• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৪ | অক্টোবর ২০২১ | গল্প
    Share
  • অসমাপ্ত : গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য


    ছাই রঙের আকাশ থেকে কুয়াশার চেয়েও হাল্কা বৃষ্টি নেমে আসছে।

    ঘাটের সিঁড়িগুলো নিঃশব্দে ভিজে চলেছে। সিঁড়ির ধার ক্ষয়ে গেছে, তার ওপর বৃষ্টির জল পড়ে পিছল। যাত্রীরা তাই সন্তর্পণে পা টিপে টিপে নামছে। শেষের কয়েকটা ধাপ আবার ঘোলা জলের ঘূর্ণিতে ঢাকা। শুধু মাঝেমাঝে তারা কচ্ছপের পিঠের মতো জলের তলা থেকে উঁকি দিচ্ছে।

    ঘাটে বাঁধা নৌকোটা ঢেউয়ের তালে দুলে দুলে উঠছে। কয়েকজন যাত্রী সেটা অগ্রাহ্য করেই বগলে বোঁচকা আর ছাতা চেপে ধরে লাফিয়ে উঠে পড়ল। কুকুরগুলো এদিক-ওদিক পাথরের নীচে আশ্রয় নিয়েছে। শুধু ঘাটে বসে থাকা সাধু আর ভিখিরিদের কোন হেলদোল নেই।

    লান-ইং বলে মেয়েটি তার ছাতাটা ঘোরাতে ঘোরাতে এসব লক্ষ্য করছিল। তার পরনে নীল-সাদা রুচেন, হাতে জেডের চুড়ি, মাথায় রেশমের রুমাল – ঠিক যেন ধূসর আকাশের পটভূমিতে কেউ ছবি এঁকে রেখেছে।

    রওনা দেওয়ার পক্ষে এর চেয়ে বাজে দিন আর হতে পারে না...

    সে বুঝতে পারে না এই দিনটাতেই কেন তাকে যেতে বলা হল। বা এই জায়গাটা থেকেই কেন শুরু করতে হল। কারণ কিছু একটা আছে ঠিকই। শি ওয়াংমুর জগতে এমনি এমনি কিছু ঘটে না। সবাইকে তার নির্দিষ্ট পথে হেঁটে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যেতে হয়। ইচ্ছার স্বাধীনতা এখানে মায়া ছাড়া কিছু নয়।

    একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে লান-ইং তার সুন্দর জুতোর ডগাটা ভিজে পাথরে ঠেকাল। অনিচ্ছাভরে। মুহূর্তে তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল।

    অসম্ভব...

    একজন সন্ন্যাসী ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। সেটা অসম্ভব কিছু না। নদীর ধারের এই ছোট্ট গ্রামটাই উত্তরের পর্বতে পৌঁছনোর একমাত্র রাস্তা। অসংখ্য সাধু-সন্ন্যাসী তাই নিত্য এই পথে যাতায়াত করে। কিন্তু এই সন্ন্যাসী তো...

    চুলে পাক ধরেছে, মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে, কিন্তু আজও সেই চোখ...

    অসম্ভব...

    সন্ন্যাসীর কাঁধ ছাপিয়ে লান-ইংএর দৃষ্টি দূরে, বহু দূরে চলে গেল, যেখানে আকাশ আর নদী মিশে একাকার হয়ে গেছে।

    অতীত আর বর্তমান পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে কিরকম অনুভূতি হওয়ার কথা?

    আকাশের মেঘ গর্জন করে উঠল। লান-ইংএর চোখে কৌতুক ঝিলিক দিল।

    .............................................

    শি ওয়াংমুর বাগানে 'তার' জন্ম। সেটা ছিল অনন্তের দেশ; সেখানে বসন্ত নিশ্চল, আর গোধূলির আলো কখনো ম্লান হয় না। তখন 'তার' নামও ছিল না, শরীরও ছিল না; সুখও ছিল না, দুঃখও ছিল না; শুধু নিজের পূর্ণতার অনুভূতিতে পরিপূর্ণ ছিল 'সে'।

    তারপর একদিন শি ওয়াংমু 'তাকে' ডেকে পাঠাল। রোগে, দারিদ্র্যেও, বিপর্যয়ে পৃথিবী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 'তাকে' সেখানে যেতে হবে। মানুষকে আশা দিতে, মানুষের সেবা করতে।

    মায়ের যত্নে শি ওয়াংমু 'তাকে' শরীর দিয়ে সাজিয়ে দিল। চিন্তা করার ক্ষমতা দিল। কথা বলার ক্ষমতা দিল। কারণ মানুষ এই পোশাকআশাক দেখেই পরস্পরকে চেনে, পোশাকের ভেতরের স্বরূপটা দেখতে পায় না। শেষে পোশাকের ওপর আরেকটা পোশাক চাপিয়ে দেওয়া হল — যাকে বলা হয় 'নাম'। শি ওয়াংমু 'তার' নাম দিল 'শিউহুয়া', মানে 'সুন্দর ফুল'।

    মহামারী রাজ্যে বিকট আকার নিয়েছে। প্রতিদিন শয়ে শয়ে মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে। 'সবুজ ড্রাগন' পাহাড়ের এক মঠের সন্ন্যাসীরা প্রাণপণে অসুস্থের সেবা করছে, দু'বেলার খাবারের জোগান দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রকৃতির তাণ্ডবলীলার সামনে তারা অসহায়। ক্রমশ তাদের মনোবল ভেঙে পড়ছে। ঠিক হল, সেখান থেকেই শিউহুয়ার কাজ আরম্ভ হবে।

    এক গ্রীষ্মের দুপুরে শিউহুয়াকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হল। শিউহুয়া দেখল সে একটা সুন্দর গ্রামে এসেছে, তার পাশ দিয়ে কুলকুল করে নদী বয়ে চলেছে। মাটির পথ দূরে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। এক পাশে কুঁড়েঘরের সারি, তার একটার থেকে কান্নার রোল ভেসে আসছে। একজন সন্ন্যাসী নদীতে হাত ধুচ্ছিলেন। শিউহুয়া তাড়াতাড়ি সেদিকে এগিয়ে গেল।

    “সবুজ ড্রাগন পাহাড়ের মঠে যাওয়ার পথ কি এটাই?”

    সন্ন্যাসী শিউহুয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালেন।

    “হ্যাঁ, এটাই। আমার সঙ্গে এস, আমি ওখানেই যাচ্ছি।”

    শিউহুয়া সন্ন্যাসীর পেছন পেছন রওনা দিল।

    “তুমি কি আমাদের গুরুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?” সন্ন্যাসী মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। “আগে তো তোমাকে এ গ্রামে দেখিনি...”

    “আমার বাড়ি অনেক দূরে। আমি খবর পেয়েছি সবুজ ড্রাগন পাহাড়ের মঠের সন্ন্যাসীরা মহামারীর সঙ্গে একা হাতে লড়াই করছে। তাই আমি এখানে এসেছি, রোগীর শুশ্রূষায় সাহায্য করার জন্যে।”

    সন্ন্যাসীর দৃষ্টিতে নতুন সম্ভ্রম দেখা গেল।

    “তাহলে তুমি চুয়েনের সঙ্গে দেখা কর। সে-ই গুরুর আদেশে চিকিৎসার তদারকি করছে।”

    কিছুদূর এগিয়ে শিউহুয়া দেখতে পেল পাহাড়ের গায়ে বসানো একটা ছোট্ট মঠ। সন্ন্যাসী জানালেন ওটাই তাদের গন্তব্য। পাহাড় বেয়ে খানিকটা উঠেই তার দরজা। চারধারে পাথরের দেওয়াল। ভেতরে চৌকোনা উঠোন, একটা মন্দির আর কয়েকটা নীচু পাথরের ঘর। তারই একটায় সন্ন্যাসী ঢুকে গেলেন। একটু পরেই বেরিয়ে এলেন, সঙ্গে আরেকজন তরুণ। মুণ্ডিতকেশ, সুশ্রী মুখ, শান্ত দৃষ্টি।

    “এই হল চুয়েন, যার কথা তোমাকে বলেছি,” সন্ন্যাসী পরিচয় করিয়ে দিলেন।

    শিউহুয়াকে দেখে তরুণ জোড়হাতে বলল,

    “তোমার আসা আমাদের জন্য ভগবান বুদ্ধের আশীর্বাদের চেয়ে কম নয়। আমরা এই মহামারীর সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত, বিশেষত মহিলা আর প্রসূতিদের চিকিৎসা আমাদের দ্বারা একেবারেই অসম্ভব। তুমি এই গ্রামের মহিলাদের ভার নিজের হাতে তুলে নাও। এ বিষয়ে তোমার কিছু জ্ঞান আছে তো?”

    “কোন চিন্তা করো না। তোমরা কি পদ্ধতিতে কাজ করছ সেটা শুধু আমাকে দেখিয়ে দাও।” সন্ন্যাসী চুয়েনের মুখে স্মিত হাসি ফুটল।

    “নিশ্চয়ই...তোমাকে কি নামে ডাকব?”

    “শিউহুয়া...”

    সেই থেকে কাজ শুরু।

    মঠের বেশিরভাগ সন্ন্যাসীরা অন্যান্য গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে চিকিৎসার জন্য। শিউহুয়া আর চুয়েন মিলেই তাই বাড়ি বাড়ি যায়, পাহাড়ের ঢালে ভেষজ খোঁজে, ওষুধ বানায়। কেউ মারা গেলে চুয়েন তার আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করে, আর শিউহুয়া শোকার্ত আত্মীয়দের সান্ত্বনা দেয়, নতুন করে বাঁচার আশা জোগায়।

    সন্ধে নামলে চুয়েন নদীর জলে নেমে বিষাক্ত জীবাণুগুলোকে শরীর থেকে ধুয়ে ফেলে। তারপর দুজন পারে বসে গল্প করে। মূলত চুয়েনই গল্প করে, আর শিউহুয়া শোনে। সারাদিনের কাজের গল্প, চুয়েনের ছোটবেলার গল্প, জীবনের নানা উপলব্ধির গল্প। শিউহুয়া জানতে পারে চুয়েন ছিল ধনী বংশের ছেলে। সারাদিন তাদের বাড়িতে গরীব দুঃখীর আনাগোনা লেগে থাকত। কপাল ভালো থাকলে কারুর চাল জুটে যেত, নাহলে শুকনো মুখেই ফিরে যেতে হত। যেদিন চুয়েন বাড়ি ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়েছিল, ব্রত নিয়েছিল সাধ্য থাকলে কোন ভিক্ষার্থীকে নিরাশ করবে না।

    এরকম নানান গল্পে সময় চলে যায়। তারপর আকাশে যখন একটা দুটো তারা ফুটে ওঠে, চুয়েন তখন মঠে ফিরে যায়। আর শিউহুয়া শুয়ে পড়ে চাঁদ-তারা দিয়ে সাজানো অনন্ত চাদরের নীচে।

    ঋতুর বদলের সঙ্গে বদলে যাওয়া এই পৃথিবীতে এসে শিউহুয়ার ভারী অদ্ভুত লাগে। বসন্তের ফুল আর গ্রীষ্মের পাতা, শরতের চাঁদ আর শীতের বরফ – সবই ক্ষণিকের, বারবার ছবিটা বদলে যায়। আজ যারা আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কাল আর তাদের কোন অস্তিত্ব থাকে না। শিউহুয়ার চেনা জগতের সঙ্গে এ জগতের কোন মিলই নেই।

    এ জগতের মানুষ আবার তাদের ছোট ছোট নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নিয়েছে। কত রকম সম্পর্ক তাদের - বাবা, মা, স্বামী, স্ত্রী, সন্তান...সারাদিন যে যেখানেই থাক, দিনের শেষে সবাই এক বাড়িতে এসে আশ্রয় নেয়। একসঙ্গে রাতের খাবার খায়। শিউহুয়া শুধু প্রদীপের শিখায় তাদের অবয়বগুলো দেখতে পায়। তার পরিবার নেই, তাই সেইসব অন্তরঙ্গ মুহূর্তে প্রবেশের অধিকারও তার নেই। চুয়েন মঠে ফিরে যাওয়ার পরের এই সময়টায় তাই তার বড্ড একা লাগে।

    চুয়েন আর আমি দু'জনেই গ্রামের প্রান্তে থাকি। দু'জনেই একা। আমরা কি এক পরিবারের সদস্য হতে পারি না?

    পৃথিবীটা তাহলে আরো কত সুন্দর হয়ে উঠত!

    কিন্তু চুয়েনের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।

    সময়ের চাকা নিজের ছন্দে ঘুরতে থাকে। ধীরে ধীরে মহামারীর প্রকোপ কমে যায়। শিউহুয়া বুঝতে পারে এখানে তার কাজ শেষ হয়ে আসছে। তবু সে গ্রামটা ছেড়ে চলে যেতে পারে না।

    আজ নতুন বছর। সূর্য ডুবে গেছে কখন। গ্রামের সবাই যে যার পরিবারের সঙ্গে আনন্দ করছে, একে অপরকে নানান উপহার দিচ্ছে। শিউহুয়ার কথা আর কার মনে আছে?

    জমে যাওয়া নদীর ধার দিয়ে আনমনে বরফ ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই শিউহুয়া তাকিয়ে দেখে চুয়েন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শিউহুয়া কাছে যেতে তার হাতে এক বাক্স আপেল আর একটা লাল রঙের খাম দিয়ে হাসিমুখে বলল,

    “আজ নতুন বছর, তোমার জন্য ক'টা উপহার এনেছি।”

    শিউহুয়ার চোখে অপার বিষ্ময় ফুটে ওঠে। “সত্যি? আমার জন্য?”

    চুয়েন হাসে।

    “সত্যি। আজ কিন্তু তুমি নদীর ধারে বসে থেকো না। আরেকটু পরেই বাজি ফাটানো হবে। অনেক দিন পরে একটা শুভ অনুষ্ঠান হচ্ছে, গ্রামের সবাই আজ জমিয়ে আনন্দ করবে।”

    শিউহুয়া মাথা নাড়ে।

    “সবাই যে যার পরিবারের সঙ্গে আনন্দ করবে। আমি গিয়ে কি করব? তবে তুমি যদি সঙ্গে থাক তাহলে যেতে পারি।”

    চুয়েন একটু ইতস্তত করে বলল, “ঠিক আছে, কিছুক্ষণ থাকব।”

    দু'জনে গ্রামের পথ ধরল। শিউহুয়া সকাল থেকেই দেখেছে বাড়িতে বাড়িতে লাল কাপড় ঝুলছে, কেউ কেউ দরজায় ভগবানের ছবি লাগিয়েছে। এখন দেখে রকমারি লন্ঠনও জ্বালানো হয়েছে। একটু পরেই আতসবাজির আলো আর আওয়াজ দিয়ে নিয়ান নামক সিংহকে ভয় দেখানো হবে।

    রাস্তায় যার সঙ্গেই দেখা হল চুয়েন আর শিউহুয়ার হাতে হরেকরকম খাবার দিয়ে গেল — মিষ্টি বানরুটি, মাছ, পিঠে, কত কী! চুয়েনের মন ভালো আছে বোঝা যায় — সবার সঙ্গে মজা করল, হাসির গল্প বলল, বাচ্চাদের আদর করল। তারপর গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে দু'জনে পাহাড়ের পথ ধরল। একসঙ্গে মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করল। চুয়েন শিউহুয়াকে তার গুরুর কাছে নিয়ে গেল। বৃদ্ধ সাধক তাকে অনেক আশীর্বাদ করলেন।

    “আজকের দিনটা এত সুন্দর করে তোলার জন্য ধন্যবাদ,” গ্রামে ফেরার আগে চুয়েন শিউহুয়াকে বলল।

    “তোমাকেও ধন্যবাদ...”

    সারা আকাশ ততক্ষণে তারায় তারায় ভরে গেছে।

    তারপর পনেরো দিন কেটে গেছে। নতুন বছরের উৎসব শেষ হয়ে লন্ঠনের উৎসবের দিন এসে পড়েছে। চুয়েন আবার প্রাণপণে মানুষের সেবায় লেগে গেছে। কিন্তু শিউহুয়া বুঝতে পারে তার হাতে আর সময় নেই।

    চুয়েন এখনো সত্যটাকে স্বীকার করছে না কেন?

    সে নতুন বছরে শিউহুয়ার জন্যে উপহার এনেছিল, তার সঙ্গে একটা গোটা সন্ধে কাটিয়েছিল। তার মানে এই জগতের নিয়ম অনুযায়ী সে শিউহুয়াকে নিজের পরিবারের সদস্য বলেই মনে করে। শিউহুয়ার সঙ্গে সংসার করতে চায়। তবু সে কেন নিজের চার ধারে মিথ্যের জাল বুনে চলেছে?

    আসলে চুয়েন তো জানে না আমার ফেরার সময় হয়ে গেছে, শিউহুয়া মনে মনে ভাবে। সে হয়তো ভাবছে এখনো সবকিছু আগের মতোই চলবে।

    সময় শেষ হয়ে যাওয়ার আগে শিউহুয়াকেই চুয়েনের সামনে সত্যের আয়নাটা তুলে ধরতে হবে। দিন শেষ হলে শিউহুয়া নদীর ধারে চলে গেল, যেখানে চুয়েন রোজ মঠে ফেরার আগে হাত-পা ধুয়ে নেয়। আলতো গলায় ডাকল,

    “চুয়েন...”

    শিউহুয়ার কন্ঠস্বরে চুয়েন ফিরে তাকাল।

    “শিউহুয়া? কিছু বলবে?”

    শিউহুয়া নদীর দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল।

    “মনে আছে, তুমি একদিন বলেছিলে তোমার কাছে প্রার্থনা করে কেউ নিরাশ হয় না।” চুয়েন অবাক হয়ে বলল,

    “হ্যাঁ...সেরকমই আমার ব্রত। নিতান্ত অসাধ্য না হলে আমি কাউকে ফিরিয়ে দিই না।”

    “তাহলে আজ আমাকে নিরাশ কোরো না।”

    চুয়েন নদী থেকে উঠে এল।

    “তুমি আমার কাছে কিছু চাইতে এসেছ?” চুয়েন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল। “কী চাও তুমি?”

    শিউহুয়ার ঠোঁটের হাসিতে রহস্য খেলা করছে। সে আরো কয়েক পা এগিয়ে একেবারে চুয়েনের কাছাকাছি চলে এল। বিদায়ী সূর্যের আলো দু'জনের গালেই গোলাপি আভা ছড়িয়ে দিল।

    “তোমার চোখের ওই শান্ত দৃষ্টি আমার চাই,” রেশমের মতো মোলায়েম গলায় শিউহুয়া বলল। “আমার ঠোঁটের ওপর তোমার ঠোঁটের স্পর্শ চাই। তোমার এই সুন্দর রূপ, যা শি ওয়াংমু শুধু আমার জন্যেই বানিয়েছে, তাকে আপন করে নিতে চাই। আমাকে নিরাশ করো না, সন্ন্যাসী।”

    এক মুহূর্তের জন্যে চুয়েন যেন পাথর হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই শিউরে উঠে দূরে সরে গেল, যেন কোন বিষধর সাপ দেখতে পেয়েছে।

    “এসব কী বলছ? জান না আমি ব্রহ্মচর্য ব্রত নিয়েছি?”

    শিউহুয়া অধৈর্যভাবে মাথা নেড়ে উঠল।

    “পৃথিবীর নিয়মে নিজেকে বেঁধে রেখো না, চুয়েন। এই জগতের বাইরে মহাজগতের একটা নিয়ম আছে। সনাতন কাল ধরে নারী পুরুষ সেই নিয়মে বাঁধা। পৃথিবী আর আকাশ, আলো আর অন্ধকার, ইন আর ইয়াং — সবকিছু সেই নিয়মের বশবর্তী। তুমিও তার থেকে মুক্ত নও। ভেবে দেখো, কেন তুমি আমাকে নতুন বছরে উপহার দিয়েছ? নিকট আত্মীয়ের মতো কেন আমার সঙ্গে সারা সন্ধে কাটিয়েছ? আমাকে তুমি কামনা কর সে কথা স্বীকার করতে কোন লজ্জা নেই!”

    চুয়েনের মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এল।

    “তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ, শিউহুয়া। তোমাকে আমি উপহার দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু তা শুধুই আমার গুরুর আদেশে। আর তোমার সঙ্গে সন্ধে কাটিয়েছি তোমার একাকিত্ব দেখে, অনুকম্পাবশত। আমাকে ক্ষমা করো শিউহুয়া। আমার এই দৃষ্টি শুধু ভগবান বুদ্ধকে দর্শন করার জন্য, আমার ঠোঁটের কাজ শুধু তাঁর বাণী উচ্চারণ করা। নারীর ছায়া স্পর্শ করাও আমার জন্য পাপ।”

    “মিথ্যে বলছ, সন্ন্যাসী।” শিউহুয়া হেসে উঠল। “তোমার স্বরূপ আমার থেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। তোমার চোখের দৃষ্টি আমাকে সব বলে দিয়েছে। এই নদীর ধারেই বসে গল্প করার সময়ে। দিনের পর দিন। আমাকে ঠকাতে পারবে না তুমি!”

    চুয়েনের কান রক্তিম হয়ে উঠল। শিউহুয়ার হাসি গাঢ়তর, ক্রূরতর হতে থাকল। সে হাসি কোন মানুষের হাসি নয়। সেদিকে তাকিয়ে চুয়েনের চোখ ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল। সহসা সে শিউহুয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।

    “এখান থেকে যাও, শিউহুয়া। তোমার এই মনুষ্যত্বহীন রূপ আমি সহ্য করতে পারছি না। তুমি যা চাইছ তা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।”

    শিউহুয়া থমকে গেল। সে বুঝতে পারল না, কল্পনায় যে মুহূর্তকে তার চূড়ান্ত জয়ের মুহূর্ত বলে ভেবে এসেছিল, তা কিভাবে তীব্র পরাজয়ে পরিণত হয়ে গেল।

    “চুয়েন...”

    “দয়া করে আর কিছু বোলো না...”

    সূর্য ডুবে গেছে। চারিদিকে ছাই রঙের সন্ধে নেমে গেছে। শিউহুয়া গ্রামের দিকে ঘুরল। তার বুকের মধ্যে কি চলছে সে নিজেও জানে না। যন্ত্রণা? লজ্জা? অনুতাপ? ধীরে ধীরে সে সবও চলে গিয়ে শুধুই একটা বিশাল শূন্যতা পড়ে রইল।

    “ক্ষমা করো আমাকে...”

    “দাঁড়াও।”

    চুয়েনের ডাকে শিউহুয়া ফিরে তাকাল।

    “তুমি ঠিকই বলেছিলে। আমার কাছে প্রার্থনা করে কেউ নিরাশ হয় না। তুমিও হবে না। আমার দৃষ্টি, আমার ঠোঁট, সব কিছু আজ থেকে তোমার হল।”

    বিদ্যুৎবেগে কোমরের তলোয়ারটা বের করে চুয়েন তার ঘাড়ে বসিয়ে দিল। দেহচ্যুত হয়ে তার মাথাটা গড়িয়ে এল শিউহুয়ার পায়ের কাছে। তার নিষ্প্রাণ চোখের দৃষ্টি চিরকালের জন্যে নিবদ্ধ রইল শিউহুয়ার ওপর।


    ..............................................

    “আমি পারব না...”

    “তোমার কাজ এখনো শেষ হয়নি। ওঠো, নতুন পোশাক পরো।”

    “না, না...দয়া করো আমাকে...”

    “বোকা মেয়ে! কর্তব্য থেকে কারুর নিস্তার নেই।”

    অগত্যা 'সে' জেগে ওঠে। নতুন পোশাক পরে। নতুন নাম নেয়। কর্তব্য করতে বেরোয়। বার বার।

    'তার' চলার কোন শেষ নেই।

    কিন্তু মানুষের সঙ্গে নিজের নিয়তিকে জড়ানোর ভুল আর 'সে' করে না। 'সে' মানুষের সেবা করে, মানুষকে আশা জোগায়, আবার নিজের পথে চলতে থাকে। 'সে' জানে তার বৃত্তের সঙ্গে মানুষের বৃত্তের মিলন শুধুই অভিশাপ ডেকে আনে।

    একা...আমাকে একাই চলতে হবে...এটাই আমার প্রায়শ্চিত্ত।

    চলতে চলতে একদিন 'সে' পৌঁছল 'রামধনু হ্রদ' জেলায়। পরপর দুই বছর অনাবৃষ্টিতে সেখানে ফসল নষ্ট হয়েছে, তার ওপর তীব্র ভূমিকম্পে বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। অঞ্চলের সব থেকে বর্ধিষ্ণু লিন পরিবার তাদের অট্টালিকার একটা অংশ মহিলা আর বাচ্চাদের জন্যে ত্রাণ শিবিরে রূপান্তরিত করেছে। কিন্তু রান্নাবান্না বা আহতদের সেবা করার কেউ নেই।

    প্রথমেই 'সে' অপেক্ষাকৃত সুস্থ যুবতীদের নিয়ে একটা স্বেচ্ছাসেবী দল তৈরি করল। তারপর পুরোদমে কাজ চলতে লাগল। ঘর পরিষ্কার করা, আহতদের চিকিৎসা করা, হ্রদ থেকে জল আনা, রান্না করা – ভোর হতেই কাজ শুরু হয়ে যায় আর মিটতে মিটতে সূর্য ডুবে যায়। দূরদূরান্ত থেকে শরণার্থীরা ছুটে আসে, সবাই 'তার' কাছে আশ্রয় পায়।

    দিনের শেষে 'তার' শরীর ভেঙে আসে। একদিন ক্লান্ত হয়ে 'সে' বারান্দায় বসে পড়ল। দুই হাতে মুখ ঢেকে নিল।

    আমার কর্তব্যের কি কোন শেষ নেই?

    “এই নাও, গরম চা।”

    'সে' মুখ তুলে তাকাল। বছর বাইশের এক যুবক তার সামনে উবু হয়ে বসে আছে, হাতে এক পাত্র ধূমায়িত চা। আধুনিক কায়দায় কাটা চুলের গোছা তার কপালে জড়ো হয়ে আছে, ফর্সা নরম ত্বক, চোখ দুটো নিষ্পাপ সারল্যে ভরা। দেখেই বোঝা যায় কোন বড়লোকের বাড়ির আদরের সন্তান।

    'সে' স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে থাকে।

    “চা খাবে না?” যুবক আবার পাত্রটা বাড়িয়ে ধরল।

    “ধন্যবাদ।” 'সে' দু'হাতে পাত্রটা গ্রহণ করে।

    “আমি রোজ দেখি তুমি উদয়াস্ত কাজ করে চলেছ। তাই আমার মনে হল আজ তোমার জন্য কিছু করি।”

    'সে' চায়ে চুমুক দিল। দামী সুগন্ধি চা।

    “তোমার নাম কী?” যুবকটি সহজভাবে জিজ্ঞাসা করল।

    “শি-” বলতে গিয়েও 'সে' থেমে গেল। না, শিউহুয়া নামটাই অপবিত্র। ওই নামের সঙ্গে কোন সংস্রব আর 'সে' রাখতে চায় না।

    “শি-ন। আমার নাম শিন।”

    “শিন,” যুবক একবার উচ্চারণ করে যেন নামটা মুখস্থ করে নিল। “আমার নাম লিন লিউ।” লিন? 'সে' তাহলে ঠিকই ধরেছে। বড়লোকের বাড়ির আদরের সন্তান।

    লিন লিউ উঠে দাঁড়াল।

    “আচ্ছা, এখন আমাকে যেতে হবে। পরে আবার তোমার সাহায্য করতে আসব। তার মাঝখানে কোন দরকার হলে কাউকে দিয়ে খবর পাঠিও।”

    শিস দিতে দিতে বরফের ওপর একটা ছোটখাটো ঝড় তুলে লিন লিউ উধাও হয়ে গেল। চায়ের পাত্রটা নিয়েও গেল না, শিন ভুরু কুঁচকে ভাবে।

    তারপর ক'দিন লিন লিউয়ের পাত্তা নেই।

    বাঁচা গেল।

    শিন আবার কাজে মন দিল। সেদিনের ঘটনা তার মাথা থেকে বেরিয়েই গেছে। হঠাৎ এক সকালে বারান্দায় বেরিয়ে দেখে লিউ উঠোনে কাঠ কাটছে।

    “তোমাদের রাতে জ্বালানোর কাঠ নেই, শীতে কষ্ট পাচ্ছ সেকথা আমাকে জানাওনি কেন?” শিনকে দেখে লিউ অভিযোগ করে।

    “আমরা নিজেদের কাজ করে নিতে সক্ষম,” শিন রূঢ়ভাবে উত্তর দেয়। “কোন সাহায্য লাগলে তোমাকে জানাব।”

    লিউ সে কথা গায়ে না মেখে কাঠ কাটতে থাকল।

    “তুমি কিন্তু ভেব না আমি বেকার যুবক,” হাসিমুখে শিনকে সে জানাল। “একুশ বছর বয়সে সম্রাটের পরীক্ষায় আমি পাশ করেছি, রাজনীতি যুদ্ধনীতি দুটোতেই ভালো নম্বর পেয়ে। চাইলে আমি রাজধানীতে চাকরি করতে পারতাম। কিন্তু আমি জেলায় ফিরতে চাইলাম। প্রতিভাশালী রাজকর্মচারীরা সবাই যদি রাজধানীতে চলে যায় তাহলে জেলার উন্নতি কী করে হবে?”

    “তাই বুঝি তুমি বাড়ির উঠোনে কাঠ কেটে জেলার উন্নতি করছ?” শিন শ্লেষের সুরে মন্তব্য করল।

    কেটে ফেলা কাঠগুলোকে গোছা বেঁধে সরিয়ে রেখে লিউ নতুন কাঠ নিয়ে এল।

    “অবশ্যই তাই করছি। সম্রাট রাজধানী থেকে সেনা পাঠাচ্ছেন, খাবারদাবার সমেত। তারা না আসা পর্যন্ত জেলার মানুষের ত্রাণের ভার আমার ওপর দেওয়া হয়েছে।”

    “জেলায় অনেক মানুষ অনাহারে, ঠান্ডায় জমে মরে যাচ্ছে। তাদের ত্রাণ করার ব্যবস্থা করো। এখানে তোমার কোন প্রয়োজন নেই।”

    “আশ্চর্য মানুষ তো তুমি,” কুঠার রেখে দিয়ে লিউ শিনের দিকে এগিয়ে এল। “কেউ তোমার উপকার করতে চাইছে, কোথায় তুমি খুশি হবে তা না সমানে গালমন্দ করছ!”

    শিন বাড়ির ভেতরে রওনা দিল।

    “অযাচিত উপকার বিড়ম্বনা ছাড়া আর কিছু নয়।”

    কাজ চলতে থাকে নিজের মতন। শিন সবকিছু ভুলে মানুষের সেবায় মন দিতে চায়। কিন্তু লিউ বার বার তার কাছে চলে আসে, কোন বারণ মানে না।

    “দেখো, তোমার জন্য নরম লেপ এনেছি, আমি শুনলাম তোমার একখানা চাদরও নেই।” শিন এক বুড়িকে লেপটা দান করে দেয়।

    “বাড়িতে বিশাল ভোজ হয়েছে, তাই তোমার জন্য কয়েকটা পদ নিয়ে এলাম।”

    শিন সেসব খাবার বাচ্চাদের দিয়ে স্যুপ আর পাঁউরুটি খেয়ে থাকে।

    পরদিন সকালে সে কথা জানতে পেরে লিউ চোখের তারায় যন্ত্রণা এঁকে শিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

    “কেন তুমি আমাকে এত অবজ্ঞা কর? আমি যা করি কোন কিছুই কি তোমার পছন্দ হয় না? তাহলে দয়া করে বলে দাও তোমার কী চাই। আমি তোমার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলব।”

    “জোর করে কারুর ভালোবাসা পাওয়া যায় না, লিন লিউ,” শিন বিরক্তভাবে উত্তর দিয়েছিল। “তুমি বড়লোক বাড়ির ছেলে, হয়তো ছোটবেলা থেকে যা চেয়েছ তাই তোমাকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জিনিস আর মানুষ এক নয়। এটা তোমার বুঝতে হবে।”

    লিউ আর কথা বাড়ায় না। মাথা নীচু করে চলে যায়।

    “কথাটা ঠিক বল নি, দিদি।”

    শিন ফিরে তাকাল। কখন যেন আই তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই অঞ্চলেরই মেয়ে আই, শিনের হাতে হাতে কাজ করে।

    “কোন কথাটা ঠিক বলিনি?” শিন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল।

    “লিন লিউয়ের জীবনটা ওরকম নয়। জন্মেই মা মারা গেছে, বাবা কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকত। দাদারা রাজধানীতে চলে গেছিল। ও ঝি-চাকরদের কাছেই মানুষ। আমার মা যখন এ বাড়িতে কাজ করত, তখন দেখত লিউ সারাদিন বাগানে একা একা খেলা করছে। একটা কথা বলারও কেউ ছিল না। মা বলত ওর জিনিসের কোন অভাব ছিল না, কিন্তু আদর ভালোবাসা কোনদিন তেমন পায়নি। তাই কারুর কাছে ভালোবাসা চাইতেও ওর সংকোচ হয়। ভয় পায়, যদি ফিরিয়ে দেয়। তোমার কাছেই কেন যেন সাহস করে এসেছিল।”

    কথাগুলো শিনের বর্ম ভেদ করতে পারল কি না আই বুঝল না। শিনের মুখে কোন অভিব্যক্তি ফুটল না।

    সেই রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, আগুনের ধারে কম্বল সেলাই করতে করতে শিনের দু'চোখ হুহু করতে লাগল।

    “পোশাক পালটে তুমি সব ভুলে গেছ চুয়েন, কিন্তু আমি ভুলতে পারব না...আরেক জন্মে আমিই ছিলাম তোমার মৃত্যুর কারণ...”

    প্রথম যেদিন লিউ তার সামনে এসেছিল, হাতে ধূমায়িত চায়ের পাত্র নিয়ে, তখনই সুদূর অতীতের সেই মুণ্ডিতকেশ সন্ন্যাসীকে চিনে নিয়েছিল শিন। তাই তাকে নিজের জীবনের থেকে বহু দূরে সরিয়ে রেখেছিল। শিন জানে না সেই মর্মান্তিক ঘটনার পরেও নিয়তি কেন তাদের দ্বিতীয়বার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কারণ কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই। শি ওয়াংমুর জগতে এমনি এমনি কিছু ঘটে না।

    কিন্তু আমি আর ভুল করব না লিউ... তোমার প্রাণের মূল্য আমার সুখের থেকে অনেক বেশি...

    তারপর কিছুদিন কেটে গেছে। শীত তখন গভীর। সারা রাত হিমেল হাওয়া এসে দরজায় আছড়ে পড়ে, উঠোনে বরফের ঘূর্ণিঝড় ওঠে। এরকমই এক দুর্যোগের রাতে দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল। শিন দরজা খুলে দেখে একটি বছর নয়েকের মেয়ে, সঙ্গে এক মৃতপ্রায় মহিলা।

    “আমরা অনেক দূরের গ্রাম থেকে এসেছি,” মেয়েটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “একটু আশ্রয় দেবেন?”

    শিন আর আই নবাগতদের শুশ্রূষায় লেগে গেল। মেয়েটির কাছে জানা গেল শিনের ত্রাণ শিবিরের কথা জেলার দূরদূরান্ত অবধি ছড়িয়ে পড়েছে।

    “গ্রামে খাবার নেই, আমরা তিন দিন ধরে না খেয়ে আছি,” গরম স্যুপে চুমুক দিতে দিতে মেয়েটি জানাল। “তার ওপর মায়ের ধুম জ্বর। সবাই বলেছিল আমাকে মন্দিরে বসে প্রার্থনা করতে, কিন্তু আমি শুনিনি। রুগীর ওষুধ লাগে, খাবার লাগে। শুধু প্রার্থনায় কি রোগ সারে? তাই ঠিক করলাম, যে করে হোক মাকে এখানে নিয়ে আসতেই হবে।”

    শিন মেয়েটির গালে গাত বুলিয়ে বলল, “একদম ঠিক করেছ।”

    “এদের শুতে দেব কোথায়?” আই শিনের কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল।

    শিন এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল। তারপর ক্লান্তভাবে বলল,

    “লিন লিউকে খবর দাও। বোলো, আমি ডেকেছি।”

    একটু পরেই উঠোনে লিউয়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। শিন বারান্দায় বেরিয়ে দেখে বাড়ির হাল্কা পোশাক আর চটি পরেই লিউ এই বরফের মধ্যে হেঁটে এসেছে।

    “তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? এইভাবে কেন বরফের মধ্যে চলে এলে?”

    শিন ছুটে গিয়ে তার গায়ের চাদরটা লিউয়ের কাঁধে জড়িয়ে দিল।

    লিউ শিনের দিকে তাকিয়ে হাসল। তিক্তমধুর।

    “জান না কেন এসেছি?”

    শিনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।

    “দূরের গ্রাম থেকে দু'জন শরণার্থী এসেছে। দয়া করে তাদের থাকার একটা ব্যবস্থা করলে খুব উপকৃত হব।”

    “নিশ্চয়ই। আমি এখনই কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

    “না,” শিন কী যেন ভেবে মত পালটায়। “ওরা আপাতত আমার কাছেই থাক। অপেক্ষাকৃত সুস্থ যারা তাদের মধ্যে দু'জনকে নিয়ে যেয়ো।”

    লিউ হেসে ফেলে।

    “জগতের সবার জন্য তোমার মনে এত করুণা, শুধু আমার প্রতি তুমি এত কেন নিষ্ঠুর, শিন? আমার সঙ্গে জীবন কাটানো কি তোমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব?”

    নিজের অজান্তেই লিউ শিনের কাছাকাছি চলে এসেছে। শিন তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল।

    “তুমি কিছু জান না লিউ,” দাঁতে দাঁত চেপে বলল শিন। “অতীতের ঘটনা...তোমার অতীত, আমার অতীত, কিছুই জান না। আমি তোমার জীবনে অভিশাপ ছাড়া কিছু নই।”

    “অভিশাপ?” লিউ অবাক হয়ে শিনের দিকে তাকাল। “কী বলছ তুমি?”

    শিন ক্লান্ত পায়ে রওনা দিল। কিন্তু লিউ ছুটে এসে তার হাত চেপে ধরল। নিজের উষ্ণ হাতের বলয়ে শিনের জমে যাওয়া হাত দুটো ঢেকে দিল।

    “অভিশাপ, দুর্ভাগ্য — এসবে আমি বিশ্বাস করি না, শিন। আমি জানি, তুমি যদি আমার সঙ্গে থাক আমি যেকোন বিপর্যয়ের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারব।”

    শিন লিউয়ের মুখের দিকে তাকাল। লন্ঠনের আলোয় অসীম যন্ত্রণা ভরা সেই দৃষ্টি দেখে লিউ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।

    “আমাকে আর কষ্ট দিও না, লিউ,” কান্নায় অবরুদ্ধ কন্ঠে শিন বলে উঠল। “শুধু শুনে রাখো, কোথাও থেমে বিশ্রাম করার অবকাশ আমার নেই। এখানের কাজ শেষ করে আমাকে অন্যত্র চলে যেতে হবে। এটাই আমার প্রায়শ্চিত্ত। তোমার আর আমার জীবন দুটো সমান্তরাল রেখার মতো। কোন দিন তারা এক কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিশবে না।”

    লিউ বেত্রাহতর মতো নিজের হাত সরিয়ে নিল।

    “আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি, শিন! তুমি যদি না চাও আমি আর কখনও তোমাকে বিরক্ত করব না। এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে চাইলে বাধাও দেব না।”

    একটু থেমে আবার কি খেয়ালে বলে উঠল,

    “কিন্তু যতদিন তুমি এখানে আছ, প্রতি রাতে একবার আমি উঠোনের উতং গাছটার নীচে এসে দাঁড়াব। তার সীমানার বাইরে এই বাড়ির দিকে এক পাও এগোব না। তুমি কথা দাও, তখন একটিবার বারান্দায় আসবে। আমি তোমাকে দূর থেকে দেখেই চলে যাব।”

    শিনের চোখ বেয়ে দু'ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। প্রজাপতির ডানার চেয়েও ক্ষীণ গলায় বলল, “বেশ, কথা দিলাম। কিন্তু তোমাকেও প্রতিদানে একটা কথা দিতে হবে।”

    লিউ মাথা নীচু করল। একবার কপালের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলের গোছাগুলো কেঁপে উঠল।

    “কী চাও তুমি?”

    “কথা দাও তুমি বিয়ে করবে। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুখে থাকবে। অযথা আমার জন্যে অপেক্ষা করবে না।”

    লিউ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর কলের পুতুলের মতো বলে উঠল, “কথা দিলাম।”

    লিউ চলে গেলে বরফে ঢাকা বারান্দায় শিন বসে পড়ল। আর কোন উষ্ণতা নেই, শুধু হিম ঠান্ডা বরফের কুচি হাওয়ায় পাক খাচ্ছে, শিনের সর্বাঙ্গে এসে জড়িয়ে যাচ্ছে। লিউ যে পথে চলে গেছে সেদিকে তাকিয়ে শিনের ঠান্ডায় নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁট কেঁপে উঠল।

    “তুমি জান না লিউ, তোমার কাছে ক্ষণিকের বিশ্রাম পেলে আমার চলার পথটা কতখানি সহজ হয়ে যেত। বসন্তের রোদের মতো উষ্ণ, গোধূলির মতো সুন্দর তোমার সান্নিধ্য আমাকে অনন্তকাল অবধি চলার রসদ দিতে পারত...”

    সেই থেকে লিউ রোজ রাতে এসে উতং গাছের নীচে দাঁড়ায়, কিন্তু বাড়ির ভেতর আসে না। কথামতো শিনও রোজ বারান্দায় আসে। নিঃশব্দে লিউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। শীত পেরিয়ে বসন্ত আসে, তারপর গ্রীষ্ম। লিউ তার আরহুটা নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। উতং গাছের নীচে বসে বাজায়। শিন চুপ করে শোনে। সে সব রাতের সাক্ষী থেকে যায় আকাশের চাঁদ, আর দু'জনের অসংখ্য দীর্ঘশ্বাস।

    মাস চলে যায়, কিন্তু প্রধান অট্টালিকায় আর বিয়ের বাজনা বাজে না।

    সেদিন ছিল শরতের এক পূর্ণিমার রাত। নিয়ম মতো লিউ এসে গাছের তলায় দাঁড়াল। কিন্তু শিন আর নিজেকে দূরে রাখল না। বারান্দার সীমানা ছাড়িয়ে লিউয়ের একদম কাছাকাছি চলে এল।

    “তুমি তোমার কথা রাখ নি,” লিউয়ের কাছ শিন অভিযোগ করল। “প্রায় এক বছর হতে চলল এখনো বিয়ে কর নি।”

    লিউ মিষ্টি হাসল।

    “বিয়ে করে বউকে কী দেব? এই ভাঙা হৃদয়, আর কয়েকটা ছেঁড়া, রঙ উঠে যাওয়া স্বপ্ন? এর জন্য একজন মেয়ে তার বাপের বাড়ি ছেড়ে আমার সঙ্গে থাকতে আসবে?”

    শিন অসহিষ্ণুভাবে মাথা নাড়ল।

    “তুমি বুঝতে পারছ না-”

    “বুঝেছি,” লিউ শিনের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা না করেই বলে উঠল। “কিন্তু তুমি বুঝতে পারছ না। মানুষ অমর নয়। আমাদের সীমিত জীবনের প্রতিটা দিনই মূল্যবান। তুমি ভবিষ্যতের কোন বিপর্যয়ের ভয়ে আমাদের বর্তমানের দিনগুলো নষ্ট করে দিচ্ছ। ভবিষ্যতে যদি বিপর্যয় আসেও, যদি মৃত্যুও আসে, তার আগে আমরা জীবনটাকে তো পরিপূর্ণ ভাবে বেঁচে নিই। তুমি নিজেকে এভাবে সরিয়ে রেখে আমাদের জীবনটাকেই নিরর্থক করে দিচ্ছ।”

    লিউ শিনের সামনে নতজানু হয়ে বসে পড়ে। যেন প্রার্থনা করছে। ধীরে ধীরে বসে পড়ে শিনও। তারপর দুই হাত দিয়ে লিউকে নিজের কাছে টেনে নেয়।

    এক মুহূর্তের জন্য লিউ বিস্ময়ে থমকে যায়। তারপর সেও শিনকে তার দু'হাতের বেষ্টনীতে টেনে নেয়।

    পশ্চিমের আকাশের দিকে তাকিয়ে শিন তার নিঃশব্দ প্রার্থনা হাওয়ায় ছড়িয়ে দেয়।

    “শি ওয়াংমু, হে পশ্চিমের দেবী, আমি জানি কর্তব্য থেকে মুখ ফেরানোর জন্য আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। তবু আমাকে একটুখানি সময় দাও। এখনি সব শেষ করে দিও না...”

    লিউ আর শিনের বিয়েতে খুব ধুমধাম হয়েছিল। বিয়ের ভোজ চলেছিল তিন দিন ধরে। নাচ গান, আতসবাজি, কবিতার আসর, কী না হয়েছিল। কর্মচারীরা সবাই সোনার মোহর উপহার পেয়েছিল, অঞ্চলের সকলেও কিছু না কিছু উপহার পেয়েছিল।

    কিন্তু বছর ঘুরলেও সবার প্রত্যাশা ব্যর্থ করে দিয়ে, নবজাতকের আগমন ঘটল না। শিন বুঝল, শি ওয়াংমু তাকে মানুষের শরীর দিলেও, সন্তান ধারণের ক্ষমতা দেয় নি। লিউয়ের অবশ্য তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।

    “অঞ্চলের সব অনাথ শিশুই আমাদের সন্তান,” হাসিমুখে জানাল সে। “তাদের দেখভাল করেই আমাদের জীবন কেটে যাবে।”

    চোখের পলকে তিনটে বছর কেটে গেল। শিন বুঝল তার সময় এসে গেছে। কোন রোগ নেই, খাওয়দাওয়াও ঠিক মতো করে, তবু দিন দিন তার শরীর ক্ষয়ে যেতে লাগল। শেষে আর বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতাও রইল না।

    লিউ দিবারাত্রি জেগে প্রাণপণে সেবা করতে লাগল, কিন্তু শিন জানে সবই বেকার। তারপর যেদিন তার চোখের আলো মিলিয়ে যেতে থাকল, নিজের ঠান্ডা আঙুলগুলো লিউয়ের আঙুলে জড়িয়ে সে শেষবারের মতো ভাবল,

    আহা, যদি আর একটিবার লিউয়ের হাসিমুখটা দেখতে পেতাম...আর একটিবার যদি বসন্তের রোদের মতো উষ্ণ ওই গলার স্বর শুনতে পেতাম...

    ............................................

    পরম মমতাভরে লান-ইং সন্ন্যাসীর দিকে তাকিয়ে থাকে। ফর্সা চামড়া এখন রোদে-জলে তামাটে হয়ে গেছে, জামাকাপড় শতচ্ছিন্ন, মুখে কষ্ট আর দারিদ্র্যের ছাপ...কিন্তু চোখের দৃষ্টি সেই একইরকম...সরল, নিষ্পাপ।

    সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে সন্ন্যাসী চোখ তুলে তাকাল। মুহ



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments