Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines






পরবাসে রঞ্জন রায়-এর লেখা
বই


ISSN 1563-8685




ছত্তিশগড়ের চালচিত্র
তুরতুরিয়া মঠের মোহান্ত ও গরম ভাতের গল্প

ততঃ প্রবিশতি লল্লন মহারাজ!

গ্রাম লখনপুর। গত আদমসুমারিতে জনসংখ্যা দশহাজার পৌঁছেচে। সেই সুবাদে ছত্তিশগড় রাজ্যের সরকার মুখ তুলে এদিকপানে চেয়েছেন। গতবছর এখানে খুলে গেছে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা পিএইচসি। আর এই বছর লখনপুর পেল একটা আস্ত ব্যাংক—গ্রামীণ ব্যাংক। তাতে লকার বা এটিএম নেই তো কী? টাকা রাখা যায়, আবার তুলে নেওয়া যায়। চাষের সময় বীজধান, সার ও মুনিষের জন্যে লোন নেওয়া যায়। ধীরে ধীরে মুদিখানা, কাপড়ের দোকান, পান-সিগ্রেট ও চা এবং ভাজিয়ার দোকানের জন্যেও লোন দেওয়া শুরু হয়েছে।

লোকজন খুশি। মেয়েরাও রুপো বা সোনার গয়না বন্ধক রেখে টাকা তুলছে। ব্যাংকের সিন্দুকে ঢুকছে রুপোর তৈরি কোমরের গোট বা করধন, হাতে পরার নাগমুহুরি বা সাপমুখো আমুলেট; আর রয়েছে গালা ভরা সোনার হার মটরমালা, নাকফুল ও কানপাশা বা ঢার। গাঁয়ের শকুনিবুড়ো জোশীজি ও রামচন্দ্র সিন্ধি পোস্ট অফিস ও দশ কিলোমিটার দূরের মহকুমা সদর থেকে কিনে মজুত করছে বেশ কিছু ১ টাকা দামের রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও ৫০ টাকা দামের নন-জুডিসিয়ল স্ট্যাম্প পেপার। ব্যাংক থেকে লোন তুলতে প্রমিসরি নোট ও এগ্রিমেন্টে দস্তখত করার সময় কাজে লাগবে। তবে দিতে হবে দুনো দাম। তা হোক গে, সবাই জানে সরকারি কাজে কিছু খচ্চা আছে।

কয়েকজন বুদ্ধিমান নিজের নিজের ক্ষেতের 'জমিন কী পর্চি' বা ল্যান্ড রেকর্ডের পাট্টা সীলমোহর লাগিয়ে আপ-টু-ডেট করে রেখেছে। ওরা ব্যাংকে কেউ লোন নিতে গেলে জামানতদার হবে। লোন মঞ্জুর হলে কৃতজ্ঞ ব্যক্তিটি ওকে নিয়ে যাবে, বাসরাস্তার মোড়ে প্যাটেলের চায়-নাস্তার দোকানে। এক কাপ কড়ি-মিঠি চায়, এক খারা (নোনতা) অউর এক পিস মীঠা ( মিষ্টি) তো হোনা হী হ্যায়। এছাড়া আছে একদিন কী বনীভূতি—একদিনের মজুরি; —আহা, ও যে নিজের কাজকম্মো ছেড়ে সারাদিন তোমার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মত ঘুরেছে, ব্যাংকের সরকারি কাগজে টিপছাপ দিয়েছে, বল্লে হবে? খচ্চা ঠিকই আছে।

আমি এই ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চে বদলি হয়ে এসেছি সপ্তাহখানেক হল। আমার কাজ ডিপোজিট বাড়ানো, জনসংযোগ করা। তখন কান টানলে মাথার মত বাকি বিজনেস এমনিই আসবে।

বেলা একটা বাজে, গ্রাহকদের প্রথম ভিড়টা সামলে দিয়ে চলেছি ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। দশমিনিট হাঁটা পথ। উদ্দেশ্য যদি ডাক্তার, কম্পাউন্ডার ও ড্রেসারের অ্যাকাউন্ট খোলা যায়।

আজ হল "নৌতপা" বা বছরের সর্বোচ্চ গরম নয়টি দিনের দ্বিতীয়টি। এইসময় সূর্যদেব নাকি আকাশ থেকে নব্বই ডিগ্রি কোণে কটমটিয়ে ধরিত্রীর দিকে চেয়ে থাকেন। এ গাঁয়ের পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে বইছে জোঁক নদী। তবে এই ভরা জৈষ্ঠে এখন গোড়ালি জল। ফলে আগুনে হাওয়ার তেজ কমছে না। পারা চড়েছে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি। বইছে হলকা। চলতি ভাষায় লু। আমরা অভ্যস্ত, তাই নাক-কান-মাথা সাদা গামছায় জড়ানো—যেন শিশুপাঠ্য বইয়ের তুরেগ দস্যু।

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভিড় ঠেলে মাথা গলিয়ে দেখি প্রৌঢ় ডাক্তার চিঞ্চলওয়ারের তিরিক্ষি মেজাজ, সামনের একটি কিষাণকে বলেছেন বোধহয় ক্রিমি আছে, পায়খানা পরীক্ষা করতে হবে। কাল সকালে উঠে ওটা নিয়ে এসে এখানে জমা দিতে হবে। সে জানতে চাইছে কতটা আনতে হবে?

ব্যস্, উনি অগ্নিশর্মা।

—কতকা লাবে? হামলাভর লাবে। খাবো কা?

(কতটা আনবি? গামলা ভরে আনবি? আমি খাব নাকি?)

জনতার মধ্যে একটা চাপাহাসির ঢেউ।

চোপ্! উনি ধমকে উঠেছেন। নীচুগলায় বিড়বিড় করছেন।

যেদিন থেকে এই চুতিয়া পাবলিক নীচজাতের লোককে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর গদ্দিতে বসিয়েছে, সেদিন থেকে সব জাতধম্মো গেছে। আচার-বিচার-সংস্কারের নামগন্ধ নেই। হোম ডিস্ট্রিক্টে ট্রান্সফারের জন্যে কবে থেকে দরখাস্ত দিয়ে বসে আছি! এখন ছোটলোকেরা মাথায় উঠেছে। কী হবে তা প্রভু গজাননই জানেন।

আমি ব্রীফকেস একপাশে নামিয়ে রেখে আবহাওয়া ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষা করি।

সবে গামছা খুলে মাথা মুখ আর গলার ঘাম মোছা শুরু করেছি এমন সময় এক নতুন আপদ। কোণার বেঞ্চিতে বসে থাকা এক বৃদ্ধ আর তার সঙ্গী চোখাচোখি করে এগিয়ে আসে আর তারপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাক্তারের পা জাপটে ধরে মুখ ঘসতে থাকে।

সবাই হতবাক।

—ছাড় ছাড় হতভাগা! পা ছেড়ে দে বলছি। কী হয়েছে তোর?

ভিড়ের মধ্যে উৎকর্ণ লোকজন এর ওর পাশ থেকে বকের মত গলা বাড়ায়। কোন কোন মহিলার মাথার ঘোমটা খসে যায়।

-—মহারাজ! তঁয় মোর গুরুদেব, তঁয় মোর মাঈবাপ! মোলা বাঁচা লে!

—আগে খুলে বল, তোর সমস্যাটা কী, আর পা ছাড়, লাগছে।

—মহারাজ, মোর সাধু মহারাজ মন্দির মাঁ প্রবেশ নহী কর পাতে, দ্বার পে হী মুড় পটক দেথে! অব তঁয় কুছু দবা-দারু করকে মোলা বাঁচা লে।

(আমার সাধু মহারাজ মন্দিরের দরজাতেই মাথা ঠুকে মরে, ভেতরে যেতে পারে না। তুই কোন ওষুধ-বিষুধ দিয়ে আমাকে বাঁচা।)

চিকিচ্ছের জন্যে ধর্ণা দেওয়া জনতার আমোদগেঁড়ে চরিত্র জেগে ওঠে। ওদের খুক খুক হাসিতে হতভম্ব ডাক্তার চিঞ্চোলকর এর ওর মুখের দিকে তাকান। আরে, কি হয়েছে কেউ কিছু বলবে? কম্পাউন্ডার ঢোঁক গিলে বুড়োর সঙ্গীটিকে শুধোয়—অ্যাই, তুই না ওর সঙ্গে এয়েছিস? এবার বল কে ওর সাধু মহারাজ? আর কোন মন্দিরে তাকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে? আমাদের ডাক্তারবাবু তার জন্যে কী করবেন?

সঙ্গীটি দু'পা পিছিয়ে তোতলাতে থাকে।

জনতা অধীর অপেক্ষায়।

এমন সময় ভিড়ের মধ্যে ধ্বনিত হল এক গম্ভীর জলদ কন্ঠস্বর।

—ও বলতে লজ্জা পাচ্ছে, আমিই বলে দিচ্ছি ডাক্তার।

সবাই চমকে তাকায়। তারপর সাদা কাপড় পরা গৌরবর্ণ চোখা চেহারার এই আগন্তুককে ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করতে থাকে। উনি আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে মুখে 'খুশ্ রহো, খুশ্ রহো' বলে ওদের নিবৃত্ত করে ডাক্তারের দিকে তাকালেন।

—শোন হে ডাক্তার!

এই বুড়ো হল চারপারা গাঁয়ের 'গৌটিয়া' (মোড়ল) নয়নদাস। গত সপ্তাহে বিয়ে করে ঘরে এনেছে একটি নাতনির বয়সী নওলকিশোরীকে। এদিকে বয়েসের সাথে ওর গুপীযন্ত্রটি হয়ে গেছে ঢিলে। প্রতি রাত্রে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, ছেঁড়া তারে সুর বাজে না। সেই সমিস্যের কথা ঠারে ঠোরে বলতে চায়। একে সারানো তোমার কম্মো নয়। ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও। তুরতুরিয়া মঠে গিয়ে সন্ধের সময় কয়েকবার আমার প্রবচন শুনুক। সব কিছু জোর করে হয় না।

এই তবে তুরতুরিয়া মঠের মোহন্ত লল্লন মহারাজ! আমি কয়েকদিন ধরে ভাবছিলাম মঠের সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলতে দশ কিলোমিটার দূরে ওই মঠে গিয়ে আলাপ পরিচয় করব। ভালই হল। এখানেই হয়ে যাক।

উনি কি অন্তর্যামী?

সোজা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন—আরে! আমাদের নতুন ম্যানেজার সাহেব যে! আপনাকে যেতে হবে না। কাল আমিই আপনার ব্যাংকে আসব, ঠিক এই সময়ে। কিছু কাজ আছে।

মহারাজ এলেন পরদিন, বেলা দুটো নাগাদ। রোজকার টাকাপয়সা জমা ও বের করার রুটিন কাজের ভিড় অনেকখানি পাতলা হয়ে এসেছে।

ওঁর পেছন পেছন এসেছে ওঁর শিষ্য, সিমেন্টের স্থানীয় দোকানদার ছোটু শেঠ, পোষাকি নাম দ্বারিকাপ্রসাদ আগরওয়াল। ওর হাজার পঞ্চাশের ক্রেডিট লিমিট চাই। আমি বলেছিলাম ভাল জামিন বা গ্যারান্টর নিয়ে আসতে, তা ওর গুরুদেবকেই ধরে নিয়ে এসেছে।

আমি একটু অপ্রস্তুত।

ওঁকে কষ্ট দেওয়ার কী দরকার ছিল বলায় শেঠ ফিচেল হেসে বলে উঠলো—কী আর করি! আপনি এমন নাছোড়বান্দা। বললাম আমার গোডাউনের ডুপ্লিকেট চাবি ব্যাংকে গচ্ছিত রাখছি, আর কী চাই? কিন্তু আপনার সেই এক রা! ভাল গ্যারান্টর চাই। ওঁর চেয়ে বড় সম্মানীয় গ্যারান্টর এই তল্লাটে আর কে আছে!

ওঁদের বসিয়ে চা আনিয়ে লোন ডকুমেন্টগুলো তাড়াতাড়ি ফিল আপ করছি, মহারাজ উসখুস করতে লাগলেন—ওঁকে যেন সইসাবুদ করিয়ে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়। মঠের মন্দিরে কিছু কাজ বাকি আছে।

বললাম—মহারাজ, কিছু মনে করবেন না, আপনি শেঠজির ব্যাংক লোনের জন্যে গ্যারান্টিতে সই করছেন, কিন্তু এর তাৎপর্য ঠিক ঠিক জানেন তো?

লল্লন হেসে উঠে বললেন—এর মানে হল ছোটু শেঠ যদি সময়মত শোধ না দেয় তো তোমার ব্যাংক আমার থেকে আদায় করবে, এই তো? শুনে রাখ; ওসব আইন আমি খুব জানি। আর তার চেয়ে বেশি জানি নিজেকে। শুধু সইসাবুদ কেন, তুমি যদি দশ জায়গায় আমার দু'হাতের ও দু'পায়ের দশ-দশ করে কুড়িটা আঙুলের ভুসোকালি মাখিয়ে ছাপ লাগিয়েও নাও —হবে কাঁচকলা! আমি যদি ভাবি যে পয়সা দেওয়া হবে না, তো তোমার ব্যাংক আমার থেকে একটি কানাকড়িও আদায় করতে পারবে না। তোমার বয়েস অনেক কম হে ম্যানেজার!

সে যাত্রা ভালয় ভালয় কাটল। উনি যাওয়ার আগে আমাকে ওঁর মঠে এসে প্রসাদগ্রহণ করতে অনুরোধ করে গেলেন। তবে তুরতুরিয়া মঠের মোহান্তের মুখের কথা যে আসলে আদেশ, অন্তত আশপাশের দশটা গাঁয়ের জন্যে—সেটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল।

ধীরে ধীরে এই বিচিত্র মানুষটির বহুবর্ণরূপ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, যেন পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানো হচ্ছে। উনি তুরতুরিয়া মঠের প্রধান মোহান্ত, গুরু গোঁসাই। বহু মানুষ ওঁর কাছে আসে, সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ হয়, আর নানান বিষয়ে পরামর্শ নিয়ে যায়—আধিদৈবিকের চেয়ে আধিভৌতিকই বেশি। লক্ষ করলাম—হেন বিষয় নেই যা নিয়ে উনি পরামর্শ দেন না, সে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধই হোক, কি নতুন কোন ধানের ক্ষেত কেনা; এমনকি শিষ্যটির পঞ্চায়েত চুনাও বা নির্বাচনে কোন পদের জন্যে প্রার্থী হওয়া শুভ বা ইলেকশন জিততে কী স্ট্র্যাটেজি ভাল হবে—সব ব্যাপারেই ওঁর এক্সপার্ট কমেন্ট শিরোধার্য।

বুঝতে পারি শাস্ত্রজ্ঞ বেদ-উপনিষদ পড়া মানুষটির ভেতরে লুকিয়ে আছে একটি সুচতুর ব্যবসায়ী।

উৎকোচের রকমফের

জানুয়ারির শেষ। শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। ধানকাটা সারা। গাঁয়ের লোকের হাতে অফুরন্ত সময় ও অল্পস্বল্প পয়সা। সাতদিন ধরে চলছে তীজাপোলার মেলা। নতুন ফসল উঠেছে, মেলার চারদিকে অসংখ্য দোকান, নাগরদোলা ও ট্যুরিং টকীজ। দেখাচ্ছে 'নদীয়া কে পার' সিনেমা। মেয়েরা কিনছে চুলের ফিতে, আলতা; গুড়ের মুড়কি আর বাচ্চাদের জন্যে মাটির তৈরি ছোট ছোট পুতুল—গরুর গাড়ি, গ্রাম্যদেবতা। বাচ্চারা খাচ্ছে পাঁপড় ভাজা আর বায়না করছে গোলাপি রঙা 'বুড়ির চুল' কিনে সখ করে ঠকবে বলে।

মেলার শেষ প্রান্তে দুটো সরকারি মদের দোকান—বিক্রি হচ্ছে মহুয়া ও কমলালেবু থেকে তৈরি দেশি মদ। এককোণায় এক সরদারজি একটি ব্রিফকেস ও আর একটি রাইটিং প্যাডের ভরসায় চালিয়ে যাচ্ছে তার সুদের ব্যবসা বা হেটো ব্যাংক—স্থানীয় ভাষায় হাটকি বেংক।

সন্ধের দিকে ঘুরতে ঘুরতে আমিও হাজির হয়েছি মেলায়। কিছু ডিফল্টার ক্লায়েন্টকে তাগাদা দেব, নতুন লোন নেওয়া দোকানিদের—যেমন মিষ্টির দোকান, তেলেভাজার দোকান, ছিপিয়া বা মেয়েদের প্রসাধন সামগ্রীর দোকান—স্টক ভেরিফিকেশনের কাজটাও সেরে নেব। রথ দেখা ও কলা বেচা দুটোই হবে।

একবার এয়ারগান দিয়ে বেলুন ফাটানোর কিছু চেষ্টা করে গেলাম একটি বৃত্তের পাশে। সেখানে ঘেরা জায়গার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে কিছু পণ্য—যেমন সাবান, ক্রীম, রুমাল সেট, এসেন্সের শিশি, আলতা ও সিঁদূর কৌটো। একটি বেতের রিং ছুঁড়তে হবে। যদি সেই রিং কোন একটি দ্রব্যকে ঘিরে মাটিতে পড়ে, তবে সেটা আমার। পাঁচটাকা দিলে পাঁচবার রিং ছোঁড়া যাবে।

প্রথম তিনবার ফসকে গেল; চতুর্থ বারে আমার টপকানো রিংয়ে ফাঁসল একটি বোরোলীনের টিউব! সবাই হাততালি দিল। আমি যুদ্ধ জেতার ভঙ্গিতে সেটি নিয়ে হাত বুলিয়ে পকেটে ভরতে যাব, পেছন থেকে গম্ভীর গলায় শোনা গেল—"ভো ভো রাজন্, শৃণ্বন্তু মম বাক্যম্!"

চমকে পেছনে ফিরে দেখি লল্লন মহারাজ।

—জিতেছেন বলে মনে পুলক জেগেছে? বেশ, কিন্তু খবরদার ওটি গায়ে মাখবেন না। ওগুলো সব নকল। দেখবেন?

খেলাওয়ালা ওঁর ইশারায় টিউবটি এনে আমার হাতে দেয়। সবুজ রঙা প্যাকেটটি, বোরোলীনই তো!

উনি আঙুল দিয়ে দেখালেন—নামটি কোরোলীন। কিন্তু অক্ষরের টাইপ, সাইজ ও রঙ একেবারে বোরোলীনের নকল। জানলাম যে চল্লিশ কিলোমিটার দূরের ভাটাপাড়া শহরটি এইসব নকল ওষুধ ও প্রসাধন তৈরির আখড়া। ওখানে ফেয়ার এন্ড লাভলির নকলে তৈরি হয় 'কেয়ার এন্ড লাভলি'—গাঁয়ের মেলায় ও দোকানে লোকজনকে বোকা বানাতে।

ওনাকে আমার ফাইনান্স করা চায়ের দোকান থেকে আদা দেওয়া গরম চা খাওয়ালাম। কিন্তু দোকানদার পয়সা নিল না। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম যে বিনে পয়সায় কিছু নিই না।

লল্লন হেসে হাত তুলে আমাকে নিরস্ত করলেন।

—সংকোচ করবেন না। ও চায়ের দাম নেবে না আমার জন্যে। আমি যে এই এলাকার গুরুঠাকুর—একমেবাদ্বিতীয়ম্।

আমার অস্বস্তি বেড়ে যায়।

কথা বলতে বলতে আমরা গেটের দিকে এগোতে থাকি।

আমি কিন্তু কিন্তু করে বলি—মহারাজ, দ্বারিকাপ্রসাদ, মানে ছোটু শেঠের তিনটে কিস্তি বাকি পড়ে গেছে। একটু বলে দেবেন। ওঁর চোখ একটু সরু হল বোধহয়। তারপর হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন—হয়ে যাবে।

আমরা বেরিয়ে আসছি এমন সময় একটা চেঁচামেচির আওয়াজ। বিস্তর লোকজনের হইচই। ভাবছি এইসব ফালতু ঝামেলায় নাক না গলিয়ে কেটে পড়ব, কিন্তু লল্লন যেন আমার মনের ভাব বুঝে হাত চেপে ধরে বললেন—চলুন।

তারপর প্রায় টেনে নিয়ে চললেন গোলমালের উৎস খুঁজতে।

মেলার একটি তাঁবুতে 'মৌত কা কুয়াঁ' বা মৃত্যুকূপের খেলা দেখানো হচ্ছিল। সেইখানে প্রচুর চেঁচামেচি। মালিক হাতজোড় করে বলছে যে আজ আমার খেলোয়াড় অসুস্থ হয়ে পড়েছে, বমি করছে। আমি টিকিটের টাকা ফেরত দিয়ে দিচ্ছি।

কিন্তু বেশ কিছু পাবলিক জিদ ধরেছে যে ওরা বিশেষ করে এই খেলাটাই দেখবে বলে দূরের গাঁ থেকে এসেছে। এমনি এমনি ফেরত যাবে না। খেলোয়াড় অসুস্থ হলে মালিক নিজে খেলা দেখাক। কী ঝামেলা!

—সব চুপ হো যাও! খেল হোগা। হো কে রহেগা।

গর্জে উঠেছেন লল্লন মহারাজ।

হঠাৎ যেন বাজ পড়েছে। সবাই অবাক।

আমার হাতে ওঁর কাঁধের ঝোলা ও চশমা। উনি পরনের ধুতিটি আঁটোসাটো করে মালকোঁচা মেরে নিলেন। হতবাক মালিকের থেকে চেয়ে নিলেন ইয়েজদি মোটর সাইকেলের চাবি। তারপর চোখ বুজে বিড়বিড় করে কোন মন্ত্র আউড়ে চড়ে বসলেন। স্টার্ট নিয়ে অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিতেই গুঙিয়ে উঠল ইঞ্জিন। প্রথমে ধীর লয়ে ওঁর মোটরসাইকেল বৃত্তাকার রিঙের মধ্যে পাক খেতে লাগল। তারপরে গতি বাড়তে বাড়তে গাড়ি বাঁদিকে কাত হয়ে ঘুরতে লাগল। আচমকা দুপাশের দেয়ালের গায়ে চড়ে গিয়ে প্রায় টিকটিকির মত দেয়াল বেয়ে পাক খেতে লাগল। তীব্রগতিতে পাক খাচ্ছে ওই মোটরবাইক। জনতা রুদ্ধশ্বাস। গোটা চার পাক খাওয়ার পর গতি কমতে লাগল। মোটরসাইকেল মাটিতে নেমে দাঁড়াল। নেমে এলেন লল্লন।

ঘামে পিঠ ভেজা, কপালে নাকে জমে উঠেছে স্বেদবিন্দু। একটু যেন হাঁফ ধরেছে। আমার হাত থেকে চশমা ও ঝোলা নিয়ে সামান্য হাসলেন। সমবেত জনতার থেকে জয়ধ্বনি উঠল।

এবার মৃত্যুকূপের মালিক এসে ওঁর পায়ে পড়ল। উনি মাথায় হাত ছোঁয়ালেন।

আমি হতভম্ব। কোনরকমে বললাম—এসবের কি কোন দরকার ছিল? বয়েস তো কমছে না।

উনি হেসে বললেন—সেইজন্যেই তো আড়াআড়ি মানে প্যারালাল চালালাম, উল্লম্ব বা ভার্টিক্যাল বাদ দিলাম। সেটাও পারি।

আমার ঘোর কাটেনি।

—কোথায় শিখেছিলেন?

—বলব, সবই বলব। তার জন্যে আমার সঙ্গে বসে মালিকের তাঁবুতে দু'কাপ কড়িমিঠি চা খেতে হবে যে! কোন সংকোচ কর না।

পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে!

মৃত্যুকূপের মালিক শুধু চা নয়, কিছু জলযোগও করালেন। তারপর একটি স্টিলের থালায় বেশ কিছু একশ' টাকার নোট ও সিঁদূর মাখানো একটি রুপোর টাকা সামনে ধরলেন। মহারাজ নির্বিকার মুখে গোটাটাই ওঁর ঝোলার গহ্বরে চালান করলেন।

আমার অস্বস্তি ওঁর নজর এড়ায় নি।

—শোন হে, ম্যানেজার। এটা ঘুষ নয়, মঠের জন্যে দান। চাই নি, খুশি হয়ে দিয়েছে। এবার একটু মন দিয়ে শোনঃ

প্রাচীন সময় থেকেই আমাদের দেশে উৎকোচ প্রথা রয়েছে। উৎকোচ হল তিন রকমের—নজরানা, শুকরানা আর জবরানা।

নজরানা হল যা প্রজাদের রাজদর্শনে বা ভক্তদের দেবদর্শনে দেওয়া প্রণামী—এটা ঘুষ নয়।

শুকরানা হল সরকারিতন্ত্রের কেউ সহজে কোন বিহিত কাজ করে দিলে উপকৃত ব্যক্তি খুশি হয়ে স্বেচ্ছায় যা উপঢৌকন দেয়। এটাও ঘুষ নয়।

ঘুষ হল 'জবরানা'—যা জবরদস্তি করে লোকের থেকে আদায় করা হয়, কাজ হোক বা না হোক।

আমি যা নিলাম তা হল 'নজরানা' ও 'শুকরানা' দুটোর মিশ্রিত রূপ। আজ খেলা না দেখালে খ্যাপা পাবলিক ওর ক্যাশবাক্স লুঠ করত, তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিত। অনেকেই মহুয়া টেনে এসেছিল।

আমার জিভে চায়ের স্বাদ তেতো হয়ে গেল। মহারাজের মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল চালানো শেখার গল্প শোনার আর আগ্রহ রইল না।

বণিকপুত্র লিঙ্গবৎ

সেদিন থেকে আমি লল্লন মহারাজকে একটু এড়িয়ে চলছিলাম। হোলির সময় তুরতুরিয়া মঠে যাওয়ার নিমন্ত্রণেও সাড়া দিই নি। কিন্তু এমনই গ্রহের ফের যে আমাকে ওঁর কাছে যেতেই হল।

কারণটি গুরুতর।

ছোটু শেঠের ব্যাংকের কিস্তি বাকি পড়েছে। তাগাদা করলেও কোন ফল হচ্ছে না। ওর এক কথা। আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি? দেখছেন এখন সময় খারাপ চলছে। আমিও তো ধারে মাল দিয়েছি। আমার গ্রাহক সব কৃষক। গোলায় ধান উঠলে তবে পয়সা পাব। তখন আপনাকে দেব। আপনারা শহুরে লোক। গোটা দুই পরীক্ষে দিয়ে ম্যানেজার হয়েছেন। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাপার চক্র বা বিজনেস সাইকেল বোঝেন না।

তা ছোটু শেঠ আমাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে ছাড়ল। কিষাণের গোলায় ধান উঠল; বিক্কিরিও হল, কিন্তু শেঠ হস্ত উপুড় করল না।

আরে ধান বিক্রি হয়েছে কৃষি মণ্ডিতে, ওরা চাষীদের কোঅপারেটিভ ব্যাংকের চেক ধরিয়ে দিয়েছে, সেই চেকগুলো এখনও ক্যাশ হয় নি। তবে না!

আমি ধৈর্য হারালাম। কাঁহাতক সয়! ওকে দিলাম রিকভারি নোটিস।

ও না দিল জবাব, না পয়সা। কিন্তু আমি রিজিওনাল অফিস থেকে প্রেমপত্র পেলাম—আমার নামে একটি বেনামি কমপ্লেন এসেছে যে আমি নাকি ছোটু শেঠকে একলাখ টাকার ক্রেডিট লিমিট দেব বলে দশহাজার টাকা কমিশন চেয়েছি। শেঠ অতিকষ্টে পাঁচহাজার টাকা দেওয়ায় আমি মাত্র পঞ্চাশ হাজার লিমিট রিলিজ করেছি, আর চাপ দিচ্ছি যে বাকি পাঁচহাজার টাকা পেলে তবে পুরো লিমিট রিলিজ করব।

আমার এবম্বিধ আচরণের একটি তথ্যসমৃদ্ধ ব্যাখ্যা অতি আবশ্যক—সাতদিনের মধ্যে আমার দিক থেকে স্যাটিসফ্যাকটরি রিপ্লাই না গেলে রিজিওনাল অফিস থেকে ভিজিল্যান্স অফিসার প্রাথমিক এনকোয়ারি করতে আমার ব্র্যাঞ্চে আসবেন।

এবার আমি খেপে গেলাম।

একে তো এই প্রথম অফিস থেকে কোন প্রেমপত্র পেলাম। তায় কানাঘুষোয় শুনলাম যে এই বেনামি কমপ্লেন-এর পেছনে লল্লন মহারাজের হাত ও মাথা দুই সক্রিয়।

ব্যাংক থেকে তুরতুরিয়া মঠ প্রায় দশ কিলোমিটার। কিন্তু মোটরসাইকেলে পনের মিনিটের বেশি লাগে না। মঠের বাউন্ডারিওয়ালের গায়ে বাইক ঠেকিয়ে আমি একটু হাঁফাচ্ছিলাম। একজন সেবায়েত এসে বলল—মহারাজ মন্দিরের পেছনে দীঘির পাড়ে রয়েছেন, আপনাকে ওখানেই ডাকছেন। দুপুরের রোদ মাথায় চড়ছে। আমি ব্রিফকেস থেকে ফাইলটা বগলদাবা করে সেবায়েতের সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম।

প্রায় কুড়ি বিঘে ধানি জমি ও পুকুর নিয়ে গড়ে উঠেছে তুরতুরিয়া মঠ। এখান থেকে আর দশ মিনিট গাড়ি দৌড়োলেই বারনওয়াপাড়া রিজার্ভ ফরেস্ট। লালচে গিরিমাটিতে ছোপানো দেওয়াল। তাতে মন্দির ও গোটাকয়েক কামরা। ভেতর থেকে ভেসে আসছে ঘন্টাধ্বনি।

দীঘির পাড় অব্দি যেতে যেতে চোখে পড়ল তরিতরকারি শাকসব্জির বাগান, বেশ যত্ন করে লাগানো।

মহারাজ দুজন ঘেসেড়ের সঙ্গে বাগানের আগাছা পরিষ্কার ও ঘাস কাটা নিয়ে দরাদরিতে ব্যস্ত। আমাকে একনজর দেখে চোখের কোণে হাসলেন। দরে বোধহয় পোষায় নি। উনি ওদের হাত নেড়ে বাতিল করে দিলেন। ওরা এককোণে গিয়ে বসে রইল।

এবার আমার দিকে তাকিয়ে আকর্ণ হেসে বললেন—তাহলে মহামহিমের আমার এই গরীবদের মঠে আসতেই হল? জানতাম।

এই মশকরায় আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সোজা অফিসের চিঠিটি বের করে ওঁর দিকে বাড়িয়ে দিলাম—এসব কী হচ্ছে? আপনি এই ডিফল্টার শেঠের গুরুদেব? ওর কানে ফলস্ কম্‌প্লেন করার ফুসমন্তর দিচ্ছেন?

ওঁর হাসি আরও চওড়া হল।

—রেগে যাবেন না সায়েব। তাতে ক্ষতি বই লাভ নেই। মহাভারতে বনপর্বে আছে রুষ্টা দ্রৌপদীকে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন—

ক্রোধে পাপ ক্রোধে তাপ ক্রোধে কুলক্ষয়,

ক্রোধে সর্বনাশ হয়, ক্রোধে অপচয়।

—হেঁয়ালি ছাড়ুন। এই কম্‌প্লেইনটি আপনি করান নি?

—ধীরে ম্যানেজার সাহেব, ধীরে! প্রথমত আমি এমন ছেঁদো কাজ করাই তার কোন প্রমাণ নেই। আপনার স্টেটমেন্ট মানহানিকারক; ইংরেজিতে ডিফেমেটরি!

আর শেঠোয়া হল বণিকপুত্র; সে ওর স্বভাব অনুযায়ী কাজ করেছে, এই আর কি!

—মানে?

—মানে হল 'বণিকপুত্র লিঙ্গবৎ'।

লিঙ্গ কেমন? না অগ্র নম্র, মধ্য দৃঢ়, পুনঃ নম্র।

তা বাণিয়া যতক্ষণ লোন না পাচ্ছে ততক্ষণ একেবারে বিনয়ের অবতার। আইয়ে, আইয়ে; সব আপকা হী হ্যায়। আরে মাল লে জাইয়ে, রোকড়া বাদ মে ভেজ দেনা।

লোন পেয়ে গেছে, তখন আর আপনাকে চিনবে না। আপনি তাগাদা করুন, ও মুখ ফিরিয়ে নেবে, খেঁকিয়ে উঠবে, উল্টে আপনার নামে কমপ্লেইন করবে।

সব মিটে গেলে আবার নম্র, সেই আইয়ে, আইয়ে।

আমি ঘামছি; এই বিষ্ণুগুপ্তের কূটবুদ্ধির কাছে হেরে গেছি।

সেবায়েতের আনা চিনি-লেবুর সরবত চোঁ চোঁ করে খেয়ে নিয়ে বললাম—বলুন, আমি কি করব?

—আপনিও আপনার ধর্ম পালন করুন। আমাকে নোটিস দিন।

কী হল, বুঝতে পারছেন না? শুনুন।

একজন ব্রহ্মচারী নদীতে স্নান করছিল, চোখে পড়ল একটি বৃশ্চিক জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। উনি দয়াপরবশ ওকে যেই জল থেকে তুলে হাতের তেলোয় রেখেছেন ও ওঁর হাতে হুল ফুটিয়ে দিল। উনি বিষের জ্বালায় ছটফট করতে করতে গুরুদেবের কাছে গেলেন। বললেন—খুব শিক্ষে হয়েছে, আর কখনও গায়ে পড়ে কারও উপকার করব না।

গুরু বললেন—ভুল করছিস। কখনও স্বধর্মচ্যুত হতে নেই। দেখ, এই কীটযোনি বৃশ্চিক, ও কিন্তু স্বধর্ম ভোলে নি, পরিত্রাতাকেও ডংক মেরেছে। আর তুই বিবেকসম্পন্ন ব্রহ্মচারী! তুই এতেই বিচলিত হয়ে স্বধর্ম ত্যাগ করবি?

ছোটু শেঠ ব্যাংকের কিস্তি না দিয়ে আপনার নামে মিথ্যে নালিশ করেছে—ওটা ওর ধর্ম, যাতে একটু বেশি সময় পায়। তা আপনিও ম্যানেজারের ধর্ম পালন করুন। আমাকে, মানে গ্যারান্টরকে নোটিস দিন।

—আর এনকোয়ারি?

—ওঃ, ওটা? আচ্ছা, আমার পরামর্শ শুনবেন?

আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। কোনরকমে ঘাড় কাৎ করি।

—আমি বলি কি—আপনি ওর লিমিট বাড়িয়ে একলাখ করে দিন, একেবারে ফ্রেশ লিমিট। ও আগের পঞ্চাশ হাজার কালই জমা করে দেবে।

—বলছেন কী, মহারাজ?

—ঠিকই বলছি। আজকাল পঞ্চাশ হাজারে কোন বিজনেস হয় না। তারপরে অফিস থেকে এনকোয়ারি এলে আমি ও ছোটু শেঠ দুজনেই স্টেটমেন্ট দেব যে ওসব কু-লোকের মিথ্যে নালিশ। ম্যানেজার অতি সৎ লোক। আগে পঞ্চাশ দিয়ে বাজিয়ে নিয়েছেন যে ছোটুর বিজনেস বুদ্ধি কেমন; তারপর সন্তুষ্ট হয়ে একলাখ করে দিয়েছেন।

—তারপর?

—তারপর ছ'মাস কাটলেই আপনার তিনবছর পূর্ণ হবে। এখানকার মেয়াদ শেষ। ভালো কাজের জন্যে আপনার আগামী পোস্টিং বড় জায়গায় হবে। গল্প শেষ।

অন্নব্রহ্ম

মাথা ঝিমঝিম করছে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াই। নমস্কার করে ওঁর ঘর থেকে বেরোতে যাব, উনি দুহাত দিয়ে দরজা আগলে দাঁড়ালেন।

—এক্ষুণি যাবেন না। সূর্য মাথার উপরে; দুটি অন্নগ্রহণ করে তবে।

আমি মাথা নেড়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই চমকে উঠলাম। উনি শক্ত হাতে চেপে ধরেছেন আমার কব্জি।

—আমাকে অপমান করে আপনি এখান থেকে বেরোতে পারবেন না।

ওঁর গলার স্বর বদলে গেছে; চোখ জ্বলছে। আমি ভয় পাই, কিন্তু কিচ্ছু বুঝতে পারি নে।

একটু একটু করে উনি স্বাভাবিক হলেন। গলার স্বর খাদে নামল।

—আমাকে ভুল বুঝবেন না সাহেব। সেদিন গল্পটা শোনানো হয় নি, আজ বলছি।

আমি আসলে অনাথ, কে আমার জন্মদাতা জানি না, আমার কী জাত জানি না—একেবারে অজ্ঞাতকুলশীল যাকে বলে। গ্রাম থেকে পালিয়ে পেটের তাগিদে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। চায়ের দোকানে বাসন মাজা থেকে শুরু করে সার্কাসে কাজ—সবই করেছি। সব দু'মুঠো ভাতের জন্যে। সেই সময় গরম লোহার ছ্যাঁকা, মালিকের হাতে কিল-চড়-লাথি সবই জুটেছে। সার্কাসে মৌত কা কুঁয়ায় বাইকের খেলা দেখানো তখনই শিখেছিলাম। সে যাই হোক, কেমন করে যেন এসে পড়লাম ছত্তিশগড়ের এই তুরতুরিয়া মঠের মোহান্তজীর আশ্রয়ে।

সেবার কলেরার মড়ক লাগল। লোকজন পালাতে লাগল। গ্রাম কে গ্রাম খালি। মোহান্তজীও ছাড় পেলেন না। মঠ ফাঁকা, ওঁর মুখে জলটুকু দেবার কেউ নেই। আমি আর কোথায় যাব, রয়ে গেলাম। ওঁর সেবা করলাম। ঈশ্বরের কৃপায় উনি বেঁচে উঠলেন। তারপর আমাকে দত্তক নিলেন, যত্ন করে শাস্ত্র পড়ালেন। উপনয়ন দিলেন—আমি দ্বিজ হলাম। তারপর বৃদ্ধবয়সে আমাকে তুরতুরিয়া মঠের গদিতে বসিয়ে গেলেন।

এই হল বৃত্তান্ত। কিন্তু গুরুর কাছে একটা পণ করেছিলাম। দ্বিপ্রহরে মঠে আসলে কেউ না খেয়ে যাবে না। রোজ এখানে দুপুরে অন্তত পঞ্চাশ-ষাটজনের পাত পড়ে। ডাল ভাত একটা ঘ্যাঁট আর আচার। সবই মঠের দেবোত্তর জমিতে ফলে।

গুরু বলেছিলেন যে উপনিষদের আসল কথা হল—অন্নই ব্রহ্ম।

—কিন্তু মহারাজ, উপনিষদে ব্রহ্মকে আনন্দস্বরূপ বলা হয় নি কি? এবার আমি সাহস করে ফুট কাটি।

—না। ভুল ব্যাখ্যা।

লল্লন মহারাজ উত্তেজিত।

প্রাণ অন্নময়। অভুক্ত মানুষের মনে আনন্দ কোথায়?

আমি পংক্তিভোজনে বসে পড়ি। মঠের সেবাইতরা পরিবেশন করছেন। সেই দু'জন ঘেসেরাও আমার পাশে খেতে বসেছে। ছত্তিশগড়ের বিখ্যাত দুবরাজ চালের ভাত। গরম ভাতের সুগন্ধে চারদিক ম' ম' করছে। সপ্ সপ্ করে লোকজনের খাওয়ার শব্দ। মহারাজের চোখ হাসছে।



(পরবাস-৭০, ৩১ মার্চ ২০১৮)