প্রথম ঝাঁকুনিটার সময় বিভাসের মনে হয়েছিল আধোঘুমে একটা উদ্ভট স্বপ্ন দেখছেন বুঝি। কিন্তু কানফাটানো শব্দ আর আলোর ঝলকানির মধ্যে যখন সার সার ভিডিও স্ক্রীনগুলো একসাথে অন্ধকার হয়ে গেল, বিভাগ বুঝলেন এটা ঠিক সাদামাটা টারবুলেন্স নয়। বিকট একটা সোঁ-সোঁ আওয়াজের সাথে সাথে মনে হল যেন ফুসফুসের সবটুকু বাতাস উধাও হয়ে গেছে হঠাৎ। কানের মধ্যে যন্ত্রণা, মাথার ওপর অক্সিজেন মাস্কগুলো ঝুলে পড়েছে, চারদিকে নানা ভাষার আর্তনাদ, বাচ্চাদের কান্না, বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থনা আর নানারকম গালাগালি সব মিলেমিশে একটা উদ্ভট ক্যাকোফোনি। বিভাস যতটা ভয় পেয়েছেন, কৌতূহলী হয়েছেন প্রায় ততটাই। জানলার বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, প্লেনের ডানার যে আলোটা দপদপ করে তার বদলে একটা লালচে আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। এঞ্জিনে বোধহয় আগুন লেগে গেছে, কেবিনেও ফুটো হয়েছে কোথাও একটা। সাড়ে তিনশ মানুষ পেটে নিয়ে এয়ারক্র্যাফট এখন দ্রুত উচ্চতা হারাচ্ছে, একটু বাদেই হয়ত মাটিতে আছড়ে পড়বে।
‘মন্দ নয়,’ বিভাস ভাবলেন, ‘খুব দ্রুত আর নিশ্চিন্ত এই অতিক্রমণ। আমার জীবনে যা-কিছু হবার ছিল হয়ে গেছে, এবার বুড়ো হবার আগেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে কেটে পড়লে কারো কিছু বলার নেই। শুধু ছেলেমেয়ের সঙ্গে যদি এক মিনিটের জন্য কথা বলে নেওয়া যেত, তাহলে আর একটুও আফসোস থাকতো না।’ আশেপাশে আরো অনেকেই পাগলের মত ফোন করার চেষ্টা করছে, তাদের চেঁচামেচি শুনেই বোঝা যায় যন্ত্রগুলো এখন বেকার। বিভাস সীটের পেছন থেকে ফোনটাকে একবার টেনে নিয়ে আবার যথাস্থানে রেখে দিলেন।
‘পুট অন ইয়োর লাইফ ভেস্টস!’— আইলের মাঝখান থেকে কেবিন ক্রু মেয়েটির তীক্ষ্ণ চীৎকার। একটু আগেই ওর হেঁটে যাওয়ার নিখুঁত ভঙ্গিমাটির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিলেন বিভাস কিন্তু এখন ওর আই-লাইনার টানা চোখের মধ্যে আলকাতরার মতো ঘন আতংক মাখামাখি। উনি যান্ত্রিকভাবে লাইফ ভেস্টটা পরে নিলেন। অক্সিজেনটা নিয়ে এখন একটু ভালো লাগছে। চারদিকে এখন ভয়াবহ হিস্টিরিয়া, ছোট জায়গার মধ্যে কয়েকশো মানুষের কান্না, বমির গন্ধ, গালাগালি, প্রার্থনা সব তালগোল পাকিয়ে একাকার। প্লেনটা কি তাহলে ভারত মহাসাগরের কোথাও একটা ওয়াটার ল্যান্ডিং করবে? কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যেতে ছয় ঘন্টা লাগে, বিভাস হিসেব করে দেখলেন টেক অফের পর ঘন্টা তিনেক সময় কেটেছে, অর্থাৎ প্লেন এখন খোলা সমুদ্রের ওপরে এবং ফ্লাইট ম্যাপ অনুযায়ী মালয়েশিয়ার উপকূল কাছেই হওয়া উচিত। হয়ত। এই তো সেদিন হাডসন নদীর মধ্যে একটা প্লেন নেমেছিল না?
প্লেনটা এক ধাক্কায় আরো খানিকটা তলায় নেমে গেল, যাত্রীদের দেহগুলো ছিটকে উঠতে চাইলো উপরের দিকে, সীট বেল্ট না থাকলে নির্ঘাৎ ছাদের সঙ্গে মাথা ঠুকে যেত। বিভাস দেখলেন সামনের সীটে ছেলেমেয়ে দুটো পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে। এয়ারপোর্টে ওদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, বিভাস সকৌতুকে লক্ষ করেছিলেন নববিবাহিত মেয়েটির মুখের অরুণিমা, চঞ্চল দুচোখে ব্রীড়া, আনন্দ, বিস্ময় মেশানো চাউনি। এয়ারপোর্টে চোখ ধাঁধানো ছিল খেলা জেতার আনন্দ, টইটম্বুর আত্মবিশ্বাস আর নতুন মিলনের উত্তেজনা। এখন দুজনেই সমান দিশেহারা, ওদের চোখেমুখে আতঙ্কের সঙ্গে অবিশ্বাস। যখন মানুষ প্রথম বুঝতে পারে যে চারপাশের ঘটনা ও পরিণামের ওপর তার এক ফোঁটা নিয়ন্ত্রণ নেই, কি ভয়ানক রকম অপ্রস্তুত সে সময়? মেয়েটি কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বারবার বলে চলেছে-- আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডাই।
‘ডু আই?’ নিজেকে প্রশ্নটা করে নিজেই অবাক হয়ে গেলেন বিভাস, ‘কেন আমার প্যানিক হচ্ছে না? আমি আমেরিকার মনোরম পশ্চিম উপকূলে সান হোসে শহরের নামজাদা কার্ডিও-ভ্যাসকুলার সার্জন বিভাস দাশগুপ্ত, আমার ঝুলিতে আছে সাতটা বেডরুমওয়ালা বাড়ি, বাইশ বছরের সফল বিবাহিত জীবন। আমার তো মরতে আপত্তি থাকার কথা কিন্তু এই মুহূর্তে আমি আশ্চর্যরকম শান্ত আর উদাসীন। আমি যেন একটা দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল যাত্রার শেষে বাড়ির গলিটা দেখতে পেয়েছি। চোখ বুজলেই দূর অতীত এসে আমার শিয়রের কাছে বসেছে। মৃত্যুর আগে মানুষের কি এইরকমই হয়, হঠাৎ করে তুচ্ছ হয়ে যায় অতি প্রয়োজনীয় বর্তমান?'
গলির মুখে বড়ো রাস্তাটার নাম টালিগঞ্জ সারকুলার রোড। একদিকে নিউ আলিপুর অন্যদিকে বেহালা। নিউ আলিপুর ছিল কেতাদুরস্ত, পরিষ্কার সোজা সোজা রাস্তা, দুধারে গাছপালা, বাংলো প্যাটার্নের বাড়িঘর, দোতলার বারান্দায় বা পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ির মধ্যে থাকতো ছাতিম ফুলের গন্ধ। টালিগঞ্জ সারকুলার রোডের অন্য দিকটায় নিজের খেয়ালখুশি মতন পুকুর, ডোবা মাঠঘাটের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেহালা। বাড়ি গজিয়ে উঠেছে যত্রতত্র, গলিরা তার মধ্য দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে আরো অনেকটা দক্ষিণে সেই ডায়মন্ড হারবার রোড অবধি। তার মধ্যে বাজার, খাটাল, বস্তি, সাইকেল রিকশ, শেতলা মন্দির, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, চা আর তেলেভাজার দোকান নিয়ে এলোমেলো শহরতলি। বিভাস এখনো স্পষ্ট দেখতে পান একচিলতে মাঠের ওপর কোনাকুনি উইকেট পুঁতে অভিনব ক্রিকেট ম্যাচ চলেছে যেখানে পাঁচিলের ওপাশে বল পাঠালেই আউট কেননা সেক্ষেত্রে পাশের বাড়ির কাকু জেঠুরা বলটি বাজেয়াপ্ত করে নিতে পারেন। ওঁর মনে আছে শীতকালে ছাদের ওপরে আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো, সেখানে নিয়ম ছিল আরো কড়া। শাটলকক যে ফেলবে তাকেই তুলে আনতে হবে, নর্দমায় পড়ে গেলে আট আনা, হারিয়ে গেলে দুটাকা ফাইন। ক্লাবঘরের পাশে ক্যারামবোর্ড প্রায়ই বেকার দাদারা দখল করে রাখতেন, সেখানে বোধহয় চোলাই সাট্টার ঠেকও বসত তাই রাত্তিরবেলায় ওদিকে যাওয়া মানা ছিল। ক্লাবের সামনে একটিমাত্র মাঝারি সাইজের মাঠ, সেখানে ঘড়ি ধরে সময় ভাগাভাগি করে ফুটবল খেলা চলতো প্রায় সারা বছর। পাড়ায় মোটামুটি তিনটে দল ছিল—বাঙালি, অবাঙালি এবং বস্তিবাসী। তাদের যে যার নিজস্ব এলাকা ও এক্তিয়ার সম্পর্কে টনটনে জ্ঞান থাকলেও সবাই মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করত। রাস্তার ওদিকটায় সন্ধ্যাবেলা নিয়মিত রামভজন শোনা যেত, সর্দারজীরা সকালবেলায় যত্ন করে চুলদাড়ি বানাতেন। ছোটবেলা বিভাসের ধারণা ছিল যে নন-বেঙ্গলি মাত্রেই হিন্দীতে কথা বলে, তাদের শিক্ষাদীক্ষা, কালচার বিশেষ নেই, মোটের ওপর বাঙালিদের তুলনায় তারা অপকৃষ্ট জীব যদিও কোনো এক অজানা কারণে তাদের অনেক টাকাপয়সা আছে। ছেলেমেয়ে মানুষ করার ব্যাপারে ওঁদের পারিবারিক অবস্থান ছিল অদম্য মধ্যপন্থা, বড়লোকের ছেলে বা বস্তির ছেলে, দু’দলকেই প্রায় সমান অবাঞ্ছিত মনে করা হতো। বিভাস বুঝেছিলেন যে যারা বড়লোক নয় আবার ছোটলোকও নয় তারাই আসলে ভদ্রলোক। পাড়ার পয়সাওয়ালা লোকদের অনেক সময় খাতির করে সাহেব বলা হতো আবার রাস্তার শেষে যে প্রকাণ্ড বস্তিটা ছিল তারও নাম সাহেব মহল। সেখানে মাটির আর টিনের ঘর, খোলার চাল আর পচা নর্দমার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, প্রকাণ্ড একটা ইঁট বার-করা কোঠাবাড়ি, তার বয়েস নাকি দুশো বছর, এখনও সারাগায়ে ঘুঁটের গয়না নিয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। শোনা যায় মহীশূর যুদ্ধে টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর ওই বাড়িতে তাঁর পরিবারের কয়েকজনকে আটকে রেখেছিল ইংরেজ সাহেবরা সেই থেকেই এলাকার নাম সাহেব মহল। তখন নাকি এর চারদিকে জলা জঙ্গল ছিল, কেঁদো বাঘ আর ডাকাতের দল ঘুরে বেড়াত। পোড়ো বাড়িটার ঠিকঠাক ইতিহাস কারোর জানা ছিল না কিন্তু ওটার কুখ্যাতি ছিল অনেকরকম। ভূতপ্রেত থেকে শুরু করে ভেজালদার, মস্তান আর মাফিয়ারা সবাই ওই বাড়িটায় ঠেক বসাত। ভাঙা পাঁচিলে ঘেরা বিরাট কম্পাউন্ড, তার প্রায় পুরোটা জুড়ে খাটাল। সেখানে গরুকে ইঞ্জেকশন দিয়ে দুধ পাতলা করা হতো, সেই নিয়ে সকালবেলা খরিদ্দারদের সঙ্গে গোয়ালাদের খিটিমিটির শেষ ছিল না। সাহেব মহলে বস্তির ছেলেমেয়েরা খালি গায়ে বা ছেঁড়া কাপড় পরে বিভাসদের বাড়ির সামনে খেলে বেড়াত, হইচই করতো সারাদিন। পাশের বাড়ির বৃদ্ধ ভদ্রলোক প্রায়ই তাদের লাঠি নিয়ে তাড়া করতেন, বাচ্চারাও নানাভাবে তাঁকে জ্বালাতন করতে ছাড়তো না। বৃষ্টির দিনে রাস্তাটা নদী হয়ে যেত, কাঁচা নর্দমা থেকে ভুসভুস করে উঠে আসতো পাঁক, তার মধ্যেই বাচ্চাদের হুটোপুটি, কাগজের নৌকা, ভাসমান চটিজুতো আর মোড়ের মাথায় তেলেভাজার দোকান থেকে গরম গরম আলুর চপের গন্ধ। বিভাস তখন জানলার ধারে বসে হেমেন্দ্রকুমার রায় বা প্রেমেন মিত্তিরের বই হাতে নিয়ে মনের সুখে বিশ্বভ্রমণ করতেন। গ্রীষ্মের দুপুরে সব জানলাদরজা এঁটে বন্ধ করা হতো, গনগনে রোদে ঝিমিয়ে থাকতো গোটা পাড়াটা, ঠিক চারটের সময় ঠেলাগাড়ি নিয়ে হাজির হতো কোয়ালিটি আইসক্রীমওয়ালা, বিভাস জ্বলজ্বল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেন কিন্তু মুখ ফুটে চাওয়ার অভ্যাস ছিল না। তাই ক্কচিৎ এক একদিন যদি টু-ইন-ওয়ান আইসক্রীমের কাপটা হাতে আসতো, তার স্বাদগন্ধও হতো অমৃতের মতো।
‘ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন! ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন! ঈশ্বর— ’
কানফাটানো একটা আর্তনাদ বিভাসের ধ্যান ভঙ্গ করলো। সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীর জুড়ে একটা তালগোল পাকানো যন্ত্রণা। এরোপ্লেনটা কি জলের ওপর আছড়ে পড়েছে, নাকি মাটিতে? বিভাস বুঝলেন তাঁর হাত পা নাড়ার শক্তি হারিয়ে গেছে, চোখের সামনে একটা ঘোলাটে চাদর তার মধ্যে মাঝে মাঝে একটা আঁকাবাঁকা আলোর লাইন, হাসপাতালের মনিটরে যেমনটা দেখা যায়। অনেক সময় ঘুমন্ত মানুষ বুঝতে পারে যে সে জেগে উঠেছে কিন্তু হাত পা নাড়াতে পারছে না, ডাক্তাররা একে বলেন স্লীপ প্যারালিসিস। বিভাসের মনে হলো পোকাখেকো গাছের মতন চারপাশের ঘোলাটে পর্দাটা দানবিক বেলুনের মতো ফুলে উঠে শরীরটাকে যেন সবদিক থেকে চেপে ধরেছে, ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে একটা আঠালো অন্ধকার গহ্বরে। সেখানে কোনো শব্দ নেই। দৃশ্যরা মুছে গেছে, বিভাস প্রচণ্ড বেগে সেই ও আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গের মধ্যে পিছলে নেমে যাচ্ছেন। এরই নাম তাহলে মৃত্যু।
হঠাৎ করেই সুড়ঙ্গটা শেষ হয়ে গেল। সামনে চোখ ধাঁধানো সাদা আলোর বন্যা।
‘মঞ্জরী, রোমিত তোমরা টেক-ওভার করো। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।’ কোনরকমে গাউন গ্লাভস খুলতে খুলতে বেরিয়ে এলেন বিভাস। অপারেটিং রুমের বাইরে হলটাও চেনা অচেনার মধ্যে দোল খাচ্ছে। পাশেই সার্জনস রুম, ইজিচেয়ারটাও ঠিক জায়গায় আছে, কিন্তু জানলা দিয়ে ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়ের বদলে একগাদা ঢ্যাঙা ফ্ল্যাটবাড়ি আর বিজ্ঞাপনের বোর্ড। ঘরে কেউ নেই, বিভাস ইজি চেয়ারে পা এলিয়ে দিয়ে ঠান্ডা মাথায় একটু ভাবার চেষ্টা করলেন।
‘আমি সার্জন বিভাস দাশগুপ্ত কলকাতার ওটিতে অপারেশন করছি। যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল এটা স্বপ্নই।’ বিভাস মনে মনে ভাবলেন। বহু বছর ধরে এইরকম একটা স্বপ্নের সঙ্গে উনি পরিচিত। উনি যেন কলকাতায় চলে এসেছেন, এখানেই প্র্যাকটিস করবেন, এমনকি ওঁর সাদা রঙের মার্সিডিজ গাড়িটাও সঙ্গে আছে। প্র্যাকটিসে কিন্তু মোটেই সুবিধা হচ্ছে না, নানা হাঙ্গামার মধ্যে নাজেহাল বিভাস তখন আবার সান-হোসেতে ফিরে যাবার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে ওঁর ডাক্তারি লাইসেন্স, বোর্ডের সার্টিফিকেট, এইসব কিছুই আর রিনিউ করা হয়নি। আমেরিকায় শুধু পরীক্ষা পাশ করেই ডাক্তার হওয়া যায় না। স্বপ্নের মধ্যে বিভাস তখন লাল ফিতের ফাঁস খোলার চেষ্টায় নাজেহাল হতে থাকেন, তারই মধ্যেই দেখা যায় ওঁর পাসপোর্ট কখন যেন বদলে গেছে, কাজেই ফিরে যেতে গেলে ভিসা করাতে হবে। ভিসা অফিসে এক রোগা-প্যাঁটকা খিটখিটে চেহারার ভদ্রমহিলা বিভাসকে যতরকমের উলটো পালটা প্রশ্ন করছেন উনি তার একটারও উত্তর দিতে পারছেন না। বসে বসে ভাবছেন কোথায় গেল সান-হোসের সেইসব পরিষ্কার সাজানো ফুলে ভরা বুলেভার্ড, গাড়ি করে নাপা ভ্যালি বা আশেপাশে সমুদ্রতীরে বেড়াতে যাওয়া, আদিগন্ত আঙুরের ক্ষেত, তার ওপরে শিশির আর সোনালি রোদ্দুর। অথচ ওইখানে বসে রোজ উনি কলকাতার কথাই ভাবতেন। এইসব নিয়ে টেনশন যখন চরমে পৌঁছয়, রাস্তায় পার্ক করা ওঁর মার্সিডিজ গাড়িটা হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়, আরো সব অসম্ভব কাণ্ডকারখানা হতে থাকে তখনই ওঁর মনে সন্দেহ হয় যে এগুলো নির্ঘাত স্বপ্ন। উনি খুব জোর করে জেগে ওঠার চেষ্টা করতে লেগে যান। অবধারিতভাবে একটু পরেই দেখা যায় বিভাস নিশ্চিন্ত মনে বাথরুম থেকে ঘুরে এসেছেন, এক গ্লাস জল খেয়ে হয় উনি তখন আবার বিছানায় নয়তো হাসপাতালে যাবার জন্য তৈরি। কিন্তু এমন পরিষ্কার স্বপ্ন তো আগে কোনোদিন দেখেননি। আগের স্বপ্নগুলো কেমন যেন ছাড়া ছাড়া, অযৌক্তিক, পুরনো দিনের সাদাকালো ছবির মতো। আজকের স্বপ্নটা যেন হাই ডেফিনিশন ডিজিট্যাল ছবির মতো কাটা কাটা রেখা আর উজ্জ্বল রং নিয়ে বাস্তবের খুব কাছাকাছি। বিভাস ভাবলেন চেষ্টা করলেই যখন ঘুমটা ভাঙবে তখন আপাতত এই স্বপ্নটাই একটু জুৎ করে দেখে নেওয়া যাক। বিশেষ করে যখন দেখাই যাচ্ছে উনি বহাল তবিয়তে সার্জারি করছেন, সবাই ওঁকে খাতির করছে, একজন সফল ডাক্তারের ক্ষেত্রে যেমনটি আশা করা যায়। উফ, আরেকটু হলেই আজকের রোগীটা মারা পড়ত।
আজকের রোগীটা! হঠাৎ কি একটা মনে পড়ে গেল বিভাসের, সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো মনের পর্দায় খেলে গেল একটার পর একটা দৃশ্য। কোনো অচেনা রোগী নয় বরং খুবই পরিচিত একজনের অপারেশন ছিল আজ। বিভাস এলোমেলো পায়ে আবার ওটির দিকে রওনা হয়ে গেলেন। স্বপ্নই হোক আর যাই হোক, পাপুর অপারেশন উনি অন্যের হাতে দিতে পারেন না। ওটি’র দরজা ঠেলে ঢোকার সময় মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেল আবার। বিভাস দেখলেন ঘরের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক ব্যস্ততা।
‘এপিনেফ্রিন দাও। প্রেসারটা আবার ড্রপ করছে।’
‘ফিব্রিলেটিং। চার্জ টু হান্ড্রেড!’
‘চার্জিং। অল ক্লিয়ার।’
টেবিলের ওপর দেহটায় একটা ঝাঁকানি, তারপর সমবেত স্বস্তির নি:শ্বাস। রিদম ফিরে এসেছে, হার্ট এখন স্বাভাবিকভাবেই চলছে যদিও রক্তের চাপ এখনও বেশ কম। বিভাস দেখলেন সার্জনদের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে কিন্তু অ্যানেস্থিটিস্টরা খুবই ব্যস্ত। অপারেশন টেবিলে রোগীর একটা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে গেছে, যেটা একেবারেই ভালো কথা নয়। এইরকম অবস্থায় মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে গিয়ে বড়োসড়ো রকমের একটা স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে, কিডনি বন্ধ হয়ে যেতেও পারে। সেসব অবশ্য পরের কথা আপাতত সার্জারি শেষ, রোগীকে আই. সি. ইউতে নিয়ে যাওয়া হবে। বিভাসের এই মুহূর্তে কিছুই করার নেই।
‘আমি ঠিক আছি। কি হয়েছিল?’
‘হঠাৎ একটা ইন্টারনাল ব্লীডিং শুরু হয়ে গেল স্যার। আর্টেরিয়াল ব্লীডার, আবার খুলে সেটাকে বন্ধ করতে করতে প্রেসার ড্রপ করে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রিসাসিটেট করা হয়েছে, আশা করি সব ঠিক থাকবে স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না।’
বিভাসও জানেন যে সব ঠিক থাকবে, কারণ এসবের কিছুই ঠিক বাস্তব নয়। তা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে পাপুর মা সমাদৃতা ওরফে তিতলির কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় বিভাসের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। তিতলির মুখটা দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে ওঁর। এতদিন অবধি স্বপ্নে যে মুখটা তিনি দেখেছেন সেটা আজ থেকে কুড়ি বছর আগেকার তিতলি। কিন্তু একটু আগেই উনি আয়নায় নিজেকে দেখেছেন, আজকের এই স্বপ্নটায় বিভাস দাশগুপ্ত একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক। তার মানে তিতলিরও নিশ্চয়ই বয়েস বেড়েছে। দেশ ছাড়ার পর থেকে ওর সঙ্গে এক দিনের জন্যেও আর যোগাযোগ হয়নি বিভাসের, তাই ও কতটা বদলেছে উনি একেবারেই জানেন না। সত্যিই কি জানেন না? কথাটা ভাবতেই গত কয়েক দিনের ঘটনা মাথার মধ্যে ভিড় করে এল, বিভাস টের পেলেন যে তিতলিকে উনি গতবারেই দেখেছেন। বিয়ের পর তিতলি মুম্বাই চলে গেছিল, এত বছর পরে এই সেদিন পাপুর অসুখটা নিয়েও ওঁর সাথে তিতলির যোগাযোগ হয়েছে। বিভাস অবাক হয়ে দেখেছেন যে মুখে কয়েকটা সূক্ষ্ম রাখার কাটাকুটি আর চুলে একটুখানি মেহেন্দির ছোঁয়া না-দিলে তিতলি প্রায় একইরকম দেখতে আছে। এই অদ্ভুত স্বপ্নটার মধ্যে যেন একটা আলাদা জীবনের সব ঘটনা স্বাভাবিক ভাবে পর পর সাজানো। মানুষ একলা চুপচাপ বসে নিজের জীবনের কথা ভাবলে যেমন মূল ঘটনাগুলো আগে মনে আসে, সাধারণ দিনগুলোর ঘটনা তার মধ্যে মধ্যে মাথা তোলে ঠিক তেমনি বিভাসের মনের মধ্যে গত পঁয়ত্রিশ বছরের একটা ধারাবিবরণী চলতে লাগলো। ঘটনাগুলো এমন কাটা কাটা পরিষ্কার আর সুসংবদ্ধ যে একটু বাদে বিভাসের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। এমনিতে ওঁর ঘুম পাতলা, সকালের দিকে প্রায়ই স্বপ্ন দেখেন। সেখানে সবকিছুই কেমন যেন ছাড়া ছাড়া, অবাস্তব, প্রায়ই এক ঘটনা বারবার ঘটে। বিভাসের হঠাৎ মনে হল যদি এটাই বাস্তব হয়, সান-হোসের জীবনটাই যদি হয়ে থাকে এক প্রলম্বিত স্বপ্ন? কথাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে নি:সীম আতঙ্কে গা গুলিয়ে উঠলো, বিভাস একটা টুল টেনে নিয়ে বসে পড়লেন।
‘স্যার আপনি অসুস্থ, আপনার কুলকুল করে ঘাম দিচ্ছে। সুগতাদি, একটা বেড ঠিক করুন স্যারকে শুইয়ে দিতে হবে।’ রোমিত আর মঞ্জরী ওঁর দুপাশে এসে দাঁড়িয়েছে, চার্জ নার্স সুগতা সিনহাও এসে হাজির হয়েছেন। সকলেই বেশ একটু হতভম্ব, বোঝাই যায় বিভাসকে এর কম বেসামাল অবস্থায় কেউ কখনো দেখেনি।
‘কিছু হয়নি। আমি বরং আই. সি. ইউ থেকে ঘুরে আসি। তোমরা নেক্সট কেসটা করো।’
‘না স্যার আপনি শুয়ে পড়ুন প্লীজ, আমরা ডক্টর মাইতিকে খবর দিয়েছি।’
কে ডক্টর মাইতি? কথাটা ভেবেই হাসি পেল কারণ ড: মাইতি আর কেউ নয় বিভাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহকর্মী এবং এক সময়কার রুমমেট শ্যামল মাইতি ওরফে শমু, শহরের নাম করা কার্ডিওলজিস্ট। এই মুহূর্তে ওর কথা ভেবে একটু আরাম পেলেন বিভাস। শমুকে সব কথা বলা যায়, এইরকম অদ্ভুত বিভ্রান্তিকর সময়ে কেউ যদি সাহায্য করতে পারে সে নি:সন্দেহে শমু।
‘মা, এবার শুতে যাও। রাত দুটো বেজে গেছে এখনও ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছো।’
‘তুই প্লীজ শুয়ে পড় মিমি। আমার ঘুম আসবে না, আমি বরং দেখি নতুন কোনো খবর এলো কিনা--’
‘খবর এলে ওরা ফোন করবে মা। এই নাও ফোনটা তোমার পাশেই রাখলাম। এবার শোও দেখি। এইভাবে শরীর খারাপ হলে আরো বিপদ হবে।’
মিমি, যার ভালো নাম মান্যতা এবার জোর করে মায়ের হাত থেকে ল্যাপটপটা কেড়ে নিয়ে আলো নিভিয়ে দিল। এই আতঙ্কের মধ্যেও একটু ভালো লাগা টের পেলেন লিপিকা। সেই ছোট্ট মেয়েটা কখন হয়ে গেল সতের বছরের এই আত্মবিশ্বাসী তরুণী। এই বিপদের দিনে ওই তো একা হাতে মায়ের দেখাশোনা করছে, বন্ধুবান্ধবদের ভিড় সামলাচ্ছে, এয়ারলাইনের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। ওর কি ভয় করে না, দম বন্ধ হয়ে আসে না এই অনির্দিষ্ট অপেক্ষার নরক যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাতে? এই দেশের ছেলেমেয়েরা আমাদের মতো আবেগপ্রবণ নয়, অনেক বেশি শক্তপোক্ত আর প্র্যাকটিক্যাল, ও সম্ভবত: ধরেই নিয়েছে যে ওর বাবা বেঁচে নেই।
‘জানো মা, আমার বন্ধু সারিনা, ওর বাবা স্পেশাল ফোর্সে অপারেটিভ, সিরিয়ায় ওদের হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ে। ওটা আই সি স জঙ্গিদের এরিয়া, গত দুই মাস ধরে কোনো খবর নেই, সবাই ধরে নিয়েছিল মারা গেছে। কাল খবর এসেছে, ও বেঁচে আছে, জঙ্গিদের কবল থেকে পালিয়ে এখন জার্মানিতে। তুমি এই কদিনেই এমন ভেঙে পড়লে তো চলবে না।’
কম্ফর্টারের তলায় মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন লিপিকা। খুব কাছের মানুষ নিশ্চয়ই মনের কথা বুঝতে পারে; না-হলে মেয়েটা কেমন করে বুঝলো উনি কি ভাবছিলেন? এই তো সেদিন এয়ারপোর্টে ছেড়ে এলেন বিভাসকে, ওঁর যাবার কথা ছিল কুয়ালালামপুরে হয়ে বেইজিং, কি একটা কনসালটেনসির কাজে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের প্লেনটা দুশো সাতাশ জন যাত্রী নিয়ে বেমালুম লোপাট হয়ে গেল, তার আর কোনরকম খবর নেই। সকলের ধারণা প্লেনটা জলে পড়ে গেছে কিন্তু ওটা কেমন করে অন্য পথে উড়তে উড়তে রাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, কেনই বা বিপদ সংকেত কিছু পাঠালো না এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। এখনও ওই তল্লাটের সবকটা গভর্নমেন্ট মিলে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে, আশা-নিরাশার সুতোয় দোল খাচ্ছে যাত্রীদের বাড়ির লোকেরা।
মিমির নি:শ্বাসের ওঠানামা গুনতে গুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন লিপিকা। সারাদিন ধকল তো কম যায়নি। ঘুম ভেঙে গেল সকাল পাঁচটা নাগাদ, মেয়ের হাতটা বুকের ওপর থেকে আস্তে করে সরিয়ে দিলেন উনি। মেয়েটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে, ওর স্বাভাবিক সৌন্দর্যের ওপর জড়িয়ে আছে প্রথম যৌবনের ঢলঢলে লাবণ্য, যেন সকালবেলায় ফুলের ওপর শিশির কণা। ওকে সোজা করে শুইয়ে দেবার সময় লিপিকা দেখতে পেলেন মেয়ের মুখ থেকে সদ্য পার করা শৈশবের স্মৃতির মতো এখনো যেন একফোঁটা লালা গড়িয়ে পড়ছে। সন্তর্পণে ওর মুখটা মুছে, কম্ফর্টারটা ভালো করে টেনে দিলেন উনি, তারপর আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন কিচেনে। সামনে বিরাট কাচের জানলা দিয়ে দেখলেন গলফ কোর্সের আকাশ ফর্সা হচ্ছে, আবছায়ায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তালগাছের সারি। বিভাসের প্রিয় কফি মেশিনটা কাউন্টারের ওপর বেকার হয়ে বসে আছে, লিপিকা কফি খান না, ওঁর পছন্দ গুড্রিকের চা, দেশে গেলেই স্যুটকেস ভরে নিয়ে আসেন। চা হাতে করে উনি বিভাসের স্টাডিতে গিয়ে বসলেন। ঘরটা বইপত্রে ঠাসা, টেবিলের ওপর কতগুলো না খোলা ম্যাগাজিন পড়ে আছে, দেওয়ালে ঝুলছে নানা সার্টিফিকেট আর মানপত্র। কমপিউটারের মাউসে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনিটরে ছবি ফুটে উঠলো অপারেটিং রুমের। ওদের সার্জিক্যাল টিম, সবাই হাসিতে ঝলমল করছে, ঠিক মাঝখানে রাজার মতন দাঁড়িয়ে আছেন বিভাস। ছবিটার দিকে তাকিয়ে অসহ্য একটা রাগ হলো লিপিকার, উনি ডেস্ক থেকে উঠে আধো অন্ধকার ঘরে ভূতে পাওয়া মানুষের মতো পায়চারি করতে শুরু করলেন। মাথার ভিতরে উৎকন্ঠা আর অবসাদ মিশে এক বিচিত্র হ্যাংওভার, চারদিকে বিভাসের ব্যবহার করা জিনিসগুলো হাঁ করে তাকিয়ে আছে। লোকটা বেঁচে আছে কি নেই শুধু এইটুকু যদি কেউ বলে দিত।
এইবার আকাশের নীল রংটা ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে ডালিমের দানার মতো স্বচ্ছ লাল আভা। এই সময় বিভাস রোজ উঠে তৈরি হতেন, মাঝে মাঝেই বাথরুম থেকে ওনার হেঁড়ে গলার রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে লিপিকার ঘুম ভেঙে যেত। আরো অনেক বছর আগে এক একদিন এইরকম ভোর রাত্তিরে দুজনের শরীর আপনা থেকেই ঘন হয়ে আসতো, অ্যালার্ম ঘড়িটা বেজে যেত অকারণেই। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বিভাস পালাতে চাইতেন কিন্তু লিপিকাও তখন কিছুতেই কাঁধের ওপর থেকে মাথাটা ওঠাবেন না, বরং পা দিয়ে আরো ভালো জড়িয়ে ধরতেন ওঁকে। এই নিয়ে খুনসুটি করতে করতে বিভাসের দেরি হয়ে যেত। একবার রাস্তায় স্পীড করার জন্য পুলিশ ধরেছিল। বিভাস অম্লান বদনে সমস্যাটার কথা খুলে বলেছিলেন— কি করবো বলুন এদিকে বৌ একবার শুরু করলে কম করে একঘণ্টার আগে ছাড়তে চায় না ওদিকে কল এসেছে এমার্জেনসি রুমে পেশেন্ট, এক্ষুনি আসতে হবে। পুলিশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চলে গেছিল সেদিন। কিসের শব্দ? ফাঁকা ঘরে হঠাৎ ভীষণ চমকে উঠলেন লিপিকা। ওপর থেকে একটা চেনা গানের আওয়াজ আসছে না— আমারে দিই তোমার হাতে নতুন করে নতুন প্রাতে। ওদের দুজনেরই একসময়ের প্রিয় গান, যদিও অনেকদিন শোনা হয়নি। কে চালালো? তাহলে কি বিভাস এসে গিয়েছে? এতক্ষণ লুকিয়েছিল সারপ্রাইজ দেবে বলে? উদভ্রান্তের মতো উপরে উঠে দেখলেন, মিমি বিছানার ওপর বসে একটা আইপড চালিয়ে গান শুনছে।
‘মা, দেখো বাবার সেই পুরনো আইপডটা পেয়েছি, ড্রয়ারের মধ্যে পড়েছিল।’
‘ও:, তুই।’
‘কি হয়েছে মা? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ভয় পেয়েছ।’
‘নারে, ঘুমটা ঠিক করে হয়নি, তাই। চল তোকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে অফিসে যাই গে।’ লিপিকা একটা নি:শ্বাস চাপলেন। প্রথম সপ্তাহে কাজে কিছুতেই মন দিতে পারেননি, এখন বরং অফিসে গিয়েই একটু আরাম লাগে, কিছুটা ভুলে থাকা যায়। এখন গরমের ছুটি, মেয়ের স্কুল বন্ধ, না হলে দুজনকেই একসাথে বেরোতে হবে। একবছর পরে ও কলেজে চলে যাবে তখন এই বিরাট বাড়িটায় উনি একা।
আশ্চর্য। একমাস আগেই লিপিকা ভাবছিলেন একা থাকতে এমন কি আর কষ্ট? প্রতিদিনের এই উদাসীনতা আর বিরক্তি, সামান্য কথায় দপ্ করে জ্বলে ওঠা, আবার বাধ্য হয়ে সমঝোতা, সবাইকে দেখানো এই সুখী মধ্যবয়েসী মুখোশ, এরকম ভাবেই কি বাকি জীবনটা চলবে? বিভাস আর লিপিকা দুজনেই কাজপাগল লোক, দুজনেই জিততে ভালোবাসেন, পাদপ্রদীপের আলোয় থাকতে চান। ওঁদের কর্মজীবনের প্রথম দিকে লড়াইটা ছিল বাইরের সঙ্গে। নতুন দেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার হাজারটা চ্যালেঞ্জ আর হাড়ভাঙা খাটুনির সঙ্গে ছোট ছোট দুটো বাচ্চা নিয়ে ওঁরা হিমসিম খেয়ে যেতেন। অথচ সেই টালমাটাল সময়টা ওঁরা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেই পেরিয়ে এসেছেন। বাইরের সমস্যাগুলো একে একে মিটে গেল কিন্তু পাল্লা দিয়ে ছোটার অভ্যাসটা ওঁদের গেলো না। এর মধ্যেই একদিন লিপিকা বুঝতে পারলেন যে এই দৌড় প্রতিযোগিতায় বিভাস নানা কারণে বেশ কিছুটা এগিয়ে রয়েছেন। অদ্ভুত একটা ভাব হয়েছিল মনে, কেমন যেন হতাশা আর বিরক্তি মেশানো, নিজেই অবাক হয়ে গেছিলেন লিপিকা। স্ত্রী হিসাবে স্বামীর সাফল্যে খুশিতে ডগমগ হওয়াটাকে বেকার আতিশয্য মনে হয়েছিল সেদিন। বরং উলটে নিজেকে শুনিয়েছিলেন সেই পুরনো প্রবাদ— প্রতিটি সফল পুরুষের পিছনে রয়েছে একটি করে অসফল নারী। বিরক্তিটা প্রথমে নিজের ওপর ছিল, তাই অফিসে আরো সময় দেওয়া শুরু করে দিলেন উনি। কয়েক বছর পরে বোঝা গেল অফিস আর বাচ্চাদের ছোটবেলায় ওদের জন্য উনি নিজের কেরিয়ারের অনেক ক্ষতি করেছেন, আর নয়। যেমন বিভাস হয়েছেন সেইরকম উনিও পাঁচ জনের একজন হতে চান, স্বামীর পরিচয়ে নয়, নিজের মুরোদে। এইভাবেই গড়িয়ে গড়িয়ে চলছিল বছরগুলো আর একটু একটু করে দুজনে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। বিরাট পুরনো জমিদারবাড়ি যেমন ভেতর থেকে ক্ষয়ে যেতে থাকলেও বাইরে থেকে অনেকদিন কিছু বোঝা যায় না, ঠিক তেমনই আত্মীয় বন্ধুরা এলেও চোরাস্রোতের কিছুই টের পায়নি। সকলের কাছে এমন সুখী পরিবার আর হয় না, যেমন বাবা মা তেমন সোনার টুকরো ছেলেমেয়ে।
ফোনটা বেজে উঠল— বস্টন থেকে ছেলে বিতান ফোন করছে। মাত্র দু’বছর হলো বাড়ি ছেড়ে কলেজে গেছে ছেলেটা। বাবাকে খুব ভালোবাসে, এই ঘটনায় বেশ একটু ঝাঁকানি খেয়েছে যদিও বাইরে সেটা দেখাতে চায় না।
‘হাই মা। অফিসে যাচ্ছ নাকি?’
‘না রে এই বেরোবো। তুই ঠিক আছিস তো?’
‘হ্যাঁ আমি তো ঠিকই আছি। মা তুমি দেখছো অস্ট্রেলিয়ান নেভি কতগুলো ফ্লোটিং অবজেক্ট পেয়েছে। হয়তো এবার প্লেনটাকে খুঁজে পাবে। হটলাইনে খবর আছে কিছু?’
‘না রে বিতাই, খবর থাকলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে ফোন বা টেক্সট করবে। তাও তুই যখন বলছিস, আমি হটলাইনে ফোন করবো একটা।’
‘মা আমার প্রফেসর বলেছেন যে দরকার হলে উনে পেন্টাগনের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। জানো তো উনি ডিফেন্সের হয়ে অনেক বড়ো বড়ো কাজ করেন, অনেককে চেনেন। আমেরিকান নেভি সার্চে জয়েন করেছে, এবার কিছু একটা হদিশ মিলতে বাধ্য।’
লিপিকা একটা নি:শ্বাস চাপলেন। বিভাস ছোটবেলা থেকে ছেলেকে রকেট সাইন্টিস্ট বানানোর কথা বলতেন। সে ছেলে তো সত্যিই এম আই টি’র মতো স্কুলে এরোনটিক এঞ্জিনিয়ারিং করতে গেল আর বিভাস ওদিকে তাঁর প্লেন সমেত নিখোঁজ হলেন। কি অদ্ভুত সারক্যাস্টিক হতে পারে আমাদের জীবন।
লিপিকা একটা নামকরা ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানির এক্সিকিউটিভ, শহরের দুটো ব্লক জুড়ে ওদের ক্যাম্পাস। আজকাল উনি ঢুকলেই সকলের কথা থেমে যায়। সবাই নিজে থেকে এগিয়ে এসে খবর নেয়, সকলেই নানাভাবে সাহায্য করতে চায়। প্রথম প্রথম এই সহানুভূতির বন্যা একরকমের আরাম আর স্বস্তি এনে দিত, এখন ক্রমশ: বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে। সাততলার ওপরে নিজের ছোট্ট অফিসে বসে অভ্যাসমতো কমপিউটার চালু করলেন লিপিকা। উলটোদিকের দেওয়ালটায় ফ্লোর টু সিলিং কাচের জানলা, এখান থেকে যতদূর চোখ যায় ঢেউ খেলানো সবুজ, সোনালি রোদ্দুরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সিলিকন ভ্যালির চোখ জুড়ানো ল্যান্ডস্কেপ। রয়েছে গর্বিত স্কাইস্ক্র্যাপার, নিখুঁত পরিচ্ছন্ন শহরতলি, অজস্র শপিং সেন্টার, উজ্জ্বল ট্রপিক্যাল ফুলে ভরা বাগান আর নারকোল গাছের সারি, তাদের পাতা কাঁপিয়ে বয়ে চলেছে উপসাগরের হাওয়া। দিগন্তের এককোণায় অদ্ভুত একটা ফাঁকা জায়গা, সেখানে আকাশ নেমে এসেছে অনেকটা নিচে, জল দেখা যায় না কিন্তু বোঝা যায় সমুদ্র ওই দিকে। লিপিকা কাচের ওপর দুহাত রেখে ওই ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। রোজ সকালে যখন জোর করে মনটাকে কাজের দিকে ফিরিয়ে আনতে হয়, ঠিক তখনই ওই সুদূর শূন্যতা ওঁকে আশ্বস্ত করে। যেন রোদ্দুরে উজ্জ্বল বেলাভূমির মতো কাঙ্খিত কিছু একটা ওখানে লুকিয়ে আছে, শুধু দূরত্বের জন্য চোখে পড়ছে না। আজ ভোররাত্তিরে ঘুমের ওষুধ আর ক্লান্তির ঘোরে মনে হয়েছিল যে বিভাসের হারিয়ে যাওয়াটা আসলে স্বপ্ন, ওই তো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ওর পরিচিত নাক ডাকার আওয়াজ। এইরকম হালকা ঘুমের ঘোর থেকে ইচ্ছা করলেই জেগে ওঠা যায়। এক ঝটকায় উঠে বসেই উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বিছানার ওপাশটা খালি, স্বপ্নের মধ্যে বিভাসের নাকডাকা শুনছিলেন উনি এতক্ষণ।
‘গুড মর্নিং লিপি।’ টাটকা কফির গন্ধের সাথে ভেসে আসা একটা মৃদু অথচ প্রত্যয়ী ব্যারিটোন ওঁর চটকা ভাঙালো। দরজায় দুকাপ কফি হাতে অভিরাজ যেন এসে দাঁড়িয়েছিলেন। অভিরাজ এই কম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, এইরকম উঁচু পদে খুব বেশি বাঙালির দেখা পাওয়া যায় না। অভিরাজ লিপিকার কাছে শুধু সিনিয়র কলিগ নন, এক অর্থে শিক্ষাগুরু, কর্পোরেট ভাষায় যাকে বলে মেন্টর। কিন্তু এসবের ওপরে ওঁরা পরস্পরের বন্ধু, যেমন অফিসের ভেতর তেমন বাইরেও। অভিরাজের স্ত্রী ক্যারল কয়েকবছর আগে কোনোরকম বিশেষ কারণ ছাড়াই ডিভোর্স চেয়েছিলেন, অভিরাজও আপত্তি করেননি। সেই ডিভোর্সের সময়টা থেকেই আস্তে আস্তে ওঁরা দুজন আরো কাছাকাছি এসে পড়েছেন। বিভাসের সঙ্গে যেসব বিষয়ে নিয়ে ঠান্ডা লড়াই আছে লিপিকার, অভিরাজ সেন নি:সন্দেহে তার মধ্যে একটা।
‘থ্যাঙ্কস অভি, কফিটার ঝুব দরকার ছিল।’
‘তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঘুম হয়নি। ওষুধটা খেয়েছিলে?’
‘খেয়েছিলাম। তার ফল হয়েছে সারারাত কতগুলো অদ্ভুত ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন। লুসিড ড্রিমিং।’
‘মিমি কেমন আছে?’ অভিরাজ একটা চেয়ার টেনে বসেছেন, হাতের ফাইলগুলো এখন টেবিলের ওপর।
‘ঠিকই আছে মনে হয়। যত কষ্টই হোক ওর বয়েসে কেউ সারাক্ষণ একটা জিনিস নিয়ে ব্রুড করে না। ও নানান কাজে ব্যস্ত আছে, আমাকেও ভুলিয়ে রেখেছে। ছেলে বরং অনেক বেশি ডিস্টাবর্ড। ও এখন ধরেছে মালয়েশিয়া যাবে।’
‘ন্যাচারাল। ওর রক্ত গরম, সেই রক্তের মধ্যেকার গুহামানব ইনস্টিংক্ট এখন মশাল আর বল্লম নিয়ে বাবাকে খুঁজতে যেতে চাইছে। কিন্তু এই যুগে ওভাবে কিছু হবার নয়।'
‘খালি মনে হচ্ছে একটা কিছু ডেফিনিট খবর যদি আসতো, ওয়ান ওয়ে অর দি আদার।’
‘সেটা নিয়ে কথা বলতেই এসেছি। এই কাগজপত্রগুলো ভালো করে দেখো। সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ অপারেশন শেষ হয়েছে, এখন শুধু রিকভারি বা প্লেনটার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন আর ইনসিওরেন্স এখন থেকে সবরকম ক্লেইম অ্যাকসেপ্ট করবে। তার মানে—
‘আই অ্যাম সরি লিপি।’
‘তুমি কেন সরি বলছো অভি। তোমার কি করার আছে? তার চেয়েও বড়ো কথা আমরা কি সত্যিই খুব দু:খিত? নাকি কথায় কথায় প্লিজ আর সরি বলার মতো এটাও একটা সামাজিক অভ্যাস। কেউ হারিয়ে গেলে প্রিয়জনেরা তার ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গোনে। অথচ এই সেদিন এই অফিসে বসেই আমরা ডিভোর্স নিয়ে কথা বলছিলাম মনে আছে? আমাদের সমস্যাগুলো কেমন নিজে থেকেই মিটে গেলো দেখো। হাতে রইল ক্ষতিপূরণ আর ইনসিওরেনস মিলিয়ে কয়েক মিলিয়ন ডলার, একগাদা হাঁ করা প্রশ্নচিহ্ন, কনফিউশন আর যুক্তিহীন অপরাধবোধ। অসহ্য!
অভিরাজ প্রায় এক মিনিট চুপ করে রইলেন। জানলার ওপাশে ক্যানাডিয়ান গীজ বা বেলে-হাঁসের একটা বিরাট ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে, শীতের প্রথমে এখন ওদের দক্ষিণে যাবার সময় হয়েছে। ঘরের ভিতরকার উত্তাপ আস্তে আস্তে কমে এল সেই নিস্তব্ধতায়।
‘এখন এইসব নিয়ে কথা না বলাই ভালো লিপি। তুমি বরং অন্য কাজে মন দাও, আরেকটু সময় যাক। যখন দরকার ফোন কোরো।’
বন্ধ দরজাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন লিপিকা। টেবিলের ওপর কাগজপত্রগুলো রাখা আছে, ইচ্ছে না থাকলেও পুরোটা পড়ে দেখা দরকার। পাতার পর পাতা শুকনো আইনের কচকচি, হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর মুখ ঢেকে ফেলেছে পাওনাগণ্ডার হিসাব। দেখতে দেখতে মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে, অভিরাজকে আবার একবার না ডাকলেই নয়।
‘অভি শোনো, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না, তুমি একটু আসবে আমার ঘরে।’
ঠিক এই সময়ে শহরের আরেক প্রান্তে মিমি ক্লাস পালিয়ে কাফেটেরিয়ায় বসেছিল। ও এখন হাই স্কুল সিনিয়র, পরের বছর বার্কলি ইউনিভার্সিটিতে প্রি-মেডিক্যাল পড়তে যাবে। পাশেই ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে সুঠাম চেহারার এক আমেরিকান তরুণ, রোনালড অ্যান্ডারসন ওরফে রনি, ওর একান্ত অনুগত বয়ফ্রেন্ড।
‘মিমস কি করলে তোমার একটু মন ভালো হবে বলো? এমনভাবে ক্লাস পালালে গ্রেড খারাপ হয়ে যাবে না?’
‘রনি তুমিও কেন কলেজ বাঙ্ক করলে। এই মন খারাপ কি ভালো করা যায়?’
‘মিমস তোমার মনে আছে। গতবছর, যখন আমার মা বাবাকে ডিভোর্স করে ইস্ট-কোস্টে চলে গেল, তুমি সারা সপ্তাহটা ছায়ার মতো আমার সঙ্গে ছিলে। ওই সময়ে আমরা প্রথমবার চুমু খেয়েছিলাম। তোমাকে তখন এক এক সময় মায়ের মতই কেয়ারিং মনে হতো। এবার আমার পালা, আমিও তোমার কাছ থেকে নড়ছি না।’
‘সো সুইট অফ ইউ রনি। আসলে জানো বাড়িতে আমায় একটা খুব আশাবাদী আর ম্যাচিওরড পারসোনা বানিয়ে রাখতে হয়, নাহলে মা যে আরো ভেঙে পড়বে। এমনিতেই যা ডিপ্রেসড হয়ে আছে, খাওয়া ঘুম সব ছেড়েই দিয়েছে বলা যায়। অথচ এতদিন আমার ধারণা ছিল যে ওরা ভীষণ ইন্ডিপেন্ডেন্ট, কেউ কারো তোয়াক্কা করে না।’
বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের মধ্যে দুরকম অনুভূতির এক অদ্ভুত ঘুর্ণিপাক টের পেলো রনি। মিমির কাঁধ ছাপানো কালো চুল এলোমেলো করে বাঁধা, সাধারণ একটা টপ আর জিনস পরে আছে, এক ফোঁটা মেকআপ নেই কোথাও অথচ ওই বিষণ্ণ মুখ আর টলটলে কালো চোখদুটো কি যে অসম্ভব সুন্দর। সামান্য ঝুঁকে টেবিলের ওপর কনুই রেখে ও বসে আছে, একটা হাত নিজের চিবুকে, অন্য হাতটা রনির বিরাট মুঠোর মধ্যে হারিয়ে গেছে। ওর খেয়াল নেই যে জামার ফাঁক দিয়ে ওর নিটোল বুকের অনেকটাই দৃশ্যমান, এরকম সময়েও রনির মনে কামনার ঢেউ উঠেছে, তার জন্য লজ্জাও হচ্ছে কম নয়। ওর ছয় ফুট লম্বা বলিষ্ঠ চেহারাটার তুলনায় এই রোগা, ছিপছিপে ছোটখাটো চেহারার ভারতীয় মেয়েটি এমনি দুর্বল আর অসহায় যে যৌন অনুভূতির সাথে সাথে প্রবল সমবেদনায় বুক টাটিয়ে উঠছে রনির। দুহাতে জড়িয়ে ওকে সব কষ্ট আর বিপদ থেকে আড়াল করে রাখতে ইচ্ছা করছে। এই মুহূর্তে বিষন্নতা ওর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে, আদিম নারীত্ব এসে গ্রাস করে নিয়েছে ওর অভ্যস্ত আধুনিক আত্মবিশ্বাস। রনির মনে হলো এইরকম একটা মেয়েকে রক্ষা করতে খুব সহজেই প্রাণ দিয়ে দেওয়া যায়।
টেবিলের ওপর রাখা আইফোনের পর্দায় ছবি ভেসে উঠলো। ফেস টাইম কল, মিমির দাদা বিতান দুহাজার মাইল দূর থেকে হাজির।
‘কেমন আছিস মিমি। মা কে ফোন করছি, ধরছে না কেন রে? ঠিক আছে তো?’
‘ঠিকই আছে। অফিস মিটিং-এ হবে হয়তো। তোর খবর বল।’
‘আমি ঠিক করেছি কুয়ালালামপুরে যাবো। নিউ ইয়র্ক থেকে একটা গ্রুপ যাচ্ছে।’
(পরবাস-৬৫, ডিসেম্বর ২০১৬)