ঘরে কম পাওয়ারের বালবের ম্যাড়ম্যাড়ে ময়লা আলো। তবুও ঘরের ভেতর ঢোকবার সাহস জোগাতে তা-ই যথেষ্ট। হারার পড়শি কাকারা ঘরে ঢুকল। ঢুকেই নাক সিঁটকালো, অর্থাৎ ঘরের বিকট বদবু ওদের নাকেও ধাক্কা মেরেছে। দুজনেই পকেট থেকে রুমাল বার করে নাকে চাপা দিল, তারপর এগিয়ে গিয়ে সুলোচনার কাছে দাঁড়াল। ওদের পেছনে পেছনে হারাও গেল।
সুলোচনা মেঝেয় কেবল শুয়ে নেই, একরকম পড়ে আছে বলা যায়। ওর চারপাশে বমি আর শরীরের নোংরা, মুখে আর তার চারপাশেও বমি শুকিয়ে আছে। চোখ দুটোর সাদা জায়গায় রক্ত জমে আছে। ও দুটো অস্বাভাবিকভাবে খোলা, দেখে মনে হচ্ছে ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। এই অসহনীয়, তীব্র দুর্গন্ধটা বেরোচ্ছে ওর শরীর আর তার চারপাশের শুকিয়ে থাকা নোংরা থেকেই। নিজের অজান্তেই হারা দু’পা পিছিয়ে গেল। তার পরেই ওর নজর পড়ল দেয়ালের তাকে রাখা ইঁদুর মারা বিষের শিশিটার ওপর। হারার বেশ মনে আছে, ও যখন মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বেরিয়ে গিয়েছিল তখন শিশিটা পুরো না হলে অনেকটাই ভর্তি ছিল। এখন ওটা খালি। হারা তার বলাই কাকার বাহুতে আস্তে আস্তে টোকা দিল। লোকটি নাকে শক্ত করে রুমাল চেপে ধরে সুলোচনার নাকের সামনে আঙুল রেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল মেয়েছেলে বেঁচে আছে নাকি টেঁসে গেছে। হারার টোকা পেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকে ফিরে তাকাল। হারা ওকে আঙুল দিয়ে ঐ খালি শিশিটা দেখাল। তারপর দৌড় মারল কলঘরের দিকে। ভয়ে, উৎকন্ঠায় ওর তলপেট এখন খুব ভারি হয়ে গেছে। কলঘরে যেতে দেরি হয়ে গেলে ও হয়তো ওর প্যান্টই ভিজিয়ে ফেলবে।
হারা যখন ফিরে এল তখন ওদের ঘরের দরজার সামনে বেশ একটা ভীড় জমে গেছে। পুরুষ, মেয়েছেলে সবাই আছে। দরজার চৌকাঠের ভেতর দিকে কেউ নেই, কারণ সুলোচনার শরীরটা চৌকাঠ থেকে একটু ভেতরেই পড়ে আছে। অনেক মেয়েছেলেরা ভীড়ের ভেতর দিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। তারা বেঁচে থাকা সুলোচনা কিরকম দেখতে ছিল তা জানত, এখন মরে গিয়ে সুলোচনা কেমন দেখতে হয়েছে সেটা জানতে চায়। হারা ঐ জটলার ভেতর লতিকা মাসিকে দেখতে পেল, উত্তেজিতভাবে হাত মুখ নেড়ে আর একজন মেয়েছেলেকে কি সব বোঝাচ্ছে। হারার মাথা ভাল কাজ করছিল না। লোকজনের টুকরো টুকরো কথাবার্তা অস্পষ্টভাবে ওর কানে আসছিল — এদানি তো মেয়েটার চরিত্তির খারাপ হয়ে গিয়েছিল, ঘরে লোক আনত — সে তো বেশ কয়েকবছর আগেকার কথা, অনেকদিন হয়ে গেল ওসব আর করত না — ছেলেটা রোজগারপাতি করতে শিখলে না, সে দুঃখটা তো ছিল — এখন পুলিশে খবর দিতে হবে, ওরা লাশ নিয়ে যাবে, কাটাছেঁড়া করবে — তার আগে বাড়িওয়ালাকে ডাকা দরকার — কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ বিষ খেতেই বা গেল কেন? ওর ছেলের সঙ্গে কোন ঝামেলা হয় নি তো? — এই ছোঁড়া, তোর মায়ের সাথে ঝগড়া করিস নি তো? —
হারার বুদ্ধি গুলিয়ে গেলেও একটা কথা ও পরিষ্কার বুঝে নিয়েছিল। কোনমতেই কাউকে বলা চলবে না যে ওর সঙ্গে ওর মায়ের খুব বিশ্রী একটা ঝগড়া হয়েছিল, কি বলে ও সুলোচনাকে গাল দিয়েছিল। তাহলে ওর মায়ের আত্মহত্যার সব দোষ ওর ঘাড়েই এসে পড়বে, সবাই ওকেই দোষ দেবে, একটা লোকও ওর হয়ে একটা আঙুল পর্যন্ত তুলবে না। ও খুব ভালমানুষের মত মুখ করে বলল, না তো, আমাদের ভেতর কখনো কোন কথা কাটাকাটি পর্যন্ত হয় নি। কিন্তু আজকাল মা প্রায়ই গুম মেরে বসে থাকত, কাজে বেরোতে চাইত না, কোন কথা বললে জবাব দিত না। মা এরকম করত, তবে আর কিছু করতে কখনো দেখি নি।
ভীড়ের ভেতর একটা লোক বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওকে বলে অবসাদ। ও একরকম মনের অসুখ, এরকম অবস্থা বেশিদিন চললে মানুষ আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে।
লোকটার এই পাণ্ডিত্য জাহির করার কারণ ছিল। আজই একটা খবরের কাগজে বেরিয়েছে, খবরে একটা কলেজের পড়ুয়া যুবতির গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার কথা খুব রসিয়ে লিখেছে। মেয়েটা নাকি বেশ কিছুদিন ধরে অবসাদে ভুগছিল।
ঐ লোকটার ওই কথাটা বলায় হারা হাঁপ ছাড়ল। কারণ ওই লোকটার কথা শুনে সবাই সুলোচনার উন্মাদ রোগ দেখা দিয়েছিল কিনা সেই আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মেয়েছেলেদের অনেকে, বিশেষ করে লতিকা সুলোচনাকে জড়িয়ে আগেকার অনেক ঘটনা বলে আর সবাইকে বোঝাতে লাগল যে তখন থেকেই সুলোচনার পাগল হয়ে যাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। মেয়েরা অনেকেই একসঙ্গে কিছু না কিছু বলার চেষ্টা করছিল, ওরা কেউ-ই অন্য কারোর কথা খুব একটা কানে নিচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল না।
এই সব হৈ হট্টগোল চলছে, এর মধ্যেই বাড়িওয়ালা এল। ওকে কে খবরটা দিয়েছিল সেটা হারার জানা নেই। আর এসেই লোকটা হারার ওপর চীৎকার শুরু করে দিল। তোর মা মাগি একমাসের ভাড়া বাকী ফেলেছে, তা এখন কে দেবে? অবলা মেয়েছেলে, বাড়ির পুরুষটা ফেলে রেখে পালিয়েছে, সেই দয়াতে ঘাড় ধরে বার করে দিই নি। এখন তুই ভাড়ার পাই পয়সা মিটিয়ে দিবি, নইলে তোকে আর ওঘরে ঢুকতে দেব না — ওর ঘর থেকে একটা জিনিষও নিয়ে যেতে পাবি না।
লোকজনের ভীড় ততক্ষণে আরও বেড়ে গেছে। অনেকেই নিজের ঘরে তালা লাগিয়ে এখানে তামাশা দেখতে জড়ো হয়ে গেছে। তাদের বালবাচ্চারাও এখানে জুটে গেছে — একটা মেয়েছেলে বিষ খেয়ে ঘরে পড়ে আছে, এরকম ঘটনা তো তারা তাদের জন্ম থেকে কখনো দেখে নি। ভীড়ের ভেতর থেকে একটা মেয়েমানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, ও ঘরে আর সাহস করে ঢুকবে কে? সুলোচনা পেত্নী হয়ে পাহারা দিচ্ছে, কেউ ও ঘরে ঢুকলে তার ঘাড়ে চেপে বসবে না?
কথাটা শুনে অনেকে হেসে উঠল, কিন্তু বাড়িওয়ালা কটমট করে তাকাল সেই মেয়েছেলেটির দিকে। এ কথাটা এতক্ষণ তার খেয়াল হয় নি। সত্যিই তো, হারাকে ঘর থেকে বার করে দেবার পরেও কি সহজে ও ঘর ভাড়া দেয়া যাবে? আর না যদি দেয়া যায় তাহলে তো ঐ ঘরটাই বরবাদ। ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক করে ভূত তাড়াতে হবে, আর পুরুৎকে দিয়ে শান্তি স্বস্তয়ন। একগাদা টাকা খরচা হবে। লোকটা ভয়ঙ্কর চটে গেল সুলোচনার ওপর। মাগি, মরবি তো মরবি রাস্তায় গিয়ে মরতে পারলি না? যে ঘরটায় শুয়ে পড়ে মরলি সেটা কি তোর বাপের?
ভীড় আরও বেড়ে যাচ্ছিল। অনেকে চেষ্টা করছিল ভীড় ঠেলে দরজার সামনে গিয়ে সেখান থেকে সুলোচনার কাঠ হয়ে মেঝেয় পড়ে থাকা দুর্গন্ধ ছড়ানো শরীরটা একবার দেখে নিতে। কিন্তু কেউ-ই ঘরের ভেতরে পা দিচ্ছিল না। কি জানি সত্যিই যদি সুলোচনা ভূত হয়ে ঘরের ভেতরে থেকে থাকে? দরজার বাইরে অবশ্য তাদের কোন ভয় নেই, সুলোচনার ভূত দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের বাইরে নিশ্চয়ই আসতে পারবে না।
হারা একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। ওকে অনেকে অনেক প্রশ্ন করছিল। ও কাউকে ভাসা ভাসা জবাব দিচ্ছিল, অনেক কথার কোন জবাব দিচ্ছিল না, খালি ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। এ সব কি সত্যি? এই যে ঘরের ভেতর নোংরা দুর্গন্ধ ক্লেদের ভেতরে ওর মা কাঠ হয়ে মরে পড়ে আছে, দরজার বাইরে এত লোকের ভীড় জমে আছে — এসব বোধহয় সত্যি নয়। ওর এখন খিদে পেয়ে গেছে, এক্ষুণি মা খেতে ডাকবে, খেতে বসলে পরে থালায় করে সামনে ধরে দেবে রুটি আর আলু চচ্চড়ি। আবার ও সচেতন হয়ে উঠছিল, নিজেকে বোঝাচ্ছিল, মা নেই, মা মরে গেছে, মার আর কোনদিন উঠবে না — মা মরে গেছে বলে এই সব লোকজন জড়ো হয়েছে ওদের ঘরের সামনে। এরপর আবার পুলিশও আসবে। পুলিশের কথা ভাবতেই ওর একটু ভয় ভয় করতে লাগল। ওরা এসে নিশ্চয়ই জানতে চাইবে ওর সঙ্গে ওর মায়ের কোন ঝামেলা হয়েছিল কিনা। হারা ওদের কিছুতেই তা জানতে দেবে না। জানতে পারলে পুলিশ ওকে ঘাড় ধরে থানায় নিয়ে যাবে। আর নিয়ে গিয়ে তো ফুলচন্দন দিয়ে পুজো করবে না, দেবে বেধড়ক মার।
পুলিশ এসেছিল আরও কিছুক্ষণ পরে। বোধহয় বাড়িওয়ালাই খবর দিয়েছিল। তারই তো গরজ। পুলিশ আসবে, তবে না ঘর থেকে মড়া বেরোবে। আর সুলোচনা আত্মঘাতী হয়েছে, ওর মড়া তো এমনি এমনি পোড়ানো যাবে না। শরীর এখন কাটাছেঁড়া হবে। তারপর পুলিশ ঐ মড়া ছাড়বে, তবে তো মুর্দা সুলোচনাকে পোড়ানো যাবে।
অনেক রাতে হারা ওদের দরজার বাইরে লম্বা বারোয়ারি বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে চুপচাপ পা গুটিয়ে বসেছিল। এখন আর ধারে কাছে লোকজন নেই। জড়ো হওয়া সব লোকের তামাশা দেখা শেষ হয়ে গেছে, যে যার ঘরে ঢুকে পড়েছে, চারপাশের সব ঘরের দরজা এখন বন্ধ। পুলিশ মায়ের মড়া নিয়ে গেছে, ওদের ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে তাতে সীল করে দিয়ে গেছে। এখন খিদেয় ওর পেট জ্বলে যাচ্ছে, কিন্তু পড়শিরা কেউই ওকে কোন খাবার দেয় নি, ঘরে ডেকে নিয়ে খেতে দেয়া তো দূরের কথা। রাতে ওর শোবার কোন জায়গা নেই, তা নিয়ে কেউ কোন মাথা ঘামায় নি। হারা এখন একটা উটকো ঝামেলা, কে শখ করে ঘাড়ে নিতে যাবে? লতিকামাসি ওকে বলেছে, হারা, তুই এখন কোথায় থাকবি — তোর মামার বাড়ি চলে যা। একথা বলে নিজের ঘরের দিকে হেলেদুলে হেঁটে চলে গিয়েছে। পড়শিদের মধ্যে একমাত্র লতিকাই জানত যে সুলোচনার একজন দাদা আছে। হারাও সেটুকুই জানে। সে মামার নাম কি, সে কোথায় থাকে, কিছুই হারা জানে না। জানার কথাও নয়। ওর বাপ ভেগে যাওয়ার পর ওর মামা একদিন ওদের বাড়ি এসেছিল। ওর বাপের কাছে সেই মামার নাকি টাকা পাওনা ছিল তা চাইতে। ওর মায়ের সঙ্গে ওর মামার খুব ঝগড়া হয়েছিল, খুব রাগ করে ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছিল ওর মামা। হারা তখন ছোট, ঘটনাটার এটুকুই ওর মনে আছে। ওর মামা বেঁচে আছে কিনা তাই-ই হারার জানা নেই। আর লতিকামাসি বলে মামার বাড়ি চলে যেতে। হারার হাসি পেল, একটু রাগও হয়ে গেল। মাসি না কচু — উজবুকের মত কথা বলে।
কিন্তু একটা কথা হারার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল — ভয়ংকর বাস্তব তার আসল চেহারা নিয়ে ওর একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যতই খাণ্ডার হোক, মা-ই ছিল আশ্রয়। মা-ই ছিল খিদের সময় থালায় সাজানো ভাত, মা-ই ছিল ঘুমের সময় মাথার ওপরে ছাদ। এখন হঠাৎ থালার ভাত হাওয়া হয়ে গেছে, মাথার ওপরের ছাদ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে। এখন হারা কি করবে, কোথায় জায়গা পাবে? ওর তো বিশেষ কোন রোজগার নেই, ও খাবে কি, বাঁচবে কিভাবে? ওর নিজের ওপর রাগ হতে লাগল। ও কেন মায়ের সেই ভাবের লোকের কথা তুলে মা-কে গালাগাল দিতে গেল? আর মা-টাও কি খচ্চর দ্যাখো, বিষ খাবার সময় একবার ভাবলি না ছেলেটার কি হবে? নিজে তো মরলি-ই, পেটের ছেলেটাকেও মেরে রেখে গেলি।
পেটে প্রচণ্ড খিদে, কাল সকাল থেকে কি হবে এই চিন্তা, এসব থাকতেও ও বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওই ঘুমের মধ্যেই ওর মনে হল ওর মাথায় কেউ হাত রেখেছে। পুরুষমানুষের হাত নয় — হাতটা ভারি নরম আর ঠান্ডা, হাতটার ছোঁয়া খুব আদরের, বড় শান্তির। মা কি ফিরে এল? মা কি মাথায় হাত রেখে আদর করছে? এক্ষুনি কি থালায় করে খাবার দেবে? আঃ, হারা পেট পুরে খাবে, তারপর মায়ের পেতে দেয়া বিছানায় আরাম করে ঘুমোবে।
হারার চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আছে, ও চেষ্টা করে চোখ খুলল।
ওর মাথায় হাত রেখেছে সামনে দাঁড়ানো লক্ষ্মীমাসি, তার পেছনে দাঁড়িয়ে গৌরা। হারার ঘুমের ভাবটা কেটে গেল, লক্ষ্মীমাসির ওপর একটু অভিমানও হল। লক্ষ্মীমাসি এতক্ষণ কেন আসে নি? কিন্তু তার পরেই ও বুঝল। লক্ষ্মীমাসি মায়ের খবরটা নিশ্চয়ই আগে পায় নি। কি করে পাবে? এক তো লক্ষ্মীমাসি ওদের থেকে একটু দূরে থাকে, তার ওপর রান্নার কাজের বাড়িগুলোর থেকে ফিরতে লক্ষ্মীমাসির বেশ একটু দেরি হয়। অনেক দিনই সন্ধে পার হয়ে যায়। আজ বোধহয় এতক্ষণে ফিরেছে, ফিরে বাতাসি বা গৌরার মুখে খবরটা শুনেছে। হারাদের এখানে ছেলেমেয়েদের ভেতর ওই দু ভাইবোনের অনেক বন্ধু আছে, বিশেষ করে বাতাসির, ওই বন্ধুদের কারোর কাছ থেকেই ওরা শুনেছে। লক্ষ্মীমাসি ঘরে ফিরে যেই খবরটা শুনেছে অমনি গৌরাকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে এসেছে। আগে খবরটা পেলে নিশ্চয়ই আরও আগে আসত।
হারা, তুই আমার সঙ্গে চল, লক্ষ্মীমাসি বলল। এখন থেকে তুই আমার বাড়িতেই থাকবি। এ ঘরে অভিশাপ লেগেছে, এখানে তোকে আর থাকতে হবে না।
সেই থেকে লক্ষ্মীমাসির কাছে থাকতে শুরু করেছিল হারা। এ ঘরে আর ফেরে নি। মড়াঘরের থেকে মায়ের কাটাছেঁড়ার পর সেলাই হওয়া শরীরটা নেওয়া, সেটা শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পোড়ানো, নমো নমো করে মায়ের শ্রাদ্ধ করা, এসবই হারা করেছিল লক্ষ্মীমাসির বাড়ি থেকে। পুরোনো পড়শিরাও ওকে সাহায্য করেছিল। লতিকামাসির তাড়া খেয়ে তার কর্তাও এসে ও সব ব্যাপারে হারাকে সাহায্য করেছিল। এমনকি ওর আগের বাড়িওয়ালাও এসেছিল — শ্মশানে মড়া নিয়ে যাওয়া, শ্রাদ্ধের পুরুৎ জুটিয়ে আনা এসবে খুব সাহায্য করেছিল। অবশ্যি তার কারণ ছিল। বকেয়া ঘর ভাড়া, ঐ ঘর পরিষ্কারের খরচা, এসব লক্ষ্মীমাসি লোকটার হাতে ধরে দিয়েছিল। বাড়িওয়ালা সুলোচনার বাসন কোসন, ওদের দুজনের জামাকাপড়, এসব লক্ষ্মীমাসির বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। লক্ষ্মীমাসি অবশ্যি সেসব কোন কিছু নিজের কাছে রাখে নি, এদিকে ওদিকে বিলিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ঐ অভিশাপ লাগা ঘরে রাখা জিনিষ ব্যবহার করার কোন দরকার নেই। হারাকে নতুন জামা প্যান্ট কিনে দিয়েছিল, কিছু বানিয়ে দিয়েছিল। নতুন জামা প্যান্ট পেতে যে কটা দিন লেগেছিল সেই কদিন হারা গৌরার জামা প্যান্ট পরে কাজ চালিয়েছিল। দুজনের গায়ের মাপ প্রায় এক, ওসব জামা পরে হারার কোন অসুবিধে হয় নি।
লক্ষ্মীমাসির বাড়িতে হারা বেশ ভালই ছিল। দুবেলা লক্ষ্মীমাসির হাতের রান্না খাওয়া, নিজের যা রোজগার তা দিয়ে বিড়ি সিগারেটটা খাওয়া, ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে দু-এক বাজি তাসের জুয়া খেলা। মাঝে মাঝে ওর এ-ও মনে হয়েছে যে মা মরে গিয়ে ওর হয়তো ভালই হয়েছে। সেই একঘেয়ে রুটি আর আলুর চচ্চড়ি, লক্ষ্মীমাসির বাড়ির খাবারের তুলনায় একেবারে ছাইপাঁশ। রোজগার করার জন্যে, বাড়িতে টাকা দেবার জন্যের কোন খিটখিট নেই — লক্ষ্মীমাসি ওসব নিয়ে একটা কথাও বলে না। গৌরাটা অবশ্য খচ্চর, ও ওদের বাড়িতে হারার থাকাটা ভালভাবে নেয় নি। ও মাঝে মাঝে গৌরার দিকে রাগের চোখে তাকাত, হাবে ভাবে ওর বিরক্তিটা বুঝিয়ে দিত। সেটা ভালই বুঝতে পারত, কিন্তু সে সব গায়ে মাখত না। গৌরাকে বেশি পাত্তা না দিলেই হল। বাতাসির অবশ্য হারাকে নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। হারার ওদের বাড়িতে থাকা আর না থাকা ওর কাছে একই ব্যাপার ছিল।
লক্ষ্মীমাসির কিন্তু অন্য চিন্তাভাবনা ছিল। হারাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসার কিছু দিন পরেই ওকে নিজের বাড়িতে পাকাপাকিরকম থাকবার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। বাতাসি ছোটবেলায় ইস্কুলে পড়েছিল, সেই ইস্কুলের কাগজে ওর জন্ম তারিখ লেখা ছিল। লক্ষ্মীমাসি দুই ছেলেমেয়ের ইস্কুলের কাগজ-ই যত্ন করে নিজের আলমারিতে তুলে রেখেছিল। সেই তারিখ অনুসারে বাতাসির আঠেরো বছর বয়েস হতেই হারার সঙ্গে ওর বিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিল। আইন অনুসারে হারার তখন বিয়ের বয়েস হয়েছিল কিনা সেটা হারার ঠিক জানা নেই। হারার ইস্কুলের কাগজ তো কেউ ওভাবে যত্ন করে রেখে দেয় নি। তবে অল্প বয়েসে মেয়েদের বিয়ে দিতে গেলেই ঝামেলা হয়, ঐ সব এন জি ও না কি বলে তার দিদিমণিরা এসে হাল্লা করে, পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে এসে বিয়ে আটকে দেয়। একটা ছেলের বিয়ে আইন মেনে ঠিক বয়েসে হচ্ছে কিনা তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। বাতাসিকে বিয়ে করতে হারার অবশ্য একটু মন খুঁত খুঁত করেছিল। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে খেলা করেছে, মেয়েটা বড্ড চেনা, একটা অচেনা নতুন মেয়েকে নিয়ে বিছানায় শোয়ার আনন্দটা একেবারেই পাওয়া যাবে না। তাছাড়া মেয়েটা কেলটি আর শুঁটকি, ঐ মুখ আর চেহারা সারাজীবন ধরে দেখতে হবে। কিন্তু হারার বাস্তববুদ্ধিও সেই বয়েসেই যথেষ্ট পেকেছিল। ও নিজেকে বোঝাল, সুন্দর মুখ আর নাদুস নুদুস চেহারা ধুয়ে কি খাওয়া যাবে? এই বিয়েটা করলে দিব্যি শুয়ে বসে খাওয়ায় চলবে, অন্তত যতদিন লক্ষ্মীমাসি বেঁচে থাকবে। তাছাড়া বাতাসি এখনই অল্পস্বল্প কাজ করে রোজগার করতে শুরু করেছে, লক্ষ্মীমাসি মরে গেলে হারাকে ও-ই খাওয়াতে পারবে। আরও একটা কথা। লক্ষ্মীমাসির কাছে টাকাকড়ি আছে, মরার আগে মেয়েকে কি বেশ কিছু দিয়ে যাবে না? পেটে খেলে পিঠে সয়, হারার কপালে পেটে খেলে রাতে বিছানায় বাতাসি সয়। অতএব বিয়েটা হয়ে গেল। হারা জামাই হবার পরের থেকে লক্ষ্মীমাসি ওকে তুই বলে কথা বলা বন্ধ করেছে। তুই বলে ডাকটা বড্ড তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মত শোনায়। তার বদলে আদর করে বাবা, তুমি, এসব বলে ডাকা শুরু করেছে। দু একবার পুরনো অভ্যেসের জন্যে মুখ ফস্কে তুই বলে ডেকে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু তারপরেই নিজেকে সামলে নিয়েছে — আবার বাবা বলে ডেকেছে।
গল্প বলা শেষ করে হারা পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে ধরিয়ে ফেলল। অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে ও হাঁপিয়ে গেছে। একটু দম নেবার দরকার। অবশ্যি পুরোনো কথা যা কিছু ওর মাথায় এসেছিল তার সবই যে ও বেবিকে বলেছে, তা নয়। অনেক ছোটখাট ঘটনা, খুচরো কথা ও বলে নি, বলার দরকারও ছিল না। তবে যা কিছু মোটামুটি বেবির জানার দরকার ছিল সে সব ও আজ বলেছে। কিন্তু বলে ফেলে হারা একটু অস্বস্তি বোধ করছিল। এসব জেনে ফেলে বেবির মাথায় কি বদমায়েসি বুদ্ধি আসবে, ও কি করবে কে জানে। ওকে কিছু বিশ্বাস নেই।
বেবি নিজের হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে হারার কথা শুনছিল। হারার গল্প শেষ হলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল, হারার মুখ থেকে বার হওয়া বিড়ির ধোঁয়া কোনদিকে যায় তা দেখল। তারপর বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দ্যাখ, যার কপালে যা হওয়ার তার তাই হয়। আর কি হবে সেটা আগে থেকে বোঝা যায় না। যখন একেবারে ছোট্ট বেলায় বাতাসির সঙ্গে খেলা করতিস, তখন কি কখনো তোর মাথায় এসেছিল যে এই মেয়েটা একদিন তোর বৌ হবে?
হারা চুপ করে রইল। এ কথার জবাবে ওর কিছু বলার নেই।
বেবি আবার বলল, সবই কপাল বুঝলি, সবই কপালের লেখা। নইলে আমার তো দিব্যি বিয়ে হয়েছিল, একটা বাড়ির বৌ ছিলাম আমি, বাজারের বারোয়ারি মেয়েমানুষ হয়ে গেলাম কি করে? অবশ্যি এখন ভালই আছি, এই কাজ করে আমার এখন অনেক টাকাও হয়েছে, দিব্যি আছি।
একটু থামল বেবি। তারপর হারার দিকে তাকিয়ে একটা শয়তানির হাসি হাসল। বলল, আমার যা হয়েছে ভালই হয়েছে, কি বলিস? নইলে তুই আমার সঙ্গে প্রেম করতিস কি করে?
এবারেও হারা বেবির কথার কোন জবাব দিল না। এসব কথার কোন জবাব না দেয়াই ভাল। বেবির এখানে আসার গল্প ও মোটামুটি জানত। টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো বেবিই ওকে বিভিন্ন সময়ে বলেছিল। সেগুলোকে মোটামুটি জোড়া দিয়ে হারা পুরো গল্পটা আন্দাজ করে নিয়েছিল। বেবির বরটা শয়তান লোক ছিল। নিজের বন্ধুদের, চেনাজানা লোকদের ঘরে নিয়ে আসত, বেবিকে ভাড়া খাটিয়ে টাকা রোজগার করত। শউর, শাউড়িরও তাতে সায় ছিল। আপত্তি করলে বেবির কপালে জুটত জবরদস্ত মার। বরটা তো পিটতোই, বরটার বাপ-মাও তাতে হাত লাগাত।
কাজেই বেবি শ্বশুড়বাড়ি থেকে পালায় — ওর বর যে সব লোক ওর কাছে নিয়ে আসত তাদেরই একজনের সঙ্গে। বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবে নি। ততদিনে ওর বাপের বাড়ি বলে আর কিছু ছিল না — বাপ মা মরে গেছে, দাদারা কোন সম্পর্ক রাখত না। ঐ লোকটা বেবির কাছে একটু ঘন ঘন আসত, ওর সঙ্গে বেবির একটু ভাব সাব হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন ও ছিল ওই লোকটার সঙ্গে, তারপর লোকটা ওকে ছেড়ে চলে যায়। তখন বেবি সোজা এখানে চলে এসে ব্যবসা শুরু করে দেয়। এখন তো দিব্যি জাঁকিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে।
বেবি এবার কথা পাল্টাল। বলল, বিকেল হয়ে গেছে, চা খাবি তো? দাঁড়া, চা আনাচ্ছি।
বেবির ঘরে চা তৈরীর কোন ব্যবস্থা নেই। ও ফোন করে দোকানে চায়ের ফরমাস দেয়। সেই সঙ্গে বিকেলের জলখাবারের কথাও বলা থাকে। দশ মিনিটের মধ্যে দোকান থেকে ফ্লাস্কে করে চা চলে আসে, আর তার সঙ্গে প্যাকেটে কিম্বা ঠোঙায় করে চায়ের সঙ্গে খাওয়ার জন্যে ফরমাস দেয়া খাবার। সিঙাড়া, কচুরি, নিমকি- কখনো বেগুনি-ফুলুরি-আলুর চপ।
মোবাইল ফোনটা সব সময় বেবি কাছে কাছে রাখে। এখন ওটার জন্যে বিছানা, বালিশের তলা হাৎড়ে দেখল — পেল না। নিজের মনে বিরক্তির গলায় বলল, ধুৎ তেরি, মোবাইলটা কোথায় গেল?
খাটের পাশে ছোট টেবিলটার ওপর ওটা আছে কিনা দেখার জন্যে সেদিকে মুখ ফেরাল বেবি। ওটা সেখানেই ছিল। ও হাত বাড়িয়ে ওটা নিল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে লাফিয়ে খাট থেকে নেমে পড়ল।
টেবিলের ওপর রাখা ছোট টেবিল ঘড়িটার ওপর বেবির নজর পড়েছে। ঘড়িতে এখন পাঁচটা বেজে দশ মিনিট।
এই, এই হারা, ওঠ, ওঠ, শীগগীর — বেবি বিছানার ওপর আরাম করে বসা হারাকে তাগাদা মারল, আমার ঘর থেকে শীগগীর বেরো। ভীষণ দেরি হয়ে গেছে, আমাকে এক্ষুণি গা ধুয়ে নিয়ে সাজগোজ করতে হবে। আজ আমি সন্ধে ছ-টার থেকে ভাড়া হয়ে আছি। সারা রাতের জন্যে। যে লোকটা আমাকে ভাড়া করেছে তার দেদার টাকা। শালা আজ আমাকে অনেক অনেক টাকা দেবে। আমাকে অনেক রঙচঙ মাখতে হবে, যে শুয়োরটা আসবে সেটা খুব রঙচঙ পছন্দ করে। তুই আজকে চলে যা, এখনি বেরিয়ে যা। চা-ফা যা খাবি তা রাস্তায় খেয়ে নিস।
বেবি হারাকে প্রায় ধাক্কা মেরে নিজের ঘর থেকে বার করে দিল। ও বেরোবার সাথে সাথে ঘরের দরজাটার জোর আওয়াজ করে ওর পেছনে বন্ধ হয়ে গেল।
হারার তিনচাকা একটা ঠোক্কর খেল। সামনের ছোট চাকাটা রাস্তার একটা গর্তে পড়ে গিয়েছিল। বেবির ঘর থেকে বেরোবার আগে আর বেরোবার সময় কি কি হয়েছিল তা মনে পড়তে একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল হারা। বেবি হঠাৎ এত খারাপ ব্যবহার করল কেন? ও তো একটু ভালভাবেও হারাকে চলে যেতে বলতে পারত। যাক্গে, মরুকগে, ওর এখন চায়ের তেষ্টা পেয়েছে, গলায় একটু গরম চা ঢালার দরকার। হারা ওদের স্ট্যান্ডের দিকে গাড়ি চালাল। এবার সাবধানে, গাড়ি আবার হোঁচট না খায়। ওদের স্ট্যান্ডের উল্টোদিকে ওদের আড্ডার চায়ের দোকান, সেখানে ওদের স্ট্যান্ডের সব রিকশাওয়ালারা চা খায়। হারাও সেখানেই চা- খাবে।
আর এক কাপ চা নিল হারা। দোকানটার কেক যতোই বিস্বাদ হোক এখানে বানানো চা খেতে সত্যি-ই ভাল। এই দ্বিতীয় কাপ চা-টা ও তারিয়ে তারিয়ে খাবে, বড় বড় চুমুক মেরে শেষ করবে না। আর সেভাবে চা খেতে খেতেই দেখল একটা টোটো এসে দাঁড়াল ওদের স্ট্যান্ডে। ওটা চালাচ্ছিল নিতাই, গাড়ি দাঁড় করিয়ে ও চায়ের দোকানে হারার সামনে এসে দাঁড়াল। জোড় গলায় হাঁক দিল, একটা বড় কাপ চা জলদি।
গাড়িটা দেখে হারার মুখ শুকনো। কারোন নিতাইয়ের গাড়িটা আনকোরা নতুন, আর ওটার তিনটে চাকাই অটো-রিক্সার চাকা। অর্থাৎ ওটা হারার গাড়িটার থেকে ঢের ভাল। নিতাই শালা গাড়িটা কিনেছে নাকি? তা অবশ্য না-ও হতে পারে। হয়তো গাড়িটার মালিক অন্য লোক, সে নিতাইকে রেখেছে গাড়ি চালাবার জন্যে। কিন্তু সন্দেহটা মিটিয়ে নেয়া ভাল। হারা নিতাইকে জিজ্ঞেস করল, ঐ গাড়িটা কার? কার গাড়ি চালাচ্ছিস আজকাল?
নিতাই বুক চিতিয়ে ডাঁট দেখিয়ে বলল, কার আবার আমার।
নিতাই হারার মুখ দেখেই বুঝতে পারছিল গাড়িটা দেখে ওর খুব জ্বলন হচ্ছে। হারার হিংসেটা বাড়িয়ে দেবার জন্যে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, এই তো ক’মাস হল কিনলাম। দেড় লাখের ওপর খরচা হয়েছে, বেশ কিছু টাকা ধারও নিয়েছিলাম গাড়িটা কেনার জন্যে। তবে এটার থেকে কামাই হচ্ছে পোচুর (প্রচুর) যা ধার নিয়েছিলাম তার অনেকটাই শোধ হয়ে গেছে। ধারটা একবার শোধ হয়ে গেলে — আঃ — খালি কামাই আর কামাই। ইচ্ছে করে হো হো করে হাসল নিতাই।
হারা আর সেখানে দাঁড়াল না। চটপট চা আর কেকের দাম মিটিয়ে দিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে পড়ে গাড়ি চালিয়ে দিল। ও এখানে থাকলেই নিতাই আরও বেশি করে ডাঁট মারবে। আর হারার সেটা সহ্য হবে না। আজ সবকিছু খারাপ — বেবি এত খারাপ ব্যবহার করল, চকচকে ঝকঝকে নতুন গাড়িওয়ালা নিতাই ওর মুখের ওপর ডাঁট দেখাল — আজকের দিনটাই খারাপ।
সেদিন বাড়ি ফিরতে হারার বেশ একটু দেরি হয়ে গেল। ও সারা সন্ধেটা ঘুরেছে ভাড়া পাওয়ার জন্যে, একটাও পায় নি। ওদের স্ট্যান্ডে গিয়ে অপেক্ষা করলে হয়তো ওর কয়েকটা খেপ ভাড়া জুটে যেত। যায় নি ওই নিতাইটার জন্যে। ফেরৎ গেলে যদি আবার ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়? যতক্ষণ না ভাড়া পাবে ততক্ষণ তো ব্যাটা ওখান থেকে নড়বে না। ওর গাড়িটা দেখা ইস্তক এমনিতেই হারার প্রচণ্ড হিংসে হয়েছে, তার ওপর ওর সঙ্গে আবার দেখা হলে আবার ও ডাঁট দেখিয়ে কথা বলবে, হারার তাহলে বুক জ্বলে যাবে। অতএব হারা রাস্তায় ঘুরেছে। যে সব জায়গায় ভাড়া পাওয়া যায় সেখানে সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করেছে। ভাড়া মেলে নি। একটা দেশী মদের শুঁড়িখানা আছে ওদের স্ট্যান্ডের থেকে খানিকটা দূরে, রাত নটা দশটার দিকে ওটার কাছাকাছি সাধারণত ভাড়া পাওয়া যায়। আজ হারার কপালে তা-ও জোটে নি। কাজেই আজ ওর পকেটে বিশেষ কিছু নেই। ইশকুলের বাচ্চাদের ডিউটির টাকা রোজ পাওয়া যায় না, সেখানে মাসকাবারি ব্যবস্থা। তার থেকে বেবি আবার একগাদা টাকা নিয়ে নেয়। ওর কথা খুব পরিষ্কার। ওদের ব্যবসাতে নাকি মাগনা কিছু দেবার নিয়ম নেই। লক্ষ্মী ঠাকুর নাকি তাতে রাগ করেন। তবে অল্পবিস্তর ছাড় নাকি দেয়া যেতে পারে। বেবি হারাকে সেই ছাড় দিয়ে থাকে। তবে বেবির এসব কথা হারা খুব একটা বিশ্বাস করে না। আসলে ও হারার থেকে সোজাসুজি টাকা নিতে লজ্জা পায়, সেজন্যে ওসব নিয়মকানুনের দোহাই দেয়। হারা সেটা বোঝে, কিন্তু মুখে কিছু বলে না, বেবি আবদার করে যা চায় তা দিয়ে দেয়। এভাবেই চলছে। বেবিটা ধড়িবাজ, হারার পকেটে কুলোয় সেরকম একটা টাকাই নেয়, তার বেশি কখনো চায় না।
হারাকে দরজা খুলে দিল গৌরার বৌ, মালতি। বাড়ির আর সবাই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছে, মালতিকে জেগে থেকে হারাকে দরজা খুলে দিতে হয়েছে, তার জন্যে মেয়েমানুষটা পরিষ্কার বিরক্ত। রাগ রাগ গলায় হারাকে বলল, তোমার খাবার ঢাকা দেয়া আছে, খেয়ে নিও। একটু থেমে আবার বলল, খাবার নিতে গিয়ে রান্নাঘরে বেশি আওয়াজ কোরো না যেন। মা-র আজ শরীর খারাপ, জ্বরভাব হয়েছে। কাজের বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। একটু দুধমুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছে, হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছে এতক্ষণে। একটা জ্বরের বড়ি খেয়ে শুয়েছে, তাতে কাজ না হলে কাল সকালে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে এসো। বাতাসির দাদার তো কোন সময় নেই, মানুষটা তো সেই সাত সকালে বেরিয়ে যায়।
মালতির হুকুম দেয়া কথা শুনে হারার একটু রাগ হয়ে গেল। ওর হাতেই যেন সময় আছে? ইশকুলের খেপ নেই? সেই একবার ছুটি নিয়েছিল ঐ বুড়োবাবুর শ্রাদ্ধের সময়, যখন বুড়োর ছেলেরা ওর গাড়ি ভাড়া নিয়েছিল। কিন্তু সে তো আগে থেকে ঠিক করা ব্যবস্থা। ও হঠাৎ কামাই দিলে বাচ্চাগুলো ইশকুল যাবেই বা কি করে, ওদের বাড়ি ফেরার-ই বা কি ব্যবস্থা হবে? গৌরা হারামজাদা আটটার আগে ঘুম থেকেই ওঠে না, ও নাকি সাত সকালে কাজে বেরিয়ে যায়। উল্টোপাল্টা কথা বললেই হল? মালতি গৌরার একেবারে উপযুক্ত বৌ, ঘোর হারামি একটা মেয়েমানুষ।
ঠাণ্ডা কড়কড়ে ভাত, তাই বেড়ে নিয়ে হারা খেতে বসল। আর এক গরাস মুখে তুলেই বুঝতে পারল আজকের রান্না মালতি করেছে। বাতাসির রান্না করার কোন প্রশ্নই নেই, ও খুন্তি কিভাবে ধরতে হয় তা-ই জানে না। মালতি রেঁধেছে দ্যাখো — আধভাজা, আধ কাঁচা। কোনরকমে প্রায় শুকনো খানিকটা ভাত চিবিয়ে হারা উঠে পড়ল। সব দোষ আজকের দিনটার — আজকের দিনটা হারার জন্যে বড়ই খারাপ।
শুয়ে পড়েও হারার ঘুম আসছিল না। বার বার মনে আসছিল বেবির ওরকম ব্যবহারের কথা — নিতাইয়ের নতুন টোটোটার কথা। তার ওপর পেটের খিদে ভাল করে মেটে নি, ঘুম আসবে কি করে? পাশে বাতাসি, দিব্যি ঘুমোচ্ছে। ঘরের জানলাটা খোলা, সেখান দিয়ে এক চিলতে চাঁদের আলো এসে ঘরের ভেতর পড়েছে, সেই আলোতে হারা ওর পাশে শোয়া বৌ-এর মুখটা দেখতে পাচ্ছে। বাতাসির মুখটা অল্প খোলা, গভীর নিঃশ্বাসের সাথে সাথে মাঝে মাঝে দু-একটা মুখের লালার বুদবুদ মুখের কোণ দিয়ে বেরিয়ে আসছে — বড় আরামে ঘুমোচ্ছে বৌটা। হারা উঠল। রান্নাঘরে গিয়ে জল খেয়ে এসে আবার শুয়ে পড়ল। এবার যদি ঘুম আসে।
হারার ওঠা শোয়ার আওয়াজে বাতাসির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ও হাতের তালুর পাশ দিয়ে মুখের কোণের লালা মুছে ফেলল। তারপর বলল, এই হারা, ঘুমিয়ে পড়েছিস?
হারা বিরক্ত হল। বাতাসিটার মাথায় কিছু নেই। একটা লোক ঘুমোলে তো তাকে দেখেই বোঝা যায়, এভাবে ডাকাডাকি করার কি আছে? ও বিরক্ত গলাতে উত্তর দিল, না ঘুম আসছে না।
বাতাসি হারার খুব কাছে সরে এল। আদুরে গলায় বল, তোকে একটা খবর দেবার আছে।
হারা অবাক হয়ে গেল। বাতাসি তো কখনো এরকম আদর কাড়বার চেষ্টা করে না। আর আজ ও কাছে সরে এসে হারার প্রায় গায়ের ওপর উঠে পড়েছে, একটা হাত আবার হারার গায়ের ওপর তুলে দিয়েছে। এরকম করা ওর স্বভাবে নেই, সেটা তো হারা খুব ভালই জানে। তবে ও যে অবাক হয়েছে সেটা হারা বাতাসিকে বুঝতে দিল না। বাতাসিকে সরিয়ে-ও দিল না। গলা স্বাভাবিক রেখে বলল, কি খবর? বলে ফ্যাল।
বাতাসি কি বলবে তা নিয়ে হারার অবশ্য খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। বাতাসি প্রচুর উল্টোপাল্টা কথা বলে। হারা তার বেশিরভাগই এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বার করে দেয়। বাতাসির কথায় বিশ্বাস করে আগে হারা অনেকবার বোকা বনেছে, সেজন্যে ও বৌটার কোন কথাতেই এখন আর গুরুত্ব দেয় না। ও চিৎ হয়ে শুয়ে ঘরের ভেতরের ছাদের দিকে চোখ রেখে নিরুৎসুকভাবে অপেক্ষা করে রইল — বাতাসি কি বলে দেখা যাক। যদি খবরটা ভূষি আর লম্বা হয় তাহলে তা শুনতে শুনতে হারা ঘুমিয়েও পড়তে পারে।
বাতাসি আরও ঘন হয়ে হারার কাছে সরে এল। একইরকম আদুরে গলায় একটু লজ্জা মিশিয়ে বলল — আমি মা হতে যাচ্ছি। তুই শীগগীরই বাবা হবি।
মুহূর্তে হারার নিরুৎসুক ভাব কেটে গেল। ও কনুই-এ ভর দিয়ে উঠে আধশোয়া হল, বাতাসির ওপর ঘনিষ্ঠ ভাবে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল, সত্যি বলছিস? বাজে কথা বলছিস না তো?
বাতাসি এবার হারাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরল। বলল, হ্যাঁরে, সত্যি কথা। এই দু মাস চলছে — ডাক্তার বলেছে। তুই-ই তো বাচ্চার বাবা, তোকে আমি গুল মারব কেন?
কিন্তু হারার পক্ষে ব্যাপারটা বিশ্বাস করা শক্ত। এত বছর ওদের বিয়ে হয়েছে, ওসব কিছু হয় নি। এখন হঠাৎ করে হয়ে গেল? তাছাড়া বাতাসি ডাক্তারের কথা বলছে, ও তো কখনই ডাক্তার বদ্দির কাছে যেতে চাইত না। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা তুললেই চীৎকার করে বাড়ি মাথায় করত। এখন হঠাৎ ও ডাক্তারের কাছে গেল কি করে? সে কথাই হারা ওকে জিজ্ঞেস করল, তুই যে বড় ডাক্তারের কাছে গেলি? আগে তো ডাক্তারের নাম শুনলেই হনুমানের মত হাত পা ছোঁড়া শুরু করে দিতিস।
হনুমানের সঙ্গে তুলনাটা শুনেও বাতাসি চটল না। বরং ফিক করে একটু হেসে দিল। বলল, আমাকে রাজী করিয়েছে আমার মা, তোর পেয়ারের লক্ষ্মীমাসি। আমাকে অনেক বুঝিয়েছে। আমি কেন রাজী হয়েছি জানিস? মা আমাকে বলেছে, হারাধন এখন অন্য মেয়েমানুষের কাছে যায়, একটা বাচ্চা হলে ঘরমুখো হবে, আর বাইরের দিকে ঝুঁকবে না। বড় রাস্তার ওপর ঐযে একটা ডাক্তারখানা আছে, রক্ত, পেচ্ছাপ, এসব পরীক্ষা হয়, সেখানে অনেক বড় ডাক্তার এসে রুগী দেখে। মেয়েদের অসুখের মেয়ে ডাক্তারও আসে। মা একজন মেয়ে ডাক্তারের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল, তার কাছে গত এক বছর হল যাচ্ছি। মা-র সঙ্গে যাই, মা-র সঙ্গেই ফিরি। কত রকম পরীক্ষা করিয়েছে আমাকে, সে আর বলবার নয়। তার পর ওষুধ — হরেকরকম ওষুধ খাইয়েছে এই এক বছর ধরে, এখনও খাচ্ছি। মাঝে মাঝে সুঁইও দিয়েছে। আজ আবার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার তারিখ ছিল। আজ ডাক্তার পরিষ্কার বলে দিল আমার দু-মাস চলছে, পেটের বাচ্চা ভাল আছে। তুই তো ব্যাটা কিছুই জানতে বুঝতে পারিস না। কার না কার সঙ্গে প্রেম করে রাত করে ঘরে ফিরিস, তার পর কোনরকমে খেয়ে নিয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে ঘুমোস। ঘরে রাখা ওষুধের শিশিগুলোর ওপরও তো নজর পড়ে না।
ওষুধের শিশিগুলো হারা দেখেছে ঠিকই কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। ভেবেছে লক্ষ্মীমাসি মেয়ের স্বাস্থ্য ভাল করবার জন্যে ওষুধ কিনে মেয়েকে খাওয়াচ্ছে। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হল ও যে অন্য মেয়েমানুষের কাছে যায় সেটা লক্ষ্মীমাসি বুঝে ফেলেছে, বাতাসি-ও কথাটা জেনে গেছে। এই খবরটা ওর বুকে একটা হাতুড়ির ঘা দিয়েছে। মাসি ব্যাপারটা বুঝল কি করে? ওর হাবভাব ব্যবহারে কি কোন বদল হয়েছে! আর তা থেকেই মাসির কাছে হারা ধরা পড়ে গেছে? তা ছাড়া মেয়েদের এসব ব্যাপার বুঝে নেয়ার একটা ভগবানের দেয়া ক্ষমতা থাকে, মাসি কি সেভাবেই হারার লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করাটা ধরে ফেলেছে? কিন্তু আশ্চর্য, হারার ব্যাপারটা টের পেয়েছে লক্ষ্মীমাসি, বাতাসি নয়। হারার সঙ্গে এক বিছানায় শুয়েও বাতাসি কিছু বোঝে নি — মেয়েটা কি বোকা। আর লক্ষ্মীমাসি সব বুঝেও হারাকে আভাস পর্যন্ত দেয় নি, যে হারা ধরা পড়ে গেছে। হারা আজ আবার নতুন করে অনুভব করল মাসি ওকে কতখানি ভালবাসে। সুলোচনার কথা হারার মনে পড়ে গেল। ওর নিজের মা ওকে এত ভালবাসত কি? কি জানি — মনে তো হয় না।
ওর গালে দাঁত বসিয়ে হারার একটু নতুন নতুন লাগছিল। বাতাসির গাল বোধহয় আর আগের মত সিঁটকে নেই, ওষুধপত্র খেয়ে একটু ভরাট হয়েছে। সেজন্যে হারার ইচ্ছে করছিল না বৌটার গালের কামড় ছেড়ে দিতে। কিন্তু বাতাসির কথা ওর কানে ঢুকেছে, বৌটা যা বলেছে তা ঠিক। হারা ওর গাল ছেড়ে দিল, কিন্তু ওকে জোরে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরল।
এই, এই, একটু সাবধান, বাতাসি ফিস ফিস করে বলল। কটা মাস একটু সাবধানে থাকতে হবে।
হারা হাতের বাঁধনটা একটু আলগা করল। জিজ্ঞেস করল, কেন, ও কথা বলছিস কেন? ডাক্তার কিছু বলে দিয়েছে? বারণ করেছে?
না, বারণ করে নি, বাতাসি বলল। তবে একটু সাবধান থাকতে বলেছে।
অত কিছু সাবধান হওয়া যাবে না, হারা ভাবল। তাহলে সব মজাই মাটি। ও মুখে সেকথা বলল না — যা করতে যাচ্ছিল তাতেই মন দিল।
(ক্রমশ)
(পরবাস-৮৫, ১০ জানুয়ারি, ২০২২)