Subscribe to Magazines






পরবাসে দীপঙ্কর ঘোষের
ছবি


সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়ের
লেখা

এবং বই



ISSN 1563-8685




মধুপুরের পাঁচালি

হারানো দূর




দেখবেন এখুনি, আমি তুমাদের বুলি ঠিইক বলতে পারি। জানি, আপনারা আমার কথা কখনো কারো কাছে শুনেন নি। কি করে আর শুনবি বাবু, আমাদের এলাকার সব গল্প লিখে দিয়েছে আমার পুরোনো বন্ধু, তার কি আর আমার কথা মনে আছে, সেই কত্ত বচ্ছর আর দিখাই তো হয় নি।

এই, তোমরা শুনুন, আমার ঐ আপনি তুমি তুই একটু মিশে যায় রে, কিছু মনে করবেন না কিন্তুক, এমনিতে আপনাদের বুলি তো ঠিক বলছি রে, কি না?

আমরা পুছালী, এই মানভূম ইলাকার আদিবাসী। ভালো ঘর রে বাবুরা, ভালো ঘর। সিংভূমের দিগরপানে পুছালী দিখবি না। মামারা খালখো, বড় আদিবাসী পরিবার তারাও। আপনাদের ওই লিখিয়ে বাবু আর আমি একই বয়স। ওরা থাকতো শহরে, আমাদের গাঁ-টা ছিল ক্রোশ তিনেক দূরে। সোম-শুক্কুর বারে ওদের বাজারে হাট বসতো, বাবা আর মামার সঙ্গে আমিও যেতাম। তরকারী, বকরা, মোরগা এইসব নিয়ে যেতাম গো।

চিতাবাঘ কাকে বলে জানেন আপনারা? শুনেছি ইংরিজিতে উটাকে লেপার্ড না প্যান্থার বলে। চিতার মতো হলদে গায়ে বড়ো বড়ো কালো বুটি, আর বড়কা বাঘোয়ার মতো হাবভাব অনেকটা। বড় বেশী বুদ্ধি ধরে আমাদের চিতাবাঘেরা। অনেকে ভুল করে ওদের চিতা বলে, কিন্তু সেটা ঠিক নয়।

চিতা আর বড়ো বাঘ আমাদের দেশে শেষ। চিতাবাঘ কিন্তু অঢেল আছে আজও।

একদিন শীতের খুব ভোরে বাবা আর পাশের বাড়ির নানাজী দেখে একটা মাদী চিতাবাঘ একটা ছাগলী মেরে নিয়ে পালাচ্ছে। বাবার কাছে টাঙ্গি থাকতো হরোয়াক্ত, বাবার বাবাকে ভালুকে খুবলে দিয়েছিলো কি না। চিতাবাঘটা বাবাদের দেখে নি। মারলো বাবা টাঙ্গি ছু্ঁড়ে, চিতাবাঘের ঘাড়টা দুফাঁক হয়ে গেলো, শেষ।

পরের দিন সবাই দেখে দুটো ছোটো ছোটো গুলবাঘের (ওই নামেও ডাকা হয় চিতাবাঘেদের, শোনচিতোয়াও বলা হয়) বাচ্চা গাঁয়ের মধ্যে ঢুকে এসেছে, আর মাঝিদের বড়ো মোরগটা আর দুটো কুকুর দূরের থেকে খুব চিল্লাচিল্লি করছে।

তা বাবাই যখন ওদের মা-টাকে শিকার করেছে তখন সবাই বললো বাচ্চা দুটোও বাবা নিক। তাই হলো। মামা বললো দে, আমাকে একটা দে, তা বাবা বলে দিলে—যা ভাগ! পরশুর হাটে বেচে দিবো।

দুদিন ধরে অনেক দুধটুধ খেয়ে ছানাদুটো খুব খুশি।

গেলাম তো শহরের হাটিয়ায় তিনজনে মিলে। সঙ্গে ছানাদুটো। বাবা তো অন্যদিনের মতো আমাদের ফেলে রেখে হাঁড়িয়া গিলতে পালালো। একটা ঝুড়ি উলটে ছানাদুটোকে চাপা দিয়া রাখলোম, আধলা থান ইঁট চাপিয়ে।

হাটে দুজন দু’রকম সেপাই ঘুরতো, আবকারির আর কোতোয়ালির। ওরা তুলতো ওদের তোলা, লেখালেখির বালাই ছিল না সে সময়ে, বুঝলি বাবুরা? তবে দুজনে দুজনের ওপর নজর রাখতো!

ওরা শুনে ফেললো ঝুড়ি চাপা কি যেন নড়ছে আর আওয়াজ করছে। ওরা ভাবলে গোসাপ, কালিয়া খাবে।

ওটা কি রে?

শোনচিতোয়ার বাচ্চা রে সেপাইসায়েব।

দেখি দেখি।

দুটো আছে, বিক্কিরির।

ঢাকনা খোল।

দুজনে দুটোকে তুলে নিল। আমার হাতে পাঁচটা টাকা দিয়ে হাঁটা দিয়েছে, আমার মামা চেঁচামেচি জুড়ে দিলো—

ও সেপাইজী, ও দুটো পঁচিশ-পঁচিশ করে বেচবো আমরা, পাঁচ টাকা কি দিচ্ছো গো?

তোদের বড় চাল হয়েছে আজকাল, না? ধমক মেরে সেপাইজীরা তো চলে গেলো।

হাটে আমরা যেখানটায় বসি, তার গায়ে লোহারদের জায়গা। কলকাতার ডেঞ্চিবাবুরা আর চেঞ্জারবাবুরা ওদের সব মাল কেনে। কাছেই কুমহাররাও বসে, তাদের মালও ওরা খুব কেনে। তারপরেই কালো মোরগা বলি দেওয়ার বড় অশ্বত্থ গাছটা গো, আর তার ঠিক নীচেই পেল্লাদ কাহারের সাইকেল সারানোর দোকান। ওর ভাগনীটা ওখানেই চা বেচতো ভাঁড়ে, চায়ে তো কোনো দোষ নেই, তাই। কমলী দানাও রাখতো, খেতোও অনেকে ওর হাতের।

চকাচকা সাইকেলটা কাহারকে কাজ করতে দিয়ে কমলীর কাছে বসে বসে দানার ঘুগনী আর চা খেতো তুদের ঐ লিখিয়ে বাবুটা। ওর কোনো বাছ বিচারটুক ছিল না তো।

সেইদিন সিপাহীদের শোনচিতোয়ার ছানাদুটো কেড়ে নেওয়াটা দেখলো বাবুটো। তারপর হঠাৎ সাইকেলটা নিয়ে হাওয়ার মতো ভেগে গেলো। আবকারি সিপাহীদের কাছারি দপ্তর তো ওদের বাড়ির পাশেই ছিল আবার। ওর দাদাজী ছিল রাজের হাকিম, সবাই খুব মানতো, তুরুক কোতোয়াল সোলেমান মিঞা সেলাম করতো।

বাবা হাঁড়িয়া গিলে ফিরে এসে ব্যাপার দেখে রেগে একেবারে তেঁতুলের রঙ! মামাকে আর আমাকে মারতে যায় আর কি, তখন সিপাইদুটো এসে হাজির। বলে টাকা পাঁচটো ফিরে দে, আর এই নে তোদের ছানাদুটো, রাজাবাবুর বাড়ি চিনিস তো, ওখানে নিয়ে যা। ইটা না বলে, টাকা পাঁচটো নিয়ে ওরা পালালো।

রাজাবাবু হচ্ছে তোদের ঐ লিখিয়ে বাবু রে। সাইকেলে ঠেস দিয়ে খুব হাসছিলো রে। গেলাম ওর বাড়ি, ওর দাদাজী অনেক বোঝালো—ছানাদুটোকে হয় কলকাতায় চিড়িয়াঘরে নিয়ে যেতে, নয়তো গাঁয়ে রেখে দিতে, যখন নিজেরা মোরগা মারতে পারবে তখন ঝাড়ে খুলে দিতে। কলকাতা যাবার টিকিট দিয়াবে বললো দাদাজী।

ঐ দেখ, তোদের বুলি আবার ভেঙে যাচ্ছে রে—যাক চিতাবাঘের ছানাদুটো বাবা বাড়ি নিয়ে আনলো, তিন মাস পর নিজেরাই পাথরোল নদীর ওপারে পাহাড়ে পালালো ও দুটা।

হলো কি, আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম বাবু—আমি সাইকেল চড়া শিখলাম নতুন বন্ধুর পাশে। পরের বছর তো বন্ধু কলকাতা চলে গেল। আমাকে ইংরাজী শিখাবে বলেছিলো, সেটা আর হলোই না।


আসি রে, ও বাবু!

(পরের পাঁচালি)


(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)