Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে প্রকাশিত উপন্যাসঃ

লোকে বলে অলৌকিক
- ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত


ভিক্টর কুজুর
- কমল চক্রবর্তী


নিওলিথ স্বপ্ন
- দীপেন ভট্টাচার্য


রাতবিরেতের গজল
- ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত


মেঘের নিচে কাকতাড়ুয়া
- বাসুদেব দেব


বর্ণবাসী
- সুভাষ ঘোষাল


ধ্বংসাবশেষ
- শৈলেন সরকার


যাত্রী
- দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


সন্ধ্যাবেলা
- সাবর্নি চক্রবর্তী


অরণ্যকথা
- আইভি চট্টোপাধ্যায়


অন্য কোনখানে
- দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


আয়নার ভিতরে
- কৌশিক সেন


ফরিয়াদ
- সাবর্নি চক্রবর্তী


রাহুলের ডায়েরি থেকে
- ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত


কোথাও জীবন আছে
- শাম্ভবী ঘোষ


হারাধন টোটোওয়ালা
- সাবর্ণি চক্রবর্তী





পরবাসে শাম্ভবী ঘোষের
লেখা


ISSN 1563-8685




কোথাও জীবন আছে

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত
সন্ধ্যা নামে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল
সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী; ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

ইটা বন্ধ করে জানলার দিকে তাকাল শরণ্যা। এতক্ষণ সে কবিকে অনুসরণ করছিল বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে, সিংহলের সমুদ্রে, বিদর্ভ নগরে। কবির ক্লান্তি তাকেও যেন স্পর্শ করে যাচ্ছিল। এখন মনটা আস্তে আস্তে বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসছে। বাইরের জগতের কোলাহল ইন্দ্রিয়গুলোর কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছে একে একে। জানলার বাইরে চেয়ে শরণ্যা দেখল, পৃথিবীর সব রঙ নিভে যেতে আর বেশি দেরি নেই। কিন্তু অন্ধকার এখানে পথ হারিয়ে ফেলে। ওই দৈত্যের মতো হল্‌দে স্ট্রীট্‌ল্যাম্প্‌গুলো জ্বলে উঠে চোখ ধাঁধিয়ে দেবে একটু পরেই। সেই আলোর তলায় হাজার হাজার জোনাকির ঝিলমিল চাপা পড়ে যায়। কলকাতায় কি জোনাকি আছে? শরণ্যা আজ অবধি দেখেনি। এখানে সন্ধে শিশিরের মতো নামেনা; চিৎকার করে নিজের উপস্থিতিটা জানিয়ে দিয়ে যায়। শিশির এখানে পড়তেই পায়না, বাষ্প হয়ে কোথায় উড়ে যায়, কে জানে!

মোবাইল ফোনের শব্দে চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। অলসভাবে ফোনটা তুলেই একটু থমকে গেল শরণ্যা। তারপর ফোন ধরে স্বাভাবিক গলায় বলল, “হাই সানা।”

“হ্যালো রাকা। য়ু গুড্‌?”

“হুম্‌ম্‌…”

“মানে? এনিথিং রঙ?”

“নাঃ, কিছু না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম।”

“কী? কি হয়ে গিয়েছিলি?”

“অন্যমনস্ক। মানে ডিস্ট্র্যাক্টেড্‌, য়ু নো।”

“ওঃ, ওকে। বেঙ্গলী ইম্‌প্রুভ করেছে আই সী।”

“তা আমার বাংলা তোর থেকে বরাবরই বেটার।”

“স্টিল্‌, আগে এতটা বলতিস না।”

“এখানে দেড় বছর হয়ে গেল প্রায়। একটু তো বলবই।”

“পয়েন্ট টেকেন্‌। কিন্তু ডিস্ট্র্যাক্টেড্‌ কেন?”

“নাথিং, একটা কবিতা পড়ছিলাম।”

“তাই? হুইচ্‌ ওয়ান?”

“‘বনলতা সেন’।”

“নেভার হার্ড অফ ইট্‌।”

“শুনবি?”

“ফর্‌গিভ মি। য়ু নো আই অ্যাম নট ফন্ড্‌ অফ বেঙ্গলী পোয়েট্রি।”

“এটা একটু অন্যরকম ছিল।”

“ওয়েল, ইট্‌স অল দ্য সেম ফর মি।”

শরণ্যা একটা দীর্ঘঃশ্বাস গোপন করে বলল, “তুই ভাল আছিস?”

“অফ্‌ কোর্স। য়ু ওয়্যার আ ফুল টু লীভ, রাকা। য়ু কুড হ্যাভ স্টেয়েড্‌ উইথ মি।”

“থাক না সানা। উই হ্যাভ ডিসাইডেড্‌।”

“ওঃ ইয়েস। উই হ্যাভ ডিসাইডেড্‌।”

খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপর ওপার থেকে ভেসে এল, “আই হোপ য়ু আর স্টাডিইং?”

“ইয়েস।”

“গুড্‌। আই ওয়ান্ট দ্য বেস্ট গ্রেড্‌জ ফ্রম য়ু। য়ু উইল হ্যাভ টু রিটার্ন সুন্‌, অ্যান্ড য়ু মাস্ট হ্যাভ দ্য রেজাল্ট্‌স্‌ ফর আ স্কলারশিপ।”

“দেখা যাক।”

“আই অ্যাম ওয়েটিং, এটা মনে রাখ।”

“রেখেছি।”

“গুড্‌। এক্স্যাম্‌স আর্‌ন্‌ট টু ফার আওয়ে। য়ু মাস্ট কন্‌সেন্‌ট্রেট্‌। আজকে হ্যাঙ আপ করছি তবে ডার্লিং।”

“সানা ... তুই একবার কথা বলবি না?”

ওপারের গলাটা একটু ক্লান্তভাবে বলল, “উই হ্যাভ্‌ বীন্‌ থ্রু দিস মেনি টাইম্‌স্‌, রাকা। বলে দিস, আই অ্যাম ফাইন। দে নীড নট ওয়রি।”

“বাই সানা।”

“বাই, হানি। টেক্‌ কেয়ার।”

ফোনটা রেখে অনেকক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে রইল শরণ্যা। তার মনের মধ্যে এখন শুধু গাড়িঘোড়ার গর্জন, সারাদিনের জমে ওঠা কুণ্ডলী পাকানো কালো কালো ধোঁয়া। যখনই সানার সঙ্গে কথা হয়, তখনই কোনো না কোনওভাবে এই প্রসঙ্গ উঠে আসবেই। ও ধরেই নিয়েছে যে শরণ্যার চলে আসাটা সাময়িক। অথচ গত এক বছরের মধ্যে যে কতগুলো পিছুটান তৈরি হয়ে গেছে, সেটা কেন যে সানা বোঝেনা! এই মুহূর্তগুলো খুব কষ্টকর। হঠাৎ নীচ থেকে মম্‌ আওয়াজ দিল, “রাকা? ছটা বাজল, রেওয়াজে বসলি না? এরপর তো পড়াশোনার সময় থাকবে না!”

তাইতো! শরণ্যা উঠে গিয়ে ঘরের কোণ থেকে তানপুরাটা নিয়ে এসে তার বাঁধল অনেকক্ষণ ধরে। কে জানে কেন, মনখারাপ হলে শরণ্যার কেবলই দেশ গাইতে ইচ্ছে হয়। তাছাড়া ক’দিন খুব রোদ ঝাঁ ঝাঁ হয়ে ছিল; অবশেষে যদি বৃষ্টি নামে এবার! আলাপের পর বন্দিশের প্রথম লাইন ধরার সাথে সাথেই তার মনে হল, বাইরে থেকে ঠান্ডা এক ঝলক হাওয়া ভেসে এল :

মেহা রে, বন বন ডার ডার ...
কতক্ষণ যে কেটে গেল কে জানে! গানের মধ্যে ডুবে ছিল শরণ্যা। ফোনে মেসেজ আসার শব্দে হুঁশ হল। গান থামিয়ে ইন্‌বক্সটা খুলেই চমকে উঠল সে।

“নেক্সট্‌ উইক কলকাতায় যাচ্ছি। সান্‌ডে বাড়িতে আসিস। ঋদ্ধিমানকে বলেছিলাম তোকে ইন্‌ফর্ম করার জন্য। বোধহয় ভুলে গেছে। সী য়ু — রঙ্গীত।”

শরণ্যা আপনমনে হাসল। মনখারাপটা কখন যেন বাষ্প হয়ে গেছে।


*

সন্ধেবেলার সময়টা উপলার প্রিয়, বিশেষ করে যদি বসন্তকাল হয়। এখন অবশ্য তা নয়, তবু সে বাইরের পানে চেয়ে বসে বসে পা নাচাচ্ছিল। কথা নেই বার্তা নেই, বৃষ্টি নেমে গেছে। বর্ষাকালের এই এক জ্বালা! এই গরমের চোটে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়তে হয়, আবার পরের মুহূর্তে এমন বৃষ্টি নামল, মনে হয় বিশ্বসংসার যেন পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেছে। তবু, এইসময়ে চায়ের সঙ্গে তেলেভাজাটা মন্দ লাগেনা! বাড়ির কেউ কি সাপ্লাই দিতে আসবে সে সব? নাকি পড়তে বসেছে ভেবে আর খোঁজই নিল না? তা, উপলার পড়তে বসার কিছু তাড়া নেই। ভাল লাগেনা বাবা! টুয়েল্‌ভ ক্লাসে উঠেছে মানেই কি রাতারাতি আইন্‌স্টাইনের মত খেল্‌ দেখাতে হবে নাকি? সবার মুখে এক কথা শুনে শুনে কান পচে গেল; কী, না আই.এস. সী. পরীক্ষার নাকি আর বছরটাও বাকি নেই। তা, দু হাজার নয় সালের কথাটা কি সেই তখনই ভাবলেই হয়না? উপলা বর্তমানে বিশ্বাসী। কোথায় চায়ে চুমুক দিতে দিতে আরাম করে ‘টিউস্‌ডেজ উইথ মোরি’ পড়বে, তা না যত রাজ্যের ইকনমিক্স হোম্‌ওয়ার্ক ... তবে আগের দিন ইকনমিক্স ক্লাসে যে কাণ্ডটা হল, যা তা একেবারে ...

মা এসে বলল, “পলা, তুই পড়তে বসে গেছিস?”

“হে হে, কই না তো।”

“সে তো দেখতেই পাচ্ছি। যাহোক, ফোন এসেছে, গিয়ে ধর্‌।”

“কার আবার ফোন এল?”

“কেন, কণিষ্ক,” মা মুখ টিপে হেসে চলে গেল।

উফ্‌! এই গাধাটা কি মোবাইলে ফোন করতে পারেনা! সিঁড়ি দিয়ে দুম দুম করতে করতে নেমে তাদের ড্রয়িংরুমে ঢুকে উপলা ফোন ধরল, “হ্যালো।”

“কণিষ্ক বলছি।”

“জানি বে।”

“একি ভাষা রে! মেজাজ তুঙ্গে মনে হচ্ছে?”

“হবেনা তুঙ্গে? যতসব অপ্রকৃতিস্থ মাতালের পাল্লায় পড়েই তো দেশটা গোল্লায় গেল।”

“আরে কিন্তু হয়েছেটা কি?”

“কতবার বলেছি, ল্যান্ড্‌লাইনে ফোন করিসনা। উনি শুনবেন কেন! আমি যেটা বলব ঠিক তার উল্টোটা করাই কি তোর পেশা নয়, ইয়ে কোথাকার?”

“ওঃ বলেছিলি বুঝি? হেঃ হেঃ, ভুল হয়ে গেছে।”

“যাক স্বীকার করছিস তাহলে।”

“এটা অন্যায়! আমি অল্‌ওয়েজ –”

“বাজে না বকে আমার কথাটা শোন্‌। এইমাত্র মনে পড়ল। ফ্রাইডেতে ক্লাসে কি হয়েছে জানিস?”

“না বললে কি করে জানব?”

“সেদিন সঙ্গীতাটা —”

“সেটা আবার কে?”

“উফ্‌, চুপ ক’রে শোন্‌ না রে বাবা! বুঝলি, তো সেদিন তার সঙ্গে পি.এস-এর যা তুলকালাম লেগেছে কহতব্য নয় —”

“পি.এস.? মানে পুনশ্চ?”

“আবার ইয়ার্কি? আমাদের ক্লাস টিচার পি.এস-এর কথা বলিনি তোকে?”

“ওঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই আধপাগল মহিলা –”

“আধা? হুঁ। তো তার ক্লাসে সঙ্গীতা যাচ্ছেতাই কাণ্ড বাধিয়েছে বুঝলি? পি.এস-এর মাথায় গণ্ডগোল বরাবরই ছিল, কিছুর মধ্যে কিছু না, ক্লাস চলছে, হঠাৎ তিনি বলে বসলেন, ‘সঙ্গীতা, হোয়াই আর য়ু টকিং?’ তার উত্তরে মেয়েটা যা করল, ভাবতে পারবিনা! তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলে কিনা, ‘আই অ্যাম নট্‌ টকিং, য়ু ফুল!’ ভাব একবার।”

“কি কাণ্ড! পাগল টাগল নাকি?”

“অপ্রকৃতিস্থ মাতাল।”

“তা আর বলতে! তারপর কি হল?”

“কি আর হবে? পি.এস. বলে কিনা, ‘ওঃ হো!’”

“অ্যাঁ? শুধু ‘ওঃ হো’?”

“শুধু তাই নয়, তারপর আধ ঘন্টা ধরে দুজনে মিলে তর্ক করে গেল, আমরা হাঁ করে বসে রইলাম। তর্ক যখন থামল, তখন দেখলাম দরজায় ঠেস দিয়ে ভাইস প্রিন্সিপাল দাঁড়িয়ে আছে।”

“হাঃ হাঃ, বলিস কী!”

“পুরোটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনেছে ভদ্রলোক। সঙ্গীতাকে তিন দিনের জন্য সাস্‌পেন্ড করে দিয়ে চলে গেল। ভাবতে পারছিস আমাদের স্কুলের লোকজনদের অবস্থা?”

“না।”

“কী না?”

“ভাবতে পারছি না।”

“ও। হেঃ হেঃ।”

“হুম্‌। হেঃ হেঃ।”

“হিঃ হিঃ হিঃ।”

“আচ্ছা, আমরা হাসছি কেন?”

“পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই। তা কণিষ্কের মুণ্ডু, তোমার পড়াশোনা নেই?”

“তা আছে।”

“তো যা না! আর হ্যাঁ, তুই ঠিক আছিস তো?”

“থাকবনা কেন! ওঃ হ্যাঁ যে কারণে ফোন করলাম, সামনের সপ্তাহে আবার একটা হিয়ারিং।”

“জানি। সেই জন্যেই তো জিগ্যেস করলাম।”

“ওঃ। হে হে। রাখলাম। টা টা।”

“হুঁ, পালা।”

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ একটু অন্যমনস্কভাবে বসে রইল উপলা। সামনের সপ্তাহটা ... একটু নার্ভাস লাগে এই সময়গুলোতে। না জানি কণিষ্কর কি মনে হয় তখন। ... যাক্‌গে, কি হল না হল সময়মত জানা যাবে আবার। উপলা উঠে পড়ল। এবারে সত্যিই বইখাতা নিয়ে বসা দরকার। তার পড়ার ঘরখানা আবার তিনতলায়, মেজজেঠিমাদের ফ্লোর-এ, এদিকে যথারীতি কণিষ্কর ফোন এসেছে তাদের ফ্লোরের বসার ঘরে। আবার সিঁড়ি ভাঙো ... ল্যান্ড্‌লাইনে ফোন করার কিন্তু কোনো মানে হয়না।


*

মৃণালিনী আবার ‘ঝিন্দের বন্দী’ নিয়ে পড়েছে। দুর্ধর্ষ বিষয়বস্তু, দমবন্ধ উত্তেজনা, এবং বলাই বাহুল্য, গৌরীশঙ্কর আর কস্তুরীর অসামান্য কেমিস্ট্রি। বিখ্যাত ডায়লগগুলো পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল রীতিমতো। কস্তুরী আবেগজর্জর অথচ দৃঢ়কন্ঠে বলছিল “আমার খিস্তা আছে ...” আর মৃণালিনী ক্রমশই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল ...

এমন সময় বেরসিক ফোন!

“জানোয়ার, কুপিয়ে দেব!” মৃণালিনী ফোন তুলেই বিকট হাঁক ছাড়ল একটা।

“মানে? চেঁচাচ্ছিস কেন ষাঁড়ের মতো?”

“আমি ‘ঝিন্দের বন্দী’ পড়ছি।”

“ওঃ, কি যা তা! কতবার এটা পড়েছিস একটু হিসেব করে বলবি আমাকে?”

“তোকে হিসেব কেন দেব বে? পরে ফোন করছি, এখন ডিস্টার্ব করবি না।”

ফোনটা রেখে বিরক্ত হয়ে চোখ বুজল মৃণালিনী। নীরাটার কোনোকালেই সময়ের জ্ঞান বলতে কিছু ছিল না। বেশ একটা ফিলিং এসে গিয়েছিল, ঠিক তক্ষুনি ফোনটা করে মুডের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল। কোনও মানে হয়! মৃণালিনী ধ্যানস্থ হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। বইয়ের পাতায় মনটাকে ডুবিয়ে দেওয়া কি অতই সহজ নাকি! সাধনা চাই, সাধনা। বলতে কি, বইটা তার কাছে এখন গীতা কিংবা রামায়ণের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোজ সন্ধেবেলা ক’পাতা না পড়লে মনে শান্তি হয়না। ... হুঁ, ভাব এসে গেছে প্রায়। একটু একটু করে চোখের সামনে ভেসে উঠল দৃশ্যটা ...

স্পষ্ট দেখতে পেল মৃণালিনী, খিস্তা নদীর পারে বিশাল এক দূর্গ, আকাশে চাঁদ হাসছে। দূর্গের ভিতরে ঢুকে অনেক অলি-গলি পেরনোর পর, প্রাসাদের যে ঘরটায় পৌঁছাল, সেটা একটা অস্ত্রাগার। ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে ভয়ংকর-দর্শন সব অস্ত্র সাজানো। এককোণে টিমটিম করে একটা প্রদীপ জ্বলছে। সেই আলোয় মৃণালিনী দেখল, ঘরে দাঁড়িয়ে আছে দুটি মানুষ। তারা গৌরীশঙ্কর আর কস্তুরী। কস্তুরীর চেহারা অনেকটা তারই মতো, তবে গৌরীশঙ্কর একরাশ অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়েছিল, তার মুখ দেখা যায়না। শুধুমাত্র তার গলার স্বর ভেসে আসছিল মাঝে মাঝে। তারপর হঠাৎ, এক মুহূর্তের জন্য অন্ধকার কেটে গিয়ে গৌরীশঙ্করের মুখটা ভেসে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল।

চমকে উঠে চোখ খুলল মৃণালিনী। খানিকক্ষণের জন্য তার চিন্তাশক্তি যেন চলে গিয়েছিল। তারপর বইয়ের দিকে তাকাল সে। কী লেখা আছে পাতাগুলোতে? নিমেষের মধ্যে ঝিন্দের জগৎটা ওলটপালট হয়ে গেছে। ... গৌরীশঙ্করের বদলে ও কার মুখ ভেসে উঠল?


*

ফোনটা রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ গোমড়া মুখে বসে রইল নীরা। এই ক’দিনে মেয়েটা কি রকম যেন হয়ে গেছে। ‘ঝিন্দের বন্দী’ নিঃসন্দেহে অতি চমৎকার গল্প, কিন্তু মৃণালিনীর এই আদিখ্যেতাটাও একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেশি নয় কি? তাছাড়া, এর আগে এরকম অদ্ভুত সমস্যা তো কখনও দেখা যায়নি! সেই কোন ছোটবেলা থেকে তাকে দেখে আসছে নীরা; আজন্মই তার ‘রণং দেহি’ ভাবেই সে অভ্যস্ত। নিজে কি কিছু কম মার খেয়েছে লিনীর হাতে? আজও ছবির মতো মনে আছে, একটা ক্লাসে স্থির হয়ে বসার ক্ষমতা ছিলনা মেয়েটার। টিচারদের নাকের ডগায় বসে পা দোলাতে দোলাতে আগাথা ক্রিস্টির ডিটেক্‌টিভ বই পড়ত, আর ছেলেরা ট্যাঁ-ফোঁ করতে এলে রে রে করে ছুটে যেত। একবার যা এক কাণ্ড হয়েছিল, সে কথা ভাবলে এখনও নীরার গায়ে কাঁটা দেয়! সেদিন ক্লাসের সবচেয়ে বড় চালিয়াৎ ছেলে অর্জুন রক্ষিত টিফিন ব্রেকের সময় মৃণালিনীকে শুনিয়ে শুনিয়ে গিটার বাজিয়ে গান গাইছিল। লিনীর বহুক্ষণ কোনো হেলদোল নেই। তারপর আচমকা তড়াক্‌ করে লাফিয়ে উঠে ছেলেটার হাত থেকে গিটার কেড়ে নিয়ে তাই দিয়ে ওর মাথায় মারল এক বাড়ি! গিটারের খোলটা ভেঙে গিয়ে অর্জুনের গলায় ঝুলতে লাগল। তাই নিয়ে সারাটা স্কুলে সে কি ডামাডোল! বেচারা ছেলে পরদিন থেকে আর গিটার হাতে নিয়েছে কিনা সন্দেহ।

ছোটবেলা থেকেই লিনীর প্রিয় বুলি হল ‘কুপিয়ে দেব’। ‘মা - বাবা’ বলার আগে থেকে নাকি এই বাক্যটি বলতে শিখেছেন দেবী। অনেকদিন আগে একবার তারই বাড়িতে বসে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ দেখেছিল দুজনে মিলে। স্পষ্ট চোখের সামনে দৃশ্যটা ভাসে; কাজলের ওড়না ছুঁড়ে দেওয়ার হৃদয়-বিদারক মুহূর্তটিতে নীরা যখন ফ্রকের আস্তিনে চোখ মুছতে ব্যস্ত, তখন মৃণালিনী গম্ভীরমুখে নিজের কেক সাবাড় করে ফেলে তার ভাগের কেকটাও গপ্‌গপিয়ে গিলছিল আর তাচ্ছিল্যভরে বলছিল, “কাঁদছিস কেন মেয়েদের মত?”

এ হেন মৃণালিনীর হঠাৎ এমন আমূল পরিবর্তন কিসের জন্য? এই ঘটনা অবশ্য খুব বেশিদিনের ব্যাপার নয়; সকলের হয়তো খেয়াল পড়েনি এখনো। তবে নীরার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়। যতই হোক বাবা, বাল্যবন্ধুর সঙ্গে ওজর চলেনা। সে হলফ করে বলতে পারে যে লিনীর ‘কুপিয়ে দেব’-তে আর আগের সেই ব্রহ্মাস্ত্রসুলভ ঝাল নেই; চোখ দিয়ে অগ্নিবর্ষণ করার ক্ষমতাও কিছু কমেছে। কি হলটা কী ওর? নীরা চিন্তিত মুখে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। সমস্যা জটিল তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য বয়স বাড়লে অনেক কিছুই নাকি পালটায়; মা তো থেকে থেকেই তাকে শেষ টিন-এজ-এর যাবতীয় মনোবৃত্তির সাংঘাতিক সব পরিবর্তন নিয়ে বাণী দিচ্ছে আজকাল ...

নীরা চোখ বুজে বিড়্‌বিড় করল, “লিনীর এই পাগলামির কারণ বলে দাও ঠাকুর!”


*

রাত বাড়ছিল। ব্যালকনিতে একলা দাঁড়িয়েছিল তিলোত্তমা। বাড়ির সামনের ফাঁকা জমিটার উপর পূর্ণিমার চাঁদের রূপোলী চাদর বিছানো; অনেকদূরের আকাশে একটি তারা ঘুমচোখে তাকিয়ে পৃথিবীর দিকে। কেমন একটা অসহনীয় সৌন্দর্য আছে এই নিসর্গের মধ্যে! এইসব ভয়ংকর সুন্দর রাতেই তো জেগে ওঠে অন্ধকার গহ্বরে লুকিয়ে থাকা যত নেকড়েমানব। সব সুন্দরের আড়ালেই কি একটা ভয়ানক কিছু শিকারের অপেক্ষায় ওৎ পেতে থাকে? তিলোত্তমা সামান্য শিউরে উঠল।

কখনো কখনো বহির্জগতের কোলাহল মিলিয়ে গিয়ে যখন সন্ধে হয়ে আসে, তখন মনের ভিতরের সন্ধানী আলো আপনিই জ্বলে ওঠে। তিলোত্তমা সবসময় তা চায়না। লুকোনো কোণে অনেক কালো কালো ছায়াদের ভিড়। সব মানুষের মনেই এসব ভাবনা এসে জড়ো হয় মাঝেমাঝে। সেদিন ক্লাসে যে কবিতা পড়ানো হল, তাতেই তো এর প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। নির্জন রাতে পুকুরের ধারে বসে মাছ ধরতে ভয় করে কবির; কিংবদন্তী আছে যে ইংল্যান্ডের সমান গভীর ওই পুকুরে হিংস্র পাইক মাছ বাস করে — দৈর্ঘে সে কমপক্ষে একশো হাত। পুকুরের ধারে বসেই কবির হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে, পাছে তাঁর বড়শি সেই মাছকেই গেঁথে ফেলে, এবং সেই জলচর রাক্ষস যদি তাঁকে টেনে নেয় অতল জলের গভীরে? ...

এই ভাবনাগুলোও এক একটি পাইক মাছ। গেঁথে তুললে বিপদ।

তিলোত্তমা সাবধানে মনের নিভৃত কোণগুলোকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। রাত বাড়তে থাকে।


|| ২ ||

বার সপ্তাহের শুরু, আরেকটা সোমবার। চিরপরিচিত অবসাদ নিয়ে শরণ্যা বিছানা ছাড়ল। প্রত্যেকটা দিনই যেন পরস্পরের যমজ বোন। কি হবে, কি হতে চলেছে, সবই তার মুখস্থ। তাই দিনগুলো আর কোনো আগ্রহ জাগায়না তার মনে। নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য শরণ্যা রোজ মনে মনে আওড়ায়, ‘আর মাত্র কয়েকটা মাস। তারপরেই দেয়র উইল বি আ নিউ লাইফ।’

তৈরি হতে খানিকটা সময় নিল সে। সকালে নীচে নামতে একদম ইচ্ছে করেনা। ওরা সবাই এই ক’দিনে কেমন যেন বদলে গেছে। কোথা দিয়ে যে কি হয়ে গেল, এখনও শরণ্যা মাঝে মাঝে ভাল করে ঠাওর করে উঠতে পারেনা। কিন্তু বদলে যাওয়া ছবিটা রোজই চোখে পড়ে তার।

“রাকা, আর য়ু রেডি?” নীচ থেকে মম্‌ আওয়াজ দিল।

“কামিং মম্‌,” শরণ্যা আর সময় নষ্ট করলনা।

নীচে এসে অবশ্য কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আজকের আবহাওয়া খারাপ মনে হচ্ছেনা। ড্যাড্‌ কাগজ পড়ছে আর মম্‌ জলখাবার সাজাচ্ছে। কারুর মুখেই মেঘের ছায়া নেই। শরণ্যা টেবিলে বসে বলল, “মর্নিং, পীপ্‌ল।”

মম্‌ আড়চোখে তাকিয়ে মুচ্‌কি হাসল, “এই স্বভাবটা কোনওদিন যাবেনা নাকি রাকা?”

“কোন স্বভাব?”

“ওই যে, ‘মর্নিং পীপ্‌ল’। এদেশের লোকেরা ওই কথা বলে সকালে উইশ করেনা।”

শরণ্যা একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমি তো এদেশের লোক নই।”

অন্যদিন হলে মম্‌ কি বলত কে জানে। আজ বোধহয় মেজাজ বেশ ভালোই। শরণ্যার কথা শুনে হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “সে না হয় হল। কিন্তু এখন তো এদেশে আছিস। সংস্কৃত প্রবাদ আছে একটা, ‘যস্মিন্‌ দেশে যদাচারঃ’। মানে জানিস?”

শরণ্যা খেতে খেতে বলল, “হুঁ।”

“কী বল্‌ তো?”

“ওই তো, যে দেশে যখন থাকবে তখন সেখানকার মত বিহেভ করবে আর কি।”

“রাইট্‌। এটা সবসময় মনে রাখবি।”

শরণ্যা মনে মনে ভাবে, ‘ভুলি আমার সাধ্য কি।’

খেতে খেতে আর কোনো কথা হলনা। শরণ্যাও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল। কথা বাড়ালে হয়তো এই সাময়িক শান্তিটুকু ভেঙে যাবে।


“দশটাকার খুচ্‌রো কিন্তু হবেনা দিদি,” অটোওয়ালা গম্ভীরমুখে জানাল। শরণ্যা অটোতে উঠতে উঠতে নির্বিকারভাবে বলল, “অত আশাও করিনা কাকু।”

জবাব দেওয়াটা অটোওয়ালা নিজের সম্মানের বাইরে মনে করল।

শরণ্যার স্কুল তার বাড়ির থেকে খুব বেশি দূরে নয়। অটো ধরলে মিনিট পনেরোর পথ; বড় রাস্তা ছেড়ে একটু ভিতরের দিকে স্কুলটা, বিজয়গড়ের কাছাকাছি একটুকরো নিরিবিলি জায়গা নিয়ে। এইটুকু সময় শরণ্যার বেশ ভাল লাগে। অটোর বাইরে কতরকম দৃশ্য দেখা যায়। সব দৃশ্যই যে মনোরম তা অবশ্য নয়। তবে শরণ্যার কাছে অনেকটাই এখনো বেশ নতুন, বেশ ইন্টারেস্টিং। কতরকমের মানুষ রাস্তায় — তার মধ্যে কয়েকটা মুখ বারবার দেখে চেনা লাগে আজকাল, আবার কিছু মুখ আর দ্বিতীয় দিন খুঁজে পাওয়া যায়না। অগুন্তি অটো, ট্যাক্সি, বাস — বৈষ্ণবঘাটার মিনিতে কি করে অত লোক ভর্তি করতে পারে কন্ডাক্টর, তা এতদিনেও ভেবে বার করতে পারেনি সে। প্রত্যেকটা মানুষ, প্রত্যেকটা যান নিরন্তর ছুটে চলেছে সর্বত্র। মনে হয়, থামবার শক্তিটাই যেন একযোগে হারিয়ে ফেলেছে সবাই। পথের দুধারের ফুট্‌পাথে জায়গার একান্ত অভাব। অবশ্য এই শহরে ফুট্‌পাথ বলতে রাস্তার দুপাশে ফালিখানেক মার্জিন মাত্র — কিন্তু তাও এখন দোকানপাটের কবলে।

তেমাথার মোড়ে এসে অটো ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। একটু থমকে গিয়ে তারপর নেমে ভাড়া দিল শরণ্যা।

“ভাড়াটা আগের থেকে বার করে রাখতে পারেন না? শুধু শুধু দেরি করিয়ে দেন,” বিরক্তমুখে মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে অটোওয়ালা একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বেরিয়ে যায়। এই শহরে সময়েরও বড় অভাব।


*

ক্লাসে ঢুকেই হাসি পেল শরণ্যার। উপলা বেশ তাড়াতাড়ি এসেছে আজ। ক্লাসঘর পুরো ফাঁকা, এখনো অবধি কারুর দেখা নেই। শুধু উপলা জুতো খুলে সামনের চেয়ারে পা তুলে দিয়ে নিবিষ্টচিত্তে একটা বই পড়ছে। শরণ্যা নিঃশব্দে ঢুকে পাশের চেয়ারে বসে ব্যাগটা সন্তর্পণে মাটিতে নামাল। আজকে শরদিন্দুর ছোটগল্প সমগ্র নিয়ে এসেছে। সেটা বার করে সেও পড়তে লাগল।

মিনিট পাঁচেক পরে হঠাৎ উপলার বিস্মিত জিজ্ঞাসা, “সেকি রে, তুই আবার কখন এলি?”

শরণ্যা বই বন্ধ করে বলল, “তা মিনিট দশেক তো বটেই।”

উপলা অবাক হয়ে শরণ্যার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ, তারপর বলল, “টেলিপোর্ট করতে শিখেছিস নাকি? ঢুকলি কখন? কোথা দিয়েই বা ঢুকলি?”

শরণ্যা নির্বিকারভাবে আবার বইটা খুলে বলল, “দশ মিনিট আগে দরজা খুলে তোর নাকের ডগা দিয়ে ঢুকেছি।”

“তো দেখতে পেলাম না কেন?”

“চশমার পাওয়ার বেড়েছে।”

“বই পড়তে তো অসুবিধে হচ্ছেনা।”



(ক্রমশ)



(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)