মধুপুর এলাকার যে কয়েকটি ছোট্ট (অলৌকিক) গল্প শোনাবো বলেছিলাম তার মধ্যে এটি প্রথম। পরের মুখে ঝাল খাওয়াই আমার অভ্যেস, এ গল্পটিও মুখ্যত অন্যদের কাছে শোনা। তবে সেই অন্যেরা সকলেই আমার পুরোপুরি অচেনা। আরো গোলমেলে কথা হলো যে তাঁদের ভার্শন গুলো ঠিক এক নয়, যদিও কোনো কন্ট্রাডিকশন নেই সেগুলির মধ্যে।
যাই হোক, ঘুরে ফিরে আবার সেই মধুপুর। কাছেই দেওঘর, যেখানে একসঙ্গে জ্যোতির্লিঙ্গ ও সতীপীঠ। শুনেছি, কখনো খুঁচিয়ে দেখিনি, ও দুটি একসঙ্গে আর কোথাও নেই - মানে কাছাকাছি থাকলেও পিনকোড আলাদা।
মেনলাইন-এর জসিডি জংশন থেকে লোকাল ধরে দেওঘরে পাণ্ডাদের খপ্পরে গিয়ে পড়তে হয়। বেশ কিছু পাণ্ডা জসিডিতেই কলকাতা থেকে আসা ট্রেনগুলিকে আক্রমণ করে, যেমন আমাকে একবার করেছিল - সে আমাকে আমার অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের নাম ঠিক বলেছিল তক্ষুনি, আমার গোত্র আর দেশের নাম বলায়। চমৎকৃত আমি, পুজো তো দিই না, বুড়োকে ভালো করে খাইয়েছিলাম। আমি আসলে যাচ্ছিলাম সেবার বাঙালিদের অচেনা একটা শিবমন্দির দেখতে - বাসুকীনাথ, কাছেই। তখন অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল, বিশ্বাস করুন। ওখানেও সেই অভিশপ্ত তালগাছের গল্প শুনেছিলাম, পরে কখনো বলবো।
এঁকিয়ে বেঁকিয়ে ওখান থেকে রেল লাইন টেনে এখন দুমকা হয়ে রামপুরহাট যাওয়া যায় শুনেছি, তখন ঘোর অসৎ আমলারাও অমন দুঃস্বপ্ন দেখতেন না।
এই যে তিনটে জায়গার নাম বললাম, জসিডি, দেওঘর, বাসুকীনাথ, এই তিনটেই এখন এতো নোংরা যে ভুলেও ওদিকে যাওয়ার কথা ভাববেন না আপনারা - অচেনা অসুখ নিয়ে ফিরতে হতে পারে। তীর্থযাত্রীদের কাছে মাপ চাইছি।
আমাদের আজকের গল্পের অকুস্থল হলো জসিডির একটু দক্ষিণে একটি (তখন ছোট) গ্রাম, নাম রোহিণী। এই গ্রামটি এখন দেওঘর শহরের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে, কারণ এর পাশেই নতুন দেওঘর “আন্তর্জাতিক” বিমানবন্দর। শুনেছি পাকা রাস্তাও হয়েছে, একটি নয়, দুটি।
আমি তো গিয়েছিলাম একলা মধুপুর থেকে সাইকেল ঠেঙিয়ে, নতুন ডায়নামো লাগাবার পর। গ্রামটি দেখে খিদে পেলো, একটা বিহারি ঢাবায় খেয়ে (ঠিক ধরেছেন, কুন্দরুর তরকারি আর লিট্টি ! বাকি গল্প-টা আপনিই লিখে নিন না?) ঘুমিয়ে দেখি (১) বেলা হয়েছে (২) চা দরকার (৩) দেওঘরে গিয়ে ফেরবার সময় নেই।
ইয়ে, মানে আমি একটু যাকে বলে মানে বিহারী। আড্ডায় জমে গেলাম। জানলাম যে ঠিক তিথিতে আসিনি। খটকা !
“কাহে রে ভাইয়া? আওর চান্দা-মে কেয়া দিখাতা?”
নাঃ বাংলাতেই চালাই, আমিও অনেক ভুলেছি, আপনারাও অনেকটা বুঝবেন না।
“ওই যে বড়ো বাড়িটা ? বিলকুল খণ্ডহার?”
“তার পর?”
“অমাবস্যার আগে পরে একদম নতুন দেখায়। ঝলমল করে। অন্ধকারের মধ্যে।”
“কি বলছো? আদ্ধেক দরজা জানলা তো চোট হয়ে গেছে ওটার!”
এর মধ্যে আরেক জন বললো, “আরে দাদা, আরো আছে। অনেকে দেখেছে, একটা কোলকাত্তিয়া বাবু আর একটা লেডিস ভাঙা বাড়ির বাগানে চেয়ার টেবিল পেতে চা বিস্কুট খায় সন্ধেবেলা, তারপর হাত ধরাধরি করে নতুন বাড়িতে ঢুকে যায়।”
“সকালবেলা বাড়ি আবার যে কে সেই খণ্ডহার।” বললো আরো একজন।
এখন ব্যাপারটা ছিল কি রকম জানেন, আমাদের চেয়ে বয়সে একটু বড়ো লোকজন আজও আমি ওসব দিকে গেলে চিনতে পারতে পারে। কাজেই খটকা থাকা সত্ত্বেও মনে করলাম না ওরা ইয়ার্কি মারছে। বললুম,
“নতুন ডায়নামো, কদিন পরে চলে আসি দেখতে?” নানারকম উত্তর -
“একলা দাদা? আমি যাচ্ছি না!”
“আমি-ও না!”
“ওসব দেখে কি লাভ বলুন, তার চেয়ে এই নানার কাছে বাকি কিসসা-টা শুনুন।”
আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন বৃদ্ধ এক মুসলমান ভদ্রলোক, সুরমা, কলপ, টুপি, লুঙ্গি, ভুল উর্দু সব সমেত। ঝিমোচ্ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন “দাদাসাব, ও সব ছোঁওড়া-পুত্তান কী বাত ছাড়ুন, ওরা কিছুই জানে না।”
“তো আপ-হি বাতাইয়ে না, নানা সাব। এ ভাই, এক লস্যি লাগানা ইধর নানা কে লিয়ে। বরফ হ্যায়?”
ভীষণ, ভীষণ খুশি হলেন ভদ্রলোক। বলেই ফেললেন, “শহর কে কদর কায়দা সীখ লেও তুমলোগ।”
“আপনাদের এক সাধুজী আছেন না? ওই মাদ্রাজের কাছে? যেখানে লোকে ফার্সি বলে?”
অনেকেই আমাকে বোকা ভাবে, কিন্তু টক করে ধরে ফেললাম যে উনি পন্ডিচেরির কথা বলছেন, ফরাসি আর ফার্সি-তে গুলিয়ে ফেলে। তাই বললাম, “পন্ডিচেরির ঋষি অরবিন্দর কথা বলছেন তো? তিনি তো অনেকদিন মারা গেছেন!”
“একশো বছর আগে ওনার বাবা ওই বাড়িটা তৈরী করেন। ওখানে ঋষি-জীর আরেক মা থাকতেন, যিনি অনেকদিন ঋষি-জী কে মানুষ করেছিলেন ওই বাড়িতে। পরে কি সব গোলমাল হয়, আমার ওয়ালিদ সাহেব তখনও পয়দা হন নি, সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। পেহলা জার্মান লড়হাইকে টাইম সে উন দোনো এক সাথ আনা শুরু কিয়ে ফিরসে।”
আমরা চুপ! দেহাতি-রা বিশেষ কিছু বুঝলো বলে মনে হলো না - আমি বুঝে হতভম্ব!
আবার বললেন নানা সাব, “সুনিয়ে দাদা, ইয়ে সব ইয়াকীন মত্ কিজিয়ে, সব ঝুট হো সকতা হ্যায়।”
একটু থেমে, “ইয়ে সব রিসি, পীর ইন লোগ কী বাত আওর হোতী হ্যায়। ছো-ড়ি-য়ে তো।”
আরেকবার চা খেয়ে নতুন ডায়নামোটা আর আলোটা রুমাল দিয়ে ঘষে নিয়ে ব্যাক টু মধুপুর।
সেলাম করে অবশ্য।
নানা সাব-কে।
(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)