Subscribe to Magazines



পরবাসে প্রকাশিত উপন্যাসঃ

লোকে বলে অলৌকিক
- ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত


ভিক্টর কুজুর
- কমল চক্রবর্তী


নিওলিথ স্বপ্ন
- দীপেন ভট্টাচার্য


রাতবিরেতের গজল
- ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত


মেঘের নিচে কাকতাড়ুয়া
- বাসুদেব দেব


বর্ণবাসী
- সুভাষ ঘোষাল


ধ্বংসাবশেষ
- শৈলেন সরকার


যাত্রী
- দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


সন্ধ্যাবেলা
- সাবর্নি চক্রবর্তী


অরণ্যকথা
- আইভি চট্টোপাধ্যায়


অন্য কোনখানে
- দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


আয়নার ভিতরে
- কৌশিক সেন


ফরিয়াদ
- সাবর্নি চক্রবর্তী


রাহুলের ডায়েরি থেকে
- ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত


কোথাও জীবন আছে
- শাম্ভবী ঘোষ


হারাধন টোটোওয়ালা
- সাবর্ণি চক্রবর্তী


কালসন্ধ্যা
- মিহির সেনগুপ্ত





পরবাসে মিহির সেনগুপ্ত-র
আরো লেখা

বই


ISSN 1563-8685




কালসন্ধ্যা

মার নিকট যজ্ঞাদি কর্মে ব্রাহ্মণদের উদরপূর্তির চাইতে দীন দরিদ্র প্রজাদের কল্যাণার্থে জলাধার নির্মাণ অথবা পূর্তকার্যের জন্য অর্থব্যয় অধিক প্রয়োজনীয় বোধ করতাম। ব্রাহ্মণদের যজ্ঞের ধূমে তো আর ফসল উৎপাদিত হয় না। তা হয় কৃষকের ভূমি কর্ষণে এবং তার জন্য জল তথা আনুষাঙ্গিক অনেক কিছুর প্রয়োজন আছে। অবশ্য ব্রাহ্মণেরা কৃষকদের এই কথা বলে তঞ্চকতা করে যে, যজ্ঞাদি না করলে মেঘের সঞ্চার হয় না, ফলে বৃষ্টিও হয় না। তারা যজ্ঞ করে বলেই যজ্ঞধূমে মেঘ এবং তার থেকে বৃষ্টিপাত ঘটে এবং কৃষিকার্যের সহায়তা করে থাকে। একারণেই লোক হিতার্থে তাঁরা বৃষ্টি ও জলের দেবতা অগ্নি, ইন্দ্র ও বরুণকে ঋকমন্ত্রে হব্য, কব্য দ্বারা যজ্ঞ করে তুষ্ট করে থাকেন।

বলা বাহুল্য, এসবই ব্রাহ্মণদের চাতুরী। চার্বাক একারণেই তাদের ‘ভন্ড, ধূর্ত এবং প্রবঞ্চক বলে উল্লেখ করেছিলেন। বৈদিক ব্যবস্থার দিন অতিক্রম করে ব্রাহ্মণেরা ক্রমে শাস্ত্র পুরাণাদি রচনা করে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিস্তার করেছে এবং সমগ্র সমাজকে চাতুর্বণীয় এক ব্যবস্থার দ্বারা শক্ত ও অলঙ্ঘনীয় ঘেরাটোপের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছে। সুতরাং চার্বাক যাই-ই বলুন এই সনাতন আবেষ্টনী থেকে আর্যাবর্তীয় মানবসমাজকে মুক্ত করা আদৌ সহজ হবে না। মানুষকে এই মোহপাশ থেকে মুক্ত করা বহুযুগের বহু ভিন্ন তপস্যার দ্বারাই করা সম্ভব। তবে তার থেকে কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল, চার্বাকের কথায় সত্যতা আছে, কারণ তার অনেক কিছুই যুক্তিপূর্ণ। কিন্তু শুধুমাত্র তত্ত্ব আউড়ে কোনও প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে ভাঙ্গা যায় না। সম্পূর্ণভাবে না হলেও আমি এই ব্রাহ্মণ্য প্রাধান্য খর্ব করার চেষ্টা করেছিল। ফলে, তারা পান্ডবদের আশ্রয় করে আমাকে সবান্ধব উন্মূল করতে সাময়িক ভাবে হলেও সমর্থ হয়েছে। কিন্তু কোনও কিছুই হঠাৎ উৎপন্ন বা হঠাৎ বিনষ্ট হয় না। এর সবটাই প্রকৃতির নিয়মে ঘটে থাকে।

আমি স্বভাবগত ভাবে যা, তার থেকে নিজেকে অন্যভাবে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য মিথ্যে আড়ম্বর অথবা ভান করি না। আপাতদৃশ্যে আমার মধ্যে তথাকথিত মন্দের ভাগ বেশি। কিন্তু সেটাতো আমার স্বভাব। সেক্ষেত্রে তথাকথিত ভাল বলে নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা করাটাকে আমি ভণ্ডামি বলে মনে করি। মানুষের মধ্যেই রিপুর আধিপত্য কম বেশি থাকে, সেটা প্রাকৃতিক ধর্মই। আমার মধ্যেও তা আছে। হয়ত কিছু বেশিই তার প্রকাশ। কিন্তু আবার বলি, সেটাই আমার স্বভাব। হয়ত আমার জন্য বাল্যকাল থেকে কিছু ভিন্নভাবে পরিপালন করার প্রয়োজন ছিল। হয়ত, তাহলেও তার ফল আরও খারাপই হত। তবে তার অর্থ-এ নয় যে, আমি যেসব অন্যায় আচরণ করেছি, পাণ্ডবেরা তার থেকে মুক্ত। কিন্তু প্রাচীন কৌরবেরা তেমনই বিচার করে থাকেন।

বেশ, যদি তাই হয়, যদি আমিই সব দোষে দোষী এবং পাণ্ডবেরা নির্দোষ এমনটাই হয়, তবে তারা আমাকে সবান্ধব বন্দী করে, এই যুদ্ধটাকে বন্ধ করলেন না কেন? আসলে আর্যাবর্তীয় ছোট বড় সব রাজারই এই যুদ্ধে কিছু না কিছু স্বার্থ ছিল। কেউই শুধুমাত্র কর্তব্য বা শান্তি প্রতিষ্ঠার মহতী উদ্দেশ্যে এই দ্বি-পাক্ষিক যুদ্ধে যোগদান করে নি। আসলে এটাই তথাকথিত ক্ষাত্রধর্মের রীতি। আবার এক পক্ষ অন্য পক্ষকে এজন্য যে দায়ী করবে, তাতে ওই রীতির মধ্যেই পড়ে। ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় বর্ণীয়রাই এই সমাজের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বহুকাল অবধি। অন্য বর্ণের মানুষদের তাদের উপর কোনও কথা চলবে না। আমার শাসনক্রমে এই ভেদটা আমি কমিয়ে আনতে চেয়েছিলাম। একারণে তারা আমার উপর অসন্তুষ্ট ছিল এবং আমাকে ব্রাহ্মণদ্বেষী তথা ক্ষত্রাচার বিরোধী বলে প্রচার করত। কিন্তু ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়দের কোনও স্বার্থবিরোধী কাজ সে অর্থে আমি করিনি। আমি শুধু যতটা সম্ভব ততটাই সর্বসাধারণের স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করতাম।

কৃষ্ণ জানত, বর্তমান সমাজে ব্রাহ্মণেরাই সব চাইতে প্রভাবশালী। রাজ্য শাসনে তাদের বুদ্ধি ও মন্ত্রণা না থাকলে ক্ষত্রিয়রা উপযুক্ত ভাবে রাজত্ব পরিচালনা করতে পারত না। অবশ্য একথা বলছিনা যে এই ব্যবস্থায় সব সময়ই শাসনকার্য ত্রুটিপূর্ণ হত, বা জনগণ কষ্টে থাকত। অনেক নৃপতিই ছিলেন প্রজাবৎসল। সেখানে কৌশলগত ভাবে ব্রাহ্মণ মন্ত্রীদের ব্যবহার করে রাজা ন্যায্য শাসনের ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু সে সব দীর্ঘ কথা, এখন বলার উপায় নেই।

আমি জানিনা, আমি আর কতক্ষণ আছি। আমার জীবৎকালের মধ্যে আমি জেনে যেতে পারব তো, আমার ওই সর্বশেষ বীরত্রয়ী অদ্যকার নৈশ সমরে কতদূর কি করতে পারল। আমার জন্য সুখকর কোনও ঘটনা বা সংবাদ অবশিষ্ট আছে বলে আমি আর মনে করি না। তথাপি আমার অন্তরস্থ ক্রোধ এবং অভিমান দূরীভূত হচ্ছে না। কিন্তু এই ক্রোধ বা অভিমান কার উপর? তা কি ভীমের উপরে? সাধারণ দৃষ্টিতে তাই মনে হয় বটে, কিন্তু সেটা সর্বৈব সত্য নয়। ভীম একজন যোদ্ধা। কিন্তু যেহেতু সে অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করেছে এবং অকারণ আমার মাথায় পদাঘাত করেছে, সে কারণে তাকে আমি ঘৃণা করি। ক্রোধ তো, যুদ্ধের ধর্ম। তবে এই কুরুপান্ডব আহবে(??) আমার প্রকৃত ক্রোধ কৃষ্ণের উপর। আমি বিশ্বাস করি, কৃষ্ণ যদি এই দুই পক্ষের মধ্যে কূটনীতির বিস্তার না করত, তবে বিরোধটা যুদ্ধ পর্যন্ত যেত না। একমাত্র প্রবল স্বার্থসন্ধি কৃষ্ণই যুদ্ধটাকে অনিবার্য করে তুলেছিল। অনেকের ধারণা কৃষ্ণের নেতৃত্বে বা কর্তৃত্বে যাদবেরা স্বার্থশূন্যভাবে সর্বদা পান্ডবদের সহায়তা করেছে। কিন্তু সেটা আদপেই নয়। আমি জানি রাজসূয় যজ্ঞ উপলক্ষ্যে কৃষ্ণ যাদবদের স্বার্থে কতটা ধন পাণ্ডবদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছিল। অথচ, সে কখনও সে প্রসঙ্গে পরিস্কারভাবে কোনও বক্তব্য নিবেদন কারুর কাছেই করেনি। তার সব চাইতে চাতুর্যপূর্ণ মিথ্যে প্রচারটি হল যে সে পাণ্ডব এবং আমাদের সমদৃষ্টিতে দেখে। যুদ্ধের ব্যাপারে নাকি তার আদৌ কোনও পক্ষপাতিত্ব ছিল না।

যদিও মহর্ষি বেদব্যাস, গাঙ্গেয় ভীষ্ম, বিদুর ইত্যাদিরা কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। সে কারণে তাঁরা তার উপরে কোনও কথা বলতেন না এবং সর্বৈবভাবে - তাকে বিশ্বাস করতেন। আমি আজ পর্যন্ত কোনওদিনই তাকে ঈশ্বর বলে গণ্য করিনি। আমার কাছে সে একজন লোভী, ধূর্ত, ষড়যন্ত্রকারী এবং হৃদয়হীন যন্ত্রবৎ মানুষ ছাড়া আর কিছুই না। কোনও সুযোগ উপস্থিত হলেই সে নিজের এবং গোষ্ঠীর স্বার্থে তার সদ্ব্যবহার করত। সেখানে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থও তার কাছে তুচ্ছ ছিলনা। তার ক্ষমতা বিস্তৃতির আকাঙ্ক্ষার কোনও নির্দিষ্ট সীমা ছিল না। তার ধর্মরাজ্য স্থাপনার পদ্ধতি ছিল অতিমাত্রায় ভেদবাদি।

বলা হয়, আমি পাণ্ডবদের সূচ্যগ্র ভূমি দিতে প্রস্তুত ছিলাম না। আমার পক্ষে তাদের রাজ্যভাগ চাওয়াকে অগ্রাহ্য করাকে কি কারণে অন্যায় বা অযৌক্তিক বলা যায়? কোন্‌ ন্যায় শাস্ত্রমতে সূচ্যগ্রভূমিও আমি তাদের দিতে বাধ্য? প্রশ্নটা এখানে কম বা বেশি ভূমি হস্তান্তর করা নিয়ে নয়। যদি আমি সামান্যতম ভূমিও তাদের বাধ্যতামূলকভাবে দিতাম, তাহলে কি রাজত্বের উপর তাদের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হত না? অজ্ঞাত কুলশীল কোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যদি কোনও পরিবারে আশ্রিত হয়ে, সেই পরিবারের সম্পত্তি গ্রাস করতে চায়, ন্যায় বা অর্থশাস্ত্রের কোন্‌ বিধি বলে তাকে সঙ্গত বলা যাবে? গৃহস্থ কি সেক্ষেত্রে তার কুলস্বার্থ ত্যাগ করবে? সেক্ষেত্রে উদ্ভূত বিরোধের জন্য দায়ী কে? অথবা সেজন্য যুদ্ধ অনিবার্য হলে গৃহস্থের যুদ্ধ অন্যায় যুদ্ধ এবং প্রমাদ সৃষ্টিকারী আশ্রিতদের যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ হয় কিভাবে? পান্ডবেরা কৃষ্ণের মন্ত্রণায় কি অত্যাচারিত, নিপীড়িত সাধারণ প্রকৃতি-পুঞ্জের স্বার্থে অনোন্যপায় হয়ে এই যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন, না ব্যক্তিগতভাবে সম্পত্তি এবং ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে তারা তদানীন্তন আর্যাবর্তীয় মৎস্য, সৃঞ্জয়, পাঞ্চাল, মগধ, চেদি, যাদব অভিজাততন্ত্র এবং অন্যান্য রাজশক্তি সমূহের আন্তঃ তথা পারস্পরিক বৈরকে অবলম্বন করে এই অনাকাঙ্খিত ক্রুর যুদ্ধের অনুষ্ঠান করেছিল?

মানুষের স্বার্থে যে কোনও যুদ্ধই কি ন্যায় এবং শান্তির পরিপন্থী নয়, যদি তা শুধুমাত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যেই হয়? যুদ্ধ নিবারণের জন্য যুদ্ধও কি সত্যই শেষ বা ন্যায়যুদ্ধ বলে আখ্যাত হতে পারে? প্রাচীন পুরাণ কথায় কি এরকম ইঙ্গিত কোনও যুদ্ধান্তকালে আমরা প্রত্যক্ষরূপে দেখেছি? যদিও তাত্ত্বিকভাবে তেমন বলা হয় বটে, কিন্তু বাস্তব কি বলে? এসব আমার বিচারে যে ছিল না এমন নয়, তবে আমার স্বভাবকে আমার শুভবুদ্ধি কখনওই অতিক্রম করতে পারে নি। এটা আমার ত্রুটি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আবার এও মনে হয়, আমার স্বভাব বুঝে কেউ যদি আমাকে সঠিক পথে পরিচালনা করত, আমি ভিন্নরকমের মানুষ হতে পারতাম। আমার একটা বদ্ধমূল একগুঁয়েমি এই যে, যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে আমাকে কেউ নত করতে পারবে না। প্রথম থেকেই আমি পাণ্ডবদের আমাদের আত্মীয় বা জ্ঞাতি বলে গ্রহণ করতে পারিনি। লোকশ্রুতি প্রমাণ নয়। তারা জ্ঞাতি হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রথম থেকেই জ্ঞাতি শত্রু। তাদের হস্তিনাপুরে আগমনের পর থেকে জ্ঞাতি-শত্রুতার সূত্রপাত হয়েছিল। তখন যুধিষ্ঠির তথা তাঁর ভ্রাতাদের এবং আমার যা বয়স তাতে শত্রুতার সূত্রপাত আমাদের দ্বারা হওয়া সম্ভব ছিল না। প্রবীন কৌরবেরা এবং মাতা কুন্তির এ ব্যাপারে ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। আবার বলি, একমাত্র যুধিষ্ঠিরকেই পাণ্ডবদের মধ্যে আমি একজন প্রকৃত মানুষ বলে মনে করি। একমাত্র যুধিষ্ঠিরই পারতেন আমাকে সুপথে পরিচালিত করতে। কিন্তু কৃষ্ণ, ভীম, অর্জুন, সাত্যকি ইত্যাদির প্রভাবে তিনি পরিচালিত হয়েছিলেন বলেই যুদ্ধটা ঘটলই। তিনি-ই পারতেন যুদ্ধ পরিহার করতে। কিন্তু আগেই বলেছি, ব্যাপারটা কোনও একক ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভর করে ঘটেনি। আর্যাবর্তের অধিকাংশ ছোট বড় রাজশক্তি এজন্য দায়ী।

বিপুল বেদনা শরীরে নিয়ে এইসব এলোমেলো ভাবনা ভেবে যাচ্ছি। গদাপ্রহারে ভূলুন্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যদি প্রাণ বিয়োগ হত তো কোনও পশ্চাত্তাপ থাকত না। বেঁচে থাকার এই যন্ত্রণা সহ্য করা আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। গুরুপুত্র অশ্বত্থামা এবং তার সঙ্গের দুই যোদ্ধা শেষ পর্যন্ত কী সুসংবাদ আনতে পারবে তা বুঝে উঠতে পারছিনা। খুব যে একটা আশা করে আছি এমন নয়। আবার আন্তরিকভাবে যে সেরকম সাফল্যই চাই এমনও বলতে পারি না। রক্তপাত অনেক হয়েছে, অবশিষ্ট সামান্য কয়েকজনের রক্তপাতে কার কি লাভ হবে? তাছাড়া, এখন রাজ্যলাভ করে কোন্‌ পক্ষই বা কিভাবে ভোগ করবে? কাকে নিয়েই বা? সবই তো ধ্বংসপ্রাপ্ত।


|| পাঁচ ||

তক্ষণ যা চিন্তা করেছি, তা শুধু আমার আত্মদোষ স্খালনেই সীমাবদ্ধ। আমার নিজস্ব স্বভাবগত ত্রুটি, অপরাধ বিষয়ে বিশেষ কিছু চিন্তা আমার মধ্যে উদয় প্রায় হয়ইনি। আমার মনে এখনও একটা আকাঙ্খা সুপ্তাকারে বিরাজিত রয়েছে যে আমার এই সর্বশেষ বীর ত্রয় নিশ্চয়ই এক অসাধ্য সাধন করবে। অন্তত আমার মৃত্যুর অব্যবহিত ক্ষণে এই বিপুল বিষাদের মধ্যেও এক চিরপোষিত আকাঙ্ক্ষার তৃপ্তির হর্ষ আমি পাব। এটাই আমার চরিত্রের সবচেয়ে বড় ত্রুটি। আমি কখনওই পান্ডবদের সহ্য করার কথা ভাবতেই পারি না।

এখন ভাবছি, পান্ডবদের কি দোষ ছিল এমন? এক তাদের পিতৃপরিচয় কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু আমি তো এই বিষয়টার উপর কোনওদিন গুরুত্ব আরোপ করিনি অন্যদের বেলায়। কর্ণের জন্ম বিষয়ে, বিশেষত তার জন্ম এবং কূল বিষয়ে যখন অস্ত্রশিক্ষা-প্রদর্শনী কালে ভীম অভব্য উক্তি করেছিল, তখন তো আমি উপযুক্ত শাস্ত্রবাক্যে তাকে তিরস্কারই করেছিলাম। তাহলে পাণ্ডবদের বিষয়ে আমি অত অসহিষ্ণু হয়েছিলাম কেন? মানুষ তো তার জন্মের জন্য দায়ী নয়। পাণ্ডবেরা যাঁর বা যাঁদের বীর্যজাত হউক না, তারা যে মাতা কুন্তি এবং মাদ্রির গর্ভজাত সে বিষয়ে তো ভুল নেই। রাজ্যাধিকারের প্রশ্নে পরে আসছি। পাণ্ডু পুত্রোৎপাদনে অক্ষম ছিলেন বলে, তাঁর স্ত্রীদ্বয়ের সন্তানাকাঙ্খা পূরণের জন্য ক্ষেত্রজ পুত্র ধারণ করার অধিকার থাকবে না কেন? কিন্তু আমি যখন কুন্তির তিন সন্তান ধারণকে বিধি বহির্ভূত বলে আখ্যা দিয়েছিলাম, তখন ভাবিনি যে বিষয়টা এমন কিছু রীতি বহির্ভূত নয় এবং মাতা কুন্তি ও মাদ্রির নিজস্ব আকাঙ্খাটাই সেখানে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ, শাস্ত্রীয় খুঁটিনাটি বিচার বা নিয়ম নয়।

পুত্রোৎপাদন বিষয়ে স্মৃতিশাস্ত্রের নিদান এক এক যুগে এক এক রকম। পুরাকালে নারী গাভীর মত মুক্ত এবং স্বেচ্ছা বিহারিণী ছিল। ক্ষেত্রজ বিধির প্রচলন যুগের প্রয়োজনে এসেছে। বর্তমানে আবার তার রীতি বদল হচ্ছে। তবে সন্তান লাভের সঙ্গে, সম্পত্তির অধিকারের সম্পর্ক যত বাড়ছে, ততই ক্রমশ রীতি পরিবর্তিত হচ্ছে এবং সামাজিক জটিলতাও বাড়ছে। পাণ্ডবদের সহিত, আমাদের যাবতীয় সংঘাতের মূলে রয়েছে ভূমির উপর অধিকারাকাঙ্খা। আমার সবচাইতে বড় অন্যায় এই যে আমি মাত্রাধিকভাবে ভূমি-লোভী। এই লোভ ক্রমশ আমাকে অতি মৎসর করে তুলেছিল। মনে পড়ছে যুধিষ্ঠিরের প্রস্তাবে আমি মাত্র পাঁচটি গ্রাম দিতেও স্বীকার করিনি, এমনকি দম্ভের সঙ্গে বলেছি, ‘বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র ভূমিও তাদের দেব না। দীর্ঘকাল, তাদের বনবাস- অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়ে এবং নিরঙ্কুশ রাজত্ব ভোগ করে আমার লোভের সীমা বর্দ্ধিতই হয়েছিল। উপরন্তু যে সামান্য রাজ্যকালে তারা নিজ উদ্যোগবলে প্রভূত ধনার্জন করেছিল, তার জন্যও আমার মাৎসর্য বৃদ্ধি হয়েছিল। যদিও আমি বলেছি যে পররাজ্য লুন্ঠন বা অধিকার করায় আমার প্রবৃত্তি নেই, কিন্তু যেহেতু পাণ্ডবদের আমি প্রথম থেকেই শত্রুরূপে গণ্য করতাম, তাদের সম্পদবৃদ্ধি বা সেই সম্পদ যে কোনও উপায়ে হস্তগত করা আমার কাম্য ছিল। আমার বিচার ছিল যেহেতু পাণ্ডবেরা জন্মসূত্রে কুরুকুলজ নয়, সে কারণে কুলের সম্পত্তিতে তাদের অধিকার থাকতে পারেনা। আসলে আমি কৈশোরাবধি, তাদের তেজ, বীর্য, উদ্যম প্রভৃতির আধিক্যে ভাবিত ছিলাম যে যদি তারা সামান্যতম ভূমিতেও অধিকার লাভ করে, তবে অতিশীঘ্রই তারা তার উপর আশ্রয় করে বিশাল রাজত্বের নির্মাণ করবে এবং আমিও রাজ্যহারা হব। এ ব্যাপারে আমার বিচারে ভুল ছিল না। যা যা আমি করেছি, বিপরীত-ক্রমে তারাও তাইই করত।

দ্রৌপদির স্বয়ংবর সভায় অংশগ্রহণ, তাদের তৎকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে আদৌ কাকতলীয় ছিল না। মনে হয়, গুপ্তাবস্থায় থাকার সময়ই কৃষ্ণের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ঘটেছিল এবং তার কূটবুদ্ধিতেই আমাদের চিরশত্রু পাঞ্চালদের সঙ্গে পাণ্ডবদের সৌহার্দ্যের সূত্রপাত হয়। দ্রুপদের সঙ্গে কৌরবদের বিগত যুদ্ধে অর্জুনের বীর্যবত্তা গুরু দ্রোণকে মুগ্ধ করেছিল। সেই বিরোধটা ছিল দ্রুপদ বনাম(??) দ্রোণের। দ্রুপদ অর্জুনকেই দ্রৌপদির জন্য উপযুক্ত পাত্র রূপে সিদ্ধান্ত করে লক্ষ্যভেদের নিয়ামাবলি ওইরূপ করেছিল। কিন্ত সে কারণে ওই ব্যাপারটাকে রাজনৈতিক রীতিই বলা যেতে পারে। কুরু এবং পাঞ্চালদের রাজ্য সীমানা নিয়ে শত্রুতা দীর্ঘকালের। কৌরব কুল ধ্বংস দ্রুপদের কাম্য ছিলই। পাণ্ডবেরাও আমাদের বিরোধে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কৃষ্ণ পক্ষে থাকায় কূটনীতিতে তারা ক্রমশ অগ্রগামী হচ্ছিল।

যাদবদের সঙ্গে কৌরবদের কোনও প্রাক্তন শত্রুতা ছিল না, বরং উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে বৈবাহিক কুটুম্বিতা ছিল। শূরসেন কন্যা মাতা কুন্তি কৃষ্ণপিতা বসুদেবের ভগিনী ছিলেন। কৃষ্ণপুত্র শাম্ব আমার কন্যা লক্ষণাকে বিবাহ করেছিল। যদুকুল গোষ্ঠীগত ভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। তাদের নেতৃত্বে বলদেব এবং কৃষ্ণ পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে আবদ্ধ হলেও, বলদেব অনুগামীরা সকলেই কৃষ্ণের অনুগত ছিল না। কৃষ্ণের কৌশলে সব গোষ্ঠীকে নিয়ে যাদব অভিজাততন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে কৃষ্ণের ইচ্ছাই শেষ কথা হলেও স্বেচ্ছাচারী গোষ্ঠীও অনেক ছিল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে এইসব গোষ্ঠীরা আমার পক্ষে যোগ দেয়। কৃষ্ণ অনুগামীরা সদলে কৃষ্ণের সহিত পাণ্ডবপক্ষে যায়। বলা বাহুল্য, উভয়পক্ষের যাদব সৈন্যই অধিকাংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। কৃষ্ণ মৌখিকভাবে বলেছিল, এই যুদ্ধে সে কোনও পক্ষ অবলম্বন করবে না বা অস্ত্রধারণও করবে না। আমি মূর্খের মত একদিকে একা কৃষ্ণ অপরদিকে এগার সহস্র নারায়ণী সেনার মধ্যে, নারায়ণী সেনাকেই নিয়েছিলাম। কিন্তু কৃষ্ণ নিরপেক্ষ ছিল না। অস্ত্র না ধরার প্রতিজ্ঞাও পিতামহ ভীষ্মের তীব্র বানবর্ষণে ভঙ্গ করতে হয়েছিল তার। তবে তার ক্ষুরধার চক্রান্তকারী কূটবুদ্ধি সর্বঅস্ত্রের সেরা অস্ত্র রূপে সে পাণ্ডবপক্ষে ব্যবহার করেছিল। সেটাই শেষ পর্যন্ত পাণ্ডবদের বিজয় এনে দিয়েছিল।

যুদ্ধ একটা নিষ্ঠুর কর্ম এবং নিঃসন্দেহে ক্ষত্রিয় নামধারী ব্যক্তিরা সেই নিষ্ঠুরতার অংশী হয়। এই যুদ্ধে নিষ্ঠুরতার, মানবসুলভ আচার বিচারের কোনও ভূমিকা কোনো পক্ষেই ছিল না। তবে একথাও সত্য যে ক্ষত্রিয়রা এক্ষেত্রে কিছু নিয়ম বন্ধ ক’রে থাকে উভয় পক্ষেরই স্বার্থের কারণে। এই যুদ্ধেও উভয় পক্ষ মিলে সেই নিয়ম বন্ধ করেছিল। কিন্তু তুলনামূলকভাবে পাণ্ডবেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। আমাদের কথা ইতিপূর্বেই বলেছি। কিন্তু এখন আমি মৃত্যু পথযাত্রী, সর্বস্বরিক্ত অবস্থায় যে জিঘাংসার প্রকোপে পড়ে গুরুপুত্র অশ্বত্থামাকে সৈন্যবিহীন সেনাপত্যে বরণ করে পাণ্ডব নিধনে পাঠালাম, তা যেন নীতিগতভাবে মেনে নিতে পারছিনা। আমার পতনে যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছে এটা স্বতসিদ্ধভাবেই সকলে মেনে নিয়েছিল। এখন অশ্বত্থামার প্রতিহিংসাটা পক্ষ বিচারে কৌরবপক্ষে বর্তায় না, সেটা একান্তই ব্যক্তিগত আক্রোশবশতঃ একটা অসম তথা অন্যায় হত্যাকাণ্ডরূপে আমার অপযশ ঘোষিত করবে। কিন্তু জ্যা-আকর্ষিত তীর এবং মুখের বাক্য একবার নির্গত হলে আর ফিরে আসেনা। অবধার্যভাবে তা নির্ধারিত ফল আহরণ অবশ্য করবে।

তবে ব্যাপারটা যদিও শুনতে অবাস্তব মনে হবে, তবুও বলছি, কেন যেন আমার মনে হচ্ছে যে অশ্বত্থামার উদ্যোগ একটা ঘোর অমঙ্গলের সূচনা করবে। আমার মন মানসে একটা হর্ষ ও বিষাদ যুগপৎ আনন্দ ও শঙ্কার সৃষ্টি করছে। আবার ভাবছি, যাক শেষ কামড়টা তাহলে আমি যাবার সময়ই দিয়ে যাই। যুদ্ধটাতে তাহলে বিজয়ী বলে কেউ থাকবে না। জনশ্রুতি এই যে সম্মুখ যুদ্ধে যেসব বীর রণশয্যা লাভ করে, তারা অক্ষয় স্বর্গের অধিকারী হয়। যদিও সখা চার্বাক হয়ত বলবে, ‘স্বর্গ-টর্গ সবই ইহজাগতিক। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই পঞ্চভূতে লীন হয়ে যায়। তবে প্রকৃতির রহস্যের সব কিছুতো আমরা জানিনা। মৃত্যুর পরপারে কোনও অস্তিত্ব থাকতেও তো পারে। থাকলে অবশ্যই বেশ হত। চার্বাক বলে, - ‘তা হয়ত হতো, কিন্তু নেই।‘

ভাবছি, মানুষের জীবন যদি জন্ম এবং মৃত্যুর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়, তাহলে সেই জীবনের মধ্যেই এত হানাহানি, হত্যা, রক্তপাতের হেতু কি? না, চিন্তা করে শুধুই ক্লান্তি এবং যন্ত্রণা বাড়ছে। এখন আমার একটাই কামনা আছে। সর্বক্লান্তিহর মৃত্যু এবার আসুক। জীবনের দিনগুলো আমি রাজারূপে বেঁচেছি। রাজার মতই দৃঢ় পায়ে মৃত্যু অতিক্রম করে চলে গিয়ে আমি মানুষের প্রশংসার স্বর্গে- ভাস্বর হব। অন্য স্বর্গের প্রয়োজন নেই।

পাণ্ডবেরা রাজ রাজত্ব পাবে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কি সুখ ভোগ করবে তারা? সব আত্মীয় পরিজন, পুত্র, পৌত্র, শ্বশুর-সম্বন্ধি ব্যাতিরেকী রাজত্বে কি সুখ? রাজত্ব ভোগ করার জন্য স্বজন-বান্ধব প্রয়োজন। তাদেরই বা কে আর বেঁচে আছে? তারা সারাজীবন প্রায় বনবাসে কাটিয়েছে, এখনও সেই নির্বান্ধব, নিশূন্য মরুসদৃশ ভূমি শাসন ক’রে, কি সুখ তারা লাভ করবে? নিস্পাদপ অরণ্য, জনহীন- স্বজনহীন রাজ্য এবং নিরন্তর শোক নিয়েই এখন তাদের আমৃত্যু কাটাতে হবে। আমি আজীবন পাণ্ডবদের অহিতই কামনা করেছি এবং তদনুসারে কর্ম করেছি। সর্বকর্মেই আমার চূড়ান্ত অদূরদর্শিতাই প্রকটিত হয়েছে জীবনভর। আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার প্রাক্কালে বুঝতে পারছি, এই সুন্দর পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা আনন্দের হচ্ছে স্বজন-আত্মীয় সমভিব্যাহারে একটি সুষম এবং পরিতৃপ্তির গার্হ্যস্থ জীবন যাপন করা। এই আদর্শে নিষ্ঠাভরে জীবন যাপনের আকাঙ্খা একমাত্র যুধিষ্ঠিরের ছিল। কিন্তু পাণ্ডবদের নিকট থেকে শিক্ষণীয়রূপে কোন কিছুই কোনও দিন আমি অনুসরণ করার কথা ভাবিনি। এটাও আমার অহংকার এবং অদূরদর্শিতার ফল।

যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থের মত রাজধানী, প্রাসাদ ইত্যাদি পরিত্যাগ করে মাত্র পাঁচ খানি গ্রাম প্রার্থনা করলে, আমি তার মধ্যের নির্লোভ স্বভাবকে মান্যতা দিই নি। পরন্তু, মনে করেছি, আমার সৈন্যদের দেখে এবং আমার প্রভাবে ভীত হয়েই সে এরূপ করছে। কথাটা অত্যন্ত দম্ভভরে আমি পিতাকে বলেছিলাম। আমি অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। নিজে যা ভাল মনে করতাম, তা থেকে কিছুতেই বিরত হতাম না। নিজের ক্ষতি হবে বুঝলেও জেদ পরিত্যাগ করতাম না। এই বিষয়টা ভীম বুঝতে পেরেছিল। আমি লোকমুখে শুনেছি, কৃষ্ণ যখন কৌরব সভায় দৌত্যের জন্য আসে, ভীম তাকে আমার বিষয়ে বলেছিল, ‘দুর্যোধন বরং প্রাণ ত্যাগ করবেন, তথাপি পরাভব স্বীকার করবেন না।‘ অত্যন্ত সঠিক কথা, স্বীকার করছি। আমি জানি, এই শ্রেণীর জেদ ভাল নয়, কিন্তু প্রত্যেক তেজস্বী পুরুষের চরিত্রেই এই দোষ বা গুণটি অতিমাত্রায় বর্তমান থাকে।

শত্রুর কথায়ও সত্যতা থাকে। প্রাজ্ঞ পুরুষেরা সেই সত্যতাকে অগ্রাহ্য করেন না। কৃষ্ণ বিষয়ে ইতিপূর্বে আমি যথেষ্ট নিন্দাবাদ এবং তার দোষের কথা ব্যক্ত করেছি। কিন্তু তার দৌত্য কালে সে যে স্পষ্ট ভাষায় তার ভাষণ প্রদান করেছিল, তা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য ছিল। কিন্তু তাতে আমি স্পর্শিত হইনি। আমার স্বভাবের প্রধান দোষটি সে দেখিয়ে দিয়েছিল। সে বলেছিল, -‘হে রাজন্‌, বিনা কারণে তুমি জন্মাবধি পাণ্ডবগণের প্রতি দ্বেষ পোষণ করিতেছ’। মহামতি বিদুর মিতভাষী এবং সত্যবাদী। তিনি শ্রীকৃষ্ণ সমীপে আমার যে পরিচয় দিয়েছেন তাতে কিছুমাত্র অত্যুক্তি ছিলনা বলেই আজ মনে হচ্ছে। বিদুর বলেছিলেন, - ‘হে কেশব, তুমি পাণ্ডবদের দৌত্য গ্রহণ করিয়া ভাল কর নাই। দুর্যোধন কি তোমার কথা শুনিবে? সে অর্থ এবং ধর্ম হইতে চ্যুত, মন্দমতি, গর্বিত, অপরের সম্মাননাশক পরন্তু স্বয়ং মানকামী, বৃদ্ধগণের শাসনাতিগ, ধর্মশাস্ত্রবিদ্বেষী, মূঢ়, দুরাত্মা, কামাত্মা, প্রজ্ঞামানী, মিত্রদ্রোহী, অকৃতজ্ঞ, মিথ্যাপ্রিয় এবং অসংযত। তাহার চরিত্রে দোষের অন্ত নাই। এহেন পাপাত্মা কি তোমার শ্রেয়োবচনে কান দিবে?’

তাঁদের এইসব বাক্য ঔদ্ধত্যবশত আমি কানে নিইনি। পরন্তু, কৃষ্ণকে বন্দী করার মত কুবুদ্ধি আমার হয়েছিল এবং বিদুরকে অত্যধিক তীক্ষ্ণ বাক্যে অপমাণিত করেছিলাম। বন্দী হবার বিষয়টা আগেই অনুমান করে, কৃষ্ণ উপযুক্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা করেই সভাস্থলে এসেছিল। ব্যাপারটা যেহেতু রাজনৈতিক শিষ্টাচার এবং রীতিবিরোধী ছিল, আমার মিত্রেরাও অনেকেই তা সমর্থন করেনি। এর কিছুদিন পরে আমার অন্য একটা অনুরূপ আচরণের জন্য বিদুর হস্তিনাপুর ত্যাগ করে তীর্থ ভ্রমণে গমন করেন। প্রবীণেরা আমাকে নানাভাবে উপদেশ দিয়েছেন, যাতে যুদ্ধে না গিয়ে আমি পাণ্ডবদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিই। কিন্তু আমি কারো কথায়ই কর্ণপাত করিনি। যে কাজ করলে পাণ্ডবদের সঙ্গে আমি পরম শান্তিতে রাজ্যভোগ করতে পারতাম, তা না করে আমি সবার ধ্বংসের এবং অনিষ্টের কারণ হলাম।

মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রও আমাকে কম সুপরামর্শ দেন নাই। কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত দোদুল্যমান চিত্তের লোক। আমি তাঁর অবাধ্য ছিলাম, এবং তাঁর স্নেহবাৎসল্যকে সমুচিত মূল্য না দিয়ে, নিজের মতে তাঁকে চলতে বাধ্য করেছিলাম। তবে নিরপেক্ষ বিচারে একটি কথা বলা আমার অন্যায় হবেনা যে আমার এই রাজ্য-লোলুপতা, প্রভূত্ব-পরায়ণতা আমি আমার পিতা মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের নিকট থেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। গুণ রূপে তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি অসামান্যরকমের প্রজাবাৎসল্য। রাজ্য পালন বিষয়ে মহারাজ আমাকে প্রকৃতই উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। রাজ্য শাসনে, জন্মান্ধ হলেও তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক এবং প্রজাবৎসল। পরবর্তীকালে, আমি যত দোষেই দুষ্ট হই না কেন, প্রজাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জনে আমার সমকক্ষ কেউ ছিল না। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বা আমার শাসনকালে কোনওদিন কোনও প্রজা অসন্তোষ ঘটেনি। পিতার কোনও কিছুরই অভাব ছিল না। পাণ্ডুর অকাল বানপ্রস্থ এবং দেহান্তের পর তিনিই দীর্ঘকাল এই বিশাল কুরুরাজ্য শাসন করেন। তথাপি, যেটা তাঁর দোষ বলে, আমি তাঁর পুত্রকল্পে মনে করি, তা হল তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রতি লোভ। তাঁর এই দোষটি আমার মধ্যে একান্তভাবেই বর্তেছে। মহারাজের ক্ষেত্রে অন্ধত্ব একটা কারণ ছিল। কিন্তু আমি স্বভাবগত ভাবেই স্বেচ্ছাচারী এবং একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রতি লোভী। এটা যদি মানুষের মধ্যে না থাকত, তবে পৃথিবী নিঃসন্দেহে শান্তির আলয় হত, সুন্দরতর হত। কিন্তু সব শান্তিময় এবং সুন্দরতর হলে, পৃথিবীতে বৈচিত্র থাকে না। এই বিশ্ব প্রাকৃতিক ভাবেই বৈচিত্র-ময়। সুতরাং আমাদের এবং পাণ্ডবদের সমতা বোধহয় আমাদের স্বভাবের ভিন্নতার কারণেই সম্ভব হয়নি। আমি এখন এরকম বুঝছি। তত্ত্বকথা, ধর্মকথা আমি বলতে পারিনা বা সে সবের উপর আমার বিশ্বাসও নেই। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ যদি তার রিপুর উপর শাসন রাখতে পারে, তবেই প্রকৃত কল্যাণ হতে পারে। আমি এক্ষেত্রে স্বীকার করছি যে আমি স্বয়ং সারাজীবন অত্যন্ত লোভ রিপুর পরবশ হওয়ার জন্য সর্ব অকল্যাণের রাস্তা প্রশস্ত হয়েছে।

কিন্তু একথাটাও না বললে চলে না যে কৃষ্ণ, পাণ্ডবেরা এবং প্রবীণ কৌরবদের প্রত্যেকেরই মধ্যে কোনও কোনও রিপু প্রবল। আমি অনেক কিছুই বিশ্বাস করি না, যেসব অন্যেরা বিশ্বাস করে। আমার মধ্যে প্রথাগত শিক্ষা দীক্ষা ছাড়াও চার্বাকের চিন্তাধারার প্রাধান্য আছে। একারণে, আমার ধর্মাধর্ম বিষয়ে বিচার সাধারণের সঙ্গে মেলে না। বিশেষত, কোনও অলৌকিকতায় আমি বিশ্বাস করিনা। মহর্ষি বেদব্যাস, পিতামহ ভীষ্ম ইত্যাদি প্রধান প্রধান ব্যাক্তিরা কৃষ্ণকে পূর্ণব্রহ্ম সনাতন নারায়ণের অবতার রূপে মনে করেন এবং তার প্রতি অসাধারণ ভক্তিপরায়ণ। আমি জানি কৃষ্ণ একজন অসামান্য মানুষ, কিন্তু তিনি মানুষই। তিনি যদি ঈশ্বরই হতেন, তাহলে মনুষ্যসুলভ রিপুর পরবশতা তার কিভাবে হত? আমি মনে করি সে অত্যন্ত বিচক্ষণ, কুশলী এবং বুদ্ধিমান মানুষ। তবে যেহেতু তার মধ্যে মনুষ্যসুলভ সবরকম দোষগুণই বর্তমান, সে কারণে সে মানুষই, ঈশ্বর কখনোই নয়। আমার বিচারে, সে যদি ঈশ্বরের অবতারই হত, তার মধ্যে পক্ষপাতিত্ব কখনওই থাকত না। এবং একথা আমি অন্তর দিয়েই বুঝতে পারি যে তার মধ্যে পক্ষপাতিত্ব দোষ ব্যাপকভাবেই আছে।

যদিও চার্বাকের মতের পরিপন্থী, তথাপি একটা কথা আমি বিশ্বাস করি যে, যে শক্তি অন্তর থেকে নির্দেশ দেন, তার নির্দেশমতই আমি কর্ম করি। ধর্ম কি, আমি জানি, অধর্মও বা কোনটা তাও জানি। কিন্তু ধর্মে আমার প্রবৃত্তি নেই, অধর্মে-ও আমার নিবৃত্তি নেই। এটাই আমার স্বভাব।


।। ছয় ।।

মাতা গান্ধারীর আমি প্রথম সন্তান। মাতাই একমাত্র যিনি, প্রকৃতপক্ষে আমাকে সৎ পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু আমি তাতে কর্ণপাত করিনি। তিনি অহরহ বলেছেন, ‘বৎস, তুমি আমার ও মহারাজের শরীর সঞ্জাত এবং অত্যন্ত স্নেহ ও আকাঙ্খার ধন। কিন্তু অসৎ সংসর্গে পড়ে বিপদে পড়তে চলেছে। আমি জানি, তুমি ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী এবং প্রান্তিক জনেদের জন্যই তোমার সহানুভূতি ব্যাপক। কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতে তোমার বিশ্বাস নেই বলে আমরা তোমাকে অধার্মিক বলে থাকি। কিন্তু আমি জানি তোমার ধর্ম সাধারণ মানুষের প্রতি তোমার কর্তব্য-পরায়ণতা। এটা খুবই বড় ধর্মীয় স্বভাব বলে আমি মনে করি। এই ধর্মকে প্রতিষ্ঠা দিতে তোমার স্বভাবজাত দোষ নিজের মধ্যে থেকে সম্পূর্ণভাবে উন্মূলন করা কর্তব্য। বৎস, ব্রাহ্মণেরা আর্যাবর্তের সমাজের সব জাতি বর্ণের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে সুদীর্ঘকাল ধরে অপরিসীম শক্তি অর্জন করেছেন। তুমি যদি তাঁদের বিরোধিতা কর, তবে তাঁরা তোমাকে সিংহাসনচ্যুত হতে বাধ্য করবে। মনে রাখবে, আর্যাবর্তের অধিকাংশ ক্ষত্রিয়কুল, বিশেষত রাজন্যবর্গ ব্রাহ্মণদের বিধি নিষেধের বশীভূত। তোমার বিশ্বাস অনুযায়ী তুমি নিশ্চয়ই প্রান্তিক জাতীয়দের, এমন কি অনার্যকথিতদের উপর অত্যাচার উৎপীড়নের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পথে সংগ্রাম করবে। তবে সবই সুকৌশলে। হঠকারিতা কোরো না। একথা বলছি এজন্য যে হঠকারিতা, অহংকার, আত্মাভিমান এবং অনমনীয়তা ইত্যাদি ত্রুটিগুলো খুব বেশিভাবেই তোমার মধ্যে আছে। সে ব্যাপারে তুমি কারও কোনও উপদেশ শুনতে পছন্দ কর না। জনকল্যাণের নিমিত্ত তুমি যে আদর্শ অন্তরে লালন কর, তা ফলবতী করতে হলে পাণ্ডবদের সঙ্গে গৃহবিবাদ তোমাকে প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে নিতে হবে। পাণ্ডবেরা তোমাদের জ্ঞাতিভ্রাতা। তাদের প্রতি তোমার বিরূপতা অনেক ক্ষেত্রেই অসমীচিন এবং অর্থহীন। তাদের প্রভূত গুণাবলি আছে। তাদের কুল বিষয়ে, তোমার ধারণার কোনও প্রকৃত যুক্তি নেই। একথা সত্য যে তাদের পিতৃত্বের বিষয়টা রহস্যময়। কিন্তু চিন্তা করে দেখ, পুরাণে, ইতিহাসে কি অনুরূপ রহস্যময় জাতকের কিছুমাত্র অভাব আছে। আর যাই হোক, তার সর্বোপরি তো কুন্তি-মাদ্রিরও গর্ভজাত। তাঁরা তো তোমার কুলেরই বধু, তোমাদের মাতৃসমা। বৎস, বৃথা কুল ধ্বংসের কারণ হয়োনা। পাণ্ডবেরা ভিন্ন বিশ্বাস এবং শিক্ষায় বড় হয়েছে। এই বিশাল আর্যাবর্তের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন বিশ্বাস এবং আদর্শের বা ধর্মের মানুষ আছে। এতবড় একটা উপমহাদেশ তুল্য ভূভাগের সব মানুষ একই রকম কখনওই হতে পারেনা। জাতি বর্ণের বিকাশ অনুযায়ী এইসব মানুষ ভিন্ন ভিন্ন পথও মত অনুসারী।'

মাতা যথার্থ বলেছিলেন। তিনি শিবের উপাসক। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস তিনি কারোর উপর চাপিয়ে দেন না। তাঁর বিষয়ে আমার অনেক কিছুই বলার আছে, তবে সেসব কথা এখন আর বিতাং (??) বলে কি হবে?

আমার পিতা মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের চরিত্রে দোদুল্যমানতার কথা আগেই বলেছি। কিন্তু মাতার চরিত্রে কোনও দোদুল্যমানতা ছিল না। আমার মধ্যে যে কোনও গুণ আছে, সেকথা একমাত্র মাতা ব্যতীত আর কারো মুখেই শুনিনি। আমার চরিত্রে যে প্রজাইতেষণা বলে একটা মহৎগুণ আছে, তার উল্লেখ একমাত্র মাতা এবং আমার প্রজারাই করেছেন। মাতা আমার দোষের কথাও স্পষ্টভাবেই বলেছেন। অন্যান্য আত্মীয় স্বজনেরা শুধু দোষের কথাই সতত বলে এসেছেন এবং আমার বিশ্বাস সে কারণেই আমি অতিমাত্রায় জেদী স্বভাব-সম্পন্ন হয়ে পড়েছিলাম।

পাণ্ডবেরা যখন ইন্দ্রপ্রস্থে রাজধানী স্থাপনা করে স্থিতু হয়েছিল, তখন অর্জুন এবং কৃষ্ণ ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় খাণ্ডববন দাহ এবং সেখানের অনার্য বলে পরিচিত মানুষদের উন্মূলন করেছিল। সেখানে ব্রাহ্মণ ঋষিদেরও অনেকে বসবাস করতেন। তাঁদেরকে অবশ্য নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে তারপরই খাণ্ডব ধ্বংস করা হয় এবং অগণ্য নির্দোষ মানুষ ও ও আরণ্যক প্রাণীদের হত্যা করা হয়। আমার বহু অনার্য জাতীয় বন্ধু এই ধ্বংসকাণ্ডের বলি হয়েছিল। যুদ্ধে এদের অনেক গোষ্ঠীই কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছিল। খাণ্ডবদহনের প্রাক্কালে, আমি সরাসরি কৃষ্ণার্জুনের বিরোধিতা করিনি বটে তবে অনার্যজাতীয় বান্ধবদের প্রভূত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলাম। সেসব যুদ্ধের অনেক আগের কথা। সেই কৃতজ্ঞতায় অলম্বুষ, একলব্য এবং তৎ পিতা হিরণ্যধনু কৌরবপক্ষে সসৈন্যে যোগ দেন তথা অলম্বুষাদি প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করে। পাণ্ডবপক্ষে একমাত্র ঘটোৎকচ ব্যতিত অন্য কোনও অনার্যজাতীয় মানুষ যোগদান করেনি। নাগকুলের তক্ষক বংশীয় অশ্বসেনও খাণ্ডব দহনের প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য আমার পক্ষে যুদ্ধ করেছিল।

অতঃপর রাজসূয় যজ্ঞকালে তারা সমগ্র আর্যাবর্তে প্রায় সব রাজ্য ও জনপদে ব্যাপক লুন্ঠন ও ভীতি প্রদর্শন দ্বারা ব্যাপক ধনরত্ন সংগ্রহ করে। যজ্ঞাদি কর্মে ক্ষত্রিয় রাজন্যবর্গ দিগ্বিজয় করে বটে, কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে প্রকৃত যুদ্ধ বিশেষ হয়ই না। সাধারণত ব্যাপারটা শান্তিপূর্ণ ভাবে মেনেই নেওয়া হয়। দুএকজন স্বাভিমানী রাজা কিছু যুদ্ধের আয়োজন করে বটে তবে তাতে বিশেষ কোনও সুবিধে হয় না। আক্রমণকারীরা দিগ্বিজয়ী রূপে খ্যাতি অর্জন করে। বলা বাহুল্য, ব্যাপারটাকে অনর্থক ধনক্ষয় এবং প্রদর্শনীমূলক আচরণ বলেই আমার মনে হয়। আমি এইসব কথা বলছি বটে, তবে পাণ্ডবদের সম্পদ এবং প্রতিপত্তি দেখে যে ঈর্ষান্বিত হয়েছি, সেটাই পরবর্তীকালে সবার জন্য সর্বনাশ উৎপন্ন করেছে। ভাবছি, এইসব বিষয়ের অন্তঃসারশূন্যতা উপলব্ধি করেও আমি কেন ঈর্ষাদগ্ধ আচরণে পদাপর্ণ করলাম, সে কথাও চিন্তনীয়। অবশ্যই তা যে আমার চারিত্রিক ত্রুটি, তাতে সন্দেহ নেই।

অষ্টাদশ দিবসের যুদ্ধের প্রত্যেকটি দিবসেই, রণক্ষেত্র যাত্রাকালে মাতাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ কামনা করতে গেলে, মাতা বলতেন, - ‘ধর্ম যেখানে, জয় সেখানে।' একদিন জানতে চেয়েছিলাম, - ‘মাতা তুমি তো আমার ধর্ম জান। আমি কি তার থেকে চ্যুত হয়েছি? আমি প্রজার কল্যাণকেই যথার্থ ধর্ম বলে জানি। আমি তো প্রজাহিতৈষণা পরিত্যাগ করে স্বধর্মচ্যুত হইনি। আমার রাজ্য প্রশাসন যথোচিতভাবে তাদের আরদ্ধ কর্তব্যকর্ম করে যাচ্ছে। তাহলে, পরিষ্কারভাবে আমায় বিজয়াশীর্বাদ তুমি কেন করছ না?’ মাতা বললেন, - ‘এই যুদ্ধটা উভয় পক্ষ থেকেই অধর্ম যুদ্ধ অথবা এমনও বলা যায়, যুদ্ধ মানেই অধর্মাচরণ। তুমি এই যুদ্ধের অন্যতর হোতা! পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমাদের বিরোধ, নিরঙ্কুশ রাজশক্তি অধিকারের। প্রজার স্বার্থ বা কল্যাণের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। এই যুদ্ধে যদি কেউ লাভান্বিত হয়, তবে তারা বণিক, শ্রেষ্ঠী, ব্যবসায়ীকুল। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে কৃষককুল। তাদের শস্য সম্পদ সৈন্য চালনার কারনে ব্যাপক বিনষ্ট হয়। প্রকারান্তরে যুদ্ধব্যায় বহন করতে হয় কৃষকশ্রেণীর এবং সাধারণজনের। তাদের উপর এই বোঝা চাপানোই ব্যাপক অধর্ম। সার্থবাহ, বণিক এবং ব্যবসায়িক যারা, তারা দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটিয়ে তাদের ক্ষতি পূরণ করার চেষ্টা করবে। বিজয়ী বা বিজিত কেউই এ ব্যাপারে লাভান্বিত হবে না। আমি তোমাদের সকলেরই মাতা এবং কল্যাণকামী। সেখানে বিশেষ কারুর বিজয় কামনা আমার ধর্ম হতে পারে না। সকলের জন্যই আমার আশীর্বাদ - ‘জীরাতবে ন মৃত্যবে’। জেতু জেতু মানব কল্যাণঃ।'

তুমি যে ধর্ম অবলম্বন করে চলেছ বলছ, সেই প্রজার স্বার্থে তো তুমি তাদের জন্য যুদ্ধে নামনি। সুতরাং আমি ধর্মপথে নেই। যদিও কৃষ্ণ এই যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ বলেছে, কিন্তু আমি বলছি, ওই মানুষটি যেদিন পাণ্ডব-কৌরবের মাঝে উপস্থিত হয়েছে, সেদিনই তাদের মাথার উপর শকুনের ছায়া পড়েছে। সে নিজেই এক একক ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার নামে মূর্তিমান অধর্মরূপে অধিষ্ঠান করছে। ভবিষ্যৎ আর্যাবর্ত যুগ যুগ ধরে এর প্রতিফল ভোগ করবে।'

প্রশ্ন করেছিলাম - ‘মাতঃ, তথাপি দুই পক্ষের কারুর জয় বা বিজয়ের একটা সম্ভাবনা থাকে, সেখানে কেইবা জিতবে, কেইবা হারবে?’ মাতা বললেন - ‘যারা ক্ষমতা হারাবে তারাও হারবে, যারা ক্ষমতা লাভ করবে তারাও শেষ বিচারে হারবেই। সূক্ষ্ম বিচারে দেখলে, দেখা যাবে, যুদ্ধের লব্ধ ফল, সব পক্ষেই একটা - সেটা ধ্বংস। তাই তুমি যেমন আকাঙ্খা কর, আমি তেমন আশীর্বাদ করতে পারি না। আমি শুধু জানি, যুদ্ধ মানব জাতির একান্তই অধর্মের কাজ। বিশেষ করে এই যুদ্ধটিতো উভয় পক্ষের দিক দিয়েই অধর্ম।' মাতার কথা শুনে, তথাপি আমার চৈতন্য হয়নি। মাতা প্রাজ্ঞচিত বক্তব্যই বলেছিলেন। মাতা এও বলেছিলেন - ‘বৎস, তোমাদের এই তথাকথিত জয় বা পরাজয় উপলক্ষে রথী, মহারথী, অর্থাৎ বীরেদের উপর সাধারণ সৈন্যরা অস্ত্রাঘাত করতে পারেনা। কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থেকে তাঁরা নির্বিচারে সৈন্যদের বধ করতে পারেন।'

চারদিক শৃগাল, কুক্কুর এবং অন্যান্য শ্বাপদজাতীয় প্রাণীরা যুদ্ধে হত অসংখ্য যোদ্ধাদের শবদেহ ভক্ষণ করছে। মাঝে মাঝে তাদের নিজেদের মধ্যে হিংস্র কাড়াকাড়ির গর্জন শোনা যাচ্ছে। মনে হল, এও তো কৌরব-পাণ্ডব কুলেরই হিংস্র আচরণতুল্য। আমরা ভূমি নিয়ে পরস্পরের প্রতি তো এরূপই জিঘাংসার প্রকাশ ঘটিয়েছি। পার্থক্য কোথায়? বন্য এবং গৃহপালিত পশুর সহিত লোভী মানুষদের মৌল প্রকৃতির কোনও পার্থক্য নেই। বরং হিংস্র প্রাণীরা অপেক্ষাকৃত ভাল। তারা লোভের পরবশ হয়ে পরস্পরের প্রতি দাঁতে-নখে যুদ্ধ করে না, করে শুধুমাত্র ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্য আহার্য সংগ্রহের জন্য। মানুষের ক্ষেত্রে ক্ষুধা নিবৃত্তির নানান উপায় থাকা সত্ত্বেও লোভ, হিংসা ইত্যাদির কারণে তারা একে অন্যের প্রতি হিংস্র আচরণ করে। একে কোনও অর্থেই ধর্ম আখ্যা দেওয়া যায় না।

ভীম ক্রোধ পরবশ হয়ে শপথ করেছিল, সে দুঃশাসনের বক্ষরক্ত পান করবে, তার বক্ষ বিদীর্ণ করে। ক্রুদ্ধাবস্থায় মানুষ অনেক কিছুই অসম্ভব শপথ করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে সেই সব শপথ কার্যে পরিণত করা যে কতটা বীভৎসতা এবং অধর্মের কর্ম হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার সেই রক্ত পান করে সে সকলকে ডেকে ডেকে বলেছিল - ‘দেখ, দেখ, আমি এই দুরাত্মার বক্ষ-শোনিত পান করছি। আমি জীবনে বহুবিধ সুস্বাদু খাদ্য পানীয় গ্রহণ করেছি, কিন্তু এই বক্ষরক্তের তুল্য সুস্বাদুতর আর কিছুই কোনওদিন আস্বাদ করিনি।' ভীমের ওরূপ আচরণ দেখে রণক্ষেত্রের কৌরব এবং পাণ্ডব সৈন্যদের প্রত্যক্ষদর্শীরা সবাই পলায়মান হয়েছিল। এর চাইতে দাঁতে নখে আর কোন পাশবিক আচরণই বা হতে পারে? এক্ষেত্রে আবার দাঁত নখ ছাড়া মানুষের অন্য একটি অদৃশ্য অস্ত্র আছে, যেটি সর্ব অস্ত্রের সেরা সেটি তার হিংস্র বুদ্ধি। পশুরা অন্তত সেদিক থেকে নিরাপদ। পশুরা হিংস্র হলেও সে শুধু প্রকৃতির বশেই চলে। মানসিক হিংস্রতা তার মধ্যে থাকে না।

মাতা বলেছিলেন, ‘যে যুদ্ধ প্রজা-সাধারণের স্বার্থে, একমাত্র সেটাই ধর্মযুদ্ধ।' আমাকে সকলে প্রজাবৎসল তথা তাদের কল্যাণকামী বলে জানে। অথচ, মাতার এই বাক্যেও আমি কর্ণপাত করিনি। ক্ষমতার লোভ এমনই শক্তিধর। ক্ষমতার লিপ্সা এবং প্রতিশোধ স্পৃহা, এই দুয়ে মিলে আজ রজনীতে কী নরকের সৃষ্টি করবে কে জানে? এতসব বুঝেও আমি অপেক্ষা করে আছি কতক্ষণে অশ্বত্থামা ইত্যাদি আমার জন্য সেই হর্ষ সংবাদ নিয়ে আসে, যা শুনে আমি শেষ সময়েও অন্তত তৃপ্তি পেতে পারি। আমার আশা, তাহলেই আমার মৃত্যু সার্থক হবে। সর্বাঙ্গে অশেষ বেদনা এবং যন্ত্রণা। তথাপি বেঁচে আছি শুধু একটা প্রায় অসম্ভব প্রাপ্তির জন্য, পাণ্ডবদের ধ্বংস।

ক্রমে অন্ধকার নেমে চারদিক আচ্ছন্ন করছে। যুধক্ষেত্রে মৃত সৈন্যদের আত্মপরিজনেরা মশাল হাতে নিয়ে তাদের জনেদের সন্ধান করছে। দূরে তাদের বাহিত আলোক মশালের ঔজ্জ্বল্য দেখতে পাচ্ছি। আমি পড়ে আছি এক নির্জন প্রান্তে স্যমন্তপঞ্চকের কিনারে।

আমি একটা ব্যাপার বুঝি না, যুধিষ্ঠির এতটা স্থিতধী এবং বিচক্ষণ হয়েও কিভাবে খাণ্ডবদাহে কৃষ্ণার্জুনকে সম্মতি দিলেন এবং কিভাবেই বা রাজসূয় যজ্ঞে এতটা প্রদর্শনী অনুমোদন করলেন। আমার বিচারে এই দুটো সংঘটনই পরবর্তী ঘটনাসমূহের আবাহন করেছে। ভূমি আবাদ করা, ফসলের উৎপাদন করাই যদি খাণ্ডবদহনের কারণ হয়, তাহলে সে ব্যাপারে অরণ্য এবং আরণ্যক অধিবাসীদের এত অধিক মাত্রায় নিধন তো প্রয়োজন ছিল না। আবাদ করার কার্য আরণ্যক অধিবাসীরাও করে থাকে, কিন্তু তার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। প্রকৃতিতে যেসব প্রাণী, উদ্ভিদ, কীট, পতঙ্গ ইত্যাদি রয়েছে, সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষার জন্য এর সব কিছুরই সংরক্ষণ প্রয়োজন। রাজসূয় যজ্ঞের সভামণ্ডপ রচনাকে অদ্বিতীয় মণ্ডপ রূপে রূপ দিতে কৃষ্ণের পরামর্শে দানব শিল্পি ময় এই কার্যটি করে। পাণ্ডবদের মাথায় এতসব আসেনি। কিন্তু যুধিষ্ঠির তো আমার দোষগুণ সব অবগত ছিল, সে কেন বুঝল না, বিষয়টা আমার ঈর্ষা বৃদ্ধি করতে পারে?

রাজসূয় না হলে, কৃষ্ণের সব চাইতে বড় শত্রু জরাসন্ধকে নিধন করা যায় না, একথা কৃষ্ণ খুব ভাল করেই জানত। আসলে রাজসূয় যজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে সম্পন্ন না করাতে পারলে তাকে চক্রবর্তী সম্রাট রূপে প্রতিষ্ঠা দেওয়া যায় না। প্রশ্ন উঠতে পারে কৃষ্ণ নিজে কেন যজ্ঞটা করল না। সেটা সম্ভব ছিল না, কারণ কৃষ্ণ রাজা ছিল না। রাজা না হলে রাজসূয় করা যায় না। কৃষ্ণ চক্রবর্তী সম্রাটের চাইতেও বৃহত্তর ক্ষমতার অধিকার চেয়েছিল। সেটা বাসুদেবত্ব, যেটা লাভ করলে, চক্রবর্তী সম্রাটও তার অধীনে থাকবে। জরাসন্ধ কংসের শ্বশুর এবং প্রবল প্রতাপশালি। পার্শ্ববর্তী রাজ্যের ক্ষুদ্রবৃহৎ রাজন্যরা কীকট জাতীয়দের আবাদিত ভূমি বহুকাল ধরে অধিকার করে নিচ্ছিল। এরকম অনেক রাজাকে জরাসন্ধ হত্যা করার জন্য বন্দী করে রেখেছিল, যাতে কীকট জাতীয়দের প্রতি তারা আর অত্যাচার না করতে পারে। কথিত আছে, এই রাজাদের সংখ্যা শতজন হলে, সে তার আরাধ্য দেবতা মহেশ্বরের নিকট বলি প্রদান করবে। কিন্তু এই কথাটা আমার নিছক লোক-প্রবাদ বলেই মনে হয়। তবে একথা সত্য যে জরাসন্ধ মহাশক্তিধর রাজা। সমগ্র মগধ তার অধীন। মগধের দক্ষিণ ভাগের বিস্তীর্ণ অরণ্য হল কীকট জাতীয়দের বাস। এরা সবাই কোল জাতীয় মানুষ। জরাসন্ধ রাজাকল্পে তাদের প্রতি যথার্থ কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। তার সৈন্যবাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য এই কীকটদের মধ্য থেকেই সংগৃহীত। তারা সবাই উত্তম যোদ্ধা। তাদের বিক্রমেই কৃষ্ণ এবং যাদবদের মথুরা পরিত্যাগ করে সুদূর দ্বারকায় পলায়ন করে, নতুন রাজ্য রাজধানী এবং বসতি স্থাপন করতে হয়েছিল। এই যুদ্ধে এরা আমার পক্ষ অবলম্বন করেছিল।

মগধরাজকে আকস্মিক আক্রমণে হত্যা করার জন্য কৃষ্ণের ভীম এবং অর্জুনের সহায়তার প্রয়োজন ছিল। কৃষ্ণ জানত সম্মুখ যুদ্ধে, জরাসন্ধের চতুরঙ্গ সেনার সহিত প্রথাগত যুদ্ধে তাকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে না। তাকে নিপাত করার একমাত্র উপায় গুপ্ত হত্যা। জরাসন্ধ অতীব চতুর যোদ্ধা। সুতরাং নিজেদের পরিচিতি গোপন না করে তাকে পর্যুদস্ত করা সহজ হবে না। তাই তারা ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে গিরিব্রজপুরের পার্বত্য গোপন পথে পুরীতে প্রবেশ করে সরাসরি তার মল্লাগারে গিয়ে উপস্থিত হল। জরাসন্ধ কৃষ্ণকে চিনত, কিন্তু ভীমার্জুন তার পরিচিত ছিল না। ভীম সরাসরি তার নিকট উপস্থিত হয়ে মল্লযুদ্ধের স্পর্ধা জানায়। এও বলে যে তার দুজন সঙ্গীও আছে। জরাসন্ধ ইচ্ছে করলে তাদের যে কোনও একজনের সহিত যুদ্ধ করতে পারে। নানা কথার পর জরাসন্ধ ভীমকেই তার প্রতিপক্ষরূপে নির্বাচন করে। ভীম অবশ্যই অত্যন্ত বলশালি, কিন্তু সে যুদ্ধের কৌশল বা নিয়ম বিষয়ে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল নয়। আমার সহিত গদাযুদ্ধে সে যেমন অন্যায় যুদ্ধ করেছিল, জরাসন্ধের সঙ্গে মল্লযুদ্ধেও সে জ্ঞানুপূর্ব অন্যায় যুদ্ধই ক’রে তাকে বীভৎসভাবে হত্যা করে।

জরাসন্ধ বধে কৃষ্ণের চক্রান্ত এবং ভীমের নীতিহীন যুদ্ধ এবং অর্জুনের কৃষ্ণ পক্ষপাতিত্বই একমাত্র দায়ী। এর মধ্যে বীরত্ব যোদ্ধজনোচিত নীতিবোধ কিছুই ছিল না। কৃষ্ণের নীতিই ছিল “মারি অরি পারি যে কৌশলে”। কৃষ্ণের শিক্ষা ছিল, - ‘যুদ্ধে প্রেমে এবং প্রাণসংশয়ে মিথ্যে অবলম্বনে দোষ নেই’। সে বলত যে এটি যোগাচার - “য়োগা কর্মসু কৌশলম্‌”। কৃষ্ণের বিচারে কোন বিষয়টা যে ‘যোগা’ আর কোনটা তার কূটচক্রী বুদ্ধি সেটা বোঝা সহজ নয়। আবার সে এও বলে, ‘যোগা চিত্তবৃত্তি নিরোধাঃ।' কিন্তু তার চিত্তবৃত্তি নিরোধের কোনও লক্ষণ তো কখনওই দেখলাম না। অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা, কৃপাচার্য ইত্যাদির নৈশ অভিযানের ষড়যন্ত্র যে কৃষ্ণের ধারণায় থাকবে না। বিশেষ করে অশ্বত্থামার পিতৃ নিধনের ন্যায্যতাবিহীন কার্যের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রচেষ্টা যে সে চালাবে না, এটা বিশ্বাস করার মত সরলবুদ্ধির মানুষ আর যেই হোক কৃষ্ণ অন্তত নয়। সেই মর্মে সে কী ‘যোগাচার’ করবে বলা দুষ্কর। কৃষ্ণ তো জানতই যে, আমার পক্ষে এখনও এই তিন যোদ্ধা জীবিত আছে। সুতরাং নিঃসন্দেহে তারা, বিশেষ করে অশ্বত্থামা, পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ প্রচেষ্টা করতেই পারে।

অশ্বত্থামাকে সে সবিশেষ জানে। পিতামহ ভীষ্ম তার বিষয়ে বলেছিলেন, ‘অশ্বত্থামাকে রথী বা মহারথী রূপে আখ্যাত করার একটাই বাধা, সে মাত্রাধিকরূপে প্রাণের ভয়ে ভীত। নচেৎ তার শিক্ষা, যুদ্ধকৌশল, অস্ত্রচালনায় পারদর্শিতার জন্য সে মহারথী আখ্যা পাওয়ার যোগ্য। কৃষ্ণ কথাটা জানে। সে অবশ্যই অশ্বত্থামার উদ্দেশ্য অনুমান করবে বলেই মনে হয়। তবে সে কৌশলটা কি নেবে চিন্তা করার মত শারিরীক বা মানসিক শক্তি আমার আর বর্তমান নেই। অশ্বত্থামার তো ততটা বুদ্ধিও নেই। দেখি, অবস্থা কি দাঁড়ায়। আমার তো আর হারাবার কিছুই নেই, সুতরাং যন্ত্রণাবিদ্ধ শরীর মন নিয়ে অপেক্ষায়ই থাকি।



(ক্রমশ)

(পরবাস-৭৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)