।। ৬ ।।
“ফুল্কি, আমি জানতে চাই পরের বছর পাশ করবার কি আদৌ কোনো ইচ্ছে আছে?” মা এসে ভীষণ বিরক্তভাবে জানতে চান।
মৃণালিনী মাথায় বালিশ চাপা দিয়ে শুয়েছিল, তার তলা থেকেই বলল, “আরে জ্বালিও না তো! কি হয়েছেটা কী?”
“ভর সন্ধ্যেবেলা বিছানায় পড়ে আছিস, পড়াশোনা নেই?”
“কাল রবিবার।”
“তাই বলেই সব লাটে তুলে দিতে হবে?”
“হুঁ।”
“যা ইচ্ছে কর্। তবে আমিও বলে রাখছি, আই.এস.সি-তে যদি এইট্টি পার্সেন্টের আধ নম্বর কম পেয়েছিস, তাহলে —”
“ত্যাজ্য কন্যা করবে তো? জানি।”
“উফ্!” মা আর সহ্য করতে না পেরে চলে গেলেন।
মৃণালিনী একই ভঙ্গিতে শুয়ে রইল। মনে মনে ভাবল, মাথায় বালিশ না দিয়ে আইস ব্যাগ চাপালে ভাল হত। একেই যে প্যাচ্পেচে গরম, তার উপর মাথায় রাজ্যের চিন্তা। এ অবস্থায় পড়াশোনা করতে বসলে সত্যিই তাকে বাঁচানো যাবে না। থেকে থেকেই কালকের টিফিন ব্রেকের কথাগুলো মনে পড়ছিল। সবাই মিলে এমন করে চেপে ধরেছিল তাকে, বাপ্রে বাপ! একটু ঢিলে দিলেই কেউ ছাড়ত না। ভেবেছিল নীরাটা অন্ততঃ ওকে সাপোর্ট করবে, কিন্তু কোথায় কি! উলটে যা বলার কথা নয় তাও সাতকাহন করে শুনিয়ে দিল সবাইকে! পয়লা নম্বরের বিশ্বাসঘাতক।
কিন্তু ভুলটাই বা কী বলছিল ওরা? মৃণালিনীর হঠাৎ কিছুদিন আগের একটা ঘটনার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। সেই যে সন্ধ্যেবেলা, সামনে ‘ঝিন্দের বন্দী’-র খোলা পাতা, আর অন্ধকারে মুহূর্তের জন্য ফুটে ওঠা গৌরীশঙ্করের মুখ ...
গৌরীশঙ্কর? না শিলাদিত্য?
ভাবনার ঘোরে মাথার উপর বালিশটা এমনভাবে ঠেসে ধরেছিল, যে দম আটকে আরেকটু হলেই গিয়েছিল আর কি! মৃণালিনী ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। কিছুই ভাল লাগছে না তার। কথায় কথায় রাগ হচ্ছে, বিরক্তি আসছে, এমনকি — ভাবলেও তাজ্জব হতে হয় — কান্না অবধি পাচ্ছে। কাউকে ভাল লাগার আনুসঙ্গিক যদি একসাথে এতগুলো খারাপ লাগা হয়, তাহলে লোকে এসব নিয়ে এত আদিখ্যেতা করে কেন তা মৃণালিনীর বোধের বাইরে। কিন্তু ... ওরা যা বলল তা যদি সত্যি হয় তাহলে ...
তাহলে কী আবার! কিছুই না! উফ্! মৃণালিনী নিজেই নিজেকে বোধাবার চেষ্টা করে, প্রেমটেম সব বাজে। নতুন স্কুলে ঢুকে অবধি এমন সব বন্ধু জুটেছে, সবকটারই বাড়াবাড়ির ধাত। ওদের কাউকেই এটা বলে বোঝানো অসম্ভব যে এসব ফিলিংগুলো হল গিয়ে দু’দিনের মায়া; কুয়াশার মতো কেটে যায় আবার। এই রকম সাংঘাতিক একটা উপমা ভেবে ফেলে যারপরনাই খুশি হয়ে উঠল সে। না, আর এই বাজে ভাবনাগুলো প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। কিছু একটা বই নিয়ে বসলে ভাল হত। হাতের কাছে ‘ঝিন্দের বন্দী’-টা পড়ে ছিল; সেটার দিকে চোখ যেতেই ছিটকে সরে এল মৃণালিনী। এই বইটাই যত নষ্টের গোড়া। এক্ষুণি ওটাকে বিদায় করা দরকার। প্রায় একটা বোমা হাতে করে নিয়ে যাওয়ার মতোই বইটা মা-বাবার ঘরের বইয়ের শেল্ফের এক কোণায় গুঁজে দিয়ে এল সে। তারপর নিজের ঘরে ফিরে এসে টেবিলে পা তুলে দিয়ে আগাথা ক্রিস্টির বই খুলে বসে রইল খানিকক্ষণ। তাতে কাজ হল না। খানিক পরেই এলোমেলো চিন্তারা আবার মনের মধ্যে ভীড় করে এল।
আসলে নিজেকে সব ব্যাপারে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করা মৃণালিনীর স্বভাব নয়। ওটা শরণ্যার অভ্যাস, হয়তো তিলোত্তমারও। তিলোত্তমার অনেক কিছুই বোধগম্য হয়না ওর, তাই সঠিক করে কিছু বলতে পারেনা। তবে এটুকু নিশ্চয়ই জানে যে তার তুলনায় তিলোত্তমা নিজেকে চেনে অনেক বেশি। নিজেকে চিনতে না পারার যে কতরকম অসুবিধে, তা ইদানীং বেশ টের পায় মৃণালিনী। আগে হলে এতরকম ভাবনা মাথাতেই আসত না। চিরাচরিত কোনো পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার হয়তো একদিনেই বদলে গেছে তার — কিন্তু পুরোটাই ঘটেছে নিজের অজান্তে। এতগুলো বছরে মৃণালিনী যে কতটা বদলেছে, তার কোনো নির্দিষ্ট হিসেব নেই ওর কাছে। কিন্তু আজকাল বুঝতে পারে, কোথাও যেন একটা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। তাই আজ মনে হল, নিজেকে কতগুলো প্রশ্ন না করলে আর চলছে না যেন। নিজের সম্পর্কে তার এতকালের ভাসা ভাসা ধারণাগুলোও হঠাৎ করে নড়ে যাচ্ছে যে! মৃণালিনী নিরপেক্ষভাবে ঘটনাগুলোকে যাচাই করবার চেষ্টা করতে লাগল।
প্রায় বছর চারেক আগে, যখন মৃণালিনী রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ইস্কুলটায় নীরার সঙ্গে পড়ত, তখন হঠাৎ একদিন শোনা গেল, পাড়ায় এক নতুন পরিবার এসেছে। খবরটা একটু অদ্ভুত ঠিকই। মৃণালিনীদের বাড়ি ভবানীপুরে। যতীন দাস পার্ক মেট্রো স্টেশন থেকে হাঁটা পথে পাঁচ মিনিট। ওই পাড়ায় সব বাড়িই অতি প্রাচীন, আর প্রোমোটারের থাবা পড়েনি তখনও সে সব দিকে। পুরোনো বাড়িতে নতুন প্রতিবেশী আসার ব্যাপারটা বিরল বৈকী। তবে শোনা গিয়েছিল যে ওই বাড়ির আগের বাসীন্দা ক্রেতাদের কিরকমের যেন আত্মীয় হতেন। তিনি শেষ বয়সে ছেলের কাছে পাকাপাকিভাবে থাকতে চলে যাওয়ার আগে বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে যান। তা সে যাইহোক, নীরা প্রথম খবরটা দিয়েছিল, মনে আছে। ছোটবেলা থেকে ওদের বাড়ি থেকে একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সময় যখন ওরা সবাই মিলে দূর-পাল্লার ট্রেনে উঠত, তখন মৃণালিনী অসীম বিরক্তি সহকারে লক্ষ্য করত, যে নীরা গাড়িতে উঠেই আর পাঁচজন সহযাত্রীদের সঙ্গে দিব্যি জমিয়ে নিয়ে ওদের কেক-বিস্কুটে ভাগ বসাতে লেগেছে। এ ব্যাপারে সে নীরার একেবারে ওপিঠ। অচেনা লোকের প্রতি তার একটাই মনোভাব; তা হল গভীর সন্দেহ। যা হোক, এ ক্ষেত্রেও দেখা গেল নিয়মের অন্যথা হয়নি। নীরা নাচতে নাচতে এসে বলে গেল, “জানিস লিনী, তেরো নম্বর বাড়িতে নতুন কারা সব এসেছে।”
“তো?” মৃণালিনী ঠোঁট উলটে উদাসভাবে বলেছিল।
“‘তো’ মানে?”
“মানে, আমার কি?”
“কী যা তা! আমাদের পাড়ায় জন্মে ইস্তক কোনও নতুন লোক এসেছে আজ অবধি? আর ওই পেল্লায় বাড়ি কিনে এসেছে যখন, নিশ্চয়ই বড়লোক। সব মিলিয়ে বেশ এক্সাইটিং ব্যাপার।”
“তোর লাগতে পারে এক্সাইটিং,” মৃণালিনী আড়মোড়া ভেঙে বলেছিল, “আমার ঘুম পাচ্ছে। রাস্তায় দেখা হলে যদি গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে আসে তাহলে জাস্ট কুপিয়ে দেব।”
“এ তো আশ্চর্য ব্যাপার! পাড়ায় নতুন এসেছে, আলাপ করতে চাইবে না?” নীরা হতভম্ব, “এতে কুপিয়ে দেওয়ার কি হল?”
“দেখ্ নীরা,” মৃণালিনী সোজা হয়ে বসে বলল, “এই যে তোর যখন তখন যার-তার সঙ্গে প্রাণের বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলার অভ্যেস, এ মোটেই ভাল কথা নয়। উট্কো লোকের হাতে পড়ে একদিন প্রাণটা খোয়াবি এই বলে রাখলাম।”
এর পর কিছুদিন আর এসব নিয়ে ভাবতে হয়নি। নতুন প্রতিবেশীরা যে বেশ অসামাজিক প্রকৃতির, একথা পাড়ায় রটে যেতে বেশিদিন দেরি হল না। ওদের বাড়ির থেকে কারুর সাথে আলাপ করার বিশেষ তাগিদ দেখা যায়নি তো। তাতে অবশ্য মৃণালিনীর যথেষ্ট সুবিধেই হয়েছিল। এইভাবে কিছুদিন নিরুপদ্রবে কাটবার পর হঠাৎ এক রবিবারের সকালে দরজায় ধাক্কা পড়ল। মৃণালিনী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে, একটা রোগাভোগা ক্ষয়াটে চেহারার ছেলে দাঁড়িয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। দেখেই চেনা গেল, এ সেই নতুন প্রতিবেশীদের একজন। একটু কাছে এগিয়ে শুনল ছেলেটা বলছে, “হ্যাঁ, আমার এখন সেকেন্ড ইয়ার চলছে।”
মা বললেন, “ও, তাহলে তো তুমি ছেলেমানুষ। আমার মেয়ে অবশ্য আরও ছোট। ইস্কুলে পড়ে। তা, তোমার বাড়িতে আর কে কে আছেন?”
“আমি আর মা-বাবা।”
“আচ্ছা! আমরা তোমাদের আসতে দেখেছিলাম। তোমাদের বাড়িতে তো কাজও হয়েছে অনেকদিন ধরে। তাই আর বিরক্ত করতে যাইনি।”
ছেলেটা এবারে একটু অপরাধী ধরণের হাসি হেসে বলল, “কী যে বলেন কাকিমা, আমাদেরই তো আলাপ করতে আসার কথা। আসলে আমার মা-বাবা দুজনেই কন্স্ট্রাক্শানের বিজনেস চালান তো, ওঁদের একেবারে সময় নেই। তার উপর বাড়ির রেনোভেশান তো ছিলই। তবে ওদিকটা এতদিনে শেষ হয়েছে, এবারে ওঁরা ঠিকই আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাবেন। কিন্তু আপনারা আসবেন তো কালকে? না হলে কিন্তু চলবে না।”
“না না, এতবার করে বলবার কি আছে? নিশ্চয়ই যাব।” এতক্ষণে মৃণালিনীকে খেয়াল করে মা বললেন, “আরে এই তো! এ হচ্ছে আমার মেয়ে ফুল্কি। ক্লাস এইটে পড়ে।”
“ফুল্কি!” ছেলেটা মজা পাওয়া গলায় বলল, “দারুণ নাম তো!”
“ওটা ডাকনাম,” মৃণালিনী ব্যাজার গলায় বলল, “ভাল নাম মৃণালিনী।”
“ওঃ। তাতে কি হয়েছে,” ছেলেটার সাদামাটা মুখটায় প্রথমবার একটা দুষ্টুবুদ্ধির ঝিলিক খেলে গেল, “আমি তোমাকে ফুল্কি বলেই ডাকব।”
মায়ের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল মৃণালিনী। মা তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সামাল দেওয়ার জন্য বললেন, “দেখ্ না, ও হল ওই তেরো নম্বর বাড়ির ছেলে। ওদের বাড়িতে কাল সরস্বতী পুজো হবে, আমাদের নেমন্তন্ন করতে এসেছে।”
“আপনারা সবাই আসবেন কিন্তু কাকিমা। ফুল্কি, তুমিও এসো,” বলে ছেলেটা একটা গা জ্বালানো হাসি দিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। মা হঠাৎ পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই, শোনো শোনো! কি কাণ্ড দেখেছো, তোমার নামটাই জানা হয়নি।”
“শিলাদিত্য,” বলে ছেলেটা গেট খুলে নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল।
তারপর কত জল গড়িয়ে গেল! ইতিমধ্যে শিল্দা বি.কম. পাশ করেছে, ব্যাঙ্কে চাকরি হয়েছে, মৃণালিনী ক্লাস টেনের গণ্ডি পেরিয়ে, নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে, এখন আই.এস.সি পরীক্ষার মুখোমুখি। তবু, এই এতটা সমইয়ের মধ্যে ঠিক কখন যে শিল্দা গৌরীশঙ্করের মূর্ত রূপ হয়ে উঠল, সেটা কিছুতেই ঠাওর হচ্ছিল না তার।
মনে পড়ে, প্রথম দিন থেকেই মৃণালিনীর সঙ্গে শিলাদিত্যর সম্পর্কটা অম্লমধুর ছিল। তার উপর একটিবার দৃষ্টি দেবার সঙ্গে সঙ্গে কি করে যেন শিলাদিত্য টের পেয়ে গিয়েছিল যে এই মেয়েকে ক্ষেপিয়ে একটা নির্ভেজাল আনন্দ আছে। প্রথম প্রথম মৃণালিনীও তার অভিসন্ধি টের না পেয়ে বার বার ফাঁদে পা দিয়েছে। পরে অবশ্য অনেক বেশি সেয়ানা হয়ে গিয়েছে। এইসব নির্দোষ ঝগড়াঝাঁটি খুনসুটির মধ্যে দিয়েই শিলাদিত্য সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা হয়ে গিয়েছিল তার। বড়লোক বলেই হোক, অথবা কাজেকর্মে ব্যস্ত বলেই হোক, ওর মা বাবাকে বড় একটা দেখা যেত না। খুব যে মিশুকে প্রকৃতির তাঁরা, তাও না। কালেভদ্রে দু-একটা পুজো-আর্চা-অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই সৌজন্য রক্ষা করতে পছন্দ করতেন। শিলাদিত্য কিন্তু ওঁদের থেকে একেবারে আলাদা। পাড়ার লোকের সঙ্গে, বিশেষ করে সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খুব অনায়াসে বন্ধুত্ব করে ফেলেছিল সে। কারুর বিপদে-আপদে, অথবা আন্য কোনো প্রয়োজনে সর্বদাই সে এক ডাকে হাজির। যে মৃণালিনী শিলাদিত্যকে প্রথম দিনেই বড়লোকের বকাটে ছেলে ভেবেছিল, সেও একসময়ে নির্দ্বিধায় তাকে পাড়াতুতো দাদাদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করতে লাগল।
এক এক সময়ে ইস্কুল-ফিরতি পথে মৃণালিনী হঠাৎ দেখত, একরাশ পাঁউরুটি হাতে করে পাড়ার কুকুরগুলোকে খাওয়াতে খাওয়াতে শিল্দা দিলখোলা হাসি হাসছে। কখনোও হয়তো তেরো নম্বর বাড়ি পেরোতে গিয়ে দেখতে পেত শিল্দা বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে বসে নিবিষ্টমনে কি একটা বই পড়ছে, অথবা বাইরের দিকে অন্যমনষ্কভাবে চেয়ে আছে। এই সময়গুলোতে মনে হত যেন শিলাদিত্যর একটা গভীর অন্তর্জগৎ আছে, যা বাইরে থেকে কিছুই বোঝা সম্ভব নয়। আসলে হয়তো সে সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষ।
মৃণালিনী একটু অবাক হয়ে গেট ঠেলে ঢুকে বলল, “অফিস যাওনি শিল্দা?”
শিলাদিত্য জবাব না দিয়ে বসতে ইশারা করল। কিছুক্ষণ চুপচাপ এইভাবে বসে থাকবার পর হঠাৎ সে বলে উঠল, “মেঘদূত পড়েছ?”
“মেঘদূত?” মৃণালিনী আকাশ থেকে পড়ে বলল, “কালিদাসের ‘মেঘদূত’?”
“হুঁ। জানো?”
মৃণালিনী হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “না, পড়িনি। আমি সংস্কৃত জানিনা।”
“ও।” এই বলে খানক চুপ করে থেকে শিলাদিত্য আবৃত্তি করে উঠল:
“তস্মিন্নদ্রৌ কতিদিদবলা — বিপ্রযুক্তঃ স কামীমৃণালিনী স্তম্ভিত হয়ে বলল, “তু-তুমি — ”
নীত্বা মাসান কনকবলয় — ভ্রংশ্রিক্তপ্রকোষ্ঠঃ।
আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং বপ্রক্রীড়া-পরিণত-গজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।”
শিলাদিত্য হেসে ফেলল, “সরি। ঘাবড়ে দেবার জন্য বলিনি। আসলে আজ পয়লা আষাঢ় কিনা। আজকের দিনেই সেই বিরহী যক্ষ পাহাড়ের সানুদেশ ঘিরে থাকা মেঘের টুকরো দেখেছিল।”
মৃণালিনী কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, “দেখার পর কি হল?”
“কি হল? মেঘটাকে সে তার প্রেমিকার খবর নিতে পাঠাল। সে বেচারি কত দূরে একা একা বসে আছে—”এইটুকু বলে একবার মৃণালিনীর দিকে মুখ ফেরাতেই যেন একটা ঘোর ভেঙে গেল শিলাদিত্যর। লজ্জিতভাবে বলল, “এঃ, কি কেলেঙ্কারি! তোমাকে ইস্কুল-ফেরত পথ থেকে ধরে নিয়ে এসে শেষে কিনা সংস্কৃত কাব্য আওড়াচ্ছি! তাও আবার আদ্যন্ত প্রেমের — সময় থাকতে খুব সামলেছি যা হোক, নইলে আজ তুমি আমাকে কুপিয়েই দিতে!” এই বলে হো-হো করে হাসতে লাগল।
মৃণালিনী খানিকক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থেকে অবশেষে আমতা-আমতা করে বলল, “না ... মানে সেটা কেন করব ...”
“করবে না? আমি পাড়ার লোক বলে আমাকে রেয়াত করবে বুঝি? তবু ভাল! বেশ, অনেকক্ষণ ভাঁট বকেছি তোমার সঙ্গে, তুমি বাড়ি গিয়ে ঠাণ্ডা হও গে।”
অগত্যা মৃণালিনী উঠে পড়ল। বেরোবার আগে একবার কিন্তু-কিন্তু করে শেষে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “কী একটা বই পড়ছিলে দেখলাম। ‘মেঘদূত’ বুঝি?”
“এটা?” শিলাদিত্য বইটা তুলে দেখাল, “না, এটা হল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঝিন্দের বন্দী’।”
কি কুক্ষণেই যে বইটার নাম করেছিল শিল্দা! পরদিনই কলেজ স্ট্রীট গিয়ে কিনে এনেছিল মৃণালিনী। এবং তারপর থেকেই যাবতীয় গোলমালের সূত্রপাত। আসলে আর কটা মাস আগে হলেও ওই গল্প ছুঁয়েও দেখত না সে। তার পছন্দ হল খুন-জখম, যুদ্ধ-বিগ্রহের বই। আর ‘ঝিন্দের বন্দী’? শুধু রোম্যান্স বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না। কিন্তু কই, এবার তো পড়তে পড়তে একবাএর জন্যেও বইটা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার ইচ্ছে হল না! এবং একটা সময় গল্পের চরিত্রগুলো যেন ভূতের মতো পেয়ে বসল। উঠতে বসতে খালি গৌরীশঙ্করকেই দেখতে লাগল মৃণালিনী। তার সাথে সাথে ভীড় করে এল অন্যান্য রাজ্যের রোম্যান্স ও অ্যাডভেঞ্চারের বই আর সিনেমা। একটা মাসের মধ্যে সে যেন অন্য একটা জগতের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
কিন্তু এই পুরো ঘটনাটার মধ্যে শিলদার ভূমিকাটা ঠিক কোথায়? শুধুমাত্র সংস্কৃতে কবিতা আওড়াতে পারে বলেই কি তার সম্পর্কে একটা অন্যরকম ধারণা তৈরি হয়েছে এই ক’দিনে? মৃণালিনী আপনমনেই মাথা নাড়ল। আসল কারণটা বোধহয় আরও একটু গভীর। এই একটা বছরেই কেমন একটা ক্লান্তি এসেছে সবকিছুতে। প্রথম প্রথম এটা ধরা পড়ত না। কিন্তু আজকাল এই ভাল না লাগাটা থেকে থেকেই জানান দিয়ে যায়।
ক্লান্তিটা হল দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, একই রকমের জীবন কাটানোর। মৃণালিনীদের কোথাও যাবার নেই, নতুন কিছু করার নেই, কোনো বিষয় নিয়েই নতুন করে ভাবার নেই। এমনকি বড়ো কোনো ঝগড়া-বিবাদ কি আকস্মিক বিপর্যয়, সবকিছুরই যেন অভাব তার জীবনে! এই অভাবের কথা ভাবতে গিয়ে প্রথমেই মনে আসে তার বাবা মায়ের কথা। সত্যি, অনেক ধরণের মানুষের কথা শুনেছে মৃণালিনী, কিন্তু ওঁদের মতো দুজন উচ্চাকাঙ্ক্ষা-বিরহিত নির্বিকার মানুষ যে পৃথিবীতে থাকতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করত না সে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তার মা বাবার দুজনেরই নিজস্ব জগৎ আছে, কিন্তু তার পরিসর এতই ছোট, যে অবাক না হয়ে থাকা যায় না। বাবার যেমন কলেজ আছে, সেখানকার কলিগ বন্ধুরা আছেন। সংসারের বাইরে মায়ের প্রাইভেট টিউশানের ছাত্র-ছাত্রীরা আছে, আর গান শিখতে যাওয়া আছে। মাঝে মাঝে ছুটি ছাটায় বেড়াতে যাওয়া সপরিবারে। কিন্তু সেও আর কদ্দূর? একবার কেরালা ঘুরে আসবার পর মা বাবা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে এতটা পথ জার্নি করে কোনোদিন ছুটি কাটাতে আসবেননা। বেড়াতে বেরিয়ে অত ধকল নাকি পোষায় না। অথচ পৃথিবীটা কত বিশাল! তারই ক্লাসের মেয়ে শরণ্যা, একটা গোটা মহাদেশ পেরিয়ে পড়তে এসেছে। শরণ্যার বাবা আবার নাবিক। সারা পৃথিবীটাকে প্রদক্ষিণ করে এসেছেন তিনি। মৃণালিনী শরণ্যার মুখে গল্প শুনে অবাক হয়ে ভাবত, যে মানুষের এত দেশের এত অভিজ্ঞতা, তার মনের ভিতরটা না জানি কেমন দেখতে হয়! চেনা জগতের বাইরের একটা কিছু তাকে নিরন্তর টানছিল।
শিলাদিত্য কি চেনা জগতের বাইরের কেউ? আজকাল কেন যেন মনে হয়, সত্যিই তাই। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও তার যে দৈনিক দশটা-পাঁচটার বাইরে একটা জীবন আছে তা মৃণালিনীর বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না। এই তো, মাঝে মাঝেই বিনা নোটিসে রুক্স্যাক কাঁধে বেরিয়ে যাওয়ার যে অভ্যেসটা আছে শিল্দার, এটাকে যে কি হিংসে করে সে! নিজের মা-বাবাকে এরকম কিছু করবার ইচ্ছের কথা জানালে ওঁদের কি প্রতিক্রিয়া হবে ভাবতেও ভয় হয়। মৃণালিনী একবার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “আমাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন নেই তোমার?”
“স্বপ্ন?” মা অবাক হয়ে পালটা প্রশ্ন করেছিলেন।
“হ্যাঁ। সব বাবা-মায়েরই তো থাকে। বড় হয়ে ছেলে-মেয়ে এই করবে, সেই করবে। তোমাদের সেরকম কিছু নেই?”
“নাঃ। খামকা আকাশ-কুসুম ভাবতে যাব কেন?” মা ঠোঁট উলটান।
“কেন? আমি কি এতটাই অপদার্থ?”
মা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বললেন, “বালাই ষাট! অপদার্থ হবি কেন? আর পাঁচটা বাবা-মা যেমন চায় আমরাও তেমনি চাই, তুই ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করে একটা ভাল কলেজে ভর্তি হবি, তারপর এম.এ পাশ করবি, একটা ভাল বিয়ে হবে —”
“বিয়ে! অ্যাঁ!” মৃণালিনী আঁতকে উঠল।
“না না, শুধু বিয়ে করলে তো আর হবে না, বিয়ের আগে যা হোক কিছু একটা চাকরি-বাকরি জুটিয়ে নিতে হবে,” বাবা হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন, “দিনকাল যা পড়েছে! কাগজে রোজ দেখছি খালি নারী-নির্যাতন আর বধূহত্যা। নিজের একটা অবলম্বন না থাকলে কাউকে বিশ্বাস নেই আজকাল —”
“উফ্, তোমার যা কথার ছিরি না, সত্যি!” মা বিরক্ত হয়ে বলেন, “এমন বাড়িতে বিয়ে দেব কেন যেখানে নারী-নির্যাতন আর বধূহত্যা হবার সম্ভাবনা আছে?”
“বাঃ! কি যুক্তি! ওরকম পরিবারে কি ‘আমরা বধূহত্যা করিয়া থাকি’ বয়ানে সাইন-বোর্ড টাঙানো থাকে? আরে বাবা, আমার এক কলিগের সাক্ষাৎ ভাগ্নী বিয়ের পাঁচ বছর পর জানতে পারল যে তার শ্বশুরবাড়ির গুষ্টিসুদ্ধু সবাই নাকি মাফিয়া! তা সে কি জেনেবুঝে বিয়ে করেছিল?”
“শোনো, তোমার এই বাড়িয়ে বলার স্বভাবটা কোনোদিন যাবে না —”
“বেশ, আমি না হয় বাড়িয়েই বললাম, কিন্তু ফুল্কি চাকরি না পেয়ে বিয়ে করতে পারবে না এও আমি বলে রাখছি।”
“অদ্ভুত তো! আমি কি চাকরি করতে বারণ করেছি? কিন্তু একটা ভাল ঘরে সম্বন্ধ এলেও ধনুর্ভঙ্গ পণ করে বসে থাকবে? ...”
এভাবে চলতেই লাগল তর্ক-বিতর্ক। মৃণালিনী খানিকক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখে তারপর নিঃশব্দে নিজের ঘরে চলে গেল, মা-বাবা টেরও পেলেন না।
আজকাল তাই মনে হয়, সারাটা জীবন শুধু একটা শহরে আবদ্ধ হয়ে থাকলে চলবে না। নিজের তাগিদেই বেরিয়ে পড়তে হবে দূরে কোথাও। সত্যিই তো, একটা জীবনে কতটুকুই বা সময়? মৃণালিনী অবাক হয়ে ভাবল, ছোটবেলাটা কখন যেন শেষ হতে বসেছে। এই বছর আঠেরোয় পা দিল সে, পরের বছর কাগজে-কলমে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। মেয়ে নয়, মহিলা! কি করে এমন হল? মনে মনে ছোট হয়েও সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করে বড়দের দলে ভিড়িয়ে দিতে যাচ্ছে, এর পর কি করবে সে? ... কিংবা হয়তো এই গণ্ডিটা পেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তটাই তার কাছে একটা চাবিকাঠি। হঠাৎ মনে পড়ে, শিলাদিত্যও যে বড়দের দলে। কিন্তু তবুও সে তার পরিচিত বড়দের তুলনায় অনেকটাই আলাদা। তার নিজের বাবা-মায়ের মতো শিলাদিত্যর জীবনটা এখনও বৈচিত্রহীন হয়ে যায়নি। আসলে তার যে সর্বদাই এই শহরের বাইরে আনাগোনা।
কিন্তু মৃণালিনী কি পারবে? শিলাদিত্য একজন পুরুষ; তার থেকে মৃণালিনীর পথ অনেক দূর্গম। আজকাল মাঝে মধ্যে এই ভাবনাটাও উঁকি দেয় তার মনে, বিশেষ করে যখন সে তিলোত্তমার দিকে মন দিয়ে দেখে। তিলোত্তমা যে কেন একটা পাথরচাপা দিয়ে রাখা ঝরণার মতো নিজেকে সংবরণ করে রাখে সব সময়, তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়। শরণ্যা আর উপলার ব্যাপারটা আলাদা। ওরা স্বাধীন; অন্ততঃ অন্যদের তুলনায়। সত্যি, এই শহরে এমন আরও কত মেয়ে আছে মৃণালিনীদের মতো, তার হিসেব কে রাখে!
হঠাৎ মনে পড়ে যায় ক’দিন আগে ক্লাসে পড়ানো কবিতাটার কথা। কি একটা ছিল এলিয়টের লেখা ওই লাইনগুলোতে, যা খুব মনে ধরেছিল তার:
His soul stretched tight across the skiesএই যে কিছু কিছু নিশ্চয়তা, তার জন্যেই কি এত গণ্ডি, এত আবদ্ধ থাকা? এবং এইসব ‘certain certainties’-এর বাইরেই কি হাতছানি দিয়ে ডাকছে শিল্দা? তার মা-বাবার মধ্যবিত্ত প্রত্যাশাগুলোর বাইরে, তার সাদামাটা সতেরো বছরের জীবনের বাইরে, অনন্ত্যকাল এক আবর্তের মধ্যে ঘুরতে থাকা এই শহরটার বাইরের পৃথিবীটা অনেক বড়। যত দিন পেরোয়, মৃণালিনী তাই ততই অশান্ত হয়ে ওঠে।
That fade behind a city block,
Or trampled by insistent feet
At four and five and six o’ clock;
And short square fingers stuffing pipes,
And evening newspapers and eyes
Assured of certain certainties …
মৃণালিনীকে খুব কম লোকেই বোঝে।
।।৭।।
আজ ছোটমাসির চিঠি এসেছে।
গানের ক্লাসে গিয়েছিল শরণ্যা। এই একটা দিনের জন্য পুরো সপ্তাহটা অপেক্ষা করে থাকে। প্রথম-প্রথম মম্ নিয়ে যেত; আজকাল একাই যায়। তার গানের শিক্ষিকা বিজয়া ম্যাম তেমন নাম-করা কেউ নন। কিন্তু এত চমৎকার শেখান! ইংল্যান্ডে থাকতে এরকম কেউ পারতেন না, যদিও সেখানেও রন্ধীরজী-র কাছে শিখেছে অনেকদিন। ম্যামের কাছে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে শুধু শুনতে ইচ্ছে করে শরণ্যার। গলা তো নয়, যেন পাহাড়ি ঝর্ণা! কোন সুর থেকে কোন সুরে অনায়াসে যাতায়াত করতে থাকে, ভাবাই যায় না। কোনোদিন কি এরকম করে গাইতে পারবে সে? ম্যাম তো বলেন, শরণ্যার হবে। ইয়ু.কে-তে থাকতে রন্ধীরজীও তাই বলতেন। কিন্তু কবে হবে, সত্যিই হবে কিনা, কে জানে!
আজ গৌড়মল্লারের উপর একটা নতুন বন্দিশ শেখাচ্ছিলেন বিজয়া ম্যাম। গানের কথাগুলো ভারি সুন্দর! ম্যাম হাসছিলেন, “এই গান গাওয়ার আর ওয়েদার নেই যদিও, আশ্বিন তো পড়ে গেল! তবু গানটা বেশ সুন্দর, তুলে নাও।”
শরণ্যা গাইতে গাইতে বিভোর হয়ে গিয়েছিল:
উমড়-ঘুমড় ঘন বাদর ছাই, বরসত মেহা প্যারি বোলত দাদুরা,গান শেষ হলে বিজয়া ম্যাম স্মিত মুখে বললেন, “বাঃ, আজকে বেশ গাইলে তো!”
সদারঙ্গ বুন্দন বরসন লাগি জল ভরে থল ভরে, ভরে সব সগরা,
সাবন কী ঝুক আঈ রী বদরা, পিয়া নহী পাস মে, ক্যায়সে ডারুঁ কজরা …
শরণ্যা একটু বিব্রত হয়েই বলল, “আসলে গানটা এত সুন্দর …”
বিজয়া ম্যাম আর কিছু না বলে হাসলেন।
মনের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে ফিরল শরণ্যা। ঘরে পা দিতেই চোখে পড়ল টেবিলের উপর রাখা একটা হলদেটে খাম। কার চিঠি বলে দিতে হবে না। এ বাড়িতে ওরকম দেখতে চিঠি আসে একজনেরই।
ছোঁ মেরে চিঠিটা তুলে নিতেই মম্ বলে উঠল, “তোদের এই চিঠি চালাচালিটা কি চলতেই থাকবে রাকা?” শরণ্যা অবাক হয়ে বলল, “মানে? ছোটমাসির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেব?”
“আমি কি তা বলেছি!” মম্ একটু বিরক্ত, “আজকাল তো ফোন, ই-মেল, ভিডিও-কল, সবই হয়ে গেছে, তার উপর তোদের ফেসবুক না কি। এমনও নয় যে আই.এস.ডি-র খরচ দিতে হবে। চিঠি লেখবার দরকারটা কি?”
শরণ্যা মাথা নেড়ে বলে, “সব জায়গায় সব কথা হয় না।”
“কি এত কথা তোদের?”
“কেন, আমাদের নিজস্ব কোনো কথা থাকতে পারে না?” কথাটা বলে ফেলেই বুঝতে পারল, ভুল করে ফেলেছে। মমের মুখ অন্ধকার হয়ে গেছে। এখন মেজাজ সহজে ঠিক হবার নয়। কথা না বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল শরণ্যা। এই একটা সুবিধে ওদের অ্যাপার্টমেন্টের। উপরে নীচে দুটো ফ্ল্যাট মিলিয়ে একটা ডুপ্লে। উপরে উঠে এলে নীচের সঙ্গে বড় একটা সম্পর্ক থাকে না। শরণ্যা কোনও মতে জামাটা বদলেই চিঠি খুলে বসল। তার জীবনে ছোট ছোট কিছু ভাললাগা আছে। যেমন কফির গন্ধ, যেমন কবিতা, যেমন গান। শরতের আগুনরঙা উইলো গাছের সারি দেওয়া লন্ডনের বুলেভার্ড। রঙ্গীতদার ফোন। ছোটমাসির বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা বর্ষা। আর তার চিঠি। শরণ্যা টের পেল, আজকের দিনটা জুড়ে ভাললাগার রঙ ছড়িয়ে পড়ছে। শরণ্যা পড়তে লাগল:
রাকা,চিঠিটা পড়ে নিঃশ্বাস ফেলল শরণ্যা। ছোটমাসী সবই জানে, কিন্তু সাধারণতঃ এসব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে না। তাও আজ যখন এত কথা লিখল, তখন ধরে নিতেই হয় যে ছোটমাসী তার জন্য চিন্তিত, আর সানাও ওকে ভাবাচ্ছে। তা, সানা ত বাড়িসুদ্ধ সবাইকে ভাবাচ্ছে। পুরো বছর মম-ড্যাডের সঙ্গে কথা নেই। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলনা। একটা মাত্র বছরের মধ্যে সব কিছু কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল।এবারের চিঠিটা যেন অনেকদিন পর পেলাম। ব্যস্ত বুঝি? স্বাভাবিক। বারো ক্লাস মানে তো শিরে সংক্রান্তি, এখন অনেক চাপ। তা ছাড়া, তুই শহুরে মানুষ কিনা! শান্তিনিকেতনে প্রতিটি দিনের সুন্দর একটা রেশ থেকে যায়। আর কলকাতায় দিনগুলো দৌড়ায় আলোর গতিতে। কেমন লাগছে কল্লোলিনীকে? আমার খুব প্রিয় জায়গা, খুব ইন্টারেস্টিং একটা শহর। মাঝে মাঝে মনে হয়, লন্ডনের চেয়ে বেশি!
শহরের প্রসঙ্গ আরও এসে পড়ল এলিয়টের কথা লিখেছিস বলে। আমাদের ইস্কুলে ওসব কবিতা পড়াত না। অবশ্য বিলেতের কথা আলাদা, সেখানে থাকলে তো পড়তেই হত। ভালই হল, বল্? প্রথম যখন এলিয়ট পড়ি, মনে হয়েছিল শহর ব্যাপারটাকেই আর কোনোদিন আগের দৃষ্টিতে দেখব না। অবশ্য এলিয়টের কবিতার ছবিগুলো অনেকখানি তৈরি হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের ভিত্তিতে। কিন্তু তাও মনে হয়, কোথায় যেন বর্তমানের সবকিছুর সঙ্গে একটা মিল রয়ে গেছে ওঁর চিত্রকল্পে। আসলে বিশ্বযুদ্ধের আগে অন্য একটা জগৎ ছিল। যুদ্ধের প্রকোপ থেকে কেউ বাঁচেনি; আমরাও না। মানুষের গভীরতম গ্রন্থিগুলোর আমূল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল রাতারাতি। এবং সেই বদলে যাওয়া হৃদয়ের উত্তরাধিকার তো তোর উপরেও বর্তায়। তাই হয়তো ভাবাচ্ছে কবিতাগুলো।
এমন কিছু কিছু ঘটনা ঘটে, যাকে আমরা ইতিহাস বলি। কিন্তু সেই সব ঘটনার বিস্তার যে কত গভীরে, তা হয়তো সব সময় বই পড়ে ধারণা করা যায় না। ব্যক্তিগত জীবনেও এমনটা ঘটে বৈকি। যেমন, তোর এলিয়টের কবিতা পড়ার কথাই ভাব। এই কবিতা পড়ার আগের রাকা আর পরের রাকার মধ্যে যে পরিবর্তনটা ঘটে গেছে, সেটা তো সারা জীবনের। তবে এলিয়টকে একদিনে উপলব্ধি করা যায় না। ফিরে ফিরে যেতে হবে তার বাড়ি। সেই সঙ্গে ওঁর সময়টাকে চিনতে হবে, আরো অনেক সাহিত্য পড়তে হবে। কিন্তু এই যে প্রথমবারের একটা না-বুঝতে-পারা মন হু-হু করে ওঠা অনুভূতি, এটাই আসল। এইভাবেই পথ চলার শুরু। ভাবতে ভাল লাগছে, আরও একজন কবিকে আবিষ্কার করা আরম্ভ করলি তুই। এই আবিষ্কারের কাজটাও গুরুত্বপূর্ণ। একজন কবি পৃথিবীকে কী দিয়ে গেছেন, তা বুঝতেই অনেক সময় কত যুগ পার হয়ে যায়। জীবনানন্দের কী হয়েছিল, মনে আছে? কবিতার কোন্ অতলে যে কী লুকিয়ে থাকে, তা আমরা জানতেও পারি না। তাই খোঁজ থামালে চলে না। পুরোনো কবিতা থেকে কী নতুন কথা বেরোবে, তা কি বলা যায়?
আমার কথা আর কি বলব। এখানে যেমন ভাল থাকি, তেমনই ভাল আছি আমি। বাগানে দু-একটা শিউলি ফুটতে শুরু করেছে, আর আমি বারান্দায় পা নাচাতে নাচাতে সুচিত্রা মিত্রের ‘নয়ন ভুলানো এলে’ শুনছি। জানি, লন্ডনের শরৎকে মিস করিস তুই। আর কলকাতায় তো শরৎ আসে না, আসে পুজো। সেই সঙ্গে আসে যত রাজ্যের কৃত্রিম আলো আর শব্দ। তাই বলি, ছুটিতে একবার এদিকটায় ঘুরে গেলে হয় না? কদ্দিন দেখি না তোকে, তোর গান শুনি না। ভেবেছিলাম তোরা দেশে ফিরলে দেখাসাক্ষাৎ বাড়বে, কিন্তু কা কস্য। দিদিকে ফোন করলেই শুনি নাকি ভীষণ ব্যস্ত। সংসারী মানুষের ব্যস্ততা নিয়ে কিছু বলতেও ভয় করে, নিজের তো ওসবের পাট নেই। জামাইবাবুকেও বলিস, যেন ভাল থাকে, শরীরের যত্ন যেন নেয়। ওদেরকে তোর নিজের মতো করে একটু ভাল রাখার চেষ্টা করিস, কেমন? তুই নিজেও ভাল থাকিস। সানাকে বলিস, মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। মা-বাবার উপরে রাগ হতেই পারে, কিন্তু ছোটমাসি কী দোষ করল বল্ তো?
তোর চিঠিতে সব সময় একটা প্রশান্তি থাকত, জানিস রাকা। কিন্তু শেষ চিঠিতে সেটার অভাব টের পেলাম যেন। তার কারণ কি শুধুই কবি, নাকি আরও কেউ, আরও কিছু? জানাস। যদি না পারিস জানাতে, তাহলে এমন একজনকে খুঁজে বের কর, যাকে বলা যায়। তুই কি একা হয়ে যাচ্ছিস রাকা? লোকের মাঝে থেকেও একা হয়ে যাওয়াটা কষ্টের। একা না হওয়ার চেষ্টা করিস। অনেক বই পড়িস, কবিতা লিখিস, আর ভাল থাকিস।
ছোটমাসি।
এখনও চোখ বুজলেই উইলো গাছের সারি দেখতে পায় শরণ্যা। তাদের লন্ডনের হলিক্রফ্ট এ্যাভিনিউয়ের বাড়ি। ছোটবেলাটা কখন যেন কেটে গেছে হ্যাম্পস্টেড হীথের পাহাড়ি মাঠে-ঘাটে, বনবাদাড়ে। ড্যাড ছিল বাণিজ্যিক জাহাজের নাবিক। বছরের আট-দশটা মাসই সমুদ্রে ঘোরাফেরা, আর মাঝে মাঝে ছুটিতে এসে জাহাজের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। বাড়িতে থাকত মম্, আর ছোটমাসী। শরণ্যার দু বছর বয়সের সময় তার দাদু-দিদা হঠাৎ মারা যান। ছোটমাসী তখন সবে ইস্কুল শেষ করেছে। দেশে ওকে দেখবার কেউ ছিল না, তাই মম্-ড্যাড ওকে নিয়ে এসেছিল নিজের কাছে। সে তাই সাহানা-শরণ্যার বেড়ে ওঠার সঙ্গী। সত্যি যখন ছোটমাসী পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে এল, তখন তারা কি কম প্রতিবাদ করেছিল! তখন কেই বা জানত যে তাদেরও দিন ঘনিয়ে এসেছে। লন্ডনের দিনগুলোর কথা পূর্বজন্মের আবছায়া স্মৃতির মতো মনে হয় আজকাল। এই এক বছরে এতটা দূরে চলে গেছে সে, ভাবলে অবাক হতে হয়। ছোটবেলার প্রিয় বন্ধুরা, টেড, ব্রায়ান, অ্যালিসন, লুইজা, ওরাই বা কোথায় গেল? ফেসবুক নামক একটা যোগাযোগের মাধ্যম থাকা সত্ত্বেও কই, শরণ্যার জীবন থেকে তো হারিয়েই যেতে বসেছে ওই দেশের সবাই। তবু এখনো চোখ বুজলে পরিষ্কার দেখতে পায় সে, হলিক্রফ্ট এ্যাভিনিউয়ের জুরি-নামানো গাছের সারি, রাস্তার কোণে একটেরে তাদের এড্ওয়ার্ডিয়ান ধাঁচের বাড়িটা। রাস্তা দিয়ে মিনিট দশেকের হাঁটা পথের পরেই ছিল ওয়েস্ট হীথ – সে যেন এক রূপকথার মায়াবন। রোজ বিকেলবেলা ছোটমাসী ওর হাত ধরে হীথ্-এ বেড়াতে নিয়ে যেত। হাঁটতে হাঁটতে কত দেশের কত রকম আশ্চর্য গল্প শোনাত তাকে। সেই মায়াবনের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে শরণ্যার কেবলই মনে হত, গল্প নয়, এ সবই সত্যিকার ঘটনা। হয়তো এই বনেরই আড়াল-আবডাল থেকে কখন উঁকি দিয়ে যাবে এল্ফ, গবলীন, পরীদের দল!
মম্ পাড়ার স্কুলে পিয়ানো-টিচার ছিল। সন্ধ্যেবেলা নানারকম বাজনা শোনা হত বাড়িতে। সানাও পিয়ানো বাজাতে পারত। বিঠোভেন, বাখ, দেবুসির কত শক্ত শক্ত কম্পোজিশান তুলে ফেলত অনায়াসেই। এ ব্যাপারে অবশ্য শরণ্যা একেবারে আনাড়ি ছিল। তার পছন্দ ছিল ভারতীয় গান। খুব ছোটবেলায় ছোটমাসী গান শেখাত তাকে। যত রবীন্দ্রসঙ্গীত সব তো তার কাছেই শেখা। আরেকটু বড় হয়ে রন্ধীরজী-র স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। ড্যাড্ও গান গাইত একটু-আধটু। যখন বাড়ি থাকত, সন্ধ্যেবেলা মমের পিয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বেশ গেয়ে উঠত পুরোনো দিনের বাংলা গান।
আর ছিল সানা। বয়সে তার থেকে পাঁচ বছরের বড় হলেও, সানা ছিল তার পরম বন্ধু। ছোটমাসীর কলেজের পরীক্ষার চাপ বাড়লে বা অন্য কিছুর ব্যস্ততা হলে সময় দিতে পারত না ক’দিনের জন্য। কিন্তু সানা কখনও বোনকে ছাড়ত না। বড় হওয়ার আনুসঙ্গিক যে সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, আশঙ্কা আর প্রশ্ন, তার সমাধান পেতে তো সানার কাছেই দৌড়ত সে। আর একটু বড় হবার পরে উইক্-এন্ডে শহরে বেরোনো, কাছাকাছির মধ্যে নাটক বা সিনেমা দেখতে যাওয়া, সব কিছুতেই সানার উপস্থিতি। সানাকে ছেড়ে, ছোটমাসীকে ছেড়ে কখনোও যে থাকা যায় তা শরণ্যার কল্পনার অতীত ছিল এক সময়ে। অথচ শেষ পর্যন্ত তো তাই হল।
দু হাজার দুই সালে ছোটমাসী দেশে চলে এল। কেন এল কে জানে! শরণ্যা তখনও বেশ ছোট, তাই সব ব্যাপার তাকে খুলে বলা হয়নি। সানাও কিছু বলেনি। ছোটমাসীকে জিজ্ঞেস করতে সে বলেছিল, “আমি নিজের দেশকে মিস করছি, রাকা। এখানে তো সারা জীবন থাকব বলে আসিনি। আমার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে, দেশে একটা ভাল চাকরি পেয়েছি, এখন তো চলে যেতেই হয়।”
“কেন? এ দেশে কি চাকরি নেই? আর তোর ফ্যামিলির সবাই এ দেশেই থাকে। ওখানে কে আছে তোর? দিস ইজ ইয়োর হোম।”
“ওদেশেও যে আমার একটা হোম আছে। শান্তিনিকেতনে আমার মা-বাবার বাড়ি আছে না একটা? দু-তিন বছরে একবার করে যাওয়া হয় ওখানে। বাড়িটা অযত্নে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
শরণ্যা এর আগে কখনও দেশে যায়নি। মম্ আর ছোটমাসী পালা করে যেত, মাঝে মাঝে জাহাজ কলকাতার পোর্টে গিয়ে লাগলে ড্যাড্ও যেত। বাড়িঘরের টান বোঝার ক্ষমতা শরণ্যার ছিল না।
“ইট্স জাস্ট আ হাউজ, ছোটমাসী। নোবডি লিভ্স দেয়ার।”
ছোটমাসী একটু বিষন্ন হেসে বলেছিল, “মাই প্যারেন্টস ডায়েড দেয়ার রাকা। ওই বাড়িতেই যা কিছু মেমরি আছে ওঁদের। আই কান্ট লেট ইট গো।”
ছোটমাসী যাওয়ার পর শরণ্যা আসা শুরু করেছিল। কখনো সকলে মিলে, কখনোও সানার সঙ্গে। শেষবার একাই। কখন যেন ভালবেসে ফেলেছিল ছোটমাসীর এই নিরিবিলি ছোট্ট শহরটাকে। এখানে রাস্তার দু-ধারে গাছের সারি, বাড়িগুলোর চারপাশ ঘিরে সুন্দর বাগান। নানারকম অজানা ফুল, পাখির ডাক, ধু-ধু মাঠ, আর দূরে রেললাইনের ধারে লাল-লাল কাঁকর বিছানো রুক্ষ জমি। সানারও পছন্দ হয়েছিল জায়গাটা। দুজনে বৈশাখের ঠা-ঠা রোদ্দুর মাথায় করে সারা দুপুর ঘুরে বেড়িয়েছিল, মনে আছে। সেই তুলনায় কলকাতাকে মোটেই ভাল লাগেনি শরণ্যার। প্রথমবার পা দিয়েই মাথা ঘুরে উঠেছিল। যেদিকে তাকাও, শুধু মানুষ, মানুষ, মানুষ। ফুটপাথেও চলার জায়গা নেই, রাস্তায় ট্র্যাফিকের নিয়মের বালাই আছে কিনা বোঝা দায়, এই পাঁচতারা হোটেল, তো এই প্লাস্টিক খাটানো ঝুপড়ি। ঢাকুরিয়া ব্রিজের ধারে গিয়ে নীচে উঁকি মেরে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সে। রেললাইনের উপরেও মানুষের ঘরকন্না। রেলের ট্র্যাকের মাঝে একচিলতে জায়গাটুকুতে মেলা রয়েছে শাড়ি, উনুন খুঁড়ে হাঁড়ি চাপানো আগুনে, টগবগ করে ভাত ফুটছে। রেললাইনের উপরে বসেই মেয়েরা মেয়েদের চুল বেঁধে দিচ্ছে, কেউ মাদুর বিছিয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু ট্রেন এলে কি হবে? সবাইকে বেশ নির্বিকার দেখল শরণ্যা। তখন মনে হয়েছিল, এই শহরে বুঝি প্রাণের দাম নেই।
তবু চলে আসতেই হল। ধীরে ধীরে, সইয়ে সইয়ে নয়, হঠাৎই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। একটা মানুষের ভাগ্য কিভাবে যে একসঙ্গে এতগুলো লোকের জীবন বদলে দেয়, কে জানে। এ ক্ষেত্রে ভাগ্যটা ছিল ড্যাড-এর। সেই মানুষটা, যার উপস্থিতিটাই টের পাওয়া যেত না কিছুদিন আগে অবধি।
সানার তখন আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের শেষ বছর। একদিন শরণ্যা স্কুল থেকে ফিরেই দেখল বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড। মম্ মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে কাঁদছে, সানা ব্যস্তভাবে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে, মুখ অন্ধকার। এর আগে কখনও কোনো অবস্থাতেই মম্কে কাঁদতে দেখেনি সে। বুকের মধ্যে বড় একটা ধাক্কা লাগল তার। পরে বুঝেছিল, বড় হওয়ার প্রথম ধাক্কাটা বোধহয় এইভাবেই আসে। হতভম্ব মুখে সানার দিকে তাকাতেই সে অসহায়ভাবে হাত ছড়িয়ে বলল, “ড্যাড হ্যাজ হ্যাড আ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক।”
“হোয়াট?” শরণ্যা প্রথমটা কিছু বুঝেই উঠতে পারে না। একটু একটু করে সানা আর মমের কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা বার করে যখন সবটা বোধগম্য হয়, তখন ওরও বসে পড়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
ড্যাডের জাহাজ অ্যাটলান্টিক পেরিয়ে ক্যানাডা যাচ্ছিল। মাঝ সমুদ্রে হঠাৎ জাহাজের দু-দুটো জেনারেটর জ্বলে গিয়ে একটা অসম্ভব ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। চীফ্ ইঞ্জিনিয়র হবার দরুণ ড্যাডকেই জাহজ কোম্পানী এবং অন্যান্য অথরিটির কাছে এর জবাবদিহি করতে হত। ড্যাড বুঝতে পেরেছিল যে জেনারেটরের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পার্টস পুরোনো ছিল। দায়টা কোম্পানীর উপরেই বর্তায়। কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন সম্পূর্ণ সৎ লোক ছিলেন না। নিজেকে বাঁচাতে বেশ কিছু নথিপত্র আগের থেকেই গরমিল করে রেখেছিলেন। এন্ক্যুয়ারি কমিটি-র কাছে ড্যাড কিছুতেই ঘটনাটা ঠিকঠাক প্রমাণ করতে পারল না। একটা ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজকে মাঝ-সমুদ্র থেকে মন্ট্রিওলে নিয়ে যাওয়ার অসম্ভব মানসিক ধকল, তার উপর দোষী সাব্যস্ত হবার আশঙ্কা ড্যাডের শরীর সহ্য করতে পারল না। বন্দরে পৌঁছানোর আগেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল। পোর্টে জাহাজ ভিড়বার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে গিয়ে একটা বড় সার্জারি করাতে হল।
তার পরের ঘটনাগুলো খুব তাড়াতাড়ি ঘটে গিয়েছিল শরণ্যার জীবনে। মনে হত যেন একটা রোলার-কোস্টারে চেপে আছে সে, ঘুরপাক খাচ্ছে, ছিটকে পড়ছে এ কোণ থেকে সে কোণে। ড্যাডের জাহাজের ঘটনাটা কোর্ট অবধি গড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ড্যাডকে স্যাক করা হল না ঠিকই, কিছু ক্ষতি যা হবার হয়ে গিয়েছে ততদিনে। ওর এতদিনের সুনাম, এতদিনের ঝলমলে ওয়ার্ক-রেকর্ডে ওই একটি ঘটনার ছাপ পড়ে গেল। তার চেয়েও বড় কথা, ওই হার্ট অ্যাটাকের ফলে ড্যাডের আর জাহাজে যাবার মতো মেডিকাল-ফিটনেস রইল না। এদিকে এই চাকরিতে তো নিরাপত্তা বলে কোনো বস্তুই নেই। না পেনশন, না অন্য কিছু। এতকাল খুব ভাল মাইনে পেয়ে আসা সত্ত্বেও দেখা গেল সঞ্চয় এমন কিছু নেই যাতে করে সারা জীবন লন্ডনে কাটিয়ে দেওয়া যায়। এই বয়সে নতুন কী চাকরি খুঁজবে ড্যাড? একেই তো রেকর্ডে কালি পড়েছে। তা ছাড়া সানার পড়াশোনা শেষের দিকে হলেও, শরণ্যার তো এখনও অনেকটা বাকি। হঠাৎ একদিন সে যেন একটা ঘোর ভেঙে উঠে দেখল, তল্পি গোটানো শুরু হয়ে গেছে। বাড়িটাও বিক্রি হয়ে যাবে খুব শিগগির। সত্যি সত্যিই লন্ডন ছেড়ে ওরা চিরদিনের মতো চলে যাচ্ছে।
সানা কিন্তু এই ভবিতব্য মেনে নিল না; হঠাৎ একদিন বিদ্রোহ ঘোষণা করে বলল, “আই অ্যাম সরি ফর হোয়াট হ্যাপেন্ড টু আস। বাট আই অ্যাম নট গোয়িং এনিহোয়্যার।”
মম্ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল, “তার মানে? কী বলতে চাইছিস তুই?”
“মানে আমি লন্ডনেই থাকব। আই কান্ট লীভ হোম লাইক দিস।”
“সানা, এরকম অসম্ভব জেদের কোনো মানে নেই। তুই জানিস আমরা বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে পার্মানেন্টলি চলে যাচ্ছি। এরপর কীভাবে থাকবি তুই এখানে?”
“আমি অ্যাডাল্ট। আই ক্যান ম্যানেজ। আই উইল অ্যাপ্লাই ফর স্কলারশিপ্স ফর মাই স্টাডিজ। অ্যান্ড আই উইল ফাইন্ড আ প্লেস টু স্টে। তোমাদের কিছু পে করতে হবে না।”
কত অশান্তি হল তাই নিয়ে। মম্ কতরকমভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল সানাকে, ঝগড়া করল, কাঁদল। কিন্তু ওর জেদের কাছে দাঁড়াতে পারল না। শেষ অবধি ড্যাডকে গিয়ে ধরল, “তুমি বাবা হয়ে চুপ করে দেখছ? মেয়েকে বোঝাতে পারছ না একবারও?”
ড্যাড কিন্তু সত্যিই কিছু বলল না। উলটে মম্কে জবাব দিল, “সানা যা ভাল বুঝবে, করবে। ওর একুশ বছর বয়স হল। ছোট তো নেই। ওর বয়সের ক’জন ব্রিটিশ ছেলে মেয়ে বাড়িতে মা বাবার সঙ্গে থাকে? ও তো এ দেশেই বড় হয়েছে, এখানকার চালচলনেই অভ্যস্ত। যা ঠিক মনে করে, ও সেটাই করবে।”
তারপর একটুক্ষণ মমের আহত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “এই পুরো ঘটনার কালপ্রিট আমিই তো। সানা সেটা জানেনা ভেবেছো? আমার আর কারুর উপর জোর খাটবে না, শ্রাবস্তী। তুমি কথা বাড়িয়ো না। সানা যাতে সেফলি থাকতে পারে, তার ব্যবস্থা আমি করে দিয়ে যাব।”
সানা এসে শরণ্যাকে বলল, “উই ক্যান স্টে টুগেদার। য়ু ডোন্ট হ্যাভ টু লীভ, রাকা। আই উইল ম্যানেজ। ড্যাড হেল্প করবে বলেছে।”
এই প্রথম যেন কেউ শরণ্যাকে একটা বাঁকের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল। এর আগে তো কখনোও এমন জীবন-বদলে-দেওয়া সিদ্ধান্ত নিতে হয়নি। ওই দিয়েই শুরু। সানার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাওয়া অন্য রাস্তাটার তুলনায় কত সহজ ছিল! কিন্তু শরণ্যা মাথা নেড়ে বলেছিল, “ড্যাড্ আমার খরচ সাস্টেন করতে পারবে না। স্কুলস আর এক্সপেনসিভ হিয়ার, সানা।”
“পুরোটা না করলেও...”
“তুইও পারবি না। য়ু ডোন্ট হ্যাভ আ জব। ইটস ডিফিকাল্ট এনাফ ফর য়ু। আই হ্যাভ টু গো।”
“বাট রাকা —”
“সানা, এটা কেন ভাবছিস না, মম্-ড্যাডের খেয়াল রাখবারও কেউ দরকার? আই নো য়ু ক্যান টেক কেয়ার অফ ইয়োরসেলফ, বাট ড্যাড ইজ ইল। হী নীড্স মী। আমাকে যেতেই হবে।”
এবং সত্যি সত্যি এপ্রিল মাসে ক্লাস টেনের পরীক্ষা শেষ করে শরণ্যা মম্-ড্যাডের সঙ্গে এ দেশে চলে এল। সানা রয়ে গেল। ছোটমাসী ওদেরকে সেটল করতে কতরকম সাহায্য করেছিল তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সানাকে থিতু করবার কেউ ছিল কিনা কে জানে। অবশ্য সানা খুব শিগগিরই পড়াশোনা চালিয়ে যাবার স্কলারশিপ পেয়ে গেল, একটা পার্ট টাইম কাজও জুটিয়ে নিল, তাই কিছুদিনের জন্যে হলেও নিশ্চিন্ত হয়েছিল শরণ্যা। কিন্তু সমস্যাটা এল অন্য দিক দিয়ে। লন্ডনের শেষ দিনগুলোতেই সানার সঙ্গে মম্-ড্যাডের বোঝাপড়ায় ভুল হয়েছিল। ড্যাডের বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছিল যে সানার কাছে সেই অপরাধী। কিন্তু মম্ উল্টোটা ভাবছিল। ওদের সঙ্গে দেশে ফিরে না যাওয়ায় সানাকে বারবার দোষ দিচ্ছিল মনে মনে। প্রথম প্রথম ফোন করত সানা। কিন্তু প্রত্যেকবারই গুরুতর কথা কাটাকাটির কোনো এক পক্ষ ফোন রেখে দিত। তারপর একদিন সানা ফোন করা বন্ধ করে দিল। মম্-ড্যাডও নিজের তাগিদে খবর নিতে গেল না। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়াল শরণ্যা।
প্রথম-প্রথম সত্যিই মনে হয়েছিল বাঁচবে না এখানে। কিন্তু কই, কেটে তো গেল দেড়খানা বছর। দিনে দিনে বাঁচা সহজ হয়ে আসছে শরণ্যার কাছে। আস্তে আস্তে সে শিখে নিয়েছে এই শহরের নিজস্ব ভাষা; আর পাঁচটা কলকাতার ছেলেমেয়ের মতোই হয়ে উঠছে সময়ের সাথে সাথে। বাড়ির পরিস্থিতিটাও কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এখন। ড্যাড একটা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পার্ট টাইম পড়ায়। শরীর সেরে উঠছে আস্তে আস্তে। মম্ বাড়িতেই কয়েকজন ছেলেমেয়েকে কি-বোর্ড শেখায়; পিয়ানোটা তো নিয়ে আসা হয়নি। সবই আপাতদৃষ্টিতে সহজ হয়ে এসেছে, শুধু সহজ হচ্ছে না মন। ক’বছর আগেই যে মানুষটার উপস্থিতিই ছিল না শরণ্যার জীবনে, সে আজ বড় বেশি করে জায়গা জুড়ে আছে। ড্যাড এক ঘরে বসেও যেন অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সব সময়, শরণ্যার বুঝতে অসুবিধে হয় না। হয়তো এই ঘটনা তাদের সবারই মনের গভীরতম গ্রন্থিগুলো পালটে দিয়েছে এক লহমায়। মম্-ড্যাডের সেই আগের সম্পর্কটা এখন তেতো হয়ে গেছে, সে টের পায়। তার কারণ কী শুধুই সানা? হয়তো এমন কিছুও আছে, যা তার পক্ষে এখন বুঝে ওঠা অসম্ভব।
কিন্তু চিঠির উত্তর যে দিতে হবে। শরণ্যা কাগজের প্যাড বার করে লিখল:
ছোটমাসী,চিঠিটা একবার পড়তে গিয়ে মনে হল, রঙ্গীতদার কথা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে যে একেবারে হয়নি তা নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে সব সময় অহেতুক ভয় করে; কে জানে, ছোটমাসী কি ভেবে বসবে। মনের জটিল বিচরণের কথা ভাবতে গিয়ে নিজেই হেসে ফেলে শরণ্যা। পরক্ষণেই মনে হল, আচ্ছা, টি. এস. এলিয়টের কি উপলা, তিলোত্তমা, মৃণালিনী, আর নীরার মতো চারজন বন্ধু ছিল?তোর চিঠি পেয়ে যেকি ভাল লাগল! এই ক’দিনে মনে হচ্ছিল এক যুগ পেরিয়ে গেছে, তোর সঙ্গে কথা হয়নি। মাঝে মাঝে এই কারণেই রাগ হয় তোর উপর। কেন যে তুই অরকুটে বা ফেসবুকে নেই! ফোনও করিস না, ই-মেল করতেও রাজি হোস না। বাড়ির আর সবার সঙ্গে তো দিব্যি অন্যান্য মাধ্যমেই কথা-বার্তা চালাস, তবে আমার বেলাতেই যত অদ্ভুত নিয়ম কেন? অবশ্য ওই ‘কেন’-র উত্তর আমার জানা। অগত্যা এই চিঠিই সই।
তুই আমার জন্য অত ভাবিস না। আমি ভালই আছি এমনিতে। তবে তোর কথাটাও ঠিক — আমি হয়তো আগের চাইতে অনেকটাই একা হয়ে গিয়েছি এই এক বছরে। আসলে জায়গার সঙ্গে মুখগুলো বদলে যায়, তাই সামলে নিতে সময় লাগে। তবে তুই যে বলিস, একজন লেখকের সব ধরণের অভিজ্ঞতা আর অনুভূতিকে স্বাগত জানানো উচিৎ; একাকীত্ত্বও তবে প্রয়োজনীয় বস্তু। তবে আস্তে আস্তে আবার সবকিছু আগের মতো হয়ে উঠবে, এই ভরসাও রাখি। আমার কিছু বন্ধু হয়েছে এখানে। তারাও আমার মতো এই স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছে। ওরা যেন একটু অন্যরকম। এক একজনের এক এক রকম গল্প। তবে আমার অজান্তেই ওরা আমার নিজের গল্পে ঢুকে পড়ে তার জটগুলো অনেকটা ছাড়িয়ে দিয়েছে। সে খবর ওরা রাখেনা, কিন্তু আমি ভাবি, ভাগ্যিস এই সাদামাটা খাপছাড়া ইস্কুলটায় পড়তে ঢুকেছিলাম! না হলে কি আর ওদের কোনোদিন চেনা হত?
সানাকে বলব তোর কথা। ওর এম.এ তো প্রায় শেষের মুখে। ক’দিন পর থিসিস লেখার চাপ পড়বে, তার উপরে পার্ট টাইম কাজের ধাক্কা। একা একা ওখানে জেদ করে পড়ে আছে, বলবই বা কি? বাড়ির সবার ছোট হলে কেমন একটা অসহায় লাগে না মাঝে মাঝে? তাও আমিই খোঁজ নিই যতটা পারি। সানাও যে ফোন করেনা তা নয়, কিন্তু মাঝে মধ্যে ভুলেও যায়। আসলে হয়তো আমাদের চলে যাওয়াটা ওর মনে তেমন সড়গড় হয়নি এখনও।
তুই ভাল আছিস জেনে খুশি হলাম। গত দুই বছরে যাওয়াই হয়নি শান্তিনিকেতনে। খুব কি বদলে গেছে জায়গাটা? পুজোর ছুটিতে যাওয়ার প্রস্তাবটা লোভনীয় বটে, তবে এবারটা হল না রে। স্কুল খুলেই হাফ ইয়ারলি। তবে আই. এস. সী পরীক্ষাটা দিয়েই চলে যাব ওখানে। সঙ্গে আমার চার বন্ধুদেরও নিয়ে যাব। অসুবিধে নেই তো?
আজ এখানেই শেষ করলাম। আবার কথা হবে, আশা করি শিগ্গির। ভাল থাকিস। তোর ছাত্রদের বেশি জ্বালাতন করিস না যেন!
রাকা।
।। ৮ ।।
বইখাতা বন্ধ করে নীরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। পুজোর ছুটিটা এবারে পুরোপুরি মাটি। আসল চারটে দিন বাদ দিয়ে পুরো সময়টা হাফ ইয়ারলি-র জোরদার প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। বাড়িতে থাকলেই মায়ের খবরদারিতে একগাদা পড়াশোনা করতে হয়। তাদের ইস্কুলে এদিকে কস্মিনকালেও ওসব অবান্তর জিনিসের পাট নেই। সেখানে সবাই যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে। সত্যি, অনেক ধরণের ইস্কুলের কথা শুনেছে নীরা, কিন্তু এমন একখানা জায়গা যে কলকাতা শহরে থাকতে পারে, এ না দেখলে বিশ্বাস করত না। প্রথমদিন চত্ত্বরে পা দিয়েই সে আর মৃণালিনী মুখ তাকাতাকি করেছিল; তাদের চোখের সামনে একটা বিশুদ্ধ পাগলাগারদের চিত্র। টিচারদের হাজিরা দেওয়ার কোনো দায় নেই, ছাত্রদের ইউনিফর্মের কোনো স্থিরতা নেই, এমনকি, ইস্কুলের হেডমাস্টার আর ভাইস প্রিন্সিপাল পর্যন্ত ছ’মাস অন্তর বদলি হয়ে যান। সত্যি, এমন একটা স্কুলে ভর্তি হতে পারলে আর পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে নাটক দেখতে হয় না। ছুটির দিনগুলোই বরং কেমনধারা পানসে ঠেকে। কবে যে ইস্কুলটা খুলবে আর পরীক্ষাটা চুকবে! লেখাপড়ার ফিকিরে সারা পুজো রন্-পল্-লিনী-তিল্লির সঙ্গে দেখাই হল না আর।
বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে স্কুলের নানাবিধ কাণ্ডকারখানার কথা ভেবে আপনমনে ফিকফিকিয়ে হাসছিল নীরা। এমন সময় ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে নজর পড়তে একটু অবাকই হল। অত্রির ফোন। এখন তো ওর ক্লাসে থাকার কথা! ওদের য়ুনিভার্সিটি কোন জন্মে খুলে গেছে।
“কি ব্যাপার, অসময়ে ফোন যে?”
“অসময়ে?”
“নয় বুঝি? এখন দুপুর দেড়টা বাজছে – ”
“ওঃ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাও তো বটে। কিন্তু আমার যে সাংঘাতিক ইয়ে একটা কথা বলার ছিল।”
“সাংঘাতিক ইয়ে আবার কি!” নীরা তাজ্জব।
“মানে, ওই আর কি, জরুরি।”
“কি ব্যাপার বল্ তো অত্রি,” এতক্ষণে নীরার সন্দেহ হয়, “কার সঙ্গে কী গণ্ডগোলটা পাকিয়েছিস?”
“পাকাইনি এখনোও, তবে শিগ্গিরই পাকাতে চলেছি।”
“অ্যাঁ! কি ভাঁট বকছিস সমস্ত?”
“ভাঁট নয়, এসব হল সাংঘাতিক ইয়ে। তোর বিকেলের দিকে সময় হবে?”
“তা হবে, কিন্তু —”
“হবে? আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবি? বেশি সময় নেব না।”
“আচ্ছা বেশ, চলে আসিস বাড়িতে।”
“আরে, পাগল নাকি!” অত্রি একেবারে হাঁ-হাঁ করে উঠল, “বাড়িতে না। একটু কষ্ট করে বেরোতে হবে।”
“আশ্চর্য! কোন চুলোয় যাব বেরিয়ে?”
“এই তো, বেশি দূরে নয়। ফুল্কিদের বাড়ির গলির মুখটার কাছে একটা নতুন কফিশপ খুলেছে না? মানে, তোর শিল্দার ঠিক পাশের বাড়ির একতলাটায়। ওই অবধি আসতে পারবি তো? তাহলেই হবে।”
“তোর মতলবটা কি খুলে বল্ তো?”
“আরে বাবা, সেটা বলতেই তো ডাকছি।”
“যা ইচ্ছে কর, তবে আমিও বলে রাখছি, কোনোরকম ক্যাচালের মধ্যে জড়ালে আমি জাস্ট হাত ধুয়ে ফেলব।”
“না রে ভাই, জড়াব না। তাহলে কফিশপ, বিকেল পাঁচটা। ঠিক তো? আচ্ছা বাই।”
ফোনটা রেখে নীরা ভুরু কুঁচকে বসে রইল খানিকক্ষণ। অত্রির ব্যাপার-স্যাপার বোঝা যায় না। এমনিতে দিব্যি শান্তশিষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। কিন্তু একবার চটে গেলে, কিংবা কোনওরকম হুজুগে পড়লে তাকে ঠেকিয়ে রাখা মানুষের অসাধ্য। ছোটবেলা থেকে আজ অবধি এই স্বভাব বদলাল না। নীরাকেও তাই সময়-বিশেষে অত্রিকে সমঝে চলতে হয়। এমনিতে তো তার চোখের পাতা পড়ার মানেটাও নীরার জানা। অত্রিকে কি আজ থেকে চেনে! কবে যে প্রথম দেখা হয়েছিল, কবে যে প্রথম বন্ধু হিসেবে খেলাধুলো শুরু হয়েছিল, তা সে মনেই করতে পারে না! মৃণালিনীর ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই। অত্রি বছরখানেকের বড় হয়েও তাই ছোটবেলা থেকেই দুজনে হরিহর আত্মা। কলেজে উঠলে অনেক সময় বয়সে সামান্য ছোটদের প্রতিও মনের ভাবটা বদলে যায়। অত্রির ক্ষেত্রে কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। অন্ততঃ আপাতদৃষ্টিতে নীরার তাই মনে হয়। মৃণালিনীর সঙ্গে অবশ্য অত্রির সম্পর্কটা বরাবরই তেমন সুবিধের ছিল না। ছোটবেলায় দুজনে পরস্পরের একটা ভাষাই বুঝত, তা হল নির্ভেজাল হাতাহাতি। এই নিয়ে একটা সময় গোটা পাড়াটা তটস্থ হয়ে থাকত। মাঝে মাঝে তো কাণ্ডটা রক্তারক্তির পর্যায়ও চলে যেত। মনে আছে, একবার মৃণালিনীর সঙ্গে নীরার কোনও কারণে ভীষণ ঝগড়া হয়েছিল। রাগের মাথায় মৃণালিনী তাকে ভীষণ মেরে তারই খাটের তলায় চ্যাংদোলা করে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছিল। সে এক বিশ্রী কাণ্ড! নীরা ছোটখাটো চেহারার মেয়ে, তার উপর বারো মাস ভুগে ভুগে বেজায় রোগা। মৃণালিনীর সঙ্গে এঁটে ওঠা তার একার কর্ম ছিল না। তাই পরের দিন সে অত্রির কাছে কাঁদো-কাঁদোভাবে নালিশ জানিয়ে এসেছিল। তার ফল হয়েছিল মারাত্মক। নীরার মুখ থেকে কথা না খসতেই অত্রি লাফিয়ে উঠে ফুঁসতে ফুঁসতে প্রতিশোধ নিতে গিয়েছিল। তার পরের কিষ্কিন্ধাকাণ্ডের বিবরণ দেওয়াই বাহুল্য। সে লড়াইয়ে শেষমেশ কে জিতেছিল তা কেউই হলফ করে বলতে পারেনা, তার কারণ ঘটনার পরের পনেরো দিন অত্রি তার হাত আর মৃণালিনী তার পা ভেঙে বিছানায় পড়েছিল। শেষটা এমন হত, যে পাড়ায় কেউ ওদের একসাথে দেখলেই পালিয়ে যেত। ততদিনে সবাই টের পেয়ে গেছে যে ফুলকি আর রিকু পরস্পরের ত্রিসীমানায় থাকা মানেই মারপিট আসন্ন। ওই যে শেলি বলেছিলেন, ‘ইফ উইন্টার কাম্স, ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড?’
আজকাল অবশ্য দুজনেরই রক্ত শীতল হয়েছে অনেকটা। রাস্তায় দেখা হলে কাষ্ঠ হেসে চলে যায়। নীরা ওদের রকম দেখে হেসে বাঁচেনা। অত্রিকে জিজ্ঞেস করলে সে মাথা চুলকে বলে, “ধুর বাবা, সে সব তো ছোটবেলার গল্প। এখন ওরকম করলে আমি আর ফুলকি দুজনেই হাজতে যাব।”
মৃণালিনীর অবশ্য সম্পূর্ণ উলটো মত। উদাসীনভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, “কি হবে? রিকুটার হাবভাব দেখেছিস একবার? পুরো ম্যাদা মেরে গেছে। কলেজে উঠলে ওরকম অনেক ছেলেমেয়েই উচ্ছন্নে যায়। এখন তোর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়াই বাকি আছে শুধু। তোরও তো আরশুলা-খাওয়া চেহারা, মিলবে ভাল।” নীরা তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল, “যাব্বাবা, এর মধ্যে আমাকে টানা কেন? হচ্ছিল কথা তোর আর অত্রির —”
“আর হাসাসনা নীরা,” মৃণালিনী কথা কেড়ে নিয়ে বলে, “তুই যদি আমাকে এতটাই মাথামোটা ভাবিস, তাহলে সত্যিই আমার কিছু বলার নেই। রিকু মালটার দিকে সেই দশ বছর বয়স থেকে যেভাবে দৃষ্টি দিস তুই, পুরো কুপিয়ে দিতে ইচ্ছে করে আমার। নেহাৎ কিনা রিকুর ঘটে কিছু নেই, নাহলে এতদিনে সব টের পেয়ে হিমালয়ে চলে যেত।”
“দেখ্ লিনী —”
“আরে চাপ নিচ্ছিস কেন? আমি কাউকে কিছু বলব না। আমার এর চেয়ে অনেক জরুরি কাজ আছে জীবনে।”
“হ্যাঁ, যেমন শিল্দাকে ঝাড়ি মারা,” এই বলে নীরা মুহূর্তের মধ্যে মৃণালিনীর চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল।
সত্যি, ছোটবেলাটাই বোধহয় ভাল ছিল। তখন এতরকম সম্পর্কের জটিলতা ছিল না। অতীত বলে কোনো বস্তুই তৈরি হয়নি, আর ভবিষ্যত নিয়ে ধারণাগুলোও খুবই অস্পষ্ট ছিল। তাই দিনগুলো বেশ সহজভাবে কেটে গেছে। অবশ্য নীরার জীবনে যে এখনও স্বাচ্ছন্দ্যের কিছু অভাব হয়েছে তা নয়। অনেকের তুলনায় দিব্যি হেসেখেলেই বাঁচছে সে। মৃণালিনীর মনে বরং ইদানীং নানারকম অশান্তির কথা টের পাওয়া যায়। সেসব কতটা সত্যিকার সমস্যা, আর কতটা মনগড়া আক্ষেপ, তা অবশ্য বলা যায়না। তবে দেশ ছেড়ে আসার কারণে শরণ্যার মনে বেশ দুঃখ আছে। সে দুঃখ কেমন, তা নীরার পক্ষে আন্দাজ করা সত্যিই কঠিন। সত্যিই তো, তার এই সতেরো বছরের জীবনে কোন জিনিসটা অভিযোগ করবার মতো? বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে বলে সবকিছুতেই অগাধ প্রশ্রয় তার। কোনো কিছুতেই কোনো বাধা নেই। ছোট, শান্তিপূর্ণ পরিবার তাদের। জন্ম ইস্তক কলকাতাতেই বেড়ে ওঠা, কাজকর্ম। কিন্তু একদিনের জন্যেও অন্য কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে হয় না তার। কোনো কিছুর অভাব বোধ করে না সে। তার আঁকা ছবিগুলোও তাই উজ্জ্বল, আনন্দময়। মাঝে মাঝে মৃণালিনীর কথা শুনে মনে হয়, ও যেন দুঃখকে খুঁজে খুঁজে বেড়ায়। আগে এমনটা ছিল না, তবে যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন এই অভ্যাস আরো পাকা হচ্ছে ওর। এহেন দুঃখবিলাসের মানে বোঝে না নীরা। না পাওয়ার মধ্যেও নাকি এক ধরণের কাব্য আছে? তা থাকতে পারে, তবে নীরা সেই রসের বোদ্ধা নয়। তাই বোধহয় আধুনিক কবিতা পড়ে তেমন বুঝতে পারে না সে।
এই প্রসঙ্গে বারবার তিলোত্তমার কথা মনে হয় কেন যেন। ওকে নীরা আজও ঠিক চিনে উঠতে পারেনি। তিলোত্তমাকে তার সব দিক থেকেই মৃণালিনীর উলটো পিঠ বলে মনে হয়। লিনী এতদিন যে ঘেরাটোপের মধ্যে বড় হয়েছে, তা ভেঙে বেরোবার জন্যে সে ব্যস্ত। কিন্তু তিলোত্তমাকে দেখে নীরার কেন যেন মনে হয়, এই মেয়ের জীবনে ঘেরাটোপ বলে কোনো বস্তুই ছিল না। মানসিকভাবে সে তাদের সবার থেকে অনেকটাই বড়। এইটুকু জীবনের মধ্যেই সে অনেককিছু জেনেছে বা উপলব্ধি করে ফেলেছে, যা করার কথা ছিল আরও অনেক পরে। তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাওয়ায় কি তিলোত্তমা খুশি? নীরার তো তা মনে হয় না। বরং তিলোত্তমার আচরণে বারবার এটাই প্রমাণ হয়ে যায় যে সে যেন তার এই অকাল-প্রাপ্তবয়স্কতার কারণে বেশ কুণ্ঠিত। যেন কোনো একটা অন্যায় করে ফেলে সেটা সকলের কাছে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। শরণ্যার দুঃখের ধরণটা আলাদা। তার মধ্যে কোনো গোপনীয়তা নেই। কিন্তু তিলোত্তমাকে দেখে সহানুভূতির চেয়ে ভয়ের উদ্রেকটাই হয় বেশি — অজানা কোনো কিছুর একটা ভয়।
তাদের চারজনের মধ্যে উপলাই একমাত্র নীরার মতো। যদিও প্রকাশ্যে পলের সঙ্গে রনেরই বেশি খাতির, যেমন তার সঙ্গে লিনীর — তবুও নীরা বোঝে, উপলার মনটা তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোময়। এটা ঠিক, যে বই মুখে করে থেকে থেকে পলের বাস্তববুদ্ধি প্রায় শূন্যের কোঠায়, তবু তাদের মধ্যে ওই সবচেয়ে সহজ মানুষ। আর হয়তো সবচেয়ে ভাল মানুষও বটে। লিনী, রন্ও ভাল, তিল্লিও নিশ্চয়ই, তবে পলের ‘ভাল’-র মধ্যে একটা বিশুদ্ধতা আছে। সেটায় কি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ মিশে যাবে? সবকিছুতেই যে উপলার বিস্ময়বোধ, সবাইকে অকাতরে বিশ্বাস করতে পারার ক্ষমতা, এই স্বভাবগুলো হয়তো একসময় চলে যাবে।
অত্রিও কি তাদের মতোই বদলে যাবে? নীরা সেটা একেবারেই কল্পনা করতে পারে না। ব্যঙ্গ করে হলেও, লিনী কিন্তু সেদিন একটা ঠিক কথাই বলেছিল। নীরার মতোই অত্রির মনে কোনো জটিলতা নেই। নীরার ভয় ছিল, কলেজে উঠে হয়তো অবস্থার চাপে পড়ে বদলে যাবে ও। কিন্তু কই, এতদিন হয়ে গেল, এই অত্রি সেই অত্রিই আছে। সেইরকমই ঠাণ্ডা, আবার সেইরকমই মাথাপাগল। কোনো কিছু ভাল লাগলে যেমন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে, তেমনি কাউকে বা কারুর আচরণ পছন্দ না হলে মুখের উপর জানিয়ে দেবে। এ হেন অত্রিকে অন্যরকম হয়ে যেতে দেখলে নীরার সত্যিই ভাল লাগবে না। আসলে মানুষের বোধহয় নিজের মনের বদলটাকে মেনে নিতেই সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়। আর নীরা এইসব সময়ে বুঝতে পারে, যে অত্রি তার থেকে আলাদা কেউ নয়। সে যেমন নীরাকে নিজের চেয়ে বেশি চেনে, নীরাও অত্রিকে তেমনভাবেই চেনে যেমনভাবে অন্ধকারেও নিজের ঘর চেনা যায়। কত সময়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অত্রি আর নীরা পাশাপাশি বসে সময় কাটিয়ে দিয়েছে; একটা কথা খরচ না করেও নীরার মনে হয়েছে যেন একটা লম্বা সময় ধরে আড্ডা হল। মনখারাপ হলে আচমকাই অত্রির ফোন এসেছে; এখন নীরা জানে তার কোনোটাই সমাপতন নয়। অত্রি এখন নীরার থেকে সম্পূর্ণভাবে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। জলের মতো, বাতাসের মতো, নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো, অত্রিকে যেমন অনেক সময়েই আলাদা করে টের পাওয়া যায় না, তেমনি ওকে বাদ দিয়ে জীবন চালানো যায় না।
বড় হওয়ার এই এক মুশকিল। সবকিছুকেই বিশ্লেষণ না করতে পারলে শান্তি হয়না! যে মুহূর্ত থেকে নীরা তার অবস্থানটা সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছে, তখন থেকেই অত্রির কাছ থেকে একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে তার। সম্পর্কের ইকুয়েশান যাবে কোথায়! আজকাল তাই থেকে থেকেই চিন্তা হয়, তার জীবনে অত্রির যতটা জায়গা, অত্রির জীবনে হয়তো নীরার ততটা নেই। হয়তো সে শুধুমাত্র তার আর পাঁচটা সাধারণ বন্ধুর দলে। অত্রি নীরাকে বোঝে ঠিকই। কিন্তু তাকে বোঝা এমনই কী কঠিন কাজ? সে তো আর সাহিত্যের কোনো রহস্যময়ী নারী নয়, যার জন্যে হাজার বছর ধরে কবিরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে! তাহলে অত্রির কাছেই বা সে অসাধারণ হয় কোন অর্থে? এই সব ভাবনা মাঝে মাঝে নীরাকে বিষন্ন করে দিচ্ছে আজকাল, যদিও সে তাদের বিশেষ আমল দিতে চায় না।
কিন্তু ... গোলমালের কথা কি বলছিল অত্রি? মাঝে মাঝে এমন সব হেঁয়ালি করে, কিছুই বোঝা যায় না! কলেজে কি কিছু ঝামেলা বেধেছে? ... নীরা ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। কলেজ ... আচ্ছা, ওর ব্যাচের সেই মেয়েটাকে নিয়ে আবার নতুন কিছু ঘটল না তো?
কলেজে ঢুকতে না ঢুকতেই বেশ কিছু বন্ধু জুটে গিয়েছিল অত্রির। তাদের মধ্যে রুদ্র আর শুচিস্মিতার নাম শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিল নীরার। আগের বছর থেকেই শুনে আসছে যে শুচিস্মিতাকে নাকি অত্রির ভারি পছন্দ। তা, পছন্দ হলে আপত্তি কিছু ছিল না নীরার, তবে ক্রমেই বোঝা গেল যে মেয়েটা নিজে মোটেই বিশেষ সুবিধের নয়। গত মাস অবধি অত্রির পয়সায় কফি খেয়ে, আইনক্স-এ সিনেমা দেখে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিল শুচিস্মিতা। ছেলের আনন্দ দেখে কে! তার বদ্ধমূল ধারণা হল যে অপর পক্ষেরও সায় আছে, যাকে ইংরিজিতে বলে ‘দ্য ফিলিং ইজ মিউচুয়াল’। কিন্তু মোক্ষম প্রশ্নটি করবার আগেই পাখি উড়ে গেল। শুচিস্মিতা অত্রির ফোন ধরা বন্ধ করে দিল, মেসেজের উত্তর দিত না, এমনকি কলেজে দেখা হলেও চিনতে না পেরে চলে যেত। সম্প্রতি নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের সিনিয়ার ছাত্রের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইরকম ঘটনা অত্রির কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। তাকে শুচিস্মিতার বিশেষভাবে পছন্দ নাই হতে পারে, কিন্তু কথা বন্ধ করে দেওয়ার কারণটা কি? অত্রি তো কখনোও কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করেনি ওর সঙ্গে। এই নিয়ে নাকি রুদ্রকেও জিজ্ঞেস করেছিল সে। রুদ্র অবশ্য কিছুই না বলে গম্ভীরভাবে হাত উলটেছে শুধু। তারপর বেশ কিছুদিন অত্রি মুষড়ে ছিল।
ব্যাপারটা বেশ অসম্মানজনক সন্দেহ নেই। তবু অত্রির যে বোধোদয় ঘটেছে তাতে নীরা মনে মনে খুশি না হয়ে পারেনি। কিন্তু ফোনে কথা শুনে হঠাৎ খট্কা লাগছে, হয়তো বিষয়টার আদৌ পুরোপুরি নিষ্পত্তি হয়নি। কোনোভাবে কি অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার তাল করেছে? ওর হাসিখুশি চেহারাটা দেখে সবাই ওকে সহজ-সরল নির্বিবাদী বলেই ধরে নেয়। এটা অনেকেই বোঝে না যে অত্রি সেনকে কোনো মতে ক্ষেপিয়ে দিলে একেবারে কুরুক্ষেত্র হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে ছেলের যা টন্টনে আত্মসম্মানবোধ। বিনা কারণে অপমানিত হলে সে মোটেই ছেড়ে কথা বলবার লোক নয়। ... কিন্তু, ব্যাপারটা যদি তাই হয়, তাহলে নীরাকে খামখা এর মধ্যে টানা কেন? এটা অবশ্য ঠিক যে নিজের যাবতীয় পেটের কথা তাকে না শোনালে অত্রির হজম হয়না; কিন্তু এ যে রীতিমতো তলব করে পাঠানো। কি এমন কেলেঙ্কারি ঘটাবার কথা ভাবছে সে, যা বাড়িতে বসে বলা যায়না?
ভীষণ রাগ হল নীরার। শুচিস্মিতার মতো মানুষেরা যে কী করতে পৃথিবীতে জন্মায়, ঠাওর হয় না ওর। যেন তাদের কাজই হল জগতসুদ্ধ লোকেদের অহেতুক ঝামেলায় ফেলা। অবশ্য এই ধরণের লোকেদের শোধরানো বলতে গেলে অসম্ভব, আর তাই এদের কাছ থেকে ভদ্র আচরণ আশা করাটাই ভুল। কিন্তু অত্রিটার সত্যি কি আক্কেল? টের যখন পেয়েছিস শুচিস্মিতা লোক ভাল না, তখন এত হাত-পা ছোঁড়বারই বা আছেটা কি শুনি? কোথায় নিরর্থক ভোগান্তির হাত থেকে বেঁচে গেছে বলে ভগবানকে বেশি করে ধন্যবাদ দেবে, তা নয়, একটা ফালতু মেয়ের পাল্লায় পড়ে ক্ষেপে উঠেছে একদম! ...
“নীরু, লাঞ্চ খেয়ে কতক্ষণে আমাকে উদ্ধার করা হবে জানতে পারি?” খাবার ঘর থেকে মায়ের গলা পাওয়া গেল।
নীরা চটকা ভেঙে উঠে বলল, “এই তো, যাই!”
নীরাকে দেখেই অত্রির একগাল হাসি, “এসেছিস এতক্ষণে!”
“এতক্ষণে মানে?” নীরা ভুরু কুঁচকে বলে, “কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটার সময় এসেছি!”
“ও, তাই বুঝি? আমি আবার — যাইহোক, বোস্ না!”
নীরা চেয়ার টেনে বসে বলে, “কি বলবি বল্।”
অত্রির কিন্তু কিছু বলার তেমন চাড় দেখা গেল না, “আরে অত হুড়োহুড়ির কি আছে? বলব’খন ধীরে সুস্থে। আগে অর্ডার দে। কি খাবি?”
“কি খাব এত সকাল সকাল? কফি বলে দে।”
অর্ডার দেওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করল অত্রি। কে জানে কাকে কী নির্দেশ দিচ্ছে! নীরার বুক ঢিপ্ঢিপ্ করে উঠল। শেষে আর থাকতে না জিজ্ঞেস করল, “তোদের কি আজ কলেজে কোনো অনুষ্ঠান ছিল?”
“কই, না তো,” অত্রি স্ক্রিনের দিকে চোখ রেখেই উত্তর দেয়।
“আমাকে কি কলেজ থেকেই ফোন করেছিলি? ... আঃ, এদিকে তাকা না, কী তখন থেকে খুটুর-খুটুর করছিস!”
অত্রি ফোন নামিয়ে রেখে বলল, “সরি, রুদ্র মেসেজ করছিল। আজকে আমি কলেজ যাইনি।”
নীরা বাস্তবিক অবাক হয়ে বলে, “তাহলে এরকম মাঞ্জা দিয়েছিস কিসের আনন্দে? তোর জুতোজোড়া অবধি যেন পালিশ করা ঠেকছে?”
“সাজটা লক্ষ্য করেছিস?” অত্রির চোখদুটো খুশিতে ঝিকিয়ে উঠল, “কেমন মনে হচ্ছে? শার্টের রঙটা কিরকম?”
“সাজ তো ভালই,” নীরা স্বীকার না করে পারেনা, “আর রঙও চমৎকার। তোর যে এরকম শার্ট আদৌ আছে তাই তো জানতাম না। টি-শার্ট আর ঠ্যাং-বের-করা বারমুডা ছাড়া তো কিছুই পরতে দেখিনা তোকে।”
“দেখবি কি করে,” অত্রি দাঁত কেলিয়ে বলে, “শার্টটা নতুন। রুদ্র পছন্দ করে দিয়েছে।”
নীরা চোখ উলটে বলে, “আজকাল শপিং করতেও রুদ্রকে ট্যাঁকে নিয়ে বেরোচ্ছিস? শাবাশ! তা সাজটাও কি রুদ্রর অনারে? তার বিয়ে-শাদি লেগেছে বুঝি?”
“কেন? রুদ্রর বিয়ে ছাড়া আমার কি সাজবার অধিকার নেই? তুই মেয়ে বলে সাজবার রাইট সব তোর? আমি ছেলে তাই একদিন সাজলেই আমাকে প্যাঁক খেতে হবে? এ তো আচ্ছা মামদোবাজি!”
“আরে, কি যা তা কেস রে বাবা!” নীরা বিপন্নভাবে বলে, “আমি কখন বললাম তোর সাজবার রাইট নেই? বিকেল হতে না হতে তুই আমাকে এই হতচ্ছাড়া কফিশপে ডেকে আনলি, ভাবখানা যেন মাথায় বাজ পড়েছে। আমি ছুটতে ছুটতে এসে দেখি কিছুর মধ্যে কিছু না, তুই হলিউডের হিরোদের মতো গেট আপ নিয়ে বসে আছিস। এখনও পর্যন্ত কাজের কথাটার ধার দিয়েও না গিয়ে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে শপিং করার গল্প বলে যাচ্ছিস। তারপর আমি কিছু বলতে গেলে আমার উপরেই চোটপাট!”
“আরে কাজের কথা কি পালিয়ে যাচ্ছে? দুটো মিনিট বোস না মা ধৈর্য ধরে; কফিটা আসুক, তারপর আদ্যোপান্ত সব বলছি।”
কফি আসতে যেন অনন্তকাল কেটে গেল। অবশেষে ধোঁয়া-ওঠা কাপটায় চুমুক দিয়ে একটা পরিতৃপ্তির ‘আঃ’ বলে অত্রি গুছিয়ে বসল।
“কই, বল এবার?” নীরা তাড়া লাগাল।
“হুঁ, বলছি,” কাপটা নামিয়ে রেখে অত্রি বলল, “আসলে আমি যেদিকে যেতে চাইছি, সেটা একটা ইয়ে ডাইরেক্শান। মানে আসল ঘটনাটা একটু ইয়ে, মানে —”
নীরা মহাবিরক্ত হয়ে অত্রিকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “তোর কি ‘ইয়ে-মানে-ইত্যাদি’ ছাড়া আর কিছু বলার আছে?”
“না, না, একশোবার। আমি শুধু ব্যাপারটা ঠিক করে —”
“দেখ্ অত্রি, আমি যে তোর অবস্থাটা বুঝতে পারছি না তা নয়, কিন্তু —”
“বুঝতে পারছিস?” অত্রি সাগ্রহে প্রশ্ন করে, “সত্যি?”
“পারছি বৈকি,” নীরা ঠাণ্ডাভাবে বলে, “তবে এটাও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে বেশি বাড়াবাড়ি করাও কিন্তু ভাল নয়।”
“বাড়াবাড়ি?” অত্রি ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “বাড়াবাড়ি আবার কী দেখলি তুই?”
“বাড়াবাড়ি নয়?” নীরা গম্ভীরভাবে বলে, “আরে বাবা, মানছি প্রেমে পড়লে লোকের মাথা খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু তাই বলে এতটা? তুই কি শাহিদ কাপুর মনে করছিস নিজেকে?”
“আমি তো কিছুই —”
“হাবভাবটা তো সেরকমই তোর। ওই যে সিনেমাটা, কারিনা কাপুর ফারদিন খানের কাছে চলে গেছে বলে শাহিদ ওকেও মারল, নিজেও মরল। তাও যদি তোর শুচিস্মিতা কারিনা কাপুর হত।”
অত্রি একেবারে হাঁ হয়ে গিয়ে বলল, “শুচিস্মিতা?”
“এমনভাবে বলছিস যেন ওই নামে কাউকে চিনিসই না!”
“আশ্চর্য। চিনব না কেন? কিন্তু হঠাৎ শুচিস্মিতার কথা উঠছে কোত্থেকে? আর শাহিদ কাপুর-কারিনা কাপুররাই বা কোথা থেকে এল?”
নীরা একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, “তুই শুচিস্মিতার ব্যাপারে কথা বলতে আসিসনি? মানে ওর উপর রিভেঞ্জ নিতে — ”
অত্রি এতক্ষণ বিমূঢ়ভাবে তার দিকে তাকিয়েছিল, এবারে হো-হো করে হেসে উঠে বলল, “রিভেঞ্জ! তুই তাই ভেবেছিলি নাকি? উফ্, তুই না, সত্যি একটা জিনিয়াস! ওরে আমার কি আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই?”
নীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “যাক, বাঁচলাম।”
“ইন্ ফ্যাক্ট, শুচিস্মিতাকে আমার থ্যাঙ্কস বলা উচিৎ,” অত্রি হঠাৎ ভাবুক হয়ে যায়, “ওর সাথে কেসটা না ঘটলে তো আমি এই ব্যাপারটা ভাল করে বুঝতেই পারতাম না।”
“কোন ব্যাপারটা?”
“এই যে, যেটার ব্যাপারে বলতে এসেছি।”
নীরা এবারে দু-হাত শূন্যে ছুঁড়ে অধৈর্য্যভাবে বলে, “সেই ব্যাপার। এতক্ষণ ধরে ভ্যানতাড়া করে যাচ্ছিস, কিন্তু ব্যাপার যে কি সেটা আর বলার প্রয়োজন মনে করছিস না! আমার কি সময়ের কোনো দাম নেই, অ্যাঁ?”
“যাচ্চলে, তুইই তো এতক্ষণ ধরে শাহিদ কাপুর —”
“ফর গড্স সেক অত্রি, আবার শুরু করিসনা। কি বলতে চাস বলে ফেল ঝটপট।”
“হুঁ,” বলে এক চুমুকে কফি শেষ করে বড় এক শ্বাস ছাড়ল অত্রি। তারপর ভীষণ সিরিয়াস মুখ করে বলল, “আই অ্যাম ইন লাভ বুঝলি।”
নীরা খাবি খেয়ে বলল, “আ-বা-র?”
“আরে ধুর, শুচিস্মিতারটা কোনো ব্যাপারই ছিল না। ওটা একটা পাসিং ফ্যান্সি। এইটা একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিরিয়াস কেস।”
“বটে? তা অপর পার্টিরও কি একই মনোভাব? নাকি তারও শুচিস্মিতার মতো —”
“আরে পাগল নাকি! এ মেয়ে তেমন মেয়েই নয়। আমাকে খুব অপছন্দ করে বলেও মনে হয়না।”
“তাই? সে তো খুব আনন্দের কথা। তাহলে গিয়ে বল্। কী বলতে হবে সেটার পরামর্শ যদি চাস, তাহলে আগে —”
“বলা হয়ে গেছে তো।”
নীরা অবাক হয়ে বলে, “স্ট্রেঞ্জ! সবই যখন করে ফেলেছিস, তখন আর আমার কাজটা কি? এত ঘটা করে আমাকে এখানে ডেকে আনলি কেন?”
অত্রি কাঁচুমাচু মুখে বলে, “উত্তরটা জানার জন্য।”
নীরা মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, “মানে?”
“মানে প্রশ্নটা তো করলাম, এবার উত্তরটা দে!”
“আমি কিসের উত্তর দেব? তুই তো —” এই বলে নীরা হঠাৎ থেমে যায়। দেখে টেবিলের উপর আঙুলগুলো নাচাতে নাচাতে অত্রি মুচকি মুচকি হাসছে। প্রশ্নটা কার উদ্দেশ্যে? উত্তরই বা কে দেবে? নীরার মাথায় সব যেন কেমন জট্ পাকিয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ পরে কথা খুঁজে পেয়ে আমতা-আমতা করে বলল, “মানে ... তুই কি ...”
অত্রি হাসতে হাসতে বলল, “আরে হ্যাঁ রে বাবা, প্রশ্নটা তোকেই করেছি কিনা, তাই উত্তরটাও তুইই দিবি। আরও পরিষ্কার করে বলতে হবে? বেশ, উইল য়ু গো আউট উইথ মী? নে, হল? এবার বুঝেছিস? এতক্ষণ যা ভোম্বলের মতো মুখ করে বসেছিলি, আমি ভাবলাম বোধহয় জীবনে কোনোদিন বাংলা বুঝতে পারবি না।”
নীরা কিছুই না বলে অত্রির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
“কি হল রে? তুই আবার স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেন? কিছু বল্!” অত্রি ফিচেল হেসে বলল, “আমাকে পছন্দ না হলে স্বচ্ছন্দে বলতে পারিস, আমি তোর উপর রিভেঞ্জ নিতে উঠেপড়ে লাগব না কিন্তু!”
নীরা এতক্ষণে ক্ষীণ হেসে বলে, “না ... আসলে ব্যাপারটা একটু ...”
“মোটেই হঠাৎ নয়,” অত্রি বলে, “আমি তোর জায়গায় থাকলে ঢের আগেই বুঝে যেতাম।”
“যেতিস বুঝি?” নীরা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “আমি কিছুই টের পাইনি।”
“তা পাবি কি করে? আমার কোন কথাটাই বা মন দিয়ে শুনিস তুই?”
“এটা একদম বাজে কথা,” নীরা চটে গিয়ে বলে, “আমি তোর হাঁচিকাশিটাও মন দিয়ে শুনি। আমি তো কোন জন্ম থেকে তোকে... ইয়ে... মানে ওই আর কি...”
অত্রি হঠাৎ আরামের নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “যাক, তোরও তাহলে ‘ইয়ে-মানে-ইত্যাদি’ আছে তো?”
নীরা এবার হেসে ফেলে মাথা নাড়ে। তারও বেশ ফুরফুরে বোধ হচ্ছে এখন।
“বাঁচলাম। তুই একটা স্পষ্ট উত্তর দিতে যা ঝোলালি না নীরা, মাইরি বলছি হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত।”
“আসলে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।”
“তা ঠিক, বুঝতে গেলে তো ঘিলু লাগে।”
“ভাল হবে না অত্রি।”
“হে হে। রুদ্র বলছিল যে এতদিনেও যখন বুঝতে পারিসনি তখন নিশ্চয়ই ইন্টারেস্টেড নোস।”
“ওরে বাবা, রুদ্রকে নিয়ে নন্স্টপ বক্বকানি থামাবি তুই? এ যে দেখি প্রথম দিন থেকেই ত্রিকোণ প্রেমের গল্পে ঢুকে পড়লাম!”
“আচ্ছা বেশ, আর রুদ্রও না, শুচিস্মিতাও না। তো সব ভালোয় ভালোয় মিটে যাওয়ার আনন্দে আরেক রাউন্ড কফি হয়ে যাক?”
“হোক। সঙ্গে চকলেট পেস্ট্রি।”
“বাঃ, তোফা!”
(পরবাস-৭৪, ১১ জুন ২০১৯)