নদীর নাম বরাক। উপত্যকার নামও তাই। বরাক নদী-বিধৌত দক্ষিণ অসমের সমতল তিনটি জেলা নিয়ে বরাক উপত্যকা। তিন দিকে দুর্গম পাহাড় ঘেরা এই বরাক উপত্যকা একটি অবরুদ্ধ জনপদ। বরাকবাসী লালন করছে তাঁদের নিজস্ব আচার-সংস্কার। ঐতিহ্যকে মহিমান্বিত করার এই প্রবণতা বরাকের সাহিত্যেও পরিলক্ষিত। বরাক উপত্যকার লেখিকা মেঘমালা দে মহন্ত ভালোবাসেন জীবনকে, তাঁর চারপাশের দেখা মানুষজনকে। অসম্ভব নিবিড়তায় জড়িয়ে ধরেন নিজের সৃষ্টিতে। এটাই শিল্পী হিসেবে তাঁর জীবনদর্শন। সমাজের নানা শ্রেণির মানুষ তাঁদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না নিয়ে হাজির হয়েছে মেঘমালার ভাবনার আকাশে। বর্ণিল সেই আকাশে শহর ও গ্রামের পরিশীলিত চিন্তনের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে প্রান্তীয় মনন। গল্পকারের সন্ধানী দৃষ্টির সঙ্গে আমরাও পথ চলতে থাকি তাঁর আঠারোটি গল্পের সংকলন— ‘অন্তর্গত রক্তের ভেতর’-এ।
রাজনৈতিক চাতুরী, সামাজিক অস্থিরতা, ভাষিক আগ্রাসন, কঠোর জীবনসংগ্রাম ও বিভিন্ন দুর্যোগপূর্ণ সময়ের প্রতিবেদন বরাকের সাম্প্রতিক বাংলা ছোটোগল্প। অসমের বর্তমান অস্থির সময়, অভিবাসন সমস্যা অসমবাসী বাঙালিজীবনে অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস। সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটবে — স্বাভাবিক। ছিন্নমূল অসহায় মানুষ — যারা এতদিন এই ভারত ভূখণ্ডেই বসবাস করে এসেছেন বংশ পরম্পরায়, বাংলা তথা ভারতবর্ষের সংস্কৃতিকে লালন পালন করেছেন — স্বাধীনতা অর্জনের জন্য রক্ত ঝরিয়েছেন — তারপর কলমের এক আঁচড়ে ভারত ভূখণ্ডেই চোদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে রাতারাতি প্রাণ আর নারীর সম্ভ্রম বাঁচাতে চলে এসেছেন ঈশান কোণের পাহাড়ে জঙ্গলে ঘেরা অসমে। মাতৃভূমির এই ভূখণ্ডকেও ভালোবেসেছেন তাঁরা — কারণ এই অংশের স্বাধীনতা অর্জনও তো তাঁদের আত্মত্যাগে সম্ভব হয়েছে। সেইসব মানুষদের আজ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। কোন নির্দিষ্ট তারিখে বাসভূমি পরিবর্তন করেছিলেন সেই তারিখটির প্রমাণপত্র সংগ্রহ করতে তাঁদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন অনেকে। আসন্ন নাগরিক পঞ্জিকরণ নিয়ে শহরের মানুষের প্রতিক্রিয়ার ছবি ‘কাগজের স্বদেশ’ গল্পটি। যেখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এই কথাটি — ‘মাঝারি স্তরে বেঁচে থাকা মানুষগুলোরই প্রয়োজন ক্রমাগত অবস্থান পাল্টে পাল্টে এগিয়ে যাবার।’ এনআরসি গ্রামবাসীদের মনে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করল তারই আভাস রয়েছে ‘তাবিজ’ গল্পে। গ্রামজীবনের এই আত্মপরিচয়ের সংকট ও তার ফলশ্রুতি সুচারুভাবে পাঠ করেছেন মেঘমালা দে মহন্ত।
বরাক উপত্যকার চা-বাগান নির্ভর জীবনের মূল্যবোধ কৃষিভিত্তিক সমাজের থেকে ভিন্ন। শোষণ, বঞ্চনা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, দারিদ্রজর্জর চা-বাগান শ্রমিকদের জীবনের পটভূমিতে লেখা হয়েছে বেশ কিছু উত্কৃষ্ট গল্প। রুজি রোজগারের আশায় চা বাগান ছেড়ে বর্তমান প্রজন্মের শহরে চলে যাওয়া এবং তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া নানা সমস্যা জায়গা করে নিয়েছে ছোটো গল্পে। জীবনধারণের জন্য ব্যাঙ্গালুরু চলে আসা পরিযায়ী নিখিলেশ, সিধুয়া ও সাবিনা-কে নিয়ে একটি ত্রিমাত্রিক গল্প ‘ঘরে ফেরার গল্প’।
আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের ফলে গত আড়াই-তিন দশকে গ্রামের লোকেদের মানসিকতায় এসেছে নানা পরিবর্তন। নগর ও গ্রামের সম্পর্কে তৈরি হয়েছে নানা জটিলতা। নিম্নবিত্তের সংসারে বিবর্ণ নগ্ন বাস্তব আর তার প্রতিচ্ছবি, যন্ত্রণা আর ক্ষুধার অনুপ্রবেশ আটকানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে সামাজিক ভব্যতা আর কোলাহল মানুষকে করেছে বিধ্বস্ত এবং এর মধ্যে এই গল্পকার তাঁর গল্পের পৃথিবীতে এইসব অন্ধকার আর আলো, কোলাহল আর নৈঃশব্দ্য-নির্জনতার মুখোমুখি যেমন দাঁড়িয়েছেন তেমনই তাঁর পাঠককেও এনে দাঁড় করিয়েছেন এই বাস্তব ভূমিতে।
আধুনিক প্রযুক্তি বিজ্ঞান, পরাবাস্তব, কল্পবাস্তবের মিশ্রণ ও আধুনিকোত্তর প্রাকরণিক বিন্যাসে বরাক উপত্যকার সাম্প্রতিক বাংলা ছোটোগল্প, বাংলা সাহিত্যের মূলধারার বাংলা ছোটোগল্পের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে বিশ্ব পুঁজিবাদ পণ্যসর্বস্বতায় সমস্ত কিছু ঢেকে দিতে চাইলেও অনন্বয় ও অসামঞ্জস্যের ছবি দ্রষ্টা চক্ষুকে ফাঁকি দিতে পারে না। ঝাঁ চকচকে মহানাগরিক বৈভবের সঙ্গে মনুষ্যত্বহীন আপাতসভ্য জীবনের নিঃস্বতাকে স্পষ্ট করে ‘আকাশপ্রদীপ’ গল্পটি।
বরাক উপত্যকার সাম্প্রতিক বাংলা ছোটো গল্প ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের শৈল্পিক দর্পণ, যার মধ্যে ধরা পড়ে মনোযোগী লেখকের স্বতন্ত্র মনোজগৎ ও সময়ের স্বতন্ত্র স্বর। বরাকের জনজীবন শুধু শহর গ্রাম বা নদীর পারে প্রবাহিত নয়, সে প্রবাহিত ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত হওয়া রেললাইন আর রেলকলোনিতেও। পুরোনোকে উপড়ে ফেলে নতুনের দিকে যাত্রা করেছে সভ্যতা। ট্রেন চলাচল কিছুদিন বন্ধ রেখে শিলচরে এসেছে ব্রডগেজের শক্তিশালী ট্রেন নতুন আশা, নতুন কৌশল নিয়ে। ব্রডগেজ শুরু হওয়ায় পুরোনো পড়ে থাকে অবহেলা আর অমর্যাদায়। পরিবর্তনের পালে হাওয়া লেগে কী পেলাম আর কী হারালাম ‘স্বপ্নকথা’ সেই কথা বলে। নতুনকে জায়গা দিতে পুরোনোর হারিয়ে যাওয়া। কিছুকাল পূর্বে যা ছিল বর্তমান, আজ তা ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনের ‘স্বপ্নকথা’।
মেঘমালার গল্পে জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠে আসে একটা সযত্নে পালিত আম্রপালি গাছ--যার সদ্য কাটা ডালে শ্মশানে দাহ করা হয়েছে তার মানুষ পিতাকে। এক তরুণী জীবনের কলেজস্মৃতির অর্জুন গাছ যে কয়েক দশক ধরে সাক্ষী থেকেছে প্রণয়ীযুগলের বলা না-বলা কথার। হয়তো এক সংবেদনশীল গৃহবধূ একদিন এই অর্জুন গাছের স্মৃতিতে তার সুখী বিবাহিত জীবনকে পাশ কাটিয়ে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াবে অন্য এক দেবদারু গাছের নীচে। এরাও কথা বলে। আর মেঘমালার পাঠক এইসব মূক প্রকৃতির কথা শুনতে পান।
বাংলা সাহিত্যের সাধারণ চরিত্র বরাক অঞ্চলের গল্পেও বর্তমান। প্রতিটি অঞ্চল নিজ নিজ অভিজ্ঞতায় স্বতন্ত্র। স্থান-কালের বিশিষ্টতায় বরাক উপত্যকার গল্পে ধরা পড়তে থাকে আলাদা এক মনোজগৎ। একই সময়ে থেকেও এ অঞ্চলের গল্পকাররা স্থানিক পরিসরের ভিন্ন জীবন অভিজ্ঞতায় সময়বোধের ও কথন বিশ্বের নতুন নতুন অবয়ব তৈরি করেছেন। তবে শুধু অঞ্চলগত স্বতন্ত্রে সীমাবদ্ধ নয় এ অঞ্চলের গল্প। স্বতন্ত্র পরিসর ও স্বতন্ত্র সময়ের স্বর বজায় রেখে মেঘমালার গল্পে উঠে এসেছে মনস্তাত্বিক চিন্তাভাবনা, তীব্র মননশীলতা, এবং জীবনকে দেখার বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি। মেঘমালা অনুভূতিপ্রবণ। তাই তাঁর ‘অন্তর্গত রক্তের ভেতর’ গল্পে উঠে আসে এক সদ্য ঋতুমতী কন্যা এবং এর সমান্তরালে তার মায়ের আবার রজঃস্বলা হবার ইচ্ছে। নারীজীবন বৃত্তের ছিন্ন চিত্রাবলী সমস্ত সত্যকে নিয়ে এখানে সোচ্চার।
আমাদের উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যে বাঙালির জীবন, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাঙালির জীবন থেকে কিছুটা আলাদা। এই অঞ্চলে মিজো, নাগা, মনিপুরী, ত্রিপুরী, অসমিয়া নানা জাতি-উপজাতির বসবাস। এইসব ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালী, সমাজব্যবস্থা, এত বিচিত্র যে বাঙালি লেখকরা তাঁদের মধ্যে নতুন এক ভুবন দেখতে পান। আর সেই নতুন ভুবনকে তুলে ধরেন তাঁদের সৃষ্টিকর্মে। মেঘমালার ‘লাইসাম্ফি’ গল্পেও উঠে এল জিরি নদীর তীরে সিংজু গ্রামে বসবাসকারী মনিপুরী সমাজের কথা।
‘খেত বাঁধার গল্প অথবা পঞ্চানন হিরালির জীবন বৃত্তান্ত’ এক হিরালির গল্প — যারা গ্রাম্য কুসংস্কারকে সম্বল করে কৃষিভূমিকে বেঁধে দেয় মন্ত্র পড়ে। কালবৈশাখী বা শিলাবৃষ্টি বা ঝড়ে শস্যপূর্ণ খেতের ফসল নষ্ট হবে না এই বিশ্বাসে সবাই হিরালিদের কাছে যায়। এইসব গুণিন ঘুরে বেড়ায় চা-বাগান ঘেরা হাওর তীরের এক-একটা দ্বীপের মতো গ্রামে। কাঁধে থাকে গামছা। ঝুরিনামা প্রাচীন বটের মতো বেঁচে থাকা অবৈজ্ঞানিক বৃত্তিগুলি আজকের যুবাদের কাছে অবিশ্বাস বা তাচ্ছিল্য পায়। একদিন নিশ্চয়ই চার-পাঁচ পুরুষের হিরালিরা মন্ত্রের জোরে লাল গামছা কাঁধে দাপিয়ে বেড়িয়েছে আশপাশের বিশ-পঁচিশটা গ্রাম। গ্রামবাসীরা সসম্ভ্রমে ছেড়ে দিয়েছে পথ। তাদেরই শেষ উত্তরপুরুষ শেষ চৈত্রে কালবৈশাখীকে আটকে রাখলে যখন জ্বর গায়ে অন্ধকার আকাশের নীচে আসে তখন তার সুদূর অতীতের ভুলতে না পারা বাল্য প্রণয়িনী নোনা রঙের কাঁখে ভাসতে থাকে বাতাসে।
খাসি সমাজের বিশ্বাস-সংস্কার-আচার-রীতিনীতি শব্দ খুঁজে পেয়েছে ‘থলেন ও ভালোবাসার অর্কিড’ গল্পে। বাণিজ্যিক সংবাদ চ্যানেলের অর্ধসত্যের রহস্য রোমাঞ্চের চাহিদা মেটাতে গিয়ে আয়ান খাসিদের সহজ সরল সুন্দর জীবনযাত্রা থেকে ভালোবাসার পাঠ নিয়ে ফিরল। এই গল্পে উঠে এসেছে সাপ পুজো সহ খাসি সমাজের নানা বিশ্বাস ও রীতিনীতির প্রসঙ্গ — ‘আসলে এই সারল্যের সুযোগ সন্ধানীদের প্রতিহত করতেই বোধহয় রীতিনীতির মোড়ক।’ খাসি সমাজে বাড়ির কর্ত্রী মহিলা। কিন্তু সেই কর্ত্রী এবং গোটা পরিবারের রক্ষাকর্তা পুরুষ। নারী পুরুষের পরিপূরকের ভূমিকাতেই চলে এই সমাজ। খাসি সমাজ মাতৃপ্রধান। ‘এরা একা বাঁচতেই জানে না। গোটা গ্রাম তাদের বিশ্বাস, রীতিনীতি নিয়ে প্রকৃতিতে একাত্ম হয়ে বেঁচে থাকে।’ এক অদ্ভুত ভালোলাগার আলো ছড়িয়ে দিল এই গল্পটি।
বর্তমান সংকলনটি বিশেষ কোনো একটি ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যাপিত জীবনের বাস্তবভূমি, ভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশ, বিভিন্ন জাতি উপজাতির লোকজন, পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ও তাদের জীবনবিন্যাস মেঘমালার গল্পের বিষয়। সমসাময়িক জীবনের জটিলতা, মানব চরিত্রের স্ববিরোধিতা — এসবই মেঘমালার গল্পে উঠে এসেছে মরমী দক্ষতায়। ছোটগল্পের এই সংকলন আসলে বরাকের এক আয়না।