝোল আর রুটি, ব্যস। আর যতক্ষণ ঘুম না পায় ক্যারম খেলব, শুধু আপনি আর আমি।

পাগলা খাবি? না, আঁচাবো কোথায়? এককথায় রাজি হয়ে যাই।

বাসে চড়ে গল্প করতে করতে কখন ছুরি এসে যায়। দুজনে নেমে পড়ে মোড়ের পানদোকান থেকে চার খিলি মিঠিপাত্তি পান নিয়ে নিই। তারপরে গাঁয়ের প্রধান সড়ক দিয়ে ভেতরের দিকে এগিয়ে চলি।

যোশীমহারাজের ঘরটা পেরোতেই বিরাট জটলা। কানে আসে কিছু লোকের ক্রুদ্ধ হুংকার ও একজনের তড়পানোর শব্দ। আমরা দুজনে ভীড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে যাই।

সে এক অশ্লীল দৃশ্য!

বরাবরের মুখচোরা মরমে মরে থাকা কোমল নামদেব মত্ত অবস্থায় তড়পাচ্ছে আর দু-একটা বাক্যের পরই পায়ের জুতো তুলে ওর স্ত্রী বুটন বাঈকে লাগাচ্ছে দু-ঘা!

যা বোঝা গেল তা হল কোমলের অভিযোগ ওর বৌ আজ ওকে মিথ্যে কথা বলে বাজারে কেনাকাটার আড়ে আসলে এক 'পোলিসওলা'র সাথে আসনাই করতে কোরবা গেছল, একসঙ্গে পবন টকিজে সিনেমাও দেখেছে আর হোটেলে একটি কামরাতেও ঢুকেছে।

কোমল কোন সূত্রে খবর পেয়ে ওকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে।

এইসব বলে কোমল ওকে লাগাচ্ছে দুই বাড়ি। আর আমাদের মুখরা কথায় চতুর ব্ল্যাকবিউটি?---কোন প্রতিবাদ না, চলে যাচ্ছে না, শুধু হাত তুলে মার ঠেকাচ্ছে আর কেমন এক চাউনি দিয়ে সবাইকে, বিশেষ করে কোমলকে দেখছে।

উপস্থিত ভীড় বাঁদর নাচানো বা সাপ খেলানো দেখার মত করে তামাশা দেখছে। কেউ কোমলকে ঠেকাতে আসছে না। বরং কয়েকজন, বিশেষকরে কোমলের ছোটভাই ও ভাইপোরা ধরতাই দিচ্ছে, চেঁচিয়ে উঠছে--মার দে! মার ডাল শালী কো, কাট কে ফেক দে!

এবার কোমল নিজের গালে জুতো মারে আর হাহাকার করে ওঠেঃ
দেখুন, সবাই দেখুন! এর জন্যে আমি জাত ছেড়েছি, পরিবার ছেড়েছি,সমাজ ছেড়েছি। এর জন্যে? একটা রেন্ডির জন্যে?

আমার কি হবে? একটা রেন্ডির জন্যে জাতধম্মো সব খোয়ালাম? আমার যে নরকেও জায়গা হবে না!

তারপর প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুটন বাঈয়ের চুলের মুঠি ধরে ওর গালে জুতো ঘষতে চেষ্টা করে।

নিজের অজান্তেই আমি কখন চেপে ধরেছি ওর হাত, ছাড়াতে চেষ্টা করছি ওর খাবলা করে চুল ধরা মুঠি।

কিন্তু ওর ভাইয়েরা চেপে ধরে আমার কলার। শক্ত হাতে ধাক্কা দিয়ে ভীড়ের বাইরে ঠেলে দেয়। বলে--আপ বাহর কে আদমী। আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবেন না।

শংকর আমাকে টানতে টানতে নিয়ে আসে।

ওর ঘরে খেতে বসে বলে --আপনি এত ভাবুক হলেন কেন?

--না, কোমলের হাহাকার খেয়াল করেছ? একটি প্রেমের অপমৃত্যুর সাক্ষী হয়ে রইলাম।

শংকর হেসে ফেলে
--কবিতা-টবিতা লিখছেন নাকি আজকাল? সময়ে বিয়ে না হলে এইসব রোগ হয়। কোন অপমৃত্যু-টিত্যু নয়। নিঘ্‌ঘাৎ আজ কামাইয়ের পুরো পয়সাটা ব্ল্যাকবিউটি স্বামীর হাতে তুলে দেয় নি, তাই জাত খোয়ানোর দুঃখ উথলে উঠেছে। আপনিও যেমন!

দিওয়ানজি রায় দিলেন---দু'রাউন্ড চায়ের পয়সা মাপ!

এবার বিমল মিশ্রকে থামানো দায়।

--এটা কি হচ্ছে? বর্মা বলল যে ও ছোট ছোট গল্পের কোলাজ শোনাবে। কিন্তু ওর কৃষ্ণসুন্দরীর গল্প তো প্রায় উপন্যাস! এ তো ফাউল! রোদ্দুর চড়ছে। সবাই বাড়ি যাবে, তাহলে আমার গল্প কখন হবে? আমার যে আজ পেটের ভাত হজম হবে না!

প্রবল ক্যালোর-ব্যালোরের মাঝে তামসকরের হুংকার শোনা গেল। --খামোশ! এটা কি মছলীবাজার? এক এক করে কথা বল। ভাইগে, মিশ্র। তোমার গল্প তাড়াহুড়ো করে নয়। কাল জমিয়ে শুনবো। এখন বর্মার শেষ গল্পটা শুনে নিই। একটু কচি করে ছোট্টমত হোক। তারপর বাড়ি যাব। বর্মাজী! কহানী কী শ্রীগণেশ কীজিয়ে। গল্পের নান্দীমুখ হোক।

--এটা জোয়ার-ভাঁটার গল্প, আবার একটি রাজনৈতিক প্রেমের গল্প বলতে পারেন। কারণ পাত্র-পাত্রী দুজনেই পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিস্ট।

বছর পনের আগের ঘটনা। খবরের কাগজে খুব হৈ-চৈ হয়েছিল। নাম বললে সবাই চিনবেন। তাই নামগুলো পাল্টে দেব।

মিশ্র ফুট কাটতে ছাড়ে না।

--আচ্ছা? এটা সত্যি ঘটনা? আগের দুটোর মতই?

--আগের দুটোও সত্যি । আমি বানিয়ে বলতে পারিনা। তোমার মত প্রেস রিপোর্টার নই তো!

--আচ্ছা, তোমাদের দিন কে দিন বয়স বাড়ছে না কমছে, সব খোকা হচ্ছ? গল্পটা শুরু কর দিকি!

(ক্রমশ)



(পরবাস-৬৭, জুন ২০১৭)