“যদি না কী?” উত্তেজনায় উপলার মুখ লাল।
“যদি না,” নীরা আড়চোখে মৃণালিনীর দিকে দেখে নিয়ে চাপা স্বরে বলে, “সেদিন ওর ভাবভঙ্গি খেয়াল করতাম।”
“কোন দিন?” শরণ্যা রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করে।
“আরে ওই তো,” নীরা প্রায় ফিস্ফিস্ করতে থাকে, “এর আগের উইক-এন্ডে আমি আর লিনী শপিং করতে বেরিয়েছিলাম। তা রাস্তায় পড়ে দেখি শিল্দা ব্যাগ ঘাড়ে করে কোথায় জানি যাচ্ছে। বেশ কিছুটা দূরে ছিল, তাই আর কথা হয়নি। তারপর লিনীর দিকে চোখ পড়তেই দেখি মেয়েটার মুখের জিওগ্রাফি বদলে গেছে। চোখদুটো হাঁসের ডিম, মুখে কেউ যেন টমেটো সস স্প্রে করে দিয়েছে। আমি তো ঘাবড়ে গিয়ে ভাবছি, রাস্তায় ফিট হয়ে পড়বে নাকি! এদিকে ওকে একবার নাড়া দিতেই আবার মুহূর্তের মধ্যে নর্মাল হয়ে গেল। বিড়বিড় করে পেট ব্যাথা না কি যেন বাজে এক্সকিউজ দিয়ে কাটিয়ে দিল ব্যাপারটা। আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাটা যে শিল্দাকে নিয়ে, এটা বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন।।”
“কঠিন কেন?” তিলোত্তমা জানতে চায়।
“না, মানে, শিল্দার মতো একটা ক্যারেক্টারের সঙ্গে ওই প্রেম-রোম্যান্স ব্যাপারগুলো একেবারে খাপ খায় না।”
“কেন রে, খুব গুণ্ডা-প্রকৃতি বুঝি লোকটা?” শরণ্যা বলে, “নো ওয়ান্ডার লিনী ওকে —”
“গুণ্ডা-প্রকৃতি? ফুঃ। আর হাসাসনা রন্, শিল্দা যদি গুণ্ডা-প্রকৃতি হয়, তাহলে মৃণালিনী সরকার স্লিপিং-বিউটি-প্রকৃতি। শিল্দা হল গিয়ে পয়লা নম্বরের বঙ্গপুঙ্গব।”
“মানে?”
“মানে ভেতো বাঙালি ভদ্রলোক। টিপিকাল দাদা টাইপের হাবভাব। অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কে দশটা-পাঁচটার অফিস। রোগামার্কা চেহারা, চশমা পরে, মাথায় টাক —”
“মাথায় টাক!” তিলোত্তমা আঁতকে ওঠে, “কি যা তা বলছিস তুই!”
“বোকো না। তোমার রাহুল দে-র ফটোও আমার দেখা আছে, কি এমন কন্দর্পকান্তি চেহারা শুনি?”
তিলোত্তমা অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “আহা, কিন্তু তা বলে কি — ”
“আরে রাখ্ তো,” উপলা বিজ্ঞের মতো হাত নাড়ে, “নীরাটার বাড়িয়ে বলা স্বভাব জানিস না? আসলে নিশ্চয়ই —”
“বিশ্বাস না হলে লিনীকে জিজ্ঞেস কর্,” নীরা কাঁধ ঝাঁকায়।
অগত্যা শরণ্যা মৃণালিনীকে ঠেলা মারে, “কি রে লিনী? সত্যি নাকি?”
মৃণালিনী এতক্ষণ ধ্যানমগ্ন হয়ে কি সব ভাবছিল, ঘুম ভেঙে ওঠা মুখ করে বলল, “কী সত্যি?”
“শিল্দার মাথায় টাক?”
মৃণালিনী একটু অবাক হয়ে বলল, “তুই কি করে জানলি?”
“তার মানে?” তিলোত্তমা তাজ্জব, “তুই বলছিস যে সত্যিই – ”
“মিথ্যে বলব কিসের দুঃখে শুনি?” মৃণালিনী বিরক্ত, “সত্যিই ওর মাথায় টাক, চোখে মাইনাস সেভেন চশমা, সিড়িঙ্গে ফিগার আর চকের গুঁড়োর মতো গায়ের রঙ। তো তাতে হয়েছেটা কি?”
নীরা বাদে সবাই ওর মুখের দিকে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর উপলা আমতা আমতা করে বলল, “মনে করিস না আমার কোনো প্রেজুডিস আছে, মানে ইয়ে, চেহারা দিয়ে আর কী ধুয়ে খায়, কিন্তু ঠিক কী দেখে তুই শিল্দার প্রেমে পড়লি বল্ তো?”
“শালা কে বলল প্রেমে পড়েছি?” মৃণালিনী খেঁকিয়ে উঠল।
“এই নিয়ে আবার তর্ক উঠবে কেন?” তিলোত্তমা অবাক হয়ে বলে, “এটা তো এতক্ষণে পরিষ্কার হয়েই গেছে যে —”
“কিচ্ছু পরিষ্কার হয়নি,” মৃণালিনী এতক্ষণে যেন আবার সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, “তোরা যা নয় তাই থিওরি বানিয়ে যাবি আর আমি আমিও সেগুলো টপাটপ গিলে ফেলব? অপ্রকৃতিস্থ মাতাল পেয়েছিস আমাকে?”
উপলা বিড়বিড় করল, “লে হালুয়া, এ যে আমার ডায়লগ আমাকেই ঝাড়ছে!”
“শাটাপ!” মৃণালিনীর ধমক খেয়ে উপলা আবার থতমত খেয়ে চুপ করে যায়। ঠিক তক্ষুণি ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেল।
হিস্ট্রি ক্লাসটা যথারীতি ফাঁকা যাচ্ছে। মিসেস রাধিকা দত্ত আজও কোনো অজ্ঞাত কারণে অনুপস্থিত। সিনিয়র টিচার হবার দরুণ স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর মিটিং-মিছিল লেগেই আছে। অবশ্য বলা যায়না, ক্লাসের মাঝখানে হঠাৎ বিনা নোটিসে উদয় হলেন হয় তো। অর্থাৎ হিস্ট্রি পড়ুয়াদের অন্য কোথাও সরে পড়বারও উপায় নেই।
“কি রে, আজ মাছের তেলে মাছ ভাজতে আসবেন না উনি?” সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে রোমিলা মুচ্কি হাসল। প্রবাদবাক্য বলা মিসেস দত্ত-র একটা মুদ্রাদোষ। ‘মাছের তেলে মাছ ভাজা’ আর ‘রক্ষকই ভক্ষক’, এই দুটো কথা তিনি ফাঁক পেলেই বলেন।
শরণ্যা হেসে বলল, “কে জানে! সামনে আবার কাল্চারাল ফেস্টিভাল না কি যেন একটা আসছে। এ কদিন কি আর ওঁর টিকির দেখা পাওয়া যাবে?”
হিস্ট্রি ক্লাসটাও ইলেক্টিভ ইংরিজি ক্লাসের মতোই ছোট। বাকিরা সবাই ভূগোল পড়ে। সংখ্যায় মোটে আট-নয়জন বলে ক্লাসটা লাইব্রেরীর ঘরেই হয়। অন্যরা বেশ কিছুক্ষণ আগে চলে এসেছে দেখা গেল। কোন বিষয় নিয়ে সম্ভবতঃ সিরিয়াস আলোচনা চলছে, কারণ সকলেরই হেসে হেসে অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। শরণ্যা জেস্কে দেখে অবাক হয়ে বলল, “তোর না জিওগ্রাফি এখন?”
জেস্ হাসির ধমক সামলে ঢক্ঢক্ করে খানিক জল খেয়ে বলল, “ক্লাস বাঙ্ক কর্ রহী হুঁ।”
“অ। আর তিল্লী, তুইই বা পলিটিকাল সায়েন্স ক্লাসে ছিলি না কেন?”
তিলোত্তমা ঠোঁট উলটাল, “কি লাভ? এমনিও মাথায় ঢোকে না, অমনিও না। তার চেয়ে এখানে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং আলোচনা চলছে।”
রোমিলা চেয়ার টেনে বসে বলল, “হ্যাঁ, এটাই তো জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, এত হাসাহাসি কিসের?”
উদিতা উৎকট গাম্ভীর্য নিয়ে বলল, “আমরা টলিউডের হিরোদের নিয়ে ডিস্কাস করছি।”
“ইস!” রোমিলা নাক কুঁচকে বলল, “আর কোনো টপিক নেই তোদের কাছে?”
“আরে শুরুটা তো অন্যভাবে হল,” উদিতা কৈফিয়ৎ দেয়, “আমি এদের বলছিলাম যে রোজ সন্ধ্যেবেলা আমার বাড়ির ল্যান্ডলাইনে একটা লোক ফোন করে। তার দৃঢ় বিশ্বাস যে ওটা রচনা ব্যানার্জির বাড়ির নম্বর। আমি বা মা, যে-ই ধরি না কেন, নিজের ভাইপোকে সিনেমায় কাজ দেবার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ঘেনিয়ে যায়।”
“বলিস কী!”
“বিশ্বাস কর্, এটা ফ্যাক্ট। এখন অবশ্য আলোচনাটা বাজে দিকে চলে যাচ্ছে —”
“থাম্ তুই,” নীরা বলে, “এন্টারটেন্মেন্ট দেখার ইয়েটা না থাকলে আর কি হল? এই দেখ তানিয়া কিরকম প্রসেন্জিতের ডায়লগ বলছে —”
নীরাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই তানিয়া নাটুকে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “অ্যা-অ্যা-ই-ই-ই-ই! যে আমার ছেলের গায়ে হাত দেবে তার হাত আমি ক্যে-ট্টে নেবো-ও-ও-ও!”
“উফ্, সাধু, সাধু,” সোমদত্তা উচ্ছ্বসিত, “এবার এটা শোন — ‘মা-আ-আ-আ! তুমি এই ছেলেটাকে একা রেখে চলে গেলে মা-আ —’”
“হচ্ছে না, হচ্ছে না,” তিলোত্তমা বাধা দিয়ে বলে, “এটা কেমন চিরঞ্জিত-চিরঞ্জিত শোনাচ্ছে।”
উদিতা বলে, “ধুস্! চিরঞ্জিত হল এরকম — ‘আরে এ্যাইইইই! বউ মরে গেলে বউ পাওয়া যায়, মা মরে গেলে কি মা পাওয়া যায় রে পাগলা?’”
সবার হাসির চোটে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়!
“আরে চুপ,” শরণ্যা তার মধ্যেই সাবধান করার চেষ্টা করে, “মুল্চন্দানি আমাদের সবকটাকে ঘাড় ধরে বের করে দেবে এখান থেকে।”
“থাম্ তো!” জেস্ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, “সাইজ দেখি হ্যায় উস্কী? আমরা ক’জন মিলে পুরো পট্কে দেব।”
“বাজে কথা রাখ্,” উদিতা বলে, “মোদ্দা বিষয়টা হল যে প্রসেনজিৎ আর চিরঞ্জিতের ‘মা’ বলার স্টাইল পুরো আলাদা। প্রসেনজিৎ চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে বলে ‘মা-আ-আ-আ’, আর চিরঞ্জিত একদম নীচু স্কেলে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে বলে, ‘ম্যা-হ্যা-হ্যা-হ্যা-হ্যা —’”
আর এক ধমক হাসির মধ্যে নীরা বলে, “আরে তোরা এখনও চিরঞ্জিত-প্রসেনজিতকে নিয়ে পড়ে আছিস কেন? লেটেস্ট ব্লকবাস্টার তো হচ্ছে গিয়ে ওই ‘প্রেমের কাহিনী’ না কি যেন একটা —”
“আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ,” শরণ্যা মহোৎসাহে বলে, “এটা আমিও দেখেছি। আমাদের পাড়ায় চতুর্দিকে পোস্টার পড়ে গেছে। খরগোস হাতে বসে আছে দুজন।”
তানিয়া বলল, “‘প্রেমের কাহিনী’ নাম না দিয়ে ‘খরগোসের কাহিনী’ নাম দিলে কত ইন্টারেস্টিং হত বল্।”
সোমদত্তা বলল, “তা ইন্টারেস্টিং নামের কথা বলতে গেলে তো সিনেমায় থাকলে চলে না, যাত্রায় নামতে হয়! উফ্, কি ইনোভেটিভ্ —”
সবাই একবাক্যে হইহই করে উঠল।
“আরে যা বলেছিস! সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম, ‘সিঁথির সিঁদুরে বাঘের আঁচড়’!”
“হ্যাঁ, তারপর গিয়ে ‘রোগা স্বামীর দারোগা বউ’ —”
“সবচেয়ে সলিড্ হল ‘তোমার মনের ল্যাম্পপোস্টে আমার প্রেমের ছাগল বাঁধা’—”
“গার্ল্স!” হঠাৎ পিছন থেকে লাইব্রেরিয়ান মিসেস মুলচন্দানির তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেল, “দিস ইজ আ প্লেস ফর স্টাডিইং! ওয়ান মোর ওয়ার্ড অ্যান্ড আই উইল থ্রো এভ্রিওয়ান আউট!”
তখনকার মতো টলিউড-বৃত্তান্ত স্থগিত রেখে সবাই নিজেদের মধ্যে অন্যান্য আলোচনায় মন দিল।
“লিনী তো মনে হচ্ছে ক্লীন্ বোল্ড্,” তিলোত্তমা মিটিমিটি হাসল।
“সত্যি, ভাবা যায়?” শরণ্যা বলে, “লিনীর মতো একটা দাউদ ইব্রাহিম টাইপের মেয়ে —”
“দাউদ ইব্রাহিম না কচুর শাগের চচ্চড়ি,” নীরা বলল, “ওটা বরাবরই ওরকম। মুখেই যত লেকচার। মালটা গোপনে কবিতা লেখে সে খবর রাখিস? এতদিন যে প্রেমে পড়েছে সেটাই বুঝতে পারেনি, এখন টের পেয়ে মুখ দিয়ে আর কথা বেরচ্ছে না!”
“হ্যাঁ, প্রথমবার ফিলিংটা এরকমই হবার কথা বটে ... ” তিলোত্তমা অন্যমনষ্কভাবে হাসে।
শরণ্যা জিজ্ঞেস করল, “কথাটা ওভাবে বলছিস কেন? কী হয়েছে?”
“তুই একটু বেশি লক্ষ্য করিস রন্।”
“তা নয় করলাম। কিন্তু প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়া কেন?”
তিলোত্তমা হেসে বলল, “ও কিছু না। আসলে আমি ভাবছিলাম, প্রেমে পড়ার সময়টা বেশ ভাল, আর ইজি। তবে দু-তরফা একটা রিলেশান চালানো? একেবারে উলটো।”
“এই, ঠিক কী বলছিস বল্ তো?” নীরা এবার নড়েচড়ে বসল, “এরকম কথা কেন উঠছে? রাহুলের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছিস নাকি?”
“না না ... সেরকম কিছুই না,” তিলোত্তমা কিছুটা আত্মগতভাবে বলে, “তবে গোড়ায় গলদ আছে।”
“ইয়ে,” নীরা একটু কেশে নিয়ে বলল, “মাইন্ড করিসনা বুঝলি, কিন্তু ওকে তেমন – মানে তোর সঙ্গে তেমন —”
“মানায় না তো? হুঁ। অনেকেই বলেছে। কিন্তু ওটা কোনো ফ্যাক্টর নয়।”
“তাহলে কিসের প্রবলেম?”
“কে জানে!” তিলোত্তমা উদাসভাবে জানলার দিকে তাকিয়ে বলে, “সবার তো সবার কাছ থেকে আলাদা আলাদা এক্সপেক্টেশান থাকে, তাই হয়তো আর...”
ওকে চুপ করে যেতে দেখে শরণ্যা আর কথা বাড়াল না। নীরার দিকে ফিরে হাসিমুখে বলল, “তোর কি খবর?”
“কি আবার খবর?” নীরা ভুরু তুলে পালটা প্রশ্ন করে।
“কী খবর তা বলে দিতে হবে?” তিলোত্তমাও যোগ দেয়।
“আরে ধুর! কিছুই নয় তেমন,” নীরা ব্যাজারভাবে বলে, “তবে অত্রি হয়তো কিছু একটা আঁচ করেছে। অবশ্য বলা যায় না, অন্য কোনো পসিবিলিটিও থাকতে পারে...”
নীরা আগের রবিবারের ছবি আঁকার পর্বটার কথা শোনাল।
“বাঃ, তাহলে তো বেশি দেরি নেই, শিগ্গিরই কিছু একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে —”
“আরে ধ্যাৎ! ওর কলেজে কে একটা মেয়ে আছে তাকে হেবি পছন্দ।”
“তুই কি করে জানলি?”
“উফ্! আগের মাসটা শুধু ‘শুচিস্মিতা’ নাম জপ শুনে গেছি চব্বিশ ঘন্টা। ও ছাড়া ছেলের মুখে জাস্ট কোনো কথাই নেই! এই কটা দিন হল বন্ধ আছে, কারণ রিসেন্টলি নাকি মেয়েটা ওকে ওয়াকিং পেপার দিয়েছে —”
“আরে তাহলে তো আরোই কেল্লা ফতে! ঝোপ বুঝে কোপ মারবার এমন সুযোগ —”
“আজ্ঞে না,” নীরা বিরক্ত, “ও এখনও ওকেই ইয়ে করে। যাক্গে, আমার কথা বাদ দে তো, বলি তখন থেকে যে জেরা করা হচ্ছে, তোমার ব্যাপারখানা কী? গত সপ্তাহে তো কাউকে কিছু না বলে ড্যাং ড্যাং করে রঙ্গীতদার বাড়ি গিয়ে —”
নীরা কথা শেষ করতে না করতেই কোথা থেকে মিসেস দত্ত এসে পড়লেন। কাউকেই অবশ্য তেমন বিচলিত হতে দেখা গেল না, কারণ ক্লাসের তখন দশ মিনিট বাকি।
“গুড আফটারনুন গার্্তস! সরি ফর বিয়িং সো লেট — কি আর বলব তোমাদের, আই অ্যাম লিটারালি গোয়িং ক্রে-এ-জি! হোয়াট ওয়্যার য়ু ডুয়িং?”
“ডিস্কাসিং অ্যাবাউট চিরঞ্জিত অ্যান্ড প্রসেন্জিৎ --” উদিতা বিড়বিড় করতে গিয়ে রোমিলার প্রবল খোঁচা খেয়ে চুপ করে গেল।
“বেগ ইয়োর পার্ডন উদিতা?”
তানিয়া তাড়াতাড়ি বলল, “ম্যাম, আমরা সত্যাগ্রহ মুভমেন্ট পড়ছিলাম।”
“এক্সেলেন্ট, ওখান থেকেই শুরু করা যাক তাহলে,” ম্যাম বসতে বসতে বললেন, “বুঝতেই পারছ, ততদিনে ব্রিটিশদের মোটিভটা দেশের কাছে খুব স্পষ্ট হয়ে গেছে, যাকে কথায় বলে ‘রক্ষকই ভক্ষক’...”
আজ পড়ব ‘The Love Song of J. Alfred Prufrock,’ মিসেস গাঙ্গুলী হেসে বললেন, “এটা তোমাদের জীবনের একটা স্মরণীয় দিন হয়ে যেতে পারে কিন্তু! অবশ্য যদি আমি ঠিকঠাক পড়াতে পারি, তাহলেই।”
“ম্যাম্,” উপলা কবিতাটা উলটে পালটে দেখে সংশয়ের গলায় বলে, “এটা নিশ্চয়ই আজকের মধ্যে শেষ হবে না?”
“আজ কেন? সারা জীবনেও শেষ হবে কিনা সন্দেহ। এই কবিতার জল অনেক গভীর। তবে আমরা খুব বেশি গভীর জলে নামবার চেষ্টা করব না, কারণ আই.এস.সি. বোর্ডের লেভেলে সেই চেষ্টা করলে তোমাদের সুদ্ধ আমি ডুবে যাব। তবু, যতটা হয় ততটাই লাভ!”
এই বলে ম্যাম শুরু করলেনঃ
Let us go then, you and I …
কেউ যেন এক সন্ধ্যায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে, কোনও একটা সংকল্প করে। অথচ, সে যেন তার নিজের মনের বাইরে এক পাও রাখছে না! যাওয়ার পথে কে তার সঙ্গী? কার উদ্দেশ্যে তার এই উদ্দেশ্যহীন সান্ধ্যভ্রমণ? কেমনভাবে এই বিষাদপূর্ণ স্বগতোক্তিকে প্রেমের গান আখ্যা দিলেন কবি? এ কি শুধুই গল্প? একটা কাল্পনিক ঘটনা? কিছু সত্য?
শব্দের তরঙ্গ বইতে লাগল চারিদিকে। সরোবরে ঢিল পড়লে যেমন বৃত্তের সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমন। কবিতাটাই একটা সরোবর। কত গভীর, কে জানে? কিন্তু ডুব না দিলে যে চলবে না! ধীরে ধীরে, স্বপ্নের রাজ্যে যাওয়ার মতোই সেই বিশাল সরোবরের মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগল শরণ্যা।
“ওগো দেখি আঁখি তুলে চাও, তোমার চোখে কেন ঘুমঘোর?” তিলোত্তমা ফুচ্কা খেতে খেতে মৃণালিনীকে খোঁচা মারে।
“শালা, কি ভাঁট বকছিস সমস্ত?” মৃণালিনী বিরক্ত হয়ে মুখে একসঙ্গে দুটো ফুচ্কা ভরে ফেলে।
“ভাঁট? এটা রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার খেলা’,” শরণ্যা খাওয়া থামিয়ে বলে।
“মায়ের খেলা বাবার খেলা যাই হোক, এসব সেকেলে ঠাট্টা শোনার মতো মুড নেই,” মৃণালিনী মুখে ফুচ্কা নিয়েই জড়িয়ে জড়িয়ে বলল।
“মুড নেই? আচ্ছা বেশ,” উপলা যুত করে মুখে ফুচ্কা ভরে বলে, “তাহলে সোজা ভাষায় বলছি। বাংলা-খাওয়া মুখ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন বে?”
“তোরা কটা অপদার্থ মিলে আমার মেজাজটা চটকে দিয়েছিস বলে। ... ও কাকু, যথেষ্ট হয়েছে, এবার ঝাল ছাড়া দাও।”
“হুঁ হুঁ বাবা, এবার আর গাল দিয়ে পার পাচ্ছিস না বুঝলি?” নীরা ছোঁ মেরে শরণ্যার বাটি থেকে একটা ফুচ্কা তুলে নিয়ে বলে, “ভাব্, ভাব্। সব সিম্টম মিলে যাচ্ছে।”
“মানলাম না হয় তর্কের খাতিরে। কিন্তু তাতে তোদের এত আনন্দ কিসের?” মৃণালিনী দাঁত খিঁচিয়ে বলে।
“আনন্দ না!” উপলা অবাক, “তুই হলি আমাদের ফ্রেন্ড, ইয়ার, দোস্ত —”
শরণ্যা যোগ করে, “ক্লাসমেট, ক্রাইমমেট, প্রাইমেট —”
“আমি প্রাইমেট?!” মৃণালিনী স্তম্ভিত।
“শুধু তুই কেন?” তিলোত্তমা নির্বিকার, “আমরা সবাই। মানে আমাদের পাঁচজনের কথা বলছি। মানুষের মতো ব্যবহার করি আমরা?”
“তা ঠিক,” এতক্ষণে মৃণালিনীর মুখে মুচ্কি হাসি দেখা যায়, “আর আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাঁদর হল এই শরণ্যা বোস।”
শরণ্যা ব্যস্তভাবে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, এমন সময় ফুচ্কা কাকু বলল, “পাঁচ টাকার করে হয়ে গেছে কিন্তু।”
উপলা বলল, “আমাকে আর ওকে আরেক রাউন্ড। কি রে রন্?”
শরণ্যা বলল, “নিঃসন্দেহে।”
“আমি আর পারছি না বাবা,” নীরা বলল, “মটর দিয়ে ফাউ দাও একটা, বেশি করে নুন দিয়ে। লিনী, খাবি না?”
“নাঃ,” মৃণালিনী আবার উদাসভাবে বলে, “আর ভাল লাগছে না।”
বাসস্টপে নেমে উপলা অবাক! কণিষ্ক ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেলিং-এ ভর দিয়ে একপেশে হাসি হাসছে।
“তুই এখানে কি মতলবে?” উপলা সন্দেহের চোখে তাকায়।
“আপাততঃ তোর সঙ্গে দেখা করবার মতলবেই,” কণিষ্ক হাসিটা বজায় রেখেই বলে।
“তা বাড়িতে অপেক্ষা করলেই তো পারতি, এখানে... এই, কি ব্যাপারখানা বল্ তো? তোর ভাবগতিক সুবিধের ঠেকছে না আমার।”
“বলছি, তার আগে এই জঘন্য বাসস্টপ থেকে নাম তো দয়া করে।”
কিছুক্ষণ পাশাপাশি হাঁটবার পরেই উপলা অধৈর্য্য হয়ে বলে, “কই, কি বলবি বল?”
“এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন বল্ তো?” কণিষ্ক তার সংশয়টাকে বেশ উপভোগ করে।
“কারণ কণিষ্ক চ্যাটার্জিকে আপাদমস্তক চেনা হয়ে গেছে আমার। শুধুমাত্র বিরহের জ্বালায় তীর্থের কাকের মতো বাসস্টপে অপেক্ষা করবার বান্দা নন তিনি।”
“বিরহের জ্বালা?” কণিষ্ক ভুরু তুলে বলে, “হোয়াট্স দ্যাট?”
“উফ, নাটকের শেষ থাকে একটা,” উপলা মহা বিরক্ত হয়ে বলে, “পাতি বাঙালির ছেলে, আজন্মই কলকাতায় বাস, বলে কিনা বিরহ মানে কি! বিরহ মানে ইয়ে, অপ্রকৃতিস্থ —”
“মাতাল,” কণিষ্ক কথা কেড়ে নিয়ে বলে, “সুকুমার রায় ‘আবোল-তাবোল’ লিখেছিলেন, তুই আবোল-তাবোল গালাগাল নিয়ে একটা বই লেখ। সেল যা হবে না, হট কেকের মতো।”
“বই লেখার হলে লিনী লিখবে,” উপলা ফিক করে হাসে, “ওর স্টক অগাধ। কিন্তু তুইই বা তখন থেকে আবোল-তাবোল বকছিস কেন? ঘটনাটা কী ঘটেছে সেটা বলবি কিনা?”
“এ যাত্রা বেঁচে গেলাম মনে হচ্ছে,” কণিষ্ক আবছাভাবে হাসল।
উপলা দাঁড়িয়ে পড়ে অবাক হইয়ে বলল, “মানে?”
“মানে ডিসেম্বরের মধ্যে ঝামেলা মিটে যাবে।”
উপলা খানিকক্ষণ কি বলবে ভেবে উঠতে পারে না। অবশেষে জিজ্ঞেস করে, “কিভাবে? হঠাৎ করে...”
“দু সপ্তাহ আগে কোর্টে হিয়ারিং ছিল না একটা? ওই যেদিন আমি ফোন করেছিলাম বললাম তোকে? তার পর পরই বাবা-মায়ের মধ্যে কথা হয়েছিল। মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে যাবে।”
“ও...” উপলা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল।
“কি হল? মাঝ রাস্তায় স্ট্যাচু হয়ে গেলি যে?”
“না,” উপলা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “আসলে হঠাৎ করে হল তো, তাই আর কি। তোর দাদা জানে?”
“হ্যাঁ, যে দিন ডিসাইড করা হল, সেদিনই মা জানিয়েছে।”
“হুম্।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ হাঁটতে থাকে। তারপর কণিষ্ক গলা ঝেড়ে বলে, “ব্যাপার কি, গুম মেরে গেলি কেন? খুশি হোস্নি মনে হচ্ছে।”
“আরে পুরো ঘটনাটা কি আনন্দে লাফানোর মতো কিছু?” উপলা অন্যমনষ্কভাবে বলে।
“কী যে বলিস!” কণিষ্ক মাথা নাড়ে, “এই নিয়ে কম দিন ধরে অশান্তি হচ্ছে? আমি অন্ততঃ ডিসিশানটাকে হ্যাপিলি ওয়েলকাম করছি।”
“হ্যাঁ, অ্যাট লীস্ট... মানে মিউচুয়াল যখন হয়েছে শেষ অবধি, তখন নিশ্চয়ই একটা ব্যালেন্সড্ ডিসিশান নেওয়া হয়েছে।”
“কোথায় আর? মা কোনও অ্যালিমনি পাবে না। বাবা মিউচুয়াল ডিভোর্স দিতে রাজি হল তো ওই শর্তে।”
“কি বলছিস তুই!” উপলা স্তম্ভিত হয়ে বলে, “আর তোর খরচ?”
“দেবে না। মা তো চাকরি করে। তা ছাড়া আমি নেক্সট ইয়ার অ্যাডাল্ট হয়ে যাচ্ছি না?”
“হোয়াট দ্য হেল, কণিষ্ক!” উপলা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ততক্ষণে, “আন্টি এরকম একটা এগ্রিমেন্টে রাজি হলেন কেন?”
“কারণ মায়ের আর পোষাচ্ছিল না,” কণিষ্ক ক্লান্তভাবে বলে, “একটা কেস টানার কি কম খরচ! পুরোটা তো একাই ম্যানেজ করতে হয়েছে। দাদা তো এই মুহূর্তে বেশি হেল্প করতে পারছে না, তাও —”
“শাক্যদার আর কি,” উপলা কিছুটা উষ্মার সঙ্গে বলে, “য়ু.এস-এ থাকে, এখানকার কোনো ঝামেলাই নিতে হয় না, নিজেরটা বেশ গুছিয়ে নিয়েছে।”
“এটা ঠিক বললি না। দাদা যখন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে, তখন ঝামেলা তুঙ্গে। কিভাবে পুরোটা হ্যান্ডেল করেছে আমি তো দেখেছি। আমাকে কত কিছুর থেকে প্রোটেক্ট করেছে তার হিসেব নেই। তা ছাড়া ওর চাকরিটা নতুন, বিদেশে খরচও কম নয়, তাও যখন যতটা পেরেছে মাকে হেল্প করেছে। আমার স্কুল ফি অনেকটাই ও দেয়।”
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে উপলাদের বাড়ির সামনে চলে এসেছে ওরা, তা কারুরই খেয়াল পড়েনি। উপলাদের পুরোনো পাঁচতলা বাড়িটা শরৎ বোস রোডে, সাদার্ন অ্যাভিনিউ থেকে ডানহাতি ঘুরে মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। কণিষ্কর বাড়ি সেলিমপুরের দিকে, তবে মাঝে মাঝে স্কুল ফেরত অথবা বাড়ির থেকে হেঁটেই চলে আসে। সেই কোন ছোটবেলার বন্ধু ওরা! পুরোনো স্কুলে উপলা কেজি থেকে ক্লাস টেন অবধি পড়েছিল। কণিষ্ক ঢোকে ফোর বা ফাইভে। তারপর থেকেই দুজনে হরিহর আত্মা। ইদানিং উপলার ইস্কুল পালটে যাওয়ায় কণিষ্কর যে বেশ অসুবিধাই হয়েছে, তা বুঝতে কষ্ট হয় না ওর। আসলে কণিষ্কর কোনোদিনই প্রচুর বন্ধুবান্ধব ছিল না। শাক্যদা যতদিন দেশে ছিল, ততদিন বোধহয় সেরকম অভাবও বোধ করেনি। কিন্তু কিছু না বললেও উপলা টের পায়, কণিষ্ক আজকাল একা হয়ে পড়েছে। তাই হুট্ বলতেই উপলার বাড়ি এসে হাজির হয়। আগে এত ঘন ঘন যাতায়াত ছিল না।
হঠাৎ দরজা খুলে বড়জেঠিমা বেরিয়ে এসে বললেন, “কী রে তোরা? বেল বাজানো নেই কিছু নেই, মশগুল হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছিস? ঢোক ভিতরে।”
কণিষ্ক আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে আমি — আমি বরং আজ —”
“ওমা, ছেলের কথা শোনো একবার,” বড়জেঠিমা অবাক, “দোরগোড়া থেকে শুকনো মুখে ফিরে যাবি নাকি? দু সেট লুচি ভাজা হয়ে গেছে। পলা, টিফিন খেয়েছিলি?”
“আরে হ্যাঁ রে বাবা,” উপলা বিড়বিড় করে ঘরে ঢুকে গেল। হাত মুখ ধুয়ে খাবার ঘরে গিয়ে দেখল কণিষ্ক টেবিলের উপর হেড ডাউন করে বসে আছে, খাচ্ছে না।
উপলা একটা চেয়ার টেনে বসে গলা ঝেড়ে বলল, “আমি শাক্যদাকে নিয়ে একটু বেশি বলে ফেলেছি। তুই খারাপ পাসনি। জানিস তো আমি একটা অপ্রকৃতিস্থ।”
কণিষ্ক মাথা তুলে হাসিমুখে বলল, “খারাপ পাবার বান্দা কণিষ্ক চ্যাটার্জি নয়। তোর তো মনে হতেই পারে। তবে দাদা অনেকটাই করেছে। দেশে ফিরে এলে হয়তো সিচুয়েশানটা আরেকটু ইম্প্রুভ করবে। ততদিন মা ম্যানেজ করে নিতে পারবে বলেই মনে হয়। এখনও বছর দশেক চাকরি আছে, সেলিমপুরের ফ্ল্যাটটা আছে।”
“তোর বাবা এরকম একটা কাজ করবেন এটা আমি ভাবিনি।”
“আমি কিন্তু খুব একটা আশ্চর্য হইনি। শেষের দিকে থিংস টার্নড আগলি। তবে আমি এটাও বলতে পারব না যে সব দোষ বাবার। এটা একটা অ্যাডজাস্টমেন্ট ইস্যু। বাবা হয়তো ভেবেছিল যে এই ভাবে প্রেশার ক্রিয়েট করলে মা ডিভোর্স দিতে পারবে না। বাবা তো শুরু থেকেই এটা চায়নি।”
“হতে পারে,” উপলা চিন্তিতভাবে বলে, “কিন্তু —”
“কোনও কিন্তু নয়,” কণিষ্ক হঠাৎ উপলাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “এসব ডিপ্রেসিং কথাবার্তা থামা তো! দয়া করে খাওয়া শুরু কর। ইস্কুল থেকে ফিরে না খেয়েই দৌড়েছি আমি, পেটে ছুঁচোর কীর্তন হচ্ছে।”
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)