আবার হারা হাতের ঘড়ি দেখল। আটটা বেজে গেছে, এখনও চা, নাস্তা কোন কিছুরই দেখা নেই। বাড়ির ছোট বৌ আজ নিশ্চয়ই অন্য কাজে ব্যস্ত আছে, আর সেজন্যে মওকা পেয়ে বাড়ির কাজের লোকেরাও সব কাজে ঢিলে দিয়েছে। কাজের লোকেদের পেছনে লেগে না থাকলে ওরা কি আর ভাল করে কাজ করে? ওর বৌ বাতাসি, সে-ই তো এক নম্বরের ফাঁকিবাজ। এই যে গৌরা, ইলেকটিরিকের কাজ করে, সব বড় বড় ফেলাট বাড়ি তৈরী হবার সময় লাইন বসায়, ও-ও তো ঠিকেদার না দেখলেই ফাঁকি দেয়, বসে জিরোয় আর বিড়ি খায়। হরে কিষ্ণ কীর্তনের দলও ছটফট করছে — ওরা তো সারারাত জেগে হরির নাম করেছে। ওদের দলের একজন হারাকেই জিজ্ঞেস করল, মশাই, চা জলখাবার কখন দেবে জানেন নাকি? হাত আর ঠোঁট দুই-ই উল্টে দিয়ে হারা মাথা নাড়ল। ও জানবে কি করে?
তখনো হারার টোটো হয় নি, সাইকেল রিকশা চালায়। সক্কালবেলায় স্ট্যান্ডে চার পাঁচটা রিকশা থাকে, ওদের ভাষায় গাড়ি। হারা গাড়ি নিয়ে সকালে স্ট্যান্ডে গেল, হাতে বাঁধা নতুন ঘড়ি। তিন চারজন ততক্ষণে এসে গিয়েছে — রাস্তার উল্টোদিকের চায়ের দোকান মাটির ছোট খুরিতে করে চা দেয়, সেই চা খাচ্ছে, রিকশা থেকে নেমে উবু আর গোল হয়ে বসে। এরকম করে বসলে আড্ডা দিতে সুবিধে হয়। এখনো ওদের খদ্দের আসা শুরু হয় নি, খদ্দের আসা আরম্ভ হবে এই আধঘন্টাটাক পরের থেকে। নিতাই আর গোবিন্দর সকালে বাঁধা খরিদ্দার আছে। নিতাই-এর খদ্দের এক বুড়ো উকীলবাবু। তাকে নিতাই খাল পার করে দেয়। সেখান থেকে অটো ধরে উকীলবাবু যান আদালতে। সব লোকজনের হলপনামা তৈরি করে দেন। উকীলবাবু বেশি মক্কেল পান না, সেজন্যে সকাল সকাল গিয়ে মক্কেল ধরার চেষ্টা করেন। রোজগারপাতি বেশি নয় বলে বাড়িতে অশান্তি। নিজের বৌ, ছেলে, ছেলের বৌ, কেউ-ই ভদ্রলোককে কোন পাত্তা দেয় না। পুরুষমানুষের রোজগারই তো আসল — টাকা রোজগার না করলে সে পুরুষমানুষই নয়। আর টাকা আনলে বাড়িতে সকলের মুখেই হাসি — তা সে টাকা চুরি জোচ্চুরি যে করেই আসুক না কেন। উকীলবাবুর সব কথা হারা নিতাই-এর মুখে শুনেছে। ভদ্রলোক বুড়োমানুষ, অনেক দিন ধরে নিতাই-এর রিকশায় চড়ছেন — তাই নিতাই-এর সঙ্গে একটু ভাব সাব হয়ে গিয়েছে। নিজের দু:খের কথা নিতাইকেই বলেন, কারণ আর কেউ সে সব শোনে না। নিতাই-ও শোনে বুড়োবাবুকে অটোস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেয়া পর্যন্তই। তাকে নামিয়ে দিয়েই চটপট রিকশা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে পেডাল চালিয়ে দেয়। ভাড়া নেবার জন্যে দাঁড়ানোর দরকার নেই — মাসিক বন্দোবস্তো আছে। গোবিন্দর খদ্দের এক মেয়ে ইশকুলের দিদিমণি। তাকেও অটো স্ট্যান্ডেই পৌঁছে দিতে হয়। দিদিমণির সকালে ইশকুল — অটো ধরে যেতে হয় মেট্রো স্টেশনে, তারপর পাতালরেলে চেপে ইশকুল। দিদিমণি মাঝবয়েসী, ইয়া মোটা — রিকশার প্রায় পুরো সীটটা জুড়ে বসে থাকেন। গায়ের রঙ কটকটে কালো, কিন্তু ঠোঁটে টকটকে লাল রঙ, সেই সঙ্গে সারা গায়ে সেন্টের গন্ধ। মহিলাকে টানতে গোবিন্দর ভাল মেহনত হয় — ঘন ঘন শ্বাস টানে, সেই শ্বাসের সঙ্গে টানে সেন্টের মিষ্টি গন্ধ। দিদিমণিকে নামিয়ে দিয়ে গোবিন্দ ঘুরে আসে, তারপর একটি ঘন্টা জিরোয় — তার ভেতর খদ্দের এলেও নেয় না। সেজন্যে গোবিন্দ মহিলার থেকে ভাড়াটা একটু বেশিই নেয়। মহিলার সংসারে কামাই ভাল। সোয়ামির রোজগার আছে, নিজের ইশকুলের চাকরির মাইনে আছে। তা ছাড়া সন্ধেবেলা ঐ ইশকুলেরই বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা তাদের মায়েদের হাত ধরে মহিলার বাড়ি আসে। চা খেতে খেতে একঘণ্টা করে মহিলা তাদের পড়াশোনা করিয়ে দেন। বাচ্চাদের পড়তে আসতেই হয় — কারণ ভয় আছে, পড়তে না এলে দিদিমণি যদি পরীক্ষায় তাদের পাশ নম্বর না দেন? মহিলার রোজগার তার সোয়ামির রোজগারকেও ছাপিয়ে যায়। এই কিছুদিন আগেও ওদের বাড়িটা একতলা ছিল। এখন তা সুন্দর রঙ করা দোতলা বাড়ি। পড়াশোনার ঝামেলা শেষ করে বাচ্চারা তাদের মায়েদের হাত ধরে ফেরৎ চলে গেলে পর সোয়ামি আর ইস্তিরি দোতলার ছাদে চেয়ারে বসে আরেক বার চা খায়, তার সঙ্গে প্রায় দিনই কলকাতার দামি দোকান থেকে কিনে আনা মশলা দোসা অথবা ভেজিটেবিল চপ। হারা এসব জানে কারণ লক্ষীমণি ও বাড়িতে রান্নার কাজ করে, আর বাড়ি ফিরে ও বাড়ির গল্প করে। মোট কথা, দিদিমণির বাড়ি কাঁচা টাকা আসে হৈ হৈ করে। সেজন্যে রিকশার ভাড়া একটু বেশি দিতে মহিলার অসুবিধে বা আপত্তি, কোনটাই হয় না।
হারা বাড়িতে চা মুড়ি খেয়ে এসেছে। কিন্তু তবুও ঐ চায়ের দোকান থেকে চা নিল। সবাই নেয়, ওকেও নিতে হবে। তাছাড়া সকালে এই চা নেয়াটা তো ঠিক চা খাওয়ার জন্যে নয়। ছোট একটা খুরির চা, দু তিন চুমুকেই শেষ হয়ে যায়। ওটা নেয়া আসলে আড্ডা মারার জন্যে। আর ওদের কাউকে দোকানে গিয়ে চা চাইতেও হয় না। ওরা এখানে এসে বসলেই হাতে খুরিভর্তি চা নিয়ে সামনে হাজির হয়ে যায় দোকানের কাজের বাচ্চা ছেলেটা। ছেলেটা এখানেই থাকে, রাতে দোকানের ভেতরে শোয়। ওর বাপ নিজে এসে ওকে এখানে রেখে গিয়েছে। ওর মা বাপ দেশে ওদের গাঁয়ে থাকে, ফি বছর একটা করে বাচ্চার জন্ম দেয়। একটু বড় হলেই ওদের বাপ ওদের বেড়াল বাচ্চা পার করার মত কোথাও একটা পাচার করে দেয়। ন-দশ বছরের ছেলে — দোকানের মালিকটা ওকে দিনরাত খাটায়। কোন মাইনেপত্তর নেই, খালি দুবেলা দুটো খাওয়া। অবশ্য বাচ্চাদের এরকমভাবে কাজ করানোর বিরুদ্ধে আইন আছে। তা থাক। বাচ্চাটার বাপ আর এই দোকানদার, কেউ-ই ঐ আইন নিয়ে মাথা ঘামায় না।
হারা হাতে চায়ের খুরি নিয়ে গোবিন্দর পাশে বসল। ওরা সবাই ঘড়ি পরে আছে ঠিকই, কিন্তু ওসব সস্তার ঘড়ি। এত দামি ঘড়ি কারোর নেই। গোবিন্দর দিকে হারা হাতটা বাড়িয়ে ধরল — এই দ্যাখ্, নতুন ঘড়ি।
একটা উগ্র সেন্টের গন্ধের ঝাপটা এল। গোবিন্দর ইস্কুলের দিদিমণি এসে গেছে। এক ঝটকায় হারার হাতটা সরিয়ে দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল গোবিন্দ, তারপর প্রায় দৌড়ে চলে গেল নিজের গাড়ির কাছে। ওর গাড়ি একটু পেছনের দিকে লাগানো আছে। ততক্ষণে দিদিমণি নিজের ডান পা ওর গাড়ির পাটাতনে তুলে দিয়ে দু হাতে সীটটা ধরে অন্য পাটাও ওপরে তোলার চেষ্টা করছিলেন। গোবিন্দর গাড়িটা ওনার চেনা, ওটার পাটাতনে একরকম রঙচঙে চিত্র বিচিত্র করা আছে। যখন গোবিন্দ নিজের গাড়ির কাছে পৌঁছেছে ততক্ষণে তিনি নিজেকে টেনে হিঁচড়ে সীটের ওপর তুলে নিয়েছেন। গোবিন্দর রিকশার ভেঁপু দু বার প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ করল, তারপর গোবিন্দ পেডাল চালিয়ে ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল।
উবু হয়ে বসে বসেই এগিয়ে এল নিতাই। গোবিন্দর জায়গাটা নিল। হারাকে বলল, দেখি, কিরকম ঘড়ি। বলে হারার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিল, ঘড়িটা নিজের চোখের কাছে ধরল।
হারার হাতটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঘড়িটা দেখল নিতাই। দেখতে দেখতে ওর মুখটা কালো হয়ে গেল, ফোঁস করে ওর একটা নি:শ্বাস পড়ল। হারা বুঝল, নিতাই এর খুব হিংসে হয়েছে। আর সেটা বুঝেই ভেতরে ভেতরে বড় আরাম পেল হারা। আমার একটা জিনিষ আছে, তোমার সেটা নেই, আমার সেই জিনিষটা দেখে তোমার বুকের ভেতর জ্বলন হবে, তবেই না আমার বড় আনন্দ, বড় সুখ।
হারা মাথা নাড়ল। বলল, কিনিনি। শাউড়ি দিয়েছে। জামাইষষ্ঠীতে।
এটাও একটা আনন্দের ব্যাপার। আমার শাউড়ি আমাকে দামি জিনিষ দেয়, কত খাতির করে। তোদের শাউড়ি জিনিষও দেয় না, খাতিরও করে না।
তোর শাউড়ি ভাগ্য ভাল, সেরকম কিছু একটা নিতাই বলতে যাচ্ছিল। বলা হল না — ও চট করে উঠে দাঁড়াল। ও দেখতে পেয়েছে। উত্তেজিত ভাবে বলল, সেই ছেলেটা আসছে। সঙ্গে ওর কুকুর।
নিতাই ওর রিকশার পাটাতন থেকে ছোট একটা কাঠের ডান্ডা তুলে নিল। বলল, ছোকরা কদিন ধরে আমাদের রিকশা স্ট্যান্ডের ঠিক সামনেই ওর কুকুরকে পায়খানা করাচ্ছে। আজ শালার কুকুরকে হাগানো বার করে দিচ্ছি।
ছেলেটা কুকুর নিয়ে কাছে এল। ওর ডান হাতে ধরা কুকুরের গলায় লাগানো চেন। কুকুরটা চেহারায় বড় সড়, কিন্তু দেখতে বেশ শান্ত, শিষ্ট, নিরীহ। ছেলেটা সবে কুকুরকে দাঁড় করাতে যাবে। সামনে চার পাঁচটা মারমুখো লোককে দেখে হকচকিয়ে এল। নিতাই বলল, ছোকরা এখানে যে তোমার কুকুরকে হাগাচ্ছ — এটা কি তার জায়গা?
ছেলেটার বয়েস বেশি নয়, এই উনিশ কুড়ি হবে। বিলক্ষণ ভয় পেয়েছে — মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একটু আমতা আমতা করে বলল, কুকুরকে রাস্তায় নিয়ে এসেছি তো। আর কোথায় নিয়ে যাব?
নিতাই খিঁচিয়ে উঠল, গোল্লায় নিয়ে যাবে — তোমাদের শোবার খাটে কুত্তাকে হাগাবে। নিয়ে যাও তোমার কুত্তা এখান থেকে। তারপর হাতের ডাণ্ডা দেখিয়ে বলল, ফের যদি তোমার কুত্তা নিয়ে এখানে আসবে তাহলে তোমার কুত্তার মাথা ভাঙব, তোমারও মাথা ভাঙব। মনে থাকে যেন।
ছেলেটা আর কথা বাড়াল না। কুকুর নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে ফিরে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে নিতাই আবার বলল, শালা মজাকি পেয়ে গেছে। ডান্ডা না দেখালে এসব লোক সোজা হয় না।
সত্যিই কিন্তু তারপর ছেলেটা কুকুর নিয়ে আর এল না। নিতাই বলল, আর আসবে? যা কড়কে দিয়েছি। হুঁ হুঁ, লাঠির নাম বাবাজি।
তবে ঐ কম্ম করাবার জন্যে কুকুরকে নিজেদের শোবার খাটে না তুললেও কুকুর-পোষা অনেক বাড়ির লোকই তার কাছাকাছি যায়। এই কিছুদিন আগে হারা তার এক বন্ধুকে পেটে ব্যথার জন্যে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল খালের ওপারে এক ডাক্তারবাবুর কাছে — যা কিছু ভাল সবই তো খালের ওপারে। ডাক্তারবাবুর খুব পশার — তাছাড়াও খুব আমুদে লোক। রোগীর সঙ্গে এমন মজা করে কথা বলেন যে চিকিৎসা শুরুর আগেই রোগীর আদ্ধেক অসুখ সেরে যায়। হারাকে ভালই চেনেন — রোগেভোগে, পেটখারাপে, জ্বরে হারা ঐ ডাক্তারবাবুর কাছেই যায়। হারার বন্ধুর পালা আসার আগে ওদের ডাক পড়েছিল ভেতরের ছোট ঘরটায় — ডাক্তারবাবু যেখানে রোগীকে লম্বা, সরু একটা টেবিলে শুইয়ে তার পেট, বুক এসব পরীক্ষা করেন। যে রোগীটা ভেতরে ছিল তাকে ডাক্তারবাবু একটা সুঁই ফুঁড়ে দিলেন, তারপর কাগজে ওষুধপত্তর লিখে তার হাতে ধরিয়ে দিলেন। লোকটা কাগজ হাতে গোমড়া মুখে বাইরে বেরিয়ে গেল। পরীক্ষা-ঘরের ঠিক বাইরে চেয়ার টেবিল পেতে ডাক্তারবাবুর একজন সহকারি এবং কর্মচারি বসে আছে — টাকা পয়সা সব তার কাছে দিতে হবে। ডাক্তারবাবু হারার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যে হারাধন — রোগী কে? তুমি না সঙ্গের লোক? হারা উত্তর দেবার আগেই বললেন, ঐ যে লোকটা গেল তাকে কুকুরে কামড়েছে, বুঝলে। একটা এটি এস দিয়ে সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম।
হারা বুঝল — সেখানে লোকটাকে পাঁচ দিন ধরে বড় বড় সুঁই ফুঁড়বে, তাই ওর মুখ অত গোমড়া। বন্ধুকে দেখিয়ে মুখে বলল, ডাক্তারবাবু, এ আমার বন্ধু। পেটে ব্যথা হচ্ছে, তাই আপনার কাছে নিয়ে এলাম।
ডাক্তারবাবু হাতের ইশারায় ওর বন্ধুকে টেবিলের ওপর শুয়ে পড়তে বললেন। তারপর হারাকেই আবার বললেন, কুকুর টুকুরের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা ভাল নয়, বুঝলে। তাতে বিপদ হতে পারে।
ডাক্তারবাবু তার পরেই একটা মজার ঘটনা বললেন।
অনেক বছর আগে তিনি একটা বাড়িতে রোগী দেখতে গিয়েছিলেন। সে বাড়িতে একটা বেশ বড় গোছের কুকুর ছিল। খাটের ওপর রোগী শোয়া, ডাক্তারবাবু পাশে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে রোগীকে পরীক্ষা করছেন। হঠাৎ টের পেলেন তার দুই কাঁধে দুই থাবা রেখে কুকুরটি ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে উঠেছে। প্রাণীটির নি:শ্বাস তার মাথার পেছনে পড়ছে, সেটির লকলকে জিভ তার ঘাড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
ডাক্তারবাবু নড়তে পারছেন না, ঘাড় ঘোরাতে পারছেন না। পেছনের জীবটি যদি আদর করে ঘাড় কামড়ে ধরে তাহলে আর দেখতে হবে না — যেতে হবে ভবনদীর ওপারে। সেই কাঠপুতুল অবস্থাতেই বাড়ির লোককে উদ্দেশ্য করে বললেন, কুকুরটাকে সরান।
পেছন থেকে একটি তরুণীর গলার করুণ আবেদন শুনতে পেলেন, ওকে কুকুর বলবেন না।
ডাক্তারবাবু আবার বললেন, মানুষটাকে সরান।
তখন সেই কুকুরের দেহধারী মানুষটিকে ডাক্তারবাবুর কাঁধের ওপর থেকে সরানো হল। ডাক্তারবাবু রোগী পরীক্ষা করার সুযোগ পেলেন।
গল্প শেষ করে ডাক্তারবাবু হারার বন্ধুর পেট টিপতে শুরু করলেন। আর তার পেট টিপতে টিপতেই হারাকে আবার বললেন, কুকুরের বেশি কাছে যাবে না, বুঝলে হারাধন। কামড়ে দিলে একগাদা ইঞ্জেকশন।
ঠিক কথা। লাই দিলে কুকুর মাথায় ওঠে — কথাটা তো আর মিথ্যে নয়। অন্তত: কাঁধে তো চাপেই।
বাড়ির সদর দরজা খুলে কয়েকজন কাজের লোক দেখা দিল। সবার আগে একটা তের চোদ্দ বছরের মেয়ে — এক হাতে একটা বড় কেটলি, অন্য হাতে ধরে আছে দশ বারোটা ছোট্ট ছোট্ট পেলাস্টিকের গেলাস, একটার ভেতর আর একটা ঢোকানো। তার পেছনে দুটো মাঝবয়েসী মেয়েছেলে। একজনের এক হাতে লুচির ঝোড়া, আর অন্য হাতে একগাদা শালপাতার থালা — একটার মধ্যে আর একটা বসানো। শেষের জনের হাতে আলুর দমের বালতি আর একটা হাতা। চট করে ওর হাতঘড়ি একবার দেখে নিল হারা। আজ এরা অনেক দেরী করেছে, সাড়ে নটা পার করে দিয়েছে।
পটাপট করে ওরা খাবার দিয়ে গেল। অল্পবয়েসী মেয়েটা একটা করে গেলাস এক একজনের সামনে বসিয়ে দেয় আর তাতে চা ঢেলে দেয়। পরের জন একটা করে থালা মাটিতে রাখে আর তাতে ঝোড়ার থেকে লুচি ফেলে দেয়। শেষের জন বালতিতে হাতা ডুবিয়ে আলু আর ঝোল তুলে আনে, সেটা খেতে বসা লোকটার পাতে ঢেলে দেয়। আজ চা-টা দিয়েছে একেবারে ঠাণ্ডা, একটুও ধোঁয়া উঠছে না তার থেকে। পরিমাণেও খুব কম — ওদের রিকশা স্ট্যান্ডের চায়ের দোকান তিন টাকায় যতটুকু দেয় তার বেশি নয়। লুচিগুলো ঠান্ডা, মিইয়ে গেছে — তায় দিয়েছে মোটে চারখানা লুচি। আলুর দমও দিয়েছে কিপটের মত। খালি দু টুকরো আলু আর অল্প একটু ঝোল। বাড়ির ছোটগিন্নী আজ নিশ্চয়ই অন্য কাজে ব্যস্ত — সেজন্যে হারা আর কীর্তনের দলকে খাওয়ানোর ব্যাপারটায় এরকম ঢিলে পড়েছে। যে মেয়েমানুষটা লুচি দিচ্ছিল সে হারাকে দিয়ে কীর্তনের দলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল — হারা তাকে ডেকে বলল, শুনছ গো মাসি, আমাকে আর দুখানা লুচি দিয়ে যাও।
মেয়েমানুষটা মাসি ডাক শুনে ভুলল না। খ্যার খ্যার করে উঠল, যা দিয়েছি তাই খাও। ভূত খাওয়ানোর জন্যে এর চেয়ে বেশি খাবার খরচা করা যাবে না।
এ কথার পর হারার আর কিছু খাবার চেয়ে নেবার প্রশ্নই ওঠে না। ছোট মেয়েটা চটপটে — সবাইকে চা দেয়া শেষ করা হারার সামনে দিয়ে ফেরৎ চলে যাচ্ছিল। হারা ওকে ডেকে বলল, বাড়ির ছোট গিন্নীমা আজ নেই বুঝি?
ছোটমার জ্বর এসেছে, মেয়েটা বলল। ওষুধ খেয়ে শুয়ে আছে। ওকে এক ধমক লাগাল লুচি দেওয়া খ্যার খ্যারে মেয়েছেলেটা। বলল, যা যা, তোর এখানে দাঁড়িয়ে সবাইকে বাড়ির ভেতরের খবর দিতে হবে না। তোর আর কাজ নেই? তাড়াতাড়ি যা, সে সব শেষ কর।
ধমক খেয়ে মেয়েটা আর দাঁড়াল না, দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল। পাতের ঠান্ডা লুচিতে হাত লাগিয়ে তা ছিঁড়তে লাগল হারা। যা পাওয়া গেছে তা-ই খেতে হবে। উপায় কি? ?
খাওয়া শেষ করে হারা গেলাস আর শালপাতার থালা হাতে নিয়ে উঠে পড়ল। থালাটা মুড়ে ছোট করে নিয়েছে। টিউকলটার থেকে একটু দূরে একটা বড় ময়লা ফেলার ড্রাম রাখা রয়েছে, তাতে থালা গেলাস ফেলে দিল। ড্রামটা একেবারে ভরতি হয়ে গেছে, কাল থেকে যা ভেতরে পড়েছে তা আর পরিষ্কার হয় নি। দুপুরে খাওয়ার আগে যদি পরিষ্কার না হয় তা হলে ময়লা ফেলা মুস্কিল হবে, সব উপচে পড়বে ওটার থেকে। যাক্ সে তখন দেখা যাবে। হারা টিউকলে হাত মুখ ধুয়ে নিল। ক্ষিদেটা পুরোপুরি যায় নি মনে হচ্ছে— যা কম কম খাবার দিয়েছে আজ। কাজের লোকগুলো সব খচ্চর। নিশ্চয়ই নিজেরা গরম গরম লুচি গান্ডেপিন্ডে গিলে সব ঝড়তি পড়তি হারা আর হরে কিষ্ণ-র দলের জন্যে নিয়ে এসেছে। যাক, বিনে পয়সায় খাওয়া, সেজন্যে দু:খ রেখে লাভ নেই। দুপুরের খাওয়াটা খেয়েই হারা ওর টোটো নিয়ে কেটে পড়বে। টোটোর ভাড়াটা ওরা অগ্রিম দিয়ে দিয়েছে।
টোটোর কথা মনে পড়তে হারা ওটার দিকে তাকাল। আহা, ঠায় রোদের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। মাস ছয়েকের কাছাকাছি হল হারা ওটা কিনেছে, এখনও নতুনের মত চকচকে ঝকঝকে। হারা নিজের হাতে ওটাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে রাখে।
গত বর্ষায় বিষ্টিতে ভিজে হারা একটু সর্দিকাশিতে ভুগেছিল। সাইকেল রিকশা চালাতে গেলে বিষ্টিতে ভিজতেই হয়। বিষ্টি যখন পড়ছে তখন ভাড়া ধরলে বেশি ভাড়া পাওয়া যায়। তখন সবে রাস্তায় টোটো বেরিয়েছে, মাঝে মাঝে একটা দুটো দেখা যাচ্ছে। দেখেই হারার ভাল লেগে গিয়েছিল। পেডাল করার ঝামেলা নেই, ব্যাটারিতে চলে, ব্যাটারিতে সামনের আলো জ্বলে, পেছনে জ্বলে ছোট ছোট চোখের মত দুটো লাল আলো। অবশ্য তিন চাকার অটোরিকশা অনেক বেশি মজবুত। গ্যাস ইঞ্জিনে চলে, দৌড়তেও পারে অনেক তাড়াতাড়ি। কিন্তু একটা অটো রাস্তায় বার করতে অনেক ঝামেলা। প্রথম কথাই হচ্ছে দাম অনেক বেশি। তার ওপর আছে হাজারটা ফ্যাকড়া। সরকারি আপিসে রেজিস্টারি করো, নম্বর প্লেট লাগাও, নিজের জন্যে চালাবার লাইসেন নাও। তার পরে ইউনিয়নে নাম লেখাও। সব জায়গায় টাকা ঢালো। তাছাড়া অটো চলে বড় রাস্তায়, সেখানে পুলিস আছে — লাল সিগন্যাল ভেঙ্গে অটো চালিয়েছো তো সাথে সাথে খপ করে ধরবে। আর সেরকম হল মানেই তো ফেঁসে গেছো। তার চাইতে টোটো অনেক ভাল — অটোর ঝামেলাগুলো নেই। তবে টোটো রেজিস্টারি করার একটা কথাবার্তা চলছে বটে। তা সেরকম যদি হয়ই তাহলে তখন দেখা যাবে। সব খোঁজখবর নিয়েছিল হারা। কিন্তু দামের কথা শুনে ওর মাথায় হাত। কোম্পানির মাল, ভাল জিনিষ হবে ঠিকই, কিন্তু দাম এক লাখের ওপর পড়বে। ব্যাঙ্কে গেলে অবশ্য টাকা ধার দেবে। তবে ফ্যাচাং হচ্ছে শোধ দেয়া। মাসে মাসে তিন চার হাজার করে শোধ দিতে হবে। আর এক মাস টাকা দিতে না পারলে টোটো তুলে নিয়ে যাবে, নিলামে অন্য কাউকে বিক্রী করে দেবে, অতগুলো টাকা কি মাসে মাসে দিতে পারবে হারা?
হারার কাছাকাছি থাকে পানু, প্রতিবেশীই বলা যায়। হারার ঠিক বন্ধু নয়, কিন্তু ভাল চেনাজানা। আগে সাইকেল রিকশা চালাত, এখন একটা টোটো কিনে চালায়। ও একটা বুদ্ধি দিল। বলল, ও সব কোম্পানির মাল ফালের পেছনে যাস না, সাধন মিস্তিরির কাছে যা। ও জোড়াতাড়া দিয়ে টোটো বানিয়ে দেয়। কোম্পানির মালের মত অত চকচকে ঝকঝকে হয় না, কিন্তু কাজ চলার মত গাড়ি হয়। আর দেখতেও খুব একটা খারাপ হয় না। অনেক সস্তায় ও টোটো বানিয়ে দেবে — প্রায় আদ্ধেক দামে পেয়ে যাবি। ও তো তোর চেনা লোক। চলে যা ওর কাছে। কথা বলে দ্যাখ ওর সঙ্গে।
সাধনের কারখানা পিচ রাস্তার ধারে, কয়েক গজ জমি ছেড়ে। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে কারখানা। তিন দিকে টিনের দেয়াল, মাথার ওপরেও টিন। গরমকালে ভেতরটা একেবারে উনুনের গণগণে আগুন। তা গরম ঠান্ডা ও সব সাধনের গায়ে লাগে না, বারোমাস ওখানে থেকে সবই অভ্যেস হয়ে গেছে। ভেতরের জমি তেল কালিতে পেছল, অভ্যেস না থাকলে পা টিপে টিপে হাঁটতে হয়। আগে সাধন চার চাকা গাড়ি সারাই-এর কাজ করত। এখন আর করে না। ওতে হ্যাপা অনেক, খাটুনির তুলনায় লাভ অনেক কম। তার চেয়ে ভাল মোটর বাইকের কাজ করা। তাতে কাজ কম, তুলনামূলকভাবে কামাই বেশি। আজকাল দুচাকার ঐ গাড়ি মেরামতির জন্যে প্রচুর আসছে। এখন রামা শ্যামা কে না দুচাকার গাড়ি চালায়? তার ওপর সব পার্টির কেডাররাই তো দু চাকার গাড়ি চড়ে চক্কর দেয়। সবাই সাধনের কাছে আসে ছোট বড় সবরকম মেরামতির জন্যে। প্রথমদিকে পার্টির কয়েকটা ছেলে শুরু করেছিল গাড়ি সারিয়ে নিয়ে পয়সা না দেয়া। তা আধা নেতা গোছের লোকেরাও তো তাদের বাইক নিয়ে আসে সাধনের কাছে। সাধন একটু কায়দা করে ঐ টাকা না দেয়ার ব্যাপারটা তাদের কানে তুলে দেয়। তার পরে পরেই ছেলেগুলো নিজেরা এসে সাধনকে টাকা দিয়ে গিয়েছিল। ছেলেগুলো এখনও আসে — খাতির করে সাধনদা বলে ডাকে।
আর যে ব্যবসাটা এখন সাধন ধরেছে সেটা হল টোটো তৈরী করা। কিছুদিন ধরে অনেকে সাইকেল রিকশা চালানো ছেড়ে দিয়ে টোটো চালানো ধরেছে। এদিককার রাস্তাগুলো ছোট বড় গর্তে ভর্তি — ঐ গর্ত ভরা রাস্তায় রিকশা চালানো কঠিন কাজ। তাছাড়া যদি সোয়ারি একজনের বদলে দুজন পুষ্ট গতরের লোক বা মেয়েছেলে হয় তাহলে তাদের টানতেও জিভ বেরিয়ে পড়ে। রোগা দুবলা গোছের রিকশাওয়ালা হলে এই কাজ করতে গিয়ে ক্ষয়রোগও ধরে যেতে পারে। টোটোতে পরিশ্রমটা একেবারেই নেই — পেছনের দুটো সীটে রোগা, মোটা যে-ই বসুক, ছ জন সোয়ারি দিব্যি টেনে দেবে। সামনে বসে রাজার মত মেজাজে তুমি খালি দু হাতে দুটো হ্যান্ডেল ধরে থাকো — এমন কি ঠোঁটে একটা বিড়িও ধরে রাখতে পারো।
হারা যখন সাধনের কারখানায় পৌঁছল তখন সন্ধে হয়ে গেছে। একটু দেরি হলেও অবশ্য ক্ষতি নেই, অনেক রাত পর্যন্ত সাধন ওর কারখানায় কাজ করে। রাস্তার ইলেকট্রিক লাইন থেকে চুরি করে একটা লাইন নিজের কারখানায় নিয়ে নিয়েছে। একটা এল ই ডি আলো লাগিয়েছে — তাতে আলো প্রচুর, প্রায় দিন করে দেয় কারখানার পুরো জায়গাটাকে। পিচ রাস্তার ধার থেকে ওর কারখানা পর্যন্ত জমিটুকুও সাধনেরই দখলে। সেখানে ওর নানা জিনিষপত্র, সারাই-এর জন্যে রেখে যাওয়া আপাতত: অকেজো দু চাকার গাড়ি — এসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। সাধন পাংচার হাওয়া টায়ারও মেরামত করে দেয়। হারা যখন ওখানে পৌঁছল তখন কাজ পুরোদমে চলছে। সাধনের সহকারি একটা ছেলে একটা গাড়ির চাকার থেকে তার রবার টিউবটা বার করে ফেলেছে, সেটাকে এক টব জলের মধ্যে ডুবিয়ে পরীক্ষা করে দেখছে টিউবটার ফুটো হয়েছে ঠিক কোথায় কোথায়। একটা অকেজো স্কুটার কাৎ হয়ে পক্ষাঘাতের রুগীর মত ভূঁই-এ শুয়ে আছে — সময়মত সাধন ওটার দুটো চাকা আর হ্যান্ডেল খুলে নিয়ে ওর তৈরী কোন টোটোতে লাগিয়ে দেবে। একটা অটোও আছে — একটা চাকা খোলা, দু চাকায় ভর করে চাকা-খোলা দিকটায় একটু পেছনে হেলে দাঁড়িয়ে আছে — ঠিক যেন একটা বাঁকা হয়ে দাঁড়ানো মাজা ভাঙা বুড়ো মানুষ।
হারা টিনের চালের ভেতর ঢুকল। দাঁড়ানোর বিশেষ জায়গা নেই — সবটা জায়গা জুড়ে সব দু চাকার বাইক এদিকে ওদিকে দাঁড় করানো বা শোয়ানো। ওগুলোর ভেতর দিয়ে পথ করে এঁকে বেঁকে হারা এগোল। একদম ভেতরে সাধন কাজ করছে, সাহায্য করছে আর একটা সহকারি ছেলে — সেখানে এসে দাঁড়াল। দাঁড়াল, কারণ বসবার কিছু নেই। সাধন উবু হয়ে বসে একটা আধা তৈরী টোটোতে চলবার মেশিন লাগিয়ে মন দিয়ে ইসকুরুপ আঁটছিল, মুখ তুলে তাকাল না। ইসকুরুপ ঢিলে থাকলে সব গোলমাল হয়ে যাবে। টোটো চলতে চলতে হঠাৎ থেমে পড়বে, আর তখন টোটোর মালিক এসে সাধনকে গালাগাল করবে। সব কটা ইসকুরুপ আর বোল্ট-এ টাইট দিল সাধন। হারা অপেক্ষা করে রইল। টাইট দেয়া শেষ করে হাতের যন্তরগুলো সহকারি ছেলেটার দিকে ছুঁড়ে দিল সাধন। ছেলেটা ক্রিকেটের ক্যাচ ধরার কায়দায় ওগুলো লুফে নিল। তখন হারা বলল, সাধনদা, তোমার সঙ্গে একটা দরকার আছে।
সাধন উঠে দাঁড়িয়ে খুব মন দিয়ে নিজের হাতের কাজ দেখছিল। টোটোটার খালি পাটাতনটা হয়েছে, বাকি বডিটা তৈরী করতে হবে। হারার কথা কানে যেতে ওর দিকে ঘুরে মুখোমুখি দাঁড়াল। কথা না বলে মুখের আর চোখের একটা ভঙ্গী করে দু হাত উল্টে জিগ্যেস করল, কি দরকার? ওর জামা, পেন্টুল তেল কালিতে চিটচিটে নোংরা, দু-হাতও তাই। এক কোণে একটা বোতলে খানিকটা কেরাসিন তেল রাখা আছে। কাজ শেষ করে বাড়ি যাবার আগে ঐ তেলে ন্যাকড়া ভিজিয়ে ঘষে ঘষে হাত পা পরিস্কার করে নেবে, তারপর পরিষ্কার জামা প্যান্ট পরে বাড়ি যাবে। গ্যারাজের পেছনের টিনটায় লাগানো কতগুলো লম্বা লম্বা পেরেকে ওর পরিষ্কার জামা প্যান্ট ঝোলানো রয়েছে।
আমি টোটো চালাব ঠিক করেছি, একটু কাঁচুমাচু হয়ে হারা বলল। আমাকে একটা বানিয়ে দাও।
সাধন একটা শুয়ে থাকা বাইকের দিকে এগিয়ে গেল। হারার দিকে পেছন ফিরে ওটাকে তুলে দাঁড় করাতে করাতে নিষ্পৃহভাবে একটা উত্তর ছুঁড়ে দিল, হয়ে যাবে। বানাতে লাগবে দিন দশেক। খরচা পড়বে পঁচাত্তর। ক্যাশ দিতে হবে। চল্লিশ অ্যাডভানস। জিনিষপত্তর কেনার খরচা আছে।
খরচার বহর শুনে হারার মুখ শুকিয়ে গেল। ভাবল একটু দরাদরি করবে কিনা। আবার ঠিক সাহসও হচ্ছে না দর করতে — সাধন মেজাজি লোক, তার ওপর ওর এসব কাজে ভাল রোজগার — হারার মত চুনোপুঁটি দর করলে যদি ওকে একদম ভাগিয়ে দেয়? তবুও খুব মিনতি করে বলল, খরচা একটু কম কর না সাধনদা? পঞ্চাশে করে দিতে পারবে না?
সাধন ততক্ষণে বাইকটা তুলে ফেলে ওটাকে স্ট্যান্ডে দিয়েছে — ওটার বিভিন্ন কোনা ঘুপচিতে উঁকি মেরে, টর্চ ফেলে দেখছে। হারার কথা শুনে ওর দিকে ফিরল। বলল, পঞ্চাশ? মজাকি করছিস আমার সঙ্গে? আচ্ছা ঠিক আছে, লাস্ট কথা — পঁয়ষট্টি। তবে সামনের চাকাটাই খালি বাইকের হবে, পেছনের দুটো সাইকেলের। আগে চল্লিশ নিয়ে আসবি, তখন কাজে হাত দেব, দশ দিন পরে আবার আসবি, বাকি পঁচিশ দিয়ে ডেলিভারি নিবি। ও টাকাটা না দিলে টোটো হাতে পাবি না। এবার যা, আমার অনেক কাজ আছে।
আবার বাইকটার ওপর ঝুঁকে পড়ল সাধন। এবারে হাতে রেঞ্চ। সহকারি ছেলেটা টর্চ জ্বেলে বাইকের একটা জায়গায় আলো ফেলে সেখানে আলো ধরে রইল, সাধন সেখানে রেঞ্চ লাগিয়ে দু হাতে ধরে মোচড় দিল।
চালার নিচের থেকে বেরিয়ে এল হারা। সাধনের অন্য সহকারি ছেলেটা ততক্ষণে রবার টিউবের ফুটোগুলো কোথায় তা বার করে ফেলেছে। বেশ তিন চারটে ফুটো — গাড়ি নিশ্চয়ই পেরেক টেরেক ওসব কিছুর ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল। যত্ন করে ফুটোগুলোতে তাপ্পি লাগাচ্ছে ছেলেটা। এরপর ও ফাঁপা টায়ারটার ভেতর ন্যাতানো টিউবটা ঠুসে ঠুসে ভরবে। তারপর সেই টিউবে হাওয়া পাম্প করে ফুলিয়ে তুলবে — আর টায়ারটাও লোহার মত শক্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু সে সব দেখার জন্যে হারা আর সেখানে দাঁড়াল না। মনটা খারাপ হয়ে গেছে। পঁয়ষট্টি কোথা থেকে আসবে? সাধনের তৈরী টোটোর জন্যে ব্যাঙ্ক ধার দেবে না। তার ওপর টাকাটা দিতে হবে ক্যাশে। ওদের পাড়ার জিতু ঘোষ টাকা ধার দেয়, হারার সঙ্গী অনেক সাইকেল রিকশাওয়ালা ওর থেকে টাকা কর্জ নেয়। কিন্তু শালা মহা হারামি — একশ টাকায় মাসে দশ টাকা সুদ নেয়। ওর থেকে এতগুলো টাকা ধার নিলে এ জন্মে ধার শোধ হওয়ার আশা নেই। ওকে টাকা ফেরৎ না দিয়ে যে কেটে পড়বে সে-ও হবার নয়। শালা বেশ কিছু গুন্ডা ছেলেকে টাকা দিয়ে হাত করে রেখেছে — ওরা একদিন রাস্তায় ধরে রামধোলাই দেবে, তারপর গাড়ি তুলে নিয়ে যাবে। ব্যাজার মুখে বাড়ির দিকে হেঁটে চলল হারা। সাধনের কাছে ও হেঁটেই এসেছে, ওর সাইকেল রিকশা সঙ্গে আনে নি।
হারা যখন বাড়ি ফিরল তখন সন্ধে ঘন হয়েছে। বাতাসি এখনও বাড়ি আসে নি, নিশ্চয়ই কোন একটা কাজের বাড়িতে আছে। ও জিরিয়ে জিরিয়ে আস্তে আস্তে কাজ করে, ওর কাজ শেষ করতে দেরি হয়। তাছাড়া বাতাসিটা লোভী আছে। কাজের বাড়িতে বিকেলে কোন জলখাবার তৈরী হলে ইচ্ছে করে সে বাড়ির কাজে দেরি করতে থাকে — জানে, বাড়ির গিন্নী ওকেও একটু খেতে দেবে ঐ জলখাবার থেকে। আর কাজের বাড়িতে চা-তো খাবেই। কাজ শেষ হয়ে গেলেও গিন্নীমার সঙ্গে এটা সেটা আল ফাল গল্প করতে থাকে। খানিক পরে গিন্নীমা চা দেয় আর সেই সঙ্গে দুটো বিস্কুট। সে সব খাওয়া শেষ করে তবে বাতাসি ঐ বাড়ি থেকে বেরোয়।
আজ বেষ্পতিবার, শাউড়ি সন্ধে হতে না হতেই বাড়ি ফিরে এসেছে। অনেকক্ষণ ধরে পুজো করেছে, তারপর ঘরে ঘরে জ্বলন্ত পিদ্দীম দেখাচ্ছে। অবশ্যি ঘর তো মোটে দুটো, এক একটাতে মালতি আর বাতাসী তাদের নিজের নিজের সোয়ামিকে নিয়ে রাতে শোয়। শাউড়ি নিজে শোয় রান্নাঘরে। নিজের বাড়িতে বুড়ির বেশিক্ষণ বা বেশি আরামে ঘুমোনর দরকার হয় না। যে সব ফেলাটে কাজ করে সে সব জায়গায় এসি চালিয়ে বেশ কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে নেয়। বুড়ি এসি চালাতে শিখে নিয়েছে — সে সব ফেলাটের গিন্নীরাই হাতে ধরে সব দেখিয়ে শিখিয়ে দিয়েছে। শাউড়ি হাতে পিদ্দীম ধরে বিড়বিড় করে কি সব জপ করতে করতে এঘর ওঘর করছিল, তা দেখতে দেখতে হারা মনে মনে গাল দিল, শালা, পুজো করে আর ঘরে পিদ্দীম দেখিয়ে হবে কচু — ওতে করে কি আর আমার টোটোর টাকা আসবে?
হারা নিজের বিছানায় উবু হয়ে বসে হাত দিয়ে নিজের দুটো পা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। শাউড়ির কথার উত্তরে একটা ছোট, শুকনো হাসি হাসল। বলল, না, না ওসব কিছু হয় নি। ভালই আছি।
লক্ষীমণির বিশ্বাস হল না। বলল, তবে ওভাবে বসে আছ কেন? দেখি — গা দেখি।
হাতের পাতা হারার কপালে আর বুকে লাগিয়ে দেখল লক্ষীমণি। বলল, না: গরম হয় নি। তারপর পায়ের দিকে হাত বাড়াল — দেখবে পায়ের পাতা ঠাণ্ডা কিনা।
হারা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। ঘরে এসে ইস্তক পা ভাল করে ধোয়া হয় নি। হেঁটে সাধনের কারখানায় গেছে এসেছে — পা দুটো ভাল করে না ধুয়ে একটু নোংরা নোংরা লাগছে। লক্ষীমণির হারার পা নোংরা কিনা তা নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই। পায়ের পাতা দুটো দুহাতে বেশ করে চেপে ধরে দেখল। বলল, না: ঠিক আছে। তাহলে বোধহয় তোমার খিদে পেয়েছে। দাঁড়াও, খেতে দিচ্ছি তোমাকে।
পাঁচ মিনিটে ওর সামনে চলে এল বড় একটা অ্যালুমিনিয়ামের গেলাসে করে ধোঁয়ানো গরম চা, আর দুটো বড় সাইজের বাটি ভরতি মুড়ি আর তালের ক্ষীর। লক্ষীমণির হাতে বানানো তালক্ষীর — তার কোন জবাব নেই। খেলে আর টোটো না হওয়ার দু:খ থাকে না। চাটা খুব গরম বলে গেলাসটাও তাই — হাতে ধরা যাচ্ছে না। পকেট থেকে রুমাল বার করে গেলাসটা জড়িয়ে নিল হারা। এ বার আর রুমালের ওপর দিয়ে গেলাস ধরতে অসুবিধে নেই। চায়ে চুমুক দিতে দিতে আর মুড়ি তালক্ষীর খেতে খেতে হারা বুঝল ওর সত্যিই খিদে পেয়েছিল। ও গ্রোগ্রাসে বাটি দুটোর মুড়ি আর তালক্ষীর শেষ করে দিল।
খাবারটা খেয়ে নিয়ে শাউড়িকে হারা কথাটা বলে ফেলল। টোটো চালাতে চায়, কিন্তু টাকা নেই। কোম্পানির মালের অনেক দাম। সাধন পঁয়ষট্টিতে করে দেবে — প্রথমে চল্লিশ, তারপর পঁচিশ। নগদ দিতে হবে। এই টাকা ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া যাবে না।
লক্ষীমণি ওর মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিল। শাউড়ি যখন এত কাছে আসে তখন হারা ওর গায়ের একটা গন্ধ পায়। বেশ একটা মা, মা গন্ধ — বরাবরই এরকম পেত। বাতাসির গায়ে এই গন্ধটা নেই। হারা শুনতে পেল শাউড়ি বলছে, ওমা টোটো চালাবে, সে তো ভাল কথা। রোজগার তো অনেক বেশি হবে। আমি দেব এই টাকা। তিনদিন পরে চল্লিশ, আর দশদিন পরে বাকি পঁচিশ।
একটু থেমে চোখ বড় বড় করে আবার বলল, কিন্তু কাউকে বলবে না আমি দিয়েছি। তোমার বন্ধুদের নয়, বাতাসিকে নয় — গৌরা আর মালতিকে তো নয়-ই। কথাটা জানাজানি হলে বাড়িতে অশান্তি, ঝগড়াঝাঁটি হবে। সবাইকে বলবে কোন এক জায়গা থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়েছ — মাস মাস সুদ আসল মিলিয়ে মোটা টাকা শোধ দিতে হবে।
শাউড়িটা কি ভাল। হারার বড় ইচ্ছে হল লক্ষীমণিকে জড়িয়ে ধরে, ওর বড়সড় পেটটায় নিজের মুখটা গুঁজে দেয়। ছোটবেলায় পাড়ার ছেলেদের সাথে ডাংগুলি খেলায় জিতলে খুশি হয়ে ঘরে এসে নিজের মাকে যেরকম করত, সেরকম। মা-ও হাসত, দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরত। তবে এমন নয় যে মাকে আদর করতে গিয়ে কখনও মায়ের হাতের থাপ্পড় খেতে হয় নি। সে-ও হয়েছে বেশ অনেক সময় — মায়ের মেজাজ খারাপ থাকলে। লক্ষীমণির তো আর ওরকম মেজাজ নয়। কিন্তু হারা তো আর ছোটটি নেই — এখন রীতিমতো একটা মদ্দ যুবক। আর লক্ষীমণিও ওর শাউড়ি, যে মেয়েছেলেটার সঙ্গে ও এক বিছানায় শোয় তার মা। অবশ্য লক্ষীমণির বয়েস হয়েছে — পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের দিকে চলেছে। কিন্তু তবুও, হারা যদি ওরকম করে লোকে তো পাপ ভাববে। ওর বৌ বাতাসিটাই তো বিরাট ঝামেলা করবে, সুযোগ পেয়ে গৌরা ওকে মার লাগাবার চেষ্টা করবে — মালতিও হয়তো খ্যাংরা হাতে নিয়ে নিজের সোয়ামির সঙ্গে জুটে যাবে। কাজেই সেরকম কিছুই করল না হারা। খালি ঢিপ করে শাউড়িকে পেন্নাম করল। লক্ষীমণি দুহাতে ওর মুখটা ধরে কপালে আর মাথায় চকাস চকাস করে চুমু দিয়ে দিল।
তেরো দিন পরে সাধনের কারখানা থেকে টোটো চালিয়ে ফিরল হারা। সব যন্তরপাতি সাধন চিনিয়ে দিয়েছে। কোন্টায় স্টার্ট, কোন্টায় থামবে, স্পীড কিভাবে বাড়বে- কমবে, আলো কিভাবে জ্বলবে — সব কিছু। সাধনের কারখানার সামনে রাস্তাতেই খানিকটা চালিয়ে বেশ একটু অভ্যেস করে নিয়েছে। প্রথমে একটু অসুবিধে হচ্ছিল — একটা করতে আর একটায় হাত পড়ে যাচ্ছিল। তবে চালানোটা এর মধ্যেই খানিকটা সড়গড় হয়ে গিয়েছে, আর দু তিন দিনের মধ্যে হাত একেবারে পাকা হয়ে যাবে মনে হয়। সাধন ইমানদার লোক — ঠিক দশদিনের মাথায় টোটোর ডেলিভারি দিয়ে দিয়েছে। নিজেদের সাইকেল রিকশার স্ট্যান্ডে এসে হারা টোটো থামাল। নিতাই নিজের রিকশায় বসে মেজাজে বিড়ি টানছে। টোটো থেকে মুখ বার করে হারা নিতাইকে ডাকল, এই নিতাই, নিতাই।
নিতাই একটু চমকাল — টোটোর থেকে কে ডাকে? ওরা কেউ জানত না হারার টোটো কেনার কথা। বিড়িটাকে মুখ থেকে সরিয়ে মুখ ঘুরিয়ে পাশের দিকে তাকাল — হারা হাসিমুখে তার মাথা বার করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নিতাই ওর দিকে তাকাতে ওর মুখের হাসিটা আরও বড় হল। ও বলল, এই টোটোটা কিনলাম। এখন থেকে টোটো চালাব।
নিতাই-এর দু চোখে হিংসে আর রাগ। চেনা কারোর হঠাৎ ভাল কিছু হলে লোকের হিংসে হয় — সেটাই স্বাভাবিক। নিতাই কর্কশ গলায় বলল, কিনেছিস তো কিনেছিস — এত ফুটানি মেরে তা বলার কি আছে?
নিতাই মুখ ঘুরিয়ে নিল, বিড়ি ফোঁকায় মন দিল। হারা টোটো আবার চালু করল। ওদের ঘরের বারান্দার ঠিক বাইরে অল্প একটু জায়গা আছে। টায়েটায়ে টোটো ঢুকিয়ে রাখার মত জায়গা। সেখানে থাকলে চুরি যাবার ভয় নেই। রাতে টোটোটা সেখানে রাখবে — সেটা হারা ঠিক করে ফেলেছে।
(পরবাস-৭৩, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮)