প্রথমে বোমার মত ফাটলেন ডক্টর গর্গ। যাঁর অন্য নাম হেলিকপ্টার। গেট আউট অব মাই ক্লাস!
শান্তশিষ্ট, হাসিখুশি ও ছোটখাটো একটি মানুষের এরকম ভয়ংকর রাগ দেখে ও বাজখাঁই গলা শুনে অনার্সের ছেলেমেয়েদের যাকে বলে কাপড়েচোপড়ে অবস্থা।
রাহুল খুবই ধীরে সুস্থে উঠে লেকচার থিয়েটারের লাস্ট রো থেকে আস্তে আস্তে নামতে শুরু করল। যদি ভদ্রলোক মত পালটান তো বসে যাবে।
গর্গ আরো জোরে হেঁকে কেসটা ফাইনাল করে দিলেন--অ্যান্ড নেভার কাম ব্যাক। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সী ইয়োর ফেস অ্যাগেন।
ফার্স্ট বেঞ্চে বসা ছটা মেয়ে এমনভাবে অধোবদন হয়েছে যেন রাহুলের কীর্তির জন্য পুরো ট্রাইবটাই দাগী হয়ে গেছে। কীর্তি মানে কিছু না, লাস্ট বেঞ্চে বসে কমিক্স বই পড়ার সুবিধে নিচ্ছিল রাহুল, হঠাৎ প্রচণ্ড হাসি পাওয়ায় হো হো করে হেসে ফেলে ধরা পড়ে গেছে। সংক্রামক ব্যাধির মত এখন সে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরোচ্ছে এবং ফার্স্ট-বেঞ্চবতীরা সরে সরে যাচ্ছে, যাতে ছোঁয়া না লেগে যায়। কেউ তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না।
রাহুলের অবশ্য খুব একটা ভয় করছিল না। কারণ গর্গকে সে ভালোই চেনে। অত্যন্ত ভালোমানুষ লোক। এ ধরনের মানুষ কোনো ছাত্রের ক্ষতি করে না। বাকি ছেলেমেয়েদের ভয় পাওয়ার কারণ তারা প্র্যাক্টিকালের খাতায় বিস্তর আঁকিবুকি করে এক একজন এক একটি স্বপ্নের গদি আগলে বসে আছে। গদির নীচে আকাশছোঁয়া নম্বরের আশা। যার গদি যত উঁচু, তার তত ভয়, পাছে কোনো শিক্ষকের কুনজরে পড়ে ইনটার্নাল অ্যাসেসমেন্টের নম্বরটা মার খেয়ে যায়। রাহুল আর গুল্লু গ্রোভার এমনিতেই পাবে সবচেয়ে কম--তাই তাদের ভয় কী? গুল্লু তো ক্লাসেই আসে না।
যেতে যেতে রাহুল সতীর্থদের অভিশাপ দিচ্ছিল--তোমাদের শিক্ষা ভণ্ডুল হোক। প্রয়োজনের সময় এই পদার্থবিদ্যা কিছুই স্মরণে আসবে না।
পরের দিন থেকে মণ্ডল কমিশনের সীট সংরক্ষণের বিরুদ্ধে সারা ইউনিভার্সিটি জুড়ে উচ্চবর্ণের ছাত্রদের বিক্ষোভ এবং অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত সব কলেজ বন্ধ।
তো অগাস্টের গোড়াতেই সেবছর স্ট্রাইক হয়ে সমস্ত ইউনিভার্সিটি বন্ধ। পুলিশ, মিছিল, হই হই কাণ্ড। রাতারাতি কারা যেন রাজনীতি-চেতন হয়ে উঠেছে। রাহুলদের ক্লাসে ঢুকে প্রফেসরকে বলল—মিছিলে ফাঁকি দিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন? দরজার গোড়ায় নতুন টাইম-টেবিল সাঁটা আছে দেখেননি?
প্রফেসর কাঁচুমাচু হয়ে বললেন—মিছিলের কিছু বুঝি না। আমি শুধু অঙ্ক করাই। তখন তারা নাক সিঁটকে বলে গেল—ক্লাস বন্ধ। বাড়ি গিয়ে হোমওয়ার্ক করুন।
বনমালীদের কলেজের হোস্টেলে বিহারী আর অ-বিহারী ছেলেদের দুটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী ছিল। তারা এই দুর্দিনে এক হয়ে গেছে। জুবিলি হলে রাত্রিবেলা মোমবাতির আগুনে জল্পনা কল্পনা, ষড়যন্ত্র। কয়েকটি ছেলে জামায় কেরোসিন ঢেলে শহিদ হয়েছে। তাদের কেউ বাঁচাতে যায়নি। কিন্তু এখন তাদের নাম পাথরে উৎকীর্ণ করা হবে। ক্রান্তি চক-এ হবে নাকি সেই শহিদ-মিনার। মস্কোর রেড স্কোয়ারের মতো প্রসিদ্ধ।
রাহুলদের সাথে রাস্তায় অঙ্ক স্যারের দেখা। উনি সাফ বলে দিলেন—তোমরা আমার পিছনে ঘুরো না হে। লুকিয়ে পড়াচ্ছি জানতে পারলে চশমা ভেঙে দেবে। দু-বছর পর রিটায়ার করছি, এখন আর ওসব ভাল্লাগে না। যাও না, মিছিলে যাও।
ক্লাসের কিছু পড়ুয়া মেয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছে। সারাদিনে একপাতা নোট নিতে পারেনি। প্রায় নি:শ্বাস না নিতে পারার মতো কষ্ট তাদের। রাহুলদের সামনেই নম্রতা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ফাইনালে এবার কি হবে স্যার? নিশ্চয়ই সেকেন্ড ডিভিশন পাব।
অংক স্যার উদাস হয়ে বললেন—ফাইনাল? ফাইনাল কি আর হবে? এ বছর বোধহয় তোমাদের পরীক্ষা ছাড়াই প্রোমোশন দিতে হবে।
হারু কলকাতা থেকে ফিরে নতুন উদ্যম নিয়ে ল কলেজে ঢুকেছিল। পড়াশোনার কোনো চাপ নেই দেখে সে সমস্ত উদ্যম সহ পলিটিক্সে নেমে গেল।
এরকমটা রাহুল চায়নি। এত বড় শাস্তি নিজের ইউনিভার্সিটিকে কেউ দিতে চায়? একে ওকে ডেকে একটা মণ্ডল-বিরোধী-বিরোধী দল খাড়া করারও চেষ্টা করল প্রথমদিন। শেষ পর্যন্ত সর্দারের মেয়ে তভলীন কাউর পান্না এসে তাকে খবরটা দিল। --তুই কি জানিস তোর নাম মেরিট লিস্টে উঠেছে?
কথাটা ভালো ঠেকল না। রাহুল জিজ্ঞেস করল—তার মানে?
--তোকে ধরে ঠ্যাঙাবে বিকেলবেলা। এক্ষুনি বাড়ি চলে যা। দুদিন আর মুখ দেখাসনি।
--কেন? আমায় ঠ্যাঙাবে কেন?
--পুরো ইউনিভার্সিটি জুড়ে প্রায় সবাই আপার কাস্ট। প্রফেসররাও তথৈবচ। এমনকী সর্দাররাও রিজার্ভেশানের বিপক্ষে। তুই কোন আক্কেলে উল্টোদিকে হাঁটছিস? তুই নিজেও তো ব্রাহ্মণ।
--আমি তো মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টে অন্যায় কিছু দেখছি না। যে কোটা ফিল হয় নি...।
--তোর পিটাই কারা করবে জানিস? জুবিলি হলের দুটো ভূমিহার ছেলে। ওরা কোটাতেই এসেছে। কিন্তু দিল্লীতে কেউ নিজের সারনেম ব্যবহার করে না। তাই কেউ ধরতে পারে না। এখন ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে সবাই আপার কাস্টদের দলে ভিড়ে গেছে। আরে আমি সর্দারনি হয়ে কোটা অপোজ করছি। আমাদেরও তো চাকরি চাই!
রাহুল ভাবছিল সুট করে কোনো হোস্টেলে ঢুকে লুকিয়ে পড়বে। তভলীন হাত তুলে বলল—দাঁড়া তোকে আমরা বাঁচাব।
মোটরসাইকেলে করে একটা ছফুট লম্বা খালসা কলেজের শিখ ছেলে যাচ্ছিল। তভলীন হাত দেখিয়ে তাকে থামিয়ে বলল—বস্, এই ছেলেটাকে ইউনিভার্সিটি থেকে বাইরে নিয়ে যেতে হবে/ ওকে অ্যান্টি-মণ্ডলরা মারবে।
--কমিউনিস্ট হ্যায় কেয়া?
--না, না। জোকর হ্যায়। নিকাল দে ইসে।
ছেলেটি হুস করে বাইক ঘুরিয়ে চলে গেল। একটু পরে যখন ফিরে এল তখন সঙ্গে আরেকটি সর্দার এবং একটি লাল মারুতি গাড়ি। রাহুলকে পিছনের সীটের তলায় শুইয়ে দেওয়া হল। উপরে তভলীন ও স্মিতা সোলাঙ্কি, যাকে ডাকা হত সিল্ক স্মিতা বলে। হু হু করে হংসরাজ কলেজের পাশ দিয়ে রাহুল পাচার হয়ে গেল।
রোশনারা বাগের কাছে রাহুল নেমে যেতে চাইছিল। ওরা বলল—নামার দরকার নেই, আমরা কনট প্লেস যাব, তোর বাড়ির তো কাছেই, তোকে নামিয়েই যাব।
বাড়িতে নেমে রাহুল টাটা করতে গিয়ে দেখে ওরাও সঙ্গে চলেছে। দরজা খুললেন রাহুলের মা। কী কারণে আজ অফিস যাওয়া হয়নি। রাহুলের সঙ্গে একটি লাল পাগড়ি পরা বলিষ্ঠ শিখ ও দুটি ততোধিক বলিষ্ঠ পাঞ্জাবী মেয়ে দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন—বাঃ তোর এত বন্ধু আছে জানতাম না তো!
তভলীন মিষ্টি করে বলল—চায় পিলাবেন তো আন্টি?
এরকম মিষ্টি কথা তভলীনের মুখে কখনো শোনেনি রাহুল। সে প্রমাদ গুণল এবং তড়িঘড়ি চা করতে ছুটল বাড়ি থেকে এই বদমাইশদের দূর করার জন্য। কিন্তু ফিরে এসে দেখে যা হবার হয়ে গেছে। রাহুলের মা ছলছলে চোখে তভলীন আর সিল্ক স্মিথার হাত ধরে বলছেন—আমার ছেলেটা একদম বোকা, তোমরা ওকে নিজেদের সঙ্গে রাখবে কথা দাও।
লাল পাগড়ি পরা টমি নামের সর্দার ছেলেটি দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বলল—রাহুলের প্রোবলেম কি জানেন? আপনারা ওকে কমিউনিস্ট করে দিয়েছেন। এরপর ও টেররিস্ট হয়ে যাবে।
রাহুলের মা আঁৎকে উঠে বললেন—না না, সব বাঙালিরা কমিউনিস্ট হয় না। আমরা তো প্রো-গভর্নমেন্ট।
টমি আরো দাঁত বের করে বলল—তভলীনের সঙ্গে বেশি থাকলে প্রো-খালিস্তান হয়ে যাবে। তবে তভলীন গুরু গোবিন্দ সিং-এর জন্মদিনে সোর্ডের খেলা দেখাবার পর ওকে সবাই ভয় পায়।
রাহুলের মা আশ্বস্ত হয়ে বললেন—খালিস্তানিই হোক। ও তভলীনের প্রোটেকশানে থাকুক। এটাই আমি চাই।
তভলীন-ও হাসিমুখে রাহুলের মা-কে বলল—আমি ওর চুলও বাঁকা হতে দেব না। যে ওর গায়ে হাত দেবে আমি তার হাত কেটে নেব। তারপর রাহুলের দিকে চেয়ে আরো হাসিমুখে বলল—যাঃ ছুটে গিয়ে দুটো বিস্কুট নিয়ে আয়।
পরে রাহুলের করুণ মুখ দেখে সিল্ক স্মিথার দয়া হয়েছিল এবং সে কনট প্লেসের নাম করে তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে গাত্রোত্থান করেছিল।
তারা যাবার পর রাহুলের মা বললেন—সমস্ত ঝামেলা না মিটে গেলে আমি তোকে আর কলেজে যেতে দেব না। তুই কথা না শুনলে এবার কিন্তু আমি একটা সাংঘাতিক কিছু করব।
রাহুল মাকে চা-টা খাইয়ে ঠান্ডা করে বলল—দুদিন বাড়িতেই থাকছি। ভালো পড়াশোনা হবে। কলেজ তো এমনিতেই বন্ধ।
রাহুলের মা চোখে জল এবং মুখে হাসি নিয়ে একটা ব্রাউন খাম এনে বললেন—আচ্ছা কে এই চিঠিটা দিয়েছে বলতো?
রাহুল খুলে দেখে তার মায়ের নামে টাইপ করা চিঠি। একটা মাদ্রাজি লোক তার মা-কে লিখেছে যে রাহুল তার ছাত্রীকে এমন ফিজিক্স পড়িয়েছে যে সে বায়োলজির পেপারেও ফিজিক্স লাগাতে গিয়ে শূন্য পাচ্ছে। এখন সমস্ত পদার্থবিদ্যা ভুলিয়ে আবার গোড়া থেকে ভিত গড়তে হবে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে রাহুলকে আগের দু-মাসের মাইনে ফেরত দিতে হবে নতুন গৃহশিক্ষকের বোনাস হিসেবে। নইলে তার বিরুদ্ধে মামলা আনা হতে পারে যা রাহুলের মায়ের মত একজন উচ্চপদস্থ সরকারী পদাধিকারীর সুনামের পক্ষে মোটেও স্বাস্থ্যকর হবে না।
রাহুল মায়ের চোখের সামনেই চিঠি ছিঁড়ে ময়লার টিনে ফেলে দিয়ে আসে।
দুদিন পরে ইউনিভার্সিটির মধ্যেই গর্গের সাথে মুখোমুখি। রাহুল বলল—হ্যালো স্যার, হাউ আর ইউ? গর্গ একগাল হাসলেন। বললেন—ভয় নেই, তুমি ক্লাসে এসো।
--হোয়াট ক্লাস স্যার? ওসব তো অনির্দিষ্টকাল বন্ধ।
--হ্যাঁ এখন তাই বটে।
--স্যার আপনি তো ব্রাহ্মিন, প্রো অ্যাজিটেশান তাই তো?
গর্গ চিন্তিত মুখে টাক চুলকোতে লাগলেন। রাহুল বলল—আমি অ্যান্টি। আমি চাই ক্লাস হোক। এসব গণ্ডগোল আমার একদম ভালো লাগে না। গর্গ বললেন—ওসব ছাড়ো। ক্লাসে তো তুমি গণ্ডগোলের রাজা। এখন বলছ পড়তে চাও। আমরাও পড়াতে চাই। কিন্তু ক্লাস নিতে গেলে ওরা এসে ভাঙচুর করবে।
রাহুলের মাথায় একটা আইডিয়া এল। --লুকিয়ে ক্লাস নিন না। আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাই চলুন। কাকপক্ষীতে টের পাবে না। শুধু আমরা যারা ফিজিক্সের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত, সেই সব ডেডিকেটেড ছাত্রছাত্রীরা... ।
--গুপ্তা তুমি নিজের সঙ্গে আমাকেও ডোবাতে চাও তো? তা হচ্ছে না। গুড লাক।
পরের সপ্তাহ থেকে কিন্তু তা-ই হল। ঘোষ, মুখার্জি, গর্গ আর কচরু, চারজনের চারটে আন্ডারগ্রাউন্ড ক্লাস। গোটা ছয়েক একস্ট্রা চেয়ার স্মাগল করে এনে ক্লাসগুলো শুরু হল ঘোষের নিজস্ব ঘরেই। জানলার কাঁচে পঞ্চাশ বছরের ধুলো, তায় তাকের উপর ফিজিকাল রিভিউ ডি-র অসংখ্য কপি ডাঁই করে রাখা। বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। ঘরটি বড় এবং সূর্যের আলো প্রায় ঢোকে না বললেই চলে। সারাক্ষণ একটা একশো ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে রাখতে হয়।
থিওরির স্পেশাল ক্লাস—সাকুল্যে আটজন ছাত্র। ছজন ফিমেল, দুটি ছেলে। মেয়েরা মেধাবী এবং স্টুডিয়াস। রাহুল বাদে অন্য ছেলেটি বঙ্গ-বিহারী, অর্থাৎ রাঁচির বাঙালি—সে সারা-রাত হস্টেলে কী গুল খিলায় তা খোদায় জানে। সকালের থিওরির ক্লাসটায় সে আসে ঘুমোতে। কেউ আসার আগেই এসে পিছনের একটা সীট-এর দখল নেয় ও সারাক্ষণ ঘাড় ঝুলিয়ে ঝিমোয়। ঘোষ ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন না এবং চোখেও কম দেখেন, ফলে শুভ্রকান্তি পালিতের কোনো অসুবিধে হয় না।
শুভ্রর পর বাকিরাও এক এক জন করে এসে স্যুট করে ঘরে ঢুকে পড়ে। শিক্ষক এলে ক্লাস শুরু হয়। নিজের আরামচেয়ারে বসে গেজ থিওরির রহস্য বোঝাতে গিয়ে ঘোষ আত্মহারা হয়ে বললেন—তোমরা জানো বিবেকানন্দ বলেছিলেন—বহুরূপে সম্মুখে তোমার... ? এটাও ঠিক তাই। যেভাবেই রূপান্তর করো, পদার্থ হল ঈশ্বরের মত, এক ও অভিন্ন। একেই বলে গেজ ইনভারিয়েন্স।
রাহুল তো গণ্ডগোলের রাজা, তার কাজই হল ক্লাসটা বেলাইনে নিয়ে গিয়ে স্টুডিয়াস মেয়েদের যথাসম্ভব চটিয়ে দেওয়া। সে হাত তুলে বলল—স্যার বিবেকানন্দ তো কাস্টও মানতেন না, কাস্টটাকে উড়িয়ে দিলে কি থাকে, সেই গেজ ইনভারিয়েন্ট মানুষ, তাই তো?
--হ্যাঁ, তাতে আর সন্দেহ কী?
--কিন্তু চাকরির বাজারটা গেজ ইনভারিয়েন্ট নয় লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই। প্রফেসাররা সবাই আপার কাস্ট। ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরাও বেশিরভাগ তাই।
--হ্যাঁ তাই। ঘোষ ঘাড় নেড়ে মেনে নিলেন এবং অপরাধীর মত মাথা হেঁট করে বললেন—খুবই ঠিক কথা বলেছ। অথচ তুমি দলিতও নও। তুমি অ্যান্টি-অ্যাজিটেশান?
মধু বিষনোই বেশ হাসিখুশি ভালোমানুষ গোছের মেয়ে। সে বলল—স্যার, রাহুল তো নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে অ্যান্টি।
শবনম বলল—আমার আন্সেসটাররা দলিত ছিল। কিন্তু মুসলিম হবার পর আমাদের আর কোনো কোটা নেই। তাই আমিও প্রো-অ্যাজিটেশান। রাহুল আঙুল তুলে বলল—আমার স্বার্থ অত ন্যারো নয়। ফেয়ার সোসাইটি হোক এটাও আমার একটা স্বার্থ।
--ফেয়ার সোসাইটি ধুয়ে তুমি চাকরি পাবে? জিজ্ঞেস করল সপনা কুলকর্ণী।
--তার চেয়ে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি মাখ রোজ। উপদেশ দিল মধু। --নিজেকে ফেয়ার করে তোল, সমাজ আপনা থেকেই লাভলি হয়ে যাবে। বিয়েও হয়ে যাবে ভালো ঘরে। মা তো এটাই শিখিয়েছে আমায়।
বাকি মেয়েরা উশখুশ করতে শুরু করল। নোট নেবার সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। কেই একজন চাপা গলায় বলল—ব্যাটা আবার ইনকিলাব শুরু করেছে। কান ধরে বসা। রাহুল আম্বেদকার থেকে একটা উদ্ধৃতি দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ভীষণ জোরে ফোঁৎ ফোঁৎ আওয়াজ। শুভ্রকান্তি ভয়ংকরভাবে নাক ডাকাতে শুরু করেছে। মেয়েরা মাথায় হাত দিয়ে বসল। রাধিকা স্বামীনাথন ঘোষকে চ্যালেঞ্জ করে বলল—স্যার এই দুটো ছেলেকে আপনি বার করে দিচ্ছেন না কেন? এরা কী কন্ট্রিবিউট করছে?
মধু বিষনোই বলল—বার করলে অ্যান্টি মণ্ডলদের গিয়ে বলে দেবে না ক্লাস হচ্ছে? সব ভণ্ডুল করে দেবে।
হঠাৎ শুভ্রকান্তি পালিত নড়ে চড়ে উঠে বলল—ওরা অলরেডি জানে।
সবাই অবাক! -–কে, কী জানে?
দেখা গেল শুভ্রকান্তি নাক ডাকাতে ডাকাতেই সব শোনে এবং মনে রাখে। সে বলল—অ্যান্টি মণ্ডলরা ভালো করেই জানে এ ঘরে ক্লাস হচ্ছে।
--অ্যাঁ!
--ভয়ের কিছু নেই। ওরা কিছু বলবে না।
--তুই কী করে জানলি?
--প্রত্যেক দিন রাতে হস্টেলে মিটিং হয়। সেখানেই তো পরের দিনের কর্মসূচি তৈরি করে। আমি থাকি সেখানে।
--জেগে না ঘুমিয়ে? জিজ্ঞেস করা হল পালিতকে। পালিত সেটা অগ্রাহ্য করে বলল—বাইরে স্বীকার না করলেও, ইউনিভার্সিটির কিছু কিছু ক্লাস হোক, এটা অ্যান্টি-মণ্ডল-কমিশন কমিটি সমর্থন করে। থিওরির স্পেশাল ক্লাসটা তার মধ্যে পড়ে।
প্রফেসার ঘোষ উদ্ভাসিত মুখে বললেন—সত্যি! ওরা ফিজিক্সকে এতটা মর্যাদা দেয়? কোনোদিন বুঝতে পারিনি তো!
দাড়ি চুলকে পালিত বলল—এই ক্লাসে সবাই আপার কাস্ট তো? তার উপরে থিওরির পুরো ডিপার্টমেন্ট আপার কাস্টে ভর্তি। এখানে যারা ঢুকেছে তারা ইউজিসি-র পি-এইচ-ডি করার স্কলারশিপ ছাড়া আর কোনো সরকারী চাকরিতে কমপিটও করে না। ফলে অ্যাজিটেশানের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই। বরং কিছু ছেলেমেয়ে থিওরির লাইনে চলে গেলে বাকি সব আসল চাকরিগুলোতে কম্পিটিশান কমে যেতে পারে। তাই কমিটি ডিসাইড করেছে যে এই লাইনে গাড়ি চলতে থাকলে সকলেরই লাভ।
সপনা কুলকর্ণী খিঁচিয়ে উঠে বলল—কী করে ওরা বুঝল আমরা কেউ সরকারী চাকরি পাব না?
পালিত নির্বিকার ভাবে বলল—তোকে আর আমাকে নিয়ে ওদের একটু ডাউট ছিল, কারণ আমরা থিওরিটা ঝোলাচ্ছি। রাহুল বর্ডারলাইন কেস। তো জানা গেল তোদের মেশিন পার্টসের ডিস্ট্রিবিউশান আছে, জনতা আমলে তোদের ফ্যামিলির এগেন্সটে সি-বি-আইয়ের কোরাপশান কেসও ছিল, কংগ্রেস আসার পরে তুলে নেয়। তুই চাকরি করবি কেন? আমাদের রাঁচিতে ছটা কেমিস্টের দোকান আছে, আমারও লাগবে না। আর রাহুলকে আমি ম্যানেজ করে দিয়েছি, বলেছি ও শুধু থিওরি নয়, সব পরীক্ষাতেই বর্ডারলাইনের নীচে থাকবে, কোথাও কিছু পাবে না।
--ওঃ, তুই-ই ক্লাসটাকে বাঁচিয়ে দিলি তার মানে। কী ভালো ছেলে দ্যাখো। সপনা ব্যঙ্গ করে বলল।
--কেন করব না? এই ক্লাসটা আমার খুব ভালো লাগে। এই বলে পালিত আবার চোখ বুজল।
রাহুল গণ্ডগোল করবে কী, হঠাৎ দেখে সকলের মুখ ব্যাজার, কারোই আর পড়াশোনায় মন নেই। বলা নেই কওয়া নেই ঘোষ মাথা নাড়িয়ে হো হো করে হেসে উঠেই কী প্রসঙ্গে কে জানে—কোথায় তুমি বেটে, কোথায় তুমি সলপেটার বলে আক্ষেপ করতে শুরু করলেন।
মধু বিষনোই রাহুলকে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করল—কী বলছে রে? বেটে বলছে কাকে?
রাহুল বলল—ছেলে নেই বলে দুঃখ আর কি। তিন মেয়ে তো। সব পি-এইইচ-ডি করছে পাঁচ-দশ বছর ধরে, বিয়ে হচ্ছে না বোধহয়।
ক্লাসে মধুই একমাত্র হাসিখুশি মেয়ে ছিল। এখন সেও প্রচণ্ড গোমড়া মুখ করে অন্য দিকে ফিরে বসে রইল।
রাহুলের ডায়েরি থেকেঃ
“একটু সকাল সকাল কলেজে যাব বলে বেরোচ্ছি, মা পলিথিনে মোড়া একটা টিফিনের কৌটো জোর করে হাতে ধরিয়ে দিল। কী আছে জিজ্ঞেস করায় বলল—দ্যাখ কিছু চন্দ্রপুলি বানিয়েছিলাম। তুই কয়েকটা নিয়ে যা। তভলীনকে দিস।
হাসব না কাঁদব? মা এমন কিছু ভালো রাঁধুনে নয়, যদিও সব রকম খাবারই তৈরি করার চেষ্টা করে বেচারা। এগুলো কাকভোরে উঠে বানিয়েছে কষ্ট করে, এখন তভলীনকে খাওয়াতে হবে, যাতে সে আমাকে তার প্রোটেকশানে রাখে!
নিয়ে তো যেতেই হবে। মন্দ কী? আমি আর বনমালী কফি-হাউসে বসে দুপুরবেলা সাঁটাবো।
--তুই চিন্তা করিস না। ফ্রিজে তোর জন্য অনেক থাকবে। বলল মা।
--চামচ দিয়েছ? জিজ্ঞেস করলাম।
--ন্যাপকিনও দিয়েছি। বিজয়গর্বে বলল মা।
মাকে আর এই মুহূর্তে বললাম না যে শুভ্রকান্তি পালিতের দয়ায় এখন আমাকে হোস্টেলের ভূমিহার ছেলেরা গোবেচারা এবং তাদের সংঘর্ষের অনুকূল বলেই মনে করে।
মা বলল—আচ্ছা তোর এই টিউশানিগুলো করার কি দরকার আছে? হাতখরচ তো আমি ভালোই দিই। বাবা নেই বলে কি তোর কোনো অভাব দেখেছিস?
আমি বললাম—তোমার ছেলে হয়ে টাকার জন্য উঞ্ছবৃত্তি করব নাকি? কখনো হতে পারে? কলেজের ছেলেমেয়েরা বরং আমার কাছে টাকা ধার করতে আসে। মাঝে মাঝে ফেরতও নিই না। যাকে দেবার হাত খুলে দিই। কিন্তু তুমি জানো না মা, থিওরেটিকাল ফিজিক্সের ছেলেমেয়েদের কী রকম ডিমান্ড! লোকে পারলে বেঁধে নিয়ে যায়।
--তাই তো হওয়া উচিত। কিন্তু তোকে কখনো আমাদের মত চাকরি করতে হবে না। তুই পড়াশোনা নিয়েই থাক। এই বলে সন্তুষ্ট মুখে মা দরজা থেকে টা-টা করে দিল ...।”
ছাত্রদের কাছে এ এক মজার খেলা। রাহুলদের মধ্যে জলধর রাজনীতি বুঝত। এইসব মিছিল-ফিছিল দেখলে নির্ঘাৎ বিষম চটে যেত সে। তাকে নিয়ে একটা ঝামেলা হতে পারত। জলধরের ভাই এদিকে টিনের ড্রামের উপর উঠে বক্তৃতা দেয়।
বনমালী একদিন এসে উপস্থিত রাহুলদের কলেজে। রাহুলকে গম্ভীরভাবে বলল—ধর্ম করবি? রাহুল ভেবে পায় না হঠাৎ ধর্ম করবে কেন। বনমালী বোঝায়। কেউ ধর্ম করতে বললে রাজনীতি আর রাজনীতি করতে বললে ধর্ম করার ইচ্ছে হয় আমার। এখন সবাই বলে মিছিলে যেতে। তাই ইচ্ছে করে শান্তিনিকেতনে গিয়ে গুরুদেবকে দেখে আসি।
রবীন্দ্রনাথ? জিজ্ঞেস করে রাহুল।
--সে গুরুদেব কি আর এখনো আছেন? কবে সব লেখাটেখা শেষ করে পাঁচ ভূতে বিলীন।
—তাহলে আর গুরুদেব কে? কোনো ফিল্ম স্টার নাকি?
—না। বনমালী গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলে। ঋষিকেশই আমাদের শান্তিনিকেতন। বাড়ির কাছে, পাহাড় নদীর কূলে, আরণ্যক পরিবেশ। ওইখানে একটা ইউনিভার্সিটি আচ্ছে, জানিস তো? গুরুকুল ইউনিভার্সিটি। কোনো স্ট্রাইক নেই, রাজনীতি নেই। বেদ-উপনিষদ পড়ানো হয়।
--সেখানেই গুরুদেব?
—কাউকে না কাউকে ঠিক পেয়ে যাব। এবছরে দিল্লীতে আর কিছু শেখা হবে না সেটা তো পরিষ্কার। ওখানে গেলে ধর মেটাফিজিক্যাল কিছু প্রশ্নের জবাব পেয়ে যেতে পারি।
প্রশ্নগুলো কি আর জিজ্ঞেস করার সময় পায়নি রাহুল। তার আগেই ব্যক্তিগত জীবনে আরেকটি ঝামেলা। যেরকম ঝামেলা চিরকাল জীবনের গতি নির্ধারণ করে। রাহুলের জীবনে যে পর পর এরকম ক্রাইসিস আসতে থাকবে সেকথা এক শখের জ্যোতিষীও বলেছিলেন—ক্রাইসিস তোমার ফুরোবে না। যতদিন না বিয়ে করছ বা মরছ, হুইচএভার কামস্ ফার্স্ট।
শুনে রাহুল মুচকি হেসেছিল। বিয়ে তখন তার ঠিকঠাক একটা হয়েই যাবে ভাবত সে। এই নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। পলাশদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত। অন্য মেয়েরাও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করে।
এখন আবার উল্টোটা ভাবে। জলধরের মতো হঠাৎ দুম করে মরে যাওয়াও অসম্ভব নয়। বাড়িতে আর যারা আছে তারা এই ধাক্কা সামলাতে পারবে না, তাই বনমালীর সাথে কথা হয়ে আছে। কিছু হলে সৎকার থেকে শ্রাদ্ধ পর্যন্ত সবই সে করবে। বনমালীর কিছু হলে রাহুল। এসব জিনিস আগেভাগে ঠিক করে রাখাই ভালো।
কারণ তভলীনের এত করার পরেও স্ট্রাইকের মাঝামাঝি একদিন ইউনিভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায় প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক ইউনিয়নের ছেলেরা রাহুলের তলপেটে নখ দিয়ে দাগ কেটে দিল। অর্থাৎ ওই দাগ বরাবর ছুরি দিয়ে কাটা হবে। পরে, হাতে সময় নিয়ে সার্জনরা এসব করবে। এখন রাহুল বসে বসে দিন গুনুক।
বনমালী তখন ধারে-কাছে ছিল না। হারু, শ্যামল, কেউ নয়। জুবিলি হলের সুরেশ পোদ্দার আর তিনটে বিহা্রী ছেলে বাঁচিয়েছিল রাহুলকে। কিন্তু এইভাবে বাঁচা আবার বাঁচা? সারাক্ষণ ঘাড়ের উপর খাঁড়া ঝুলছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে পিছন থেকে অ্যাম্বাসাডার গাড়ি চাপা দিতে আসে। লাফিয়ে ফুটপাথে উঠে বেঁচেছিল রাহুল। একের পর এক ক্রাইসিস!
—চল ঋষিকেশেই যাই। আজই যেতে রাজি আছি। বনমালীকে গিয়ে ধরল শেষপর্যন্ত রাহুল। এখনই নিয়ে চল। গুরুকুলে আয়ুর্বেদ পড়ব। ওষুধ বানানো শিখব।
বনমালী বলল—হঠাৎ?
রাহুল বলল—এই পোড়া শহরে আর ভাল্লাগে না। অ্যাসাসিনেশন অ্যাটেম্প হচ্ছে।
বনমালী বলল—পুরো ঘটনাটা বল।
আসলে রাহুলেরও একটু দোষ ছিল। রাশিয়া থেকে এক বাস ভর্তি চ্যাংড়া-চিংড়ি এসেছে কি জানি কি ধরনের সংস্কৃতি বানাতে। দুপুরে তারা খাবে বলে ইউনিভার্সিটির ক্যাফে থেকে দুজন রিডার, একজন কলেজের অধ্যাপককে তুলে দেওয়া হচ্ছে চেয়ার টেবিল থেকে। ইউনিয়নের নেতা, একজন উঠতি রাজনৈতিক গুণ্ডা পুরোভাগে থেকে মুসাবিদা করছে। রাহুলের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের কান অপমানে লাল। চুপ করে থাকাই নিয়ম। রাহুল পাকামো করে বলতে গেল—রাশিয়ার অবস্থা খুব খারাপ, তাদের জন্য এতটা না করলেই নয়? জাপান হলে আলাদা কথা ছিল।
গুণ্ডারা যে আঁতে ঘা-লাগানো কথা সহ্য করতে পারে না তৎক্ষণাৎ হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছিল রাহুল। পেটের কাপড় তুলে বনমালীকে দাগটা দেখাতে হলো। মারকিউরোক্রোম লাগানো। ব্লাডারের উপর দিয়েই গেছে। বনমালী দেখতে দেখতে উজবুকের মতো হাঁ। সম্ভবত জলধরের পেটের সেলাইয়ের কথা মনে পড়ে গেছে।
সেবার হাওয়া এমনই গরম, কেউ বনমালী-রাহুলের সাথে যেতে রাজি হলো না। এমনকী রোগাপটকা হারুও একদিন কফিহাউসে ওদের সঙ্গে দু-মিনিট কথা বলেই ভীষণ বোর হয়েছে এমন ভাব দেখিয়ে বলল—চল দুটো পুলিশ পেঁদিয়ে আসি।
বনমালী হাসি চেপে বলল—দিল্লী পুলিশ আমার ভালো লাগে না। ঋষিকেশে গিয়ে মনের সুখে ইউপি কনস্টাবুলারির লোক পেঁদাবি তো চ।
হারু তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল। আইটিও-তে নাকি বিরাট প্রদর্শন আছে। ছাত্রদের শো অফ স্ট্রেংথ। ভি-পি সিং-এর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হবে। সিআরপিএফ টিয়ার গ্যাস চার্জ করতে পারে। দেরি করে ফেললে মজাটাই মাটি।
হারুরা চলে গেলে বনমালী আর রাহুল ঠান্ডা কফির দাম আর চার-আনা টিপ্স দিতে গিয়ে দেখল কফিহাউসের পিছনের দরজা দিয়ে ছাই রঙ আর হলুদ রঙের শালোয়ার কামিজ পরে দুজন ঢুকছে। শ্যামলী আর কৃষ্ণা। রাহুলের কাছে এখন দুইই সমান।
কৃষ্ণা হই হই করে বলল—রাহুল তুই বেঁচে আছিস? তোকে নাকি মার্ডার করবে বলেছে?
শ্যামলীর দিকে রাহুল আর বনমালী খুব সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকায়। রাহুল মুখে আঙুল দিয়ে বলে—শ-শ-শ-শ। অমনি কৃষ্ণারও মুখে আঙুল। ফিসফিস করে বলে—কি হয়েছিল বল না! প্লিজ বল!
রাহুল জানে এখন যদি সে সকলের সামনে পেটের কাপড় তোলে, শ্যামলী অত্যন্ত বিরক্ত, অপমানিত হবে। সত্যিকারের মৃত্যুভয় এসব মেয়েদের নেই। সম্ভ্রম থাকলেই হলো। মনে মনে সে ভাবে কৃষ্ণার পেটে আঙুল দিয়ে লাইন টেনে দেখাবে। তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে নাইকুণ্ডলীতে সলিড খোঁচা মেরে বলবে—বুল’স আই-টা নাড়ার নিচে থাকে না উপরে?
কিন্তু বনমালী রাহুলকে কাঁধ দিয়ে আড়াল করে দেয়। শ্যামলীকে জিজ্ঞেস করে—তোরা ভিড় বাড়াতে যাচ্ছিস না?
—কোথায় যাব?
শ্যামলী আর কৃষ্ণা আদৌ জানে না কোথায় কার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হচ্ছে। রাহুলদের চেয়েও কম রাজনীতি বোঝে দেখা গেল। কৃষ্ণা বলল—দ্যাখ আমরা তো কোনো খবরই পাই না। ক্লাস ক্যানসেল হয়ে গেছে বলে কফি খেয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছিলাম। তোরা যাচ্ছিস নাকি কোথাও? আমি যেতে রাজি আছি।
বনমালী খুব গম্ভীর হয়ে বলে—দেশের অবস্থা খুব খারাপ। চারদিকে কি হচ্ছে টের পাস না?
কৃষ্ণা কাঁচুমাচু হয়ে বলে—পাই। কিন্তু কাকে সাপোর্ট করব বুঝতে পারি না। আসলে এত দলাদলি আমার ভালো লাগে না। আচ্ছা বলত এই ভি-পি সিং লোকটা ভালো না খারাপ?
বনমালী দাড়ি চুলকে বলে—এখন একটা রি-অ্যাালাইনমেন্ট অফ ফোর্সেস হচ্ছে, বুঝলি? ভালো-খারাপ বলে কিছু নেই। বল “কার পক্ষে ভালো?” এনিওয়ে তোর বয়ফ্রেন্ড কাকে সাপোর্ট করছে?
—আমার কোনো বিএফ নেই। চটপট জবাব দেয় কৃষ্ণা।
—ম্যাথামেটিক্সের বিহারী ছেলেটা?
—জাস্ট এ ফ্রেন্ড।
রাহুল অন্যমনে পেটের ঘা চুলকোচ্ছিল। শ্যামলীর সাথে চোখাচোখি হতেই হাত চালানো বন্ধ। সমস্ত কাট-অফ হয়ে গিয়েও বুক গুড়গুড় করে। সে যদি দিল্লীতেই থেকে যায়? মার্ডার হয়? লাশ ভয়ে ছোঁবে না শ্যামলী। কিন্তু দূর থেকে তার জ্বলন্ত চিতার সামনে দাঁড়িয়ে হয়তো ক্ষমা চাইবে বিড়বিড় করে। অতি অবশ্যই ক্ষমা করে দেবে রাহুল।
বনমালী কফিহাউসের কাউন্টার থেকে মৌরি তুলে নিতে নিতে বলে—কৃষ্ণা, পলিটিক্সটা ছেলেখেলা নয়। জীবনমরণের ব্যাপার। নিজে যদি ভেবে ঠিক না করতে পারিস তাহলে একটা গুরু ধর।
—গুরু পাব কোথায়? সবাই কনফিউস্ড। শ্যামলীও ঠিক বোঝে না। আসছে বছর নাকি ইলেকশন হতে পারে। কাকে ভোট দেব কিচ্ছু জানি না।
—বরই হলো তোদের গুরু বুঝেছিস? বিজ্ঞের মতো মৌরি চিবোতে চিবোতে উপদেশ দেয় বনমালী। সিনিয়র, বরিষ্ঠ পতি ইজ পরম গুরু। সে যাকে ভোট দেবে তোরাও তাকে চোখ বুজে দিয়ে দিবি।
রাহুল দেখতে পায় শ্যামলী আবার অসম্ভব চটে গেছে। কিন্তু কৃষ্ণা খিক-খিক করে হেসে বলে—এক বছরের মধ্যে বর জোটাব কোত্থেকে? বিএফই নেই। আমার মা আর বাবা কিন্তু অপোসিট পার্টিকে ভোট দেয়। সিরিয়াসলি বলছি—দে ডু ইট অন পারপাস।
শ্যামলী দাঁতে দাঁত চেপে বলে—আমাদের ভবিষ্যতের ব্যবস্থা তোকে করতে হবে না বনমালী, তুই নিজের জন্য কোনো গুরু জোটাতে পারিস কিনা দ্যাখ।
—প্রিসাইজলি। বলে চওড়া হেসে আস্তে আস্তে কফিহাউস থেকে বেরিয়ে যায় বনমালী। সবাই অবাক। কৃষ্ণা ফিস-ফিস করে জিগ্যেস করে—রাগ করল নাকি? রাহুল এমন একটা ভঙ্গি করে যার মানে—হতেও পারে, নাও হতে পারে।
তারপর সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন। দূরপাল্লার বাসে দীর্ঘদিনের মতো মালপত্তর, রসদ তুলে রাহুল আর বনমালী দিল্লীর পটভূমিকা থেকে অপসৃত। দেখতে দেখতে কেটে যায় একমাস, দেড়মাস। দিল্লীতে শরতের রোদে কাঁচা হলুদের রঙ। সিংহের চোখের মতো।
একদিন স্কুটারে চেপে দেবনাথ সমাদ্দার আর শ্যামলী রাহুলদের বাড়িতে। রাহুলের মা দরজা খুলে শ্যামলীকে চিনতে পারলেন। লাজুক হাসছে শ্যামলী। হাত জোড় করে নমস্কার করছে দেবনাথ সমাদ্দার। বিয়ের নেমন্তন্ন করতে তারা নিজেরাই এসেছে।
বাইরের ঘরে তাদের বসিয়ে কাজুর হালুয়া খাওয়ালেন রাহুলের মা। মুখটি তাঁর লাল। একবার চোখও ছলছল করে উঠল।
—সে তো তার বন্ধুর সাথে আজ দুমাস প্রায় দিল্লী-ছাড়া।
—কোনো খোঁজখবর নেই? গম্ভীরভাবে জিগ্যেস করে দেবনাথ সমাদ্দার।
—আশ্চর্য দায়িত্বজ্ঞানহীন তো! শ্যামলী ভীষণ বিরক্ত বোধ করে। আপনার খোঁজখবর নেয় না একটুও?
—একটা ফোন নাম্বার দিয়ে রেখেছে। দরকার হলে সেখানে ফোন করতে বলেছে। সেটা কোথাকার, কার ফোন তাও জানি না। কোনোদিন করিওনি। অভিমান করে বললেন রাহুলের মা। —আমার বুড়ো ভাই তো আছে। দরকারে তাকেই ডাকব।
দেবনাথ সমাদ্দার ভীষণ বিব্রত বোধ করে। শ্যামলীর মনে হয় রাহুলকে হাতের কাছে পেলে পিটিয়ে ছাতু করে দেয়। নিজেকে কী মনে করে ও?
রাহুলের মা বলেন—বাবা নেই। মায়ের কথা শোনে না। ছেলেটা একেবারেই হাতের বাইরে চলে গেছে।
দেবনাথ সমাদ্দার নিজের একটা কার্ড বের করে। —কোনো দরকারে আমাকে ফোন করতে দ্বিধা করবেন না। বেশি দূরে থাকি না। স্কুটার আছে। চট করে চলে আসতে পারব।
শ্যামলী রাহুলের মায়ের হাত ধরে আশ্বাস দেয়—রাহুলটা কিছুদিন বাইরে থাকলেও আমরা তো দিল্লীতে আছি।
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)