Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines




পরবাসে প্রকাশিত উপন্যাসঃ

লোকে বলে অলৌকিক
- ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত


ভিক্টর কুজুর
- কমল চক্রবর্তী


নিওলিথ স্বপ্ন
- দীপেন ভট্টাচার্য


রাতবিরেতের গজল
- ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত


মেঘের নিচে কাকতাড়ুয়া
- বাসুদেব দেব


বর্ণবাসী
- সুভাষ ঘোষাল


ধ্বংসাবশেষ
- শৈলেন সরকার


যাত্রী
- দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


সন্ধ্যাবেলা
- সাবর্নি চক্রবর্তী


অরণ্যকথা
- আইভি চট্টোপাধ্যায়


অন্য কোনখানে
- দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


আয়নার ভিতরে
- কৌশিক সেন


ফরিয়াদ
- সাবর্নি চক্রবর্তী


রাহুলের ডায়েরি থেকে
- ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত


কোথাও জীবন আছে
- শাম্ভবী ঘোষ


হারাধন টোটোওয়ালা
- সাবর্ণি চক্রবর্তী






পরবাসে
ইন্দ্রনীল দাশগুপ্তের

আরো লেখা


ISSN 1563-8685





|| ৪ ||


প্রেমের ব্যাপারে শ্যামলীর মতামত জানতে চেয়েছিল রাহুল। প্রেম নিয়ে শ্যামলী কি ভাবে?

—এ বিষয়ে তোর চেয়ে বেশি জানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শ্যামলী বলেছিল। তুইই তো যখন তখন প্রেমে পড়িস। আমি এখনও প্রেম করিই নি।

—সে তো আমিও করিনি। কিন্তু প্রেমে পড়ে থাকতে পারিস। প্রেম করা আর প্রেমে পড়া এক নয়।

ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিল শ্যামলী—তাও ঠিক। কিন্তু আমি প্রেমে পড়েছি কিনা সে খবর তোকে দিতে যাব কেন?

—সে খবর চাইছি না। কোনো ব্যক্তিগত কৌতূহল প্রকাশ করছি না। শুধু কিছু সাধারণ প্রশ্ন আছে। যেমন ধর, প্রেম কতটা জরুরী? প্রেমের জন্য কতটা ক্ষতি স্বীকার করা উচিত বা সম্ভব?

—আগে বল প্রেম বলতে কী বোঝাচ্ছিস? সত্যিকারের ভালোবাসা?

—হ্যাঁ, একেবারে খাঁটি জিনিসের কথাই বলছি। মনে আলসার হলে যেরকম হয়।

—আমার মনে হয় তার জন্য নিজের সমস্ত কিছু ত্যাগ করা যায়। তুই হয়তো বুঝবি না। তোর বোঝার ক্ষমতা আছে কিনা সন্দেহ। শ্যামলী ঘাড় উঁচু করে বলেছিল।

—নিজেকে অত সুপিরিয়র ভাবিস না। আমিও একটা শিক্ষিত পরিবারের ছেলে।

—ঠিক আছে। ঠিক আছে। রাগিস না। কী জানতে চাস বল, আমি পারলে উত্তর দেব।

—কারো পক্ষে কি একসাথে একাধিক লোকের প্রেমে পড়া সম্ভব? গম্ভীরভাবেই জিজ্ঞেস করেছিল রাহুল।

ফিক করে হেসে শ্যামলী বলেছিল—কেন সম্ভব নয়? প্রেমে তো কেউ ভেবেচিন্তে পড়ে না। ওটা হয়ে যায়। হয়ে গেলে আটকাবে কে?

—তোর সেরকম হলে কী করবি?

—সব-কটাকে বিয়ে করব। দ্রৌপদীর মতো। বলেই চোখ পাকিয়েছিল শ্যামলী—আবার পার্সোনাল কোয়েশ্চেন?

রাহুল থামেনি—আর ধর বিয়ের পর যদি দেখিস ভালোবাসা কমে যাচ্ছে। বা নেই, তখন?

শ্যামলী একটু চুপ করে থেকে বলেছিল—কতো কীই তো হতে পারে! জানিস আমাদের পাড়ায় একটা মেয়ে আছে। তার বর তার চোখের সামনেই অন্য মেয়ের সাথে—ছি-ছি, আমি হলে কখনো সহ্য করতাম না।

—কী করতিস?

—কে জানে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল শ্যামলী। ছেলেরা এত স্বার্থপর হয় কেন বলতো? তুই কখনো এরকম করতে পারবি রাহুল?

আমার তো বিয়েই হবে না। মনে মনে বলেছিল রাহুল। বনমালী, জলধর, হারু ওদের সবার ঠিকই হয়ে যাবে। আমি শিবরামের মতো মেস ভাড়া করে থাকব। যখন তখন এর ওর বাড়িতে গিয়ে উপদ্রব করব। দুপুরবেলা একা একা গোলচায় বসে একই সিনেমা উনত্রিশ বার দেখব।

—ওরকম ভ্যালভ্যালের মতো চেয়ে থাকিস না। তোকে ছোটো থেকে দেখছি। ছোটোবেলা তোরা ঠিকই থাকিস। যেই দাড়িগোঁফ গজায়, অমনি পালটে যাস। আমার ভাইটা সেদিন পর্যন্ত পায়ে পায়ে ঘুরত। এখন নিজেকে পুরো হিরো ভাবে। কলেজের ফাংকশানে স্টেজে উঠে গান গেয়ে এসেছে। তারপর তিনটে মেয়ে নাকি ওকে প্রপোজ করেছে। উনিও তিনজনকেই অ্যাক্সেপ্ট করে বসে আছেন। এটা আবার গর্ব করে বলা হচ্ছে। আমি আর মা ধমকে দেবার পর বলছে—না, না, ওদের আমি বোনের মতো দেখি। ফ্রেন্ডশিপ করতে চাইল, না বলতে পারলাম না। তোরা ছেলেরা যে কী করে এত সহজে হ্যাংলা হয়ে যাস।

—তবে যে বললি তুইও দ্রৌপদীর মতো হবি?

—আহ, ফাজলামো করিস না রাহুল। ওটা একটা কথার কথা। সিরিয়াসলি বলেছি নাকি?


*********


বনমালীর সাথেও একই বিষয় নিয়ে কথা বলেছে রাহুল। শ্যামলী আর বনমালীর দৃষ্টিভঙ্গিতে আকাশপাতাল তফাৎ। দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল রাহুল। এরকম দুজনের সঙ্গে সৌহৃদ্য বজায় রাখবে কী করে? এ তো প্রায় একই সঙ্গে মোহনবাগান আর ইস্ট-বেঙ্গলের সমর্থক হবার মতো। বেআইনি যদি নাও হয়, অবৈধ তো বটেই।

—প্রেম, ভালোবাসা সবই আসছে হরমোন থেকে। শরীরের জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ার একটা বাই-প্রোডাক্ট। পলমল-এর ক্রাশ প্যাকেট ঠুকতে ঠুকতে বলেছিল বনমালী। মরালিটির সাথে প্রেম গুলিয়ে ফেলিস না রাহুল। বিপদে পড়ে যাবি।

—বাহ, তার মানে সত্যিকারের ভালোবাসায় মরালিটির কোনো স্থান নেই?

—কেন থাকবে? সত্যিকারের খিদেয় মরালিটি-র স্থান আছে? খিদের জন্যে মানুষ প্রাণহত্যা করে, প্রয়োজনে নরমাংসও খেতে পারে। খিদে যত বাড়বে, মরালিটির ভূমিকা ততই কমবে।

—কিন্তু যার প্রেমে পড়ছি সে একটা খাবার নয়। তার একটা পরিচয় আছে। খিদে পেলে ভাতের বদলে রুটি কিম্বা কেকও খাওয়া যায়। একটি বিশেষ চালের দানার প্রতি আমরা বেশি করে আকর্ষণ বোধ করি না। প্রেম আর খিদের মধ্যে তফাৎ আছে।

হেসেছিল বনমালী—কিন্তু এই তফাতটাও বায়োলজিক্যাল। এর মধ্যে ফিলোসফি আনিস না। যেমন ধর তুই পলাশের প্রেমে পড়েছিস। পলাশের এক যমজ বোনকে এনে দেওয়া হল। একই রকম দেখতে। একই রকম কথাবার্তা, হাব-ভাব। তুই কি তার প্রেমে পড়বি না? মরালিটি আসবে কোত্থেকে?

সব শুনে গুম হয়ে গিয়েছিল রাহুল। প্রেম করা আর জাবর কাটা তাহলে একই রকম ব্যাপার হলো? দুটোই জৈবিক ক্রিয়া?!

বনমালী আরো আশ্বাস দিয়েছিল। ফ্লিপ-সাইডটা দেখ। শ্যামলী আর দেবুদা দুদিন পরে দস্তুরমতো অফিসিয়ালি প্রেম করবে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘুরবে। একসাথে ফুচকা খাবে। বড়ো বড়ো বিল্ডিং-এর লিফটে উঠে তোর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেবে। তখন যদি তুই এটা ভাবতে পারিস যে ওরা দুজনে স্রেফ লুকিয়ে একটু জাবর কাটছে তাহলে আঘাতটা সহ্য করা অনেক সহজ হতে পারে।


*******


রাহুলের ডায়েরি থেকে:

“...বিষ্যুদবার সকালবেলা ইউনিভার্সিটিতেই একটা কাণ্ড হয়ে গেল। দিল্লী স্কুল অফ ইকনমিক্স-এর সামনে দিয়ে আমি আর জলধর হাঁটছি। বনমালীর কলেজে গিয়ে দাবা খেলব বলে। এমন সময় একটা বাস এসে রাস্তার ধারে ঘ্যাঁচ করে থামল। হঠাৎ ভীষণ হই হই, ভিড়।

বাসের পিছনের দরজা দিয়ে তিন-চারটে ছেলে লাফিয়ে নেমেছে। সামনের ছেলেটা সর্দার। একেবারে পিছনের ছেলেটা নেমেই ফুটপাথের উপর পেট চেপে ধরে শুয়ে পড়েছে। জলধর বলল —এই রে, আমি রক্ত দেখতে পারি না। আমাদের চোখের সামনেই দুটো ছেলে দৌড়ে দিয়ে সর্দার ছেলেটাকে ধরল, এবং একজন মাখনের মতো তার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে, বের করে আবার ঢোকালো। হঠাৎ বাস-শুদ্ধু লোক গেল গেল বলছে। মহিলাদের মিহি গলায় চিৎকার।

পিচকিরির মতো রক্ত বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। ছুরিটা যে মেরেছে, সে অমনি এক দৌড়ে হাওয়া। অন্য দুটো ছেলেকে দেখলাম ফুটপাথে শুয়ে থাকা ছেলেটার শুশ্রূষা করতে। সেখানেও ভাঙা ফুটপাথে, ধুলোয় গরম তাজা রক্ত কোত্থেকে বেরিয়ে সব লাল করে দিচ্ছে।

জলধর উবু হয়ে বসে পড়েই ভয়ঙ্কর শব্দ করে বমি করতে লাগল। চা, পাঁউরুটি, অমলেট সব হড় হড় করে বেরিয়ে চারদিক ভাসাচ্ছে, সেই সঙ্গে বিষম খেয়ে চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে ওর।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এত ভিড় হয়ে গেল যে আর কিছু দেখা গেল না। আমি জলধরের মাথায় থাবড়া মেরে ওকে সুস্থ করলাম। ডি-স্কুলের ঢাবা থেকে একটা পুরো লিমকা খেয়ে আরেকটু চাঙ্গা হয়ে সে বলল—কত রক্ত বেরিয়ে গেল রে। ওরা আর বাঁচবে না।

আমি ধমক দিয়ে বললাম—আরে দূর। এক্ষুনি সেলাই করে সব ঠিক করে দেবে। এরকম ছোটখাটো অপারেশন তো ডাক্তাররা রোজই করে। এক মাসের মধ্যে ফিট হয়ে আবার দাপিয়ে বেড়াবে দেখিস।

জলধর বলল—বাজে বকিস না। নিয়ে গেছে বাড়া হিন্দু রাও হসপিটালে। ভর্তি হতে হতেই প্রাণ বেরিয়ে যাবে। তারপর মুচি এসে লাশ সেলাই করে বলবে বকশিস দাও। এটা একটা সিস্টেম? থুঃ।

সিস্টেমের উপর রাগ করে জলধর সেদিন দাবাই খেলল না। বনমালী মাঝে মাঝে শেখরদের বাড়িতে দাবা খেলতে যায়। ওদের বাড়িতে সবাই বাঘা দাবাড়ে। বনমালী একটা বই ধার করে এনেছে শেখরের বাবার কাছ থেকে। আমাকে খুলে দেখাল। গ্রান্ডমাস্টারের লেখা বইতে শেখরের বাবা লাল কালিতে বড়ো বড়ো দাঁড়ি টেনে লিখে রেখেছেন “স্টুপিড”। বনমালী বলল —আমি শেখরের বাবার কায়দায় খেলতে গিয়ে প্রতিবার বিচ্ছিরিভাবে হেরে যাচ্ছি। তুই একবার ট্রাই করে দেখবি?

আমিও সেভাবে খেলতে গিয়ে বার তিনেক হেরে গেলাম...”


*******


রাহুলের ডায়েরি থেকে:

“...পরদিন কলেজে গিয়ে শুনলাম গল্পটা। প্রথমে খালসা কলেজের সর্দার রামজস কলেজের ছেলেটাকে ছুরি মেরেছে। তারপর ভিক্টিমের বন্ধুরা ওই ছুরি দিয়েই আততায়ীর পেট ফাঁক করেছে। জলধরের অনুমান খুব একটা ভুল ছিল না। সারাদিন হিন্দু রাও-এ পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে রাত্রিবেলা অক্কা পেয়েছে দুজনেই।

কলেজ থেকে ছুটতে ছুটতে পলাশদের বাড়ি। পলাশ একটা শাড়ি পরে রেডি-শেডি হয়ে বসে আছে। আমায় বলল — রাহুল, তুই কিছু খাবি?

আমি বললাম —সে তো ওখানে গিয়েও খেতে পাব। এখন আর দেরি করিস না। টাইম হয়ে গেছে।

পলাশ বলল —ব্যস্ত হোস না। আমরা একটু দেরি করেই যাব।

আমি বললাম —কেন?

পলাশ বলল—বুঝলি না। দেবুদা আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। আমরা ওর জন্য অপেক্ষা করব কেন?

বুঝলাম, মেয়েদের সব কাজ কত ভেবেচিন্তে করতে হয়। পলাশের মা তারই মধ্যে একটা সন্দেশ, একটু জল খাইয়ে দিলেন। বাইরে বেরিয়ে আমরা স্কুটার ধরলাম। পলাশ বলল—তুই আমাদের সঙ্গে মিনিট কুড়ি অন্তত বসিস। তারপর ইচ্ছে হলে যেতে পারিস।

আমি বললাম—মানে? একটু বসে চলে যেতে বলছিস?

পলাশ তাড়াতাড়ি বলল—না, না। ইচ্ছে হলে বসিস। তবে তাড়া থাকলে যেতেও পারিস। এই আর কি! আমি মনে মনে বললাম—বুঝেছি।

কমলানগরে নতুন একটা নিরুলা খুলেছে। সেখানেই যাবার কথা। দরজা দিয়ে ঢোকার সময় আমারই বুক ঢিপ ঢিপ করছিল। পলাশ সিঁড়িতে একবার হোঁচট খেল। কালো আর সাদা রঙের তাঁতের শাড়ি পরেছে ও। আজকে নিশ্চয়ই কলেজ যায়নি। মুখটা রুমাল দিয়ে একবার মুছে দরজা দিয়ে ঢুকলো পলাশ। পিছনে আমি। ওর গা থেকে একটা ফুল-ফুল, ঘাম-ঘাম গন্ধ। ভিতরে ঢুকে বেশ ঠান্ডা পেলাম। হালকা মিউজিক চলছে। কোণের একটা মাত্র টেবিল খালি আছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক ভালো করে দেখলাম। কোথাও দেবুদা নেই...”


*******


পালটি খেয়ে রাহুল নিরুলা থেকে বেরিয়ে আসছিলো। শ্যামলী খপ করে তার জামার হাতা খিমচে ধরেছে।

—আবার কোথায় চললি?

—দেবুদা নেই। দেখে নিয়েছি।

—তাতে কী হয়েছে? এসে পড়বে। হয়তো কোথাও আটকে গেছে।

—সেই জন্যই তো বেরিয়ে যাচ্ছি। আমরা আধঘণ্টা পরে ফিরব। দেবুদা আমাদের জন্য অপেক্ষা করুক।

—বেশি স্মার্ট হোস না। আধঘণ্টা এখন ফ্যা ফ্যা করে রাস্তায় ঘুরব নাকি? চ গিয়ে ওই টেবিলটায় বসি।

শ্যামলী এত সাজগোজ করে আর গরমে বেশিক্ষণ ঘুরতে চায় না। রাহুলকে বগলদাবা করে সে কোণের টেবিলটায় গিয়ে বসল।

—বসেছি যখন, একটা কিছু খেতে হয়।

—তোর কাছে পয়সা আছে? রাহুল জিজ্ঞেস করে।

শ্যামলী সাবধানে ব্যাগ খুলে একটা একশো টাকার নোট বের করে দেয়।

—এখন বেশি খরচা করিস না। আমি নিজের কাছে এনাফ টাকা রাখতে চাই।

—সে তো যা দেবার দেবুদাই দেবে।

—দ্যাট ডিপেনড্‌স। প্রয়োজনে আমাকেও দিতে হতে পারে। তুই আমার জন্য একটা আইসক্রিম নিয়ে আয়। নিজের জন্য যা তোর ইচ্ছে।

রাহুল দুটো আইসক্রিম নিয়ে ফিরল। নিজের জন্য একটা বড়োসড়ো বানানা-স্প্লিট। বেশ খিদে পেয়েছে তার। গপ গপ করে খেতে খেতে দেখল, শ্যামলী দরজার দিকে মুখ করে গম্ভীরভাবে বসে আছে। সামনে গেলাসে গোলাপি সান্‌ডে গলে জল হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই।


*********


রাহুলের ডায়েরি:

“... ইচ্ছে হলো পলাশের হাতে একটা হাত রেখে সান্ত্বনা দিই। দেবুদা আধ-ঘণ্টার উপর লেট। পলাশের মুখ থম থম করছে। আমি বললাম—আইসক্রিমটা খাবি না? পলাশ শুধু বলল—ধর ও যদি না আসে? আমি বললাম—ধুৎ, তা কি হয়? পলাশের চোখ ছল ছল করছে। বলল—আচ্ছা, ডেকে এনে এরকম অপমান করবার কোনো মানে হয়? এই তোর দেবুদা? এর এত প্রশংসা করলি তুই? আমি কী করে সান্ত্বনা দেব ভেবে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বললাম—বেট রাখবি? দেবুদা যদি না আসে, আমি সারাজীবন আর মদই খাব না...”


********


শ্যামলী হেসে ফেলেছে। এতক্ষণে হাসি ফুটেছে তার মুখে।

—সত্যি বলছিস রাহুল?

—বেট ইজ আ বেট। কথার খেলাপ হবে না।

—যাক একটা ভালো কাজ তাহলে হল, তোর ওই দেবুদার সৌজন্যে। একটু থেমে আবার হাসতে থাকে শ্যামলী। —তোর কপালে যতো মদের বোতল ছিল রাহুল সেইগুলো বোধহয় এই মুহূর্তে সব আমার কপালে এসে জুটল। সপ্তপদী দেখেছিস? তাতে সুচিত্রা সেন উত্তমকে না পেয়ে শেষে কিরকম মদ খেতে শুরু করল মনে কর।

—বেট-এ হারলে তুই কী দিবি?

—আমি কী দেব? তাহলে আমি কোনোদিন মদের বোতল স্পর্শ করব না। বলে খিলখিল করে আবার হাসে শ্যামলী।

—না, ওটা তোর গায়ে লাগবে না। হারলে একটু স্যাক্রিফাইস করতে হবে। আমি যা চাইব তাই দিতে হবে।

—তুই কী চাইবি সেটা না জেনে ওরকম কোনো কথা দিতে পারব না রাহুল। তোর মাথার ঠিক নেই।

—বেশি কিছু চাইছি না। বেট হারলে তুই আমাকে সারাজীবন বিনা পয়সায় যত্ন করে খাওয়াবি। যখনই তোদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হব, যে সময়ই হোক না কেন, তুই তোর বাড়ির সেরা খাবারগুলো, যা তোর বরকে দিবি বলে তুলে রেখেছিস হয়তো, তাই থেকে আমাকে অর্ধেক দিবি। নিজের হাতে এনে দিবি। এমন যেন না হয় যে কাজের ছেলেটা এসে দিয়ে গেল। বসে থেকে গল্প করে খাওয়াবি। খাওয়া হয়ে গেলে মুখশুদ্ধির জন্য একটা মিষ্টি পান কি একটু মৌরি যেন পাই। তারপর বিদায় জানাবার সময় গেট-এর কাছে এসে ফিসফিস করে বলবি—আবার আসিস।

—ফিসফিস করে বলতে হবে কেন?

—যাতে অন্যরা শুনতে না পায়। অন্যরা যেন ভাবে আমাদের মধ্যে কোনো গোপন কথা আছে।

হি হি করে হাসতে থাকে শ্যামলী। —তুই তো আমার সংসার ভেঙে দিবি রে রাহুল। এসব করলে শাশুড়ি নির্ঘাৎ আমাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেবে। তবে একটাই বাঁচোয়া। কিছুদিন পরেই সব ভুলে যাবি। তখন তোর টিকিটাও দেখতে পাব না।

—অত কনফিডেন্ট হোস না। বে-থা করব না। মেস ভাড়া করে থাকব। মদ যদি ছেড়ে দি তাহলে আর কোনো কাজই থাকবে না। হা হা করে ঘুরবো। আমার কাজই হবে চেনাজানা সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে উপদ্রব করা। তোর বাড়িতে গিয়ে তোর বরের সঙ্গে পলিটিক্স নিয়ে ঝগড়া করে আসব।

—বিয়ে করবি না, না ছাই। আমি দেখেশুনে তোর বিয়ে দেব। এমন একটা মেয়ে আনব যে তোর কবিতার মানে বোঝে।

—তাহলেই হয়ে গেল। বলে রাহুল। বিয়ে না হবার এর চেয়ে বড়ো গ্যারান্টি আর নেই। শোন, বেট-টা অ্যাাক্সেপ্ট করছিস তো?

—করছি। দু দিক দিয়েই তুই জিতলি কিন্তু।


*******


রাহুলের ডায়েরি:

“... পলাশ আর আমি, মুখোমুখি আইসক্রিম নিয়ে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে প্রায় এক ঘণ্টা। পলাশ খুব হাসিখুশি ছিল, অনেকরকম মজার মজার কথা বলল। আমি চেষ্টা করলাম ওকে হাসাতে। আমায় বলল, তোরা পাহাড়ে বেড়াতে যাস, আমায় নিয়ে যাস না কেন? আমিও তো যেতে পারি? আমি বললাম—বনমালী মেয়েদের নিয়ে যাওয়া পছন্দ করে না। পলাশ ঠোঁট উলটে বলল—বনমালীটার বেশি বেশি। নিজেকে বড্ড বড়ো ভাবে। শোন রাহুল, তুই কিন্তু ভীষণ অন্য লোকেদের কথা শুনে চলিস। তোর একটা নিজস্ব মতামত নেই কেন? আমি বললাম—আস্তে আস্তে হবে। আগে একটা চাকরি হোক। পলাশ বলল—আরেকটু ভারিক্কি হ। গম্ভীর হ। নইলে মেয়েদের কাছে পাত্তা পাবি না। আমি তোকে আমাদের কলেজের ভালো ভালো ফার্স্টইয়ারের মেয়েদের সাথে আলাপ করিয়ে দেব। ওরা সবাই বয়ফ্রেন্ড খুঁজছে। এটা শুনে আমার পটাং করে রাগ হয়ে গেল। ফার্স্টইয়ারের অপরিণতমস্তিষ্ক মেয়েদের জন্য আমাকে গম্ভীর সেজে থাকতে হবে? ইচ্ছে হল ওদের কলেজের সবকটা ফার্স্টইয়ারের মেয়েকে গাঁট্টা মেরে আসি। সত্যি সত্যিই মেরে আসব একদিন। গোয়েল-এর মোটরসাইকেলের পিছনের সিটে বসে কালো চশমা পরে গাঁট্টা মারতে মারতে চলে যাব। বুড়ো দারোয়ানটাকে ‘হ্যান্ডস্‌ আপ” বলে দুহাতে চারখানা ইঁট চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আমাদের গলায় সোনার লকেট থাকবে। প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকে টেবিলের উপর পা তুলে জাঁকিয়ে বসব। সোনার লকেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলব—গোপিনীদের খবর দিন। কিষনা আ গিয়া। রাগ করে পলাশকে এসব বললাম, সে হা হা করে ছেলেদের মতো হেসে এমন কাণ্ড করল যে পুরো রেস্টুরেন্টের লোকেরা আমাদের দিকে চেয়ে রইলো দু-মিনিট। আমি পলাশের কাছ থেকে আবার পয়সা নিয়ে গেলাম একটা পিৎজা আনতে।

পিৎজা কিনতে কিনতে দেখলাম পলাশ নখ দিয়ে নখ খুঁটছে। খুঁটতে খুঁটতে নখের লাল রঙ তুলে টেবিলের উপর ফেলছে। আমি আসতেই শাড়ির আঁচল দিয়ে সব টেবিলের নিচে চালান করে দিল। দেখলাম ঠোঁটের রঙও প্রায় তুলে ফেলেছে। কপালে তখনও ছোট্ট টিপটা আছে। মাছির মতো। কিন্তু নিজেকে আর সুন্দর করার চেষ্টা করছে না পলাশ। বুঝলাম লক্ষণ ভালো নয়। দেবুদা যদি এখন এসেও পড়ে, কী ফল হবে কে জানে।

একটু পরে পলাশ কাঁটাচামচ সরিয়ে রেখে বলল—ধুৎ আর ভাল্লাগছে না। আমি চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিলাম। পলাশ বলল—দ্যাখ্‌ ছেলেরা কিরকম ফ্রড হয়। সাড়ে এগারোটার টাইম দিয়ে আমাকে বসিয়ে রেখেছে। খুব সম্ভবতঃ তোর দেবুদা আজ আর আসবে না। বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে কিরকম ছোটো হব ভাব একবার। চ এবার উঠে পড়ি। আমি বললাম—দাঁড়া, আরেকটু বসি। হয়তো ট্রাফিকে আটকে গেছে। কত কী হতে পারে! পলাশ বলল—দিনটাই খারাপ। এর চেয়ে খারাপ কি কিছু হতে পারে?

প্রত্যাখ্যান পেলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি কষ্ট হয়। আমি ঠিক সামলে গেছি। পলাশ এই অপমান জীবনে ভুলতে পারবে না। আমি বললাম—দেবুদার অফিসে ফোন করে দেখব? পলাশ বলল—এখন আর করে কী লাভ? এতক্ষণে যদি সে বেরিয়ে পড়ে থাকে তাহলে আমরা কি আর বসে থাকব? তখন আমি বললাম—অপেক্ষাই করিব আমিও বছর চার। পলাশ বলল—মানে? আমি তখন গড় গড় করে বলে গেলাম—

অপেক্ষাই করিব আমিও বছর চার
তাহার পর লিখিয়া যাইব, পড়িব না—
ভালবাসিয়া বলিব তাহাকে পলাশ তোর
রটিছে ভাই চমৎকার কী কলঙ্ক!।

কুলিয়া যদি উঠিতে পারেও, ঘামিবে সে
ভাবিয়া আমি হাসিয়া হাসিয়া পাগল হই
হাসিয়া হাসিয়া ভাবিতে থাকি নামটি যার
পলাশ, তার প্রথম গুণ তো সারল্যই ...

চলচ্চিত্র দেখিব বসিয়া তিরিশবার
তাহাকে আমি সঙ্গে কখনো লইব না -
বিবাহ তার হইয়া গেলে বুজিয়া চোখ
খুঁজিব কোনো নিজেরই মতো অন্য লোক।

ঘামিয়া যদি উঠিতে পারেও, ভিজিবে সে
ভাবিয়া আমি হাসিয়া হাসিয়া পাগল হই
হাসিয়া হাসিয়া ভাবিতে থাকি নামটি যার
পলাশ, তার আরেক নাম তো সারল্যই...
পলাশ আমার হাত-টা চেপে ধরে বলল—রাহুল, তুই কথা দে আমাকে নিয়ে আর কখনো কবিতা লিখবি না। আমি বললাম—কেন? কী হয়েছে? পলাশ বলল—আমার মাথার দিব্যি! আমি বললাম—দিব্যি দিয়ে কবিতার মুখ বন্ধ হয় না, গুলি করে বন্ধ করতে হয়। তখন পলাশ আরো রেগেমেগে বলল—তোকে আমি একদিন গুলি করেই মারব। আপাতত বলে রাখছি, খবরদার আমার নামে আর কবিতা লিখবি না। এসব তুই বন্ধুদের পড়িয়ে বেড়াস, এরপর তো সারা শহরে সত্যিই আমার নামে ঢি-ঢি পড়ে যাবে।

কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবার জন্য আমি বললাম—তা অবশ্য ঠিক, গাঙ্গুলীরা জানতে পারলেই চিত্তির।

পলাশ আরো রেগে কী একটা বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখি ওর মুখের হাঁ-টা আর বুজতে চাইছে না। চোখ দুটোও ছানাবড়ার মতো হয়ে গেছে। আর তাতে একটা অদ্ভুত ভাব। সেটা ভয়ের না জয়ের না আনন্দের না বিতৃষ্ণার কিছুই বুঝলাম না। পিছন ফিরে দেখি দরজা খুলে ঢুকেছে দেবুদা। লম্বা চেহারায় বাদামী টেরিকটের প্যান্ট আর জামা। কালো জুতো, কালো চশমা, দারুণ দেখাচ্ছে। হাসি হাসি মুখ। সঙ্গে একটি বয়স্কা মহিলা। দরজা দিয়ে ঢুকে ইতিউতি চাইছেন।

আমি নিচু হয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম ওটা আবার কে?

পলাশ ঢকাস করে ঢোঁক গিলে বলল—এই রে, মা কে নিয়ে এসেছে সঙ্গে!


**********

(ক্রমশ)



(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)